কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব -১৬+১৭

গল্পের নাম : #কিছু_জোড়াশালিকের_গল্প
পর্ব ১৬ : #কোর্টিং_দ্য_মুন
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)

গাড়িতে জড়সড় হয়ে আছে ত্রয়ী। নীলের বেশ কাছাকাছি। একটু আগে বাসন্তীকে এনজিওর সামনে নামিয়ে দিয়েছে নীল। আপাতত ওরা দু’জন এখন।
নীল ড্রাইভ করতে করতেই একপলক তাকালো ত্রয়ীর দিকে।
কাটখোট্টা গলায় বলল, “এসি আছে তারপরও ঘামছ!”
ত্রয়ী ঠোঁটে ঠোঁট চিপলো। চোরের মতো চোখের মণি ঘুরিয়ে নীলের দিকে তাকালো একনজর। আলগোছে মুখ আর গলায় হাত বুলালো।
হ্যাঁ, সে সত্যিই ঘামছে। খুব ভয়ভয়ও লাগছে। কেনো লাগছে তা সে নিজেও জানেনা। লোকটা তো বাঘও না, ভাল্লুকও না। তাহলে?

খানিক বাদে গাড়ি থামালো নীল। পার্ক করলো একপাশে। নেমে এসে ত্রয়ীর দিকের দরজাটা খুলে দিতে দিতে বলল, “নামো, এসে গেছি।”
ত্রয়ী চোখ পিটপিটালো। আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে নামলো গাড়ি থেকে।
চিড়িয়াখানা! এখানে কেনো এনেছে ওকে!
অবাক হয়ে তাকালো ত্রয়ী।
নীল মুচকি হাসলো। বলল, “পার্থক্য বোঝাতে এসেছি যে আমি কোনো বাঘ ভাল্লুক নই। বাঘ ভাল্লুক চারপায় হাঁটে, বনেজঙ্গলে বা চিড়িয়াখানায় থাকে। বাসাবাড়িতে না।”
এমন কথায় ভীষণ অপ্রতিভ হয়ে পড়লো ত্রয়ী।

🌸
জয়িতা অনেকক্ষণ ধরেই কিছু বলার জন্য মিনমিন করছে। কিন্তু কিছুই বলা হয়ে উঠছে না।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অবশেষে আড়ষ্টভাব ভেঙে বলল, “মেয়েটার সাথে তোমার সত্যিই কিছু ছিলো না ঠাকুরপো?”
ইভান ফিরে তাকালো না। কপালে অমসৃণ ভাঁজটা বিদ্যমান রেখে রাশভারি মুখে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলো।
“আমি আসলে বলতে চাই নি। মুখ ফসকে গেছিলো। তাছাড়া তুমি তো জানো, মা তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আর তুমিও বিয়ের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছ না, ওইজন্যই আমি…। কিন্তু পরে তো মা সব ভুলেই যাচ্ছিলো। তুমিই তো মেয়েটাকে আবার এনেছ, বলো! আর মাও দেখেছে ক্যামেরাতে সবটা যে তুমি আর ওই মেয়ে…।” এটুকু বলে খুকখুক করে গলা ঝাড়লো জয়িতা।
তাকালো ইভানের প্রতিক্রিয়া দেখতে। কিন্তু সে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আর না কিছু বলল। স্থির, নির্বিকার ভঙ্গিতে সামনে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রইলো।
চোখ সংকীর্ণ করলো জয়িতা। অধৈর্য হয়ে গমগমে গলায় বলল, “এই ঠাকুরপো! আর কতোদিন রাগ করে থাকবা?”
ইভান এবারো কিছু বলল না।
মনোক্ষুণ্ণ হয়ে গাল ফোলালো জয়িতা। তিনদিন হয়ে যাচ্ছে ইভান কথা অব্দি বলেনি তার সাথে। কতোবার না ফোন দিয়েছে জয়িতা! ধরেনি সে। তাই আজ বাধ্য হয়ে চলেই এসেছে ইভানের বাসায়। নিজের কোন পরিচিত মাসির বাসায় যাবে বলে বের করে নিয়ে এসেছে ইভানকে। সেই সুবাদে কথাও বলা যাবে।
কিন্তু সে তো মুখে কুলুপ এঁটেছে। খুব সহজে মুখ খুলবে বলে মনে হয় না।
ক্লান্ত শ্বাস ফেললো জয়িতা। সল্পক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবার একই কথা বলতে শুরু করলো। সারটা রাস্তাজুড়ে এভাবেই বকরবকর করে গেলো।

গন্তব্যে এসে গাড়ি থামালো ইভান। নেমে গেলো সীটবেল্ট খুলে।
জয়িতাও নামলো।
ইভান পিছনের সীট থেকে মিষ্টির প্যাকেট গুলো বের করে জয়িতার দিকে এগিয়ে দিতেই জয়িতা ভনিতা করে বলল, “ঠাকুরপো হাতে ব্যথা আমার। একটু বাসা অব্দি চলো।”
বলেই উল্টোদিকে ঘুরে সবেগে হাঁটা শুরু করে দিলো জয়িতা।
বিরক্ত হয়ে তাকালো ইভান। অগত্যা যেতে হলো জয়িতার পিছু পিছু।

