কাঁটায় লেখা ভাগ্য পর্ব -০৭

#কাঁটায়_লেখা_ভাগ্য
পর্ব—০৭
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

মেয়েটার কথা কেউ শুনতে পাচ্ছেন না।সবাই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।একজন এসে মশালটা ছুড়ে মারলো তাকদীর ভাইয়ের দিকে।অমনি দাউ দাউ করে করে আগুন জ্বলে উঠলো চারদিকে।গ্রামবাসীরা হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেইদিকে….

মেয়েটা ‌গাছের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলতে থাকে।

—মূর্খ মানুষের দল।যে আগুনের সৃষ্টি তাকে আগুন দিয়েই মারতে চাইছিস…দেখ এবার কি হয় তোদের সাথে!

তাকদীর ভাইজান আগুনের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে।আগুনের কোনো প্রভাবই পড়ছে না তার ওপরে।এই দৃশ্য দেখে গ্রামবাসীরা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো।কিছু সময়ের ভেতরে আমাদের বাড়ি লোকশুন্য হয়ে পড়ে।তাকদীর ভাইজান আগুনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলেন।এরপর হাত ধরে আমায় কবর থেকে ওপরে তুলে নিয়ে আসেন।এরপর আমার শরীরের সমস্ত বাঁধন খুলে দেন।

—আর কোনো ভয় নেই।এবার আর কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

—আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না তাকদীর ভাইজান,কি হইতেছে এগুলো?আপনি আগুনের ভেতর থেকে এইভাবে বেরিয়ে আসলেন কিকরে?

—ওরা যা করেছে আমার ভালোর জন্যই করেছে।এতোদিন আমি শক্তিহীন ছিলাম।মানুষের হাতের আগুনের ছোঁয়া পেয়ে আমি আবারও আমার নিজের সমস্ত শক্তি ফিরে পেলাম।এবার কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের।

—আমি সত্যিই কিছুই বুঝতে পারতেছি না,আপনার এই কথার অর্থ কি?

—এখন কিছু বুঝতে হবে না,তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে তাই তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।

এরপর তাকদীর ভাই আমায় কোলে তুলে নিলেন।ধীরে ধীরে আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।আমায় আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানার ওপরে শুইয়ে দেন।আমি তাকদীর ভাইকে বলতে লাগলাম।

—ভাইজান আমার খুব ভয় করতেছে,ওরা যদি আবারও ফিরে আসে।

—কাদের কথা বলতেছো তুমি?

–কাদের কথা বলবো আর গ্রামবাসীদের কথা বলছি।

—তুমি আর ওদের ভয় পেয়ো না,আমি থাকতে কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তোমার!

এই বলে তাকদীর ভাই আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন,আমি তার হাতটা টেনে ধরলাম।

—কোথায় যাচ্ছেন?

—আসিফ শেখের লাশ দাফন করতে হবে না?ওনার রুহু যে আজাব পাইতেছে!তুমি বিশ্রাম নাও,আমি আইতেছি।

তাকদীর ভাই কবরস্থানের কাছে গেলেন।আমি জানলা দিকে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম।তাকদীর ভাই কোদালটা হাতে নিয়ে কবরের কিছুটা মাটি ফেললেন।এরপর হাত দিয়ে ইশারা করতেই চারপাশের মাটি জড়ো হয়ে কবরের ওপরে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।তাকদীর ভাই একা দাঁড়িয়ে জানাজার সূরাহ পড়তে লাগলেন।ওনার সূরা পাঠের শব্দ আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছলো।

—-আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদি ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহিমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহিমা ইন্নাকা হামিদুম্মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা ………

আমার চোখের সামনেই এভাবে আমার স্বামীর দাফন কার্য সমাপ্ত হলো।আসিফ শেখ মারা যাবার সাথে সাথে তার সাথে আমার সমস্ত সম্পর্ক ঘুচে গেলো।
আমি এখন আর তার স্ত্রী নই,না সে আমার স্বামী।তবে লোকটা আমার জন্য যে ত্যাগ করেছে আমি চাইলে সারাজীবনেও তা ভুলতে পারবো না!

