কুঞ্জছায়া পর্ব ২৭+২৮+২৯

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২৭
(কপি করা নিষেধ)

পহেলা এপ্রিল।পহেলা বৈশাখ বাঙালী জাতির হাজার বছরের প্রানের উৎসব। এই দিনে পুরোনো জীর্ন অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে আমরা সতেজ-সজীব নবীন এক জীবনকে বরণ করে নেই। আজ ছায়া রিয়ার সাথে বাইরে যাবে ঘুরতে।তাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে অরূপ।
ছায়া আজ সাজবে।ভীষণ সুন্দর করে রক্তিম গোলাপের ন্যায় সাজবে।টকটকে লাল শাড়ি পড়েছে ছায়া।ছায়ার মা মীরা বেগম ছায়াকে নিজ হাতে আদুরের সহিত পড়িয়ে দিলো শাড়ি।সুক্ষ্ম সুতোর বুননে তৈরি জামদানি লাল শাড়িতে ছোট ছোট ফুল করা তেরছাভাবে। শাড়িটির পাড় খয়েরি রঙের।
মাথায় রজনীগন্ধার গাজরা,হাতে লাল আর সোনালি চুরি,গলায় মালা,কানে ঝুমকা,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক,চোখে কাজল। হঠাৎ করেই যেনো ছায়া খুব বড় হয়ে গেলো। নারীর শ্বাশত সৌন্দর্য প্রকাশে শাড়ির জুড়ি নেই।ছায়ার মা ছায়াকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হলো।তার মেয়েটা কি সুন্দর!কারো নজর যেনো না লাগে।
আজ রিয়াও লাল শাড়ি পড়েছে।রিয়াকেও খুব সুন্দর লাগছে।অরূপ আসলো ছায়াকে নিতে রিয়ার সাথে।
ছায়া নিচে নামলে অরূপ তখনো তাকায়নি ছায়ার দিকে।হঠাৎ একটা ফোন কল আসায় সে বাড়ির গেইটের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।কিছু জরুরি কাজে তাকে যেতে হবে রিয়াকে বলেই সে চলে যায়। রিকশা ভাড়া করে দিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পর সে যাবে ছায়াদের কাছে কাজ শেষ করে।ছায়া আর রিয়া রওনা হয়।মুলত অরূপ যেইখানে চেয়েছে রিকশা সেখানেই থামলো।ছায়া নেমে দেখলো নদীর পার।চারিপাশে বিরাজ করছে নৈসর্গিক নিস্তব্ধতা।বিস্তৃত নদীতীর,সামনে কল্লোলিত নদী,স্বছ মেঘহীন নীল আকাশ ।ঠিক তখনই অরূপ এলো।
এসেই ছায়াকে লক্ষ্য করলো।প্রেয়সীর এই রূপ যেন তার বক্ষগহ্বরকে অনুভূতির চাদরে আন্দোলিত করলো।দুই পা সে পিছিয়ে গেলো।হৃদপিন্ডের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ যেন উচ্চস্বরে বাজছে।হায় একি হলো!শরীরে মৃদু কম্পন টের পাচ্ছে।তার খরস্রোতা বুকে এ কোন উন্মাদনা। তার সেই ছোট্ট কোমল এতো বড় হয়ে গেলো?কলিকার ন্যায় পূর্ণ যৌবনা যেন প্রস্ফুটিত হচ্ছে।তার মনে জাগছে নিষিদ্ধ ইচ্ছা।তার সংযমের প্রয়োজন।সে ধীর পায়ে এগোলে ছায়া তাকে দেখেই দৌঁড়ে এলো বিচলিত পায়ে।

