কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব -৩০ ও শেষ

গল্পের নাম : #কিছু_জোড়াশালিকের_গল্প
পর্ব ৩০ : (প্রথম অংশ)
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)

একটু আগেই এগারোটার ঘর ছেড়েছে ঘণ্টার কাটাটা। শীতকাল হওয়ায় রাতটা বেশ ভালোই গভীর মনে হচ্ছে। বসার ঘরের বিষম নিস্তব্ধতার মাঝে সেকেন্ডের কাটার টিক-টিক আওয়াজ স্পষ্টত কানে বাজছে।

তিয়াসা সোফায় ডানকাত হয়ে শুয়ে আছে। মাথার নিচে ডান হাতটা রাখা। পা দুটো গুটিয়ে সোফার উপরে উঠানো।
অকারণেই বাম হাতের তর্জনী দিয়ে সোফার আঁকিবুঁকির উপর আঙুল ঘোরাচ্ছে সে।
অপেক্ষা করতে করতে ঝিমিয়ে পড়ছে হয়তো। তবুও ঘুমোচ্ছে না।

প্রয়াস অন্যদিন আটটা, সাড়ে আটটার দিকেই ফিরে আসে। আজ আসছে না এখনো।
আগেই অবশ্য দেরী হবার বিষয়টা ফোন করে জানিয়েছে। আর খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছে তিয়াসাকে। কিন্তু তিয়াসা তবুও অপেক্ষা করছে। ওর ঠাকুমা কয়েকবার বলে বলেও ওকে ঘুমাতে পাঠাতে পারে নি। অবশেষে তাই আর জোরাজুরি করেন নি।
শরীরটা একটু খারাপ থাকায় নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
রেখাই তাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে তিয়াসার সাথে, মুখোমুখি সামনের সোফায় বসে আছে।
সে আজ এখনো আছে। প্রয়াস না ফেরা অব্দি তার যাওয়া নিষেধ থাকে। আজ যেহেতু রাত বেশি হয়ে গেছে তাই রাতে এখানেই থাকবে সে।

রেখা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। ঘুম টুলুটুলু চোখে চেয়ে কণ্ঠে আকুতি মেখে বলল, “আপামনি! আর কতোসময় এমনে বইয়া থাকপেন? লন, ঘুমাইতে লন।”

কথাটায় বেজার বিরক্ত হলো তিয়াসা। ভ্রুকুটি করে তাকালো রেখার দিকে। তবে রেখার মলিন চোখমুখ দেখে একটুও দয়ামায়া হলো না। কারণ সে তো আর ওকে বসে থাকতে বলে নি! তার দরকার হলে সে যাক না! শুধু শুধু বেশি কথা বলছে!

তিয়াসা চোখ নামালো। পুনরায় নজর দিলো সোফায় আঁকা রঙিন ফুলগুলোর দিকে।

রেখা হতাশ হয়ে নিঃশ্বাস ফেললো। বুঝলো বলে কোনো লাভ নেই। প্রয়াস আসা অব্দি সে এখানেই পড়ে থাকবে। নড়বে না।

এদিকে ক্লান্তিতে চোখদুটো বুজে আসছে রেখার। তারপরও সে বসে আছে। বলা যায় না, তিয়াসা যদি আগের বারের মতো না দেখেই দরজা খুলে দেয়! আবার ওই অসভ্য লোকটা চলে আসে!
এটা ঠিক লোকটা জেলে আছে। তবুও বলা তো যায় না!
এজন্যই অপেক্ষা করছে সেও।
কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আর পারা যাচ্ছে না। চোখ দু’টো টেনে টেনে খুলে রাখতে হচ্ছে।

🌻
অবশেষে অপেক্ষার প্রহর বোধহয় শেষ হলো। স্তব্ধ ঘরটা কাঁপিয়ে কলিং বেল বেজে উঠলো একবার।

রেখা ঘুমে ঢুলতে থাকায় বেশ চমকে উঠলো। বিকট আওয়াজটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সজাগ দৃষ্টিতে তাকালো তিয়াসার দিকে।
তিয়াসা ততক্ষণে ঝটপট উঠে পড়েছে। এক ছুটে দরজা অব্দি এগিয়েও গিয়েছে সে।

