চরিত্রহীনা ২ পর্ব ৭

‘চরিত্রহীনা২’ পর্ব-৭
.
লেখক : Mahian Khan
.
তিন্নি প্রচুর কৌতূহলী হয়েই দরজাটা খোলে। দরজাটা খোলা মাত্র অদ্ভুত ও অপ্রাত্যাশিত একটা প্রতিবিম্ব তিন্নির দুচোখকে স্বজোরে আঘাত করে। মুহূর্তে একেবারে পাথর হয়ে যায় তিন্নি। সেই একই উজ্জ্বল শ্যামবর্নের সেই ছেলেটি! সেই একই হাসি, সেই একই নাক, মুখ, শুধু হালকা পরিবর্তনের ছাপ। পূর্নজন্ম যদি সত্যিও হয় তবুও এত তাড়াতাড়ি পূর্নজন্ম সম্পুর্ন অসম্ভব। এটাকে অদ্ভুত কোনো স্বপ্ন বলেই তিন্নির মনেহয়। সেই অদ্ভুত প্রতিবিম্বটি থেকে ভেসে আসে তিন্নির সেই সুপরিচিত কন্ঠ,
.
– কেমন আছো?
.
কন্ঠটা শুনে তিন্নির সমগ্র দেহজুড়ে শিহরন জাগে, প্রায় কেঁপে ওঠে তিন্নি। কন্ঠটা সম্পুর্ন বাস্তব বলেই মনেহয়। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! তিন্নির দুচোখ সম্পুর্ন স্থির, দেহ সম্পুর্ন নিস্তেজ। বেশ মৃদু তবে স্পষ্ট স্বরে বলে ওঠে,
.
– জাভেদ!!!
.
– হ্যা, আমি। এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? দু:খিত তোমার সাথে দেখা করার জন্য অনেক অভিনয় করতে হয়েছে।
.
তিন্নির দুচোখ এখনো বিশ্বাসে অনিচ্ছুক । একবার না পরপর দু বার নিজের হাতে বেশ জোরে চিমটি কাটে। নাহ! তবুও চোখের অভ্যন্তরে প্রতিবিম্বটি সরেনি। শুধু একটা প্রশ্ন তিন্নির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে আর তাহল, “এগুলো কি তবে কল্পনা না! ”
.
– কি ব্যাপার কিছু বলছ না যে!
.
– মানে, আপনি এত নিম্নমানের একটা ফাজলামি করলেন আমার সাথে?
.
– দু:খিত বললাম তো। ক্ষমা করো প্লিজ। কিন্তু আর ধৈর্য ধরে রাখা সম্ভব ছিল না, আমার পক্ষে। আর তুমি কাঁদছো কেন?
.
দুচোখকে দ্রুত পরিষ্কার করে অনেকটা অভিনয় করেই তিন্নি বলে,
.
– চোখে বালি গিয়েছে।
.
– আচ্ছা এভাবে ভিজে আছো কেন? বৃষ্টিতে ভিজতেছিলে?
.
– হ্যা।
.
– এখনো সেই অভ্যাস যায়নি তাহলে? আমি কখনো বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করতাম না। সত্যি বলতে জীবনে প্রথমবার স্বেচ্ছায় ভিজেছিলাম তোমার জন্য, মনে আছে?
.
– আছে। কিন্তু আপনি এরকম ফাজলামি করলেন কেন? এতটা লো লেভেলের ফাজলামি!
.
– বললাম তো আর ধৈর্য ধরতে পারছিলাম না। এই ৩ বছর কিভাবে কাটিয়েছি তা আমি জানি। প্লিজ ক্ষমা কর।
.
– কিন্তু আমাকে দেখাটা এতটা বাধ্যতামূলক কেনো ছিল? নিজেদের অতীত ভুলে থাকাটা আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না?
.
– ছিল, হয়ত। কিন্তু আমি তো আর অতীতকে, বর্তমানের সাথে যুক্ত করতে আসিনি। এসেছি শুধু তোমাকে আর ইরাকে দেখতে। তারপর আর ম্যাসেজ দিব না, আর বিরক্ত করব না। হয়ত একটা ছবিও তুলে নিব। ব্যাস এতটুকু! তারপর তোমার জীবন থেকে আমার অধ্যায়, চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিব। কিন্তু আমার জীবনে তোমার অধ্যায় কখনো বন্ধ হবে না। সেটা চিরকাল চলমান।
.
