গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক ২ পর্ব -০৮+৯

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-৮)
সিজন ২
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

আজ ইকরার গায়ে হলুদ। মেহজা কিছুদিন হলো জানতে পারে যে এই পুরো বিল্ডিংটার মালিক যে আহনাফ মজিদ তিনি আর কেউ না ইকরা, ইরফানদের বাহিরে। এতে অবশ্য তার মাথা ব্যথা নেই। তবে ব্যাপারটা দারুন বলা চলে। আজ পুরো বিল্ডিং এর সবাইকে নিমন্ত্রন করা হয়েছে। মেহজারাও যাবে। অ্যাপার্টম্যান্টের চারিধারে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নানান রঙের আলোকসজ্জা সহ রয়েছে বাহারি ফুলের মেলা। মেহজা বারান্দা থেকে বাহিরের এই সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখেছে। নিচে নাকি কয়েকটি ফুচকার স্টল করা হয়েছে। খুব বেশি মানুষজন দেখা যাচ্ছে। অবশ্য মেহজার ধারণা বেশি মানুষের মধ্যে মজা হয়। ইকরা মেহজাকে আগে আগেই তাদের বাসায় যেতে বলেছে তবে সে এখনও যায়নি। বর্তমানে বিছানার উপর নিজের সব জামা কাপড় বিছিয়ে মুখ বেজার করে বসে আছে। কোনটা পরবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। তার মন চাইছে ইরফানের সাথে ম্যাচিং করে পরতে। আচ্ছা ইরফান কী রঙ পরেছে? হলুদ না সোনালী? নাকি টিয়া! ড্রেস কোড এই তিনটা। এখন ইরফান কোনটা পরেছে? সে আবারও বারান্দায় গেল। যদিও আঠারো তলা থেকে নিচের আলোকসজ্জা ছাড়া আর কিছুই ভালো বোঝা যাচ্ছে না তবুও সে চাতক পাখির মতো তৃষ্ণিত হয়ে চেয়ে আছে সেদিকে। ইদানিং ইরফানকে দেখাও যায় না তেমন একটা। আজ দেখবে সেই খুশিতে সে দিশাহারা। এবারও আশাহত হয়ে বারান্দা থেকে চলে এলো। তবে রুমে আসতেই শুনতে পেল কিছু পুরুষকন্ঠ উচ্চস্বরে কথা বলছে। একটা তো রাদিফের কন্ঠ, আরেকটা? সেই কন্ঠও তো মেহজা চেনে। সে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রয়িং রুমের পাশেই তার রুমটা। তাই দরজা থেকেই দেখতে পেল রাদিফ আর ইরফান কথা বলছে। হাতে বাক্স। রাদিফ বলছে,
-‘ইরফান ভাই এগুলো এখন এখানেই রাখি। একটু পর নিয়ে যাব।’
-‘হ্যাঁ সেটা ভালো হয়। এখানেই রাখো।’
বাক্সটা এক কোণে রেখে তারা চলে যাচ্ছিল। দরজা পর্যন্ত যেতেই ইরফান বলল,
-‘তোমাদের বাসায় কেউ নেই?’
-‘মেহজা আছে বোধ হয়। মা পাশের বাসায় গেছে। আসবে এখন।’