-অরূপদা দেখো কি সুন্দর।আমি যে আর কখনো আসিনি এই খানে।তোমাকে ধন্যবাদ।

ছায়া এরপর রিয়ার হাতে টেনে আবারও নদীর দিকে গেলো এলোমেলো পায়ে।নদীর জলে হাত ডুবিয়ে খেলা করছে জল জল খেলা।তার হাসি আশে আশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অরূপ দূর থেকেই দেখে গেলো।সে কি করবে?তার সামনে যে বহু বাধা।তার ধর্ম যে বড় বাধা।ভালোবাসা কি এতো বাধা মানে?কি করবে সে?
ছায়া রিয়া আর অরূপ একটা মেলায় গেলো।এই মেলাটা প্রতি নববর্ষে উদযাপিত হয় এইখানে।ছায়া এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে অচিরপ্রভার ন্যায়।
গিয়ে ঝুমকা পছন্দ করছে তো আরেকটা দেখে সেটা আর পছন্দ হচ্ছে না।এইরকম করতে করতে সে কিছুই কিনতে পারছে না।অন্যদিকে রিয়া তা দেখে মুখে হাত চেপে হাসছে।এইসব দেখে অরূপ গিয়ে রিয়া আর ছায়ার জন্য কিনলো কানের দুল,আর চুরি।সেইটা সে নিজের কাছে রেখে দিলো যাওয়ার সময় দিবে।সে ঠিক করলো আর কখনো ছায়ার মুখোমুখি হবে না।সামনে তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল এক্সাম।সে খুব মন দিয়ে পড়বে।ছায়ার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।তার এতো বছরের সুপ্ত ভালোবাসা হারাতে দিবে না।কিন্তু এর আগে ছায়ার সামনে আসবে না।
শেষ অপরাহ্নে এইবার বাড়ি ফেরার পালা।অরূপ নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ছায়াকে বিদায় জানালো।

-কোমল!

-হু অরূপদা।জানো আজ না অনেক মজা হয়েছে।তোমাকে না আমার কাছে ম্যাজিক ম্যানের মতো লাগে।সব যেনো জাদুর ঝুরি দিয়ে খুব সুন্দর বানিয়ে দাও।যেমন আজকের দিনটা।আবার কবে নিয়ে যাবে বলো বলো?

অরূপ ছায়ার কথা শুনে মলিন হাসে।

-আমি যদি অন্যরূপে আসি মানতে পারবি?

-অন্যরূপ?

-ছাড় তো।বাড়ি যা।আর ২ দিন পরেই কলেজে ভর্তি হবি।এইবার একটু বড় হয়ে যা।একটু ঠিকঠাক ভাবে চলিস।আর ছেলেদের সঙ্গ এড়িয়ে চলিস।কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিস।আমি যাই রে

ছায়া সম্মতি জানায়।তার ছোট্ট মন বুঝতেই পারলো কি গভীর ভালোবাসা লুকানো ছিলো এই কথা গুলিতে।যদি জানতো তবে এই ছেলেটাকে সে নিজের আঁচলে বেঁধে রাখতো।
ছায়া বাড়ি যায়।গিয়ে দেখে তার বাবা সোফায় বসে মিটিমিটি হাসছে।ছায়া গিয়ে বাবার পাশে বসলো।
বুঝার চেষ্টা করলো কেন তার বাবা হাসছে।

– কি হলো বাবা হাসছো কেনো?আমাকে কি ভালো দেখাচ্ছে না?এই রোজ কই তুই?এদিকে আয় জলদি।
ছায়ার ডাক শুনে রোজ দৌঁড়ে আসে।

-কি হয়েছে আপু?

-বাবা হাসছে কেনো রে? আমাকে কি পেত্নির মতো লাগছে?
রোজ হোহো করে হেসে দেয়।

-পেত্নি আপু।ছায়া আপু।
ছায়া রেগে তাকালেই রোজ ভো দৌঁড়।

-আরে মামনি এদিকে এসো।বসো আমার পাশে।তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।তোমার জন্য একটা গিফট আছে।
এইটা বলেই একটা বক্স এগিয়ে দেয় ছায়ার দিকে।
ছায়া ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলো এটা একটা মোবাইল।বাবা তাকে মোবাইল দিয়েছে?

