কুঞ্জছায়া পর্ব ৩০+৩১+৩২

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব-৩০
(কপি করা নিষেধ)
..
খাওয়া শেষে সবাই ঘুমিয়ে গেলে মীরা বেগম শুয়া থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালেন।রাত ১২ টা।তিনি নিঃশ্বব্দে বিছানা থেকে উঠে গেলেন ছায়ার রুমে।ছায়া ঘুমোচ্ছে।কাথা দিয়ে মুখ ঢেকে।মীরা বেগম ছায়ার ফোনটা হাতে নিলেন।পাসওয়ার্ড দেওয়া।কিন্তু ফোন স্ক্রিনে কয়েকটা মেসেজ শো করছে,

-“বেবি চুম্মা,গুড নাইট। কাল এই ঠিকানায় ঠিক সময়ে চলে এসো”
এই মেসেজ দেখে মীরা বেগম ক্রোধান্বিত হলেন।চোখ বড় বড় করে মেয়ের দিকে চাইলেন।মেয়ে ঘুমোচ্ছে।
এইটা ছায়ার কোন বান্ধবী হতেই পারে না।কোন ছেলে নয়তো?তার জানতেই হবে এইটা কে?কার সাথে মেয়ের সম্পর্ক চলছে।
মীরা বেগম মাথা গরম করে সিদ্ধান্ত নিতে চান না।তার এই মুহুর্তে অরূপের কথা মাথায় এলো।অরূপ বললে ছায়া তার কথা শুনবে।অরূপের কথা মানবে।মীরা বেগম বেশ চটে গেলেন মেয়ের প্রতি।এইসব লোক জানা জানি হলে সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে।লোকে ছি ছি করবে।আগে দেখা প্রয়োজন ছায়া কোথায় যায়।ছেলেটাকেও হাতে নাতে ধরবে।কতো বড় কলিজা তার একটু পরখ করে দেখবে।
এইদিকে ফোনের পুরো মেসেজ লিস্ট দেখলে হয়তো মীরা বেগম বুঝতেন মেয়ে নির্দোষ।মেয়েকে ফাঁসানো হচ্ছে।
..
মীরা বেগম অরূপকে সব জানায়।সাথে ঠিকানাও বলে দেয়।
..
পরেরদিন ছায়া সকালবেলা উঠে রিয়ার বাড়ি যাবার নাম করে বের হয়।মীরা বেগম সব বুঝেও কিছু বললেন না।মীরা বেগম রাগে কটমট করলেন।মেয়ে এতো নিচে নামবে জীবনে ভাবতে পারেনি।

ছায়া এইদিকে রিয়াকে মেসেজ দিয়ে সব জানায়।রিয়া এইসব শুনে বেশ ভয় পেয়ে যায়।আর ছায়ার বোকামির জন্য ছায়াকে বকতে থাকে।কিন্তু ছায়া রিয়াকে মেসেজ পাঠিয়ে রিয়ার আর কোন মেসেজ সিন করেনি।সে আহানের দেওয়া ঠিকানায় রওনা হয়।
..
-এসে গেছো সুন্দরী। কি সুন্দর লাগছে তোমাকে।
ছায়ার বাহুতে হাত বুলাতে গেলে ছায়া সরে যায়।আহান ভ্রু কুচকে ফেলে।আর মনে মনে বলে আজ দেখি তুমি কিভাবে পালাতে পারো।সব প্লান মাফিক হলেই হয়।এইটা ভেবেই একটা বিশ্রী হাসি দেয়।

-একি সুন্দরী তুমি রাগ করছো কেনো?আমিই তো।আমরা তো এখন সম্পর্কে আছি।লজ্জা পাচ্ছো নাকি?আসো তো লজ্জা ভেঙে দেই।
ছায়ার গা ঘিন ঘিন করে উঠে এইসব কথা শুনে।ছায়ার মন মেজাজ খারাপ হচ্ছে।

-দেখো আহান।এইটাকে কোন সম্পর্ক বলে না।তুমি আমাকে রীতিমতো ফোর্স করছো।আমি তোমাকে চিরতরে না করতে এসেছি।এইসব সম্ভব না আমার পক্ষে।
আহান এইবার হাসলো যেনো বেশ মজার কিছু শুনেছে।
ছায়া যেইখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাটা একটা কেল্লার মতো।মানুষ নেই বললেই চলে।পার্কের পিছনেই এই কেল্লার মতো জায়গাটা।ছায়া এই জায়গা সম্পর্কে আগে তেমন জানতোই না।মনে করেছে মানুষ থাকবে অনেক।এখন ছায়ার নিজেকে বেশ অনিরাপদ মনে হচ্ছে।এইভাবে একা একা আসা একেবারেই উচিত হয়নি।এইখান থেকে ভালোই ভালোই বের হতে পারলে হলো।চিরতরে ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।পরে না মানলে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে বিচার দিয়ে দিবে।

