চন্দ্রপুকুর পর্ব -২৯+৩০

#চন্দ্রপুকুর
||২৯ ও ৩০তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
যামিনীর কথা অনুযায়ী নব আগমন করা দাসীদের তার কক্ষে এনেছে দিলরুবা৷

সবাই একই সুরে উচ্চারণ করে,
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক।”

“আমিন। তোমাদের সকলকে কী জন্য ডাকা হয়েছে তা তো জানোই। দিলরুবা এদের থেকে কর্মে ও বুদ্ধিতে শক্তিশালী, ধূর্ত ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যারা তাদের রাখো। বাকিদের বের করে দাও।”

দিলরুবা একে একে সবার হাত-পা, মুখ পরীক্ষা করে। প্রশ্ন-উত্তরও করে কিছু। এর পর চৌদ্দ-পনেরো জন বাদে বাকিদের বিদায় দেয় সে।

“তোমাদের আমি চয়ন করেছি। তবে একটা বিষয় খুবই পরিস্কার ভাবে শুনে রাখো। আমার সেবায় থাকলে, আমাকে অন্ধ ভাবে মান্য করলে, আনুগত থাকলে তোমাদের জীবন বেলির ন্যায় সুরভিত এবং সুন্দর হবে।

কিন্তু আমার বিরুদ্ধে গেলে, বেইমানি করলে মৃত্যুর জন্য কামনা করবে, এতো ভয়ংকর হবে পরিণাম।
কারণ আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা, ক্ষমা নামক কিছু আমার শব্দভান্ডারে নেই।

যারা আমার বচন শ্রবণ করার পর আমার সেবায় থাকতে চাও তারা আমার পিছনে এসে দাঁড়াও। বাকিরা যেতে পারো কোনো অসুবিধা নেই তাদের প্রতিও।”

দুই জন বাদে সকলেই থেকে যায়। যামিনী মৃদু হাসে।

নিজের কানের দু’টো ঝুমকো খুলে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা তোমাদের উপহার স্বরূপ। নিঃসন্দেহে আমায় কর্ম দ্বারা সন্তুষ্ট করতে পারলে এর চাইতেও মূল্যবান উপহার পাবে, পাবে সুযোগ-সুবিধাও।”

এর মাঝে কামরার দরজায় করাঘাত করে কেউ। দিলরুবা দ্বার খুলে দিলে মোহিনী প্রবেশ করে।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম।”

কোনোরকম হাঁপাতে হাঁপাতে সালাম জানায় মোহিনী।

“ওয়ালাইকুম আসসালাম, মোহিনী। তুমি প্রথমে শান্ত হও। তারপর কথা বোলো। দিলরুবা একটু জল দাও কন্যাকে।”

ঢকঢক করে গোটা পানপাত্রের জল পান করে নেয় মোহিনী। তার অবস্থা দেখে ধারণা করা যাচ্ছে সে ছুটে এসেছে এখানে।

“বলো কন্যা, এভাবে ছুটে আসার কারণ কী?”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। আমি আপনার হেফাজতে আসতে চাই, আপনার সেবায় নিয়োজিত হতে চাই।”

“এ তো ভালো সংবাদ। তবে মনে রেখো আমার সেবায় আসা মানে ভালো ও মন্দ উভয়কেই গলা বেঁধে নেওয়া। শপথ গ্রহণ করে নিতে হবে প্রাণ যাবে তবুও ভরসা ভাঙা যাবে না।”

“অবশ্যই বেগম। আপনায় কখনও লজ্জিত মুখে তাকাতে হবে না আমার দিকে।”

“ঠিক আছে। দিলরুবা, তুমি আয়েশা খাতুনকে জানিয়ে দাও। এই কন্যারা আমার সেবায় থাকবে। আর আয়েশা খাতুনকে এও জানাও আকাশের বক্ষে দিনের আলো মেটার পূর্বে যেন প্রহরী আসে দোয়ারে।”

“যথা আজ্ঞা, বেগম।”

___

বেগম নূর বাহারের কর্ণগোচর হয়েছে যামিনীর সবার প্রথমে দাসী চয়ন করার সংবাদ। রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন তিনি। কারণ নিয়ম অনুযায়ী সবার প্রথমে বেগম লুৎফুন্নেসা ও তিনি তারপর যামিনীর চয়ন করার কথা।