-‘আচ্ছা। ও যাবেনা?’
-‘কে? মেহজা?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘আরে ওর তো সাজগোজ হয়নি এখনও। সেই কখন থেকে সাজছে। শেষই হচ্ছে না। মেয়ে মানুষ বলে কথা।’
দুজনেই হেসে দিল হা হা করে। তবে এই যাত্রায় মেহজার রাগ হলো না। অন্য সময় হলে সে সত্যিই ঝগড়া করত। তবে সে এখন একটা জিনিস ভেবেই খুশি যে ইরফান তার খোঁজ নিয়েছে। মেহজা রুমে গেল। ইরফানের পরনে সে সাদার উপর সোনালী কারুকাজের একটি পাঞ্জাবি দেখেছে। মেহজা জানে তার এমন কোনো জামা নেই। তবুও খুঁজে দেখে যদি কিছু পাওয়া যায়! অবশেষে সে ক্ষান্ত হলো। তার এমন কোনো পোশাকই নেই। মন খারাপ করে সে বিছানায় বসে রইল। চোখ ছলছল করে উঠছে। তখনিই মনে পড়ে তার মা কিছুদিন আগেই একটি শাড়ি কিনেছে। শাড়িটি সোনালী রঙের পুরোটা। পাথরের কাজ রয়েছে, খুবই সুন্দর! তবে সে শাড়ি পরবে? এটা হয় নাকি! তার লজ্জা লাগে এমন শাড়ি টাড়ি পরতে। এমন নয় যে সে কখনো পরেনি। পরেছে। বন্ধু মহলে পরেছে তবে এমন কোনো ফাংশনে পরা হয়নি। মেহজা অপেক্ষা করতে থাকে কখন তার মা পাশের বাসা থেকে আসবে। সে এদিক সেদিক পায়চারি করতে থাকে, ডাইনিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিতেই তার মা হাজির। পানি আর ছুঁলো না। সে খুশি মনে মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। তার মা সাবিনা বেগম তাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন,
-‘এই! তুই এখনো তৈরি হোস নাই! তোকে সেই কখন দেখলাম জামাকাপর বের করতে। এখনও তোর এই অবস্থা! তা অনুষ্ঠান তো শুরু হয়ে গেছে। ইকরার আম্মু কল করেছে। বলেছে তাড়াতাড়ি যেতে। আর তুই তৈরি হলি না!’
-‘আম্মু! আমি পরার মতো জামা পাচ্ছিনা।’
-‘কী! এত জামা তারপরেও পাচ্ছিস না!’
-‘আরে না সেটা নয়। ড্রেস কোড দেওয়া হয়েছে তিনটা। এর মধ্যে দুইটা কালার আমার ভালো লাগেনা। তবে একটা ভালো লাগছে। কিন্তু সেই রঙের জামা নেই।’
-‘কী কালার?’
-‘গোল্ডেন কালার।’
-‘তো না থাকলে অন্যটা পর।’
-‘না না আমি এটাই পরব। তোমার একটা শাড়ি আছে না নতুন? গোল্ডন কালার!’
-‘ও হ্যাঁ! আছে তো। তুই পরবি?’
-‘হুম। যদি তুমি দাও তো।’
-‘দিব না কেন! আয় আয় তাড়াতাড়ি করে ব্লাউজ পেটিকোট পরে নে। তোর তো গোল্ডেন ব্লাউজ থাকার কথা। লাল শাড়িটার সাথে পরেছিস যে!’
-‘হুম আছে। তুমি বসো আমি আসছি।’

