চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -০৫+৬+৭+৮

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৫

হিম বাতাসে নিমজ্জিত পরিবেশ। সোনালী রোদ্দুরের ছটা খেলা করছে আন্তরীক্ষের আঁকে-বাঁকে। দাঁড় কাকের দল বসে আছে বটমূলে বিপরীতমুখী বৃক্ষে, খাবারের অন্বেষণ চালাচ্ছে বহুক্ষণ ধরে। মাঝে মধ্যে তীর্যক দৃষ্টি গিয়ে ঠেকছে বটমূলের নিচে অবস্থান করা বন্ধুমহলের দিকে। সকলে মগ্ন স্পর্শীতে, তীব্র মনোযোগ দিয়ে শুনছে কিছু প্রহর পূর্বের ঘটনা। সম্পূর্ণ ঘটনা খোলাসার পর সকলের দৃষ্টি পরিপূর্ণ হয় রোষানলে। ক্রোধে ফেটে পড়ছে তারা। এত ভালোবাসা, এত পাগলামো সবই অভিনয় মাত্র? কি নিখুঁত অভিনয়? মানুষ এতটা নিম্ন,নিকৃষ্ট কিভাবে হয়? স্পর্শীকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত ভাষাও কেউ খুঁজে পাচ্ছে না, খেই হারিয়েছে সকলেই। কি-বা সান্ত্বনা দিবে তারা, সান্ত্বনা দেওয়ার আদৌ কিছু আছে কি? সামি আর নিধি তাকিয়ে আছে স্পর্শীর মুখপানে, বুঝার চেষ্টা করছে তার ভিতরকার অবস্থা। কিন্তু স্পর্শী নির্বিকার বসে আছে, মুখভঙ্গিতে নেই কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যার দরুন তার ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে জানা দুরূহ। সামি অবশেষে বলে, “তুই ঠিক আছিস?”

স্পর্শী মন্থর কন্ঠে বলে, “আমার খারাপ থাকার কথা নাকি? আজিব!”

কেয়া বলে, “সেটা না। কিন্তু..”

কেয়াকে বলতে না দিয়ে স্পর্শী বলে উঠে, “ওর প্রতি শুধু আমার ভালোলাগা ছিল, ভালোবাসা না। তাই সব জানার পরও আমার তেমন কষ্ট হচ্ছে না। বরং ঘৃণা হচ্ছে এমন একটা মানুষের সাথে আমি দুই মাস ছিলাম।”

নিধি পাংগু মুখে বলে, “কি নিদারুণ অভিনয়ই না করলো? আমি তো সত্যি ভেবে বসেছিলাম ব্যাটা তোকে সত্যি পাগলের মত ভালোবাসে। তাই তো আমরা তোকে রাজি করালাম এই সম্পর্কে যেতে। কি ভুলটাই না করলাম রে।”

মাহিন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “শুধু তুই না আমরা সবাই ভেবেছিলাম। ভালোই অভিনয় জানে ব্যাটা৷ কয়েকটা জুতার অস্কার প্রাপ্য তার।”

স্পর্শী হেসে বলে, “জানিস! আমার বাবা সবসময় একটা কথা বলে, কাউকে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে বিশ্বাস করতে নেই৷ ভালোবাসতেও নেই। অন্যথায় দিনশেষে কান্না ব্যতীত ভাগ্যে কিছু জুটে না। সে কথা মেনে চলেছিলাম বিধায় হয়তো আজ আমি ভালো আছি।”

কেয়া বলে, “কিন্তু আমার মতে কাউকে ভালোবাসা বা বিশ্বাস করাই বোকামি। সব ছেলেরাই এক। ধূর্ত ও প্রতারক। এইসবের পর আমি কাউকে সর্বস্ব দিয়ে কেন, নিজের এক শতাংশ দিয়েও ভালোবাসতে বা বিশ্বাস করতে রাজি নই। একাই কাটিয়ে দিব পুরো জীবন, দরকার নেই কারো।”

কেয়ার কথায় মাহিন রেগে গিয়ে বলে, “সব ছেলেরা এক না বুঝলি। দুই-একজনের জন্য তুই সবাইকে একই শ্রেণীতে ফেলতে পারিস না। ভুলে যাস না, তোর বাবা-ভাইও কিন্তু পুরুষই। এখন বল তারা কি এমন? নাকি আমরা এমন?”