-ইয়ায়ায়ায়াহু।

একটা চিৎকার দিয়েই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।তার খুশি যেন ঝরছেই না।

-শুনো মামনি রেজাল্ট ভালো হয়েছে তাই দিয়েছি।পড়াশুনা করার সময় কাজে লাগবে।

-কি দরকার ছিলো মোবাইল দেওয়ার?
মীরা বেগমের একদমই ভালো লাগলো না।মাত্র ইন্টারে উঠলো আর এখনই মোবাইল।বয়সটা বড্ড ভয়ংকর।
দেখে দেখে রাখতে হবে।নইলে একবার ভুল পথে পা বাড়ালে ফিরে আসা খুব কঠিন হবে।

-আহ মীরা আমার মেয়ে মোটেও তেমন না।দেখো সে ঠিক আমাদের মান রাখবে।বড় হয়ে ডাক্তার হবে।
ছায়া দৌড়ে গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে শাড়ি না খুলেই মোবাইল নিয়ে বসলো।সব নাম্বার সেট করতে হবে তো!
সবার আগে কার নাম্বার সেট করা যায়?কার করা যায়?
অরূপদা!
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২৮
(কপি করা নিষেধ)
ড্রয়িংরুমে মীরা বেগম,রেজাউল সাহেব আর ছায়া বসে আছে।ছায়ার জন্য কোন কলেজ ভালো হবে সেইটা ওরা ভাবছে।
এইবার রেজাউল সাহেব গলা খাকারি দিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলেন।
-আমি চিন্তা করছি এইখানের স্থানীয় একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো।
মীরা বেগমও সায় জানালেন।এখনই মেয়েকে ঢাকা পাঠাতে চাচ্ছেন না।সিদ্ধান্ত নিলো কাল ছায়ার বাবা গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবে।
ছায়া নিজের রুমে গিয়ে রিয়াকে ফোন করলো।

-রিয়া কাল কলেজে ভর্তি হচ্ছি।তুই কাল আমাদের সাথে যাবি?
রিয়াও প্রফুল্লতার সাথে উত্তর দিলো যে,

-হ্যাঁ যাবো।

মানুষের জীবনের ভালো দিনগুলো কেমন যেনো দ্রুত চলে যায়।খারাপ দিনগুলো কাটতেই চায় না।ছায়ার এই ভালো দিনেও বুঝি কারো নজর লেগে গেলো।
কলেজে ভর্তি হয়ে গেলো ছায়া।এইবার তাহলে ছায়ার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু।

যথারীতি চলতে থাকলো ছায়ার কলেজ জীবন।
এইবার তার সুখের জীবনে ভাটা পড়লো।ছায়াদের কলেজের পাশেই আরেকটি কলেজ যেইটা অনার্স আর মাস্টার্স ভবন নামে খ্যাত।
কোন এক ছেলের নজরে পড়ে গেলো।ছেলেটি ছায়াকে টার্গেট করলো।
কলেজে ছায়া আর রিয়ার আরেকটা বান্ধবী হলো অবন্তী।
কলেজ ছুটি হতেই ছায়া,রিয়া আর অবন্তী বাড়ির পথে রওনা হলো।পথিমধ্যে বখাটে এক ছেলে তাদের রাস্তা রুখে দাঁড়ালো।

-এই যে সুন্দরী তোমার নাম কি?

ছায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো।
ছায়া মুখটা কালো করে ফেললো।অপরিচিত কোন ছেলের সাথে তার কথা বলা মানা।সে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই আবারো ছেলেটি ডেকে উঠলো,

-আরে সুন্দরী যাচ্ছো কোথায়?আমি আহান হক।তোমাদের পাশের কলেজেরই।অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।

