চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -০১+২+৩+৪

পাত্র হিসাবে নিজের ভার্সিটির স্যারকে দেখে ভড়কে গেল স্পর্শী। বিমূঢ় দৃষ্টিতেই স্থির হয়ে বসে রইলো সেভাবে। সামনে বসে থাকা ব্যক্তিটির অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। আকার ভঙ্গি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, সেও এই বিষয়ে অবগত ছিল না। অথচ আজ তাদের আকদ, কি অদ্ভুত তাই না? দুইজনের জন্য পরিবেশটা এখন বেশ অস্বস্তিকর। স্পর্শী অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, রুদ্ধদ্বার অবস্থা তার। বিয়ের জন্য যে মানা করবে বা পাত্রের সাথে কথা বলতে চাইবে তারও সুযোগও নেই। কথা পাকাপাকি হয়ে গিয়েছে, এমনকি কাজী সাহেবও চলে এসেছেন। কাগজ-পত্র গুছাচ্ছেন তিনি, মিনিট দুই-একের মাঝেই হয়তো বিয়ে পড়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। স্পর্শী বুঝতে পারছে না সে কি করবে। এই বিয়ে করাটা কি আদৌ ঠিক হচ্ছে? তাও যাকে সে বিন্দুমাত্র পছন্দ করে না? উফ! কি বিশ্রী এক অবস্থা। নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে এখন তার, কেন সে আগে পাত্রের ছবি দেখলো না? তার মা সাহেলা বানু কত করে বলেছিলেন একবার ছবিটা দেখতে, কিন্তু জীদের বসে দেখলো না সে। মা-বাবার পছন্দের উপরই ছেড়ে দিল সব। একবার পাত্রের ছবিটা দেখলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না তাকে। কিন্তু তারও বা দোষ কোথায়? কথা ছিল আজ ছেলে পক্ষের সকলে এসে দেখে আংটি পড়িয়ে চলে যাবে। সেটা ভেবেই স্পর্শী ঠিক করেছিল পাত্রের সাথে কথা-বার্তার পাঠ আজ চুকিয়ে নিবে। কিন্তু ভাগ্য যে প্রথম দেখাতেই তাদের বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিবে তা কে জানতো? স্পর্শী দৃষ্টি নত করলো, থুতনি গিয়ে ঠেকালো চিবুকে। আঁচলটা হাতের মাঝে পুরে হত্যাকাণ্ড চালালো তার উপর, ডান পায়ের বৃদ্ধা আঙুলটি অবিশ্রান্ত ঘষামাজা করতে থাকলো মার্বেল টাইস করা মেঝের উপর। উৎকন্ঠা, সংশয়,অস্বস্তিতে মন-মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়েছে। ভাবতে পারছে না সে আর কিছু।
মিনিট পাঁচেক নিভৃতে গড়িয়ে যেতেই কাজীর কণ্ঠধ্বনি কর্ণধারে এসে বারি খেল। বিয়ে পড়াচ্ছেন তিনি। স্পর্শী নিষ্প্রভ চাহনিতে চারদিক পরোক্ষ করলো। বর ও কনে ব্যতীত সকলের মুখেই শোভনীয় হাসি। স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পুনরায় দৃষ্টি নত করলো। পলক ফেলার ব্যবধানেই তার বিয়েটা হয়ে গেল। হয়ে উঠলো সে নির্বাণ সাইয়্যেদ নামক ব্যক্তিটির স্ত্রী।

_____________

চারদিকে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। টেবিলে উপর জমেছে মিষ্টান্ন বক্সের স্তুপ, তার বা-দিকেই উঁকি মারছে হরেক রকমের ফলসমূহ। বাড়ির কর্ত্রীরা হয়ে উঠেছে ব্যস্ত, রান্নাঘরে চলছে মহাভোজের আয়োজন। নতুন জামাই ও বেয়াইনদের আপ্যায়নে কোন কমতি রাখতে চাচ্ছে না তারা। কর্তারা বসেছে বৈঠকঘরে, বিয়ে-সংসার নিয়ে আলোচনা করছেন নিজেদের মধ্যে। দুইপক্ষের সাম্প্রতিক সম্পর্কে নিবিড়তা আনার ক্ষীণ প্রচেষ্টা।
সোফার এক কর্ণারে আঁটসাঁট হয়ে বসে গুরুজনদের কথা শুনছে নির্বাণ। নিরংশু দৃষ্টি চোখ বোলাচ্ছে চারদিকে। আপন লোকগুলো ব্যতীত সবই অচেনা মুখ। দুই হাত মুঠোয় পুড়ে চেপে বসো সে। চরম অস্বস্তিতে মেজাজ উগ্র হয়ে উঠেছে। অকস্মাৎ হওয়া বিয়েটা কিছুতেই হজম করতে পারছে না সে। উপরন্ত, তার বউ হচ্ছে তারই ছাত্রী। প্রথমে ধরতে না পারলেও কিছু সময়ের ব্যবধানে ঠিকই ধরতে পেরেছিল। কিন্তু ততক্ষণে সম্পূর্ণ বিষয়টাই ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে, পিছ-পা হওয়ার কোন সম্ভাব্যতাই নেই। ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো সে, স্বাদের পেশা তাকে এইভাবে আথান্তরে ফালাবে তা আগে জানলে সে ভুলেও এই পেশায় ঢুকতো না। বিতৃষ্ণায় ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করলো নির্বাণ। পুনরায় নড়ে চড়ে বসলো, ভাল্লাগছে না তার কিছুই।
কিছু প্রহর বিতৃষ্ণায় পরিবাহিত হতেই পাশ থেকে নাহিদ কুনোই দিয়ে নির্বাণের পেটে হালকা গুঁতো মেরে ফিসফিসিয়ে বলে,

— ভাই, তোর কি প্রেশার পড়সে? বাথরুম যাবি?

নাহিদের এহেন কথা নির্বাণ দৃষ্টি চওড়া করে তাকালো। কন্ঠে কঠোরতা মিশিয়ে বলে,

— ফাজলামো করিস আমার সাথে?

নাহিদ অবাক হয়ে বলে, “ফাজলামো কেন করবো? তুই তো কখন ধরে কৈ মাছের মত ছটফট করছিস, তাই ভাবলাম.. ”

নির্বাণ নিচুস্বরে এক ধমক দিয়ে বলে, “তোকে ভাবতে কে বলেছে হ্যাঁ? নিজের ভাবনায় তালা দিয়ে বসে থাক।”

” আমাকে বকা না দিলে তোর পেটের ভাত হজম হয়না? নতুন বর তুই, কই একটু লজ্জা পাবি তা না।”

” তোর কি আমাকে মেয়ে মনে হয়, ষ্টুপিড? এইভাবেই মাথা হ্যাং হয়ে আছে তার উপর তোর বেহুদা প্যাঁচাল। চুপচাপ বস, নাহলে তোর গাল লাল করতে আমার দেরি হবে না।”

কন্ঠে তেজ রেখেই মৃদুস্বরে কথাগুলো বলল নির্বান। নাহিদ ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে নিল, আপনমনে বিরবির করে কিছু একটা বলে চুপ হয়ে গেল সে। নির্বাণ নাহিদের কথা শুনেও না শোনার ভাণ করলো। আপাতত তার ভাবনা অন্য কিছুতে নিহিত।