রেখা হকচকালো। মেয়েটা আজও বিপদ বাধায় কিনা- এ-চিন্তায় দ্রুত পদে সেও এগিয়ে গেল। তবে তার কোনো আশঙ্কাই সত্যি হলো না।

প্রথমত, তিয়াসা দরজা খোলার আগে লুকিং গ্লাসে দেখে নিলো। আর দ্বিতীয়ত, তিয়াসা যার প্রতীক্ষায় ছিলো, সে-ই এসেছে। অন্যকেউ নয়।
এজন্যই মেয়েটার মুখটায় ঝলমলে হাসি ছেয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

রেখা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়েটা অধৈর্য আর চাঞ্চল্যে পূর্ণ হলেও বোকা নয়, সেটা বুঝলো।
আর বরপাগল এই মেয়েটার কাণ্ডকীর্তি দেখে নিঃশব্দে একগাল হেসে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।

প্রয়াস তিয়াসাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে একটু অবাক হলো। হাত উলটে ঘড়ি দেখতে দেখতে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “ঘুমাওনি কেন?”

তিয়াসা ওর প্রশ্নের মধ্যেই কাছে এগোলো। দ্বিধাহীন, আদুরে ভঙ্গিতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো প্রয়াসকে।
প্রয়াস অপ্রস্তুত হলো। বোকার মতো পলক ঝাপটালো কয়েকবার৷ তবে সন্ধিক্ষণেই অকপটে হেসে সেও জড়িয়ে ধরলো তিয়াসাকে।
মেয়েটাকে সারাদিনের মধ্যে অসম্ভব মিস করে সে।
দিনের শেষে মুখটা না দেখা অব্দি, বুকে না নেওয়া অব্দি শান্তি মেলে না।

গল্পের নাম : কিছু_জোড়াশালিকের_গল্প
পর্ব ৩০ : (দ্বিতীয় অংশ)
লেখিকা : Lucky_Nova(কপি নিষেধ)

🌸
ক্যান্ডেল অবন্তীকে মাঝখানে শোয়ার জন্য বালিশ পাতিয়ে দিলো। তারপর ইভানের দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত হেসে ফিচেল গলার বলল, “সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবা! ঘুমাবা না?”

ইভান গম্ভীর চোখে তাকিয়ে ছিলো। উক্ত প্রশ্নে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বিছানার দিকে এগোলো।

ক্যান্ডেল ঠোঁটে ঠোঁট চিপে হাসলো। ইভান যা পরে ছিল তাই-ই পরে আছে এখনো। ফ্রেশ হয়ে ঠিকমতো চোখমুখও মুছতে পারেনি বেচারা। কারণ এক্সট্রা কোনো তোয়ালে এখানে রাখেই নি ক্যান্ডেল।
কারণ হয়রানি তো এ ক’দিন সেও পুরোদমে করবে।

ইভান বিছানায় বসতেই ক্যান্ডেল খুক খুক করে কেশে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ইভান বিনাবাক্যে হাত বাড়িয়ে চাদরটা ধরার আগেই সেটা ক্যান্ডেল টেনে ধরে বলল, “এটা না। ওইযে সিংগেলটা, ওটা তোমার। তোমাকে একদম বিশ্বাস নেই মি. পার্ভাট!”

শেষোক্ত কথাটায় ইভানের ভ্রু খুব কুচকে গেল। ও শক্ত দৃষ্টিতে ক্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে তারপর অবন্তীর দিকে তাকালো।

অবন্তী চকলেট খাচ্ছিলো। ক্যান্ডেলের কথার পিঠে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “পার্ভাট কি?”
ক্যান্ডেল হাসি আটকে ওর দিকে তাকালো। গায়ে চাদরটা টেনে দিতে দিতে বলল, “কিছুনা। চকলেট মজা?”
“হ্যাঁ, অনেক!”
“গুড।” বলে অবন্তীর পাশে শুয়ে পড়লো ক্যান্ডেল। অকপটে ইভানের রাশভারি গোছের দৃষ্টিতে একনজর চেয়ে ইশারায় তাকেও শুয়ে পড়তে বলল৷

