চডইপাখির অভিমান পর্ব -১৭+১৮

#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা

নিঝুম ঝকঝকে দুপুর। তটিনীর কূলে ডেকে যায় একলা ডাহুক। এমন নিস্তব্ধ দুপুরে শুধু নৌকার বৈঠা শব্দ করছে ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। এমনই এক ঘোর মাখা সময়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বাংলার অ্যামাজন নামে পরিচিত সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুলে।

রাতারগুল আমাদের দেশের একমাত্র ‘ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট’ বা জলাবন। সিলেট থেকে দেশের একমাত্র স্বীকৃত এই সোয়াম্প ফরেস্টের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এই জলাবনের অবস্থান।

উত্তরে মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর। মাঝখানে ‘জলাবন’ রাতারগুল(Ratargul Jolabon)। উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে এর দুটি, একটা শ্রীলংকায় আর আরেকটা আমাদের রাতারগুলে।

অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল এ বনের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র অ্যামাজনের। রেইন ফরেস্ট নামে পরিচিত হলেও বিশ্বের স্বাদুপানির সবচাইতে বড় সোয়াম্প বন কিন্তু ওই অ্যামাজনই। ঠিক অ্যামাজন সোয়াম্পের মতোই স্বাদুপানির বন আমাদের এই রাতারগুল।

সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটিগাছ ‘রাতাগাছ’ নামে পরিচিত। সেই মুর্তা অথবা রাতাগাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল। অ্যামাজনের মতোই গাছগাছালির বেশির ভাগ অংশই বছরে চার থেকে সাত মাস থাকে পানির নিচে। ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে, আর সেখানকার এক সরু শাখা চেঙ্গী খাল হয়ে পানিটা প্লাবিত করে পুরো রাতারগুল জলাবনকে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে ( মে – সেপ্টেম্বর)। শীতকালে অবশ্য সেটা হয়ে যায় আর দশটা বনের মতোই, পাতা ঝরা শুষ্ক ডাঙ্গা। আর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়েচলা মেঠোপথ। আর তখন জলজ প্রাণীকুলের আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বড় বড় ডোবাগুলোতে।

বর্ষায় বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। কোনো গাছের কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে পানিতে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলো আবার শরীরের অর্ধেকই ডুবিয়ে আছে জলে। কোথাও চোখে পড়বে মাছ ধরার জাল পেতেছে জেলেরা। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন অন্ধকার লাগবে পুরো বনটা। মাঝেমধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দিবে পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে পথ চলতে হয়। তবে বর্ষায় এ বনে চলতে হবে খুব সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া। বর্ষায় পানি বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর।

বনবিভাগের তথ্যমতে- এই বনের আয়তন তিন হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বন ১৯৭৩ সালে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বিশাল এ বনে রয়েছে জলসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের পানি সহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। রাতারগুল বনে সাপের মধ্যে নির্বিষ গুইসাপ, জলঢোড়া ছাড়াও রয়েছে গোখরাসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ উঠে পড়ে গাছের ওপর।

বনের ভেতর দাঁপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বানর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরো অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায় এই বনে। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজ। শীতে মাঝেমধ্যে আসে বিশালকায় সব শকুন। আর লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বালিহাঁসসহ হরেক জাতের পাখি। শুকনো মৌসুমে ডিঙ্গি নিয়ে ভেতরে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আপনাকে উড়ে সরে গিয়ে পথ করে দেবে। এ দৃশ্য আসলেই দুর্লভ!

গাছের মধ্যে এখানে করচই বেশি। হিজলে ফল ধরে আছে শয়ে শয়ে। বটও চোখে পড়বে মাঝেমধ্যে। আর বনের দক্ষিণে মুর্তা (পাটি) গাছের প্রাধান্য। রাতারগুলের বেশ বড় একটা অংশে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি হয়। মুর্তা বেশি আছে নদীর উল্টো পাশে। এ ছাড়া ওদিকে শিমুল বিল হাওর আর নেওয়া বিল হাওর নামে দুটো বড় হাওর আছে।

সন্ধ্যায় সবাই বাড়ি ফিরে এলাম। যাওয়ার সময় আমার গোমরা মুখে দেখে স্পর্শ যা বুঝার বুঝে গিয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পর আর আমার হাত আর আমাকে এক সেকেন্ডের জন্য ও ছাড়েনি।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আমি স্পর্শের হাত ধরে দেখলাম জানলাম।

