কুঞ্জছায়া পর্ব ২৪+২৫+২৬

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২৪
(কপি করা নিষেধ)
..
৪:৩০ এর দিকে ফজরের আযান দিয়েছে।আজানের ধ্বনি কানে পৌছাতেই ছায়ার ঘুম ভেঙে গেলো।আড়মোড়া ভেঙে চোখ দুটো কচলে শোয়া থেকে উঠে বসে টেবিল হাতড়ে ঘড়িটা হাতে নিয়ে সময় দেখলো ছায়া।নামাজের জন্য অযু করে এসেই ফজরের নামাজটুকু আদায় করে নিলো।নামাজ শেষ হতেই প্রায় ৫ টা বেজে যায়।ছায়া ধীর পায়ে হেঁটে রুমের জানালাগুলো খুলে দেয়। সকালের নির্মল অক্সিজেনসমৃদ্ধ বায়ু ছায়ার গায়ে এসে লাগলো।ছায়া নাক টেনে একটা লম্বা শ্বাস নেয়।এর পর বেলকনির দিকে যায়।ছায়াদের বাড়ির আঙিনায় লাগানো বকুল গাছ থেকে সুমধুর ঘ্রাণ আসছে।চারিপাশ মো মো করছে।ছায়া গায়ে উড়না জড়িয়ে একটু ভোরের সকালটা উপভোগ করতে বের হলো।এই ভোরবেলার
প্রকৃতিকে তার অপূর্ব সুন্দর মনে হয়। পাণ্ডুর প্রকৃতির মধ্যে এক নীরব সৌন্দর্য দেখা যায় এই লগ্নে । এ সৌন্দর্য অনেকটা বিমূর্ত। প্রকৃতি যেনো আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মগ্ন হয়ে পড়ে ।পূব দিগন্তে সূর্য উঁকি ঝুকি দিচ্ছে।লাল রক্তিম আভায় ছেয়ে যাচ্ছে পূর্ব দিক।পাখির কলকাকলি কানে এসে বারি খাচ্ছে।ছায়া বকুল গাছের নিচে গিয়ে কিয়ৎক্ষন ফুল টুকালো।এরপর বাড়ির পিছনের দিকে দিলো।তাদের নিজেদের শান বাধানো দীঘি আছে।তার দাদাভাই আমজাদ হক থাকতে তিনি এটা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।এই বর্ষা মৌসুমে দীঘি যেনো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে।পানিতে টইটুম্বুর। ছায়া হাতে ফুলগুলো নিয়ে একটা কবরের দিকে হেঁটে গেলো।ফুলগুলো কবরের উপর রেখে মায়াময় কন্ঠে শুধালো,
-কেমন আছো অরূপদা?এই দেখো তোমার জন্য বকুল ফুল এনেছি।
এইটা বলেই হাটুমুড়ে মাটিতে বসে পড়লো কবরের পাশেই।উড়নার আজল থেকে আরো কিছু ফুল নিয়ে পুরো কবরজুড়ে ছড়িয়ে দিলো আদুরে হাতে।
এরপর বহুক্ষণ অনিমেষ তাকিয়ে থাকলো কবরপানে।
মনে করতে লাগলো তার ছোটবেলার কথা,তার পুরানো কালো অধ্যায়।
….
-ইশশ হচ্ছে না কোমল।ভালো করে লিখ।তুই তো দেখছি চাপের সূত্রই ভুলে গিয়েছিস।P=A/F হবে নাকি F/A হবে?
ছায়া চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রিয়ার খাতার দিকে।
রিয়ার খাতাটা দেখার চেষ্টা করতেই কেউ একজন তার মাথায় চাটি মারে।
-উফফ অরূপদা।ব্যাথা পেয়েছি।
অরূপ এইবার ভ্রুজোড়া কুচকে ছায়ার ন্যাকামোর দিকে তাকালো।
-এইটুকুতে কেউ ব্যাথা পায়?আমি তো জাস্ট একটু লাগিয়েছি মাত্র।আগে যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দে।
-ভুলে গিয়েছি অরূপদা।কাল না আমার নানু এসেছিল।আমার মামাতো ভাই বোন এসেছিল। তাই পড়া শিখতে পারিনি।মাকে বিচার দিওনা।প্লিজ
অরূপ একটু নরম হলো।
-সত্যিই ব্যাথা পেয়েছিস?
ছায়া অরূপকে মুখ ভেংচি দেয়।
রিয়া ছায়াকে চিমটি কেটে বলে,
-এই মেয়ে এতো নাটক কিভাবে করিস।আমি জানি তুই ব্যাথা পাস নি।
ছায়া রিয়াকে একটা চিমটির বদলে দুইটা চিমটি ফিরিয়ে দেয়।
রিয়া চিৎকার দিয়ে উঠে,
-দাদা এই ছায়া আমাকে কতো জোরে চিমটি দিয়েছে।
অরূপ একবার ছায়ার দিকে বিরক্তির নজর দেয়।মেয়েটা আজকাল বেশি পাজি হয়ে যাচ্ছে।ঠিক তখনই
ছায়ার মা মীরা বেগম মেয়ের খুঁজ করতে আসে অরূপদের বাড়ি।মেয়ে ঠিকভাবে পড়ছে নাকি।
মীরা বেগম ছিমছাম লম্বা গড়নের অরূপকে বেশ স্নেহ করেন।অরূপ সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও মীরা বেগমদের সাথে অরূপদের পরিবারের খুব ভালো সম্পর্ক।মেয়ের অতি ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রিয়ার ভাই।ছেলেটা মারাত্মক টেলেন্টেড।এইবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে। যদি মেয়েটাকে একটু পড়ায় রিয়ার সাথে সাথে। আর কয়দিন পরই এসএসসি পরীক্ষা ছায়াদের।তাই গণিতটা আর ফিজিক্সটা একটু করালেই ছায়া বেশ এগিয়ে যেতে পারবে।অরূপ আগেও মেয়েটাকে বেশ আদর করতো।পড়াতো নিজের বোনের সাথে।রিয়া আর ছায়ার যাতায়াত লেগেই লাগতো একজন আরেকজনের বাড়িতে।তাই অরূপ বাড়ি আসলেই দুটোকে কান ধরে পড়ায় বসাতো।মীরা বেগমের কঠোর আদেশ।সময় নষ্ট করা যাবে না।ভালো রেজাল্ট করতে হবেই।