আমরা যা ভাবি তা অনেক সময় হয় না।নিয়তিতে অন্য কিছু লেখা থাকে।ছায়ার ভাবনামাফিকও কিছু হলো না।ছায়ার ভাগ্যেও বোধ হয় অন্য কিছু লেখা ছিলো।

-তা তো হচ্ছে না সুন্দরী। কীভাবে তোমাকে যেতে দিই বলো তো।এমন মেয়েকে হাত ছাড়া করলেতো জীবনই বৃথা যাবে।আসো তো কাছে।

এইটা বলেই ছায়ার দিকে এগোতে থাকে।ছায়ার আহানের দিকে স্তব্ধ হয়ে ভীতি চোখে তাকিয়ে থাকে আর পেছাতে থাকে ছায়ার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে ভয়ে হাটু কাপা শুরু হয়।ঘামতে থাকে।আহান ছায়ার
হাত ধরে তার গা থেকে উড়না সরিয়ে নিতে গেলে ছায়া হাত ছুড়াছুঁড়ি করতে থাকে।কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না।আহান যেন ছায়ার হাত শক্ত করে ধরে উড়না টেনে নিলো। ছায়া বেশ ভয় পেয়ে গেলো।সে পালাতে চাইলো।উড়না টেনে ধরলো।কিন্তু পারলো না আহান খপ করে তাকে ধরে ফেললো।প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে ঢোক গিলে ছায়া আশেপাশে সাহায্যের জন্য চিৎকার করলো।চিৎকার গুলো দেয়ালে বারি খেয়ে তার কাছেই ফিরে আসছে।

-চিৎকার করে লাভ নেই সুন্দরী। কেউ শুনবে না তোমার চিৎকার।

ছায়ার বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠলো সম্ভাব্য বিপদটি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো।সে কি মস্ত বড় ভুল করলো সে বুঝতে পারলো।ছায়ার অক্ষিকোটর অশ্রু দ্বারা প্লাবিত হলো।তার চোখের সামনে তার মা বাবার চেহারাটা ভেসে উঠলো।ছায়া দিশেহারা হয়ে উঠলো।
আহান তার দেহের প্রতিটি ভাজে ভাজে কামুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।ছায়া ঘৃণা লজ্জায় আহানের মুখ বরাবর থুতু দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।আহান তেতে উঠে।বিকট আর বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে উঠে আর ছায়ার কাধে কামড় বসিয়ে দেয়।ছায়ার কোমরে হাত দেয়।ছায়া গোঙালো অতি কষ্টে।সে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে আহানকে সরানোর চেষ্টা করলো।নিজের সম্ভ্রম হারানোর আতঙ্কে ছায়ার বুকে কাঁপন ধরলো।তীব্র সাহস জুগিয়ে আহানকে কানে কামড় দিয়ে সহসা দৌঁড় দেয়।আহান সেই মুহুর্তে ছায়ার জামা টান দিয়ে ধরে।ছায়ার জামার কিঞ্চিৎ অংশ মুহুর্তেই ছিড়ে যায় আর নোখের আচড় পেটে গেথে যায়।

-এমন লাস্যময়ী মেয়েকে সামনে রেখে ভোগ করবো না তা তো হয় না।সেই প্রথম দিন থেকে নজরে নজরে রাখছি।পিছু পিছু ঘুরেছি পাত্তা দাও নি।এতো তেজ কই থেকে আসে আজ দেখবো।সব রস নিংড়ে বের করবো।

ছায়াকে ধাক্কা দিয়ে ছায়ার উপর চড়ে বসলো।ঠিক সেই মুহুর্তে আহানের বুকে সজোড়ে লাথি বসায় কেউ।আহান উল্টে গিয়ে পড়ে মাটিতে রাখা পাথরে বারি খায়।যার দরুন তার মাথা থেকে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে।ছায়া তাকিয়ে দেখে চিৎকার করে উঠে,

-অরূপদা আমাকে বাঁচাও।এই শয়তানটা আমাকে..

এইটা বলেই হুহুহু করে কাঁদা শুরু করলো।
অরূপ একবার ছায়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।ছায়ার উন্মুক্ত পেটে নোখের আচড়।কাধে কামড়ের দাগ।কামড় থেকে লাল তরল পড়ছে।পুরো শরীরে ধুলোবালি ।অরূপের চোখে জ্বালা ধরে।তার সত্তায় কেউ যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।।দুনিয়াটা এতো নিষ্ঠুর কেনো।অরূপের বুকে তীব্র কষ্ট হচ্ছে।সে রূদ্ধশ্বাস ফেললো।প্রচণ্ড হিংস্রতায় গর্জে উঠে সামনে এগিয়ে গিয়ে আহানের পুরুষাঙ্গে লাথি মারে।

-তোর সাহস হয় কি করে এই পবিত্রার গায়ে আচড় লাগানোর।তোর হাত কাঁপলো না।যার গায়ে আজ অবধি একটা ফুলের টোকা দেইনি তুই দিলি কোন সাহসে।আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস তুই।তোর হাত আমি রাখবো ভেবেছিস?