আসার পথে স্পর্শ এর সাথে আমি বসে ছিলাম। জারা দূর থেকে মুখটা কঠিন ভাব করে রেখেছিল। গাড়িতে সবার অগোচরে স্পর্শ আমার গালে চুমু দিয়েছিল। ভুলবশত সেটা জারার নজরে পড়ে যায়। এজন্য আরেকটা চমক আমার জন্য অপেক্ষা করে। শুয়ে শুয়ে সবাই বিশ্রাম নেয় ফিরে এসে।

স্পর্শ কিছুসময় শুয়ে থেকেই কোথায় যেন চলে যায়। আমি রুমে একাই থাকি। এই সুযোগে জারা রুমে আসে আর আমাকে টেনে উঠিয়ে যে গালে স্পর্শ চুমু খেয়ে ছিল সেখানে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়।
আমি চোখ দুটো বড় বড় করে জারার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। চড় মারার কারণটা অজানা আমার কাছে।

জারার ফর্সা মুখ লাল টকটকে হয়েছে রাগে। আমার ও রাগ মাথায় উঠে গেছে।আমি কি করব কি করব ভেবে না পেয়ে ঠাস করে একটা চড় মেরে দেয় জারার গালে।

আমার হাতে চড় খেয়ে জারা চিৎকার করে ওঠে, ‘ তোমার তো সাহস কম না। তুমি আমার বাসায় এসে আমাকেই থাপ্পর মারলে।’

‘ হ্যাঁ মারলাম। কিন্তু তোমার ও ত সাহস কম না তুমি বাড়ির আত্মীয় কে থাপ্পড় মারো। তোমার মত বেয়াদব তো আমি দুটো দেখিনা।’

‘তোমাকে মেরেছি বেশ করেছি! আবার মারবো।’

বলে জারা ওর হাত উঁচু করল মারার জন্য আমি ওর হাত মুচরে ধরলাম।

‘তোমার সমস্যা কি মারামারি করতে এসেছ কেন?’

‘স্পর্শ ভাইয়া তোমাকে তখন চুমু খেলো কেন?’

‘হোয়াট এই কারণে তুমি আমাকে মারতে এসেছ?’

‘হ্যাঁ ভাইয়া তোমাকে স্পর্শ করবে কেন? আমি ভাইয়াকে ভালোবাসি সে শুধু আমাকে স্পর্শ করবে। আদর করবে ভালোবাসবে।’

‘বোন হিসেবে তোমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তুমি তোমার পাগলামো বন্ধ না করলে তোমার এই আজেবাজে পাগলামো কথা কিন্তু আমি স্পর্শ বলে দেব তখন স্পর্শ তোমার মুখের দিকে ফিরে তাকাবেনা। আর আমি তার ওয়াইফ। তিনি আমাকে আদর করবে, ভালোবাসবেই সেটা নিয়ে যদি তুমি জেলাস ফিল হ‌ও আমার তাহলে কিছু করার নেই সরি।’

জারা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি আর ঘুমাতে পারলাম না। ঘুম চোখে আর আসলো না। গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। স্পর্শ রুমে এসো আমাকে এভাবে বসে থাকলে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

‘কি হয়েছে? মন খারাপ?’

আমি মাথা নেড়ে না বললাম। স্পর্শ চোখে সরাসরি আমার গালে থাপ্পড় এর দাগ পরলো। উত্তেজিত হয়ে আমার পাশে বসে গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘তোমার গালে কি হয়েছে?’

আমি গাল লুকানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘ কিছু হয়নি তো।’

‘ মিথ্যা বলছো? দেখতে মনে হচ্ছে কেউ যেন আঘাত করেছে। পাঁচ আঙুল স্পষ্ট ফুটে আছে!’

‘না মানে আসলে…!

‘ কে এসেছিল রুমে? আর এই কাজ কে করেছে?’

‘কেউ করেনি। এই কাত হয়ে ঘুমাচ্ছিলাম তো তাই এই এরকম হয়ে গেছে।’

‘তোমার কি আমাকে পাগল মনে হয়! যা বুঝাবে আমি তাই বুঝবো!’

‘আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন!’

‘ওকে না বললে। আমিই খুঁজবো কে আমার বউকে এমন টর্চার করেছে।’

স্পর্শ দু হাত আমার দু হাত রেখে কথাটা বলল। তারপর দুজনের কপাল এক করে চুপ করে রইলো।

আমি ও চুপ করে আছি। স্পর্শের চোখ বন্ধ আমি তাকিয়ে তার উঁচু নাকের দিকে চেয়ে আছি। স্পর্শের ঘনঘন নিশ্বাস আমার চোখে মুখে বারি খাচ্ছে। আমি পলক ফেলছি শুধু। পাক্কা পাঁচ মিনিট পর স্পর্শ চোখ খুলে তাকালো। আমি তো তাকিয়ে ছিলাম। দুজনে চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি ফট করেই হেসে উঠলাম। এত কাছ থেকে স্পর্শকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। আমি নিজের হাসি আটকাতে পারলাম না। আর আমার হাসি যথেষ্ট স্পর্শ রোমান্টিক মুড নষ্ট করার জন্য। আমার এমন পাগলের মতো হাসি দেখে স্পর্শ আমাকে ছেড়ে দূরে সরে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘হুট করেই এতো হাসির কি হলো?’

