চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ২১

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ২১

🍂🍂🍂

বাগানের দোলনায় বসে আছে শুভ্রতা। গায়ে জড়ানো ওই ছেলেটার পাঠানো লাল-সাদা শাড়ি, হাত ভর্তি লাল-সাদা চুড়ি, চোখে গাঢ় কাজল, হাত পায়ে আলতা, পায়ে নুপুর, ঘন কালো চুলগুলো বাঁধনহীন। ছেলেটার পাঠানো চিরকুট হাতে নিয়ে দোলনায় দোল খেতে ব্যস্ত। শাড়ির আঁচলটা যে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে তাতে তার মনোযোগ নেই। সে চিরকুট পড়ায় মনোযোগী। শাড়ি পড়ার আগেই একবার চিরকুটটা পড়েছে। এখন আবারও পড়ছে। আজকের লেখা গুলো যেনো তার মন ছুঁয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত এই লোকের দেওয়া কোনো শাড়িই ছুঁয়ে দেখেনি শুভ্রতা। অচেনা মানুষের দেওয়া জিনিস ছুঁবে কেনো? লোকটার দেখা মিললে সব ফেরত দিয়ে দিবে ঠিক করেছে সে। আগের গুলো সুন্দর হলেও আজকের উপহার গুলো মন কেড়েছে তার। অসম্ভব ভালো লেগেছে। ঠিক করেছে ওই লোকের সাথে দেখা হলে নাহয় বাকি শাড়িগুলো ফিরিয়ে দিবে আর এই শাড়ি এসবের টাকা দিয়ে দিবে। তাও এইগুলো সে রেখে দিবে।

“শোনো কাজল চোখের মেয়ে
আমার দিবস কাটে, বিবশ হয়ে
তোমার চোখে চেয়ে।

তুমি এতো মায়াবতী কেনো বলো তো! খুব, খুব, খুব পড়ালেখা আর পরিশ্রম করে হার্ট সার্জন হয়েছি। কিন্তু কি লাভ বলো দেখি! এই যে তোমার প্রেমে আমার হৃদয় প্রতি মুহূর্ত দগ্ধ হচ্ছে তাতে আমি কিছু করতে পারছি? পারছি না। ডাক্তার জগতে এই খবর প্রচার হলে কি একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি হবে ভেবে দেখেছো? তুমি খুব পোড়াচ্ছো শুভ্রতা। মনটাকে পুড়তে পুড়তে ছাই বানিয়ে দিচ্ছো। এই হৃদয় শীতল হতে এখন তোমাকে চাইছে। কি করা যায় বলো তো? তুমি তো আসতে চাইছোই না।

মা তোমাকে ভীষণ পছন্দ করেছে। তার বড় ছেলের বউ হিসেবে নাকি তোমাকেই চাই। তুমি রাজি না হলেও যেনো তোমাকে তুলে নিয়ে যাই গতকাল এই আদেশ দিয়েছেন তিনি। কি বলো? তুলে নিয়ে আসবো নাকি?

এই পর্যন্ত যত গিফট্ দিয়েছি তার বেশির ভাগই মা আর বোনের পছন্দ করা, অনলাইনে কিনেছি কিংবা মা বোনদের দিয়ে কিনিয়েছি। আজকের গিফটটা আমি নিজে কিনেছি। একদম নিজের পছন্দে। পছন্দ হয়েছে তোমার? দেবদাস মুভিটা দেখেছিলে? ঐযে শাহরুখ আর ঐশ্বর্যের। লাস্ট সীনে পারোর শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই নিজের পারোর জন্য এমন রঙের শাড়ি কিনে নিলাম। এই শুনো তোমাকে পারো বলছি বলে ভেবো না আমি দেবদাসের মত তোমাকে অন্য কারো হতে দেখবো। আমার মৃত্যুর ১ বছর হোক, ১ দিন হোক কিংবা ১ মিনিট আগেই হোক না কেনো তোমাকে আমার বধূ করে তবেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবো বলে দিচ্ছি। তুমি একান্তই আমার। তোমার ব্যাপারে আমি খুব জেলাস আর ইন্সিকিউর, জানো তো?