অরূপ যেনো নিজের মাঝে নেই।আহানকে এলোপাথাড়ি মারা শুরু করলো।আহানের সাথে সাথে অরূপের হাতও হলো লালাভ রক্তে রঞ্জিত।তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো আহান।তার মুখ অনবরত থেকে বের হচ্ছে বিশ্রী নোংরা গালি।অরূপ আহানের মুখ চেপে ধরে। আহানের চুল টেনে ধরে তার পেটের উপর বসে বুকে থাবা বসালো।ছায়া দৌঁড়ে গিয়ে অরূপকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে।অরূপ শান্ত হয় কিন্তু থরথর করে কাপতে থাকে রাগে ।ছায়া ক্রন্দনরত কন্ঠে বলে,
-অরূপদা ছেড়ে দাও।মরে যাবে।
অরূপ ছেড়ে দেয়।মাটি থেকে উড়না নিয়ে ছায়াকে ঢেকে দিয়ে বুকে আগলে নেয় পরম স্নেহে।ছায়া টের পার অরূপের শরীরের তীব্র কম্পন । অরূপের হৃদপিন্ডের তীব্র ধ্বনি।
ছায়া বিড়ালের ছানার ন্যায় অরূপের বুকে পড়ে রইল।
মানুষ গভীর নদীর অতলে তলিয়ে যাবার সময় একটা শক্ত অবলম্বন পেলে যেইভাবে আঁকড়ে ধরে ঠিক সেই ভাবে।এ যেন তের নিরাপদ আশ্রয়।এইখানে যে আর ভয় নেই।
আহান তার পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে ছায়ার হাতে দেয়।ছায়া চিঠিটা নিয়ে অরূপের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালে অরূপ বলে,

-বাসায় গিয়ে পড়িস।

ছায়া অরূপের কথা মেনে নিলো।আজ অরূপদা না এলে তার কি হতো।ভাবতেই শিউরে উঠে।
ছায়া কাঁদছে অনবরত। হিচকি তুলে কাঁদছে।
অরূপ ম্লান, নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– কোমল কাঁদছিস কেনো?তোর কোন ভয় নেই।আমি আছি তো।কেন এসেছিলি এইখানে?আমি না করেছিলাম অচেনা ছেলেদের সাথে কথা বলতে।সেই জায়গায় তুই এতো দূর অবধি চলে গেলি?

অরূপ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।

ছায়ার চোখে মুখে শংকা।কথা গলায় যেনো আটকে আসছে।ওষ্ঠাধর কাঁপছে। কাধের কামড়ের জায়গার ব্যথাটা যেনো এইইবার মাথা চারা দিয়ে উঠলো
দেহে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হলো।শ্বাস ভারি হয়ে আসছে,অপ্রকৃতস্থ মস্তিষ্কের স্নায়ু।
অরূপ বুঝতে পারলো তার কোমল কথা বলার অবস্থায় নেই।খুব খারাপ কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই সে এসে গিয়ে ছিলো নয়তো আজ কি হতো!ভাবতেই যেনো চারিপাশে নিকষ কালো আধার ছেয়ে যায়।
অরূপ ছায়াকে নিয়ে যায় ছায়ার বাড়িতে।

রেজাউল সাহেব মীরার মুখ থেকে সব শুনে যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো।মেয়ে প্রেম করছে?আবার আজ বাড়িতে মিথ্যে বলে প্রেমিকের সাথে দেখাও করতে গেলো!মেয়ে যে এতো বাড় বাড়বে সে কখনো ভাবেনি।মেয়েকে সে বিশ্বাস করেছিলো।আজই একটা হেস্তনেস্ত করবে।ঠিক তখনই ছায়াদের বাড়িতে হামিদা বানু, মালা আর রোওশানারা বেগম আর তার ছেলে মেয়ে আসে।শুক্রবার ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে।

-আসসালামু আলাইকুম ভাই ভাবী।কেমন আছো তোমরা?একি এমন কেনো লাগছে তোমাদের?কেমন থমথমে! কিছু কি হয়েছে?কেমন চিন্তিত লাগছে?

মীরা বেগম এইবার যেনো ঝড়ের পূর্বাবাস পেলো।এই মহিলাটার এখনই আসার সময় হলো।তিলকে তাল বানাতে এই মহিলাই যথেষ্ট।

রবিন এসে মামা,মামীকে সালাম করলো।

-মামা ছায়া কোথায় দেখছি না।আজ তোমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ নিউজ দিতে এসেছি।ছায়া বাইরে কি করে বেড়াচ্ছে কোন আইডিয়া আছে তোমাদের?