ছায়ার কেনো জানি ভালো লাগলো না। ছেলেটার চাহনি তার ঠিক লাগছে না।
ছায়া রিয়ার হাত ধরে দ্রুত চলে যায়।অবন্তী একবার পিছু ঘুরে আহানকে দেখে নেয়।এরপর অবন্তীও পা চালায়।
ছায়া ব্যাগ কাধে জলদিই বাড়ি যায়।আজকাল সে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে।এখন আগের থেকে দৌঁড় ঝাপ কিছুটা কমেছে।
তিন মাস কেটে গেলো অথচ অরূপদা সেইদিনের পর আর সামনে এলো না।ছায়ার অরূপদার কথা খুব মনে পড়ছে।একটা কল করে দেখবে? যেইভাবা সেই কাজ কিন্তু কলটা রিসিভ হলো না।

রাত ১০ টা। ছায়া টেবিলে বইয়ের ভাঁজে মুখ গুজে আছে।আজকাল পড়ার খুব প্রেসার যাচ্ছে।শনিবারে ক্লাসটেস্ট আছে।ভালো করে পড়তে হবে।তখনই মোবাইল টুং টাং করে বেজে উঠে।ছায়া কিছুটা অবাক হলো।এতো রাতে কে কল করেছে?তাকে এতো রাতে সচরাচর কেউ কল করে না।ছায়া ফোন নাম্বার চেক করে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে।ছায়া ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে যায়।আবারও কল আসলে ছায়া রিসিভ করে কানে ধরতেই কেউ বলে উঠে,

-সুন্দরী হুয়াটস আপ?

ছায়া ভীষণ ভয় পেলো।সে ছেলে তার নাম্বার পেলো কি করে?কে দিলো।৩-৪ জন বান্ধবী ছাড়া তো আর কারো কাছে তার নাম্বার নেই।ছায়া ফট করেই কলটা কেটে দিলো।ছায়ার বুকের ভিতর কাপন ধরলো।মা যদি বিষয়টা জেনে যায় আর ভাবে আমি মোবাইল পেয়ে ছেলেদের নাম্বার দিয়ে বেড়াচ্ছি তবে খুব খারাপ হবে।তাই বিষয়টা চাপা রাখলো।
ছায়া ফোনটা চট করেই অফ করে দিলো।

ক্যাম্পাসে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে অরূপ।আড্ডা বলতে শুধু বসে আছে।শরীরে এইখানে থাকলেও মন অন্য কোথাও পড়ে আছে।কত পরিচিত মুখ,মানুষ,কোলাহল।তবুও সেই একটা মুখ দেখার জন্য তার মন পুড়ে।কতো মাস হয়ে গেলো।রিয়ার মুখে শুনেছে ছায়া নতুন ফোন পেয়েছে তাকেও একটা কিনে দিতে।সে চাইলেই ছায়াকে ফোন দিতে পারে।আজকাল একটা নাম্বার থেকে প্রায়শই কল আসে।অরূপ বুঝতে পারে এইটা তার কোমল।কিন্তু ধরার সাহস পায় না।সে আজকাল খুব দূর্বল হয়ে গিয়েছে।কথা বললে আরো হয়ে যাবে।পরে উপায়?খুবই অধৈর্য হয়ে আর কিছু না ভাবতে পেরেই কল লাগায় ছায়াকে।কিন্তু সুইচড অফ বলছে।এরপরও বহুক্ষণ সে ফোনটা কানে ধরে রাখলো।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফেলে।
….
সকাল হতেই মীরা বেগমের ডাকাডাকি শুরু ছায়াকে আর রোজকে।

-এই ছায়া সাতটা বেজে গেলো।উঠ।কলেজে যেতে হবে।তোদের নিয়ে আর পারি না।সকাল সকাল সব কাজ একা হাতে সামলাতে হয়।তোকে উঠিয়ে আবার রোজকে রেডি করাতে হবে স্কুলের জন্য।

-এতো চিল্লা চিল্লির মধ্যে ঘুমানো যায় মা?একটু অফ যাও।উঠছি।
ছায়া উঠে হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে যায়।

-গুড মর্নিং বাবা।

-গুড মর্নিং মামনি।ঘুম হয়েছে?