– বাহিরে দাড়িয়ে আছেন কেন? ভিতরে বসুন।
.
জাভেদ বাসার ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ে। হাতের নীল ছাতাটা ঘরের এক কোনে রেখে দেয়।
.
– বাহ! বাসাটা খুউব সুন্দর। তুমি এত পেইন্টিং করেছো এই কয় বছরে? পুরা বাসাটাকে আর্ট গ্যালারি মনে হয়। কি সুন্দর সবকিছু সাজানো, গোছানো। এককথায়, অসাধারণ।
.
– ধন্যবাদ। কিছু খাবেন চা অথবা কফি?
.
– না, কিছু খাব না। কিন্তু ইরা কোথায়?
.
– ইরা ওর এক বান্ধবীর বাসায় যেতে চেয়েছিল তো সেখানে দিয়ে এসেছি। এই তো আর এক-দেড় ঘন্টার মধ্যেই আসবে।
.
– নিজে নিজে!
.
– আরে, না। ঐ মেয়েটার মা, নিয়ে আসবে। সপ্তাহে দু-একদিন ওদের দুজনকে নিয়ে ঐ মেয়েটার মা বাহিরে ঘুরতে বের হয়। আবার বিকালের আগে বাসায় দিয়ে যায়।
.
– তাও এভাবে অন্যের দায়িত্বে নিজের সন্তানকে না দেওয়া ভালো।
.
– না, সবসময় আমিও সাথে থাকি কিন্তু আজকে আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল।
.
– আচ্ছা, তিন্নি একটা প্রশ্ন করব?
.
– করুন।
.
– সত্যি তুমি অতীত ভুলে থাকতে পেরেছো? সত্যি ৪ বছরে এতগুলো স্মৃতি ভুলে গিয়েছো? কত কথা, কত আড্ডা,কত ইয়ার্কি, ফাজলামি, হাসি, রাগ, কান্না। কত সহস্র শব্দ আমরা ব্যয় করেছি একে অপরের সাথে কথা বলে। সত্যি! সব ভুলে গিয়েছো?
.
– না, ভুলিনি আসলে ভুলে থাকা সম্ভব না। তবু পরিস্থিতির খাতিরে অভিনয় করে থাকাটা ভালো।
.
– এমন কি পরিস্থিতি যে,এতগুলো বছরে একবার আমার সাথে স্বেচ্ছায় কথা বললে না? যেদিন চলে গিয়েছিলে, সেদিন কেনো চলে গিয়েছিলে সেটাও তো জানাও নি।
.
– আমি সারাজীবন সবার জন্য বোঝা হয়ে, ঝামেলা হয়ে থেকেছি, সবাইকে ঝামেলামুক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছি, এই যা। আর কারো জীবনে ঝামেলা হয়ে ফেরত আসার ইচ্ছে নেই আমার মধ্যে।
.
– আমি তো কখনো তোমাকে আমার ঝামেলা বলিনি। তাহলে?
.
– সবকিছু কি পৃথিবীতে মাইক নিয়ে ঘোষনা দিয়ে বলতে হয়? কিছু জিনিস নীরবে বুঝে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।
.
– নীরবে, মানুষ ভুলও তো বুঝতে পারে, নাকি?
.
– না, আমি মানুষের নীরবতার ভাষা সম্পর্কে প্রচুর দক্ষ ও অভিজ্ঞ। ভুল করিনি। কিন্তু যাহোক আজকে যে, ফাজলামি করলেন সেটা সম্পুর্ন নিম্নমানের।
.
– মাঝেমাঝে,জীবনে নিম্নমানের কিছু কাজ করতে হয়।
.
– কিন্তু এটা কি উচিত ছিল?
.
– জানি না, আর কোনো বুদ্ধি মাথায় আসেনি।
.
– তাহলে, ঐ শোভন ছেলেটা কে?
.
– ও, আমার বন্ধু। ওকে অনেক কষ্ট করে রাজি করেছিলাম, এই অভিনয়ের জন্য। হি ইজ এ ব্রিলিয়্যান্ট এক্টর। দেখো, যদি কষ্ট পেয়ে থাকো তাহলে ক্ষমা কর। কিন্তু আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছিলাম না।
.
– কেনো? না দেখা করে থাকাটা কি ভালো ছিল না?
.
