কুঞ্জছায়া পর্ব ২১+২২+২৩

##কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব২১
(কপি করা নিষেধ)
সকাল গড়িয়ে দুপুর প্রায়।বৃষ্টি থেমে গিয়েছে অনেক্ষণ।
সূর্য যেমন দ্বিগুন তেজ নিয়ে জেগে উঠেছে।এই বৃষ্টি তো এখন আবার তীব্র রোদ।আশুগঞ্জ স্টেশনে আসতেই অরন্য ছায়াকে নামতে বলে।সে ছায়ার হাত ধরে নামাতে গেলে ছায়া অরন্যের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু অরন্য ছাড়ার জন্য ধরেনি সে আরো শক্ত করে হাত ধরে।পরে সাবধানে অন্য হাতে নিজের আর ছায়ার ব্যাগ দুটো নিয়ে ট্রেন থেকে নামে।
ট্রেন থেকে নামতেই তীর্যক সূর্য রশ্মি চোখে এসে লাগে।ছায়া হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে দাঁড়ায়।আর অরন্য তা চেয়ে চেয়ে দেখে।ভালোবাসার মানুষের সব কিছুই বুঝি সুন্দর লাগে!
ছায়া একটা রিকশা ডাকে।স্টেশন থেকে খুব বেশি দূরে না ছায়াদের বাড়ি।
-আপনি এইবার চলে যান।
-আমি কি আপনার বাড়ি যাচ্ছি নাকি?পুরা শহরটাই কি আপনার নাকি মিস।আমার ইচ্ছে হলে থাকবো।নয়তো চলে যাবো
ছায়া দাঁত কটমট করতে লাগলো।একটা ঝামেলা না বাধিয়ে এই লোকের শান্তি হবে না।

ছায়া রিকাশায় উঠলো।
অরন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে এসে ছায়ার পাশে বসলো।
প্রথমেই উঠতে চাইলে ছায়া উঠতে দিতো না।তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন

-একি একি এই চলন্ত রিকশায় কেউ উঠে নাকি।হাত পা ভেঙে গেলে কি হতো?পাগল হয়ে গিয়েছেন নাকি।
আতংকিত ছায়ার চোখ মুখ।
অরন্য বেশ জোরেই হেসে দিলো।
-আপনি আমার কেয়ার কবে থেকে করছেন মিস?আমার হাত পা ভাঙলে আপনার কি?আপনি তো আমাকে বিয়ে করবেনই না।
অরন্য হাসতে লাগলো।
-আপনাকে এইসব মানায় না ডাক্তার সাহেব।নিজের বাড়ি ফিরে যান।এই শহরে আপনার কেউ নেই।আপনি থাকবেন কোথায়?ঝোঁকের বশে না হয় চলে এসেছেন।দয়া করে এখন চলে যান।আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না।

-আমার অনুভূতি আপনার শুধু আবেগ মনে হচ্ছে ছায়াকরী?আমার ভালোবাসা আপনার চোখে পড়ছে না?আমি টিনেজার নই।আমি প্রাপ্ত বয়স্ক এক যুবক।তাকান আমার দিকে।
ছায়াকে অপর হাত দিয়ে টেনে কাছে আনলো। তার চোখের দিকে চোখ রাখলো।
ছায়ার শরীর অনুরণিত হলো।নিঃশ্বাস হলো ঘনতর ।
এই গুমোট অনুভূতি সে চায় না।অরন্যের এই হুটহাট আগমন তার এতো বছরের সংযমে বাধা দিচ্ছে।

-কি দেখতে পাচ্ছেন এই চোখে?শুধুই আবেগ?ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছেন না?আমার বুকের ভিতরের হাহাকার শুনতে পাচ্ছেন না?আমি যে আপনার ভালোবসার কাঙাল ছায়াকরী।
এইটা বলেই হুট করেই চলন্ত রিকশা থেকে নেমে গেলো অরন্য।ছায়া ভড়কালো,বেশ ভয় পেলো।তড়িৎ গতিতে সে রিকশার ফুট নামিয়ে পেছনে তাকালো।অরন্য দাঁড়িয়ে আছে মুখে হাসি নিয়ে।
ছায়া তাকাতেই অরন্য চিৎকার করে বলছে,
-অবশেষে আপনি পিছু ফিরে তাকালেন ছায়াকরী। এইভাবেই আমি আপনাকে আমার ভালোবাসার কাছে টেনে আনবো একদিন।
ছায়া ক্ষণপ্রভার ন্যায় সামনে ফিরলো।হাত দিয়ে আচমকা বুক চেপে ধরলো।ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলো।
অরন্যের প্রতিটা কথাই তার বুকে গিয়ে লাগলো।কর্নগহ্বরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো অনবরত।সে কি আসলেই আস্তে আস্তে নরম হয়ে যাচ্ছে?