সামি বলে, “কেয়া শুন! এই কথাগুলো তোর মস্তিষ্কের, মনের না। ভালোবাসাহীন জীবন হয় না।আর ভালোবাসা বলে কহেও হয় না। যখন হওয়ার এমনেই হয়ে যায়, কোন বাঁধা-নিষেধ সে তখন মানে না। তুই কাউকে ভালোবাসলে বুঝবি।”

নিধি বলে, ” সবসময় কি আর মস্তিষ্কের জোর চলে? ভালোবাসলে অবুঝ মনের নিকট এক না এক সময় নিজের সর্বস্ব হারাতেই হয়।”

স্পর্শী কিছু না বলে সকলের কথা মন দিয়েই শুনলো। আনমনে ভাবলো, “আসলেই কি ভালোবাসলে নিজের সর্বস্ব হারাতে হয়?”

ক্ষণে কেয়া মুখ ছোট করে বলে, ” আচ্ছা বাবা সরি। আমি কথাটা ওভাবে বলতে চাই নি।”

স্পর্শী বলে, “আচ্ছা তোরা থামবি এইবার?”

অতঃপর একটু সময় নীরব থেকে ব্যঙ্গ করে বলে, “ভাগ্যিস! রুদ্রের প্রতি আমার মুগ্ধতা আগেই কেটেছিল, নাহলে কি যে হতো।”

মাহিন স্পর্শীর মনোভাব বুঝতে পেরে হেসে বলে, “কি আর হতো? পাগল গরাদে সিট বুক হতো।”

কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠে। হঠাৎ নিধি বলে বলে, “এই তুই সত্যি বিয়ে করেছিস?”

স্পর্শী নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “আর কতবার বলবো?”

“জামাই কেডা তাইলে? নাম কো?”

স্পর্শী এক মূহুর্ত চুপ থেকে বলে, “নাম বা পরিচয় দিয়ে তোর কাজ কি? আপাতত এতটুকু জেনে রাখ তোরা তাকে চিনিস।”

সামি বলে, “এইভাবে আমাদের ঝুলিয়ে রাখা কি ঠিক?”

স্পর্শী বলে, “অবশ্যই ঠিক। তোদের ঝুলিয়ে রাখা আমার বন্ধুগত অধিকার।”

মাহিন বলে, “বুঝছি, জামাই বুইড়া বা ভুড়িওয়ালা টাকলা ব্যাটা। তাই তুই বলতে চাস না।”

মাহিনের কথা শুনে স্পর্শী রোষানল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “বাজে বকবি না একদম।”

“বাব্বাহ! জামাই এর জন্য দেখি এখনই দরদ উতলাইয়া পড়তাসে। কি প্রেম! উহুউ!”

স্পর্শী মাহিনের পিঠ ধুম করে কিল বসিয়ে দেয়। মাহিন ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্পর্শী বলে উঠে,
“এই সম্পর্কে আমি কথা বলতে চাই না। সময় হোক জেনে যাবি আমার জামাই কে।”