– জানিনা কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোভাবে বিদায় দিতে পারিনি। সবকিছু এতটা আকস্মিক হয়েছিল যে, চরম অপরাধবোধ হচ্ছিল নিজের মধ্যে। জীবন হয়ত স্বাভাবিক নিয়মে চলত কিন্তু একটা তীব্র ব্যাথা হত, প্রচন্ড তীব্র ব্যাথা! বিদায় সহ্য করা যায় কিন্তু হারিয়ে যাওয়া সহ্য করা যায় না। কিন্তু এখন সেই ব্যাথা যথেষ্ট কমেছে। আমি তোমার কাছে থাকতে আসিনি অথবা তোমাকে নিজের জীবনে ফেরত পেতে আসিনি বরং একবার শেষবারের মত তোমায় দেখতে এসেছি তুমি যদি বিরক্ত মনেকর তবুও এই শেষ একবার তোমাকে বিরক্ত করব। কথা দিলাম আর করব না।
.
তিন্নি কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখন দরজায় বেলটা বেজে ওঠে। অবশ্যই ইরা এসেছে, এই বিষয়ে তিন্নির কোনো সন্দেহ নেই। তারাহুড়ো করে দরজাটা খুলে দেয়।
.
– কেমন আছো তিন্নি?
.
ইরা তিন্নিক দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে। একবারে তিন্নি,ইরাকে কোলে তুলে নেয়।
.
– এই তো আপু ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
.
– এই তো আছি। আর এভাবে ভিজে আছো কেনো?
.
– ঐ, একটু বৃষ্টি লেগেছে।
.
– ওহ! আর ইরা কিন্তু আজকে ব্যাপক দুষ্টুমি করেছে। বাবা! ওরা ২ জন একসাথে যা পারে!
.
– হ্যা, বাসায় সারাদিন খুব একটা ডিস্টার্ব করে না কিন্তু কাউকে পেলে ব্যাস! পারলে ঘরবাড়ি ভাঙচুর করতেও দ্বিধা করে না। তো আপু ভিতরে আসেন।
.
– না, আজকে না। এখন বাসায় অনেক কাজ। অন্য একদিন আসব।
.
– শুধু ৫ মিনিট, কিছু খেয়ে যান।
.
– আজকে না, বললাম অন্য একদিন।
.
– আচ্ছা আপু, আল্লাহ হাফেজ!
.
– আল্লাহ হাফেজ!
.
.
– আজকে নাকি অনেক দুষ্টুমি করেছো?
.
– কৈ, আমি কখনো দুষ্টুমি করি?
.
– উম! না। তুমি লক্ষ্মী আম্মু না!
.
জাভেদকে দেখে ইরা একদম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হয়ত জাভেদকে দেখে প্রচুর কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। জাভেদও ইরাকে দেখে বেশ গভীর, মুচকি একটা হাসি দেয়।
.
– আমাকে চিনেছো? আমার কথা মনে আছে? জাভেদের কথা মনে নে?
.
ইরা হয়ত হালকা লজ্জা পাচ্ছে অথবা বেশ অবাক হচ্ছে। জাভেদ উঠে দাড়িয়ে, ইরার গালে হালকা টান দিয়ে নিজের ব্যাগের মধ্যে থেকে পুরো এক প্যাকেট চকলেট বের করে দেয়। প্যাকেটটা দেখামাত্র ইরার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি দেখা যায়। সামান্য সঙ্কোচ না করেই প্যাকেটটা হাতে তুলে নেয়। ইরাকে দেখেই বোঝা যায়, জাভেদের প্রতি সে প্রচুর সন্তুষ্ট।
.
– বাহ! আমরা অনেক খুশি, তাই না আম্মু?
.
ইরা হালকা লজ্জা পেয়ে মুখ, তিন্নির কাধে গুঁজে নেয়।
.
– কেনো? এভাবে ওকে বিরক্ত করছ কেনো?
.
– চকলেট খেতে খেতে দাঁতের অবস্থা দেখেন না, কি হয়েছে!
.
– দেখলাম তো! তারপরও ছোটবেলা সবার চকলেটের নেশা থাকে। ধীরে ধীরে বড় হলে, চকলেটের প্রতি এই আকর্ষন আর থাকবে না।
.
– আমার তো মনেহয় না। দিনে ৮-১০ টা চকলেট খাওয়ার অভ্যাস কোন বাচ্চার আছে?
.