রিকশা এসে থামলো ছায়াদের বাড়ির সামনের।ছায়াদের বাড়ির বেশ নাম ডাক এলাকায়।হাজী বাড়ি বলে সবাই চিনে।ছায়া রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলো।
ছায়াদের বাড়িটা দ্বিতল ভবন।বাড়ির পাশেই বকুল ফুলের গাছ।বাড়ির আঙিনায় রয়েছে ছায়া আর রোজের হাতে লাগানো গোলাপ,সন্ধ্যা মালতী,চেরি, কামিনী, বেলী ফুলের গাছ।ছায়া বাড়ি থাকতে সে নিজেই এইসবের পরিচর্যা করতো।কিন্তু তার অনুপস্থিতে রোজই এইসব দেখাশোনা করে।
বাড়িতে ঢুকতেই রোজ কোথা থেকে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে।
-আপু তুমি এসেছো।আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।এইবার তাড়াতাড়ি ফিরতে দিবো না।আমরা খুব মজা করবো।
রোজ এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ছাড়লো ছায়াকে।রোজের চোখে মুখে বিরাজ করছে অনাবিল হাসি,প্রফুল্লতা। বহুদিন পর প্রাণপ্রিয় বোনকে কাছে পাবার তীব্র আনন্দ।
ছায়া রোজের ললাটে দীর্ঘ চুম্বন দেয়।মাথায় আদুরে হাত বিলিয়ে উত্তর দেয়,
-আমি তেরো দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি।এইবার আর জলদি যাচ্ছি না।
রোজ যেনো খুশিতে আত্মহারা।সে চিল্লিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুললো।তার চিৎকার চেঁচামিচিতে ছায়ার মা মীরা বেগম নিচে নেমে আসলেন।মেয়েকে বহুদিন পর দেখে আবেগে আপ্লুত হলেন।মান অভিমান ভুলে মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।
-আসবি বলে আসবি না?চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে একবারে।ঢাকা কি খাওয়া দাওয়া করিস না।তুই গিয়ে রুমে গিয়ে গোসল কর।আমি রান্না বসাচ্ছি।
মীরা বেগম চিৎকার করে কাজের মেয়ে তুশিকে ডাকলো।
-কইরে তুশি ফ্রিজ থেকে মাংস আর মাছ বের কর,সবজি গুলো কেটে রাখ ছায়া এসেছে।
রোজ গিয়ে বাবাকে ফোন দিলো।বাবা অফিসে আছে।সন্ধ্যায় বাড়ি আসবে।রোজ বাবাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয় ছায়া এসেছে।রেজাউল সাহেব এইবার তাড়াতাড়ি যেনো বাড়ি ফিরে আসে।ছায়ার মনটা খুশি হয়ে গেলো যেনো সব আগের মতো পেয়ে।মানুষ পরিবর্তনশীল। হয়তো তারাও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তাই সব ঠিক করতে চাইছে।কিন্তু তার মনে যে ক্ষত হয়েছে সেই ক্ষত পূরণ হবে কিভাবে?
ছায়া নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
নিজের রুমে পা রাখতেই ছায়ার মনে ভালোলাগা ছুয়ে গেলো।কতোদিন পর কতোমাস পর এসেছে।সব আগের মতোই আছে।শুধু সে নিজেই বদলে গেলো।
#চলবে
(ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই।আর এতো অধৈর্য্য কেন সবাই হু?