আমি হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি। আর স্পর্শ কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আমার দিকে বিরক্তকর চাহনী দিয়ে তাকিয়ে আছে।

আমি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে উঠে বসলাম। স্পর্শ আমার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে গটগট করে চলে গেল রুমে থেকে। যাওয়ার আগে বলে গেল,

‘ আমার এতো সুন্দর রোমান্টিক মুডটাই নষ্ট করে দিলা। আমার আর রোমান্স করা হবে না।’
#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_১৮
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা

বিছানাকান্দি ( Bisnakandi / Bichnakandi) ভারত এবং বাংলাদেশের বর্ডার এলাকায় অবস্থিত। বিছনাকান্দি থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে থাকা লাল পতাকাগুলোর সারি জানান দেয় যে ওপাশেই ভারত। এখান থেকে সহজেই ভারতীয় জলপ্রপাত গুলো দেখা যায় যা থেকে পানি বয়ে আসে বিছানাকান্দি পর্যন্ত।

মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে ছুটে আসা স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা সৃষ্টি করেছে এক মনোরম পরিবেশ। যা হতে পারে ভ্রমণ পিপাসীদের জন্য এক আকর্ষনীয় স্থান। একটি কাঠের ব্রিজ বাংলাদেশের বর্ডারের মধ্যে পড়েছে যা পানি প্রবাহের বিপরীত দিকে অবস্থিত উচ্চভুমি আর সমতল ভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ করে। এর ফলে আদিবাসীদের গবাদীপশু চারনের বিশেষসুবিধা হয়েছে।

পাথর, পানি, পাহাড় আর আকাশ নিয়েই যেন বিছানাকান্দি। এখানে আসার পর যে কথাটি সর্বপ্রথম মনে হয় তা হল প্রশান্তি। এই প্রশান্তিটুকু নিমিষেই ভুলিয়ে দেয় প্রতিদিনকার শত গ্লানি। প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে যেন হার মানতেই হয় নাগরীক সভ্যতাকে।
স্পর্শ ফটোগ্রাফারকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে এলো আর আমার সাথে ফটাফট কয়টা পিকচার তুলে নিলো‌। আপু আর মাহিন ভাইয়া নিজের ফোনেই সেলফি নিতে ব্যস্ত। আমি আর স্পর্শ পোজ দিতে। বড়রা নিজের মতো আছে।

বিকেলের দিকে আমরা মালনীছড়া চা বাগানের দিকে অগ্রসর হলাম।

চারপাশে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা পেতে আছে সজীব প্রকৃতি। উঁচু-নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে টিলা বেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়ের কিনার ঘেষে ছুটে গেছে আকাবাঁকা মেঠোপথ। কোন যান্ত্রিক দূষণ নেই। কোথাও আবার ধাবমান পথে ছুটে চলছে রূপালী ঝর্ণাধারা। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যের সম্মিলন যেন এখানে। এমন অন্তহীন সৌন্দর্যে একাকার হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অন্য এক ভালোলাগার ধারক হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান। তাই ছুটির অবসরে কিংবা বৈকালিক বিনোদনের তৃষ্ণা মেটাতে ছুটে যান চা বাগানের সবুজ অরণ্যে। সারাটা বিকাল চলে সবুজের ভেতর লুকোচুরি, হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে অবগাহন।

আব্বু আম্মু বাসায় এসে ই শুয়ে পরেছে। এতো জার্নি তারা নিতে পারেনি। কাল আমরা চলে যাব তিনদিন শেষ। রাতে আজ সবাই আড্ডা বসলো। স্পর্শের ফোন আমার হাতে। আমি আজকে বেড়ানোর ছবিগুলো দেখছি। আমাদের পাশে ভাইয়া আপু আর স্পর্শের 5 মামাতো বোন আছে।
আমি ছবি দেখতে দেখতে আজকের তোলা ছবি পেরিয়ে গেলাম।
গ্যালারি ফাংশন থেকে বেরিয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করতে লাগলাম। স্পর্শ আবার কোন মেয়ের সাথে কথা বলে নাকি চেক করছি। হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং দেখছি।

‘ আমার ব‌উ কি করছে?’