রেজাউল সাহেব বেশ অবাক হলেন।স্বীয় ভাগ্নে এইসব কি বলছে।তার এতোদিনের অর্জন করা সম্মান কি এইবার ধুলিসাৎ হতে যাচ্ছে?প্রেশারটা মনে হয় বেড়ে যাচ্ছে।রেজাউল সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন।কাউকে বুঝতে দিলেন না।

#চলবে#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৩১
(কপি করা নিষেধ)
ছায়া আর অরূপ বাড়িতে প্রবেশ করেই দেখলো পুরো বাড়ি থমথমে, ভয়ংকর রকম নিস্তব্দ,বেশ শীতল,শান্ত বিকারহীন।রেজাউল সাহেবের মুখ পাংশুটে, মীরা বেগমের চোখ থেকে যেমন আগুনের ফুলকি ঝরছে,হামিদা বানুর অশ্রুসিক্ত মুখাবয়ব। ছায়া বুঝতে পারছে না কি হয়েছে।
অরূপ ক্ষীণ অথচ শান্ত গলায় বললো ছায়াকে

-ঘরে যা।আমি না বলা অবধি বের হবি না।

ছায়া অরূপের কথা শুনলো।সে দ্রুত পদযুগল চালালো।
কিন্তু রোওশানারা বেগম ক্ষেপা বাঘের মতো গলা খাকারি দিয়ে উঠলেন,

-এই মেয়ে কার সাথে নোংরামি করে এসেছিস।বংশে শেষমেষ কালি লাগালি। আগেই বলেছিলাম।মেয়ে বড় হয়েছে।বিয়েশাদি দিয়ে দিতে।কেউ শুনেনি আমার কথা।এইবার বুঝো।নাগর জুটিয়েছে।তার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে এসেছে।
এইবার রোওশানা বেগম আরো জোরে জোরে বলা শুরু করলেন,

-এই তোর কাধে কি রে? কামড়ের দাগ না?জামাও তো ছেড়া।

এইবার মীরা বেগম গরম তেলে জল পড়ার মতো ছ্যাত করে উঠে।সে তড়িঘড়ি করে এসে ছায়ার উড়নাটা সরিয়ে ভালো করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন।অগোছালো চুল,গায়ে ধুলোবালি, চোখের কোনে জল,পেটে আঁচড়ের দাগ,কাধে কামড়।অজানা আতংকে তার বুক কেঁপে উঠে।মীরা বেগমের ভয়ংকর চোখের চাহনি।আগ্নেয়গিরির লাভার উদগিরনের ন্যায় ঘর কাপিয়ে চিৎকার করে উঠে,

-ছায়ারে কেনো করলি এমন?ছোট বোনটার দিকে তাকাতি।এতো সেয়ানা হয়ে গেলি তুই।এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোদের।কি হয়েছে তোর?এই অবস্থা কেনো?
এই বলেই ঠাস করে এক থাপ্পড় মারে গালে।ছায়া ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে। অরূপ এসে ছায়াকে ধরে ফেলে।

-আপনারা ভুল ভাবছেন।যা ভাবছেন আসলে এমন কিছু হয়নি।আমি সময়মত পৌঁছে গিয়েছিলাম।

রোওশানারা বেগম এইবার এগিয়ে এসে অরূপকে শাসিয়ে বলে,

-একদম আমাদের পরিবারের বিষয়ে নাক গলাবে না।
বেরিয়ে যাও।আমাদের চোখ আছে।বেশ বুঝতে পারছি।এই মেয়ে ধর্ষণ হয়েছে।

মালা এইবার মুখ বেকিয়ে বলে,

-কি যে বলেন না আপা ধ’র্ষ’ণ তো জোর করে হয়।ছায়া তো নিজের ইচ্ছায় গিয়েছিলো ছেলের সাথে তাহলে এটা ধ’র্ষ’ণ কীভাবে হয়?

অরূপ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে।
ছায়া এইসব শুনে হিম হয়ে যায়।অস্ফুটস্বরে বলতে থাকে আমি ধর্ষিতা না।আমি ধর্ষিতা না।

চিৎকার চেঁচামিচির আওয়াজ পেয়ে আশেপাশের প্রতিবেশীরা ছুটে আসে।
রেজাউল সাহেবের দৃষ্টি ভীষণ স্থির,নিষ্কম্প।তিনি অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত। মেয়েদের তিনি অতি আদুরে বড় করেছেন।মেয়ের বিষয়ে এইসব শুনতে তার কলিজাটা ফালি ফালি হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এখন নিজেকে কঠোর করতেই হবে।
তিনি আচানক ভাবনায় বুদ হয়ে থাকা গম্ভীর চোখ দুটো কুঁচকে অমসৃণ গলায় বললেন,

-আমি তোমাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি।আমার ভুল হয়েছে তোমাকে মোবাইল কিনে দেওয়া।তোমাকে এতো স্বাধীনতা দেওয়া।আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম।তুমি তা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছো।
আজ থেকে বাড়ির চৌকাঠ পেরোনো তোমার বন্ধ।

রেজাউল সাহেবের গলা ধরে আসে।হাঁপাতে থাকে।সোফায় গিয়ে বসে পড়েন।তিনি আর কিছু বলার অবস্থায় নেই।
মীরা বেগমের ঘোলা চোখ,চোখে জল নিয়ে একবার স্বামীকে পরোখ নিলেন।

ছায়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।সংকুচিত গলায় বললো,

-বাবা?আমি কিছু করি নি।

লজ্জা আর অপমানে ছায়ার পুরো শরীরে যেনো ছেপে গেলো।তীব্র ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। চোখে বিধুরতা,দ্বিধানীত,নত মুখ।তার বাবা মা যে তাকে ভুল বুঝছে।কিশোরীর ছোট্ট মনে জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় প্রবল বেগে আঘাত করলো একটি কথা সে কলঙ্কিত।ছায়া যেনো হঠাৎ করেই নিভে গেলো।

রোওশানারা বেগম এইবার কুটিল হেসে বলে,

-এইবার কে বিয়ে করবে তোকে?