___________

নিকষকৃষ্ণ আকাশে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে তুলো রাশির দল। তাদের মাঝেই মোহনীয় দ্যুতি ছড়াচ্ছে বৃত্তাকার চাঁদটি। মাধুর্য বাড়াচ্ছে দীর্ঘ রজনীর। এক ফালি মাধুর্যযুক্ত আলো জানালার শিকল ভেদ করে গলিয়ে পড়ছে স্পর্শীর পদতলের নিকট। সে অংশটুকুতেই একমনে তাকিয়ে আছে স্পর্শী। গায়ে জড়ানো এখনো লাল জামদানী শাড়িটি। দেখতে তাকে শান্ত দেখালেও মেজাজ উঠে আছে তুঙ্গে। পাশে অযত্নে পড়ে থাকা মুঠোফোনটি বেজে উঠছে বারংবার। কিন্তু স্পর্শী সেদিকে কোন আগ্রহই প্রকাশ করছে না। সে ব্যস্ত সম্পর্কের সমীকরণ মিলাতে। ঘন্টাখানিক পূর্বেও সব স্বাভাবিক ছিল, অথচ কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই জীবনটা পুরো বদলে গেল তার। অগোছালো হয়ে গেল। বিয়ে নিয়ে প্রচন্ড অস্বস্তি কাজ করছে তার। মায়ের মুখে শুনেছিল, ছেলে পেশাগত শিক্ষক৷ কোন এক ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরেই আছে। কিন্তু সেটা যে তারই ভার্সিটি এবং তারই ডিপার্টমেন্ট হবে সেটা সে ইহকালেও ভাবেনি। বিষয়টা যে কি বিশ্রী হয়ে উঠেছে তা না বললেই নয়। স্পর্শীর এখন প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কেন সে, জীদের বসে না জেনে-শুনে একবারে ছেলেপক্ষের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো? আর বাবা-মাও কি ভালো মত সব খোঁজ খবর নেই? তারা বা কিভাবে পারলো হুট করে বিয়েটা দিয়ে দিতে? ধ্যাৎ!
স্পর্শীর মুঠোফোন পুনরায় বেজে উঠতে স্পর্শী অবশেষে বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুললো। কানের কাছে ফোনটা রাখতেই উচ্চস্বরে কেউ বলে উঠলো,

— ওই হারামি, কই তুই? ফোন ধরস না কেন? কতক্ষণ ধরে ফোন দিতাসে জানোস?

স্পর্শী ক্ষিপ্ত কন্ঠেই বললো, “বাসর ঘরে আছি,আসবি তুই? আয়, দুইজনে একসাথে বাসর রাত পালন করি।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ! কিসব নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা কইতাসোস তুই? ঠিক আছোস তো?”

স্পর্শী তিক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, “আমার কথা রাখ। এতক্ষন ধরে পাগলের মত ফোন দিচ্ছিলি কেন? কে মরসে?”

নিধি জিহ্বার ডগা নিয়ে ঠোঁট দু’টো ভিজিয়ে নিয়ে বলে, “রুদ্রকে কি তুই ব্লক দিয়েছিস? ওই তোর খোঁজে আমাকে আর বাকি সবাইকে ফোন দিয়ে জ্বালিয়ে মারছে রে।”

রুদ্রের কথা শুনে স্পর্শীর চোখমুখ আরও শক্ত হলো, তেজী কন্ঠে বললো, “ওর ফোন তোদের ধরতে বলসে কে? এখনই ওর নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে ফালা।”

“দোস্ত মাথা ঠান্ডা কর। একবার শুনে দেখই না ও কি বলতে চায়।”

“আমি কিছুই শুনতে চাই না। ওর থেকে একদমই না। আর তুই জানোস না ওই কি করসে? তাও ওর হইয়া সুপারিশ করতে লজ্জা করে না? ”

“ও অনুতপ্ত দোস্ত। আমাদের কাছে ফোন দিয়ে অনেক কান্নাকাটি করতাসিল।”

“কান্না করছিল বলে কি কোলে তুলে নিতে হবে ওকে এখন? যতসব! এমনেই জীবনে ক্যাঁচালের অভাব নাই, আবার এইসব। আরেকবার যদি তুই ওর জন্য আমায় ফোন করেছিস তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

কথাটা বলেই খট করে ফোন কেটে দিল স্পর্শী। রাগে তার শরীর তিরতির করে কাঁপছে। ইচ্ছে করছে নিজেকেই নিজেই খুন করতো। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল রুদ্র। একমাত্র ওর জন্যই আজ তার জীবন এত অগোছালো।
স্পর্শী মাথা ফেটে যাচ্ছে রাগে, সে যদি এখন রুদ্রকে সামনে পেত নির্ঘাত খুন করে বসতো। কোন কুলক্ষণ সময়ে যে ওর সাথে রুদ্রের দেখা হয়েছিল কে জানে। নিজের রাগ দমাতে চট জলদি উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। কাবার্ড থেকে একসেট কাপড় নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। শাওয়ার না নেওয়া পর্যন্ত সে স্থির হতে পারবে না।

___________________

সকলের আলোচনার শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো স্পর্শীর তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল এক্সামের পর পরই আয়োজন করে স্পর্শীকে উঠিয়ে দেওয়া হবে। সে সাথে, আজ রাতটা নির্বাণ এই বাসাতেই কাটাবে। কাল সন্ধ্যায় না-হয় চলে যাবে। নির্বাণ এতে আপত্তি জানালেও, মায়ের আদেশে অগত্যা রাজি হতে হলো। এই বাসায় রাত কাটাতে হবে ভেবেই অস্বস্তিটা যেন আরও গাঢ় হলো নির্বাণের।

যেহেতু নির্বাণ ব্যতীত বাকি সকলে চলে যাবে সেহেতু খাবারের আয়োজন দ্রুত করা হলো। খাবারের পর্ব চুকিয়ে সকলে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। এমন সময় নাহিদ নির্বাণের পাশে এসে দাঁড়ায়। ফিসফিসিয়ে বলে, “ভাই প্লিজ দোহাই লাগে, বাসর ঘরে গিয়ে নিজের টিচারগিরি শুরু করে দিস না? তোর ভাষনে ভাবী ঘুমিয়ে পড়লে আমার আর চাচ্চু ডাক শোনা হবে না রে।”

নিবার্ণ অগ্নিময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে, “তুই এখনই এইখান থেকে বের হো। তোর ছাঁয়াও যাতে আমি এই বাসার ত্রিসীমানায় না দেখি।”

” বাহ রে! শ্বশুরবাড়ি ঠিক হওয়া মাত্র ভাইকে অবজ্ঞা করা শুরু করে দিলি? এই তোর মনুষ্যত্ব?”