এতো দিনের চিরকুট গুলো হয় অনলাইন শপের লোকেরা লিখেছে নয়তো বাড়ির কাউকে দিয়ে লিখিয়েছি। আজকের চিরকুট আমার নিজ হাতে লেখা। বাকি ডাক্তারদের মত আমার হাতের লেখাও অসুন্দর হলে হেসো না প্লীজ।
এই পর্যন্ত দেওয়া এক শাড়িও পড়লে না কেনো? পছন্দ হয়নি? যাই হোক, আজকের দেওয়া শাড়িটা পড়ে একদিন আমার সামনে এসে আমাকে চমকে দিবে, ওকে? আমি মুগ্ধ হয়ে দুচোখ ভরে দেখবো তোমায়। ইশ! শুভ্রতা! তুমি আমায় পাগল করে দিচ্ছো। কবে না জানি মায়ের কথা মতো সত্যি সত্যিই তোমাকে বাড়ি তুলে নিয়ে আসি। তখন আবার বলিও না যে আমি তোমাকে আগে জানাইনি।

আর শোনো! আমি কে তা নিয়ে এতো ভেবো না। সময় হলে আমি নিজেই তোমার সামনে আসবো। শাশুড়ি মাকেও বলে দিও মেয়ের জামাই একদিন সামনে এসে মা, মেয়ে দুজনকেই চমকে দিবে।

ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও। আর হ্যা! ভালোবাসি।

ইতি
তোমার হবু বর”

শুভ্রতা বেশ কয়েকবার চিরকুটটা পড়লো। মনে মনে আওড়ালো “লোকটা ভীষণ অসভ্য”। তা না হলে এমন তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয় কি করে? শুভ্রতা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

~আসুক না তুলে নিয়ে যেতে। মাথার চুল টেনে একদম টাকলা করে দেবো। বেটা অসভ্য!
______________________________________

চিরকুটটা ভাঁজ করে দোলনার ওপর রেখে একটা পাথর চাপা দিয়ে সে উঠে দাড়ালো। এখন সে প্রকৃতি বিলাস করবে। আকাশের মেঘ গুলো ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে তার কাছে। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। সম্ভব হলে তাই করতো। দু হাত প্রশস্ত করে লম্বা এক শ্বাস নিতেই রেনু হাক ছেড়ে ডাকলো,

আপামনি? আপনার ফোন আইছে।

শুভ্রতা অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে তাকালো। তার রাগী চাহনী দেখে রেনু ঢোক গিললো। এই সময় শুভ্রতাকে ডাক দেওয়া মোটেই উচিত হয়নি তার। ধমক খাওয়ার আগেই ঘরে উমার কাছে চলে গেলো। তার বিশ্বাস শুভ্রতা এখানে তাকে ধমক দিতে আসবে না। ফোন ধরতে সে সোজা ঘরেই যাবে। দরজা দিয়ে উকি মেরে দেখলো শুভ্রতা শাড়ি সামলে বড় বড় কদম ফেলে ঘরে যাচ্ছে। রেনু ভয় যেনো এবার কমলো। সস্তির নিশ্বাস ফেলে সে নিজের কাজে ফিরে গেলো।
____________________________________

~আসসালামু আলাইকুম। কি সমস্যা?

শুভ্রতার ধমকে রিদিতা একটু হকচকালো। প্রথমে শীতল কণ্ঠে সালাম দিয়ে পর মুহূর্তেই ধমক দেওয়া যায় তা শুভ্রতাকে কল না দিলে জানতেই পারতো না সে। এই মেয়ে কল দিলে এমন রেগে যায় কেনো? কথা বলতে গেলে এত বিরক্তবোধ ওর মধ্যে আসে কি করে? শুভ্রতা আবার ধমক দিতেই সে এক নিশ্বাসে বললো,

আর্জেন্ট রক্ত লাগবে। পেটেন্ট এর অবস্থা কেমন জানি না। আমি হাসপাতালের লোকেশন সেন্ড করছি তুই জলদি আয়।

বলেই খট করে কল কেটে দিলো। নাহলে এখনি হুংকার দিয়ে শুভ্রতা বলতো,

এই কথাটা মেসেজে বলা যেতো না? কল দিলি কেনো আজাইরা? বিরক্ত করার আর উপায় পাস না!

