কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব -০১+২

“ক্যান আই কিস ইউ?”

ভরা ক্যাম্পাসে উচ্চ স্বরে চিরকুটে লেখা শব্দগুলো পড়ল সজল। মূহুর্তেই আশেপাশের সকলের নজর পড়ল এদিকটায়। পলক তাজওয়ার বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল আশেপাশে। সজলের দিকে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে বলল,
“কমনসেন্স কি পাইকারি বাজারে বিক্রি করে দিছিস? এতজোরে কেউ এসব পড়ে? কিস করতে চায় তো ভালো। যা না চিপায় চাপায় গিয়ে কার্য হাসিল কর। ভরা ক্যাম্পাসে মাইকিং করছিস কেন? আশ্চর্য।”
সজল মেকি হেসে বলল,
“ভাই চিঠিতে আফনের নাম মেনশন করা। সামনে এমন টসটসে আম রাইখা ক্যাডা এই পঁচা কাঁঠালের বিচির দিকে নজর দিব? হেই কপাল আমাগো আছে নাকি।”

পলক তাজওয়ার জহুরীর মত পর্যবেক্ষণ করল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঘর্মাক্ত মানবীর দিকে। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে গাল গড়িয়ে। হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে। শ্যামা তরুণীর ঘোমটার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে ঘন কালো কেশের গাছি।
পলক লাফ দিয়ে বাইক থেকে নেমে গেল। বা হাতে সিল্কি চুলগুলো সেট করে এগিয়ে গেল ঘর্মাক্ত মানবীর দিকে। গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে শুধালো,
“নাম কি?”
“তিয়াশা তপা।” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল তপা।
“কোন ইয়ার?”
“ফার্স্ট ইয়ার। ভর্তি হতে এসেছি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিন্তু ভর্তির ডেট তো ওভার হয়ে যাওয়ার কথা।”
তপা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
“আজ লাস্ট ডেট।”
“ওহ। কিন্তু এটা বলো মেয়ে, ভর্তি হতে এসেই পলক তাজওয়ার কে কিস করতে চাওয়ার দুঃসাহস দেখিয়ে ফেললে? বুক কাঁপলো না একবারও?”
তপার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো “আমার ঠ্যাকা পড়েছে আপনার মত নাক উঁচু টাইপ মানুষকে কিস করতে চাওয়ার। দেশে কি কিস করতে চাওয়ার মানুষের অভাব পড়েছে নাকি?”
কিন্তু কিছুই বলা হলো না তার। কণ্ঠনালী তার সাথে বেইমানী করছে আজ। মনের ভেতরে স্বশব্দে উচ্চারিত হওয়া একটা কথাও বের হচ্ছে না গলা দিয়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আমার কথাটা একটু শুনুন?”
পলক বাকা হেসে বলল,
” কোথায় কিস করতে চাও? গালে? নাকি ঠোঁটে?” বলেই ঠোঁট পাউট করে দেখালো পলক। তপার গা শিরশির করে উঠল। দুপা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আমার কথা শুনুন একবার প্লিজ।”
পলক গম্ভীর ভরাট কন্ঠে বলল,
“এসো আমার সাথে।”
বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ঠিক যেদিক দিয়ে এসেছিল তপা। যাওয়ার আগে চিলের মত ছো মেরে চিরকুটটা নিয়ে গেল সজলের হাত থেকে।

তপার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। লোকটা কি সত্যি সত্যি চুমু খেয়ে বসবে নাকি? অদৃশ্য মন্ত্রবলে বশীভূত হয়ে তপাও পেছন পেছন ছুটলো পলকের।
পেছনে হা করে তাকিয়ে রইল সজল। অবাক হয়ে একা একাই বিরবির করল, ” ভাই কি সত্যি সত্যি চুমু খাবে ?”

তিনশত আট নাম্বার রুম। এই রুমটা হলরুম নামেই পরিচিত। বেশ বড় রুম হওয়ার তিন তিনটে দরজা এই রুমে। পলক একটা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। তার প্রবেশে ভেতরে এতক্ষণ ধরে চলা আড্ডায় ভাটি পড়ল। তপা ভেতরে গিয়ে চমকে গেল। সেই ছেলেমেয়ে গুলোর দল। যারা তপার হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছিল। ভার্সিটি চত্বরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মুখোমুখি হয় তাদের। তপার হাতের কাগজের ফাইল ছিনিয়ে নিয়ে বিনিময়ে চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুদর্শন যুবককে দিতে। তপা বুঝতে পারে নি এতগুলো মানুষের মাঝে সবচেয়ে সুদর্শন যুবককে সে চিনবে কি করে? আর চিরকুটেই বা কি লেখা আছে? জিজ্ঞেস করতেই ছেলে মেয়েগুলো হেঁসে উঠেছিল উচ্চস্বরে। একজন কে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়েছিল এই সুদর্শন যুবক পলক তাজওয়ার কে। তপা মনে মনে বলল, “কুলক তাজওয়ার।”