অতঃপর মা নিজের মেয়েকে অতি যত্নে শাড়ি পরিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন। মেক আপ টা মেহজা নিজেই করল। ভালোই মেক আপ পারে সে। আর তার ম্যাচিং জুয়েলারি ছিল সেগুলো পরেছে। মেহজাকে দূর্দান্ত লাগছে! শাড়িটা অনেক সুন্দর। মেহজা চুলে খোপা করেছে। এতে তাকে বেশ বড় মানুষ লাগছে। বাবা তাকে দেখে বলল,
-‘সোনামনি কী বড় হয়ে গেছ! বাবা তোমাকে আরো শাড়ি কিনে দিব। তোমাকে শাড়ি খুব মানায় আমার বাচ্চা।’
বাবা মাথায় টুক্কুস দিলেন। মেহজা কিছুটা আবেগি হয়ে গেল। তারপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে সে ইকরা দের বাসার উদ্দেশ্যে গেল। ওর বাবা-মা সরাসরি নিচেই যাবে। হলুদের আয়োজন মাঠে করা হয়েছে। লজ্জা আর সংকোচ নিয়েই মেহজা পা রাখে ইরফান নামক মানুষটার আঙিনায়।

১৭.
মেহজা যখন ইরফানদের বাসায় ঢোকে তখন চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো অবস্থা হলো। এমনিতেও বাসাটা সুন্দর তার উপর আরো সুন্দর করে সাজানো। তাছাড়া চারিদিকে মানুষে ভরপুর। মেহজাকে দেখে অনেকেই তাকায়। সকলের আকস্মিক দৃষ্টিতে সে লজ্জায় নুয়ে যায়। মাহিমা বেগম নিচেই ছিলেন। তবে মহিলাদের সাথে কথা বলছিলেন। মেহজা সেদিকে এগিয়ে যেতেই হাসনা চেঁচিয়ে উঠল,
-‘ওরে আল্লাহ্! মেহজা আফা আপনেরে কী সুন্দর লাগতেছে! আম্মা দেখেন! মনে হয় নতুন বউ!’
মাহিমা বেগম সহ আরো অনেকেই হাসনার কথা শুনে মেহজার দিকে দৃষ্টিপাত করে। মাহিমা বেগম হাসনার কথা শুনে চোখ কুঁচকে ফেললেও মেহজাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা গেল। সে হেসে ফেলে। মেহজার হাসনার উপর ভীষণ রাগ ওঠে। এসব কী কথা বলছে সে! মাহিমা বেগম মেহজার কাছে এলেন মেহজাকে দেখে মিটিমিটি হাসলেন। তারপর প্রশংসা করলেন। শাড়িতে তাকে ভালোই মানিয়েছে। পরক্ষণে মেহজার অস্বস্তি ধরতে পেরে তিনি হাসনাকে বলল,
-‘এই ওকে ইকরার রুমে দিয়ে আয়। ওরা ওর খোঁজ করছিল।’
-‘জে আম্মা।’

হাসনার সাথে যদিও মেহজার আসতে বিরক্ত লাগছিল তবুও কিছু বলল না। ইকরার রুমে আসতেই হাসির শোরগোল শোনা গেল। বিয়ে বাড়িতে এসবই মূখ্য। সে রুমে ঢুকতেই তাদের চার বোনকে দেখতে পেল সাথে আরো কয়েকজনও ছিল। মেহজাকে দেখে সবার হাসি থেমে গেল। ইকরা চেঁচিয়ে বলল,
-‘ওয়াও! তুমি শাড়ি পরেছ! সো সুইট! কী মিষ্টি লাগছে তোমাকে। আসো ছবি তুলি।’
ইমাকে দেখে মেহজা সবাইকেই সালাম দিল। ইমা ও মেহজার প্রশংসা করল। ইরা সহ সবাই কিছুক্ষণ কথা বলল। একটু পরেই হলুদ অনষ্ঠান শুরু হবে। সবাই প্রিপারেশন নিচ্ছে। ইনায়া হঠাৎ করেই বলল,
-‘বাব্বাহ! মেহজা তোমার ড্রেস কোড তো আমাদের ইয়াজের সাথে মিলে গেছে। সে ও এই গোল্ডেন কারার পরেছে। বাকি সবাই সে হলুদ আর টিয়া পরেছে। আমাদের ভাইটা আসলে ইউনিক।’
মেহজা লজ্জা পেল। ইমা বলল-
-‘কালার ম্যাচ করতেই পারে। নট আ বিগ ডিল। সবাই নিচে চলো।’