-হ্যা বাবা।খুব হয়েছে।
রেজাউল সাহেব কিছু টাকা মেয়ের হাতে দিয়ে বললো,

-এই নাও আজকের টাকা।আর এতো কষ্ট করে হেঁটে এসো না।রিকশা করে চলে এসো।
ছায়া সম্মতি জানায়।
মীরা বেগম ছায়ার দিকে নজর দেয়।মেয়েটা আজকাল চুপ হয়ে থাকে।আগের মতো নেই কিছু কি হয়েছে? মায়ের মন যেনো কু গাইছে।
রিয়া আর অবন্তী এসে ছায়াকে ডাক দিলে ছায়া রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।
যাওয়ার পথে আজও আহান দাঁড়িয়ে আছে।ছায়াকে দেখেই আহান এগিয়ে আসে।

-সুন্দরী আমার ফোনটা কেনো ধরলে না।আমার সাথে একটু কথা বলো।প্রমিজ আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না আর।
অবন্তী ছায়ার হাত টেনে এনে ছায়ার কানে কানে বলে,

-রাজি হয়ে যা দোস্ত।ছেলেটাকে আমি চিনি। খুবই ভালো। একটু কথা বললে যদি সব ঝামেলা মিটে যায় তবে ডেইলি ডেইলি পেইন না নিয়ে একদিনে মিটিয়ে নে।
ছায়া অবন্তীর কথাটা ভেবে সম্মতি জানালো।
সে আহানের কাছে গিয়ে শঙ্কিত হয়ে বললো,

-আচ্ছা ভাইয়া বলুন।
আহান বুকে হাত দিয়ে আহত কন্ঠে বলে,

-ডোন্ট কল মি ভাইয়া সুন্দরী। কল মি আহান।ওকে?

ছায়ার খুব অস্বস্তি লাগছে সাথে ভয়ও।জীবনে প্রথম লুকিয়ে কোন ছেলের সাথে কথা বলছে।কেউ দেখে ফেললে অথবা বাবা মা জানলে যে কি হবে।
ছায়া ভীত হচ্ছে এইসব ভেবে।

-চলো আমারা একটা পার্কে যাই। আজ কলেজের ক্লাসটা মিস দাও।নইলে পরে কলেজের পরে কথা বললে তোমার বাড়ি যেতে দেরি হবে।পরে আন্টি সন্দেহ করবেন।
অবন্তী যেনো ভীষণ এক্সাইটেড। সে ছায়াকে সাহস দিচ্ছে।এইদিকে রিয়ার খটকা লাগছে বিষয়টা।আহানকে সে না চিনলেএ কিছু কিছু শুনেছে আহানের ব্যাপারে।ছেলেটা ভালো না তেমন।তবে অবন্তী এতো প্রশংসা করছে কেনো?
রিয়ার মন মানছে না ছায়াকে যেতে দিতে।রিয়া ঠিক করলো সেও ছায়ার সাথে যাবে।
রিয়া সন্দেহ মনেই রাখলো।এর পরে বললো,

-আমিও যাবো ছায়ার।ওকে একা ছাড়তে পারবো না।

অবন্তী তৎক্ষণাৎ রিয়াকে আটকে ফেলে।আর বলে যে,

-আরে তুই গিয়ে কাবাব মে হাড্ডি কেন হবি?এর চেয়ে বরং আমরা কলেজে যাই।একসাথে তিন জন কলেজ বাধা করলে সন্দেহ করবে স্যাররা।এর থেকে বরং আমরা ক্লাসে যাই।কারন সবাই জানে তোর আর ছায়ার বাড়ি একসাথে আর তোরা ছোটবেলার বান্ধবী।
তুই যদি স্যারকে বলিস ছায়া অসুস্থ তাই আসতে পারেনি তাহলে বিশ্বাস করবে।ছুটির পর না হয় আমরা ছায়াকে এইখান থেকে নিয়ে যাবো।আজতো বৃহঃস্পতি বার।তাই হাফ ডে।কয়েক ঘন্টারই ব্যাপার।