রিদিতা কল কাটতেই শুভ্রতা ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নিচে নামতেই রেনুকে দেখতে পেলো। হাত খোঁপা করতে করতে রেনুর উদ্দেশ্যে বললো,

মাকে জানিয়ে দিও আমি একটু বের হচ্ছি। টেনশন যেনো না করে।

রেনু ঘাড় কাত করে আচ্ছা বলতেই শুভ্রতা আর দাড়ালো না। দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে এলো।
_____________________________________

যখন চন্দ্রের কাছে শুনেছিলো ডক্টর অরণ্য খেয়াল রাখছে তখনই শুভ্রতা বুঝলো অরণ্য এই হাসপাতালেই চাকরি করছে। রিকশাতে বসে সিওর হওয়ার জন্য অরণ্যকে কল করলো শুভ্রতা,

~ভাইয়া আপনি কি….. হাসপাতালের ডাক্তার?
~হ্যা। কেনো তুই জানিস না? আর তুই এসেছিলি নাকি? তোর বান্ধবীদের দেখলাম আজ মাহতাবকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল।
~তাকেই রক্ত দিতে গিয়েছিলাম। এখন রাখছি।

কল কাটতেই শুভ্রতার মনে পড়লো শুভ্রতা হাসপাতালে গিয়েছিলো নিজ গাড়িতে করে। কথার তালে পড়ে ভুলেই গিয়েছিলো সে। গাড়ি হাসপাতালে রেখেই সে রিকশা নিয়ে প্রায় মাঝ পথে চলে এসেছে। রাগে কপাল চাপড়ে রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বললো,

মামা! রিকশা ঘুরান। আগের জায়গায়ই চলুন।

হাসপাতালে আসতেই সোজা পার্কিং এরিয়ায় চলে গেলো গাড়ি আনতে। সেখানে গিয়ে আবারো দেখা মিললো চন্দ্রের। শুভ্রতাকে দেখতেই সে তার কাছে এগিয়ে এলো।

~তুমি এখনো এখানে? বাসায় যাওনি? তোমার বান্ধবীরা তো সেই কখন চলে গেছে। তুমি এখনও এখানে কি করছো?

এক সাথে এত প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো শুভ্রতা। চন্দ্র ফের প্রশ্ন করলো,

~কি হলো? জবাব দিচ্ছো না কেনো?

~ভুলে গাড়ি রেখে রিকশা নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। মাঝপথে গিয়েও আবার ফিরে এসেছি।

~এতো খামখেয়ালী কেনো তুমি?
চন্দ্রের প্রশ্নে শুভ্রতা জবাব দিলো না। পাল্টা প্রশ্ন করলো,

~মাহতাব ভাইয়া কি সত্যিই আপনার আপন ভাই?

শুভ্রতার প্রশ্ন চন্দ্রের মাথার উপর দিয়ে গেলো। এ আবার কেমন ধরনের প্রশ্ন! চন্দ্রের এরূপ চাহনিতে শুভ্রতা থতমত খেয়ে গেলো। জোরপূর্বক হেসে বললো,
~আসলে আপনার ভাই হাসপাতালে ভর্তি। আর আপনাকে যখনই দেখছি ভাইয়ের কাছে না থেকে এদিক ওদিক ঘুর ঘুর করছেন। দুমিনিট কি তার কাছে বসা যায় না?