🌻
বাতি নিভানো। অন্ধকার ঘরে হলুদরাঙা টেবিলল্যাম্প জ্বলছে।
প্রয়াস বিছানার হোল্ডবোর্ডে হেলান দিয়ে আছে। চোখ কোলের উপরের ল্যাপটপের পর্দায় নিবদ্ধ। মনোযোগের সাথে কাজে ব্যস্ত সে।
তিয়াসা পাশেই আছে। বসে প্রয়াসের হাতে মাথা ঠেস দিয়ে আছে। প্রয়াসের একহাত ওর পিঠে, চুলের ভাঁজে গলিয়ে রাখা।
তিয়াসা কিছুক্ষণ ধরে চুপচাপ প্রয়াসের কী করছে সেটাই দেখে যাচ্ছে। তবে কিছু বুঝতে পারছে না। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও এই কাজ শেষ হবার আশাতেই বসে আছে।
কিন্তু এ তো শেষ হবার নামই নেই!

তিয়াসা তৃষ্ণায় পূর্ণ চোখদুটো স্ক্রিন থেকে সরিয়ে তাকালো প্রয়াসের মুখের দিকে।
প্রয়াস হয়তো টের পেল ওর চাহনি। একপলক তাকিয়ে ফের ল্যাপটপের পর্দায় মনোযোগ দিলো। মৃদু হেসে বলল, “আমার একটু দেরি হবে৷ তুমি শুয়ে পরো। রাত জেগো না।” বলতে বলতে হাত আলগা করলো প্রয়াস। না তাকিয়েই পাশের বালিশে হাত রেখে শুয়ে পড়তে ইশারা করলো।

কিন্তু তিয়াসা শুয়ে পড়লো না। নড়েচড়ে প্রয়াসের কাছ ঘেঁষে ঘনিষ্ঠতার পরিমাণ বাড়ালো। প্রয়াসের বুকের কাছের শার্টটা মুঠোয় চেপে ধরে বুকের সাথে মিশলো ও।
প্রয়াস ভ্রু কুঞ্চিত করলো। তিয়াসার অদ্ভুত ব্যবহারে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে প্রশ্নসূচক পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো তিয়াসার দিকে।
চোখাচোখি হলো। মুহূর্তেই মেয়েটার একান্ত দৃষ্টি নজরে এলো ওর। তিয়াসার ঠোঁটের ভাঁজের লাজুক হাসিতে কাছে চাওয়ার তীব্র আহূতি সুস্পষ্টভাবে টের পেতেই অবাক হলো অনেকটা। আকাশসম বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে পড়লো।

তিয়াসা আরেকটু নিবিড় হলো। প্রয়াসের বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়ে বাসনাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ও।

প্রয়াসের অবাক ভাবটা বাড়লো। মেয়েটার এমন আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ মনোভাবে ঠোঁটে প্রশ্রয়ের মুচকি হাসি ফুটলো। তবুও শুধুমাত্র মেয়েটাকে একটু জ্বালানোর জন্য সব বুঝেও না বোঝার ভান করে ফের লেপটপের দিকে তাকালো সে। ঠোঁটে হাসিটা যথাসাধ্য লুকানোর চেষ্টা করে বলল, “আমার তো দেরি হবে। তুমি নাহয় ঘুমিয়ে পড়ো! জেগে আছো কেন?”