পুরো ঘরের সমীরণ যেনো চঞ্চল হলো এইবার।ঘরে আসা প্রতিবেশীরা গুন গুন করে যা তা বলা শুরু করে।

-আপা গো আমরা তো মেয়েরে ভালো ভাবছিলাম।এখন এইটা কি হলো।

-আরে হ আপা দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটা উলটাইয়া খাইতে পারে না।

-দেখে মনে হচ্ছে রেপ হইছে।আল্লাহ ভালো জানে।

ছায়া কান চেপে ধরে। তার কানে যেনো কেউ গরম গলিত কয়লা ঢেলে দিয়েছে।ছায়া ভীতসন্ত্রস্ত হয় আশেপাশের পরিচিত মানুষের অবিশ্বাস্য আচরণে।ছায়ার চোখ টলমল করছে পানিতে।

অরূপ খুব শান্ত,নির্বিঘ্নে অস্বাভাবিক গলায় বললো,

-আমি বিয়ে করবো।

সবাই যেনো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।
রেজাউল সাহেব যেনো বিশ্বাস করতেই পারছেন না।এক অমিমাংসিত ভাবনায় ডুবে গেলেন।
মীরা বেগম আশংকিত গলায় বললেন,

-তুমি তো অন্য ধর্মের।

অরূপ এইবার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে।চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে রয়ে সয়ে ঝলসানো গলায় বললো,

-আজ সবার সামনে দাঁড়িয়ে কালিমা পড়ে আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।আমি মুসলিম হলাম।

উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো।নিশ্চল হলো সবার চোখ,সবাই যেনো কিছু মুহুর্তের জন্য হয়ে গেলো হতবাক,বিস্মিত, বিমুঢ়।
ছায়ার কানে বার বার কথাটা ধাক্কা খাচ্ছে।ছায়ার মনে তৈরি হলো অস্থিরতা। চোখ দুটো চঞ্চলচিত্তে অরূপের পানে নিবদ্ধ করলো।

-ভেতরে যা কোমল।

অরূপ শুণ্য দৃষ্টিতে তাকায় ছায়ার পানে।অরূপের লালাভ আখি দেখে ছায়া আতকে উঠে।
ছায়া চলে যায় নিজের রুমে অস্থিরচিত্তে।গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।এতো কিছু হবার পর হাতে থাকা চিঠিটা পড়ার কথা ছায়ার মনেই থাকলো না।
ছায়া নিজের ঘরে চলে যেতেই মীরা বেগম মাটিতে বসে পড়লেন।রেজাউল সাহেব অরূপকে উত্তর দেওয়ার আগেই বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো।হঠাৎই বুক চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া শুরু করে।মীরা বেগম দৌড়ে গিয়ে স্বামীকে ধরলেন।
হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো রেজাউল সাহেবকে।মাইনর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।রোওশানারা বেগম, মালা আর রবিন ছায়াকেই দোষী করলেন।মীরা বেগম পুরোটা সময় নীরবতা পালন করলেন।হামিদা বেগম পুত্রশোকে কাতর হলেন।মিজান সাহেব সব শুনে যেন মূর্ছা গেলেন।
….
-আমি যা শুনেছি তা কি ঠিক?কোন সাহসে তুই নিজের ধর্ম ত্যাগ করলি?উত্তর দে।আমাদের বংশের মান ইজ্জত এইভাবে ডুবালি?আমাদের পূর্ব পুরুষদের হায় লাগবে।তোকে আমি তেজ্যপুত্র করলাম।

অরূপের বাবা অনিন্দ্য মূখার্জী ক্রোধের সহিত ছেলের গালে সজোরে থাপ্পড় দিয়ে বললেন।

অরূপ যেন আজ নিজের কাঠিন্যতা বজায় রাখলো।খুবই শান্ত ছেলেটা হয়ে গেলো আজ বড্ড কঠোর, অবাধ্য।
সুস্মিতা দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের ছেলে আর স্বামীর সম্পর্কের ভাঙন দেখে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদছেন। কি থেকে কি হয়ে গেলো?সন্তান যাই করুক মায়েরা কি সন্তান অস্বীকার করতে পারে?