চন্দ্র কপাল কুঁচকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

মা আর বোন ওর কাছে আছে এখন। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত আমি তাই বাড়ি যাচ্ছিলাম।

~ও আচ্ছা।

শুভ্রতা গাড়ি নিয়ে চলে এলো। মিররে দেখলো চন্দ্র এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি এখনও তার যাওয়ার দিকেই স্থির।
_________________________________

ড্রয়িং রুমের সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে আছে শুভ্রতা। গায়ের শাড়িটাও এখনও পাল্টায়নি। উমা এসে এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার শুভ্রতাকে এমন করে সোফায় পড়ে থাকার জন্য বকে গেছে। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে আগের মতোই বেকে পড়ে রইলো শুভ্রতা। রক্ত দিয়েছে পর থেকে অসম্ভব মাথা ঘুরাচ্ছে। সারাদিনে খাবার না খাওয়ার সাজা এখন ভালোই টের পাচ্ছে। বাবাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে শুভ্রতা উঠে বসলো। বাবা এসে পাশে বসতেই বাবার বুকে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। আবসার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

~কি হয়েছে আমার ছোট মায়ের? মন খারাপ?

শুভ্রতা মাথা নাড়ালো। আহ্লাদী স্বরে বললো,

~শুভ্রতা আজ ভীষণ ক্লান্ত বাবা। জানেন রক্তদান করেছি আমি আজ।

আবসার খুশি হলেন খুব। তখনই উমা এসে পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসে বললেন,

~আপনার মেয়ে সকাল থেকে খাবার খায়নি। না খেয়েই তিড়িং বিড়িং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শুভ্রতা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো,

~একদম মিথ্যা, আমি খেয়েছি।
~কি খেয়েছিস? পানি?

শুভ্রতা মাথা নাড়ালো। মিনমিন করে বললো,

~কফি

উমা ভ্রু কুচকালেন। কখন? যতক্ষন শুভ্রতা বাড়িতে ছিল ততক্ষণ সে তো রান্না ঘরেই ছিলো। বাকি সময় রেনু তার সাথেই ছিল। রেনুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো রেনু বানিয়েছে কিনা। রেনু যেনো এই সুযোগেই ছিল। ফটাফট জবাব দিলো,

মিছা কথা খালু। আপামনি কফি খায় নাই। আমি তো আজকে কফির ডিব্বা ধইরাও দেহি নাই। আপামনি তো আজকে সারাদিনে একবারও রান্দন ঘরে যায় নাই। তাইলে কফি দিবো কেডা? আপামনি মিছা কথা কন ক্যা?

শুভ্রতা চরম বিরক্ত হলো। দাতে দাত চেপে রাগে গজগজ করতে করতে বললো,

~ আমি যে আজ বাহিরে গিয়েছিলাম এটা বেশ মনে আছে। তা বাহিরে যে কফি বেচেঁ এই জ্ঞান নেই?

শুভ্রতার কথায় রেনু জিভ কাটলো। “ছরি, ছরি আপামনি। এই কথা আমি ভুইলাই গেছিলাম হেহে” জোরপূর্বক হেসে জানালো সে। শুভ্রতা চোখ গরম করে চেয়ে রইলো রেনুর দিকে। অকারণেই তাকে কেউ মিথ্যাবাদী বলুক তা তার পছন্দ নয়। উমা আর আবসার বুঝলেন মেয়ের রাগের কারণ। আবসার চাপা স্বরে বললেন,

~নিজের স্বাস্থ্য নিজে হেয়ালি আমার মোটেও পছন্দ নয় ছোট মা। আজকে আবার রক্ত দিয়েছো। যদি রাস্তায় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে? নিজের ব্যাপারে এত খামখেয়ালী হলে চলে।

শুভ্রতা মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। রাগের কারণে আবারো মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে তার। চুপ করে বসে রইলো। মৃদু স্বরে নিজের করা কাজের জন্য বাবা, মা আর রেনুকে সরি বললো। রাগের মাথায় এমন ঝাড়ি দেওয়া উচিত হয়নি। খাবার বাড়তে বলেই সে ঘরে চলে এলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। এখন আর কফি খাবে না। ওষুধ খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। ওষুধ খেলেই মাথা ঝিমঝিম করে সারাদিন। কোনোমতে খাবার খেয়েই ঘুম দিবে।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here