কিছুক্ষণ পরে আমার ঘরে কড়া নাড়ার শব্দ ভেসে আসে।আমি গিয়ে দরজাটা খুললাম।অমনি চমকে উঠলাম আমি।

—একি তুমি?তুমি আবার কেনো এসেছো…কি চাও আমার কাছে?

—খুব চালাক তুমি।তোমাদের মানুষের বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না,ছলাকলা করে ঠিক বেঁচে গেলে!

—তুমি চলে যাও এখান থেকে,তাকদীর ভাইজান কিন্তু ছেড়ে দেবে না তোমায়!তুমি নিজেও জানো না কতো বড়ো ভুল করছো তুমি।

মেয়েটা আমায় একটা ধাক্কা মেরে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলো।এরপর আমায় ঘরের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে।

—হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস তুই।আমি মস্ত বড়ো ভুল করেছি।আজ নিজের সমস্ত ভুল শুধরে নেবো।তাকদীরকে আজ নিজের করে নেবো আমি,আর সেটা তোর চোখের সামনে কিন্তু তুই কিছুই করতে পারবি না।

—তাকদীর ভাইজান আমায় বলেছে সে তার নিজের শক্তি ফিরে পেয়েছে,তুমি কিছুই করতে পারবে না তার!

—তাই নাকি?দেখ তোর শক্তিমান তাকদীর ভাইজানকে কিকরে বোকা বানাই আমি।

ইতিমধ্যে তাকদীর ভাই এসে আমার ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হয়।সে বাইরে দাঁড়িয়ে আমায় উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো।

—মান্নাত আছো ভেতরে…আমি কিন্তু ভেতরে ঢুকছি।

—হ্যাঁ ভাইজান আমি ভেতরেই আছি,আপনি আসতে পারেন।

কথাটা আমি বললাম না,বললো আমার রূপধারী নকল মান্নাত।তাকদীর ভাইজানের পা ঘরের ভেতরে পড়তেই সে আমায় সজোরে দেয়ালের সাথে একটা ধাক্কা মারলো,আমি অনুভব করতে লাগলাম যে আমি দেয়ালের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি।একপর্যায়ে আমার পুরো শরীর দেয়ালের ভেতরে আটকে গেলো।শুধুমাত্র চোখের সামনের দুটো ছিদ্র দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম….

নকল মান্নাত দ্রুত গিয়ে বিছানার ওপরে শুয়ে পড়ে।ও হাত দিয়ে একটা ইশারা করতেই শরীরে কাঁটাছেড়া আর রক্তের দাগ ফুটে উঠলো ঠিক আমার মতো।তাকদীর ভাই এসে বিছানার ওপরে বসলো,এরপর নকল মান্নাতের হাতটা ধরে।মান্নাত উঠে বসলো।

—এখন কেমন লাগছে মান্নাত?

—হুমমম খুব ভালো।

—আচ্ছা তোমার শরীরের কাটা ছেঁড়ার দাগগুলোর ওপরে ওষুধ দিতে হবে,আর দেখো মুখে রক্ত লেগে আছে।এইভাবে তোমাকে দেখতে একদম ভালো লাগছে না।

—তাহলে যেভাবে ভালো লাগে আপনি তার ব্যবস্থা করুন তাকদীর ভাইজান।

—আচ্ছা তুই কথায় কথায় একদম ভাইজান বলে ডাকবে না আমায়!আমি তোমার কোনো ভাইজান হই না।

—তাহলে কি বলবে ডাকবো আপনিই বলে দিন…

—তুমি শুধু তাকদীর বলে ডাকতে পারো আমায়,অথবা তোমার যা খুশি শুধুমাত্র ভাইজান বাদ দিয়ে।