রিয়া এইবার আর কিছু বললো না।অবন্তীর সাথে সম্মতি জানালো।
ছায়া রিয়ার দিকে তাকালে রিয়া চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে যে ভয় নেই আমি আছি।
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_২৯
(কপি করা নিষেধ)

-আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।তোমাকে কলেজে প্রথম দেখায়ই খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।প্লিজ আমাকে মেনে নাও।
এইটা বলে ছায়ার হাত ধরতে নিলেই ছায়া ছিটকে দূরে সরে যায়।
ছায়া নিজেকে স্থির রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলো।সে নড়েচড়ে একটা ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে বললো,

-সরি আমি তোমাকে ভালোবাসি না।তেমন পছন্দও করি না।আর আমি এইসব ভাবছিও না আপাতত।আমাকে আর বিরক্ত করো না।তুমি এইভাবে আমার সাথে কথা বললে আর আমার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ভুল বুঝবে।আমার সম্মান নষ্ট হবে।
আহান এইবার রয়ে সয়ে তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে ছায়াকে কথার জালে ফাসানোর চেষ্টা করে।এই পুচকে মেয়ে তাকে রিজেক্ট করছে তার ভাবতেই রাগ লাগছে।

-দেখো তুমি আমাকে মেনে না নিলে এইখানেই আমি সবার সামনে সুইসাইড করবো।

আহানের এইসব কথা শুনে ছায়া আতংকিত হয়।তার ছোট্ট মস্তিষ্ক ধরতে পারে না এইটা শুধু ওকে ভয় পাওয়াতে বলছে।সে তো একটা সদ্য ফোটা ফুল।বাইরের বিরূপ আবহাওয়াতে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা যে তার নেই।বাইরের মানুষ কেমন সেটাও তার অজানা
এতোদিন যে সে বাবা মা আর অরূপদার স্নেহের খোলসে আবৃত ছিলো।এইবার কি তবে সেই খোলস ভঙ্গুর হতে চলেছে?
ছায়া একবার আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখে নিলো।বড্ড ভয় লাগছে।কেউ দেখে ফেললে ভুল ভাববে যে।
অবন্তী আর রিয়া কলেজে চলে গেলেও আহানের সাথে ছায়া একটা পার্কে আসে।সেইখানে আহান রীতিমতো ছায়াকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে।ছায়া খুব ঘাবড়ে যায়।ছায়ার গলা শুকিয়ে কাঠ।সে কি করবে?তার জন্য কারো জীবন যাক সে নিশ্চয় চাইবে না।সে এইসব কাউকে বলতেও পারবে না।

-দেখো ছায়া আমি তোমাকে ভাবার জন্য ১ দিন সময় দিচ্ছি।তুমি আমাকে কাল জানাবে।আমি ফোন করবো।ফোন কোনভাবেই বন্ধ রাখার চেষ্টা করবে না।মনে রেখো।
এইদিকে ছায়াকে আহানের সাথে কথা বলতে অরূপের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেখে ফেলে।আর সাথে সাথেই অরূপকে কল দিয়ে জানায়।

-হ্যালো অরূপ?ভাই কই তুই?ছায়াকে দেখলাম পার্কে কলেজ ড্রেস পড়ে আহানের সাথে।

অরূপ যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো।শংকিত গলায় বললো

-আরেহ না ভাই।তুই হয়তো ভুল দেখছিস। এইটা কোমল হতেই পারে না।কোমল এমন মেয়ে না।

-আরে বিশ্বাস না হলে আমি তোকে ছবি পাঠাচ্ছি। নিজে দেখে নে।

কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিয়ে অরূপ যেনো বড়সড় একটক ঝটকা খায়।আবছা হয় তার দৃষ্টি।যেনো চেতনের মধ্যেই নেই।সব যেনো বিরান,শুণ্য।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।কেমন যেনো ফাকা ফাকা লাগছে সব হঠাৎ করে।হতাশার চাদর লেপ্টে গেলো অচিরেই। বুকের মধ্যের আটকে থাকা শ্বাদ ঘন ঘন নির্গত হলো।এরপর জড়ানো গলায় বললো,

-কোমল এতো বড় হয়ে গেলি? আমার কোমল কলেজ পালিয়ে প্রেম করছে?মানতে পারছি না।সব মিথ্যে।আমাদের দেখার আড়ালেও কিছু সত্য আছে।সেটা কি?