প্রয়াসের এমন কথায় ঠোঁটের লাজুক হাসিটা কেমন মিইয়ে গেল তিয়াসার। প্রয়াসকে ফের ল্যাপটপে নজরবন্দি করতে দেখে আষাঢ়ের নিকষকালো মেঘের মতো হলো পড়লো মুখটা।
ও হাতের মুঠোর শার্টটা আরো চেপে ধরলো। যাতে প্রয়াস ওর দিকে ফিরে তাকায়।

প্রয়াস বুঝলো ঠিকই। তারপরেও ইচ্ছে করেই ফিরলো না। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকিয়ে আড়চোখে একবার তাকালো তিয়াসার দিকে।

তিয়াসা ক্ষুদ্ধ হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলছে ইতিমধ্যে। চোখের দৃষ্টি অসহ্য রকমের অভিমানে পূর্ণ।

প্রয়াস প্রশস্ত অধরে হেসে ফেললো। ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে রেখে দু’হাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো তিয়াসাকে। তিয়াসা ভ্রুকুটি করে তাকাতেই দুষ্টুমির ছলে বলল, “আমি তো তোমাকে বাচ্চা মেয়ে ভেবেছিলাম! কিন্তু তুমি তো মোটেও বাচ্চা না!”

(চলবে…)গল্পের নাম : #কিছু_জোড়াশালিকের_গল্প
পর্ব ৩০ : (শেষ পর্ব)
লেখিকা: Lucky Nova

ভোরের পাখির কলতানে কারো বাহুডোরেই ঘুম ভাঙলো ক্যান্ডেলের। আস্তেধীরে চোখ মেলতে না মেলতেই বিস্মিত হয়ে পড়লো সে।
তড়িঘড়ি করে মুখ তুলে তাকালো পুরুষটির দিকে। ফিচেল একজোড়া চোখের সাথে চোখাচোখি হলো।
অমনি চমকালো ও। অবাক ভাবটা বাড়লো।

ইভানের এতোটা সান্নিধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মাঝখানে না অবন্তী ছিলো! গেল কোথায়! আর ও কখন এলো এখানে!

“তুমি…!” আমতা আমতা করতে করতেই ওর উপর ঝুঁকলো ইভান।
ক্যান্ডেল হড়বড়িয়ে গেল। চকিতে ওপর পাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই মুখটা হা হয়ে গেল।

অবন্তী নেই। জায়গটা ফাঁকা পরে আছে একদম। কিন্তু কীভাবে!
অগাধ বিস্ময় নিয়ে চোখ ফিরিয়ে তাকালো ইভানের দিকে। বিশাল চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “অবন্তীকে কী করেছ তুমি? ও কোথায়?”

উত্তর এলো না। কারণ সে এখন খুব ব্যস্ত। গভীর স্পর্শে মত্ত!

__________

পরিশিষ্ট:

🌼
“আপনাকে না আমি বললাম এভাবে আসবেন না! তাও! সবাই কী মনে করে!” লজ্জায়, সাথে কপট রাগে চোখ পাকালো ত্রয়ী। কপাল কুচকে এসেছে তার। সদ্য রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসায় ঘেমে আছে লালচে মুখটা।

নীল গভীর চোখে তাকিয়ে দেখলো ওকে। তারপর কাছে এগিয়ে এসে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে নিতে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল, “কী মনে করে?”

ত্রয়ী হালকা কেঁপে উঠলো। রাগ দেখতে চেয়েও আর পারলো না।
তাছাড়া কিছু বলে লাভও নেই। হাজারবার বলা হয়েছে ইতিমধ্যে। লোকটা শুনলে তো!

রোজ রোজ তার ভরদুপুরের সময় বাসায় আসা লাগবে। আর তারপর? এইযে এসব!

আর এদিকে সবাই সব বুঝে যায় না! তখন লজ্জায় তো ওকেই একমাত্র পড়তে হয়! তাইনা!

“আমি না আসলে খুশি হও?” কানের কাছে অধর ছুঁয়ে নিমজ্জিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো নীল।

ত্রয়ী শিহরিত হলো। চোখ বুঁজে ফেললো অকপটে।

“হও?” সমস্বরে আবার জিজ্ঞেস করলো সে।

ত্রয়ী ঢোক গিললো। ঝুপ করে নীলের বুকের মধ্যে মুখ গুজে লাজুক ভঙ্গিতে নাসূচক মাথা নাড়লো সে।

🌸
ক্যান্ডেল থেকে থেকে রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠছে। রাগে দুঃখে সবকিছু ভাঙতে মন চাইছে ওর।

