কাঁটায় লেখা ভাগ্য পর্ব -০৬

#কাঁটায়_লেখা_ভাগ্য
পর্ব—০৬
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

এই বলে মান্নাত আমায় গাছের আড়াল থেকে ঠেলে উঠানোর দিকে ফেলে দিলো।গাছের পেছনে থাকাতে গ্রামবাসীরা ওকে দেখতে না পেলেও আমায় পেয়েছে।অমনি হায়নার মতো দল বেঁধে ছুটে আসে আমার দিকে।আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি মান্নাত আড়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে!

—হায় আল্লাহ,এ কোন পরীক্ষার মুখে ফেললে আমায় তুমি।আমি নিজেই কিনা এখন নিজের শত্রু?!

—ঐ তোরা সবাই এদিকে আয়,পাইছি মান্নাতরে।চল ওরে ওর স্বামীর সাথে কবর দিয়া দেই…
গ্রামবাসীরা আমায় উদ্দেশ্যে করে বলতে লাগলো।ঠিক তখন তাকদীর ভাই তাদের সামনে এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

—মান্নাতের হাত ছাড়ো,কইতাছি।একদম ভালো হচ্ছে না কিন্তু…

—কি করবি তুই…না ছাড়লে তুই কি করবি?আইজ তোর ফাতড়ামি ছুটাইতেছি আমরা।ঐ কে কোথায় আছিস এই ব্যাটারে গাছের সাথে বাঁধ।

কেউ একজন আমার হাত ধরে ছিলো,তাকদীর ভাই তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো।এরপর আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো।আমি তাকদীর ভাইকে বলতে লাগলাম।

—ভাইজান তুমি চলে যাও এখান থেকে…দয়া করে চলে যাও।ওরা আমারে তো আজ মারবোই,সাথে কিন্তু তুমিও মরবা!

—তুমি চিন্তা করো না,ওরা কেউ কিছু করতে পারবে না আমার।আচ্ছা মান্নাত তুমি তো পালাই গেছিলা তাহলে আবার ফিরে আসলা কেনো?

—আমি নিজের ইচ্ছেতে ফিরে আসিনি,কেউ একটা ছল করে আমায় এখানে নিয়ে এনেছে..

—কার কথা বলছো তুমি,কে ছল করে নিয়ে আসছে এখানে তোমায়।তুমি তার কথা শুনতে গেলে কেনো?

—না শুনে উপায় ছিলো না তাকদীর ভাইজান।সে আমারে খুব বাজেভাবে ফাঁসাই দিয়েছে।

—আচ্ছা সে কি নিজের কোনো পরিচয় দিয়েছে…?

—হুমমম।সে কইলো তার নাম নাকি মান্নাত!আর শেষে দেখি তারে দেখতেও হুবহু আমার মতো।বিশ্বাস করো তারে দেখে আমার মাথা কাজ করতেছিলো না।এখন বুঝতে পারছি সে আমায় বিপদে ফেলার জন্য এসব ইচ্ছে করে করছে।

—ও আচ্ছা!এইবার বুঝতে পারছি!আজ আমার হাত থেকে নিস্তার নেই ওর।

—তুমি কার কথা কইতেছো তাকদীর ভাই?

—তার কথা কইতেছে যার ষড়যন্ত্রে আজ তোমার এই দশা,যে তোমায় মিথ্যে বলে নিয়ে আসছে এখানে।

—তুমি সত্যিই চিনো তারে?

—আমি চিনবো না তো কে চিনবে?আজ এই গ্রামবাসীরদের থেকে তোমায় উদ্ধার করি তারপরে দেখতেছি তারে।

তাকদীর ভাইয়ের কথার কোনো অর্থই বুঝতে পারলাম না আমি।কে এসেছিলো আমার কাছে উনি জানলেন কিকরে,আর উনি তারে কিভাবে দেখে নিবেন।হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ পেছন থেকে তাকদীর ভাইয়ের মাথায় একটা শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করলো।অমনি সে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।আমি চিৎকার করে ছুটে গেলাম তার দিকে।

—তাকদীর ভাই,কি হইলো তোমার?তাকদীর ভাই ওঠো।

আমার কথার কোনো সাড়াশব্দ দিলো না সে!পেছন থেকে আম্মা আমার চুলের মুঠি চেপে ধরলো।তারপর টানতে টানতে কবরের কাছে নিয়ে যায়।পাশেই আসিফ শেখের লাশ পড়ে আছে।আম্মা গ্রামবাসীরদের উদ্দেশ্যে করে বলতে লাগলো।

