কাঁটায় লেখা ভাগ্য পর্ব -০৮

#কাঁটায়_লেখা_ভাগ্য
পর্ব—০৮
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকদীর ভাই একটা অবাক কান্ড করে বসে।নকল মান্নাতকে একটা চড় মেরে বিছানার ওপরেই তাকে চেপে ধরলো।তাকদীর ভাইয়া তার বুকের ওপরে উঠে যায়,এরপর গলাটা টিপে ধরে বলতে থাকে ‌…

—আমি ভালো করেই বুঝে গিয়েছি তুই মান্নাত হতে পারিস না।মান্নাত এতোটা নির্লজ্জ কোনোদিন ছিলো না যে একটা পরপুরুষের কাছে নিজেকে স্বেচ্ছায় বিকিয়ে দেবে!
বল মান্নাতকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তুই… আজ শেষ করে ফেলবো তোকে আমি।

—আমায় মেরো না,আমি বলছি।দয়া করে ছেড়ে দাও আমায়…
আমি বলছি মান্নাত কোথায় আছে!

—আমি জানি ও হয়তো এই ঘরের ভেতরেই আছে।আগে তোকে শায়েস্তা করি,এরপর মান্নাতকে খুঁজে বের করছি।

তাকদীর ভাইজান একটা কাচের ছোটো শিশি এনে বিছানার ওপরে রাখলো…এরপর মেয়েটার দিকে ইশারা করতেই সে ধীরে ধীরে অতিক্ষুদ্র আকার ধারণ করে।তারপর তাকে শিশিটার ভেতরে ভরে তার ওপরে শক্ত করে ছিপি লাগিয়ে দিলো তাকদীর ভাইজান….

আমি দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে থাকি।মেয়েটা শিশির ভেতরে প্রবেশ করে মোমবাতির আলোর ছ্বটার মতো জ্বলজ্বল করতে লাগলো।এই আলোই তার উপস্থিতির জানান দিচ্ছে।

এরপর তাকদির ভাইজান আমাকে খুঁজতে শুরু করে।আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি কিন্তু সে আমায় দেখতে পেলো না।তাকদীর ভাইজান আমায় সাধারণভাবে খুঁজে না পেয়ে একপর্যায়ে নিজের শক্তির প্রয়োগ করতে লাগলো।হাত দিয়ে ইশারা করতেই পুরো ঘরের সমস্তকিছু অসংখ্য টুকরোয় বিভক্ত হয়ে যেতে লাগলো।আর সেই টুকরোর ভেতর থেকে আমার আঁটকে থাকা নিথর দেহ বেরিয়ে আসে।মেঝের ওপরে পড়ে গেলাম আমি,অমনি পুরো ঘর আবারও তার পূর্বের রুপে ফিরে আসে।তাকদীর ভাইজান এগিয়ে আসলো আমার দিকে,এরপর আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে।

—মান্নাত কি হয়েছে তোমার?তুমি ঠিক আছো তো?

আমি কথা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু মুখ থেকে শব্দ উচ্চারণে ব্যর্থ হই।তাকদীর ভাইজান আমায় কোলে করে তুলে নিয়ে বিছানার ওপরে শুইয়ে দিলো।

—মান্নাত কথা বলো,এভাবে চুপ করে থেকো না।দেখো আমি চাইলে মূহুর্তেই তোমায় সারিয়ে ফেলতে পারি,কিন্তু আমি চাই না সবক্ষেত্রে এই শক্তির প্রয়োগ করতে।কারণ পরবর্তীতে এর প্রভাব খুব একটা ভালো হয় না।তুমি চেষ্টা করো তাহলেই কথা বলতে পারবে,আমি জানি কথা বলতে পারবে তুমি।

দীর্ঘক্ষণ প্রচেষ্টার পরে আমার কন্ঠনালীর জট খুললো…তাকদীর ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করে উঠে বসলাম আমি।আমায় সুস্থ হতে দেখে তাকদীর ভাই খুব খুশি হয়।

—আমি জানতাম তুমি ঠিক নিজের চেষ্টায় কথা বলতে পারবে!এবার আমি তোমাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে পারবো,আর কোনো বাঁধা নেই।

—কোথায় নিয়ে যাওয়ার বলছেন আপনি আমায়,আমি তো বুঝতে পারছি না কিছুই।

—এখন তোমায় কিছুই বলা যাবে না,তুমি গেলেই বুঝতে পারবে।

—আপনি আগে নিজের পরিচয় দিন,নয়তো আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।বলুন ঐ আগুনের ভেতর থেকে কিকরে বেরিয়ে আসলেন আপনি?এই কাজ তো কোনো সাধারন মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

—তুমি কি বলতে চাইছো আমি অসাধারণ কেউ?