দরজা খুললেন এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা। জয়িতাকে দেখে হাসলেন সচ্ছলভাবে।
জয়িতা হাসিমুখে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কুশল বিনিময় করে পরিচয় করিয়ে দিলো ইভানের সাথে। এটাই জয়িতার মাসি রুবি। সিটিজেনশিপ পেয়ে দীর্ঘদিন প্রবাসেই ছিলেন সপরিবারে। বেশিদিন হয়েনি স্বদেশে ফিরেছেন।

“দাঁড়িয়ে থাকিস না।ভেতরে আয়। তুমিও এসো বাবা।” হাসিমুখে বললেন ভদ্রমহিলা।
ইভান না করতে চাইলেও জয়িতা যেতে দিলো না। ভদ্রমহিলাও শুনলেন না।
সৌজন্যতার খাতিরে তাই আসতেই হলো ইভানকে।

ভদ্রমহিলা বসার রুমে বসতে বলে চা নাস্তা আনতে গেলেন। জয়িতাও গেলো পিছু পিছু।
ইভান ঢুকলো বসার ঘরটায়। অকারণেই হাত উলটে ঘড়ি দেখলো একবার। তারপর চোখ তুলে বসার ঘরটায় নজর বুলালো।
অত্যন্ত ছিমছাম, পরিপাটি বসার ঘরটা। একপাশে বই দিয়ে ভরা একটা সাদা বুকসেল্ফ। সেটার পাশেই চিনামাটির তৈরি বড়ো একটা ফুলদানি। আর বুকসেল্ফের ঠিক অপরপাশে একটা পেইন্টিং।
বসার ইচ্ছে না থাকায় ইভান এগিয়ে গিয়ে সেটার সামনে দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে দেখতে লাগলো সেটা।
পল বন্ডের আঁকা – ‘কোর্টিং দ্য মুন’।
পূর্ণচন্দ্রের মোহনীয় জ্যোৎস্নারাতে একঝাঁক পাখির উন্মাদনা ভরা নৃত্যের।
ছবিটা দেখে ফের ঘুরতে যেতেই ট্রে-র সাথে ধাক্কা খেলো ইভান। নিমিষেই ট্রে-তে থাকা পানীয় গড়িয়ে গেলো শার্টে। ভিজে গেলো বুক থেকে উদরের অংশ। হতবুদ্ধি হয়ে সামনের ব্যক্তির দিকে তাকালো ইভান।
কাজের মেয়েটা হুড়মুড়িয়ে পিছিয়ে গেলো। জিভ কেটে বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বলল, “সরি সরি ভাইজান। আমি বুঝিনাই আপনি হুট করে ঘুইরা দাঁড়াইবেন। হায় হায়! এহন কী হইবো! আপনের শার্ট তো শরবতে মাখামাখি হইয়া গেছে।”
বলতে বলতেই ক্যাথি ঘরে ঢুকলেন। ইভানের শার্টের দিকে নজর যেতেই চোখ চড়কগাছ হলো তার।
“কী করেছিস তুই আবার?” ঝাঁঝ মিশানো গলায় আক্ষেপের সাথে বলতে বলতে এগিয়ে এলেন তিনি।
মুখটা শুকিয়ে গেলো মেয়েটার। আড়চোখে তাকালো একবার ক্যাথির দিকে।
“একটা কাজও যদি ঠিকঠাক পারতি!” চোখ দ্বারা ভর্ৎসনা করলেন ক্যাথি।
“কী হয়েছে?” বলতে বলতে ভিতরে ঢুকলো জয়িতা।
ইভানের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে গেলো তার মুখ।
“ওমা! কী করে হলো?” এগিয়ে এলো জয়িতা।
“আর বলিস না। এই অকর্মাটার কাজ। যা এখান থেকে।” ঝাড়ি খেয়ে হরদমে পালালো মেয়েটা।
“সরি, দেখেছ কী হয়ে গেলো!” আহাজারি করে উঠলেন ক্যাথি।
“সমস্যা নেই। It’s ok.” বলল ইভান।
উনি তাও থামলেন না। হাইহুতাশ করে গেলেন। বোঝা গেলো তিনি বেশ লজ্জিত মেয়েটার এমন ভুলের দরুন।

জয়িতা কিছু ভাবলো। তারপর বলল, “ঠাকুরপো, এক কাজ করো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নেও। আর শার্টটা যেটুকু অংশ ভিজেছে সেটুকু একটু পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলো। শুকাতে সময় লাগবে না।”
ক্যাথিও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
“হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে। উপর তলায় গিয়ে কষ্ট করে ফ্রেশ হয়ে নেও।”
এছাড়া আর উপায় দেখা গেলো না। এভাবে বসে থাকলে গা চিটচিট করবে। তারচেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেওয়াই ভালো।

