গল্পটা_আমারই (সুরমা) পর্ব : ৩

গল্পটা_আমারই

(সুরমা)
পর্ব : ৩

সেদিনের পর ভেবেছিলাম অর্ণবের সাথে আমার আর দেখা হবে না। বেশ কিছু দিনও কেটে গেছিল। এর মধ্যে তন্বী আপু আমাকে কয়েকবার তার সাথে যেতে বলেছিল। আমি যাই নি। আমার সেখানে যাওয়াট কারণ তো অর্ণব।

আমি যখন অর্ণবকে এক নজর দেখতে পারি না তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়। ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে কাজ করে তৃপ্তি পাওয়া যায়। কিন্তু মনটা অস্থির হয়ে থাকে অন্য কিছুর জন্য।

কাজ করে মেসে ফিরে আসার পরও আমার মন ভালো হতো না। ইচ্ছে করতো কাঁদি। কিন্তু কাঁদতেও পারতাম না। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করলে ভাবতাম আমি কতটা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছি।তখন অর্ণবের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

কিন্তু না, অর্ণবের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। রেস্টুরেন্টে। সেদিন আমি আর আমার ফ্রেন্ড মিতুল রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। আমি আবার ফাস্টফুড খাবার খুব পছন্দ করি। যার কারণে মাঝে মাঝেই আমার রেস্টুরেন্টে যাওয়া হতো।

আমার আরেকটা গুণ আছে। সেটাকে বাজে গুণও বলা যায়। সেটা হলো যেখানেই যাই প্রচুর ছবি তোলি। ছবি না তোললে আমি তৃপ্তি পাই না। সামান্য একটা জায়গাকে আমি অসামান্য করে তোলি আমার ক্যামেরায় বন্দী করে।

সেদিনও তাই হয়েছিল। মিতুল গিয়েছিল ওয়াশরুমে। এই ফাকে আমি ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সেদিন আমার ক্যামেরায় একটা মুখ ভেসে উঠেছিল। হুম, সে আর কেউ না। আমার কাঙ্ক্ষিত সেই মুখ। অর্ণব। ক্যামেরায় অর্ণবের মুখটা ভেসে উঠতেই আমার বুকটা ধরাম করে কেঁপে উঠেছিল।

প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো আমার ভুল। কল্পনা করি বলে এমনটা মনে হচ্ছে। কিন্তু না। সেটা কল্পনা ছিল না। বাস্তব ছিল।

আমি পেছনে ফিরে দেখি অর্ণব ল্যাপটপে কাজ করছে। আমার মন থেকে ছবি তোলার নেশাটা নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেছিল। আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই অর্ণবের কাছে এগিয়ে গেলাম। আরো একটি বার অর্ণবের কণ্ঠটা শোনতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে হলো সেই মানুষটার সাথে একটু সময় কাটাতে।

অর্ণব নিজের মতো করে কাজ করেই যাচ্ছে। আমি তার সামনের চেয়ারটা টেনে বসতেই অর্ণব মুখ তোলে তাকায়। আমি কিছু বলার আগেই অর্ণব বলে,,,
– তুমি??
– জ্বি, চিনতে পেরেছেন আমায়??
– না চিনার কোনো কারণ নেই। তন্বীতো তিনটা কথা বললে দুইটা কথায় তোমার সম্পর্কে বলে। অর্ণবের কথা শোনে এবার আমি অবাক হলাম। সেদিন স্বপ্নেও অর্ণব আমাকে এসব বলেছিল। আজ বাস্তবেও তাই হলো। আমি বললাম,,,

– আসলে দেখলাম আপনি একা একা বসে আছেন। আর আপনার মতো একজনের সাথে কথা বলতে পারাও আমার ভাগ্যের ব্যাপার। তাই চলে আসলাম কথা বলতে। আমার কথা শোনে অর্ণব নিজের গালে হাত দিয়ে চোখ গুলো ছোট করে কেমন অদ্ভুত রকমের হাসি নিজের মুখে এনে আমার দিকে তাকায়। অর্ণবের সামনে বসে আমার শরীর রীতিমতো কাঁপছিল। ভয়ে না। এই কাঁপার পেছনে কারণ ছিল ভালোবাসা। আগে অনেকবার শুনেছি কেউ যদি কাউকে গোপনে ভালোবাসে তাহলে তার সামনে গেলে নাকি হাত পা কাঁপে। লজ্জা লাগে। এমনকি কথার মধ্যে জড়তা তৈরি হয়। আজ তার প্রমাণ পেলাম।

অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছিল আমার।এরকম ফিলিংস আগে কখনও কারো জন্য হয়নি আমায়। তবুও সাহস করে বসে রইলাম অর্ণবের সামনে। অর্ণবের এমন বিহেভ আমাকে আরেকটু বিচলিত করে তুলে। অর্ণব বলে,,,,,

-আমি কি আলাদা কেউ??
-জ্বি, অন্য কারো কাছে আপনি কি আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে আপনি স্পেশাল একজন। আপনার কাজকর্ম, আপনার ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরণ, অন্য সবার থেকে আলাদা। তাছাড়া আপনার মানবতা আমার খুব ভালো লাগে।

আমার কথা শোনে অর্ণব এবার হাসলো। আর আমি সেই হাসির নেশায় ডুবে গেলাম। সত্যি অর্ণবের হাসিটা মনোমুগ্ধকর। স্বপ্নে দেখা সেই পাগল করা হাসি। আমি হা করে চেয়ে দেখলাম হাসিটা। ইচ্ছে করছিল দুহাতে সেই মায়ার হাসিটা কুড়িয়ে তোলি। অর্ণব বলে,,,,