এমন সময় মোহিনীর আগমন হয়।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিন্তু তুমি কে, কন্যা? তোমাকে তো চিনলাম না।”

“আমি নতুন এসেছি বেগম। বেগম চন্দ্রমল্লিকার সেবায় নিয়োজিত আছি। বেগম চন্দ্রমল্লিকা অন্দরমহলে ভোজসভা ও আনন্দোৎসবের আয়োজন করেছেন। আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে পাঠিয়েছেন আমায়।”

“ভোজসভা? উৎসব? কার অনুমতি নিয়ে করছে ঐ আঁধারিয়া কন্যা এসব? আবার নিমন্ত্রণ পাঠাচ্ছে। যাও এখান হতে, আমি তোমার জিভ না ছিঁড়ে ফেলি ঐ কন্যার আক্রোশে।”

কোনোরকম বিদায় জানিয়ে স্থান ত্যাগ করে মোহিনী।

বেগম নূর বাহারও বড়ো বড়ো পা ফেলে অগ্রসর হন বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষের দিকে। পথিমধ্যে শাহাজাদি মেহনূরের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সেও একই কারণ বশত এসছে।

বার্ধক্যের ভরের সাথে দুঃশ্চিন্তায়ও যেন নুয়ে পড়েছেন মানুষটি। তবে তা দেখতে পান না তাঁর পুত্রবধূ ও পৌত্রী, স্বার্থান্ধ বলে কথা।

“আসসালামু আলাইকুম, আম্মিজান। আপনি এখানে শয্যায় পড়ে আছেন। জানেন তো কী হচ্ছে অন্দরমহলে?

“জিভে লাগাম দাও, নূর বাহার। তুমি আজকাল বারবার ভুলে যাও কার সাথে কথা বলছো। এখন বলো কী হয়েছে?”

“দুঃখিত, আম্মিজান। আজকাল পরিস্থিতি এমন যাচ্ছে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছি। আম্মিজান, ঐ কন্যা চন্দ্রমল্লিকা নিয়মের বাহিরে যেতে শুরু করেছে। সাহস বেড়ে গিয়েছে তার৷

আপনি তো জানেন আজ নব দাসীরা এসেছে। সবার পূর্বে সেখান হতে নিয়োগ দেওয়ার কথা আপনার ও আমার। সেখানে সে কারো অনুমতি ব্যতীত নিজে প্রথমে চয়ন করেছে।

আবার এখন তো সীমাই পেড়িয়ে গেল। আপনার অনুমতির বিনাই অন্দরমহলে উৎসবের আয়োজন করেছে সে। আপনি এখনও চুপ করে থাকবেন, আম্মিজান?”

“এছাড়া উপায় রেখেছো কী? মাঝে মাঝে মস্তিষ্ক দিয়েও বিচার-বিশ্লেষণ করে। এমনিতেই সকলে তোমাদের করা কার্যে আমাদের উপর অসন্তুষ্ট ও চন্দ্রমল্লিকার প্রতি সহানুভূতিশীল। এর মাঝে তার সাথে আরেকটি ঝামেলা করলে, দুর্নামগ্রস্ত তোমরাই হবে।

তাই যা হচ্ছে হতে দাও। কিছু সময় সহ্যও করার প্রয়োজন হয়। তোমাদের সহ্য করতে হবে নীরব হয়ে। কারণ তোমরা সবার চোখেই নেমে গিয়েছো। বিশেষ করে তুমি মেহনূর। ঝামেলা না করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করো। আমি তো যেতে পারছি না, আমার একটু গঞ্জে যাওয়ার প্রয়োজন। যাতে সবাই ভাবে তুমি প্রকৃত অর্থেই অনুতপ্ত।”

“ক্ষমা করবেন। যতো যাই হোক আম্মিজান, আমি যাচ্ছি না। ঐ অমাবস্যার চন্দ্রকে দেখলে দিনটাও আঁধার কাটে। শাহাজাদি তুমি যেয়ো, আর বোলো আমি অসুস্থ।”

___

যামিনী অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হচ্ছে৷ খুব করে সাজসজ্জা করেছে সে আজ।

“দিলরুবা কেমন লাগছে আমায়?”