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২২
(কপি করা নিষেধ)

মেয়েকে কাছে পেয়ে রেজাউল সাহেব আবেগে আপ্লুত হলেন।মেয়ে দূরে একা থাকলে বাবা মায়ের যে কেমন দুশ্চিন্তা হয় সেটা কেবল বাবা-মায়েরাই বুঝে। ছোট মেয়ের কল পেয়ে তিনি বাজার করে দ্রুত বাসায় আসে।
-কই গো মীরা এদিকে এসো
বেশ উত্তেজিত হয়েই রেজাউল সাহেব স্ত্রীকে ডাকলেন
মীরা বেগম মাত্রই সারাদিনের পর বিছায়ায় পিঠ লাগিয়েছিলো স্বামীর এমন ডাক শুনে গিয়ে দেখে কতো বাজার সাজার।বুঝলেন মেয়ে আসার খুশিতে এইসব।মেয়ের মনটা এইবার গললেই হয়।
মীরা বেগম রেজাউল সাহেবের হাত থেকে বাজারগুলো নিয়ে বললো,
-আপনার মেয়ে এসে খেয়েদেয়েই ঘুম দিয়েছে।গিয়ে দেখে আসুন।সারাদিনের ধকল শেষে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো।
রেজাউল সাহেব ধীর পায়ে মেয়ের ঘরের দিকে গেলেন।ছায়ার ঘরটা দোতলায় দক্ষিণমুখি।
তিনি দেখলেন মেয়ে লাইট নিভিয়ে ঘুমিয়ে আছে।জানালা দিয়ে থেকে থেকে আলো আসছে।মেয়ের মুখটা এইটুকুন আলোই দেখার চেষ্টা করলেন।চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে।মেয়ের পাশে বসলেন।ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন।
ছায়া ঘুমের মধ্যেই বুঝলো কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তার ঘুম খুব পাতলা। কিঞ্চিৎ শব্দেও ঘুম ভেঙে যায়।ছায়া পিটপিট করে চোখ খোলে বাবাকে দেখে চোখে হাসে।
-এই যা মামুনি ঘুম তো দেখি ভেঙে গেলো।
-ব্যাপার না বাবা।কেমন আছো?আজ এতো জলদি বিকেল বিকেল অফিস থেকে চলে এলে যে?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। অফিস থেকে চলে এসেছি।এতোদিন পর এলে তাই চলে এলাম।কিন্তু তোমাকে দেখে ঠিক লাগছে না।রাতে কি ঘুম কম হয়?
-আমি একদম ঠিক আছি।পরীক্ষার জন্য একটু আধটু রাত জাগতে হয়েছে তাই এমন লাগছে।
-আজ তোমার ফুপু আসবে।সাথে কিয়ারা আসবে।
ওদের আসার কথা শুনে ছায়া মৌনতা অবলম্বন করলো।
রেজাউল সাহেব বুঝলেন।
-মাত্রই এলাম অফিস থেকে আমি গিয়ে হাত মুখ ধুচ্ছি।তুমি ঘুমাও।
ছায়ার আর চোখে ঘুম আসবে না।বাবা চলে গেলে সে আস্তে আস্তে উঠে জানালার পাশে যায়।আকাশের দিকে তাকায়।বৃষ্টি হবার দরুন আকাশ বেশ পরিষ্কার।মেঘের কোন আনাগোনা নেই।কয়েকটা নাম না জানা পাখি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।হঠাৎই তার মনে হয় অরন্যের কথা।বাড়িতে গেলো ঠিকভাবে নাকি জেদ ধরে এইখানেই পড়ে থাকবে।চিল্লা চিল্লির আওয়াজে ছায়ার মনোযোগ ছিন্ন হয়।নিচ থেকে আওয়াজ আসছে।সে নিচে যায়।গিয়ে দেখে তার ফুপু রোওশনারা বেগম এসেছে।ফুপুকে তার একদমই পছন্দ না।মহিলাটা খুবই চতুর আর লোভী।কাউকে ছোট করতে দুইবার ভাবে না নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।