তারপর মেয়েরা ডালা সাজিয়ে একে একে নিচে নামতে থাকে। অবশ্যই লিফটে করে!
নিচে গেইটে পেরিয়ে যাওয়ার সময় ক্যামের ম্যান ভিডিও করা শুরু করে আবারও। মেহজা পেছনেই ছিল। এই বিল্ডিংয়ের একটা মেয়ে তনুশ্রীর সাথে। একটু আগেই তাদের পরিচয় হয়েছে। দুজনেই কথা বলতে বলতে আসছে। চারিদিকের পরিবেশ মুগ্ধ হয়ে দেখছে। অস্বস্তির কারণেই মেহজা আর তনুশ্রী দূরে সরে গেল লাইন থেকে। তারপর নিজেদের মতো হাঁটে, কথা বলে। ফুসকার স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তনুশ্রী বলল,
-‘মামা দুই প্লেট ফুসকা দিন।’
অর্ডার দিয়েই তারা নিজেদের কথা বলতে থাকে। তনুশ্রীও এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। তবে সে মানবিকের শিক্ষার্থী। দুজনের অল্প সময়ে ভাব জমে ভালো। ফুসকা খেয়ে আবারও আশেপাশে হাঁটে তারা। তখনিই তনুশ্রী বলে,
-‘আমার দাদাভাইয়ের ক্যামেরা আছে দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি। ছবি তুলব দুজন।’

মেহজাকে একা করে সে চলে গেল। মেহজার আবারও লজ্জা লজ্জা লাগে, অস্বস্তি লাগে। সে একটু হেঁটে বসার জায়গায় গিয়ে বসে। চারিদিকে অনেক যুবক। তাই অস্বস্তিটা একটু বেশিই লাগছে। হঠাৎ করেই মেহজার সামনের চেয়ারে কেউ এসে বসে। মেহজা তাকিয়ে তার চেহারা দেখে তো চমকে যায়। ইরফান হেসে বলে,
-‘ভ’য় পেলে নাকি!’
-‘ন না।’
-‘কাঁপো কেন?’
-‘কই!’
-‘দেখছি তো!’
-‘কী?’
-‘তোমাকে।’
মেহজা লজ্জা পেল। তার বুক ধরাম ধরাম করে বিট করছে। সত্যিই সে কাঁপছে। ইরফান হেসে বলল,
-‘একা বসে আছো কেন? সাথে কেউ নেই?’
-‘একজন ছিল। সে একটু কাজে গেছে, আসবে এখনিই।’
-‘ওহ। ইকরা আপুকে হলুদ ছোঁয়াবে না?’
-‘আমি?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘না অনেক মানুষ ওইদিকে। যেতে ইচ্ছা করেনা।’
-‘এখানেও আশেপাশে অনেকেই আছে।’
-‘জানি।’
মেহজা মাথা নিচু করে বসে থাকে। ইরফান নড়েও না চড়েও না। হঠাৎ করেই ডাকে,
-‘মেহজা!’
চমকে গিয়ে মেহজা মাথা তুলে বলল,
-‘জ্বি!’
তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে ইরফান বলল,
-‘খোপা কেন করেছ?’
মেহজা অবাক হয়ে বলল,
-‘এমনেই করেছি। ইচ্ছা হলো।’
-‘খোপা করলে বেশি বড় লাগবে তাই?’
-‘না না। সেটা কেন করব! আমার মনে হলো শাড়ির সাথে মানাবে। তাছাড়া চুল সামলানোর ঝামেলা অনেক।’
-‘ওহ।’
দুজনেই চুপ। মেহজা জানেনা ইরফান কেন এত কাজের মধ্যেও এসে বসে আছে তার সাথে। তার বোনের বিয়ে আর সে সেদিকে না গিয়ে এখানে এসে বসে আছে! ইরফান আবারও বলল,
-‘শাড়ি সচরাচর পড়া হয়?’
-‘না ভাইয়া। আগে কখনো এমন প্রোগ্রামে পরা হয়নি। এই প্রথম।’
-‘এখন পরেছ কেন?’
-‘এই রঙের জামা ছিল না তো তাই মায়ের শাড়িটাই পরেছি।’
-‘তোমার পছন্দ এই রঙ?’
-‘সেরকম নয় তবে ভালো লাগে।’
-‘আমার খুব পছন্দ। সবাই হলুদ পরেছে তবে আমি আমার পছন্দের টাই পরেছি। থিম যদিও দিয়েছি হাতে গোণা কয়েকজন ছেলে ছাড়া আর কেউ পরেনি। মেয়ে বলতে বোধ হয় শুধু তুমিই পরেছ। সুন্দর লাগছে।’