—এতো কিছু জানি না,আমি আপনার আসল পরিচয় না জানা পর্যন্ত কোথাও যাবো না…

—তুমি না যেতে চাইলে আমি জোর করবো তোমায়,এই জায়গাটা একদম নিরাপদ নয় তোমার জন্য।কেনো বুঝতে পারছো না।
আর শোনো,এই শিশিটা নিজের কাছে রেখো।ভুলেও শিশির মুখ খুলবে না।

—আমি জানি আপনি এই শিশিটার ভেতরে আমার মতো দেখতে ঐ মেয়েটাকে আটকে রেখেছেন!

—তুমি কোথা থেকে দেখলে এসব?

—আমি দেওয়ালের ভেতর থেকে সব দেখতে পেয়েছি!

—ও কিন্তু ভয়ংকর।একবার এই শিশি থেকে ছাড়া পেলে আরোও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।

—বুঝতে পেরেছি!আপনি নিশ্চিন্তে একে আমার জিম্মায় রেখে দিতে পারেন।

এরপর তাকদীর ভাইজান শিশিটা আমার হাতে দিলো।আমি শিশিটাকে একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখি।

আম্মাকে দেখতে পাচ্ছি না দীর্ঘক্ষণ হয়ে গিয়েছে।আমার বেঁচে থাকার খবরে আম্মা নিশ্চয়ই শোকপালন করছে।সে ভাবতেই পারেনি তাকদীর ভাইজান তার পরিকল্পনা এভাবে বিফল করে দেবে।বাড়ির বাইরে বের হতেই আম্মার সাথে দেখা হয় আমার।আম্মা আমায় দেখে বলতে লাগলো।

—একদম ঠিক করছিস না তুই,তাকদীরকে বিশ্বাস করে।ও সবথেকে বড়ো ধোঁকাবাজ।যখন বুঝতে পারবি তখন অনুশোচনা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

—তুমি একদম চুপ থাকো আম্মা।তাকদীর ভাইজান কেমন মানুষ আমি ভালো করেই জানি।

আম্মা আমার কথা শুনে হাসতে লাগলো।

—মানুষ…কে মানুষ?তাকদীরকে তোর এখনও মানুষ মনে হয়?

—যাই হোক না কেনো।উনি কখনোই আমার খারাপ চাইতে পারে না,তুমি মিথ্যে বলে বিভ্রান্ত করতে চাইছো আমায়।আমি তোমার শয়তানি হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি…..
আর আমি এটাও বুঝে গিয়েছি তুমি আর যেই হও আমার মা কিছুতেই হতে পারো না।তুমি আমার মা হতে পারো না,তুমি একটা ডাইনি…

—এতোদিনে নিজের মাকে চিনলি তাহলে,তোর তো বুদ্ধি খুলে গেলো মান্নাত!

এরপর আর আম্মার সাথে দেখা হয়নি আমার।পরেরদিন সকালবেলা….

তাকদীর ভাইজান আমার ঘরে আসলো।এরপর আমাকে এই বাড়ি ত্যাগ করার কথা বলে।

—আর কয়েকটা দিন পরে গেলে হয় না তাকদীর ভাইজান?