তাকেও তো কম নাজেহাল করেনি।ড্রয়িংরুমে যেমন মাছের বাজার বসেছে।ছায়ার বিরক্ত লাগছে।ছায়ার দাদী হামিদা বানু, ছোট চাচী মালাও এসেছে।দাদী হামিদা বানু খুবই ভালো মানুষ।নিজের পরিবারকে ভীষণ ভালোবাসে।ছায়াকে নাতি নাতনীদের মধ্যের যেন একটু বেশিই স্নেহ করেন।তাই বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও এসেছেন।হামিদা বানু ছোট চাচা মিজান হকের সাথেই থাকেন।মিজান হকের বাড়ি ছায়াদের পাশের বিল্ডিংটাই।মিজান সাহেবের দুই মেয়ে এক ছেলে।মেয়ে দুইটা ছায়ার ছোট ।মিম,ঝিম একই ক্লাসে পড়ে।ক্লাস এইটে।ওরা জমজ।আর ছেলেটা সব চাইতে ছোট।ক্লাস ফাইভে পড়ে রোহান।রোওশানা বেগমের এক ছেলে এক মেয়ে কিয়ারা আর রবিন।মেয়েটা এইবার ইন্টারে পড়ে।আর ছেলেটা ছায়ার বড়।মাস্টার্সে পড়ে।
রোওশানারা বেগম এসেই ছায়ার মা মীরা বেগমকে বললেন,
-ভাবী কেমন আছো তোমরা?শুনলাম ছায়া এসেছে।তা সে কই?বয়স তো কম হলো না।কলঙ্ক তো আছেই।বিয়ে শাদি হবে নাকি সন্দেহ।আরো বয়স বাড়লে তো সম্ভাবনাটাও থাকবে না।
মীরা বেগম খুব রেগে গেলেও প্রকাশ করলেন না।মীরা বেগম ভীষণ কঠিন প্রকৃতির মহিলা।মেয়েদের সব সময় নজরে নজরে আর কঠোর নিয়ম শৃংখলার মধ্যে বড় করেছেন।মেয়েদের খুব ভালো করে চিনেন তিনি।মেয়েদের সামনে এতো ভালোবাসা প্রকাশ করেন না ঠিকি কিন্তু মেয়েদের ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ফোটা ছাড় দেন না তিনি।মেয়েদের সুখী দেখতে চান তিনি।
মীরা বেগম দাপটের সাথেই জবাব দিলেন,
-কি যে বলেন না আপা।ছায়ার বয়স বেশি হলো কোথায়?মাত্র ২৩। খুব বেশি বয়স না।আর বিয়ের কথা বললে মেয়ের আমার খুব বড় বড় ঘর থেকে বিয়ে আসে।ওর পড়াশোনার জন্য দেই না।
রোওশানা বেগম দমে গেলেন।তিনি সব সময় চাইতেন তার ছেলে রবিনের সাথে বিয়েটা দিতে।কিন্তু কিছুতেই ভাই আর ভাবীকে রাজি করাতে পারেন না।
মালা এইবার মুখ বাকিয়ে বলেন,
-ভাবী কেউ জেনে শুনে এই মেয়েকে ঘরে তুলবে?যে সব বিয়ে আসে তারা মনে হয় জানে না।জানলে আর আসতো না।
রোওশানা বেগমের মুখটা চকচক হয়ে যায়।এইবার তিনি একটা সুযোগ পেয়েছেন।
-হ্যা ভাবি বলছিলাম কি আমি ছায়াকে নিজের মেয়ের থেকে কম দেখি না।আমি সব জেনেই ছায়াকে ঘরে তুলতে চাই।
এইবার মীরা বেগম ভয়ানক রেগে গেলেন।অগ্নিঝরা কন্ঠে উত্তর দিলেন,
-আমার মেয়েটা আমি আপনি সবার থেকে বেশি পবিত্র। ফুলের মতোই স্নিগ্ধ। কেউ আমার মেয়ের সম্পর্কে একটা বাজে কথা বললে আমি মেনে নিবো না আর।অনেক হয়েছে।এতোদিন চুপ ছিলাম।সবাই যা ইচ্ছা বলেছে আমার মেয়েকে।এইবার কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না।আপা আপনার ছেলেতো নেশা করে।বহু মেয়েলি বিষয়ে জড়িত।সেই খোঁজ রাখেন?