ইভান উপরের একটা রুম থেকে ফ্রেশ হলো। ভিজে শার্টটা বেলকনিতে দিয়ে এসে বসলো বিছানাটাতে। মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। ভেবেছিলো ছুটির দিন বলে আজ দুপুরে ভাতঘুম দেবে। কিন্তু তা আর হলো কই। জয়িতা টেনে নিয়ে এলো।
শার্টটা না ভিজলে বাসায় ফেরা যেতো। অবশ্য এখন শার্ট শুকানো অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। কিছু করার নেই।
কান্ত নিঃশ্বাস ফেললো ইভান। সময় কাটানোর জন্য ফোন বের করে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসলো।

🌸
ঘটা করে সন্ধ্যে নেমেছে ধরনীতে। কৃত্রিম আলোতে ছেয়ে গেছে চারিদিক। অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘরটা বেলকোনি থেকে তীর্যকভাবে আসা কৃত্রিম হলুদাভ আলোতে আলোকিত হয়েছে কিছুটা। তবে আঁধারের রেশ পুরো কাটে নি।
ক্যান্ডেল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। মুক্ত শ্বাস ফেলে কাধে ঝুলানো মোটা চেইনের পার্স ব্যাগটা ধপ করে রাখলো চেয়ারের উপরে।
গাড়ি থেকে নেমে রুম অব্দি আসতে আসতেই ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে সে। এতো গরম!
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চুলগুলো হাতখোপা করে নিলো ক্যান্ডেল।
হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে চট করে নিজের গায়ের কাপড় খুললো। চেয়ারের উপর থেকে তোয়ালে নিয়ে প্যাঁচালো শরীরে।
ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে নিজের হাতঘড়ির দিকে নজর গেলো ওর। বিরক্তসূচক শব্দ করে হাতঘড়ি খুলতে খুলতে বেরিয়ে এলো ও।
ওয়াশরুমের বাতিটার আলো ছলকে পড়লো রুমের মেঝেতে। বেশ আলোকিত হয়ে উঠলো রুমটা। ড্রেসিং টেবিল ঘড়িটা রেখে আনমনেই আয়নার দিকে একপলক তাকালো ক্যান্ডেল। ঘুরে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। সেকেন্ড ব্যবধানে আয়নায় দেখা প্রতিবিম্বটা মগজে খেলতেই কপাল কুচকে এলো ওর। আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে আয়নার বিপরীতপাশে তাকালো ক্যান্ডেল। মুহুর্তেই পীলে চমকে উঠলো ওর।
চোখের সামনে আস্ত একটা পুরুষ মানুষকে দেখে পুরো শরীর শিউরে উঠলো যেন। চরমভাবে চমকে দুইপা পিছিয়ে দেয়ালের সাথে লেপ্টে গেলো ও।
চোখাচোখি হতেই একহাত দিয়ে চেপে ধরলো বুকের কাছের তোয়ালের অংশটা।
চোখের পাপড়িতে অনুরণন তুলে কোনমতে অস্ফুটস্বরে আওড়াল, “তু..তুমি!”

ঘটনার আকস্মিকতায় ইভান নিজেও বেশ বিমূঢ় হয়ে পড়লো। শূন্য হয়ে পড়লো মস্তিষ্ক। তার সাতাশ বছরের জীবনে এর মতো অস্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়ে নি।

ক্যান্ডেলের দিক থেকে চোখ সরালো ইভান। হাতে থাকা শার্টটা মুঠোয় চেপে ধরে বিরক্তিকর একটা নিঃশ্বাস ফেললো।

এতক্ষণে বিস্ময় কাটলো ক্যান্ডেলের। এটা যে বাস্তবেই ঘটছে সেটা বোঝার সাথে সাথে শরীরে কাঁপন ধরে গেলো ওর।
একটু আগে ও এখানে, এই লোকটার সামনে নিজের কাপড়গুলো…।
ক্যান্ডেল আর ভাবতে পারলো না। হাতপা অবশ হয়ে এলো। বুক ওঠানামা করতে লাগলো অতিদ্রুত।

ইভান বুঝলো হয়তো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো একবার। কিন্তু বলার মতো কিছুই খুঁজে বের করা সম্ভব হলো না। আর পরিস্থিতিও এমন যে কিছু বললে সেটা আরো অস্বস্তিদায়ক হবে। আপাতত রুমটা থেকে বের হওয়াটাকেই উচিত বলে মনে হলো ওর।
কিন্তু সে অবকাশ পাওয়া গেল না। তার আগেই এবাসার কাজের মেয়ে, রাশেদা নব ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো।
“আপামনি, এতবার ডাকলাম আপনে…” এটুকু বলেই থমকালো মেয়েটা। চোখ কপালে তুললো সে।
রাশেদাকে দেখে ইভান, ক্যান্ডেল দুজনেই চমকালো খুব।
মেয়েটা রসগোল্লার মতো চোখ বানিয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাওয়া স্বরে বলল, “আন্নেরা… এমনে খাড়াইয়া… কী করেন?”
বলতে বলতে আড়চোখে পিছনে তাকালো একবার। ততক্ষণে ইশারা হাসিমুখে এসে দাঁড়িয়েছে রাশেদার পিছনে। উদ্দেশ্য জয়িতার সুপরিচিত, দূরসম্পর্কের মাসির মেয়েটির সাথে দেখা করা।