-বাবা এই বাদরটা তোমাকে জ্বালাইনি তো?
মীরা বেগম বেশ স্নেহের সহিত অরূপের কাছে জানতে চাইলো।
অরূপ পশ্রয়ের হাসি হেসে বললো,
-না আন্টি।পড়া ঠিকভাবেই পড়ছে।আর না পড়লেও আমি আদায় করে নিবো।
-পড়া না পড়লে আমাকে ফোন দিয়ে বিচার দিবে।আর কান মলে দিওতো।ঢিঙি মেয়ে হয়েছে।এখনো নেচে বেড়ায়।একটা ইয়া বড় লাঠি দিয়ে যাবো।পায়ে মারবে পড়া না পারলেই।আর কয়দিন পরই পরীক্ষা।আর মাত্র ১০ দিন বাকি।টেস্ট পেপারের বোর্ডের কোশ্চেন গুলা তুমি নিজে হাতে ধরে শেষ করিয়ে দিবে।
অরূপ মীরা বেগমকে আশ্বস্ত করলো।
-আপনি চিন্তা করবেন না।আমার ছুটি আছে ১৫ দিনের মতো।এই ১৫ দিনে আমি চেষ্টা করবো।
মীরা বেগম চলে এলেন। যেনো বুক থেকে ভারি পাথর নেমে গেলো।পরীক্ষা মেয়ের কিন্তু তার যেনো চিন্তার শেষ নেই।
-শুনলি আন্টি কি বললো কোমল?ভালো করে পড়তো।আর কয়েকটা দিন পরিশ্রম করলেই A+ পেয়ে যাবি।পড়ে ভালো একটা কলেজে ভর্তি হয়ে যাবি।আর ভালো রেজাল্ট করলে তোদের দুইজনের জন্য সারপ্রাইজ আছে।
সারপ্রাইজের কথা শুনেই ছায়া আর রিয়ার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো।
এইবার তারা মন লাগিয়ে পড়বে।
পরীক্ষা এগিয়ে আসলো।ছায়া মন লাগিয়ে পড়তে লাগলো।দেখতেই দেখতেই পরীক্ষা কাছে চলে আসলো।অরূপও নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করলো।
পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে ছায়া বেশ নার্ভাস।ছায়া রিয়াদের বাড়ি গেলো।অরূপ একটা বই পড়ছিলো।ছায়াকে এতো নার্ভাস দেখে সে এগিয়ে এলো বইটা টেবিলের উপর রেখে।
-খুব নার্ভাস লাগছে তোকে?ভয় পাচ্ছিস?
ছায়া মাথা দুলালো।
এইবার অরূপ ছায়াকে বসতে ইশারা করলো।ছায়া বসলেই অরূপ ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-বোকা মেয়ে।পরীক্ষা হলো আনন্দের বিষয়।ভয় পাবার কি আছে?ভয় পাবে বোকা তুই কি বোকা?
ছায়া মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে বোকা না।
-পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি শেষ ততো তাড়াতাড়ি পড়া থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।ঘুরতে যেতে পারবি,মুভি দেখতে পারবি,হাসান মামার বাগানে হানা দিতে পারবি,আম চুরি কররে পারবি,মামা বাড়ি বেড়াতে যেতে পারবি।কতো কতো আনন্দ করতে পারবি একটু ভাবতো।তাই যত তাড়াতাড়ি পরীক্ষা শেষ হবে ততো তাড়াতাড়ি শান্তি।আবার পরীক্ষার সময় কতো কতো আদর পাওয়া যায়।পরীক্ষার হলের বাইরে মজার মজার স্ট্রেট ফুড পাওয়া যায়।
এইসব শুনে যেনো ছায়ার উচ্ছ্বাস ফিরে এলো।সে তো ভেবেই দেখেনি পরীক্ষার সময় এতো মজা।আর সে বোকার মতো ভয় পাচ্ছিলো।তার নিজের উপর খুব হাসি পেলো।যাক ভালো হয়েছে রিয়াটা দেখেনি।নয়তো খুব পচাতো।ছায়া দাঁত কেলিয়ে হাসে।
অরূপ একটা ব্রান্ডেড দামী ঘড়ি নিজের টেবিল ড্রয়ার থেকে বের করে ছায়ার দিকে এগিয়ে দেয়।
গিফট পেয়ে যেনো ছায়ার আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে যায়।সে ঘড়িটা হাতে নিয়ে লাফালাফি শুরু করে দেয়।
অরূপের বুকে যেনো প্রশান্তির পবন বয়ে যায়।মেয়েটাকে এইভাবে প্রানবন্ত ভাবে হাসতে দেখলেই যেনো তার শান্তি।তার বাচার প্রণোদনা ফিরে পায়।অরূপ হাসে নীরবে।
#চলবে #কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২৫
(কপি করা নিষেধ)
….
পরীক্ষার দিন সকালে ছায়ার মা নিজের হাতে মেয়েকে তৈরী হতে সাহায্য করলেন।প্রবেশপত্র,রেজিস্ট্রেশন কার্ড, কলম,পেন্সিল রাবার সব ফাইলে গুছিয়ে রাখলেন।
-মা আমি আর খেতে পারছি না।