রোওশানা বেগম চোখ মুখ কুচকে বসে রইলেন।আর মালা কিছুটা ভয় পেলো।শত হলেও সে ছোট বউ।ভাবী মীরা বেগমের অনেক পরেই সে বিয়ে করে এসেছে।
হামিদা বানু এতোক্ষণ সব চুপচাপ শুনছিলো।
এইবার তিনি মুখ খুললেন।
-খবরদার কইতাছি আমার নাতনীডারে কেউ কটু কথা কবি না।আমার নাতনীডার মতো ভালা মাইয়া এই যুগে পাওয়া মুশকিল। যা হইছে তা নিয়তির দোষ।হেইর দোষ না।
ছায়া দূর থেকে দাদী আর মায়ের প্রতিবাদ শুনে কিছুটা শান্তি পেলো।কিছু বছর আগে এমন করলে হয়তো সে মানসিকভাবে স্টেবল থাকতো।সে আর ওদের সামনে গেলো না।নিজের রুমে পুনরায় গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
রাতে রোজ এসে দরজার অনবরত ঠকঠক আওয়াজ করছে।মেয়েটা এতো চঞ্চলা প্রকৃতির।একদম এক মিনিটও এক জায়গায় শান্তিতে বসতে পারে না দাঁড়াতেও পারে না।
ছায়া এসে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে ঘরে।
হাপাতে হাপাতে বলে,
-আপু খেতে আসো।
-তুই যা আমি আসছি।
#চলবে#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২৩
(কপি করা নিষেধ)
রাতে সবাই মিলে খেতে বসেছে।হামিদা বানু কয়েকটা দিন বড়ছেলে রেজাউলের কাছেই থাকবে।আজ বহুদিন পর পরিবারের সবাই একসাথে জমা হয়েছে।
-তা ছায়া মামনি পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
ছায়ার চাচা মিজান সাহেব আদুরে গলায় জানতে চাইলেন।
-জ্বি চাচ্চু ভালো হয়েছে।
– ছায়া তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?বিয়ে টিয়ে করবে না?
মালা যেনো ইচ্ছা করে ছায়াকে অপ্রস্তুত করতে চাইলো।
-আহ মালা মেয়েটা খেতে বসেছে কেন এইসব কেনো বলছো?সময় জ্ঞানটা আজও হয়নি তোমার।
মিজান সাহেব ধমক দিলেন নিজের স্ত্রীকে।বড্ড অপ্রয়োজনীয় কথা বলে।
রোওশানারা বেগম বেশ আক্রোশের সাথেই বলে উঠে,
-বিয়ে করবে কিভাবে পুরানো প্রেমিককে ভুলতে পারলে তো।
খাওয়ার টেবিলের সবাই কিছু সময়ের জন্য চুপ হয়ে গেলো।ছায়া নিজেও অবাকের শেষ সীমান্তে।একটা দিন নিজের বাসায় এসে শান্তি নেই।
এইবার হামিদা বানু নিজের মেয়েকে শাসন করলেন।
-কেউই ধোয়া তুলসি পাতা না রুশো।কথা সামলাইয়া কইবি।আমার নাতনী লাখে এক।একদম চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনাবি না।তোর ইতিহাস শুরু করলে শেষ হইবো না।
রোওশানারা বেগম দমে গেলেন।
মীরা বেগম সব শুনেও কিছু বললেন না।এইখানে বড়রা আছে তাই কিছু বলাটা ভালো দেখাবে না।তবে ঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকলেন।
-বড়দের খাবার শেষ হলে মিম,ঝিম,রোহান,রোজ, কিয়ারা বসে যাবে।আগে বড়দের খাবার দিয়ে নেই।মীরা বেগম বললেন।
-আহা আগে ছোটদের দিয়ে নিতে মীরা
রেজাউল সাহেব মীরাকে বললেন।
-ওদের খেতে অনেক দেরি লাগবে তাই বড়দের আগে দিয়ে নিয়েছি।
সবাই খেলেও ছায়ার আর খেতে ইচ্ছা করলো না।প্লেটে খাবার বাকি রেখেই উঠে গেলো।
-একি মা খাবার রেখে কোথায় যাচ্ছো।বসো খাবার শেষ করো।
-না বাবা পেট ভরে গিয়েছে।
ছায়া চলে যায় উপরে কারো কথা কানে না নিয়ে।এইখানে আর ওদের দেখতে ইচ্ছা করছে না।