সেই তাগিদেই রাশেদার পাশ গলিয়ে রুমের ভিতরে তাকালেন তিনি। আর তাকাতেই কিয়ৎপলের মধ্যেই হাসিটা উবে গেলো তার।
নিজের ছেলের সাথে সেদিনের সেই মেয়েটাকে এমন দৃষ্টিকটু অবস্থায় দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেলো তার। বিস্ফোরণ ঘটে গেলো তার বুকের মধ্যস্থানে।
রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলে উঠলেন, “তুই এই মেয়ের সাথে কী করছিস?”

ইশারাকে দেখে হৃদস্পন্দন থেমে গেলো দু’জনেরই। পলকেই পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো ওদের চেহারাখানা।
এটাই হয়তো বাকি ছিলো!

ঝামেলার সূচনা হতে বিলম্ব হলো না। ইশারা চেঁচামেচিতে বিষয়টা তিল থেকে তাল হয়েই গেল।

🌸
বসার রুমে বসে একনাগাড়ে নিজের ভুলবোঝা গল্পগুলো গমগমে স্বরে বলে গেলেন ইশারা। সেই প্রথম দিনের কল্পকাহিনী থেকে শুরু করলেন।
ইভান থামালো না। কারণ লাভ নেই। তার মা কখনই শুনবে না। তারউপর আজকের ঘটনার পর থেকে তো আর জীবনেও বুঝতেও চাইবে না। শত বললেও না। এটা তার মায়ের বিশেষ দোষ।
তাছাড়া তিনি যে অবস্থায় ওদের দুজনকে আবিষ্কার করেছে তাতে তো আরোই মানতে চাইবেন না।

সব শুনে হতবাক হয়ে বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন ক্যাথি।
ক্যান্ডেল চুপচাপ মাথা নুয়ে রইলো। এতসময়ে ইভানের মায়ের বলা কিছুই তার কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সে নিজেও জানে না। বরং এখন, এই মূহুর্তে ইভানের আশেপাশেও থাকতে লজ্জা হচ্ছে ওর। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ক্যান্ডেলের কাঁচুমাচু ভাব দেখে বিষয়টা সত্যি বলে ধরে নিলেন ক্যাথি। তাছাড়া একটা বয়স্ক মানুষ সামনাসামনি বসে মিথ্যে কেন বলবে?

🌼
গাড়িটা ত্রয়ীর বাসার সামনে থামালো নীল। ত্রয়ী নিজের সীটবেল্ট খুলে একপলক তাকালো নীলের দিকে।
নীলও তাকালো। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো ত্রয়ী।
মিনমিন করলো, “আপনি কী ভিতরে যাবেন?”
সারাদিনের মধ্যে এটাই হয়তো ওর নিজে থেকে বলা কথা। এর আগ পর্যন্ত নীল যেটুকু বলেছে সেটুকুই শুনেছে। আর যতটুকু প্রশ্ন করেছে সংক্ষেপে তার উত্তর করেছে। মেয়েটা অতিরিক্ত চুপচাপ ধরনের।

মুচকি হাসলো নীল। বলল, “তুমি চাইলে যাব। আর তুমি চাইলে তোমার সাথে থাকবোও।”
থতমত খেয়ে গেলো ত্রয়ী।
“বলো তুমি কী চাও?” ভারিক্কি গলায় বললো নীল।
হতবুদ্ধি হয়ে গেলো ত্রয়ী। ঘনঘন পলক ঝাপটিয়ে কোলের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলো কী বলবে।

নীল চুপচাপ অপেক্ষা করলো ত্রয়ী কী বলে তা শোনার জন্য।
ত্রয়ী দিকদিশা খুঁজে পেলো না। অবশেষে কয়েক মুহূর্ত ব্যয় করে বলল, “আপনার ইচ্ছা।”
নীল কাছে এগিয়ে গিয়ে ডানহাত রাখলো ত্রয়ীর একপাশে।
চকিত ভঙ্গিতে তাকালো ত্রয়ী।
নীল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অধরে সুক্ষ্ম হাসি টেনে সুডোল স্বরে বলল, “আমি জানতে চাচ্ছি তুমি কী চাও?”