পলক হুংকার দিয়ে বলল,
“এটা কার হাতে লেখা?”
সবাই চিৎকার শুনে মাথা নিচু করে ফেলল। আগে বুঝতে না পারলেও এখন তারা বুঝতে পারছে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বাঘ ক্ষেপে গেছে মানে আজ কপালে শনিরদশা আছে।
“আমি জানতে চাইছি কে লিখেছে এই চিরকুট?”
আবারও চিৎকার শুনে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে সবাই। তপাও কিছুটা ভড়কে গেছে। চোখ পিটপিট করে কেবল চেয়ে রইল পলকের দিকে। মাত্র কিছুক্ষণ আগেও বুঝতে পারে নি শান্ত মানুষটা এতটা বদমেজাজী।
“আর এক মিনিট সময়। এর মধ্যে যদি না জানতে পারি কে লিখেছে এটা। তবে এই রুমের একটা পিঁপড়ের হাতও লেখার মত অবস্থায় রাখবো না গড প্রমিস।”
ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল রাত্রি। মাথা নিচু করে বলল,
“আমি লিখেছি। ওদের দোষ নেই।”
পলক নিজেকে কন্ট্রোল করতে কপালে আঙুল বুলালো। ঠোঁট কামড়ে কয়েক বার এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
“ভাগ্যিস মেয়ে হয়ে জন্মেছিস। আমি মেয়েদের গায়ে হাত দেই না বলেই বেঁচে গেলি। আর একদিন যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছি তবে ভুলে যাব তুই একটা মেয়ে।”

তপা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তপাকে আরও অবাক করে দিয়ে তপার সামনে দাড়িয়ে গরগর করে বলল,
” আর তুমি? একজনে হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিল আর তুমি নাচতে নাচতে চুমু খেতে চলে গেলে? এত শখ চুমু খাওয়ার?”
তপা মাথা নিচু করে ফেলল। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা জল। সন্তর্পণে তা মুছে নিল বাম হাতে। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“নিজের স্বপ্ন যখন অন্যের হাতে বন্দি হয়ে যায় তখন একটা চুমু কেন বিষ খেতে বললেও চোখ বন্ধ করে খেয়ে নিতে পারি আমি।”
পলক অবাক হয়ে দেখল চোখে জল নিয়ে ঠোঁটের কোণে ঝুলতে থাকা মেকি হাসি।

“আমার ফাইল দিন। নয়তো উনি যে কাজটা করে নি সেটা আমি করে দেব।”
রাত্রি অবাক হয়ে বলল,
“কি করবে তুমি?”
তপা ডান হাতটা উঁচু করে বলল,
“এই যে হাতটা দেখছেন এটা পেডিকিউর মেনিকিউর করা মোলায়েম হাত নয়। এটা খেটে খাওয়া মানুষের শক্ত হাত। এই হাতের চড় যদি একবার গালে পড়ে না সাতবার মেকআপ করেও দাগ মুছতে পারবেন না। দিন ফাইলটা। বলে চেয়ারের উপর রাখা নিজের ফাইল নিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল তপা।
পলক অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মৃদু স্বরে বলল,
” বাহ কি ঝাঁঝ। একেবারে ধানিলংকা । কিন্তু ঝাসিকি রানীর এই ঝাঁঝ এতক্ষণ কোথায় ছিল?”

সবাই চলে যেতেই রাত্রি চেয়ারে লাথি মেরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করল। তপার চৌদ্দ গোষ্ঠীর পিন্ডি চটকাতেও ভুলল না।

ভর্তির কাজ শেষে মাঠের কর্ণারে বরাদ্দকৃত জায়গায় গিয়ে বসল তপা। ভীষণ ক্লান্ত সে। তার জীবনটাই কেন এত ঝামেলায় জড়ানো? নির্ঘাত ঝামেলা লগ্নে জন্মেছে সে। তাই তো ঝামেলা পিছুই ছাড়ছে না।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল দিল একমাত্র বান্ধবী পৃথা কে। তপার একমাত্র আপনজন সে। এই অচেনা শহরের একমাত্র চেনা মানুষটা। গ্রাম থেকে এসে পৃথার বাসায়ই উঠেছে তপা।কিন্তু অন্য কারো বাসায় আর কতদিন? তাই তো আজ পৃথাকে নিয়েই বের হবে বাসা খুঁজতে। মোটামুটি একটা থাকার মত নিরাপদ জায়গা হলেই হবে। যাতে রাতে একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারে সে। কতদিন শান্তির ঘুম ধরা দেয় নি দুচোখের পাতায়।