“মাকে ডাক দিচ্ছি দাঁড়া।”

নাহিদ দ্রুত লাফিয়ে উঠে বলে, “ভাইদের একান্ত ব্যক্তিগত কথার মাঝে মাকে টানিস কেন বেদ্দব? যাচ্ছি তো আমি।”

কথাটা বলেই নাহিদ কেটে পড়লো। নির্বাণ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেল মায়ের কাছে।

_____________

রুমের মধ্যে তখন কৃষ্ণতা ছেঁয়ে আছে। চাঁদের স্থান পরিবর্তন হয়েছে, জানালার ধারে নেই তার অস্তিত্ব। তাই নিজের অস্ত্বিত্ব রক্ষার্থে বারান্দার শিকল গলিয়ে তীব্র প্রচেষ্টা করছে রুমের মেঝেতে হামাগুড়ি খাওয়ার। হালকা বাতাসে জানালার পর্দাগুলো বার বার কেঁপে উঠছে। পরিবেশটা নীরব হলেও, রাতটা মোহনীয়৷ পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে গগনে, বিভূষণ ভালোবাসার স্বাক্ষী হতে।
এরই মাঝে স্পর্শী ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো, হাতের মুঠোয় থাকা তোয়ালেটা চুলের মাঝে গভীরভাবে ডুবিয়ে। মুখ ঢাকা পড়লো তাতে। স্পর্শী হাতরে ওয়াশরুমের লাইট অফ করে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল। চুল মুছা শেষে চোখ তুলে তাকালো উপরে। পুরো রুম আঁধারে আবৃত দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার, বিরবির করে বলল, “রুমের লাইট কে অফ করলো?”
কথা ভেবেই এগিয়ে গেল সুইচ বোর্ডের দিকে। ক্ষণেই বিছানার পাশে কারো পুরুষালী অবয়ব দেখে থমকে যায় সে। ভালো মত পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করল আসলে পুরুষালী অবয়বটির মালিক কে? স্পর্শীর রুমে সচরাচর কেউ আসে না, কাজিনরা বলতেও সব বাচ্চা টাইপ। এক বাবা-চাচা ব্যতীত কোন পুরুষ নেই তাদের বাড়িতে। আর তারা এখন আসবে না স্পর্শী জানে। তাহলে কে তার রুমে? রুমের দরজার দিকে একবার তাকালো স্পর্শী। দরজা ভিতর দিয়ে আটকানো। স্পর্শীর এইবার কেন যেন ভয় হলো। সে অস্ফুটস্বরেই জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
অপর পক্ষ থেকে কোন উত্তর আসলো না। স্পর্শী আবারও একই প্রশ্ন করলো। কিন্তু উত্তর মিললো না, উল্টো এইবার ছায়ামূর্তিটি নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। স্পর্শী এতে ভড়ে উঠলো, লেপ্টে গেল দেয়ালের সাথে। কোন উপায়ন্তর না পেয়ে চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। ছায়ামূর্তিটি হয়তো বুঝে যায় স্পর্শী পরিকল্পনার সম্পর্কে, ক্ষণেই সে দৌড়ে এসে তার বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরে স্পর্শীর মুখ। অচেনা পুরুষের ছোঁয়া পেয়ে ভয়ে সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে পড়লো স্পর্শীর, তীব্র কাঁপন ধরলো শরীরে। হাতের মুঠোয় থাকা তোয়ালেটা লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২

“তোমরা মেয়েরা কি চিল্লানো ছাড়া কিছু পারো না? মান-সম্মান সব আমার এখনই যেত।”

কথাটা বলেই নিবার্ণ অন্ধকারে হাতড়ে লাইটের সুইচে জ্বালালো। অকস্মাৎ আঁধার কেটে যাওয়ায়, কৃত্রিম আলোর স্পর্শ সূঁচের মত বিঁধলো স্পর্শীর অক্ষিকাচে। খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে, বার কয়েক ভারি পল্লব ফেলার পর দৃষ্টি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। অতঃপর নিজের খুব নিকটে নির্বাণকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে উঠলো সে, কণ্ঠনালী দিয়ে বেরিয়ে এলো উদ্ভট শব্দ। তা দেখে নির্বাণ স্পর্শীর মুখ থেকে হাত সরিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল। নির্বাণের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে ছাড়া পেতেই স্পর্শী লম্বা নিঃশ্বাস নিল। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের দিকে, “আপনি আমার রুমে কি করছেন?”

নির্বাণ কন্ঠে কঠোরতা মিশিয়ে বলে, “লুডু খেলছি, খেলবে?”

স্পর্শী শাণিত কন্ঠে বলল, “লাইট অফ করে?”

নির্বাণ প্রত্যুত্তর না করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর দিকে। অতর্কিত নির্বাণের এমন দৃষ্টির মানে বুঝলো না স্পর্শী, ভ্রু যুগল একত্রিত করে তাকালো। অতঃপর নির্বাণের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের দিকে চোখ বুলাতেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো সে, গায়ে ওড়না নেই। স্পর্শী দ্রুত ভেজা চুলগুলো সামনে এনে মেলে দিল। একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল খাটের দিকে। নির্বাণও ততক্ষণে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। স্পর্শী গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিতেই তার চোখ যায় বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নির্বাণের পোশাকগুলোর দিকে। ক্ষণেই সে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের দিকে। তার পড়নে নিজের বাবার পোশাক দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে তার। কৌতূহল দমাতে না পেরে স্বগোতক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— আপনি অন্ধকারে করছিলেনটা কি?

নিবার্ণ অন্যদিকেই মুখটা ঘুরিয়ে রেখে স্পষ্টবাক্যে উত্তর দেয়, “চেঞ্জ করছিলাম।”

“কিন্তু কেন?”

নির্বাণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আজ রাত আমি এইখানেই থাকছি। তাই আন্টি আঙ্কেলের পোশাক দিয়েছিল চেঞ্জ করতে।”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই স্পর্শী বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের দিকে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে, “আপনি থাকবেন মানে? কি করতে?”

নির্বাণ নিজের রাগ সংযত করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “বাসর করতে।”

নির্বাণের কথা শুনে স্পর্শীর মাথায় আগুন ধরে গেল, “কথার কি শ্রী। ছিহ! এই আপনার লজ্জা করলো না নিজের ছাত্রীকে বিয়ে করতে?”

নির্বাণের ত্যাড়া উত্তর, “তোমার লজ্জা করলো না নিজের শিক্ষককে বিয়ে করতে?”

“আমি জানতাম নাকি?”

” আমি মনে হয় কত জানতাম? সবটাই তো হঠাৎ হয়ে গেল।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজা ওপাশ থেকে সাহেলার ডাক শোনা যায়। স্পর্শীকে ডাকছেন তিনি। স্পর্শী নির্বাণের দিকে একপলক তাকিয়ে চুপচাপ দরজা খুলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

__________________

ঘড়ির কাটা এসে থেমেছে একটার ঘরে। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। নির্বাণ বিছানার এক প্রান্তে বসে মোবাইল দেখছে আর স্পর্শী দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে। দুইজনের মাঝেই বেশ অস্বস্তিকর পরিবেশ, জড়তা কাটিয়ে কথা বলে উঠতে পারছে না কেউ। দুইজনই ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছে, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তারা একে অপরের সাথে জুড়ে গিয়েছে। এখন কোন কিছু বলেও লাভ নেই, বিয়েটা তাদের মানতেই হবে। কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা কিন্তু থেকেই যায়।
কিছু প্রহর নিভৃতেই অতিবাহিত হয়ে যায়। অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে নির্বাণ বলে, “তুমি কি চাও?”

অকস্মাৎ নির্বাণ কথা বলে উঠায় স্পর্শী কিঞ্চিৎ ভড়কে যায়। গোলগোল চোখে তাকায় নির্বাণের দিকে, “কি চাই মানে?”