“মাশা আল্লাহ বেগম। সবসময়ের ন্যায় অপরূপা। দুনিয়ার সবচাইতে সুন্দরী নারী।”

“মিথ্যে সুনাম করতে হবে না দিলরুবা৷ আমি কেমন তা সম্পর্কে আমি জ্ঞাত। তবুও আমার সৌভাগ্য বাবু মশাই আমায় গ্রহণ করেছেন, তাও ভালোবাসার সাথে। তাঁর হৃদয়টা তাঁর চাইতেও অধিক সুদর্শন। আল্লাহ তাঁর পদতলে দুনিয়ার সকল সুখ দান করুক।”

“আমিন, বেগম। তবে একটা বিষয় বুঝলাম না, হুট করে এমন জমজমাট আয়োজন করলেন ক্যানো?”

হাতের ইশারায় সকলকে স্থান ত্যাগের আদেশ করে রমণী। তারপর ফিসফিস করে উত্তর দেয়,
“শাহাজাদি মেহনূরকে বের করতে। তাও সে নিজেই নিজেকে এই নবাববাড়ি ছাড়া করবে”

“এই অনুষ্ঠানের দ্বারা!” বিস্মিত বাঁদী তার বেগমের কথায়।

“হুম, তুমি শুধু দেখে যাও সামনে কী হয়।”

দিলরুবা সায় জানায়। যামিনী পুনরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে দর্পণে দেখায়।

___

সংগীতের মিষ্টি সুরে মেতে আছে পরিবেশ। কোমর ডুলিয়ে ডুলিয়ে নৃত্য করছে দাসীরা। মুখরোচক খাবারের সুব্যবস্থা তো আছেই।

যামিনী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে শাহাজাদি মেহনূরের। বেশ কিছু সময় কাটার পরও তাকে উপস্থিত হতে না দেখে দিলরুবাকে ইশারায় নিকটে ডাকলো সে।

“জী, বেগম চন্দ্রমল্লিকা?”

“খোঁজ নাও তো শাহাজাদি মেহনূর এখনও আসেনি ক্যানো?”

“জী।”

জবাব দিতেই শাহাজাদি মেহনূর প্রবেশ করে। থেমে যায় কলরব, মাথা ঝুঁকে যাওয়ার পথ দিয়ে দাঁড়ায় সকলে।

যামিনী হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে যেয়ে স্বাগতম জানায় তাকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই।
“স্বাগতম শাহাজাদি। আমি তো এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না। বস্তুত, এমন সব লজ্জাজনক ঘটনার মুখ দেখানোর মতো অবস্থা কারোরই থাকে না।”

“আমি যে কেউ না চন্দ্রমল্লিকা। আমি শাহাজাদি মেহনূর। তোমার মতোন কোনো চাষার ঘরে বেড়ে উঠা কন্যা নয়।”

যামিনী কানের নিকট মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“আপনি ভুলে যাচ্ছেন শাহাজাদি, আমি আপনার সম্পর্কে ভাবী তো হই-ই, আবার ক্ষমতায়ও আপনার চেয়ে বড়ো। আমি বেগম নবাবের। সেখানে আপনি সত্যিকার অর্থে শাহাজাদিও না, কারণ আপনি এই বংশের কন্যা নয়। হাওলাদার বংশের কন্যা।”

“এতো উড়ো না, চন্দ্রমল্লিকা। শাহ এখন তোমার আপন, পর হতে কতো ক্ষণ? মনে রেখো শাহ আমার ভালোবাসা, আর ভালোবাসা জয়ে প্রতিটি সীমা লঙ্ঘন করা যায় নির্ভয়ে।”

হেসে দেয় কিশোরী।
“তাহলে তো আপনার অধিক পরিমাণ ভীতি করা উচিত শাহাজাদি। কারণ আপনি ভুলবেন না, শাহ আমার ভালোবাসাই নয়, প্রয়োজনও। যাকগে ছাড়ুন এসব, বসুন।”

যুবতীর মোহনীয় মুখ খানা ক্রোধের আগুনে ঝলসে যায়। তবুও নিজেকে কোনোরকম সামলে নিয়ে নরম গদিতে বসে সে।

গান-বাজনা চলছে। চলছে খাওয়া-দাওয়া, কথোপকথন। যামিনী মোহিনীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইশারা করে। সেও ইশারায় সায় জানিয়ে আদেশ পালনে এগিয়ে যায়।

খাদিমরা শরবত, কাবাব ও মিষ্টি পরিবেশন করছে। মোহিনীও সেই কাজের ভার কাঁধে নেয়। শাহাজাদি মেহনূরকে শরবত পরিবেশন করতে যেয়ে মোহিনী ইচ্ছাকৃত ভাবেই তার গায়ে পানীয় ফেলে দেয়।