হঠাৎ করেই স্পর্শের ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলা কথা শুনে ছিটকে উঠলাম। ঠাস করে ফোন আমার কোলের উপর পরে গেছে। খুব ভয় পেয়েছি।

আমি ভয়ার্ত চোখে স্পর্শের দিকে তাকালাম। তার মুখে হাসি। আমি আমতা আমতা গলায় বললাম,

‘ কিছু না তো। ছবি দেখছি আপনি খুব ভালো ছবি তুলেছেন আমার একা।’

স্পর্শ আমার পাশে খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলল, ‘ তাই।’

আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘ হুম।’

স্পর্শ আমার কোলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনের হাসিটা আরো জড়ালো করলো।আমি শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিচ্ছি বারবার।

‘ হোয়াটসঅ্যাপ এ তুমি কার ছবি দেখছি ব‌উওওও?’ স্পর্শ শেষের কথাটা টেনে বললো।

আমি তরিৎ গতিতে নিচের দিকে তাকিয়ে হাত মুচড়াতে লাগলাম। আর আড়চোখে স্পর্শের দিকে তাকালাম। স্পর্শ ফোন আমার সামনে ধরে একটা একটা করে কয়েকটা মেয়ের আইডি ও মেসেজ দেখালো।

‘ এই মেয়েদের সাথে তোমার হাজব্যান্ড এর কোন রিলেশন আছে নাকি দেখছিলে তাই না ?’

আমি মুখে কুলুপ এঁটে দাঁতে দাঁত চেপে শক্তভাবে বসে আছি। স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

‘ এরা আমার কলেজ, ভার্সিটি লাইফের বান্ধবী। যাদের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক প্রতিদিনই একবার করে হলেও কথা হয়। তোমার সাথে ওরা
মিট করতে চাচ্ছে অনেকদিন। এখানে থেকে গিয়ে একদিন ওদের সাথে মিট করিয়ে দেব।’

আমি লজ্জা পেলাম খুব। আমি এই মেয়েদেরকে সত্যি সন্দেহ করে মেসেজ গুলো পরতেছিলাম কিন্তু স্পর্শের কাছে ধরা খেয়ে লজ্জায় নাকানিচুবানি খেলাম ভালোই।

স্পর্শের ছোট মামার মেয়ে তনু এসে আমাকে জোর করে স্পর্শের সামনে থেকে নিয়ে গেল‌। স্পর্শ আসতেই দিবে না তনু জোর করে নিয়ে বাসার ভেতরে নিয়ে এলো।

আমি ও তনু জিজ্ঞেস করছি কেন টেনে নিয়ে এলো। বলছে না শুধু বলে আসো আমার সাথে ভাবি‌। আর কি করার ওর সাথে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে এসে দেখলাম এখানে আরেকজন আছে। মিলি জারার ছোট বোন। দুজনে এখানে কি জন্য আমাকে আনলো কে জানে? আমাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে এরা গুজুর ফুজুর করতে লাগলো। আমি কান খাড়া করে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একটা বাক্য আমার কানে এসেও পৌঁছালো না।
2 মিনিট পর‌ই দুজনের মতলব বুঝতে পারলাম।

‘ তোমরা আমাকে এই শাড়ি পড়ানোর জন্য নিয়ে এসেছে?’ তনুর দিকে প্রশ্ন ছুড়লাম।

তনু বলল,’ভাবি কালকে তো আপনারা চলে যাবেন!তাই আজকে আমাদের তরফ থেকে ভাইয়ার জন্য একটা গিফট ছোট্ট। আপনাদের জন্য তেমন তো কিছু করতে পারলাম না। তাই ভাবছে আপনাকে ভাইয়ার মনের মত করে সাজিয়ে ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দেবো।’

আমি ওদের বললাম, ‘এসবের কোন দরকার নাই! আমি শাড়ি পড়ে ইজি ফিল করিনা। এটা আমাকে পড়িও না।’

‘ আমরা অনেক সুন্দর করে পরিয়ে দিব তুমি প্লিজ না করো না।’

ওদের মুখের উপর আর আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওদের আনন্দটা মাটি করতে চাইলাম না। ওদের কথা মত শাড়ি পড়লাম।