অরূপ কাঁপা কাঁপা হাতে একটা কাগজ নিয়ে লিখতে বসে গেলো একটা চিঠি।সে আজই আশুগঞ্জ যাবে।

ছায়া আজ ভয়ে ভয়ে বাসায় আসলো।রিয়া এতো করে সব জানতে চাইলো কিছু বলতেই পারলো না।আসলে এই কিশোরী বয়সটা বড্ড ভয়ংকর। বাস্তবতা বুঝে না।যা দেখে যা শুনে তাই সহজ মনে, মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। বিপদে পড়লেও কাউকে বলতে ভয় পায়।যদি সম্মান নষ্ট হয়।যদি ভুল বুঝে।ভাবে নিজে নিজেই সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে।ছায়া দুরু দুরু কম্পনরত পায়ে বাসায় প্রবেশ করতেই মীরা বেগমের মুখোমুখি হয়।
মীরা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের পানে চায়।ছায়াকে কেমন যেনো খুব ভীত লাগছে।মেয়ে কিছু লুকাচ্ছে না তো আবার?

-কেমন যেনো লাগছে ছায়া আজ তোকে?অসুস্থ লাগছে?
ছায়া যেন ঘাবড়ে গেলো মায়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে।
সে তোতলাতে তোতলাতে বললো,

-ন..ন..না ম…ম..মা কি..ক..কি..ছ..ছ..ছু না
এইটা বলেই দৌঁড়ে চলে যায় নিজের ঘরে।গিয়েই চট করে ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়।
মীরা বেগম কপাল কুচকালেন।এরপর রিয়াকে কল করলেন,

-হ্যালো রিয়া ছায়ার কি কিছু হয়েছে?কেমন যেনো করছে?
রিয়া নিজেও ভয় পেয়ে গেলো।কি বলবে বুঝতে পারছে না।সে আমতা আমতা করে বললো,

-না আন্টি আজ কলেজে ছায়া একটু অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো।তাই আরকি?

মীরা বেগম চিন্তিত হয়ে বিচলিত স্বরে বললেন,

-ওমা একি তাই নাকি।দেখো মেয়ের কান্ড।কিছুই বলে না মাকে।আমি কি বকবো?এতো ভয়ের কি আছে।অসুস্থ হয়ে গেলো।ঠিকমতো না খেলে তো এমন হবেই।আচ্ছা রাখি রে।বাসায় আসিস।
ছায়ার স্কুলের স্যারদের সাথে ছায়ার মায়ের বেশ ভালো পরিচয়।স্টুডেন্ট ভালো হলে স্যাররা এমনিতেই নিজে থেকে পরিচিত হতে আসে।
ছায়ার মা ছায়ার ক্লাস টিচারকে ফোন দেয়।মেয়েটা অসুস্থ হয়ে গেলো।ক্লাসে যাতে একটু খেয়াল রাখে মেয়েটার।

-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম স্যার।আমি ছায়ার মা।ভালো আছেন?

-জ্বী ওয়ালাইকুম সালাম।আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।ছায়ার কি অবস্থা?সে ভালো আছে?আজ তো কলেজেও আসেনি।
ছায়ার কলেজে না যাওয়ার কথা শুনতেই ছায়ার মা আকাশসম বিস্মিত হয়ে গেলো।কিন্তু সেইটা ফোনে স্যারকে বুঝতে দিলো না।

-এখন একটু ভালো।মেয়েটার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।ধন্যবাদ।