যুবতী এমনিতেই ক্রোধান্বিত যামিনীর উপর। তার উপর এই পরিস্থিতি। দাস-দাসী, জনসাধারণ সর্ব কালেই তার নিকট নিচুস্তরের মনে হয়। সুতরাং তার সকল ক্রোধ ভেঙে পড়লো মোহিনীর উপর।

চার-চারটা চড় মেরে দিল তাকে। মাথা যেয়ে পড়লো কাঠের চৌপায়ায়, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়তে শুরু করে। সেখান হত উঠে দাঁড় করিয়ে গলা চেপে ধরে। এতক্ষণ নীরব থাকলেও এবার যামিনী এগিয়ে যেয়ে এক ধাক্কায় ফেলে দেয় শাহাজাদি মেহনূরকে মেঝেতে। আগলে নেয় মোহিনীকে।

“চন্দ্রমল্লিকা! তোমার স্পর্ধা কী করে হয়…”

চেঁচিয়ে উঠে মেহনূর। থামিয়ে দেয় তাকে কিশোরী।

“মোটেও চেঁচাবেন না, শাহাজাদি। মানুষ আপনি? দেখুন, মেয়েটার কী অবস্থা করেছেন! ছিঃ আপনাকে তো শাহাজাদি বলে সম্বোধন করতেও ইচ্ছে করছে না আমার। এতো ঘৃণ্য আপনি!

আপনার সাহস কী করে হয় আমার সম্মুখে আমার অন্দরমহলের কন্যাদের সাথে এমন আচারণ করার? আপনি বেগম চন্দ্রমল্লিকার আয়োজনে এসেছে, তার সম্মুখে এমন বেয়াদবি করার দুঃসাহস!

ভুলক্রমেও ভুলবেন না সামান্য শাহাজাদি আপনি, তাও মাতার সম্পর্কে। সর্বদাই আমার নিচে আপনার স্থান।”

শাহাজাদি আরও ক্ষুব্ধ হয়। উঠে যেয়ে গলা চেপে ধরে যামিনীর। দাসীরা এসেও ছুটাতে পারছে না। বারবার তেড়ে আসছে যুবতী। অবশেষে প্রহরীরা বন্দী করে তাকে।

“তোমার জান নিয়ে ফেলব আমি কন্যা! নেই রূপ, নেই বংশ পরিচয়, আর আমাকে অপমান করা! অতীত কখনোই বদলাবে না, তুমি এক চাষাভুষার ঘরের পাপ তা-ই থাকবে।”

আরও নানা রকম কথা চিৎকার করে বলছে মেহনূর। যামিনীকে আগলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দিলরুবা সহ আরও কিছু দাসীরা। তার গলায় দাগ পড়ে গিয়েছে আঁচড়ের। চিৎকার শুনে বেড়িয়ে নিজ নিজ কামরা হতে আসেন মেহমাদ শাহ ও বেগম নূর বাহার।

উপর তলা হতে নিচের দৃশ্য দেখে মুখশ্রী কঠোর হয়ে যায় যুবকের। দ্রুতো সিঁড়িপথ বেয়ে নিচে নামে। বেগম নূর বাহার তা দেখে ভীতিগ্রস্ত হন, নিজেও পিছন পিছন এগিয়ে যান।

“সাবধান! জমিদার নবাব শাহ আসছেন!”

প্রহরীর কথায় সকলেই নত চোখে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। শাহাজাদি মেহনূরও ভয় পায়।

“কী হচ্ছে এখানে? কী হলো বলছো না ক্যানো কী হচ্ছে?”

মোহিনী ব্যথাতুর গলায় শুধায়,
“আমার হস্ত হতে ভুলক্রমে শাহাজাদির গায়ে একটু শরবত পড়ে যায়। আমি বারবার ক্ষমা চাইলেও শাহাজাদি আমায় মেরে এই অবস্থা… বেগম আমাকে রক্ষা করতে আসলে তিনি তাঁর উপরও আক্রমণ করেন। তাঁকে কোনো ভাবেই আটকানো যাচ্ছিলো না তাই প্রহরীরা তাঁকে ধরে রেখেছে।”

মেহমাদ শাহ শীতল মস্তিষ্কের লোক। উত্তেজনা কিংবা ক্রোধে কাজ নেওয়ার ব্যক্তি সে নয়।