নির্বাণ মুঠোফোনটা বালিশের পাশে রেখে সোজা হয়ে বসে বলে, ” দেখো, আমাদের দু’জনের জন্যই সম্পর্কটা বেশ আগোছালো। পারসোনাল এবং প্রোফেশনাল দুই জায়গাতেই আমাদের বিয়ে প্রভাব ফেলছে। সবটা এখন গুছাতে হলে আমাদের দুইজনকেই কম্প্রোমাইজ করতে হবে। তাই আমি তোমার থেকে জানতে চাইছি তুমি কি সম্পর্কটা আগাতে চাও নাকি ডিভোর্স নিতে চাও?”

স্পর্শী মিনমিনে স্বরে বলে, “ডিভোর্স কেন চাইবো?”

“মেনে নিতে চাইছো?”

স্পর্শী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “বিয়ে যেহেতু হয়েই গিয়েছে, সেহেতু মেনে নেওয়াই শ্রেয়। এমনেও, আমার বিয়েতে অমত ছিল না। তবে..”

সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করলো না স্পর্শী, সংশয়ে দৃষ্টি নত করে নিল। নির্বাণ অর্ধাংশ কথাটুকু বুঝতে পেরে বলে, “আমাকে বর হিসাবে মানতেই সমস্যা হচ্ছে তাই তো?”

“আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন সবটা মেনে নিতে। ”

“আচ্ছা।”

স্পর্শী এইবার ইতস্তত সুরে বলে, “তবে আমি চাই আমাদের বিয়ের বিষয়টা আপাতত গোপন রাখতে। ভার্সিটিতে জানাজানি হলে সমস্যা আছে।”

“সেটা তুমি না বললেও আমি জানি। আর এমনেও আমি আমার পারসোনাল আর প্রোফেশনাল লাইফ আলাদা আলাদা রাখতে চাইছি। আশা করি বুঝবে।”

স্পর্শী মাথা দুলিয়ে বলে, “হুম”

নির্বাণ আর কোন কথা বললো না, চুপচাপ বালিশে মাথা হেলিয়ে শুয়ে পড়লো। স্পর্শী কিছুক্ষণ ইতস্তত করল, নির্বাণের পাশে শুবে কি-না তা নিয়ে দ্বিধার শেষ নেই তার। অস্বস্তি কাজ করছে তার মধ্যে বেশ। সুদীর্ঘ সময় সে আকাশ-কুসুম ভেবে কার্বাড থেকে পাশবালিশ বের করলো। সেটা বিছানার মাঝ বরাবর রেখে লাইট অফ করে কিনার ঘেষে শুয়ে পড়লো। মিনমিনে স্বরে বলল, “ভুলেও এই পাশে আসবেন না। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

_____________

প্রভাতের আলো ফুটেছে ঘন্টাখানেক হলো। মেঘে মেঘে খেলা করছে দুরন্তপনা রোদ্দুর। আকাশে উড়ছে বেড়াচ্ছে চড়ুইপাখির দল, রোদ মাখাচ্ছে গায়ে। নির্জীব শহরটি হয়ে উঠছে ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ। নিত্যদিনের তুলনায় আজ ঘুমটা আগেই ভেঙে গেল স্পর্শীর। না নিজ থেকে নয়, ফোনের কর্কশ ধ্বনিতে। স্পর্শী ঘুমের ঘোরেই হাতড়ে মোবাইলটা খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু পেল না কোথাও। এইদিকে ফোনটা অনাবরত ফোনটা বেজেই চলেছে, অবশেষে বিরক্ত হয়ে চোখ খুললো সে। হঠাৎ মুখের সম্মুখে পুরুষালী চেহেরার কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেল সে। মিনিট কয়েক তার লাগলো বুঝতে আসলে মানুষটি কে? নির্বাণের ঘুমান্ত মুখশ্রীর দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকার পর নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হতেই হকচকিয়ে উঠলো সে। রাতে স্পর্শী যে পাশবালিশ দুইজনের মাঝে বোর্ডার হিসাবে দিয়ে নিবার্ণকে তা অতিক্রম না করার হুমকি দিয়েছিল। তা সে নিজেই ভঙ্গ করে বসে আছে। পাশবালিশের উপর দিয়েই নির্বাণের গায়ে পা উঠিয়ে ফেলেছে স্পর্শী। সেই সাথে, নির্বাণের গা ঘেষেই শুয়ে আছে সে। মুহূর্তেই এক ঝাঁক লজ্জা ভীড় করলো তার মনের দুয়ারে। নির্বাণ জাগার আগেই দ্রুত সরে আসলো সে, ভরাট গাল দু’টিতে ছেঁয়ে আছে রক্তিমা ভাব। সে ভেবেই কূল পাচ্ছে না, তার আগে যদি নির্বাণ জেগে যেত তাহলে কি হতো? একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে সে, নাহলে এই মুখ লুকানোর আর জায়গায় থাকতো না।
পুনরায় ফোন বেজে উঠতেই স্পর্শী আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে থাকে নিজের ফোনটা। অতঃপর স্টাডি টেবিলের উপরে ফোনটা দেখতে পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে যায় সেদিকে, ফোন হাতে নিতেই দেখতে পায় কলটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আসছে। ক্ষণেই স্পর্শীর ভ্রু কুঁচকে আসে, সে ফোন রিসিভ করতেই কেউ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠে,

— এট লাস্ট তুমি ফোনটা ধরেছ স্পর্শী।

সদ্য ঘুম থেকে উঠায় নিম্প্রভ মস্তিষ্ক কন্ঠটা সনাক্ত করতে ব্যর্থ হলো। তাই সে জিজ্ঞেস করলো, “কে?”

“আমি রুদ্র।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩

— এট লাস্ট তুমি ফোনটা ধরেছ স্পর্শী।

সদ্য ঘুম থেকে উঠায় নিম্প্রভ মস্তিষ্ক কন্ঠটা সনাক্ত করতে ব্যর্থ হলো। তাই সে জিজ্ঞেস করলো, “কে?”

“আমি রুদ্র।”

‘রুদ্র’ নামটা কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতেই স্পর্শীর চোখে-মুখে কাঠিন্য ভাবটা ছড়িয়ে যায়। সে কোন প্রকার দ্বিরুক্তি না করে নিভৃতেই লাইনটা কেটে দেয়। রুদ্র নামক ব্যক্তির সাথে আপাতত তার কোন কথা নেই। লাইন কাটার পর, যেই নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফালাতে যাবে ঠিক তখনই পুরো দম নিয়ে ফোনটা বাজতে শুরু করে। স্পর্শী লাইনটা একবার কাটতে গিয়ে কাটলো না, কলটা রিসিভ করলো। ক্ষণেই রুদ্র কাতর কন্ঠে বলে উঠলো, ” প্লিজ স্পর্শী, আমাকে কথা বলার একটু সুযোগ দাও। ফোনটা কেট না। ”

স্পর্শী কন্ঠের তীক্ষ্ণতা প্রখর করে বলে, “আমাকে ফোন করার সাহস আসে কোথা থেকে তোমার, হ্যাঁ?বলি নি আমি,তোমার সাথে কথা বলার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই?”