-আহহ ছায়া বেশি কথা বলবি না তো।না খেয়ে পরীক্ষা দিবি কিভাবে?শক্তি পাবি না তো নইলে।সারারাতই পড়েছিস। পড়ে মাথা ঘুরাবে না খেয়ে গেলে।
ছায়া বেশ বিরক্ত হলো।পরীক্ষার দিন সকালে এইসব জানা কাহিনী। সব সময় হয়ে আসছে।জানে কিছু বলেও লাভ হবে না তাই চুপ করে খেতে লাগলো।
খাওয়া শেষ হতেই রিয়া বাড়ির গেইটে এসে হাঁক ছাড়লো।
-এই ছায়া আর কতোক্ষণ আয় জলদি। পরীক্ষা শুরু ১০টায়। এখন ৯:১৫ বাজে।সব সময় দেরি করিস।
ছায়া জলদি পানি খেয়ে ফাইল হাতে নিয়ে জুতো পড়ে বেরিয়ে আসে।
ছায়ার মাও যাবে সাথে।রিয়ার সাথে যাবে রিয়ার ভাই অরূপ।
ছায়ার মা ছায়াকে পরীক্ষার হলে পৌছে দিয়েই বাড়ি চলে আসলেন।এইদিকে অরূপ ছায়া রিয়াকে নানা উপদেশ দিতে লাগলো কিভাবে পরীক্ষা দিবে,আনসার কোন কোন টপিক থেকে করবে।