শীতল কণ্ঠে প্রহরীকে আদেশ করে,
“মেহনূরকে তাঁর কক্ষে নজরবন্দী করা হোক। তার ব্যবস্থা কাল করা হবে। তবে এর পূর্বে তার সাথে যাতে কেউ সাক্ষাৎ না করতে পারে।”

যামিনীর স্তব্ধ ও অশ্রুসিক্ত মুখ খানা দেখে তাকে আর কিছু বলে না মেহমাদ শাহ। নৈশব্দে কোলে তুলে নেয়। তার বক্ষে মুখশ্রী আড়াল করে জয়ের হাসি দেয় কিশোরী। তার জীবনের প্রথম বিশাল পরিকল্পনা শতভাগ সফল হয়েছে।

___

গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে গঞ্জের দিকে। বেগম লুৎফুন্নেসার হৃদস্পন্দন পথের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। পুরোনো ক্ষততে জ্বালা ধরলে হয়তো এমনই বোধ হয়।

হুট করে বেগম লুৎফুন্নেসা চালককে আদেশ করেন,
“গাড়ি এখানেই থামাও। আমি এখানেই নামবো।”

গাড়ি থেকে নেমে যান তিনি। হাঁটতে শুরু করেন। তাঁর পরনে সাধারণ মুসলিম নারীর ন্যায় বিবর্ণ কালো আলখাল্লা, কারো চেনার উপায় নেই তিনি নবাববাড়ির সম্ভ্রান্ত নারী।

গঞ্জের একটি ছোট্ট কুড়ে ঘরে ঢুকে সে। অভ্যন্তরে একজন বৃদ্ধ লোক।

“সব তৈরি?”

“হ্যাঁ, বেগম।”

ইশারা পেতেই বাহিরে চলে যান বৃদ্ধ লোকটি। তাঁর আচারণ ও আনুগত্যেই বোধগম্য তিনি বেশ পুরোমো ভৃত্য বেগম লুৎফুন্নেসা।

টেলিফোনে কল লাগায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে। রিসিভ করা হয় অপরপাশ হতে।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম? কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আর রইতে দিলে কোথায় আরমান? কী জন্য এমন উন্মাদনা নামক মরণফাঁদে গা ভাসাচ্ছো?”

“এখানে পাগলামোর কী হলো, বেগম? আমার হৃদয় কি পাথরের? আমার হৃদয়ও তো টানে আপনার উদ্দেশ্যে। কতো বছর আপনায় দেখি না! আফসোস, আপনি কখনও ভালোবাসেননি বেগম। তাই তো সেদিন ফিরাননি নবাবকে…”

“এ কথা বোলো না আরমান। তুমিই আমাকে সর্বপ্রথম স্বাদ দিয়েছো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতির। তোমার কর্মই ছিল তোমার পরিণামের জন্য দায়ী। নবাব তো তোমায় হত্যা করতে চেয়েছিলেন আর আমায় তালাক দিতে। কারণ তাঁর সাথে বেইমানি করেছিলাম আমি।

কতো কষ্টে তাঁর সিদ্ধান্ত বদলিয়েছি তা আমার আল্লাহ জানেন! তোমার ভালোর জন্যই তোমায় এখানে আসতে বারণ করছি আরমাম। এখানে এলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত। মেহমাদ শাহের নিকটও তুমি অপছন্দের পাত্র।”

“কিন্তু…”

“কোনো কিন্তু নয় আরমান। দয়া করে আমার কথা শোনো। সেবারও আমার বচন অমান্য করেছিলে, এবার কোরো না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আরমান বাবু। দর্শন না করলেও বুঝতে পারেম বেগম লুৎফুন্নেসা। হয়তো ত্রুটিহীন ভালোবাসার বন্ধনটাই এমন।

প্রায় ঘণ্টা খাণেক কথাবার্তা শেষ করে সেই ঘর হতে বের হয়ে যান বেগম লুৎফুন্নেসা। রেখে যান বেশ কিছু অর্থ।

ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন এসপি সাহেব। বস্তুত, জনসাধারণের পুলিশ হলেও, ক্ষমতাধদের গুপ্তচর স্বরূপই কাজ করা হয় অধিক।

আনমনেই বিড়বিড়ালেন,
“যাকগে কথা শেষ করে গেল। খাবারটা সেড়ে খবর দিতে হবে মনিবকে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here