ইভানের সাথে আবার ঝগড়া করছে সে। সেই সূত্র ধরেই গোটা দিনটায় তার সাথে মোটেও কথা বলে নি।
এতে যে ইভানের কিছু গেছে-এসেছে, তা মনে হচ্ছে না। সে তো বিন্দাস আছে। সবসময় যেমন থাকে।

মূলত কোনো ঝামেলা হলে ক্যান্ডলেরই সবসময় আগ বাড়িয়ে আসা লাগে। এমনটাই হয়ে আসছে এক বছর ধরে!
অবশ্য দোষটাও তারই থাকে।
কিন্তু তাতে কী! পা’র্ভাটটাও তো নির্দোষ থাকে না পুরোপুরি! তার অল্প হলেও দোষ থাকেই।

এজন্যই রুম চেঞ্জ করছে ক্যান্ডেল। নিজেদের বেডরুম ছেড়ে পাশের গেস্টরুমে থাকবে বলে ঠিক করেছে। ভুলেও, মুখ ফসকে হলেও একটা টু শব্দও করেও তার সাথে কথা বলে নি সারাদিনে।

মনে মনে পণ করেই নিয়েছে এবার সে মোটেও ঝামেলা মিটাবে না। এতে যদি এক বছরও দূরে সরে থাকা লাগে সে থাকবে। তাও এবার নিজে থেকে যাবে না। মরে গেলেও না!

বেলা গড়িয়ে গেল। আবছা অন্ধকারে সন্ধ্যা নামলো। তারপর সন্ধ্যা থেকে রাত।
লোকটার এখনো অব্দি কোনো রকমের কোনো হদিস নেই! একবারের জন্যও এলো না!
এই রুমে চলে আসার সময়ও সে ভাবলেশহীনভাবে নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলো।

ক্যান্ডেল অধৈর্য হয়ে উঠলো। একই সাথে ক্ষোভে জ্বলতে লাগলো। অভিমানী মনে নানারকমের প্রশ্ন জাগতে লাগলো। তবে একটা প্রশ্নে এসে সে থমকে গেল।
বিয়ের পর সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভালোবাসা কমে যায়! সত্যিই কি তাই? নাকি না?
এমন হলে সারাজীবন একসাথে কীভাবে থাকবে?

ভেতরে ভেতরে ভয় ঢুকে গেল ওর। অস্থিরতায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
তবে পরমুহূর্তেই আবার নিজেকে ধাতস্থ করলো ক্যান্ডেল।
ইভান তো আগে থেকেই এমন কাটখোট্টা। তাই না?
কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।

কিন্তু তবুও…

ক্যান্ডেল ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখটা কেমন ভিজে ভিজে আসছে। বিষাদময় লাগছে সবকিছু। আর ভাবতে ভালো লাগছে না।

নিস্তব্ধ রাত্রিটা কেমন দীর্ঘ মনে হচ্ছে!

ও ঘাড় ঘুরালো। মনের মধ্যের সুপ্ত উদ্দেশ্যে একবার তাকালো দরজার দিকে। তবে সেটা আগের মতোই বন্ধ দেখে আশা ছাড়লো। হতাশ হয়ে নিঃশ্বাস ফেলে গায়ের চাদরটা টেনেটুনে নিয়ে চোখ বুজলো। নীমিলিত চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা জল গড়াতেই নিজের উপর নিজে বিরক্ত হলো ক্যান্ডেল। জোরপূর্বক চোখ বুজে রেখে ঘুমোনোর চেষ্টা চালালো।

ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের ঘর পেরুলে একটু ঘুম ধরা দিলো চোখে। ঝিমিয়ে পড়লো মস্তিষ্ক। কিন্তু পুরোপুরিভাবে ঘুমের রাজ্যে তলানোর আগেই এক বলিষ্ঠ হাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
হালকা চমকে উঠলো ও। ঘুম উবে গেল এক নিমিষে।
সন্দিহান দৃষ্টিতে চট করে ঘাড় ফিরাতেই খোলা কাচের জালানা দিয়ে আসা চন্দ্রশোভায় পুরুষ অবয়বটি স্পষ্ট বোঝা গেল।
যে কিনা ওর ঘাড়ের মধ্যে মুখ গুজে দিয়েছে ততসময়ে। ভরাট গলায় বলে উঠেছে, “রুম হিটারটা কি তুমি নষ্ট করেছ? এতো ঠান্ডা বেডরুমে!”