মেহজা লজ্জা পেল আবারও। তারই সাথে মাথা নিচু করে হেসে দিল। ইরফান তাকে সুন্দর লাগছে বলেছে। তার প্রশংসা করেছে! এটাও সম্ভব?#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-৯)
সিজন ২
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১৮.
তনুশ্রী এলো হাতে ক্যামেরা নিয়ে। ইরফানকে দেখে ক্ষানিকটা চমকায়। মেহজা তাকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
-‘এসেছ? চলো চলো! এখনও অনেক জায়গা ঘুরে দেখিনি। সেখানে যাই।’
ইরফান বলল,
-‘চলে যাচ্ছো?’
-‘আসলে ভাইয়া আমরা ছবি তুলব তো।’
-‘এই ক্যামেরায়?’
তনুশ্রী জবাব দিল-
-‘হ্যাঁ।’
-‘আমার কাছে আরো ভালো মডেল আছে। ওয়েট করো আমি তোমাদের ছবি তোলার ব্যবস্থা করছি।’
-‘তার প্রয়োজন নেই, আমারটা দিয়েই তুলব।’
-‘সেটা তো তুলবেই, আমি বলছি আরেকটু বেটার কোয়ালিটির ক্যামেরায়ও কিছু তোলো।’

ইরফান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ডাক দেয়,
-‘তানভীর! এদিকে আয় তো!’
তখনিই একটা ছেলে ছুটে এলো। ছিপছিপে গড়নের বেশ লম্বা এক ছেলে। গায়ের রঙ তামাটে, ঝাকরা চুল, মজার ব্যপার সামনের একটি দাঁত নেই। তাই একটু অন্য রকম লাগছে। অবশ্য নেই বললে ভুল কিছুটা ভেঙে গেছে। কিন্তু দাঁত কীভাবে ভাঙল? মা’র’পি’ট করে নাকি! মেহজা মনে মনেই ভাবে। তবে কিছু বলেনা।
-‘ওদের সুন্দর করে ছবি তুলে দিবি। আর দেখে শুনে রাখিস। অনেক বহিরাগত আছে।’
-‘ভাই চিন্তা করবেন না। আমি আর আসিফ আছি।’
-‘আমি তবে গেলাম। তোমরা থাকো।’
তনুশ্রী আর মেহজাকে বলে ইরফান চলে গেল। তনুশ্রী মনে মনে খুশিই হলো। যাক! কষ্ট করতে হবে না আর। ক্যামেরম্যান আছে এখন সাথে। তবে মেহজা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ইরফানের হঠাৎ কী হলো? মেহজা লজ্জা আর সংকোচে দূরে দূরে থাকতে চাইছিল আর লোকটা কীনা নিজে থেকে এসে কথাও বলে গেল। আবার যাওয়ার সময় ওদের খেয়াল রাখার কথাও বলল। আনমনেই সে হেসে দেয়। তখনিই মুখে ফ্ল্যাশলাইটের আলো পড়ে আর ক্লিক করে শব্দ হয় একটা। মেহজা তাকাতেই তানভীর নামের ছেলেটা হেসে বলল,
-‘ছবিটা সুন্দর আসছিল আপু। তাই তুলে ফেলেছি। রাগ করবেন না।’
মেহজা কিছুটা বিরক্ত হয়েছে বটে তবে সত্যিই রাগ করেনি। সে হেসে বলল,
-‘সমস্যা নেই।’

তারপর বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তাদের দুজনের ছবি তুলে দিল তানভীর। একটা ছেলেও তাদের পাশেই ছিল সে হচ্ছে আসিফ। তানভীরের সহযোগী।

এখানে নাঁচ গানের বিশাল আয়োজন হয়েছে। নামি দামি শিল্পী এনেছে। সবাই পুরো অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখছে। এর মধ্যে ইরা মেহজাকে ডেকে নিল। যদিও ইরা আগেই ইকরাকে হলুদ লাগিয়েছে তবুও মেহজা একা দেখে দুজন একসাথে আবারও স্টেজে ওঠে। হলুদ লাগায়। তখনকার মুহূর্ত ইরফান নিজের সেলফোনে ধারণ করে নিল টুক করে।