তপা আপনমনে বসে বিরবির করছিল। সহসা পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অকস্মাৎ তাকাল। পলককে দেখে ভ্রু কুঁচকে এল তার।মনে মনে বলল,” এই কুলক তাজওয়ার আবার কি চায় এখানে? একটু বসেও শান্তি নেই যেন। সব জায়গায় অশান্তির মেলা।”

পলক ভরাট গলায় বলল,
“রাত্রিকে ওসব না বললেও পারতে।”
তপা অলস ভঙ্গিতে হাই তুলে বলল,
“কেন? জ্বলছে? এতই যখন জ্বলন তাহলে গেলেন কেন সেখানে? আমি পায়ে ধরিনি আমাকে বাঁচানোর জন্য।”
পলক নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
” পলক তাজওয়ারের পায়ে ধরা কেন মরে গেলেও সে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করে না। আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি গিয়েছি। কেন গিয়েছি তার কৈফিয়ত নিশ্চয়ই আমি তোমাকে দেব না। রাত্রির জন্য এত জ্বালা থাকলে আমি সেটাই করতাম যা চিরকুটে লেখা ছিল। এতক্ষণে এই ঠোঁট ঠোঁটের জায়গায় অক্ষত থাকতো না। আমার ইচ্ছে হলে এতক্ষণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত আমার ঠোঁটের স্পর্শে।”
তপার সারা শরীর রি রি করে উঠল রাগে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলার আগেই দ্রুত গতিতে তপার কোমর চেপে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“এরপর কথা বললে সাবধানে বলবে। শুধু কথা কেন তুমি বা তোমার ঠোঁট কোনোটাই যেন আমার চোখের সামনে না পড়ো। নেতাদের চরিত্র কিন্তু অতটাও ভাল হয় না। আমার কলঙ্কে কলঙ্কিত হতে না চাইলে সাবধান।”
কথা শেষ করে এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে শার্টে ঝুলিয়ে রাখা চশমাটা চোখে পড়ে দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল।
তপা বেয়াক্কেলের মত তব্দা খেয়ে বসে রইল।
#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০২

চিলেকোঠার ছোট্ট একটা ঘর। উপরে টিনের ছাউনি। রুম থেকে বেরিয়েই নজরে আসবে সাদা গোলাপের সাজানো বাগান। পুরো ছাঁদ জুড়ে অন্য কোনো ফুলের কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। কেবল সাদা গোলাপ। তপা বিদ্রুপাত্মক হাসল।
” বাহ ফুলেদের বেলায়ও সাদা কালো বাছ বিচার শুরু হয়ে গেছে তবে। কেবল আমিই অবহেলিত নই কালো রঙের জন্য।”
ছোট্ট একটা দোলনা। তার পাশেই শারীরিক কসরতের কিছু জিনিসপত্র। তপা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখানে আবার কে ব্যায়াম করতে আসে? বাড়িটা নিরাপদ হবে তো আমার জন্য?”

পৃথা তপার নতুন সংসার গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল। গোছানোর তেমন জিনিসই নেই তার। কেবল একটা সিঙ্গেল বেড, পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার আর রান্নার জন্য কিছু বাসনপত্র। ব্যস আর কিছু নেই। একা থাকতে আর কি লাগে? আপাতত একটু নিরাপত্তাই মূল চাওয়া তপার জীবনে।