চোখের পাতা কেঁপে গেলো ত্রয়ীর। বড়োবড়ো চোখে তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে।
নীল ভ্রু তুলে আবার নামালো।
ঢোক গিললো ত্রয়ী। নাকমুখ ঘেমে উঠলো নিমিষেই। চোখ নামিয়ে কাঁপা চোখের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নিজের কোলের দিকে।
নীল স্থির, বিমোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ওকে। কিছুক্ষণ বাদে নরম কণ্ঠে বলে উঠলো, “তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরি?”
বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠলো ত্রয়ীর। থমকে তাকিয়ে রইলো নিম্নপানে। হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। নীল শোনার অপেক্ষাও করলো না। একহাতে বুকে জড়ালো ওকে।
এতুটুকু ঘনিষ্ঠতায় সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো ত্রয়ীর। ঢোক গিলতেও গলায় আটকালো যেন।
নীল ওর গলার ভাঁজে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ডুবিয়ে দিতেই শিউরে উঠলো ও।
নীল প্রতিটি প্রশ্বাসের সাথে ওর শরীরের মিষ্টি মেয়েলি ঘ্রাণ নিলো।
ঘাড়ে, গলায় উষ্ণ নিঃশ্বাসের বহরে শরীর শিথিল হয়ে আসতে লাগলো ত্রয়ীর। ঠোঁটে ঠোঁট চিপলো ও। দুরুদুরু বুক, অশান্ত মন আর কম্পিত শরীরে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলো ত্রয়ী।
কিন্তু মিনিটের পরে মিনিট পেরিয়ে গেলেও লোকটার হুঁশ হলো না। যেমন ছিল তেমনই রইলো শুধু হাতের বাঁধন পূর্বের চেয়ে দৃঢ় করলো।
দোটানায় পড়ে গেলো ত্রয়ী। এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে লোকটা! ওর সুড়সুড়ি লাগছে খুব। আর এভাবে শক্ত হাতে আর কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলেই তো শ্বাস আটকে মরেই যাবে ও!

কাঁপা হাতের মুঠোয় নীলের বুকে ঠেস দিলো ত্রয়ী। মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল, “ছাড়ুন। লাগছে আমার।”

ঘোর কাটলো নীলের। হাত আলগা করলো তাড়াতাড়ি। মুখ তুলে তাকালো ত্রয়ীর দিকে। চোখাচোখি হলো। প্রতিবারের ন্যায় চোখ সরিয়ে নিলো ত্রয়ী। বেশ লজ্জাও পেলো। আলগোছে গালের পাশে চুলগুলো কানের পিছনে গুজলো।
নীল নৈশব্দে হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে।
আচমকা ত্রয়ীর দিকে ঝুঁকে এসে অভাবনীয় কাজ করে বসলো একটা।গল্পের নাম : #কিছু_জোড়াশালিকের_গল্প
পর্ব ১৭ : #প্যাচ
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)

“এখানে কী করছ তুমি?”
হালকা চমকালো তিয়াসা। তাকালো পিছন ফিরে। সামান্য দূরত্বে প্রয়াসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসলো কোমলভাবে। চোখের ইশারা করে পুনরায় ঘুরলো সামনের দিকে।
ভ্রুকুটি করলো প্রয়াস।
অফিস থেকে ফিরে তিয়াসাকে বাগানে দেখে বেশ অবাক হয়েছে ও। মেয়েটা এই ভরসন্ধ্যাবেলা বাগানে কী করছে!
দেখার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ালো প্রয়াস।
ছোট ডালিম গাছটার উপর বিছানো জালে একটা শালিকের পা জোড়া আটকে আছে। সেটাই ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করছে তিয়াসা। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। পাখিটার পায়ের সাথে বেশ জটিলভাবে আটকে আছে জালটা। যতটুকুওবা তিয়াসা ছাড়াচ্ছে, পাখিটার ছটফটানিতে সেটুকুও আবার জড়িয়ে যাচ্ছে।

এতসময় চেষ্টা করেও যখন হলো না তখন মুখটা মলিন করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তিয়াসা। যেন ওর পা-ই আটকে গেছে।
“আমি এটাকে ধরবো না।” আবদার বুঝে সরাসরি বলে দিলো প্রয়াস।
হতাশ হলো তিয়াসা। ঠোঁট উলটে ফের নিজেই চেষ্টা করতে লাগলো। পাখিটা বড্ড বেশি অস্থির। ছটফটিয়ে উঠে তিয়াসার আঙুল কামড়ে দিচ্ছে। হয়তো ভয়ে। কিন্তু তিয়াসা তাও হাল ছাড়ছে না। বিরক্ত বা ব্যথাবোধও করছে না।