________________

সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে এক মুঠো রক্তিমা ছড়িয়ে গেল নীলাভ অম্বরের বুকে। পাখিরা ব্যস্ত হলো নিজ নীড়ে ফিরতে। আযানের পরপরই যান্ত্রিক শহর আবৃত হলো কৃত্রিম আলোয়, পরিবেশ নিমজ্জিত হলো নিরালোকে।
নির্বাণ এক কাপ কফি নিয়ে বসলো ল্যাপটপ খুলে, ওয়েবসাইট ঘাটছে কোন এক কারণে। এমন সময় রুমে নাহিদের আর্বিভাব হয়৷ সদ্য ঘুম থেকে উঠার ফলে চুলগুলো বেশ এলোমেলো, চোখের পাতা জুড়ে এখনো ঘুম ঘুম ভাব বিদ্যমান। নাহিদ নিঃশব্দে গিয়ে বসে পড়লো নির্বাণের পাশে৷ নির্বাণ ভ্রু কুঞ্চিত করে পাশ ফিরে তাকানোর পরমুহূর্তেই নাহিদ নির্বাণের হাত থেকে নিয়ে কফি খাওয়া শুরু করে। তৃপ্তি নিয়ে বলে, “আহা! কি শান্তি।”

নির্বাণ মুখ ঘুচে বলে, “মুখ ধুয়েছিস তুই?”

নাহিদ একটা হামি তুলে বলে, “ধুবো নে। এত তাড়া কিসের?”

“মুখ না ধুয়ে তুই আমার কফিতে মুখ দিলি কোন সাহসে? এখনই বের হো আমার রুম থেকে বলছি। খাচ্চোর একটা!”

নাহিদ মন্থর কন্ঠে বলে, ” মুখ না ধুয়ে কফিতে মুখ দিয়েছি বলে আমাকে এইভাবে বলতে পারলি? ভাই নামে কলঙ্ক তুই।”

নির্বাণ মুখ বিকৃতি করে বলে, “তোর মত নোংরা মানুষের ভাই হওয়া চেয়ে কলঙ্ক হওয়া ভালো। কফির মগটাই আমার এখন চেঞ্জ করতে হবে। ধ্যাৎ!”

নাহিদ দাঁত চিবিয়ে বলে, “দোয়া দিলাম, তোর বউ যাতে আমার চেয়েও ডাবল নোংরা হয়। তোর জীবনটা যাতে নোংরার সাগরে ভাসিয়ে দেয়। শালা শুচিবাই একটা!”

নির্বাণ তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাতেই নাহিদ দাঁত কেলিয়ে বলে, “বউ থেকে মনে পড়লো আমার ভাবী কেমন আছে রে? তোদের প্রেমালাপ কত দূর?”

নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না, নিজের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে মনোযোগী হলো। তা দেখে নাহিদ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তোর আদৌ ভাবীর সাথে কথা হয় তো?”

নির্বাণের সরল স্বীকারোক্তি, “না!”

“সর্বনাশ! বিয়ের এক সপ্তাহ হয়ে গেল এখনো তুই কথা বলা শুরু করিসনি? দুইজনে কি বিবাহিত ব্যাচেলর হওয়ার পণ নিয়েছিস? ”

নির্বাণ ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায় নাহিদের দিকে, “ফাজলামো করবি না।”

“তুই ফোন দিস না কেন ভাবীকে? প্রেমালাপ এখন থেকে শুরু করবি না তো কি আমার নাতি-নাতনি জন্ম নেওয়ার পর করবি? একটু তো রোমান্টিক হো ভাই, নাইলে ভাবী তোকে নিরামিষ ভাববে।”

“হোস্টেলে থেকে এই শিখছিস? মাকে বলে তোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”

“ভাইদের গোপনীয় কথার মাঝে মাকে টানিস কেন হ্যাঁ? লজ্জা করে না এই বয়সে সারাক্ষণ মা,মা করতে?”

“ঠাডিয়ে দিব এক। বেদ্দব একটা!”

নাহিদ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে, “ভালো কথার দাম নাই। সময় থাকতে আমার থেকে টিপস নে, নাইলে কপালে বউয়ের সোহাগ জুটতো না।”

নির্বাণ এইবার চেঁচিয়ে উঠে, “মা!!!”

নাহিদ এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আরেহ ভাই যাচ্ছি তো। মাকে ডাকস কে?”

কথাটা বলে কফির কাপটা নির্বাণের পাশে রেখে রুম থেকে চলে যায়। পিছন থেকে নির্বাণ চেঁচিয়ে বলে, “কফির কাপ সাথে নিয়ে যা। এই কফি এখন কে খাবে?”