রোহান,রোজ,মিম,ঝিম আর কিয়ারা খাবার শেষ করেই ছায়ার রুমে দৌড়। কাজিন মহলে ছায়া খুবই জনপ্রিয়। তাকে সবাই খুব ভালোবাসে।
সবাই এসেই ছায়াকে জড়িয়ে ধরলো।
-আপু আমরা জানো তোমাকে কতো মিস করেছি?এই এত্তোগুলা।
রোহান হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে ছায়াকে দেখিয়ে বললো।
ছায়া রোহানকে কোলে বসিয়ে বললো,
-তাই নাকি সোনা।আমিও তোমাকে এতোগুলা মিস করেছি।
এইটা বলেই রোহানের গালে টুপ করে একটা চুমো খেলো।
-এই ছায়া আপু তোমার চুল দেখি অনেক বেশি লম্বা হয়ে গিয়েছে।কি সুন্দর।
কিয়ারা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো ছায়ার চুলে হাত গুজে।
ছায়া কিয়ারাকে তার পাশে বসতে ইশারা করলো।বলতে দেরি হলো কিয়ারার বসতে দেরি হলো না।ছায়ার গা ঘেষে বসে গেলো।
মিম ঝিম তো ছায়ার বিছানায় উঠে ছায়ার চুলে হাত বিলানো শুরু করে দিলো।
-এই ছায়া আপু আমি বেনী করে দেই।
মিম এইটা বলতেই ঝিম না করে দেয়।সে বলা শুরু করে
-না ছায়া আপু মিম কে দিওনা।আমি করে দেই বেনী।
কে বেনী করে দিবে এইটা নিয়ে মিম ঝিমের মাঝে তুমুল ঝগড়া।মধ্যে দিয়ে রোজ এসে এই দুইজনকে টেনে বিছানা থেকে নামায়।ছায়া ওদের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করে।মিম ধরেছে ঝিমের চুলে আর ঝিম ধরেছে মিমের কাপড় লটকে।ছায়া কিছুতেই ওদের ফিরিয়ে রাখতে পাছনে না।শেষ অবধি একটা বিকট চিৎকার দেয় ছায়া।ওরা সবাই চুপ।এক একটা যেনো ফেরেশতা হয়ে গিয়েছে।
ছায়া মুচকি মুচকি হাসে।
-এই ঝিম এদিকে আয়।এই মিম তুইও এদিকে আয়।
মিম আর ঝিম গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ছায়ার দুইপাশে দাঁড়ায়।
-কাল সকালে বেনী করে দিবে মিম আর দুপুরে করে দিবে ঝিম।ওকে?
ওরা দুইজনে মাথা নাড়ায়।আবার একজন আরেকজনকে মুখও ভেংচি দেয় চোখ মুখ কালো করে
-আচ্ছা তবে তোরা গিয়ে খেলাধুলা কর।আমি একটু ঘুমাই।কাল আড্ডা দেওয়া যাবে।
ওরা চলে যেতেই ছায়া দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়ে।
….
অরন্য একটা হোটেল বুক করে নিয়েছে।কিছুদিন এইখানেই থাকবে।মেয়েটাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছা করছে না তার।কিন্তু ডক্টরদের নিজেদের ব্যক্তিগত লাইফ থেকে বেশি প্রায়োরিটি দিতে হয় রোগীদের।রোগীদের ভালোথাকা আর জীবন ডক্টদের উপর ডিপেন্ড করে।তাই চাইলেও অরন্য ২-৩ দিনের বেশি থাকতে পারবে না।এইসব ভাবতেই অরন্য হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে।
তখনই একজন কল করে অরন্যকে।নাম্বারটা আশিকের।
-দোস্ত।আহানের বিষয়ে কিছু পেয়েছি।ছেলেটা যেমন চরিত্রহীন তেমন মারাত্মক ডেঞ্জেরাস।অন্যের জমি দখল করা,মারামারি তো আছেই তবে আমি মনে করছি ছেলেটা মার্ডারের সাথেও যুক্ত থাকতে পারে।একটা ভালো মানুষির মুখোশ পড়ে থাকে সব সময়।প্রমাণ পাওয়া মুশকিল। তবে আমি চেষ্টা করছি।

অরন্য বেশ চিন্তিত হলো ছায়াকে নিয়ে এইসব শুনে।রাগের বশে ছায়া আহানকে সত্যিই বিয়ে করে ফেলবে না তো?
আশিক আবারও বললো,
-রিসেন্ট আহানের ডিভোর্স হয়েছে শুনলাম।
-কার সাথে হয়েছে কিছু জানিস?তার এক্স ওয়াইফের কন্টাক্ট ইনফোটা দিতে পারবি?