বেশ রাত হয়েছে অনুষ্ঠান শেষ হতে। এরই মাঝে আরেক কান্ড ঘটে। মাহিমা বেগমের কোন বান্ধবী তার বোনের ছেলের জন্য মেহজাকে পছন্দ করেছেন। মাহিমা বেগম এতে তেঁতে গিয়ে দুই দফা ঝগড়া লেগেছেন। অবশ্য নিজেদের বয়স্ক মহলেই। ঝগড়ার পর মাহিমা বেগম থম মেরে বসে রইলেন। ইমাকে ডেকে বললেন,
-‘দ্যাখ, দ্যাখ! তুই আর তোর ভাই বলস মেহজা নাকি পিচ্চি। ইয়াজের সাথে যায়না। মানুষ কী বলবে! এদিকে মানুষরাই বলতেছে তাদের পঁয়ত্রিশের কৌঠার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে এই মেয়েরে। আমার ছেলে কী বুড়া! সবেমাত্র ঊনত্রিশে পড়ছে। মেহজাও তো আর শিশু না। শুনলাম আঠারো শেষ হইছে। তো সমস্যা কী? দশ বছরের পার্থক্য কিছুই না। তোর বাপ আমার তেরো বছরের বড় না! তো আমি সংসার করিনা? এসব ঢং বাদ দে। তোর ভাইরে বোঝা। আমি এই মেয়েরেই ঘরে তুলমু। ওই চু’ন্নি আমারে বলে নাকি আমার ঘরেও মেহজা আসব না। ওরে আমি দেখাই দিব মেহজারে ঘরের বউ বানাইয়া।’
-‘আহ মা! বাচ্চামো কেন করছ? আর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছ কেন?’
-‘এই! আমার মাতৃভাষায় আমি কথা বলব তোর সমস্যা আছে!’
-‘আছে। এখন চুপ থাকো। মেহজা রাজি হবে কিনা সেটা ভেবেছ? ওরা আজকালকের মেয়ে। পছন্দ থাকতে পারে।’
-‘আমার চাঁদের মতো ছেলেরে রেখে আর কারে পছন্দ হবে! তুই চুপ থাক। বাপ আর ভাইয়ের মতো করস। যা দূর হো।’

ইমা চলে এলো সেখান থেকে। তার ধারণা মা ভুল করছে। মেহজা নিতান্তই বাচ্চা তার ভাইয়ের তুলনায়। যদি মেহজার মত থাকত তবে তারও সমস্যা ছিল না। এখন যেহেতু মেহজার দিকটা জানা যাচ্ছে না তাই চুপ থাকায় শ্রেয়। এদিকে ইরফানকেও তো রাজি হতে হবে। সে বলেছে এত ছোট মেয়ে বিয়ে করবেনা। তাতেই মা ছেলের এক অদৃশ্য দ্বন্দ চলছে। এর জাতা কলে পিষে যাচ্ছে আহনাফ মজিদ। মাহিমা বেগম উঠতে বসতে তাকে বকাবকি করে। এটাই বলছে, ছেলেকে সে কেন বোঝায় না!

১৯.
বিয়ের দিন সকালে ছাদে রঙ খেলার আয়োজন করা হলো। মেহজা ঘুমাচ্ছিল, তখনিই রাফসান এসে চেঁচাতে থাকে,
-‘ওই ওঠ! রঙ মাখামাখি করবিনা? সবাই রঙ মাখছে।’
-‘মাখুক। আমার কী! একদম ডিস্টার্ব করবিনা। যা ভাগ!’
দাঁত কিড়মিড়িয়ে তো রাফসান চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল,
-‘উপর তলার ইনায়া আপু এসেছে। ড্রয়িং রুমে বসে আছে। তোকে ডাকতে বলেছে তাই এসেছি নয়তো আমার ঠেকা পড়েনাই তোর জন্য!’
মেহজার খুব রাগ হলো। এরা পাঁচ ভাই-বোন তো খুব জ্বালাচ্ছে! ধুর ভালো লাগেনা। মেহজা আবারও শুয়ে পড়ে। বিশেষ লাভ হলো না। ইনায়া এসে জোর করে নিয়ে গেল।