দুজন আমাকে ইচ্ছা মতো সাজালো। তারপর দুই পাশের দুই হাত ধরে দুজনে আমাকে সবার কাছে নিয়ে চেয়ে নিয়ে এলো। স্পর্শর পাশে নিয়েই বসিয়ে দিল। লাল রঙা শাড়ি পরেছি নতুন বউদের মত আমার ঘুমটা টেনেছি। এজন্য অটোমেটিকলি নতুন ব‌উদের মতন এক রাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরেছে আমাকে।

স্পর্শ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এটা দেখে আমার লজ্জার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তবু ও জড়োসরো হয়ে স্পর্শের পাশে বসে পরলাম।

এখানকার সবাই মিলে আমার প্রশংসা করছে‌। তনু আর মিলি কেও করছে ওরা খুব সুন্দর সাজিয়েছে আমাকে তাই।‌ সেই মুহূর্তে জারা এসে ওর বোন মিলিকে টেনে বাসার ভেতরে নিয়ে গেল। আর আমার দিকে রাগী চোখে তাকাল। সবাই যার যার ব‌উকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। স্পর্শ আমার হাত মুঠোয় নিয়ে বসে আছে।

পাঁচ মিনিট পর মিলি এলো মুখটা কালো করে। গালে থাপ্পড় এর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে আমার সাথে মেশার ফল এটা বুঝতে বাকি রইলো না।

মিলির জন্য মন খারাপ হলো আমার। জারা যতটাই খারাপ মিলি ততটাই ভালো।

‘ কি হয়েছে মুখ কালো করেছো কেন?’

স্পর্শ আমাকে মলিন মুখে দেখে জিজ্ঞেস করলো।আমি মিলির থেকে চোখ সরিয়ে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ আমাকে কেমন লাগছে?’

স্পর্শ বলল, ‘ কথা ঘুরানো শিখে গেছো দেখছি‌’

‘ কথা ঘুরালাম কোথায়?’

‘ মন খারাপ কেন তাহলে?’

‘ আমার জন্য একজন কষ্ট পাচ্ছে তাই।’

স্পর্শ কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল, ‘ তাই? কে?’

‘ আছে একজন। আচ্ছা বললেন না তো আমাকে কেমন লাগছে!’

‘ কেমন লাগছে! বলতে হবে কেন আমার তাকানো দেখে বুঝতে পারছো না?’

‘না আমি এতো চোখের ভাষা বুঝতে পারি না।’

‘ এটা ভালোবাসা।’

‘ আমি তো বুঝি না তাহলে কি আমার মধ্যে ভালোবাসা নাই?’

স্পর্শ চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ নানা আছে। সবার ভালোবাসা কি আর এক রকম নাকি‌!’

‘ হুম।’

আমি মিটিমিটি হাসছি মুখ ঘুরিয়ে। স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

শাড়ি পড়ে হাঁটতে এখন আমার ঝামেলা না হলেও বাধা সৃষ্টি করতে জারা আছে। মুটামুটি আড্ডাটা শেষ হতেই আমরা সবাই বাসার ভেতরে যেতে লাগলাম তখন জারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইলো। আমি ভয় পেয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি পড়ার আগেই স্পর্শ পাশ থেকে আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। আর বাঁচিয়ে নিয়েছে। এটা বোধহয় স্পর্শের চোখে পরেছে। স্পর্শ আমাকে সাবধানে ধার করিয়ে জারাকে বলল,

‘ জারা তুই মারিয়াকে ধাক্কা দিলি কেন?’

জারা ভয়ে কাঁপছে। ও যে এইভাবে ধরা খাবে ভাবতেই পারেনি। ভয়ে কান্না করে দিয়েছে। স্পর্শ রাগে চিৎকার করে ফেলেছিল কিন্তু জারার কান্না দেখে শান্ত হয়। আমি ও দ্রুত এসে স্পর্শের এক হাত জরিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি।

‘ কি হলো কথা বলছিস না কেন? ধাক্কা কেন দিলি সমস্যা কি তোর?’

‘ আমি ইচ্ছে করে দেয়নি ভাইয়া। অসাবধানতাবশত লেগে গেছে বিশ্বাস করো।’ জারা কান্না মিশ্রিত গলায় বলল।

স্পর্শ তাও বিশ্বাস করছে না। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে স্পর্শের অনেক কষ্টে থামিয়ে বললাম,

‘ ইচ্ছে করে দেয়নি মনে হয়। চলুন তো ঘুম পাচ্ছে আমার।’

‘ আমি স্পষ্ট দেখেছি জারা প্রতিহিংসা চরিত তোমাকে ধাক্কা দিয়েছে। এতো রাগ কিসের ওর তোমার উপর?’

‘ জানি না। কাল তো চলেই যাব আজ আর ঝামেলা চাইনা প্লিজ।’

#চলবে…..
#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here