-জ্বী অবশ্যই এইটা আমার দায়িত্ব।

-আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকবেন।

-আল্লাহ হাফেজ।

ফোন কেটেই ছায়ার মা ঘরের এক কোনা থেকে অন্য কোনায় গেলো।অস্থির অস্থির লাগছে।মেয়ে কলেজ না গিয়ে কোথায় গেলো? কোন বাজে পাল্লায় পড়েনি তো?মেয়েটার বাস্তব জ্ঞান নেই।দুনিয়ার নির্মম বাস্তবতা থেকে আড়াল করেই মেয়েকে বড় করেছেন।ছায়ার বাবাকে কি এখন জানানো ঠিক হবে?মীরা বেগম ভাবলেন মেয়ের সাথে খোলামেলা কথা বলবেন।

রাতে খাবার টেবিলে মীরা বেগম, রেজাউল সাহেব আর রোজ বসে আছে।মীরা বেগম রেজাউল সাহেবকে ছায়ার বিষয়ে সব খুলে বললো।
রেজাউল সাহেব চিন্তিত হলেও মেয়ের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে বলেন,

-মীরা এই বয়সে ছেলে মেয়েরা একটু স্বাধীনতা চায়।ঘুরতে ফিরতে পছন্দ করে।হয়তো বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে।সেইটা তোমাকে বলতে ভয় পাচ্ছে।আমার কথাই ধরো। স্কুল কলেজ পালিয়ে কতো ঘুরাঘুরি করেছি।সব বিষয়েই তুমি চিন্তা করো।

মীরা বেগম কেনো যেনো নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না।
…..
এইদিকে ছায়ার ফোনে আহান অনবরত ফোন দিয়েই যাচ্ছে।ছায়া ফোন রিসিভ করছে না।এটলাস্ট আহান একটা ছবি পাঠায় ছায়ার ফোনে এমএমএস করে।সেই ছবি দেখে ছায়ার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।সে কয়েকবার ঢোক গিলে।নিজেকে শান্ত রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়।ছবিটিতে আহান একটা ধারালো ছুরি তার বাম হাতের শিরায় ধরে রাখে। আবার হাতের কিছু অংশ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।ছায়া কি করবে এইবার।আহানের কিছু হলে পুলিশ যদি ছায়াকে ধরে নিয়ে যায় তবে তার বাবা মায়ের সম্মান যে ধুলোয় মিশে যাবে।ছায়া আহানকে ফোন দেয় দেরি না করেই।আর অস্বাভাবিক ভীত গলায় বলে,

-.আ..আ..আমি র..র..রাজি।

আহান ছায়ার কথা শুনে বাঁকা হাসে।মেয়েটা তবে ট্র্যাপে পা দিয়েই দিলো।

-চুম্মা সোনা।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।কাল একটু আমার সাথে ঘুরতে যাবে।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।একদম না করো না।আমি কোন না শুনবো না।আর এইসব কাউকে বলতে যেওনা ভুলেও।মনে থাকে যেনো।

ছায়া হীনমন্যতায় ভুগছে।আহানকে তার ঠিক লাগে না।সে ভেবেছিলো সাময়িক সময়ের জন্য রাজি হয়ে আহানকে বুঝানোর চেষ্টা করবে।এখন যদি কোন বিপদ হয়?
ছায়া কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না।সে নিচু স্বরে আচ্ছা বলে রেখে দেয়।

..
মীরা বেগম মেয়েকে খেতে ডাকতে আসায় শুনলেন মেয়ে কারো সাথে নিচু স্বরে কথা বলছেন।মীরা বেগমের সন্দেহ তীব্র হলো।কোন বান্ধবীর সাথে তো এইভাবে কথা বলবে না।তবে কি ছায়া সম্পর্কে জড়িয়েছে কারো সাথে?
মীরা বেগম ছায়াকে ডাকলেই ছায়া ভড়কে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা পিছনে লুকিয়ে ফেললো।ছায়া ঘামতে শুরু করে হঠাৎ করেই।মীরা বেগম বেগম সব দেখেও কিছু বললেন না।তিনি অন্য কিছু ভেবে রেখেছেন মনে মনে।

-খেতে আয়।

ছায়া মাথা নাড়ালো।

#চলবে

(।ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here