-শোন একদমই মাথা গরম করবি না।মাথা ঠান্ডা রেখে লিখবি।যেই সৃজনশীলটা ভালো পারিস সেইটা আগে দিবি।আর যেইটা কম পারিস সেইটা পরে। কোন প্রশ্নই বাকি রাখবি না।না পারলেও একটু ধারনা নিয়ে লিখে ফেলবি।আর সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ যেইটা খাতার রোল আর রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ঠিকভাবে লিখবি।বেস্ট অফ লাক।
ছায়া আর রিয়া মন দিয়ে শুনলো এর পর বিদায় দিয়ে এক্সাম হলে চলে গেলো।
অরূপ পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি পরীক্ষার হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
এইভাবে তিনটা পরীক্ষা অবধি অরূপ ছিলো।কিন্তু পরে তার ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা চলে গেলো।কিন্তু মন পড়ে থাকলো এইখানেই।দূর থেকেই খবর নিলো।
সময় কতো দ্রুত চলে যায়।বিশেষ করে ভালো সময়গুলো।কিন্তু পরীক্ষার সময়গুলা যায়ই না।যেমনটা ছায়ার।একবারে হাপিয়ে উঠেছে।এতো এতো পরীক্ষা।এক মাসের উপর ধরে পরীক্ষাই চলছে।কবে থেকে সে একটা মুভি দেখে না।একটু আনন্দ করতে পারে না।তার দীঘির পাড়ে গিয়ে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকতে মন চাইছে।কিন্তু খুশির কথা এই যে আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি।মীরা বেগম ছায়াকে ডাকলো অরূপ ফোন দিয়েছে।
ছায়া দৌড়ে যায় মায়ের কাছে।ফোন কানে নিয়েই হাপাতে হাপাতে বলে,
-অরূপদা আমি কিন্তু ভালো করে দিচ্ছি পরীক্ষা।আমার সারপ্রাইজ রেডি রেখো।কবে আসবে গো তুমি।বাবা সব সময় বিজি থাকে মা তো কোথাও নিয়েই যায় না।তুমি এসে আমাকে আর রিয়া কে একটু ঘুরতে নিয়ে যাওনা।
আহা ছায়ার কি শিশুসুলভ মায়াময় আবদার।অরূপ কি না পূরণ করে পারে?এই মেয়েটার জন্য তো সে জানও দিয়ে দিতে পারে।
অরূপের বুকের ভিতর শীতন হাওয়া যায় ছায়ার কথা শুনে।কতোগুলা দিন সে ছায়াকে দেখে না।সে ঠিক করেছে লাস্ট পরীক্ষার দিন পরীক্ষার হলে গিয়ে ছায়াকে চমকে দিবে।কেমন হবে তখন?
-এই অরূপদা কোথায় হারিয়ে গেলে কথা বলো না কেন?
-হ্যা শুনছি।আচ্ছা আমি নিয়ে যাবো।আর আমি তোর বইয়ে কতো গুলা টিপস দাগিয়ে দিয়ে এসেছিলাম।সেইগুলা ভালো করে পড়িস।আর ভালো করে পরীক্ষা দিস কেমন?রাখছি তাহলে।
ফোন কেটে দেয়।
সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরী চঞ্চল পায়ে দৌড়ে যায় নিজের ঘরের দিকে।তার মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।এইবার পড়ায় মন বসবে।অরূপদা জাদু জানে।