দেয়ালের ভেতরে আটকে পড়া আমার চোখ সমস্ত দৃশ্য নিঃশব্দে দেখে চলছে।আমি জানিনা সামনে কি ঘটতে চলেছে,শুধু এটুকুই জানি এই মেয়েটার উদ্দেশ্য মোটেও ভালো নয়।তার তাকদীর ভাইজান ওকে কোনো চিনতে পারছে না বুঝতে পারছি না।

—আচ্ছা মান্নাত তুমি বসো এখানে।আমি তোমার জন্য কিছু খাবার আর ওষুধ নিয়ে আসি।

—ওষুধ আর খাবার দিয়ে কি হবে?

—কি হবে মানে?ওষুধ আর খাবার না খেলে তোমার রোগ সারবে কি করে শুনি।তোমার শরীরের এই ক্ষত কিকরে ঘুচবে?

—ওষুধ দিয়ে হয়তো শরীরের ক্ষত ঘুচানো সম্ভব,কিন্তু আমার মনের ক্ষত কিকরে ঘুচাবো আমি?

—কি বলছো তুমি এগুলো মান্নাত?তুমি আবার রহস্য করা কথা বলা শিখলে কবে থেকে?

—আমি জানি না আমার কি হয়েছে তাকদীর।শুধু এইটুকুই বুঝতে পেরেছি আজ আমার তোমায় ভীষণ প্রয়োজন।আমার মনের রোগ তুমি ছাড়া কেউ সারাতে পারবে না।

এই বলে নকল মান্নাত তাকগীর ভাইজানকে নিজের দিকে টেনে নিলো।এরপর তার ঠোঁটের ওপরে নিজের ঠোঁট রেখে আলতো করে একটা চুমু খেলো।তাকদীর ভাইজান এরপর উঠে বসে।

—এগুলো কি হচ্ছে মান্নাত।এর আগে এতো কাছে ডেকেছি আমি তোমায়,তুমি প্রতিবারেই পালিয়ে গিয়েছো আমার থেকে।নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছো,আজ হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো তোমার।তাও এইরকম একটা মুহুর্তে!

—বললাম তো আমি জানি না কি হয়েছে আমার।এতোদিন ধরে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছি নিজেকে তোমার থেকে।আজ সমস্ত কিছুর হিসেব চোকানোর দিন।দেখো এই ঘরে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই।পূরনো সমস্ত হিসেব সুদে আসলে উসুল করে নাও।আমায় কাছে টেনে নাও তাকদীর।

তাকগীর ভাইজান কিছু একটা ভেবে নকল মান্নাতের হাঁটুর ওপরে ভর দিয়ে বসলো।এরপর দু’জন পরস্পরের দিকে হাসি বিনিময় করে।

—তাকদীর ভাইজান এই ভুল করো না,এই দেখো আমি এখানে।তুমি এই বহুরূপীর ফাঁদে পা দিও না।ও নষ্ট করতে চাইছে তোমায়,কেনো বুঝতে পারছো না তুমি।
আমি অস্পষ্ট স্বরে কথাগুলো বলতে লাগলাম।কিন্তু আমার কন্ঠস্বর দেয়ালের ভেতরেই আটকে রইলো।এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকদীর ভাই একটা অবাক কান্ড করে বসে।নকল মান্নাতকে একটা চড় মেরে বিছানার ওপরেই তাকে চেপে ধরলো।তাকদীর ভাইয়া তার বুকের ওপরে উঠে যায়,এরপর গলাটা টিপে ধরে বলতে থাকে ‌…

—আমি ভালো করেই বুঝে গিয়েছি তুই মান্নাত হতে পারিস না।মান্নাত এতোটা নির্লজ্জ কোনোদিন ছিলো না যে একটা পরপুরুষের কাছে নিজেকে স্বেচ্ছায় বিকিয়ে দেবে!
বল মান্নাতকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তুই… আজ শেষ করে ফেলবো তোকে আমি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here