প্রয়াস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। হাতে ঝুলানো কোটটা তিয়াসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ভারি স্বরে বলল, “ধরো এটা।”
তিয়াসা তাকালো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে।
প্রয়াস কোটটা তিয়াসার ডান কাধে রেখে ওর হাতের ভাঁজ থেকে পাখিটাকে ছাড়িয়ে নিলো।
তিয়াসা ড্যাবড্যাব করে তাকালো। একটু আগেই না সে বলল এটাকে ধরবে না! এখন আবার ঠিকই ধরলো!
প্রয়াস সময় নিয়ে জালটা ছাড়াতে লাগলো পাখিটার পা থেকে। কিন্তু পাখিটা উপকার বুঝলো না। কামড় দিলো প্রয়াসকেও। সে ভ্রুকুটি করে পাখিটার দিকে তাকাতেই খানিক ভড়কালো তিয়াসা। হাত বাড়িয়ে ঠোঁট চিপে ধরলো পাখিটার।
ওর দিকে তাকালো প্রয়াস। চোখাচোখি হতেই নৈশব্দে হাসলো তিয়াসা। যেন বলতে চাইলো, ‘পাখিটা একটু বোকা, তাই কামড়ায়।’

বেশ সময় লাগলো জালটা ছাড়াতে। নির্ঘাত রেখাই জাল দিয়ে রেখেছে পাখিরা ডালিম নষ্ট করে বলে। সেই সুবাদেই ডালিম খেতে এসে এই পাখিটা ধরা পড়েছে।

পাখিটাকে সম্পূর্ণভাবে ছাড়িয়ে নিতেই মুখটা খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠলো তিয়াসার। প্রয়াসের হাত থেকে নিজের হাতে নিলো পাখিটাকে।
“কী করবা এটাকে এখন?” জিজ্ঞেস করতে করতেই পাখিটাকে মুক্ত করে দিলো তিয়াসা।
ফুড়ুৎ করে উড়াল দিলো সে। আমগাছের উপর গিয়ে বসলো, তার সঙ্গিনীর পাশে। যে বিচলিত হয়ে অপেক্ষা করছিলো তারজন্য।
তিয়াসা মুক্ত চাহনিতে অবারিত হাসি হেসে প্রয়াসের একবাহু টেনে অন্যহাতে ইশারা করে দেখালো পাখিদুটোকে।
প্রয়াস তিয়াসার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর তাকালো সেদিকে।
“দেখা হলে চলো ভিতরে। সন্ধ্যার সময় এখানে বের হয়েছ কেন? সন্ধ্যার সময় বের হবা না।” গাঢ় স্বরে বলল প্রয়াস।
তিয়াসা চোখ পিটপিটিয়ে হালকাভাবে মাথা নাড়লো।

🌸
“আমি কি জানতাম নাকি যে ক্যান্ডেলই সেই মেয়েটা। আর তাছাড়া তোমার মাকে এমনিই আমি আসতে বলেছিলাম যাতে এই সুবাদে তোমার সাথে সব মিটমাট হয়ে যায়। কে জানতো এসেই এমন একটা ঝামেলা হবে।” ঠোঁট উলটে বলল জয়িতা।

ইভান দুই হাঁটুর উপর হাত ভাঁজ করে রেখে তাতে মুখ ঢেকে আছে। প্রচন্ড বিরক্ত সে।
জয়িতা এক পা এগিয়ে এলো। তারপর স্বর নামিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল, “বিয়েটা করে নিলেই তো পারো। এভাবে আর কতদিন! অবিবাহিত অবস্থায় এমন সম্পর্ক রাখা ঠিক না। হ্যাঁ, মানছি যে ও ছোট থেকে বাহিরের দেশে ছিল। তুমিও অনেক বছর বাহিরে পড়াশুনা করেছ। সেখানে এসব কিছুই না। কিন্তু আমাদের দেশে তো তেমন না বলো! আমাদের দেশে থাকতে হলে বিয়ে করে থাকতে হয়।”
ইভান দাঁত কিড়মিড়িয়ে মুখ তুলে তাকালো জয়িতার দিকে।
চোখ বড়োবড়ো করলো জয়িতা। অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমাকে কেন রাগ দেখাচ্ছ বলো তো! আর যতই যা বলো না কেন ঠাকুরপো, সে আমার মাসির মেয়ে। তাকে তুমি এভাবে ছেড়ে দিতে পারো না। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে।”

জয়িতার উলটো-পালটা কথায় প্রচন্ড রকমের বিরক্ত হয়ে উঠলো ইভান। ধপ করে উঠে বেরিয়ে গেলো রুমটা থেকে।
“আরে আরে! কোথায় যাচ্ছ তুমি?” পিছু পিছু এগিয়ে এলো জয়িতা।

ড্রয়িং রুমে থম মেরে বসে ছিলেন ইশারা। পাশেই ক্যাথি। ক্যান্ডেল উপরে চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই।