পরীক্ষা শেষ হতেই ছায়া আর রিয়া শক খায়।স্বয়ং অরূপ দাঁড়িয়ে আছে।ছায়া আর রিয়া দৌড়ে অরূপকে জড়িয়ে ধরে অরূপদা বলে।
অরূপ দুইজনের মাথায় স্নেহের হাত বুলায়।সে কতো ভাগ্যবান।এই মিষ্টি মুহুর্ত গুলা সে কোথায় পেতো এই মেয়েটা না থাকলে।
-চল আজ তোদের আমি ট্রিট দেই।কি খাবি বল।আজ কোন না নেই।
ছায়া আর রিয়া উচ্ছ্বসিত হলো।অতি আনন্দে ছায়া আর রিয়া হাই ফাইভ দিলো।
ছায়ার হাসি দেখে অরূপের বুকের ভাজে অনুভূতিরা উড়ো মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে।

-অরূপদা আমি ফুচকা খাবো।

-এই দাদা আমি ঝালমুড়ি খাবো।

অরূপ হাসে তাদের কান্ড দেখে।

-এইসব ভালো হবে না তেমন।চল কোন রেস্টুরেন্টে যাই।ঝালমুড়ি আর ফুচকা খাইয়েই নিয়ে যাবো।তবে অল্প খাবি।এইগুলা ভালো হয় না।

ছায়া আর রিয়া খুশিমনে রাজি হয়ে গেলো।
ছায়া আর রিয়া স্কুলের পাশের ফুচকার দোকানে গিয়ে ফুচকা খেতে বসলো।অরূপ বসলো না।সে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো।ছায়া একটা ফুচকা হাতে নিয়ে এসে টুপ করে অরূপের মুখে পুড়ে দিলো।
অরূপ মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুললেও তার হৃদয়ে রঙ বেরঙ এর প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।ছায়া খিল খিল করে হাসতে থাকে।
রেস্টুরেন্টে গেলো।ছায়া আর রিয়া একসাথে বসলো।অরূপ তাদের সামনেই বসলো।ওয়েটারকে ডাক দিয়ে অর্ডার করে দিলো কে কি খাবে।রিয়া আর ছায়া এইটা সেইটা বলে হাসি মজা করতে লাগলো।
ছায়াদের ২ টেবিল পড়েই একদল ছেলেরা বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।তাদের একজনেরই হঠাৎ ছায়ার দিকে নজর যায়।সেই ছেলেটা অরূপের মুখ দেখেনি।শুধু পিঠ দেখছিলো।তাই না দেখেই টিটকারি করে বললো,

-এই এই তোরা দেখ আমরা একটা পাখিও পাই না মামু এই ছোকরা দুইটা পটাইয়া মজা মারতাছে।
এইটা বলেই বিশ্রী ভাবে হাসা শুরু করলো।
আরেকটা ছেলে ছায়াকে দেখিয়ে বললো,