_______________

পার্শিয়াকে কোলে মাঝে নিয়ে স্পর্শী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আনমনে কি যেন ভাবছে। হঠাৎ পার্শিয়া মৃদুস্বরে ডেকে উঠতে স্পর্শীর ধ্যান ভাঙ্গে। সে পার্শিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “কি হয়েছে?”

পার্শিয়া প্রত্যুত্তরে আলতো করে মাথাটা ঘেষে দেয় স্পর্শীর বা পার্শ্বের বাহুদ্বয়ে, আদুরে সুরে ডেকে উঠে কয়েকবার। স্পর্শী তা দেখে হালকা হেসে পার্শিয়ার কৃষ্ণ-ধূসর লোমশের মাঝে হাত গলিয়ে দেয়, মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “দিন দিন বড্ড আহ্লাদী হয়ে যাচ্ছো।”
পার্শিয়া কথাটা বুঝলো কি-না কে জানে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার আদুরে সুরে ডেকে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই অতিক্রম হতে স্পর্শী আনমনে বলে, ” “ভালোবাসা বলতে কি কিছু আছে? আমি কি সত্যি কখনো কাউকে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে ভালোবাসতে পারবো? আদৌ কি সম্ভব?”
স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “রুদ্রের প্রতি নিছক আমার অনুভূতিগুলো ফিকে ছিল, তাই এইবারের ধাক্কা সহ্য করে যেতে পেরেছি৷ কিন্তু জীবনের বাকি মোড়ে কি পারবো? নির্বাণের স্যারের সাথেও তো আমার সম্পর্ক পুরো আগোছালো। একে গোছাবো কিভাবে? এই অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের পরিনতি কি? উফফ! জীবনটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল কেন? ভাল্লাগে না।”

হঠাৎ স্পর্শীর মুঠোফোন বেজে উঠতে সে আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। সে পার্শিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে ফোন হাতে নেয়, স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার প্রদর্শিত হতে দেখে ক্ষণেই তার ভ্রু কুঁচকে আসে। ফোন রিসিভ করে, “আসসালামু আলাইকুম! কে বলছেন?”

ওপরপাশ থেকে উত্তর না আসায় স্পর্শী বেশ কয়েকবার একই কথা পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু তাও কোন প্রত্যুত্তর না পাওয়ায় স্পর্শীর অভিব্যক্তি বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সে ঈষৎ মেজাজ দেখিয়ে বলে, ” আজিব তো! চুপ থাকার জন্য ফোন দিয়েছেন নাকি? কথা বলেন না ক…”

কথাটি শেষ হওয়ার পূর্বেই ফোনটা কেটে যায়। স্পর্শী এক রাশ বিরক্তি নিয়ে মুঠোফোনটির দিকে তাকায়। কে ফোন করেছিল কে জানে?

______________

রৌদ্রজ্বল দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীর শৈথিল্য করতে
ক্লাসরুমের ফ্যানের নিচে বসে আছে অনেকেই। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে গল্প করতে মশগুল, তো কেউ আবার আগতপ্রায় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান নিয়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হওয়া সুবাদে অনুষ্ঠানের অর্ধাংশ দায়িত্ব এসে পড়েছে তাদের উপর। দায়িত্ব নিয়ে কারো আক্ষেপ নাহলেও আক্ষেপটা হচ্ছে গিয়ে অন্যকিছুতে।

“ভাই, আর কাউকে পাইলো না স্যার? অনুষ্ঠানটার দেখা-শোনার দায়িত্ব হিটলার স্যারকেই দিতে হলো?”

