গোধূলি বেলায় পর্ব ৮

#গোধূলি_বেলায়
#পর্ব_8

অন্ধকার ঘরটার মধ্যে অনেকক্ষন ধরে বসে আছে আনন্দি। সেই যে সবাই ওকে বসিয়ে রেখে গেল তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। সারাদিনের ধকলে ঘুমও পাচ্ছে খুব, অনেক রাত হয়ে গেছে মনে হয় । কয়টা বাজে বুঝতে পারছে না আনন্দি। অন্ধকার ঘরটাতে নিজেকেই ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছে না অন্য জিনিস তো দুরে থাক।

অনেক ক্ষন হয়েছে এবার আনন্দির বেশ বিরক্ত লাগছে। কয়টা বাজে দেখতে পেলে ভাল হতো। ঘরের মধ্যে একটা বড় ঘড়ি আছে। অনেকক্ষণ ধরে সেই ঘড়িটা থেকে টিকটিকি শব্দ আসছে। মাঝে মাঝে ঢং ঢং করেও শব্দ হচ্ছে, ঘন্টার প্রবাহের ইঙ্গিত হয়তো এই শব্দ। একে একে অনেকটা ঘন্টাও পার হয়ে গেল।

আনন্দির আর ধৈর্য নেই। একে শরীর এতো দুর্বল, তাতে এতো ওজনের শাড়ী আর গয়না। শাড়ির ওজনে যেন আনন্দির কোমর বাকা হবার জোগার। আনন্দি আস্তে করে উঠে দাড়াল, কোন রকমে হাতড়ে হাতড়ে হাটা চেষ্টা করছে। এর আগে এই ঘরে দুই একবার আসা হয়েছিল আনন্দির তবে সেটা নেহাতেই ক্ষনিক সময়ের জন্য। এখন থেকে নাকি এই ঘরটা ওর ভাবতেই কেমন জানি লাগছে।

হাতড়ে হাতড়ে হাটতে গিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় হোচট খেল আনন্দি। বেশ অনেকটা ঘোরার পরও লাইটের সুইচটা খুজে পেল না আনন্দি। হতাশ হয়ে ফিরে যাবার সময় দড়জার পাশে কিছু শব্দ শুনল। হয়তো সমাপ্ত এসেছে তাই দ্রুত আবার বিছানায় ফিরে গেল। দ্রুত হাটতে গিয়ে শক্ত কোন কিছুতে পায়ে অনেক জোরে ধাক্কা খেয়েছে আনন্দি। হয়তো রক্তও বেড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আনন্দি ওই অবস্থায় আবার বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল।

সমাপ্ত ঘরে ঢুকে কিছুটা সময় দাড়িয়ে থাকল। এই নিকস কালো ঘরটাই কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। আস্তে করে ডিম লাইটটা জালিয়ে দিল সমাপ্ত। ভেবেছিল হয়তো আনন্দি ঘুমিয়ে পড়েছে তাই বড় লাইটটা জালায় নি। কিন্তু ডিম লাইটের আলোতে দেখলো আনন্দি এখনও বিছানায় বসা। সমাপ্ত একবার আনন্দির দিকে তাকিয়ে হনহন করে ওয়াসরুমে ঢুকে পড়ল।

বিছানার ঠিক মাঝখানটাই বসে আছে আনন্দি। উল্টো দিকে মুখ করে বসে সমাপ্ত । আনন্দির দিকে পিঠ করে বসেছে সমাপ্ত তাই এই মুহু্র্তে আনন্দির প্রতিক্রিয়াটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু কেন জানি আজ এই মেয়েটার সাথে কথা বলতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। হয়তো বাবা মার রাগটা এখন ট্রান্সফার হয়ে আনন্দির উপর গিয়ে পড়েছে।

এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। দুজনেই চুপ থাকে অনেকটা সময়। হঠাৎ একটা নারী কন্ঠ এসে ধাক্কা খায় সমাপ্তর কানে।