“জান, শুধু একটা বার দেখা করো আমার সাথে। প্লিজ! আমি সবটা ক্লিয়ার করে দিব। আমাকে বুঝানোর একটা সুযোগ দাও।”

“দেখা করবে কি আবার থাপ্পড় খেতে? আর সকল বোঝা-বুঝির পাঠ আমি আগেই চুকিয়ে নিয়েছি। এখন কিছু বোঝার নেই আমার, তোমার থেকে তো একদমই না। নেক্সট…”

স্পর্শীর কথার মাঝেই রুদ্র ফোড়ন কেটে বলে, “আমি জানি, আমি ভুল করেছি। এর জন্য আমি অনুতপ্ত হয়ে তোমার কাছে ক্ষমাও চাইছি।”

“ক্ষমা মাই ফুট! এইসব নকল অভিনয় অন্যের সামনে করো আমার সামনে নয়। আর যদি তুমি আমার নাম্বারে ফোন করেছ তাহলে আমার দু’মিনিটও লাগবে না, তোমার নামে হ্যারাসমেন্টের ক্যাস দিতে। মাইন্ড ইট!”

রুদ্রকে আর কথা বলার সু্যোগ না দিয়ে স্পর্শী ফোনটা কেটে, নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিল। এই নিয়ে বোধহয় স্পর্শী রুদ্রের মোট পাঁচটি নাম্বার ব্লকে ফালালো। কিন্তু তাও যুবকটির নতুনত্ব নাম্বার থেকে ফোন দেওয়া-দেওয়ির নিশ্চলতা নেই। স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখেই ঘুরে দাঁড়ালো সে, ক্ষণেই নির্বাণকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে ভড়কে গেল সে। নির্বাণ বিছানার উপর সটান হয়ে বসে, ভ্রু যুগল একত্রিত করে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুহূর্তেই তীব্র অস্বস্তি ঘিরে ধরে তাকে। সে সাথে ভাবনায় আসে, “নিবার্ণ কি তার কন্ঠে উঠে গিয়েছে? কিছু কি শুনেছে সে?”

স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাণ ওয়াশরুমে যেতেই স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।

_________________

বাসায় এখন তেমন কোলাহল নেই, গত রাতেই সকলে যে যার বাসায় চলে গিয়েছে। রয়ে গিয়েছে শুধু চার সদস্যের পরিবারটির সাথে নির্বাণ। নিত্যদিনের তুলনায় আজ একটু পূর্বে উঠেই চুলো ধরিয়েছেন সাহেলা, দ্রুত কাজ শেষ করার আশায়। কিন্তু সে গুড়োর বালি, ঘড়ি কাটা নয়টার ঘরে এসে স্থির হতে না হতেই গ্যাস ফুরিয়ে গেল। হায়-হুতাশ বাড়লো তার মনের। ঘরে নতুন জামাই, কখন না কখন উঠে পড়ে। সময় মত নাস্তা সামনে পেশ করতে না পারলে কি এক বিড়ম্বনাতেই না পড়তে হবে তাকে। হায়-হতাশ করতে করতেই তিনি সেই জ্বালেই কোনমতে রান্না শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

স্পর্শী ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং টেবিলের কাছে আসতেই দেখে সকলে খেতে বসে পড়েছে। স্পর্শী আড়চোখে একবার নির্বাণকে দেখলো, সে মিজান সাহেবের পাশের চেয়ারে বসেছে। টুকটাক কথা চলছে দুইজনের মাঝে। অকস্মাৎ নির্বাণ চোখ তুলে তাকাতে দৃষ্টি মিললো তাদের। জড়তা ও সংশয় স্পর্শী দ্রুত দৃষ্টি সরালো, “মা, পার্শিয়া কোথায়?”

সালেহা নির্বাণের প্লেটে খাবারা সাজাতে সাজাতে বলে, ” স্পৃহার কাছেই হবে হয়তো, রাতে ওর সাথেই ছিল।”

“রাতে খেয়েছিল ও?”

সাহেলা স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলেন, “অন্যের হাতে আজ পর্যন্ত খেয়েছে যে জিজ্ঞেস করিস? তুই কালকে ওকে খাবার দেসও নি, সে খায়ও নি।”

“তাই বলে, ওকে জোর করে কিছু খাওয়াবা না? উফফ! কি যে করো না। আমি না থাকলে তো ওকে না খায়িয়ে মারবা।”

সাহেলা কিছু বলতে নিলেও মিজান তাকে চুপ করিয়ে দেন। অতঃপর নেই মৃদুস্বরে স্পর্শীকে বললেন, “তোমার মা আর স্পৃহা অনেক চেষ্টা করেছিল খাওয়ানোর, ও খায়নি। তুমি যাও এখন, ওকে গিয়ে খাবার দিয়ে আসো।”

স্পর্শী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। অতঃপর রান্নাঘরে গিয়ে পার্শিয়ার জন্য বরাদ্দ করা পাত্রে খাবার নিয়ে ছুটলো স্পৃহার রুমের দিকে।

এতক্ষণ ধরে নির্বাণ নীরব দর্শক হয়ে সবটা দেখছিল৷ পার্শিয়াকে তা জানা কৌতূহলী মনে জাগ্রত হলেও তা প্রকাশ করলো না সে। নীরবে খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়।

_____________

নির্বাণ রুমে আসতেই সর্বপ্রথম তার চোখে পড়লো কৃষ্ণ ধূসর রঙ্গে আবৃত লোমশ বিড়ালটির দিকে। সে বিছানার ঠিক সামনে বসেই লেজ দুলিয়ে খাবার খাচ্ছে আর স্পর্শী হাটু মুড়ে বসে অতি আদর সহিত তার লোমশ পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে মিষ্টি হেসে বিরবির করে কি যেন বলছে। বিড়ালটি আদৌ কথা বুঝছে কি-না কে জানে, কিন্তু মিনিট দুই-এক পর পর মৃদুস্বরে ডাকছে আর মাথা হেলিয়ে দিচ্ছে স্পর্শীর দিকে। বিড়ালটির খাওয়া শেষ হতেই স্পর্শী সপ্তপর্ণে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসে। পরক্ষণে দরজার দিকে চোখ যেতে নির্বাণের সাথে তার পুনরায় দৃষ্টি অদলবদল হয়। নির্বাণ বলল, “তুমি বিড়াল পালো?”

স্পর্শী দৃষ্টি নত করে মিনমিনে কন্ঠে বলে, “হ্যাঁ!পার্শিয়া নাম ওর।”

নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তীক্ষ্ণ বলে, “ওকে রুম থেকে বের করো।”

নির্বাণের কথায় স্পর্শী হতবিহ্বল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়, “বের করবো মানে? কেন?”