কেটে যায় ৭ দিন।ছায়া নিজেকে ঘরবন্ধী করে ফেললো।কাউকে আর জবাবদিহি করলো না।কেউ না জেনেই তাকে দোষারোপ করলো। সে আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইলো না।হঠাৎ করেই যেনো বড় হয়ে গেলো। রেজাউল সাহেব পূর্বের থেকে কিছুটা সুস্থ।রোওশানারা বেগম আর মালা ছায়াকে অপমান করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করলো না।হামিদা বানু যেনো নিস্তেজ হয়ে পড়ে।মীরা বেগম চুপ থাকলেন।
ঠিক সেইসময় এক সন্ধ্যায় রিয়া এলো দৌঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে। কোন দিকে না তাকিয়েই সোজা ছায়ার দরজায় অনবরত ধাক্কা দিতে লাগলো।ছায়া নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলো।দরজায় ধাক্কানো শুনে সে যেই না দরজা খুললো রিয়া ছায়ার বুকে ঝাপটে পড়লো।অনবরত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে আর বলছে,

-দ..দ..দা দ..দ..দা

ছায়ার অজানা আশংকায় কলিজা শুকিয়ে গেলো।
ছায়া রিয়াকে ঝাকিয়ে বললো,

-কি হয়েছে অরূপদার?এই রিয়া বল।

-আত্মহত্যা#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৩২
(কপি করা নিষেধ)
ছায়া ঢলে পড়লো ফ্লোরে।তার চোখ জোড়া নিমিঝিমি করছে।নিঃশ্বাস হলো ঘনতর।শরীর যেনো হঠাৎ করে তাপমাত্রা পরিবর্তন করে উষ্ণতর হয়ে উঠলো। ঠোঁট ফাক করে মুখ দিয়ে গরম হাপ বের করতে লাগলো। নিজের কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না।শ্রবণইন্দ্রিয়তে ঝংকার সৃষ্টি করছে।সে কি ঠিক শুনলো?এ হতেই পারে না?নিশ্চয় ভুল শুনেছে।ছায়া রিয়ার ক্রন্দনরত মুখপানে চেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-ক..ক..কি স..স..ব ব..ব..ল ছি স।অঅররুপপ দা?
রিয়ার নীরবতা যেন ছায়ার বুক ক্ষত বিক্ষত করছে।
ছায়ার হঠাৎ মনে হলো সেই চিঠিটার কথা।ছায়া হাতের উপর ভর দিয়ে উঠতে চাইলো।কিন্তু শরীর অতিরিক্ত দূর্বল থাকায় উঠতে গিয়ে আবার পড়ে গেলো।এরপর এক হাতে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে এলোমেলো পায়ে চিঠিটা খুজঁলো উন্মাদের ন্যায়।চিঠিটা পেলো টেবিলের একবারে কোণায় অবহেলায় পড়ে আছে।ছায়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একবার চোখ বন্ধ করে অরূপদার হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা স্মরণ করে ঠোঁট কামড়ে অবাধ্য কান্নাটা আটকে চিঠিটা পড়া শুরু করে।

“প্রিয় কোমল,
তুমি বলেই সম্বোধন করছি।শুনেছি প্রেমিকাদের তুমি বলে সম্বোধন করতে হয়।কিন্তু তুমি যে আমার না হওয়া প্রেমিকা।সেই ছোট্ট থেকেই কেনো জানি খুব টান অনুভব করতাম।কিন্তু বুঝতাম না এতো কিসের টান।বড় হবার সাথে সাথে যেনো বুঝলাম এই মেয়েকে ছাড়া আমার চলবে না। এইটা যে শিকড়ের টান আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেথে গিয়েছে প্রিয়।এইবার উপায়?আমার জীবনে প্রাণচাঞ্চল্যতা দানকারী কিশোরী তুমি।শীতের রিক্ততা শেষে বসন্তে যেমন দখিনা বাতাসের মৃদু চরণধ্বনি শুনা যায় ঠিক তেমন তুমি নামক সেই বসন্তের বাতাসের স্পর্শে আমার অশান্ত হৃদয়ের মর্মদোলায় দেয় দোল।উত্তরের বিষাক্ত হিমেল হাওয়া বিদায় হয় তোমার আগমনে।যখন তোমাকে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছট ফট করি, হৃদয়ে হয় চৈত্রে ফোটা কৃষ্ণচূড়া, অশোক ফুলের ন্যায় টকটকে লাল রক্তক্ষরণ।সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরী যেনো আমার অন্তরীকরণে কালবৈশাখী ঝড়ের মাতম এনে দিলো।সেই দিন শাড়ি পরিহিতা কিশোরীর পূর্ণ যৌবনা যেনো কলিকার ন্যায় প্রস্ফুটিত হচ্ছিল।আমি বুঝলাম আমার সর্বনাশ অতি সন্নিকটে।আমার মুক্তি নেই।আমার হৃদয়কে করলো চৈত্রমাসের কাঠফাটা রোদের ন্যায় উত্তপ্ত। আমি হাসফাস করলাম এক ফোটা প্রেমের বারির অপেক্ষায়।হলো কই?সেই তৃষ্ণার্তই রয়ে গেলাম।সেই সপ্তাদশী কিশোরীর শরীর থেকে আসা কস্তূরীর ন্যায় ঘ্রাণ যেনো করলো আমায় সংযম ছাড়া।রূপচ্ছটা আমার হৃদয়ে আনলো বসন্তের ছন্দহিন্দোল।আমাকে একটু ভালোবাসা গেলো না কোমল?আমি যে বড্ড ভীতু।যেইদিন তোমায় দেখলাম অন্য একটা ছেলের সাথে আমার হৃদয় সেইদিনই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো।মনকে মিথ্যে সান্তনা দিলাম সব মিথ্যে।কিন্তু দেখো সব জানি কেমন নির্জীব হয়ে গেলো।আমি চাইবো জীবনে একটিবার সেই লাল শাড়িপরিহিতা কিশোরী আমাকে উষ্ণ আলিঙ্গন করুক।আমার অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করুক।আমি সব সময় চাইবো আমার কোমল ভালো থাকুক।যদি জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতি আসে তবে নিজেকে ভালো রেখো।মনে রেখো তোমার ভিতর আমার সুখ।তোমার দুঃখে আমি কখনো ভালো থাকবো না।ভালো থেকো।”
ইতি
“অরূপ”