—-যদি মরবার না চাও,এক মূহুর্ত দেরী করো না কেউ।এখুনি কাজ সাইরা ফালাও…

—হ ঠিক কইছো মান্নাতের মা।এই সুযোগ আর পাওয়া যাইবো না।

এরপর সবাই আমায় ধরে বেঁধে ফেললো।আমি নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি,কিন্তু তাদের শক্তির কাছে পরাজিত হলাম।গ্রামবাসীরা আমায় পুরোপুরি বেঁধে ফেলতে সক্ষম হলো।নিজের আসন্ন মৃত্যু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কিছুই করার নেই আমার।হঠাৎ আমার চোখজোড়া কবরের পাশে থাকা আমগাছের ডালের ওপরে গেলো।
আমার মতো দেখতে সেই মেয়েটা গাছের ডালে বসে খিলখিল করে হাসছে।আর আমাকে বলতে লাগলো।

—কি ভেবেছিলি।তোর তাকদীর এসে বাঁচাবে তোরে…?সেই আশা আর কোনোদিন পূরণ হবার নয়।তবে চিন্তা করিস না।তাকদীর মরবে না।ওরে মারা শুধু গ্রামবাসী কেনো এখানের কারোর পক্ষেই সম্ভব না।তুই এবার নিশ্চিন্তে স্বামীর সাথে তার কবরে যা।কারণ তোর জায়গা তো এটাই।আল্লাহ ঐটাই ঠিক করে রাখছে তোর জন্য।

খেয়াল করলাম মেয়েটার কথা শুধু আমি শুনতে পারছি,আর কেউ শুনতে পারছে না।কেউ গাছের ওপরে লক্ষ্যও করছে না।আমি নিজের চোখদুটো আবারও নিচে নামিয়ে নিয়ে আসলাম।

আসিফ শেখের লাশ কবরে নামানো হলো।এরপর আমার পালা।আমাকে ধরেবেঁধে সবাই কবরে নামাতে লাগালো।পেছনে দাঁড়িয়ে আম্মা মায়াকান্না করছে।

—ও আল্লাহ এই ছিলো আমার কপালে।শেষে কিনা নিজের মাইয়াডারে কবরে পাঠাইতে হইতেছে।তুমি আর কী কী পরীক্ষা নিবা আমার।এইবার আমারে তুইল্লা নাও।

আমায় নিজের মৃত্যুর থেকেও আম্মার এই মায়াকান্না সবথেকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে।আফসোস তার আসল সত্যিটা না জেনেই মরতে হচ্ছে,এদিকে তাকদীর ভাইয়ের কি অবস্থা জানি না আমি।উনি কি এখনো বেঁচে আছেন,আল্লাহ ভালো জানেন।

আমায় একটা ধাক্কা মেরে কবরের ভেতরে ঢেলে দেওয়া হলো।ঠিক তখন কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে তাকদীর ভাই উপস্থিত হয়।সে আবারও গ্রামবাসীকে বাঁধা দিলো।

—আমার জান থাকতে এই পাপ করতে দেবো না আমি তোমাদের।সবাই যদি নিজেদের ভালো চাও চলে যাও এখান থেকে।

—অনেক হইছে।এই ছোকড়া কথা শোনার পাত্র না।ওর মরণ আর কেউ আটকাইতে পারবে না আইজ।

—আচ্ছা তাইলে একটা কাজ করি ওরেও একই করবে মাটি চাপা দিয়ে দেই?

—না,আসিফ শেখ হয়তো মানবো না সেইটা।ওর জন্য অন্য ব‌্যবস্থা আছে তো?

—কি ব্যবস্থা…

—একটা গাছের সাথে শক্ত করে বাঁধ ওরে।এরপর কইতাছি।

গ্রামবাসীরা সবাই মিলে তাকদীর ভাইরে আমগাটছার সাথে বেঁধে ফেললো।আমি কবরের ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে সমস্ত দৃশ্য দেখতে লাগলাম।ওরা আমার মুখ বেঁধে দেওয়াতে আমি কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছি না।

এরপর একজন একটা আগুনের মশাল ধরিয়ে নিয়ে আসলো।আগুন থেকে তাকদীর ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটলো।উনি যেনো এটাই
চেয়েছিলেন।ওনার এই আচরণে অবাক না হয়ে পারলাম না আমি।তাকদীর ভাইয়ের মুখে মৃত্যুর ভয় লেশমাত্র নেই।গাছের ওপর থেকে দেখছি সেই মেয়েটা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছে।

—না এই ভুল করো না তোমরা কেউ।ওর গায়ে আগুন দিও না।আরে মূর্খের দল তোরা আমার কথা শোন যারে মারা প্রয়োজন তারে আগে মার।আমার কথা কি কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

মেয়েটার কথা কেউ শুনতে পাচ্ছেন না।সবাই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।একজন এসে মশালটা ছুড়ে মারলো তাকদীর ভাইয়ের দিকে।অমনি দাউ দাউ করে করে আগুন জ্বলে উঠলো চারদিকে।গ্রামবাসীরা হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেইদিকে….

মেয়েটা ‌গাছের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলতে থাকে।

—মূর্খ মানুষের দল।যে আগুনের সৃষ্টি তাকে আগুন দিয়েই মারতে চাইছিস…দেখ এবার কি হয় তোদের সাথে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here