নির্বাণ কিছু বলতে যাবে তার আগেই পার্শিয়া উচ্চস্বরে ডেকে উঠে আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের দিকে। যার অর্থ, নির্বাণের কথা তার মোটেও পছন্দ হয়নি। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে তাকায় পার্শিয়ার দিকে, মনে মনেই তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে সে। তিক্ত কন্ঠে বলল, “আমার প্রবলেম আছে।”

“আপনার প্রবলেম আছে বলে কি আমাকে ওকে বের করতে হবে? আজব! আপনার প্রবলেম হলে আপনি রুমের বাহিরে যান। ”

“আমি তোমার স্যার ভুলে যেও না। তুমি আমার কথা মানতে বাধ্য।”

স্পর্শী মুখ বাঁকিয়ে বলে, “সেটা ভার্সিটিতে। ভার্সিটির বাহিরে আপনি আমার স্যার নন এবং আমিও আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই। উপরন্তু, এইটা আমার বাসা। এইখানে আমার রাজত্ব বেশি, আপনার না।”

নির্বাণ বিতৃষ্ণায় ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে সূক্ষ্মাগ্র দৃষ্টিতে স্পর্শীর পানে তাকায়। স্পর্শী সে দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বিছানায় বসে পার্শিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। নির্বাণ দ্বিরুক্তি করতে যাবে তার আগেই স্পৃহা এসে বলে, “আপু, একটু এদিক আয় তো। মা তোকে ডাকছে।”

” যা তুই আমি আসছি।”

স্পৃহা যাওয়ার আগে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে ছোট হাসি দিয়ে বলে, “ভাইয়া, আপনার কোন সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবেন। আম্মু বলেছে, আপনার যাতে কোন সমস্যা না হয় সে খেয়াল রাখতে আমায়।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ!”

নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে, “তা সমস্যা আছে একটা। তোমার আপু…..”

কথার মাঝে স্পর্শী ফোড়ন কেটে একটু চেঁচিয়েই বলে, ” এই তোকে না বললাম যেতে। আমার কোন কথাই শুনোস না।”

কথাটা বলেই দ্রুত স্পর্শী উঠে দাঁড়ালো। নির্বাণ বা স্পৃহাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে স্পৃহার কোলে পার্শিয়াকে দিয়ে একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল নিজের সাথে। তবে, যাওয়ার আগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নির্বাণের দিকে তাকাতে ভুললো না।
নির্বাণ তাতে তাচ্ছিল্য হেসে রুমে প্রবেশ করলো। বিছানায় বসে রুমের চার দেয়ালে চোখ বুলাতেই দৃষ্টি স্থির হলো মনকাড়ার মত বেশ কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্যের পোট্রের্টের উপর। রঙ তুলির সংমিশ্রণে খুব নিখুঁত ভাবেই দৃশ্যগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, জীবন্ত লাগছে। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকালো, চিত্রগুলো মোটেও বাজার থেকে কেনা মনে হচ্ছে না। সে ভালোমতো এদিক-সেদিক চোখ বুলাতেই দেখতে পেলো কাঠের আলমারির এক চিপা দিয়ে উঁকি মারছে বেশ কিছু শুভ্র ক্যানভাসের দল, স্টাডি টেবিলের উপর হামাগুড়ি খাচ্ছে কিছু সংখ্যক রঙের টিউব, কোটা, ব্রাশ। নির্বাণ বিরবির করে বলে, “মেয়েটার মধ্যে আর কত রহস্য আছে কে জানে? তবে তার আঁকার হাত সত্যি প্রশংসনীয়।”

_________________

রূপ-রঙ-সৌরভের স্মৃতির বার্তাবাহক ফাল্গুনকে বিদায় জানানো হয়েছে বহু পূর্বেই৷ চৈত্রের রৌদ্রজ্বল রক্তিম প্রভাতের অপার্থিব সৌন্দর্যে শুরু হচ্ছে দিনগুলো। মাধবীলতার মোহ ঘুরে বেড়াচ্ছে অনিলে৷ এমনই এক তপ্ত দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে জাবির শহীদ মিনারের সিড়িতেই আড্ডায় মেতে উঠেছে বন্ধুমহলের সকলে। তবে আজ বন্ধুমহলের আড্ডায় মন নেই একজনের, সে হারিয়ে আছে আপন ভাবনাতে। হঠাৎ পাশ থেকে তার উদ্দেশ্য কেউ বলে উঠে,
“এই স্পর্শী কোন ভাবনাতে ডুবে আছিস? কখন থেকে দেখছি কোন কথাই বলছিস না।”

স্পর্শী নিজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে নিধির উদ্দেশ্যে বলে, “আরেহ না এমনি।”

বিপরীত পাশ থেকে মাহিন বলে, “গত সপ্তাহের একদিনও ভার্সিটি আসোস নি। তার উপর এখন মনমরা হয়ে বসে আছিস। বুঝলাম ভার্সিটি আসিস নি রুদ্রের জন্য। কিন্তু এখন কি মন মরা হয়ে আছিস ওর জন্যই? ”

নিধি মাহিনের মাথায় একটা চাপড় দিয়ে বলে, “রুদ্রের কথা তুলোস কেন হারামি? মরার শখ জাগসে?”

কথায় কথায় মাহিন ও নিধির খুটিনাটি ঝগড়া বেঁধে যেতেই কেয়া আর সামি ওদের দুইজনকে শান্ত হয়ে ব্যস্ত পড়ে। আর স্পর্শী, সে তো এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে প্রবেশ দুয়ার দিয়ে আসতে থাকা কালো গাড়িটির দিকে। দুই ধারের কাঁচ উঠিয়ে রাখা সত্ত্বেও স্পর্শী জানে ভিতরে বসে থাকা মানুষটিকে। মানুষটি বরং কেউ নয় নির্বাণ। শেষ তার দেখা মিলেছিল পরশুদিন, চলে যাওয়ার সময়।
সেদিন রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর স্পর্শী ভুলেও ওই রুমে যায়নি, রাগ জমেছিল তার উপর। অবশ্য, নির্বাণও তার খোঁজ করেনি। তবে, বিকালে নিবার্ণ চলে যাওয়ার সময় সাহেলা এক প্রকার টেনে এনেই স্পর্শীকে তার সম্মুখে দাঁড় করিয়েছিল। দুইজন দুইজনের সামনে দাঁড়ালেও কথা হয়নি কিঞ্চিৎ পরিমাণ, নির্বাণ নীরবেই বিদায় নিয়েছিল তার থেকে। অতঃপর তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ হয়নি।

নির্বাণের গাড়ি পার্কিং এরিয়ার কাছে চলে যেতেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। স্পর্শী এইবার সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নিধি,মাহিন,কেয়া ও সামির দিকে তাকায়। নিধি ও মাহিনের ঝগড়া ইতি টানার পরমুহূর্তেই স্পর্শী কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই বলে উঠে,
“আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”

কথাটা সকলের কর্ণধারে এসে বারি খেতেই সকলে গোলগোল দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর দিকে। নিধি ভরাট কন্ঠে বলে, “তোর কি নামের পাশে বিবাহিত মহিলা ট্যাগ লাগানোর শখ জাগসে? নাকি মেয়াদ উত্তির্ন কিছু খেয়ে টাল হয়ে আছিস, কোনটা?”

সামি বলে, “তুই কি রুদ্রের বিরহে উন্মাদ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিস নাকি? লক্ষণ তো ভালো না।”

স্পর্শী শীতল কন্ঠেই বলে, “বার বার রুদ্রকে এইসবের মাঝে আনা বন্ধ কর। ও আমার লাইফে জাস্ট একটা আবর্জনা ছিল, যা আমি প্রথমে ধরতে না পারলেও পরে পেড়েছি এবং ছুঁড়েও ফেলেছি। এখন সেই চ্যাপ্টার ক্লোসড্। আর রইলো বিয়ের কথা, সত্যি আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস নাহলে মাকে ফোন দে আমার।”

স্পর্শীর কথা শুনে সকলে থম মেরে বসে থাকে। হতবিহ্বল চাহনিতে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। তাদের বোঝা হয়ে গিয়েছে স্পর্শী তাদের সাথে মিথ্যে বলছে না। কিন্তু তাও সব যেন কোথাও জটলা পাঁকিয়ে যাচ্ছে। স্পর্শী নীরবেই তাদের পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। নিজেদের বিস্ময় কাটিয়ে নিধি আর সামি একত্রেই জিজ্ঞেস করে, “কাকে বিয়ে করেছিস তুই? সে কি করে? আর কিভাবে বিয়ে হলো তোদের? মানে কিভাবে কি?”

“আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে তোরা চিনিস।”

কথাটা বলে স্পর্শী থামে। সকলে এইবার বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়, বুঝে উঠার চেষ্টা করে তাদের চেনা-জানা এমন কোন ব্যক্তি আছে যার সাথে স্পর্শী বিয়ে হতে পারে। হাজারটা সমীকরণ মিলিয়েও যখন কারো নিকটেই উত্তর ধরা দিল না তখন তারা স্পর্শীকে ওই ব্যক্তি সন্ক্রান্ত প্রশ্ন করার জন্য উদ্যোগী হলো। কিন্তু সেই সময় কেউ ঝড়ের গতিতে এসে হাজির হলো তাদের সামনে, মুহুর্তেই স্পর্শীর একহাত হাতের মুঠোয় নিয়ে কাতর কন্ঠে বললো,

— অবশেষে তুমি এসেছ।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪

— অবশেষে তুমি এসেছ।

অকস্মাৎ কারো উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই রুদ্রকে দেখে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। সে এক ঝাটকায় নিজের হাত রুদ্রের হাতের মুঠোয় হতে সরিয়ে নিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে, “হোয়াট দ্যা হেল! তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার হাত ধরার?”

রুদ্র নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে বলে, “আর কতদিন এইভাবে রাগ করে থাকবে? অনেক তো হলো৷ এইবার একটা সুযোগ দাও আমাকে, আমার কথা বলার।”

স্পর্শী ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠে, “তোমার কথা শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। চলে যাও এইখান থেকে, আমি কোন সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না।”

রুদ্র এককদম এগিয়ে এসে বলে, “আমিও এইখানে সিনক্রিয়েট করতে আসি নি, শান্তিপূর্ণ ভাবেই কথা মিটমাট করতে এসেছি।”

“সবকিছু তো আগেই মিটমাট হয়ে গিয়েছে, এখন নতুন করে কি মিটমাট করবে?”

“তুমি প্লিজ একটু ওদিকটায় চল, আমরা আলাদাভাবে কথা বলি।”

স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “ওদিকটায় কেন? নীরব জায়গায় দেখে আবার….”

রুদ্র কথার মাঝেই ফোড়ন কেটে বলে, “স্পর্শী প্লিজ! মানছি আমি ভুল করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওমন নই। আমি ইচ্ছে করে সেসব করিনি।”

হঠাৎ কেয়া বলে উঠে, “আমাদের কি আপনার আহাম্মক মনে হয়? আপনি বলবেন আপনি ওমন নই, এমন নই। আর আমরাও নাচতে নাচতে তা মেনে নিব?”

কেয়ার সাথে তাল মিলিয়ে সামি বলে, “আপনাকে আমাদের চেনা হয়ে গিয়েছে ভাইয়া। তাই দয়া করে এই থার্ডক্লাশ এক্টিং আমাদের সামনে করতে আসবেন না।”

রুদ্র বলে, “তোমরা আমায় ভুল বুঝছো।”

স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তাহলে ঠিকটা বুঝছে কে?”

“স্পর্শী প্লিজ, একটা সুযোগ দাও কথা বলার।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর না করে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায়। নিধি পাশ থেকে এগিয়ে এসে স্পর্শীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, “একবার গিয়ে দেখ কি বলতে চায়। তুই সাথে না যাওয়া পর্যন্ত এই ব্যাটার ঘ্যানঘ্যানানি থামতো না। আর আমরা তো আশেপাশেই আছি। এইবার উল্টাপাল্টা কিছু করলে গণধোলাই খাইয়েই ছাড়বো, চিন্তা করিস না। ”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়, নিঃশব্দে হেটে যায় সামনে। তা দেখে হাসি ফুটে উঠে রুদ্রের মুখে।

_________________

শহীদ মিনার থেকে কিছুটা দূরতেই নিম গাছের অধস্তনে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আর স্পর্শী। আশেপাশে তেমন একটা মানুষজনের আসা যাওয়া নেই। নীরব এবং কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। মৃদু বাতাসের সাথে ভাসছে শালিকের মিষ্ট কলধ্বনি। পরিবেশটা মন ভালো করার মত হলেও রুদ্রের উপস্থিতির জন্য সবটাই তিক্ততায় পরিপূর্ণ লাগছে স্পর্শীর। এই মানুষটার ছাঁয়াও এখন সহ্য হয়না তার। তীব্র রাগ হয়। রুদ্রের প্রতি নয় বরং নিজের প্রতি এবং নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি। কোন আক্কেলে সে এই মানুষটির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল কে জানে? এখন তো ভাবতেও তার গা ঘিন ঘিন করে এমন এক নিকৃষ্ট মানুষের সাথে সে কখনো কোন সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। রাগে,ঘৃণায় স্পর্শী অন্য পার্শ্বে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। কিছু প্রহর এইভাবেই নীরবে অতিবাহিত হয়ে যায়। অবশেষে নীরবতা ঠেলে রুদ্র বলে, ” সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওইসব নিজের ইচ্ছায় করিনি।”

স্পর্শী অন্যদিকে মুখ করে তিক্ত কন্ঠে বলে, ” এতসব করেও বলছো তুমি কোনকিছু নিজের ইচ্ছায় করো নি? লাইক সিরিয়াসলি! আহাম্মক মনে হয় আমাকে?”

“দেখ স্পর্শী, ওই বিষয়টা এখন বিএফ-জিএফের মাঝে কমন। আমার বেশির ভাগ ফ্রেন্ডরাই তাদের জিএফদের নিয়ে প্রায়শই নীরব জায়গায় যায় একান্ত সময় কাটাতে। একমাত্র আমিই এইসবে মধ্যে ছিলাম না, তুমি ওসব পছন্দ করো না বলে। আর এই বিষয় নিয়েই আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারা শুরু করে। আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। তাই সেদিন জীদের বসেই তোমাকে আমি সে প্রস্তাব দিয়ে বসি কিন্তু পরে বুঝতে পারি আমি কত বড় ভুল করেছি।”

স্পর্শী তাচ্ছল্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তুমি আমাকে শুধু প্রস্তাব নয় বরং জোরপূর্বক নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছ। আমার ভাগ্য ভালো সেদিন তোমার বলা জায়গায় আমি দেখা করতে রাজি হয়নি। কোলাহলপূর্ণ জায়গায় দেখা করেছিলাম বিধায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম৷ নাহলে রাস্তার কুকুরের খাবার হতে আমার সময় লাগতো না।”

— আমি মানছি, আমার দ্বারা অনেক বড় ভুল হয়েছে। আর এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থীও। আমি বন্ধুদের কথ..