তাজমহল।
ঐশ্বর্যের এক জলন্ত উদাহরণ। না না আগ্রার শাহজাহান মমতাজের তাজমহল নয়।তাজওয়ারদের তাজমহল। রায়হান তাজওয়ার একজন সফল ব্যবসায়ী। পায়েল তাজওয়ার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার। পায়েল রায়হান দম্পতির একমাত্র সন্তান পলক তাজওয়ার।
দরজা ঠেলে হেলেদুলে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো পলক। পায়েল রান্না ঘর থেকে উচ্চস্বরে বললেন,
“পলক এদিকে এসো। কথা আছে তোমার সাথে।”
অগ্যতা নিজের গতি পরিবর্তন করে মায়ের কাছে গেল পলক।
“রাত্রির সাথে কি করেছো তুমি?”
পলক অবাক না হয়ে কপালে আঙুল চালিয়ে বলল,
“ওহ! খবর পৌঁছে গেছে। তা তোমার রাত্রি তোমাকে বলে নি কি করেছি আমি?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সে জানে এই ছেলে সোজা কথা সোজাসাপটা বলতে পারে না। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“ওকে সবার সামনে অপমান করেছো তুমি?”
পলক অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“ওর সম্মানবোধ আছে নাকি? থ্যাংক গড তুমি বললে। আমি তো জানতামই না।”
“পলক। ভুলে যেও না আমি তোমার মা। বাইরের অন্য পাঁচটা লোকের মত তুমি আমার সাথেও একই ব্যবহার করতে পারো না।”
পলক একসাথে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা। আমি এমনি এমনি কিছু করি না সেটা তুমিও জানো বাবাও জানে। তবে বাইরের একটা মেয়ের কথা শুনে কেন নিজের ছেলেকে জাজ করো? ও শুধু আমি কি করেছি সেটা বলল। কিন্তু কেন করেছি সেটা বলল না? ও একটা নিষ্পাপ মেয়ের সম্মান নিয়ে টানাটানি করছিল মা। হেনস্তা করতে চেষ্টা করেছিল। সেটা আমি কি করে হতে দেই?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“অন্য কেউ কি করল তা আমার দেখার বিষয় নয়।কিন্তু আমার ছেলে যেন কোনো অন্যায় না করে সেটা তো আমাকে দেখতে হবে তাই না? নয়তো পাছে শুনতে হবে অন্যের সন্তান মানুষ করতে গিয়ে নিজের সন্তান মানুষ করতে পারি নি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
“আমাকে দেখে অমানুষ মনে হয় তোমার?”
পায়েল হাসি লুকিয়ে বললেন,
“খবরদার আমার সামনে ভ্রু কুঁচকাবে না। তুমি কি ভাবো তোমার বাইরের চামচেদের মত তোমার কুঁচকানো ভ্রু দেখে আমি ভয় পাব? ভুলে যেও না আমি তোমাকে পেটে ধরেছি। আকাশ থেকে টপকে পড়ো নি। আর একবার এরকম ভাবে তাকালে হাতে খুন্তি দেখেছো তো? পাছে লজ্জায় চামচে না না তোমাদের ভাষায় ফ্যান ফলোয়ার, তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।”
পলকের কুঁচকানো ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঁচকে গেল। মাথা নাড়িয়ে বিরবির করতে করতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে।

গায়ে ওড়না জড়িয়ে জানালার পাশে বসল তপা। একফালি চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘরময়। জানালা খুলে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল চাঁদের দিকে।
” চাঁদ তুইও কি আমার মত নিঃসঙ্গ? তোরও কি ভরসা করে আঁকড়ে ধরার মত একটা হাত নেই? তুইও আমার মত লুকিয়ে বেড়াস তোর দুঃখগুলো? নাহ তোর আবার কিসের দুঃখ। তুই তো সবচেয়ে সুখী। তোর রূপের এত তেজ যে কলঙ্কটা কারো চোখে পড়ে না।কিন্তু আমাকে দেখ কলঙ্ক না করেও কলঙ্কিত আমি। কালো রঙটাই কি আমার কলঙ্ক? এটা কি আমি নিজে গড়েছি বল? আল্লাহ দিয়েছেন আমার কালো রঙ। এতে আমার কি দোষ? তুইও নিশ্চয়ই নাক ছিটকাচ্ছিস? ভাবছিস এই কলঙ্কিত নারী কেন তোর আলোয় আলোকিত হওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। কিন্তু জানিস তো দিন শেষে আমরা দুজনেই একা। আমাদের দুঃখগুলো এক সুতোয় বাঁধা। তোর যেমন তোর কলঙ্ক নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নেই তেমনি আমারও নেই। কিন্তু কি বলতো মাঝে মাঝে মানুষের কথায় ভীষণ কষ্ট হয়। সে এক নিদারুণ কষ্ট। তাই তো তোর কাছে বলে নিজেকে হালকা করি। কাল আবার নতুন উদ্যোমে বাঁচতে হবে তো। তুই কি বিরক্ত হোস? কিছু করার নেই রে। বিরক্ত হলেও আমি তোকেই বলবো। তুই ছাড়া কে আছে আমার?”