ইভান পাশের রুমটা থেকে বেরিয়েই তাদের মুখোমুখি হলো পুনরায়। অস্বস্তিকর মূহুর্তের সৃষ্টি হলো যেন।
ততক্ষণে জয়িতা এসে দাঁড়িয়েছে ইভানের পাশে।
‘ঠাকুরপো’ বলে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ইভান বেজার দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। কেন জানি ওর সব দোষ জয়িতাকেই দিতে ইচ্ছে করছে।
না জয়িতা এখানে আসতে বলতো, আর না এসব হতো! কিন্তু এখন এসব ভেবে লাভ নেই। তাই জ্বালাময়ী এক নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ইভান বেরিয়ে গেল বাসাটা থেকে।
জয়িতা পিছু ডাকলো কয়েকবার। এগিয়ে গেলো দরজা পর্যন্ত। ইভান তোয়াক্কা করলো না।
ছেলের এমন বেপরোয়া ব্যবহারে ইশারার গমগমে মুখটা আরো গুমট হয়ে এলো।

🌸
বিছানায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়লো ইভান। মুক্ত এক শ্বাস ফেলে পকেটে অনবরত ভাইব্রেট হওয়া ফোনটা বের করে হাতে নিলো। তবে স্ক্রিনে জয়িতার নামটা দেখে ধপ করে রেখে দিলো বিছানায়। মুখ দিয়ে শব্দ করলো অপছন্দসূচক।
কপালে হাত তুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করতে না করতেই সেই অপ্রীতিকর মুহূর্তগুলো ভেসে উঠলো চোখের পাতায়।
চট করে হাত সরিয়ে চোখ খুললো ইভান। বেজার অস্বস্তিতে পড়ে কপালে ভাঁজ ফেললো কয়েকটা।

সে মোটেও ওইসময় ওখানে উপস্থিত থাকতেই চায় নি। শার্টটা শুকাতে দিয়ে অপেক্ষা করতে গিয়ে ওই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও।
ঘুম ভেঙেছিল ভরসন্ধ্যায়, আচমকা দরজা বন্ধের আওয়াজে। চোখদুটো কুচকে ঘুমঘুম দৃষ্টিতে চোখ মেলেছিলো ও। সময় নিয়ে ঘুমের রেশ কাটিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়েই থমকে গিয়েছিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোদস্তুর বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো। সম্পূর্ণ বিষয়টা মস্তিষ্ক সচলভাবে ধারণ করতেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছিলো ও। যদিও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
মেয়েটা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়তেই তাকে কোনোরকম অস্বস্তিতে না ফেলার জন্যই তখনি বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলো ইভান।
কিন্তু কপাল ছিল তার ষোলোআনাই খারাপ। বেলকনিতে থেকে শার্টটা নিয়ে যেই না বের হলো ওমনি তার মুখোমুখিই হতে হলো আবার। একদম সরাসরি।
তারপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে গেল। কিয়ৎপলের মধ্যেই ইশারা জল ঘোলা করে ফেললো। সে যে ওই মুহূর্তেই ওখানে উপস্থিত হতে পারে সেটা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি ইভান।

ইভান উঠে বসলো। বাজতে থাকা ফোনটা একেবারে বন্ধ করে ঢুকে গেলো ফ্রেশ হতে।

🌸
“আপামনি খাবার।” রাশেদা খাবার হাতে ঘরে ঢুকলো। পুরো ঘর অন্ধকার দেখে বলল, “এত আন্ধার কইরা রাখছেন ঘরডা! কিছুই তো দেহি না।”
ক্যান্ডেল চুপচাপ উলটো পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে ছিল। রাশেদার স্বর শুনে বেশ বিরক্ত হলো।
প্রথমত একে একশোবার বললেও, সে নক করে ঘরে ঢোকে না। আর দ্বিতীয়ত ওকে কোনো জিনিস মানা করলে সেটা ওর গায়েই লাগে না।
এই যেমন একটু আগেই খাবার হাতে বিদায় করেছে। বলে দিয়েছে খাবে না। তবুও আবার এসেছে এই মেয়ে।
ক্যান্ডেল রাশেদার কথার কোনো উত্তর দিলো না। ধুম ধরে শুয়ে রইলো।
রাশেদাও নড়লো না। উত্তরের অপেক্ষায় ‘আপামনি আপামনি’ বলে ঘ্যানঘ্যান করেই চললো।
বাধ্য হয়েই মুখ খুললো ক্যান্ডেল। গনগনে গলায় বলল, “একবার বলেছি না, খাব না?”
“খালাম্মার উপরে রাগ করছেন? রাগ কইরেন না। আস্তে আস্তে সবাই মাইনা নিবো। প্ররথম প্ররথম এট্টু এমন করেই সবাই।”
ভ্রুদুটো কুঞ্চিত হলো ক্যান্ডেলের।
“কী মেনে নেবে?”
রাশেদা একটু লজ্জা পেলো বোধহয়। নাজুক স্বরে বলল, “আবার জিগায়! আপনাগো দুইজনকে।”
মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়লো ক্যান্ডেল। চট করে উঠে বসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালতে জ্বালতে রাশেদার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো, “মানে!”
“আরে আপামনি আপনের বিয়ার কথা কইতাছি। আপনার আর আপনার ‘হের’। সবাই মাইনা নিবো। একটু খালি সবুর করেন।”
হা হয়ে গেলো ক্যান্ডেল। ভ্রুতে ভাঁজ পড়লো। অবাক কণ্ঠে বলল, “কীসের মেনে নেওয়া? আর কীসের বিয়ে? এসব ফালতু কথা কে বলছে?”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো রাশেদা। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপর বুঝতে পারার মতো করে বলল, “ভাইয়ের লগে রাগারাগি করছেন নাকি! হয় হয়, আমারো হয়।”
আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল রাশেদা।
বেজার বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকালো ক্যান্ডেল। গমগমে স্বরে বলে উঠলো, “কে তোমার ভাই? অদ্ভুত তো! বেশি কথা না বলে এখান থেকে যাও। যাও।”
থতমত খেয়ে গেলো রাশেদা।
“খাওন?”
“নিয়ে যাও।” দারাজ কণ্ঠে ধমকে উঠলো ক্যান্ডেল।
অতিরিক্ত কথা বলে এই মহিলা।