ছায়া চিঠিটা পড়ে নির্বাক মূর্তির ন্যায় হয়ে গেলো।ছায়া কাঁদলো না।চোখের পলকও পড়লো না একটিবার।ছায়া পা টেন টেনে আলমারি থেকে সেই লাল শাড়িটি বের করলো।খুব সুন্দর করে পাক্কা গৃহিনীর ন্যায় শাড়ি পড়লো।আলতা বের করে পা আলতা দিয়ে রাঙালো।চুলে দিলো সেই দিনের শুকিয়ে যাওয়া রজনীগন্ধার গাজরা।চোখ কাজল দ্বারা আবৃত করলো।
রিয়া এমনিতেই ভাই হারানোর শোকে কাতর।এইদিকে প্রাণপ্রিয় বান্ধবী ছায়ার অস্বাভাবিক আচরণ মেনে নিতে পারছে না।ছায়াকে ঝাকাচ্ছে আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
-পাগল হয়ে গিয়েছিস ছায়া? কি করছিস এইসব।

ছায়া নিষ্প্রাণ কন্ঠে বললো,

-অরূপদা আমাকে এই শাড়িতে আরেকবার দেখতে চেয়েছে।তাই সাজছি।
এইবার রিয়া হাউ মাউ করে কেঁদে দিলো।ভাইয়ের মন কিছুটা হলেও বুঝতে সক্ষম ছিলো।কিন্তু এ যে কোন কালেই হওয়ার ছিলো না তাই চুপ থাকতো।এইবার যেনো তা কান্নার বাঁধ ভাঙলো।সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির শোকের মাত্রা টের পেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদা শুরু করলো।এইদিকে কান্নার শব্দ পেয়ে ছায়ার মা মীরা বেগম এগিয়ে এলেন।এরপর সব শুনতে পেয়ে তার পায়ের তলায় মাটি সরে যায়।

ছায়া চিঠিটা হাতে নিয়ে অরূপদের বাড়ি যায় গুটি গুটি পায়ে। শাড়ির আচঁল মাটিতে গড়ায়।চোখের কাজল লেপ্টে একাকার।মাথার চুল এলোমেলো।মুখ একদম নির্জীব।চারিপাশ থেকে আহাজারি আর কান্নার রোল ভেসে আসছে।আগর বাতির সুঘ্রাণ বাতাসে।একটা কাঠের পাটাতনে চাদরে মুড়ানো সেই ব্যর্থ প্রেমিক।ছায়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেই দিকে অপলক। তার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো।সব যেন সুনামির তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।সে ধীর পায়ে হেটে গিয়ে বসলো অরূপের পাশে।মিহি কন্ঠে শুধালো,
-এই অরূপদা দেখো,তাকাও আমার দিকে কি সুন্দর সেজে এসেছি।শাড়ি পড়েছি।পায়ে আলতা দিয়েছি।তুমি না একদিন বলেছিলে ‘কিরে কোমল তুই আলতা টালতা পড়িস না?শুনেছি পা আলতা দিয়ে রাঙালে নাকি দেখতে বউ বউ লাগে।’আমি শুনে খিলখিল করে হাসতাম।তুমি মনোযোগ দিয়ে সেই ধ্বনি শুনতে।আমাকে হাসানোই বুঝি তোমার মুখ্য উদ্দেশ্য হতো।
এখন আমি সত্যি সত্যি আলতা পড়েছি।
ছায়া অরূপের বুকে ধাক্কা দিতে লাগলো অনবরত।

এইদিকে অরূপের মৃত্যুর খবর শুনে ছায়ার পরিবার আরো আগেই উপস্থিত হয়েছিলো।তারা মেয়ের এমন পাগলের ন্যায় ব্যবহার মানতে পারছেন না।বড্ড কষ্ট লাগছে।
অরূপের মা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছিলেন।ছায়ার কথা শুনে উনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন।দ্রুত হেটে ছায়াকে দূরে সরিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে,