– আমি জানি তোমার এখনকার মনের অবস্থা। আমি সরি আমার জন্য তোমার এমনটা হল। তবে তুমি চিন্তা কইরো না তুমি আগের মতোই থাকো, তোমার মতো। আমি কোনদিনও তোমার সমানে আসবো না নিজের অধিকার নিয়ে।

সমাপ্ত পিছনে ফিরে তাকালো। আগের মতো সেই আধ হাত ঘোমটাটা আর নেই যেটা বাসর ঘরে এসে বর তুলে দেয়। হয়তো সেটা আনন্দি নিজেই তুলেছে। সমাপ্তকে তাকাতে দেখে আনন্দি আবারও বলল,,

– এটুকু ভরসা তো আশা করতেই পারি তাই না। আজকের দিনটা সহ্য কর, বাড়ি ভর্তি আত্মীয়। তবে কাল থেকে আবার সব কিছু আগের মতো হবে।

– অনেকরাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।

আনন্দি ওই অবস্থায় কোনরকমে গুটিসুটি মেরে শুতে গেল। সমাপ্ত আবারও শান্ত গলায় বলল, এতো ভারী শাড়ি নিয়ে শুয়ে পড়ছ যে। ঘুমাতে পারবে তো।

আনন্দি আবারও উঠে বসে কিন্তু মাথাটা নিচু করে রাখে। মনে মনে বলে, মাথা মোটা শাড়ি চেন্জ করে পড়বটা কি খালি ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে ঘুমাতে বলিস। মনে মনে আরও কয়েকটা ভঙ্ককর গালি দিতে দিতে সমাপ্তর দিকে তাকালো। কখনই চোখে পড়ল সোফার উপর ভাজ করে কাপড় রাখা আছে যেটা এতোক্ষন ঘোমটা দিয়ে বসে থাকার জন্য আনন্দি দেখতে পায় নি।

আনন্দি বিছানা থেকে উঠে কাপড়গুলো নিয়ে ওয়াসরুমে যায়। ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে দেখন সমাপ্ত বিছানাটা ঝেড়ে ঠিক করে রেখেছে। আর বিছানার ঠিক মাঝখানটাই একটা ফাস্ট এইড বক্স। আনন্দি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বিছানার দিকো। তখন পায়ে লাগায় এখনও ব্যথা করে।

আনন্দি বিছানার কাছে যেতেই সমাপ্ত আনন্দির দিকে তাকিয়ে বলল, বস।

আনন্দি চুপ করে বিছানায় বসে পড়ল। সমাপ্ত এসে আনন্দির পাটা ধরে উপরে তুলতে নিলে আনন্দি আচমকা পা টা সরিয়ে নিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ করে। সমাপ্ত আনন্দির দিকে তাকিয়ে বলল,, কি হয়েছে?

– তুমি এভাবে আমার পায়ে হাত দিলে কেন?

– কেন পাপ হয়ে গেল বুঝি?

– হ্যা। তুমি এমন হুটহাট আমার পায়ে হাত দিবে না তো।

সমাপ্ত হাসল খানিকটা। তারপর বলল, এই না বললে সব আগের মতোই থাকবে। কাল সবাই চলে গেলে আর তুমি আমার কাছে অধিকার চাইবে না তাহলে আমি পা ধরলে কি সমস্যা?

– ওটা তুমি বুঝবে না।

– সত্যি তোমরা মেয়েরা বড় রহস্যময়ী। কিংবা কখন কি কর, কখন কি বল তা নিজেও জানো না।

আনন্দি চুপ থাকলো। কি বলবে ও। সত্যি তো ও এতোক্ষন বলল, ও আর সমাপ্তর সামনে স্ত্রীর অধিকার চাইবে না। কিন্তু মনে মনে তো ও ঠিকই সমাপ্তকেই নিজের সবটাই মানে। আগে এমন মনে হতো না কিন্তু সেই যে তিন কবুল বলল তারপর থেকে ও পুরোটাই যেন বদলে গেছে। এটা হয়তো বিয়ে বাধন। কবুল বলার পর থেকেই এক অদ্ভুত একটা টান চলে আছে যা পৃথিবীর সব মায়ার উর্ধে।