🌻
তিয়াসা পাশে এসে দাঁড়াতেই তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে আয়নায় ওর দিকে তাকালো প্রয়াস৷
তিয়াসা স্নিগ্ধ, নীরব হাসি হেসে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনি হাতে নিতেই সন্ধিহান দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো প্রয়াস।
তিয়াসা এগিয়ে এলো ওর কাছে। বিনাবাক্যে দুই পায়ের পাতার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে উঁচু হলো খানিক। একহাত প্রয়াসের কাধের উপর রেখে অন্যহাতে মাথায় চিরুনি করে দিতেই হতভম্ব হয়ে গেলো প্রয়াস। তোয়ালে ধরে রাখা হাতটা আস্তে আস্তে নেমে গেলো নিচে। বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো কতক্ষণ।
তিয়াসা যেমন পারলো তেমনভাবে মাথা আঁচড়ে দিলো।
তারপর কাধ থেকে হাত সরিয়ে ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে পরখ করে দেখে নিবদ্ধ ঠোঁটদুটো প্রশস্ত করে হাসলো।
বোকা হয়ে পলক ঝাপটালো প্রয়াস। নিজেকে সামলে খুকখুক করে গলা ঝাড়লো। গম্ভীর গলায় বলল, “তোমাকে এসব কে করতে বলেছে?”
বলেই সে চুল নেড়েচেড়ে ফের অগোছালো করে ফেললো। তোয়ালে টাঙিয়ে দিতে চলে গেলো বারান্দায়।

তিয়াসা আশাহত হয়ে তাকিয়ে দেখলো। ম্লান হয়ে এলো মুখখানা। ও ভেবেছিলো প্রয়াস খুশি হবে।
প্রয়াস বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকলো। তিয়াসাকে চুপসানো মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, “ঘুমাতে যাও। রেখা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”

তিয়াসা গমগমে হয়ে নাখুশ চাহনিতে তাকালো। প্রয়াস গাঢ় স্বরে ফের বলল, “ঘুমাবা না? অনেক রাত হয়ে গেছে। রেখা বসে আছে।”

প্রয়াসের কথার মাঝেই গটগট করে ওর বিছানায় গিয়ে উঠলো তিয়াসা। অভিমানী মুখটা ফুলিয়ে পাতলা চাদরটা গায়ে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো ধপ করে। অর্থাৎ সে যেতে নারাজ।
হতভম্ব হয়ে চেয়ে দেখলো প্রয়াস৷ মেয়েটা বড্ড বেশি জেদি।
প্রয়াস ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ধীর, অপরিবর্তনীয় অভিব্যক্তিতে বলল, “তোমাকে না বলেছি রেখার সাথে ঘুমাতে?”
তিয়াসা কানে না শোনার মতো করে চোখ চিপে বন্ধ করে রইলো।
“আমি জানি তুমি ঘুমাও নি। ওঠো আর চলো।” থমথমে গলায় বলল প্রয়াস।
তিয়াসা নড়লো না।
প্রয়াস ওর গা থেকে কাথাটা সরিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় বলল, “আমি দিয়ে আসি চলো।”
তিয়াসা চোখ খুললো। তবে অভিমানে ভরা চোখদুটো নত রাখলো। প্রয়াস সবসময় শুধু ওকে তাড়িয়েই দিতে চায়। খুব খারাপ সে। একটুও ওকে পছন্দ করে না, বন্ধু ভাবে না।
একগাদা অভিযোগ জমা হলো ওর মনের কোণে। মুখটা ভার হয়ে এলো।
প্রয়াস আলতো করে ওর হাতটা ধরে ওকে উঠিয়ে বসাতেই চোখের জল ছেড়ে দিলো ও। টপ করে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো প্রয়াস। ওকে কাঁদতে দেখে নিজের অজান্তেই হড়বড়িয়ে বলে ফেললো, “কোথাও যেতে হবে না। এখানেই থাকো তুমি।”

(চলবে…)

(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here