-এই দুই বেনী করা খাসা মাইটার কি বডি রে দোস্ত।শইল্লে আগুন ধইরা যায়।আহহ মামু।
অরূপ এইবার বুঝতে পারে তারা ছায়াকে আর তাদের উদ্দেশ্য করেই এই কথা গুলো বলছে।এইবার তার রক্ত গরম হয়ে যায়।পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।দুপ দাপ পা ফেলে সে উঠে তাদের টেবিলের দিকে যায়।তার সারা শরীর স্তিমিত ক্রোধে কাপছে।ক্রোধাগ্নির রোষানলে যেনো সবাইকে পুড়িয়ে ছাই করে দিবে।তার দৃষ্টি কঠোর। বিনা বজ্রপাতে গর্জে উঠে সে,
তাদের একজনের কলার ধরে মাথা টেবিলে চেপে ধরে আরেকজনের গলায় শক্ত বলিষ্ঠ হাত দিয়ে চেপে ধরে।ছেলে দুইজন গোঙালো।বাকি ছেলেগুলো অরূপের হাত থেকে তাদের বন্ধুকে ছাড়াতে চাইলো।রেস্টুরেন্টের ম্যানাজার ছুটে এসে অরূপকে ধরলো।ছাড়ালো।
অরূপ তখনও ক্রোধে ফুস ফুস করছিলো।সে কখনো ছায়ার পানে সেইরকম দৃষ্টি দেয়নি এতো ভালোবাসার পরও আর এই সেই দিনের ছেলে গুলা আজে বাজে কথা বলছে,বাজে নজর দিচ্ছে।সে বেঁচে থাকতে কাউকে ছায়ার দিকে নোংরা দৃষ্টিতে তাকাতে দিবে না।
ছায়া আর রিয়া এইসব দেখে বেশ ভয় পেলো।তারা সব সময় অরূপকে শান্তশিষ্ট দেকেছে।উগ্র কখনোই ছিলো না অরূপ।আর তারা যেনো অরূপদার আরেকটা বজ্রকঠোর রূপ দেখলো।
মার খাওয়া ছেলে দুটো অরূপকে দেখে চিনতে পারলো।এইবার তারা ক্ষমা চেয়ে কোনমতে কেটে পড়লো।ম্যানাজারও আন্তরিকভাবে দুঃখ পোষণ করলো সব কিছুর জন্য।অরূপ এইবার ছায়ার দিকে তাকালো।মেয়েটা ভয়ে চুপসে আছে।সে ভেবেছিলো এখানে আর একমুহুর্তও না।কিন্তু কিয়ৎকাল ভেবে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টালো।সে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসলো।ছায়া আর রিয়াকেও বসতে বললো।
ছায়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গিয়ে বসলো নিজের জায়গায়।