আনন্দিকে চুপ থাকতে দেখে সমাপ্ত বলল, একজন বন্ধু হিসেবে আমি তোমার পা ধরলে তো কোন পাপ হবে না। তাই না।

আনন্দি এবারও চুপ করে থাকল। সব ভাষারা যেন ওর মুখের মধ্যে এসে হাড়িয়ে যাচ্ছে। সমাপ্ত আবারও আনন্দির পাটা ধরে উপরে তুলল। এবার আনন্দি কোন বাধা দিল না কিন্তু মনে মনে ওর একটা অপরাধবোধ হতে থাকল। কি এমন হল যে পা ধরতে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই নিচে তাকাতে দেখল ওর পা দিয়ে রক্ত বের হয়ে পুরো পাটা রক্তে মেখে গেছে।
এমন কি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ও যে যায়গাগুলো দিয় হেটে গেছিল তা রক্তের ছাপ পড়ে গেছে।

সমাপ্ত আনন্দির পা ধরে প্রথমে রক্তগুলো মুছল তারপর ঔষধ লাগিয়ে দিয়ে আনন্দির দিকে তাকাল। আনন্দি প্রচন্ড বিষ্ময় নিয়ে সমাপ্ত দিকে তাকিয়ে আছে।
সমাপ্ত একটু গলা খাকরি দিয়ে বলল, তুমি এই আবস্থাতে এভাবে বসে ছিলে। দেখ বেডসিটেও রক্ত লেগে গেছে। এটা পরিষ্কার করার কথা মাথায় আসে নি।

আনন্দি মাথা নিচু করে বসল। সমাপ্ত আবার আনন্দির দিকে তাকিয়ে বলল, এখন প্লিজ এটা বলো না যে পা কেটে গেছে তা তুমি বুঝতেই পার নি।

আনন্দি হালকা করে মাথাটা নাড়াল। সমাপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হাইরে আল্লাহ্ , এই মেয়ের কোন ইন্দ্রিয় কাজ করবে না কি। এতোটা কেটেছে এতো রক্ত পড়ে অথচ বলে কি না সে বুঝতেই পারে নি।

বলেই এক দফা হেসে নিল সমাপ্ত। আনন্দি তখনও গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। সমাপ্ত কিছুটা কড়া কন্ঠে বলল, হয়েছে এবার। অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়।

আনন্দি উঠে আলমারি থেকে একটা বেডসিট বোর করে। আগের বেটসিটটা ওয়াসরুমে রেখে এসে নতুনটা বিছিয়ে দেয়। তারপর বলল, ওটাতে রক্ত ছিল কাল ধুয়ে দিব নে।

– খবরদার, এই পা নিয়ে পা নি নাড়বে না। অন্য কাউকে বল।

তারপর কি জানি ভেবে বলল, না থাক আমি নিজেই ধুয়ে দেব নে কালকে।

– আপনি কেন ধুবেন আমি বরং পারুলকে বলব ধুয়ে দিতে।

– বললাম না আমি ধুয়ে দেব। এতো বেশী কথা কোন বল।

– পারুল ধুলে কি সমস্যা?

এবার সমাপ্ত আনন্দির দিকে বেশ রেগে রেগে তাকালো তারপর বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বাসর রাতের পর রক্ত লাগানো বেডসিট অন্য ধোয়ানোর মানে বোঝ?

আনন্দি মাথাটা দুদিকে দুলালো। সমাপ্তর যেন আরও রাগ হলো। পড়ে মনে হল ও তো এমনিতেই ছোট তারউপর মা নেই। মেয়েরা তো এসব কথা মায়ের থেকেই বেশী জানতে পারে। দায়িত্ববান মায়েরা নিজের সন্তানকে এই সব জ্ঞান দেয় যাতে ওরা জীবনে কোন ভু না করে বসে।

সমাপ্ত কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল, ঘুমিয়ে পড়।

– না ঘুমাবো না। বলো না কি হবে? বলা না প্লিজ।

– সমাপ্ত পড়েছে উভয়সঙ্কটে। কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল, সেক্স বুঝো।