-আমি আলাদা কেউ না। আমি অন্য সবার মতো। তাছাড়া আমার কাজকর্ম গুলোও আলাদা কিছু না। এই কাজ গুলো তুমিও করতে পারবে। যদি আমার কাজ গুলো অন্য কারো দ্বারা সম্ভব না হতো তাহলে আমি আলাদা হতাম। হয়তো সবাই এরকম কাজ করে না। কিন্তু চাইলেই করতে পারবে।

ইশ! মানুষ এতো সুন্দর করে কিভাবে কথা বলে। একটা মানুষের মধ্যে এতগুলো ভালো গুণ এক সাথে কিভাবে থাকে। অর্ণবের সাথে কথা বলছিলাম। ওর প্রত্যেকটা কথা আমার হৃদয়ে লাগছিল। ইচ্ছে করছিল অর্ণবকে বলি,,,,,

” অর্ণব আমি আপনার সব কিছুকে ভালোবাসি। ভালোবাসি আমি আপনার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম জিনিস গুলোকে। ভালোবাসি আপনাকে।ভালোবাসতে চাই আপনার ভালোবাসাটাকে। আমাকে দেবেন আপনার ভালোবাসাটা। কথা দিচ্ছি যত্ন করে রাখবো হৃদয়ে।”

অর্ণবের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি কেমন বেহায়া হয়ে গেছি। নির্লজ্জও বলা চলে। যেখানে আমি কখনও ভার্সিটিতে থাকা ছেলে ক্লাসমেট গুলোর সাথে কথা বলতাম না সেখানে নিজে সেধে অর্ণবের সাথে কথা বলতে চলে এসেছি।

আমি অনেক্ষণ চুপ করে দুনিয়ার সব কথা চিন্তা করে ফেললাম। তখন অর্ণব বলে,,,,

-কফি খাবে? আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। একটা কফির ছলে অর্ণবের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে। কিছুতেই এই লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি বললাম,,,,

-আপনি এখানে একা বসে কি করছিলেন?
-কাজ করছিলাম। আসলে আজিমপুর পথশিশুদের একটা স্কুল আছে। ওখানে বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগ, খাতা, কলম, এবং স্কুলের ড্রেস প্রয়োজন। তার জন্য টাকা কালেক্ট করতে হবে। এটা নিয়েই কাজ করছিলাম। আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনছিলাম। আমি বললাম,,,,,,

-আমি আপনাকে হেল্প করতে চাই। আমার কথা শোনে অর্ণব অবাক হয়ে বলে,,,,,,
-কিভাবে??
-আমি প্রতি মাসে আপনার ফাউন্ডেশনে বিশ হাজার করে টাকা দিবো। এবার অর্ণব বেশ অবাক হলো। সে ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললো,,,,
-এতো টাকা?
-জ্বি?

-কিন্তু তুমি এতো টাকা কেন দিবে আমাকে??
-আপনাকে দিবো না। বাচ্চাগুলোকে দিবো। কথাটা বলেই আমি হেসে দিলাম। অর্ণবও হাসলো। আমি আবার বললাম,,,,
-আমিও আপনার মতো এই শিশুগুলোর পাশে থাকতে চাই। জানি আপনার মতো ওদের সাহায্য করতে পারবো না। তবে একটু শরীক থাকতে চাই। আই মিন, আপনার পাশে থাকতে চাই।
-থ্যাংকইউ সো মাচ। এটা বাচ্চাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
-আপনার ফোন নাম্বারটা কি পেতে পারি?
-অহ, অবশ্যই। অর্ণব আমাকে তার ফোন নাম্বারটা দিলে আমি খুবই খুশি হই। এখন থেকে তাহলে অর্ণবের সাথে আমার কথা হবে। আমি বললাম,,,,

-আমি কি আপনাকে কল করতে পারবো??
-অবশ্যই। কল করতে না পারলে নাম্বার দিয়ে কি করবে।
-আপনি তো অনেক বিজি থাকেন তাই জিজ্ঞেস করলাম।
-আমি যে কারণে বিজি থাকি তুমিও তার মধ্যেই আছো। যা হোক, আমার অনেক ভালো লাগলো তুমি এই শিশু গুলোর জন্য এতগুলো টাকা দিচ্ছো। ওরা অনেক উপকৃত হবে। বড়লোকরা ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা ইনভেস্টমেন্ট করে তবুও গরীবদের জন্য একটা টাকা খরচ করতে তাদের হাত কাঁপে। তারা চাইলেই কিন্তু আমাদের দেশটা উন্নত হতে পারে। শিক্ষার অভাব থাকে না। আমরা নিজেরা শিক্ষিত হলে কোনোদিন দেশ উন্নতি করতে পারবে না। নিজের শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরেকজনের শিক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। অর্ণব একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে। আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। খুবই ভালো লাগছে অর্ণবের কথা গুলো। ওর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসা আরো বাড়তে লাগলো। অর্ণব যেন আমার নেশা হয়ে গেছিল।

সেদিন অর্ণবের থেকে নাম্বারটা নেওয়ার পর থেকে ওর সাথে আমার কারণে অকারণে কথা হতে লাগলো। এমনকি অর্ণবকে আমি আমার ফ্রেন্ডলিস্টেও জায়গা দিয়েছিলাম। অর্ণব প্রথম ছেলে ছিল আমার ফেইসবুকে। এমনকি আমার হৃদয়ের গহীনেও।

চলবে——

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here