-হ্যা অবশ্যই।এইটা আর এমন কি!
-ধন্যবাদ রে।বাসায় আসিস ভাবীকে নিয়ে।
-হ্যা আসবো একদিন সময় করে।প্রান আর অভিক মিলে আয় আমরা একদিন বসি।
-আমি ঢাকায় ব্যাক করলে আড্ডা দেওয়া যাবে।
আরো টুকটাক কিছু কথা বলে অরন্য রেখে দেয়।তার আরও অনেক কিছু জানা বাকি।
আশিকের ফোন রাখতেই অরন্যকে অরন্যের বাবা ফোন দেয়।

-তুমি আমাদের কাউকে না জানিয়ে আশুগঞ্জ কেন গেলে? আজমির চৌধুরী বেশ গম্ভীর হয়েই প্রশ্ন করলেন ছেলেকে।
-২-৩ দিন পর চলে আসবো।আমার জীবনের সব চাইতে মূল্যবান কিছু খুঁজতে এসেছি।
-কোথায় থাকবে কিছু ঠিক করেছো?
-এইখানে একটা হোটেল বুক করেছি ওইখানেই থাকবো।
আজমির চৌধুরী ছেলেকে আর কিছু বললেন না।তিনি জানে তার ছেলে অহেতুক কিছু করে না।নিশ্চয় এমন কেউ ছেলের জীবনে আছে যার জন্য ছেলে চাকরি বাকরি ছেড়ে তার পিছনেই ছুটেছে।তিনি মনে মনে বেশ খুশি হয়েছেন।যাক ছেলেটার একটা ব্যবস্থা হলেই তিনি নিশ্চিন্ত হবেন।ছেলে যে কাউকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন।
এইদিকে অরন্যের মা কেঁদে কেটে একাকার তার ছেলেটা সবাইকে না জানিয়ে কোথায় গেলো।বড়োসড়ো কিছু হয়েছে কি?নইলে ছেলেতো এমন করার কথা না।
আজমির চৌধুরী নিজের স্ত্রীকে ডাকলেন,
-শুনছো জেসমিন নিজেকে শাশুড়ি হিসেবে তৈরি করতো দেখি।তুমি দেখি বুড়ি টুড়ি হয়ে যাচ্ছো।তোমার ছেলের বউ আসছে যে।এইভাবে কেঁদে কেটে বুক ভাসালে চলবে?
জেসমিন খাতুন অবাক হয়ে বললেন,
-ছেলের বউ,শাশুড়ি এইসব কি বলছেন আপনি?অরন্য কি মাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললো।
এইবার জেসমিন খাতুন পূর্বের থেকে অধিক স্বরে বিলাপ পেরে কাঁদতে লাগলো।
আজমির চৌধুরী স্ত্রীকে দেখে এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
-তোমার ছেলে তোমার পুত্রবধূ না আরেকটা মেয়ে আনতে গিয়েছে।
জেসমিন খাতুন এইবার কান্না থামালেন।
এর পরেই আত্মবিশ্বাসের স্বরে বললেন,
-সেটা আপনাকে বলতে হবে না।আমার ছেলের বউকে আমাদের অনুর মতোই ভালোবাসবো।সে হবে আমার আরেকটা মেয়ে।আমি কাঁদছি আমার দঃখে।আমার ছেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করে আর আমাকে বলেনি।আমি কি না করতাম?আমার ছেলের পছন্দ খারাপ হতেই পারে না।ঢাক ঢোল বাজিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসতাম।
এইবার তাহলে আমিও বুঝাবো আমি কি জিনিস।
জেসমিন খাতুন প্রাণকে ফোন লাগালেন।
প্রাণ ফোন ধরতেই অরন্যের মা বলা শুরু করলেন,
-পাজি ছেলে তুই সব জানতিস? আমাদের বললি না কেন? তোর একদিন কি আমাদের একদিন।
প্রাণ ঢোক গিললো।অরন্যের জন্য সে সব সময় ফেঁসে যায়।সে হতবাক হয়ে কেবল শুনতেই থাকলো অরন্যের মায়ের ঝারি।অবশ্য মা বেঁচে থাকলে হয়তো এইভাবেই তাকে বকতো।প্রাণের মায়ের কথা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বুকটা চিনচিন করে উঠে।
#চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here