#চলবে #কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২৬
(কপি করা নিষেধ)
..
খাওয়া শেষ হতেই তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে একটা আইসক্রিমের দোকানে যায়।আইসক্রিম পেতেই ছায়ার চোখ চক চক করে উঠে।এতোক্ষণের পাওয়া ভয় যেনো নিমিষেই কর্পূরের ন্যায় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।হাসি আবার তার অধরে ধরা দেয়।অরূপ তাকে দুটো আইসক্রিম কিনে দিলো।একটা ভ্যানিলা ফ্লেভার আরেকটা চকোলেট ফ্লেভার।ছায়া দুইটা আইসক্রিম দুইহাতে নিলো।এর পর রাস্তায় দুলে দুলে একবার এক হাতেই আইসক্রিমে তো আরেকবার অন্য হাতের আইসক্রিমে মুখ দিচ্ছে।অরূপ রয়ে সয়ে পিছু পিছু হাঁটছে আর ছায়ার বাচ্চামো দেখছে।গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দুপুর।গ্রীষ্মের দুপুরে চারিদিক নিস্তব্ধ নিঝুম। আকাশ থেকে যেন ফুলকি ঝরে। নিজের উষ্ণতায় সূর্যের কিরণ পর্যন্ত যেন জ্বলে পুড়ে অস্থির অধীর হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে ক্ষুদ্রাকৃতি ঘূর্ণি হাওয়া উঠে ঝরে-পড়া গাছের পাতা নিয়ে খেলায় মাতে।ছায়ার দুই বেনীর সামনে কিছু চুল কপালে আছড়ে পড়ছে।ঘর্মাক্ত ললাটে সেই
ক গাছি চুল লেপ্টে রইলো।অরূপের মনে ইচ্ছা জাগলো সেই চুলগুলো অতিযত্নে কানের পিছনে গুজে দিতে।কিন্তু কোথায় যেনো একটা বাধা রয়ে যায় তাকে সামনে এগোতে দেয় না।বুকে অনুভূতিরা যেনো বিরোহ মিছিল করে উঠে।
অরূপ এরপরেও হাসে। প্রাপ্তির হাসি। প্রিয়তমার মুখে হাসি ফুটাতে পারার হাসি।কয়জনে পারে এমন?
ছায়া যখন হেলতে দুলতে হোঁচট খায় আর মুখটাকে একবারেই পাংশুটে করে ফেলে সেইটা দেখে অরূপ ঠোঁট চেপে হাসে।মেয়েটা আর বড় হলো না।আর মনে মনে বলে,তোমাকে অনেক বড় হতে হবে কোমল অনেক বড় হতে হবে।এখনও যে অনেক কিছু হবার বাকি।
এইদিকে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরী বুঝলোই না কোন এক না হওয়া প্রেমিক তার দিকে কি গভীর প্রণয়ের নজরে তাকিয়ে আছে।যদি বুঝতো তবে হয়তো লজ্জার উড়নায় মুখ লুকাতো।
অরূপ ছায়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে রিয়াকে নিয়ে নিজের বাড়ি যায়।ছায়াদের বাড়ি থেকে ৩ বাড়ি পরেই অরূপদের বাড়ি।খুব কাছেই।
অরূপ একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল।আজই রাতে ট্রেনে ঢাকা ফিরে যাবে।মন বসছিলো না ওইখানে তাই চলে এলো।
..
ছায়া বাড়ি গিয়েই গোসল করে শান্তির ঘুম দিলো। পরীক্ষা শেষ মানে মাস্তি টাইম শুরু।
আজমির সাহেব সন্ধ্যায় বাড়ি এলেন।এসে দুই মেয়েকে ডাকলেন।রোজ আর ছায়া দৌঁড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে

-বাবা কি এনেছো?

ছায়ার সাথে রোজও জিজ্ঞেস করে,

-পাপা কি এনেছ?আমাকে বেশি বেশি দিও।আপুকে কম দিও।

ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া রোজ যেনো একটু বেশিই চঞ্চল।পুরো ঘর দৌঁড়া দৌঁড়ি করে বেড়ায়। আর মীরা বেগমের ঘাম ছুটে।
ছায়াও কম না।সেও বোনের সাথে খুনশুটিতে মেতে থাকে।
এইভাবেই চলতে থাকে দিন।দেখতে দেখতেই পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে।
রেজাল্টের দিন ছায়ার বেশ খারাপ অবস্থা।তবে এর চেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা ছায়ার মায়ের।মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে খুব সিরিয়াস।তিনি ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।আর ছায়ার বাবা সোফায় বসে পেপার পড়ছেন।একটু পর পর আড়চোখে স্ত্রীর কাণ্ডকারখানা পর্যবেক্ষণ করছেন।

-আহ মীরা একটু শান্ত হয়ে বসো তো।যাহ হবে ভালোই হবে।

-আল্লাহ ভরসা।এরপরেও আমার কেমন জানি লাগছে।
ওদের এইসব দেখে ছায়ার নিজেরও টেনশন হচ্ছে।নাহ আর বাসায় থাকা যাচ্ছে না।রিয়াদের বাড়ি গেলে কেমন হয়?
যেই ভাবা সেই কাজ।ভো দৌঁড় লাগায় রিয়াদের বাড়ি।
রিয়ার মা সুস্মিতা মুখার্জী ছায়াকে এমন দৌড়ে আসতে দেখে হেসে বলে,

-দেখেছো মেয়ের কান্ড।এইভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন? পড়ে যাবি তো।আস্তে আস্তে আয়।
ছায়া খুবই দ্রুত জবাব দেয়,