ছাদের ডেকোরেশনটা অনেক সুন্দর, সবটাই রঙিন। নানা রঙের কাগজ, ফুল, ফিতা দিয়ে সাজিয়ে রাখা। সামনে নানা রকম ডালা ভর্তি রঙ। সবার ভীড়ে তনুশ্রীকেও দেখা গেল। দুজনে হাত নেড়ে হাই, হ্যালো করল। মেহজা যেতেই এক বিচ্ছু দল তাকে রঙ মেখে সঙ বানিয়ে দেয়। ভূ’তের মতো অবস্থা নিয়ে সে এক কোণে দাঁড়ালো। তখনিই দেখে ইরফান আর কালকের ছেলে গুলো সুইমিংপুলের পানি উঠিয়ে একটা বালতিতে ভরে সেখানে রঙ গুলছে। এবার হয়তো রঙের স্যুপ বানানো হবে। আর সেই স্যুপ দিয়ে সবাইকে গোসল করানো হবে! মেহজার মনে হলো এই মুহূর্তে এখানে থাকা বি’প’দ’জনক। তাই সে ভো দৌড় দিয়ে বাসায় ফিরে এলো।

বারোটার দিকে গোসল করে সে শুয়ে পড়ে আবারও। কেমন ক্লান্ত লাগছে। তখন তার মা হাঁক ছাড়লেন তৈরি হতে। বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হবে। তাই যেতে যেতেও তো সময় লাগবে। সে যেন তৈরি হয়ে যায়। তবে মেহজার একটুও ভালো লাগছিল না। সে ঘুমিয়ে পড়ে।

যখন ঘুম ভাঙে তখন বেলা দুইটা। সারা বাসায় কেউ নেই। মেহজা বুঝতে পারে সবাই চলে গেছে তাকে ফেলে। সে তার মাকে কল করে। প্রথমে অবশ্য নিজেরই গাফিলতির জন্য কিছু কড়া কথা শুনতে হয় তাকে। পরে বললেন রাদিফকে পাঠানো যায় কিনা দেখবে!

এরপর মন খারাপ করে সোফায় বসে থাকে সে। আধা ঘন্টা পর তাদের কলিং বেল বেজে ওঠে। মেহজা ভাবে তার ভাই এসে গেছে। সে দরজা খুলেই চমকে যায়। ইরফান দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে। মেহজাকে দেখেই সে বলল,
-‘ফটাফট তৈরি হয়ে নাও তো! দেরি করো না।’
-‘কী!’
-‘তৈরি হও। বিয়েতে যাবেনা?’
-‘কিন্তু আপনি কেন এলেন!’
-‘আমার মা পাঠিয়েছেন। তুমি নাকি ঘুমে ডুবে ছিলে। তাই সবার সাথে যাওনি। এখন নাকি আবার যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছ।’

মেহজার রাগ হলো। কোথায়? সে একটুও কান্নাকাটি করেনি। এটা নিশ্চয়ই তার মায়ের কাজ। তার মা হয়তো ইরফানের মা’কে এমনটা বলেছেন। সে দরজা থেকে সরে ইরফানকে ভেতরে আসতে বলে তৈরি হতে গেল।

#চলবে।
(ভালো লাগছে না তাই না? কেউ কেউ নাকি আগা গোড়া বুঝছে না। এখন কি করা যায়? বন্ধ করে দিব কী!)

#চলবে।
(অনেক কিছুই লেখা বাকি ছিল। ইন শা আল্লাহ্ কাল দেওয়ার চেষ্টা করব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here