– আরে, বাবা! তুমি ওর নামে এত বদনাম করতেছো কেন? যাহোক তোমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে চলে যেতে চাই আর অযথা বিরক্ত করব না।
.
– কি যে বলেন! এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবেন? আর এতদিন পর এসেছেন এই ৫-১০ মিনিট কথা বলার জন্য?
.
– না, তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাই না। যতটুকু কথা বলেছি ততটুকু যথেষ্ট।
.
– মানে? ফালতু কথার জায়গা পান না? চুপচাপ বসুন। আর হাসতেছেন কেন?
.
– না, মানে কেন জানি সেই ৬-৭ বছর আগের কথাগুলো মনেপড়ছে। কিভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোনো উত্তর অপছন্দ হলে রেগে যেতে মনে আছে?
.
– হুম, আছে তো। আর রাগ যেন দেখাতে না হয়। তাই বসুন।
.
– আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে।
.
জাভেদ চুপচাপ তিন্নির আদেশানুসারে সোফায় বসে পড়ে। ইরাকে তিন্নি কোল থেকে নামিয়ে দেয়। জাভেদ ইরাকে ডাক দেয় অতপর ইরা কথা বলার জন্য বেশ ভালো বন্ধু খুঁজে পায়। তিন্নি দ্রুত পোষাক পাল্টিয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
.
(১০)
.
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে, আকাশ প্রায় নীল হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি থামার কোনো নামগন্ধ নেই। বারান্দায় দাড়িয়ে তিন্নি একনজরে বৃষ্টি দেখছে। ইরা গভীর ঘুমে, জাভেদ সেই কখন থেকেই মোবাইলটা চালাতে ব্যস্ত। জাভদের একটানা মোবাইল চালানো দেখে বেশ বিরক্ত হয়ে, তিন্নি প্রায় হুংকার দিয়ে ওঠে,
.
– আপনার অবস্থা কি?
.
– হুহ!
.
– কখন থেকে মোবাইল চালাচ্ছেন, হিশেব আছে?
.
– তো আর কি করব?
.
– বাবা! এখানে আসেন, বৃষ্টি দেখুন আমার সাথে।
.
তিন্নির কথায় জাভেদ উঠে তিন্নির পাশে দাড়ায়। তিন্নি অদ্ভুত ভঙ্গিমায় জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টিতে তিন্নি বৃষ্টি উপভোগ করছে। হাতটা জানালার বাহিরে দিয়ে বৃষ্টিগুলো স্পর্শ করতে থাকে। ভিজে যায় তিন্নির ডানহাত। গোলাপি রঙের জামায় তিন্নিকে সবসময় অদ্ভুত সুন্দরি দেখায়, আজও একইরকম লাগছে। বৃষ্টির দিকে জাভেদের কোনো খেয়াল নেই, এক দৃষ্টিতে সে তিন্নিকেই দেখতে থাকে। কি অদ্ভুত চঞ্চল, কতটা গভীর হাসি তিন্নির মুখ জুড়ে। জাভেদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বেশ অদ্ভুত এবং রাগী ভঙ্গিমায় জাভেদকে জিজ্ঞেস করে,
.
– কি ব্যাপার?
.
– কৈ? কিছু না।
.
– কত সুন্দর বৃষ্টি, দেখেছেন?
.
– হুম, দেখলাম। এত বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে আছো কিভাবে? এই বৃষ্টিতে কেউ বারান্দায় দাড়ায়? নিজে ভিজতেছো সাথে আমাকেও ভিজাচ্ছো।
.
– আচ্ছা তো দাড়াবো না।
.
প্রচন্ড রাগ আর অভিমান নিয়ে তিন্নি হাটা শুরু করে। তিন্নির অভিমান ভাঙাতে জাভেদও তিন্নির পিছনে হাটা শুরু করে। পিচ্ছিল বারান্দায়, হোচট খেয়ে তিন্নি পড়ে যাওয়া শুরু করে একেবারে আলোর গতিতে জাভেদ কোনোভাবে তিন্নিকে নিচে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। জাভেদের দু হাতের মাঝে হেলান দিয়ে নিজেকে কোনোভাবে স্থির রাখে তিন্নির বেঁকে থাকা দেহ। কোনোভাবে সোজা হয়ে দাড়িয়ে, জাভেদের দিকে বেশ অদ্ভুত এবং বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তিন্নি।
.
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here