ক্যান্ডেল চোখ পিটপিটালো। ভালো লাগায় মনের আনাচ কানাচ পূর্ণ হবার আগেই উক্ত প্রশ্নের মর্মার্থ বুঝে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। রুম হিটারের দোহাই দিচ্ছে! অ’সভ্য একটা!

জোরপূর্বক ইভানের হাতটা সরিয়ে দিলো ক্যান্ডেল। নড়েচড়ে সরে সমানে এগিয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “এসব করে পার পেয়ে যাবা ভাবছ! বেটার লাক নেক্সট টাইম। এসবে মোটেও কাজ হবে না।”

ইভানও সুক্ষ্ণভাবে হেসে এগিয়ে এলো। চাদর ভেদ করে ফের ওকে জড়িয়ে নিলো পেছন থেকে।

ক্যান্ডেল খুশি হলো। তবুও পড়ে যাওয়া রাগটা জোর করে ধরে রাখতে চাইলো। এজন্যই বোধহয় ফের ছাড়িয়ে নিতে চাইলো নিজেকে।
কিন্তু পারলো না। বরং স্পর্শগুলো বেহায়া হয়ে উঠলো লোকটার।
ক্যান্ডেল শিউরে উঠলো। চকিত ভঙ্গিতে ফিরে তাকাতেই ইভান ফিচেল গলার বলল, “তুমি সিওর এসবে কাজ হবে না?”

ক্যান্ডেল চোখ রাঙালো। কপট রাগ নিয়ে বলল, “পা’র্ভাট!”

🌻
শীত সকালের নরম রোদ গ্রিল গলিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। শীতল সমীরণে মুখিয়ে আছে চারপাশ।
তিয়াসা ক্যানভাসের উপর মনোযোগের সঙ্গে তুলি ঘুরাতে ব্যস্ত।
সাদাকালোর মিশ্রণে একটা খুব সুন্দর মুহূর্তের ছবি আঁকতে বসেছে সে। অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে সেটা।

বর্তমানে আর্ট নিয়ে পড়াশুনো করছে ও। ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকিটা বেশ ভালোই পারায় এটাই রপ্ত করতে চাইছে। এজন্যই ওকে আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়েছে প্রয়াস।

সবকিছুতেই ঠিক কতোটাই না উৎসাহ দেয় সে!

তিয়াসা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। আঁকিবুঁকিতে ব্যস্ত হলো। এমন সময় হুট করে গালে বরফ ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চমকে উঠলো ও। চকিতে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই প্রয়াসকে দেখলো। পলকেই অকৃত্তিম হাসিটা ঠোঁটে এসে ভিড়লো।
প্রয়াসও নিঃশব্দে মৃদু হাসলো।

“কী আঁকো?” বলতে বলতে চেয়ারের হ্যান্ডেলে ঠেস দিয়ে আগ্রহ নিয়ে দৃষ্টি ফেললো ক্যানভাসে।

সাদাকালো মিশেলের ছবিটা নজরে আটকালো তখন। ভ্রুদ্বয়ে আপনাআপনি ভাঁজ পড়লো সামান্য।

একটা অফিশিয়াল পোশাক পরিহিত গম্ভীর পুরুষ, যার পাশেই আদুরে হাসিসমেত উচ্ছল, মায়াবী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে তার পানে। আর দুজনের সামনেই দানব আকৃতির এক দোকানদার। যে কিনা গম্ভীর পুরুষের ভয়ে খাটো হয়ে আছে।

প্রয়াস নিঃশব্দে হেসে ফেললো। প্রথম সাক্ষাতটা মানসপটে ভেসে উঠলো মাত্রই।
নির্মল দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে তাকালো তিয়াসার মুখপানে। তিয়াসা অমায়িক হাসলো।

“তুমি খুব সহজেই বিশ্বাস করেছিলে আমাকে। যদি আমি খারাপ কেউ হতাম!” ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো প্রয়াস।
তিয়াসার হাসিটা প্রসারিত হলো। দৃষ্টি স্থির হলো প্রয়াসের মুখপানে।

খারাপ কেউ!