দু টুকরো পাউরুটি মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল তপা। কেনাকাটা করতে হবে। চাল, ডাল, সবজি কিচ্ছু নেই ঘরে। পাউরুটি খেয়ে তো আর জীবন চলবে না। বাজারে পৌঁছে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে ফিরতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল সে। হাতের টাকা প্রায় শেষের দিকে। রিকশা নিলে ভাড়া নিশ্চয়ই অনেকগুলো টাকা গুনতে হবে। মামার দেওয়া সামান্য কিছু টাকা রয়েছে হাতে। বাড়ি ভাড়া অগ্রিম দিতে গিয়ে এই ঝামেলায় ফেঁসে গেছে সে। কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই নাকি নিয়ম। দু’হাতে বাজারের ব্যাগ তুলে হাঁটা শুরু করল তপা। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর আর কুলোচ্ছে না হাতে। নিজেকে অজস্র গালাগালি দিল মনে মনে। এত কিছু কেনার জন্য। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরেই ভাবল এটুকু তো কিনতেই হতো। রোজরোজ তো বাজারে আসতে পারবে না সে। ক্লাসও তো করতে হবে দু’দিন পর থেকে। তাছাড়া পৃথার ধরিয়ে দেওয়া টিউশনিটাও করতে হবে। আরও খুঁজতে হবে। একটা টিউশনি করিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাবে কীভাবে আর খাবেই বা কি? বাড়ি ভাড়াও দিতে হবে মাসে মাসে। টেনশনে দম বন্ধ হয়ে আসে তপার। হাতের ধরে রাখা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“জন্মেছাে অভাগী হয়ে আর জীবন কাটাতে চাও ননীর পুতুলের মত? ধিক্কার তোমাকে তিয়াশা তপা।”

“মামা আমাকে নিয়ে ভেবোনা তুমি। আমি এখানে ভালো আছি। এখানে কষ্ট হলেও শান্তিতে ঘুমাতে পারবো আমি। নিজের রোজগারে খোঁটা ছাড়া দু মুঠো খেতেও পাব। এখন থেকে শুধু খাবার হজম করলেই হবে মামা। খোঁটা দেওয়া কথাগুলো হজম করতে হবে না। আমি এখানে সত্যি ভালো আছি। কাল থেকে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। তুমি শুধু দোয়া করো আমি যেন বড় হতে পারি মামা। এতটাই উঁচুতে উঠতে পারি যেখানে ওই মানুষগুলো আমাকে ছুঁতেও পারবে না। দেখতে ইচ্ছে করলে চলে এসো মামা। তোমার জন্য আমার ঘরের দরজা সব সময় খোলা। কিন্তু অন্য কেউ যেন না আসে প্লিজ। আমি আর পেছনে তাকাতে চাই না।”

কলেজে পৌঁছে নিজের ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য লিফটের কাছে গেল তপা। দুবার লিফটে চড়া হয়েছে ওর। সাথে মামা ছিলেন একবার, অন্যবার পৃথা। মনে মনে একটু ভয় হচ্ছে। কিন্তু কি করবে সে? ছয়তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে সকালের আলুসিদ্ধ ভাত এখনই হজম হয়ে যাবে। তাই উপায় না পেয়ে উঠে গেল লিফটের ভেতরে। চোখ বন্ধ করে সুইচ প্রেস করার আগেই হনহন করে ভেতরে প্রবেশ করল পলক তাজওয়ার। বাঁহাতে ধরে রাখা ফোনটা কানের সাথে সেঁটে দেওয়া তার। একনজর পলকের দিকে তাকিয়েই সেদিনের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল । সহসাই হাতটা চলে গেল নিজের ঠোঁটের উপর। মুখ ঢেকে আল্লাহ আল্লাহ করতে শুরু করল তপা।

ফোন কানে লাগিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে সে।
” ওরা এখনো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে কি করে ইডিয়ট? তোরা আমার নাম ভাঙিয়ে যখন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে মাস্তি করিস তখন আমার পারমিশন নিস? তাহলে এখন কেন? লাফরা করিস আমার সাথে? ওদের হসপিটালে অ্যাডমিট করে আমাকে ঠিকানা টেক্সট কর। নয়তো তোর গার্লফ্রেন্ড নামটা যেন কি? মিনা না টিনা ওর সাথে কিসিং মোমেন্টের ফটো এক্সিবিশনে পাঠিয়ে দিব। অবশ্যই ওর মুখটা দেখা যাবে না। কিন্তু তোর ওই পঁচা কাঁঠালের বিচি ঠিকই জলরঙে ঝিকঝিক করবে। সো চয়েজ ইজ ইউরস।”
বলে টুক করে লাইন কেটে ফোনটা পকেটে চালান করে দিল।

তপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পলকের দিকে। লোকটা কি আগাগোড়াই এমন ঠোঁট কাটা?
পলক তপার বিস্ময়ে ভরা চোখজোড়া খেয়াল করল কিনা জানা নেই তার। কিন্তু যাওয়ার সময় আড়চোখে তাকানো টা খুব করে দেখেছে সে।

চলবে…
চলবে…

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#সুচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here