– আনন্দি মাথাটা মৃদু দুলালো। ওকে এঘরে রেখে যাবার সময় আরফা বলছিল। তবে এতটাও ডিটেলে নয়। তবুও মাথাটা দুলালো।

সমাপ্ত আনন্দির দিকে তাকিয়ে বলল, এটার মানে ওটা বোঝায়। এখন আর বলতে পারব না। আমার ঘুম পেয়েছে।

আনন্দি সমাপ্তর কথা শুনে যেন লজ্জায় জমে গেল। আর কিছু বলতে পারল না। এবার সত্যি সত্যি গুটিসুটি হয়ে সুয়ে পড়ল। সমাপ্তও লাইটটা অফ করে এসে শুয়ে পড়ল।

পরের দিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো সমাপ্তর। ঘুম ভাঙ্গার পর আনন্দিকে দেখি হয়তো অাগে উঠে পড়েছে। উঠে ফ্রেস হয়ে নিল সমাপ্ত। সমাপ্ত প্রত্যেকদিন সকালে তাততারি উঠে জগিং যাওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরী হয়ে যাওয়াতে ডেইলী রুটিনের হেরফের হয়ে গেছে।

সমাপ্ত ফ্রেস হয়ে নিচে এসে দেখলো আনন্দি সবার জন্য খাবার সার্ভ করছে। আত্মীয় সজন সবার প্রায় খাওয়া হয়ে গেছে। এখন টেবিলে শুধু বাসার লোকরাই বসে আছে। সমাপ্ত গিয়ে টেবিলে বসল। আজ নাকি সব খাবার আনন্দি রেধেছে।
বিয়ে পর আজ আনন্দির প্রথম শশুড়বাড়িতে সকাল। আর পরিবার নিয়ম অনুযায়ী আজ সারা দিনের সব রান্না আনন্দিকে করতে হবে অবশ্য অন্যরাও হেল্প করবে।

সমাপ্ত নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। আনন্দি জানে সমাপ্ত মুখে যতোই ভাল কথা বলুক না কেন ও মন থেকে আনন্দিকে মেনে নেয় নি। কিন্তু আনন্দিরও তো কিছু করার ছিল না।
আনন্দি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাজে মন দিল। আরফা পাশে এসে জিজ্ঞেস করল, কি সব ঠিক আছে তো।

– হ্যা। কেন?

– না সমাপ্ত ওভাবে বেড়িয়ে গেল। খাবার সময়ও কারও সাথে রোন কথা বলল না। তোর সাথে কথা বলছে।

– হ্যা বলেছে তো।

– বললেই ভাল। হয়তো এভাবে বিয়ে হওয়াতে একটু রেগে আছে। তবে তোর সাথে কোন সমস্যা না থাকলেই ভাল। আমাদের উপর ওর রাগ বিকালেই কমে যাবে।

আরফা হাসল। আনন্দিও হাসার চেষ্টা করল। তবে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হাসিটা আবারও মিলিয়ে গেল। সত্যি কি ওদের মাঝে সব ঠিক আছে? সমাপ্ত কি ওকে মেনে নেবে আদৌ? জানে না আনন্দি।
তবে নিজের দিক থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা ও করবে। এভাবে এই পবিত্র সম্পর্কটা ভেঙ্গে যেতে দেবে না কিছুতেই।

চলবে,,,

জাকিয়া সুলতানা

বি দ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। জীবনটা পুরাই প্যারাময় হয়ে গেছে। কাল থেকে পেইন দিতেই আছে আজও চলছে। ভাই কেন, আপনাদের এতো সমস্যা কেন আমার থেকে। যাই হোক আজকে পুরোদিন প্যারার মধ্যে কেটেছে, কোন রকমে লিখে পোস্ট করছি। এমন কি ইডিট ও করা হয় নি। একটু কষ্ট করে পড়ে নেবেন। ধন্যবাদ,,
হ্যাপি রিডিং

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here