-খবরদার ছুবি না আমার ছেলেকে তোর সেই কলঙ্কিত হাত দিয়ে।আজ তোর জন্য আমার ছেলে আমার বুকে নেই।তুই কেড়ে নিয়েছিস মুখপুড়ি।আমার ছেলেকে মৃত্যু দোয়ারে ঠেলে দিলি কালনাগিনী। আমার ছেলেকে তুই মেরেছিস।
রিয়া দৌঁড়ে এসে মাকে ঝাপটে ধরে।

-ও মা এমন কথা বলো না।ছায়ার দোষ নেই মা।

-আমার ছেলে আত্মহত্যা এই মেয়ের জন্যই করেছে।

ছায়া যেনো নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলো।সে নিজের অবস্থান বুঝতে পারলো।তার হৃদয়ে প্রবল বেগে আঘাত করলো একটি কথা অরূপদা আর নেই।বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় যেনো সব চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো।ললাট, গলদেশ ঘামতে লাগলো।পুরো দুনিয়া দুমড়ে মুচড়ে গেলো।
এইবার ছায়া চিৎকার করে কেঁদে উঠে অরূপদা বলে।সে দৌঁড়ে গিয়ে অরূপকে ঝাপটে ধরলো।আহাজারি করলো।মাটিতে হাত চাপড়ালো।মাটিতে মাথা ঠুকলো।
রিয়া গিয়ে ছায়াকে জড়িয়ে ধরলো।কিন্তু থামানো গেলো না।সুস্মিতা নিজেও ছায়ার কান্না দেখে ব্যথিত হলো।ছায়া অরূপের পা ধরে বিলাপ পারলো,
-অরূপদা আমাকে ক্ষমা করো।বাবা মায়ের পর কাউকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলে সেই পুরুষ তুমি।আমার নিরাপদ আশ্রয়স্থল।ভরসার আশ্রয়স্থল। আমার মাথার উপর তোমার বটবৃক্ষের ন্যায় ছায়া ছিলো।আমি যে তোমাকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসতাম।কেন চলে গেলে?কেনো আমাকে তোমার ভালোবাসা ছাড়া করলে?কেনো?ফিরে এসো।অরূপদা।

ছায়ার গলা ফাটা কান্নায় উপস্থিত সবাই মুর্ছা গেলো।
ছায়া দৌঁড়ে নিজের মায়ের কাছে গেলো,
ঘোলা চোখ,জিভ যেনো জড়িয়ে আসছে।
-মা অরূপদাকে উঠতে বলো না।
মীরা বেগম মেয়ের নাজেহাল অবস্থায় কাঁদলেন মুখ লুকিয়ে।
এরপর ছায়া দৌঁড়ে নিজের বাবার কাছে গেলো,
-এই বাবা তোমরা বললে অরূপদা ঠিক উঠবে বলো না
এরপর আবার দৌঁড়ে রিয়ার কাছে এলো,
-এই রিয়া তোর দাদাকে উঠতে বল।অংক ভুল করলে কে আমার কান মুলে দিবে বল?বল না।আমার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিবে কে?কাঁদলে কে চোখের পানি মুছিয়ে দিবে?এই রিয়া দেখ না আমার বুকে প্রচন্ড ব্যথা করছে।অরূপদা উঠে না কেন?

ছায়া আবার অরূপের কাছে দৌঁড়ে গেলো। অরূপের কাপড় খামছে ধরে কাঁদলো।হয়তো জীবনের সব চোখের পানি আজই বিসর্জন দিবে।
ইশশ দুনিয়াটা এতো কষ্টের কেনো হয়?
ছায়া শেষবারের মতো অরূপকে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত উষ্ণ আলিঙ্গন দিলো। কিন্ত্য ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যেই আলিঙ্গনের জন্য সেই প্রেমিক পুরুষ দীর্ঘ বর্ষ,মাস অপেক্ষা করলো সে দেখে যেতে পারলো না।কে জানে হয়তো কোথাও না কোথাও থেকে সে অনুভব করলো প্রিয়তমার মধুর আলিঙ্গন।

রাতের আধারে নিমজ্জিত চারিপাশ। অদূরে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে।ঝিঝি পোকার ডাকও শুনা যাচ্ছে।সোডিয়াম নিয়নের আলোয় হালকা আলোর রেখা খেলা করছে আধারে।এক বিষন্ন কিশোরী এক কবরের পাশে বসে আছে মাটি আকড়ে।দিনের বেলাও যেইখানে আসলে গায়ে কাটা দেয়।সেই নিস্তব্ধ পরিবেশে এক কিশোরী দুঃখ বিলাস করছে।তার কান্নার মিহি আওয়াজ চারিপাশে তরঙ্গের ঢেউ সৃষ্টি করছে।
কেউ পারলো না তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে।অরূপদা একা থাকতে পারবে না তো।সে চলে গেলে হয়?

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here