-নাগো আন্টি।টেনশনে আছি খুব।না জানি রেজাল্ট কেমন হয়।রিয়া কই গো?
সুস্মিতা গালে হাসে।তার ছেলে এই মেয়ে দুটোকে পড়িয়েছে তাই খারাপ হতেই পারে না রেজাল্ট।নিজের ছেলের উপর খুব বিশ্বাস আছে।

-নিজের ঘরে গিয়ে দেখ।নাওয়া খাওয়া ছেড়ে বসে আছে ক্যাং ধরে।রেজাল্ট এর ভয়ে গিয়ে দেখ মরার মতো পড়ে আছে।
ছায়া রিয়ার রুমের দিকে পা বাড়ায়।

-রিয়ারে আমার ভয় লাগছে রে।না জানি কি হয়রে।
কিছুটা বিলাপের সুরেই রিয়াকে বললো।
এইদিকে রিয়া তো এমনিতেই টেনশনে জান যায় যায় অবস্থা আবার ছায়ার এইসব তার অস্বস্তি বাড়াচ্ছে।সহ্য করতে না পারে দেয় মাথায় এক বারি।ছায়া মাগো মাগো করে উঠে।

– এই আমাকে মারলি কেন?

-তো কি করবো? দেখছিস না আমার চিন্তা হচ্ছে।তুই আমার চিন্তা ডাবল বাড়িয়ে দিচ্ছিস।
রিয়ার মা ফোন নিয়ে রিয়ার রুমে ঢুকে রিয়ার দিকে ফোন বাড়িয়ে দেয়।

-তোর দাদা নে।
রিয়া ফোন রিসিভ করতেই অরূপ রিয়াকে তার রেজাল্ট বলে।রিয়ার আত্মায় যেনো পানি ফিরে আসে।ফোন কানে নিয়েই আনন্দিত কন্ঠে ছায়াকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,

-A+ পাইছি রে ছায়ু।আমার জানে জান ফিরা আইলো রে।
এই বলে ছায়ার দিকে ফোন বাড়িয়ে দেয়।ছায়ার বুকের ভিতর উত্তেজনায় ঢিপ ঢিপ করছে।না জানি কি হয়।

-হ্যালো কোমল!গোল্ডেন পেয়েছিস। তোর রোল আমি জানতাম। আজ সকালেই তোর আর রিয়ার রেজাল্ট বের করি।কনগ্রাচুলেশনস।
ছায়া খুশিতে কেঁদে দেয়।কি আনন্দ।এতো আনন্দ সে কোথায় রাখবে।এইবার বেশ জোরেই ছায়া কেঁদে দেয়।

-পাগলি কাঁদছিস কেন?এখনতো সেলিব্রেট করার সময়।
অরূপ নিজেও প্রিয়তমার খুশির সাক্ষী হলো।এটা যে তার নিজের প্রাপ্তি।সে নিজে অর্জন করেছে।আজ অরূপের আখিকোটরেও খুশির অশ্রুরা ধরা দিলো।

ছায়া দৌঁড়ে বাড়ি যায়।গিয়ে তার রেজাল্টের কথা বলে।ছায়ার মা তার রেজাল্টের কথা শুনে কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে খুশিতে আবেগে কেঁদে দেয়।

– কই গো ছায়ার বাবা মিষ্টি আনুন।সবাইকে যে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।
ছায়ার দাদী হামিদা বানুও বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।

-কই গো আমার নাতনী। তার বলে ফলাফল দিবো।দিছে নি?আমি জানি আমার নাতনী ফাসক্লাস পাইবো।
ছায়া গিয়ে দাদীকে ঝাপটে ধরে,

-হ্যা গো দাদী আমি গোল্ডেন পেয়েছি।
ছায়ার দাদী ছায়াকে মন প্রাণ ভরে দোয়া করলো।

-বাইচ্চা থাকো।বাপ মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো। দোয়া করি।

এইদিকে রোজও বোনের খুশিতে বাকবাকুম হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে।
#চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here