—না মান্নাত আমাদের যেতেই হবে।এই জায়গাটা তোমার জন্য একদম নিরাপদ নয়।তোমার জীবনের জিম্মেদিরী নিয়েছি আমি,কীকরে তোমায় বিপদের মুখে ফেলে রাখি।

—আমি আপনার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না…

—আগে চলো আমার সাথে,সময় হলে সব বুঝতে পারবে।শুধু তাই নয় দেখতেও পাবে।

আমি সেদিনই তাকদীর ভাইয়ের হাত ধরে নিজের বাড়ি থেকে বেরিযে পড়ি।এই বাড়িতে ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছি আমি।নিজের স্মৃতিবিজড়িত স্থান থেকে চলে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু যখনই আমার এই গল্পের সকল
পর্ব সবার আগে পড়তে ভিজিট করুন
প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ পেজ বিশ্বাঘাতক মা
আর এই নিষ্ঠুর গ্রামবাসীর কথা মনে পড়ে
তখন কেমন ঘৃণা আর অভিমানই নির্গত হয় হৃদয় থেকে।তাকদীর ভাইজানের হাত ধরে আমি গ্রামের সীমানা পেরোই এরপর অন্য প্রান্তে নিজেদের পদচিহ্ন আঁকি।প্রায় সন্ধ্যাবেলা তাকগীর ভাই আমায় নিয়ে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছায়।

—এই যে দেখো আমরা পৌঁছে গিয়েছি মান্নাত।এবার আমি আমার দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলাম আর তোমার জীবনেও তোমার আম্মার কোনো নিয়ন্ত্রণ রইলো না।

তাকদীর ভাই আমায় নিয়ে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে এটা যেনো কোনো জ্বিন পরীর আড্ডাখানা।চারদিকে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস আর ছবি আঁকা।

—তাকদীর ভাইজান আমরা কার কাছে যাচ্ছি?

—যার কাছে গেলে আর তোমার কোনো দুঃখ কষ্ট থাকবে না তার কাছেই যাচ্ছি।তোমায় তার কাছে ফিরিয়ে দেবার পরে আমার সমস্ত দ্বায়িত্ব কর্তব্য পুরণ হবে।

—আপনি কি তারপর চলে যাবেন এখান থেকে?

—আমাকে তো যেতেই হবে মান্নাত…
আমার যে আর কোনো কাজ নেই এখানে

—না আমি একা একা কিছুতেই থাকবো না এখানে!আপনাকেও আমার সাথে থাকতে হবে।

—তবে কি তুমি আবার নিজের মায়ের কাছে ফিরে যাবে?ঐ জায়গায় তোমার থাকা মানে মৃত্যুর সাথে বাস করা।আমি যে জাহান্নাম থেকে বের করে এনেছি তোমায় সেখানে আর যেতে দিবো না।

—আমি কখন বললাম যে আমি আমার গ্রামে ফিরে যেতে চাই!

—তাহলে?

—আমি আপনার সাথে যাবো,আপনি যেখানে থাকেন আমায় সেখানে নিয়ে যাবেন?

—আমি যেখানে থাকি সেখানে সাধারণ মানুষ যেতে পারে না।শুধু সাধারণ মানুষ কেনো কেনো মানুষই যেতে পারে না।
তোমার আর আমার পথ চলা এখানেই শেষ।আমি আমার দ্বায়িত্ব যথাযথভাবে পূর্ণ করতে পেরেছি এটাই আমার জন্য বড়ো প্রশান্তির।

এরপর তাকদীর ভাইজান আমায় একটা ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলো।সে স্পর্শ করতেই দরজাটা খুলে গেলো।এরপর যা ঘটে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি নি।

তাকদীর ভাইজান আমায় একটা ধাক্কা মেরে ঘরের ভেতরে ফেলে দিলো।আমি দেখতে পাই কেউ একজন বসে আছে আমার সামনে।তাকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমি।তাকদীর ভাইজান তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো।

—জনাব আপনার জিনিস আপনার কাছে সমর্পণ করলাম!এবার আপনি এর ব্যবস্থা করুন আর আমায় আমার দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি দিন।

লোকটা তাকদীর ভাইজানকে বলতে থাকে।

—আরে বাহহহ!
এতোদিন আমার মনের মতো কাজ করেছিস তুই,তোকে আমার তরফ থেকে কি উপহার দেবো বুঝতে পারছি না আমি।

এই বলে দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠলো।আম্মার বলা শেষ কথাটা মনে পড়ে গেলো আমার।তাকগীর ভাইজানের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে সেই কথাটাই ভাবছি।

—তাকদীর সবথেকে বড়ো ধোঁকাবাজ!

এখন বুঝতে পারছি আম্মা কেনো কথাটা বলেছিলো আমায়….

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here