তিয়াসার এখনো মনে আছে। ছোটোবেলায় একবার বাসার সামনের এক বিক্রেতার থেকে হাওয়াইমিঠাই নিয়ে খেতে শুরু করে দিয়েছিলো। দোকানদারই এমনভাবে বলছিলো যেন জিনিসটা ফ্রি।
ও-ও না বুঝে নিয়েছিলো। পরে টাকা দিতে না পারায় সে কী বকাবকি!
ঘাবড়েই গিয়েছিলো ও।

তবে ভাগ্যিস বাসার সামনেই ও। এজন্যই ওর বাবা দৌড়ে এসেছিলো। টাকা মিটিয়ে দিতে লোকটা শান্ত হয়েছিলো।
তিয়াসাকে ওর বাবা তখন বলেছিল কারো জিনিস এভাবে না নিতে। নিলে টাকা দিতে হয়।

ও বুঝছিলো। তবুও একই কাজ দ্বিতীয়বার আবার করে ফেলেছিলো সেদিন। খুব খিদে পেয়েছিলো কিনা!
আর এতে ওই দোকানদারটা খুব চেঁচামেচি শুরু করেছিলো। তখন কী ভয়টায় না পেয়ে গেছিলো ও! থরথর কাঁপছিলো। বাবার কথাও খুব মনে পড়ছিলো।

তবে অদ্ভুতভাবেই বহুদিন পর, প্রথমবারের মতো তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো কেউ। যেখানে সবাই তাকে সবসময় বকতে আর মারতে ব্যস্ত সেখানে প্রয়াসই প্রথম ওর জন্য কিছু করেছিলো।
কেমন চুপসে গেছিলো ওই দানব দোকানদারটা। বকাবকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো!
ভেবেই এখন হাসি পায় ওর।

তবে কী কারণে, ঠিক জানা নেই, তাকে অন্যরকম মনে হয়েছিলো৷ এজন্যই তো হুট করেই ও পিছু নিয়েছিলো প্রয়াসের। সে বিরক্ত হলেও সে পিছু ছাড়েনি।
যখন সে গাড়ি করে চলে গেল তখন মন খারাপ হয়েছিলো খুব। তবুও ও অপেক্ষা করেছিলো ওখানেই। ভেবেছিলো আসবে।
এজন্যই হয়তো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলো।

আর তারপর!
ওর ধারণা সঠিক হতে দিয়ে সে এসেছিলো। সত্যিই এসেছিলো।
অবশেষে সমস্ত দুঃখের অবসানে নতুন খুশির দিন শুরু হয়েছিলো।

তিয়াসা অধর প্রসারিত করে হাসলো। পলকহীন চেয়ে রইলো প্রয়াসের পানে।

মুচকি হাসলো প্রয়াস। সে এখন মোটামুটি ইশারায় বলা সব কথাই বোঝে তিয়াসার।
আগে ওর ওই কাকাকাকির বকাবকির কারণে লিখে লিখে বলতে হতো। কারণ তারা ইশারায় বলা কথা বুঝতে না পারলেই বকাবকি শুরু করে দিতো।

এখন অবশ্য সে চিন্তা আর নেই। তাই ইশারাতেই কথা বলে ও।

তিয়াসা উঠে দাঁড়াতেই প্রয়াস হাত বাড়ালো। এক হাত ওর ঘাড়ে গলিয়ে দিয়ে দূরত্ব ঘুচালো। ঠোঁটদুটো একত্র করার মূহুর্তে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে চমকে উঠলো দু’জনে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো বাগানের দিকে।

সেই ডালিম গাছেটায় আবার একটা শালিক বউ আটকা পড়ে গেছে।

(সমাপ্ত)

Wifi line এর সমস্যার জন্য কাল পোস্ট হয়নি।
দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here