রুদ্রের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই স্পর্শী বলে, “কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না, বুঝলে। নিজের স্বার্থ এখনো হাসিল হয়নি বলেই এই ক্ষমাপ্রার্থীর নাটক হচ্ছে তাই তো? তোমার ভালো মানুষি মুখোশ বহু পূর্বেই আমার নিকট খুলে পড়েছে, তাই অভিনয় করে লাভ নেই।”

“তোমার মনে হচ্ছে না তুমি এইবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছো? ভুল করেছি, মাফও চাচ্ছি৷ তাহলে খামাখা কথা কেন বাড়াচ্ছো?”

“কথা আমি না তুমি বাড়াচ্ছো৷ আমি আমাদের সম্পর্কের ইতি অনেক আগেই টেনেছি, কিন্তু তুমি মানতে চাইছো না। উল্টো বারংবার আমাকে উত্ত্যক্ত করছো।”

রুদ্র এককদম এগিয়ে এসে বলে, “তুমি আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো।”

স্পর্শী দ্রুত কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে, “ভুলেও কাছে আসার চেষ্টা করবে না। এইবার অসভ্যতামি করলে কিন্তু শুধু থাপ্পড় না, কপালে অনেক কিছুই জুটবে মনে রেখ।”

“তুমি কিন্তু এখন বেশি বেশি করছো। সেই বিষয়টা অনেক কমন। এমন অহরহ হচ্ছেই, আমিও সেরকমই একটা ইচ্ছা পোষন করেছি এতে এত রিয়েক্ট করার কি আছে?”

” এত ইচ্ছা থাকলে কিছু টাকা রাস্তায় ফালালেই নিজের সকল ইচ্ছা,কামনা পূরণ করতে পারবে৷ খামাখা কুকুরের মত আমার পিছে ঘুরছো কেন? আমি মোটেও কোন তুচ্ছ জিনিস নই। শেষবারের মত বলছি, আমার থেকে দূরে থাকো।”

স্পর্শী তেজী কন্ঠের বুলি শুনে রুদ্রের কান গরম হয়ে যায়। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী তাচ্ছিল্যে সুরে বলে, “ভাগ্যিস! তোমার সাথে আমি সিরিয়াস রিলেশনশিপে যায়নি অন্যথায় কান্না ব্যতীত ভাগ্যে আমার কিছুই জুটতো না।”

স্পর্শী কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে রুদ্র ওর হাত টেনে ধরে। স্পর্শীর রাগ এইবার সকল সীমা পেরিয়ে যায়। সে অবিলম্বে নিজের হাত ছাড়িয়ে তীব্র গতিতে রুদ্রের গালে চড় বসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই পরিবেশটা নিস্তব্ধতায় তলিয়ে যায়, নত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুদ্র৷ রক্তিম হয়ে আসা চোখে যেন অগ্নির বর্ষণ দেখা দিচ্ছে। চারদিকের নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই স্পর্শীর তীব্র কন্ঠের ঝংকারে তা দৌড়ে পালায়,

— আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহসিকতা আর দেখিও না। আজ শুধু থাপ্পড় মেরেছি কিন্তু পরেরবার একদম হাতটাই ভেঙে দিব।

রুদ্র অগ্নিমূর্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, “কাজটা তুই ঠিক করিসনি। ভালো ভাবে দুই-একটা কথা কি বলেছি, পেয়ে বসেছিস একদম। আরেহ, তোর মত মেয়ের দিকে তো রুদ্র তাকিয়ে দেখে না। নেহাৎ ফ্রেন্ডের সাথে বাজি ধরেছিলাম বলে এতদিন সহ্য করেছি। নাহলে তোর মত মেয়ের সাথে আমার যায় নাকি? কিসের দেমাগ এত তোর? না আছে চেহেরা, না আছে গুণ। পিস অফ গার্বেজ!”

স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ পিছন থেকে বলে উঠে,

” কি হচ্ছে এইখানে?”

কারো ভরাট কন্ঠ শুনে রুদ্র ও স্পর্শী পিছনে ঘুরে তাকায়। আগন্তুকটিকে দেখে স্পর্শী ভিতরে ভিতরে বিচলিত হলেও বহির্ভাগে তা প্রকাশ করে না। স্থির থাকে। কিন্তু রুদ্র কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সে আমতা-আমতা করে বলে, ” নির্বাণ স্যার, আপনি!”

নির্বাণ দুই কদম এগিয়ে এসে গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে বলে, “হুম? কোন সমস্যা?”

রুদ্র কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলে, “না-তো।”

নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে, “এইখানে কি করছো তোমরা দুইজন? কিছু কি হয়েছে?”

স্পর্শী মুখ না খুললেও রুদ্র বিনয়ী সুরে বলে, “না স্যার কিছু হয়নি। আমরা তো এইভাবেই টুকটাক কিছু কথা বলছিলাম। গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।”

নির্বাণ প্যান্টের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে বলে, “আচ্ছা। এখন ক্লাসে যাও, এইসময় এইদিকটা নিরাপদ না।”

“জি স্যার।” কথাটা বলেই রুদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে চলে আসে। পুরো ক্যামেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টই অবগত নির্বাণের রাগ সম্পর্কে। নির্বাণের আগমনে বেশি দিন নাহলেও তার ভীতি সকলের মধ্যেই কম-বেশি আছে। প্রচন্ড কঠোর ব্যক্তিত্ব তার। তার প্রত্যেক কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয় স্টুডেন্টদের, সামান্যটুকু ভুল তার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। যার দরুন, সকল স্টুডেন্টদের নিকট সে ‘হিটলার স্যার’ নামে পরিচিত। বিষয়টা রুদ্রেরও অজানা নয়। সে প্রায় কয়েকবারই নির্বাণের কাছে শাস্তি পেয়েছে এবং বেশ ভুগেছেও। আর কোনরকম ভোগান্তিতে পড়তে চায় না সে, তাই দ্রুত কেটে পড়ে।

রুদ্র চলে যেতেই নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকায়। স্পর্শী তখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার নত। নির্বাণ গলা ঝেড়ে বলে, “ঠিক আছে সব?”

স্পর্শী মাথা হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে, “জি স্যার!”

“আর ইউ সিউর?”

স্পর্শী এইবার দৃষ্টি তুলে তাকায়, ম্লান মুখে বলে, “ইয়েস!”

নির্বাণ কিছু না বলে নীরব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে স্পর্শীকে। স্পর্শীর তাতে একটু অস্বস্তি হলেও পরবর্তীতে তার মস্তিষ্কে অন্য চিন্তার দল এসে হানা দেয়। ক্ষণেই সে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। অকস্মাৎ তার কি হলো কে জানে, সে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে,

— আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছু নয়। আ…..

স্পর্শীকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে নির্বাণ বলে উঠে, “কিছু বলার প্রয়োজন নেই। বিশ্বাস আছে আমার।”

দুই বাক্যের এই ছোট সংলাপে নিগূঢ় মাধুর্য খুঁজে পেল স্পর্শী। যা মুহূর্তেই তাকে বাক্যহারা করে দিল, বাধ্য করলো থমকাতে। নিবার্ণ বা হাত উঠিয়ে একবার ঘড়ির টাইম দেখে বললো, “ক্লাসের টাইম হচ্ছে তোমার, ক্লাসে যাও।”

কথাটা বলেই নির্বাণ হাঁটা দেয় উল্টো পথে। স্পর্শী সেদিকেই সীমান্তহীন বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে শ্যাম পুরুষটিকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here