হায়-হুতাশ করতে করতে কথাটি বললো মাহিন৷ কেয়া মুখ ছোট করে বলে, “সাথে লেডি হিটলারও তো আছে। এইবার কাজে কোন ভুল হলে ডাইরেক্ট ইন্না-লিল্লাহ।”

নিধি পাংশু মুখে বলে, “কত ভালো ভালো টিচাররা বদলি হয়ে যায় বা ভালো জব পেয়ে অন্য কোথাও চলে যায়। এরা যায় কেন ভাই? কই ভার্সিটি লাইফে একটু চিল করুম তানা। নির্বাণ স্যার আর তাপসি ম্যামের অত্যাচারে জীবনটাই কয়লা। কোন দুঃখে এইখানে মরতে আইসিলাম আমি?”

স্পর্শী একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “থামবি তোরা?”

নিধি বলে, “এখন কি নিজের দুঃখও প্রকাশ করতে পারুম না তোর লিজ্ঞা? আর তুই এমন মুখ বানাচ্ছিস কেন যে তোর প্রিয় স্যারের নামে কিছু কইতাসি? দুইজনই তো তোর চরম অপছন্দের। স্পেশালি নির্বাণ স্যার, সে তো তোর দুই চোখের বিষ। দেখতেই পারোস না একদম।”

স্পর্শী কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে কেউ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে, “কে কার চোখের বিষ আর কে কাকে দেখতে পারে না শুনি?”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৬

“কে কার চোখের বিষ আর কে কাকে দেখতে পারে না শুনি?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই সকলে পিছন ফিরে, দৃষ্টির সম্মুখে নির্বাণকে দেখেমাত্র ভড়কে উঠে। নিজেদের বিস্ময় সামলে তারা কোনমতে তড়িঘড়ি করে নির্দিষ্ট স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। স্পর্শীও উঠে দাঁড়ায়, বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নির্বাণের দিকে। এই মূহুর্তে সে নির্বাণকে এইখানে আসা করেনি। আশঙ্কার মাঝে আছে সকলেই, নির্বাণ কোথা থেকে কতটুকু শুনেছে কে জানে? যদি সবটাই শুনে থাকে? ভয়ে সকলের জবুথবু অবস্থা প্রায়।
নির্বাণ একপলক সকলের দিকে তাকিয়ে নিধির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়, “বল! কি যেন বলছিলে? কে কার চোখের বিষ? ”

নিধি অস্ফুটস্বরে বলে, “ক..কেউ না তো স্যার, এমনি বলছিলাম আমি।”

কথাটা বলে নিধি কিঞ্চিৎ হাসার করে। পরক্ষণেই নির্বাণের অভিব্যক্তি দৃঢ় হয়ে আসে। সে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় নিধির দিকে। নিরংশু কন্ঠে বলে, “অহ আচ্ছা।”

কেউ আর প্রত্যুত্তর করলো না, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। নির্বাণ এইবার বোর্ডের সামনে যায়, মাইক হাতে নিয়ে কয়েকটা ফাঁকা বারি দেয় তার উপর। পরমুহূর্তেই সম্পূর্ণ ক্লাসের মনোযোগ নির্বাণের উপর এসে স্থির হতেই সে গলা পরিষ্কার করে আগতপ্রায় অনুষ্ঠান সম্পর্কিত ধারণা ও নির্দেশনা দিয়ে বলে,
“অনুষ্ঠান যেহেতু অতি নিকটে সেহেতু তোমাদের মধ্যে কাজগুলো আমি এখনই ভাগ করে দিচ্ছি। ভালো ভাবে কাজগুলো বুঝে নিবে। আমি কিন্তু কোন ধরণের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবো না। তাই সাবধান! মন দিয়ে কাজ করবে, কোন প্রকার হেলা করবে না।”

সকলে একপ্রকার ভয়েই মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। এরই মাঝে তাপসি এসে হাজির হয় রুমে। সে এবং নির্বাণ পরস্পরের মাঝে কাজের বিষয়টা আলোচনা করে, কয়েকটা দল গঠন করে তাদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়। তাপসি অন্য এক গ্রুপকে বুঝাতে ব্যস্ত হলে নির্বাণ স্পর্শীদের কাছে এসে ওদের উদ্দেশ্যে বলে, “তোমাদের ব্যাক স্টেজের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সেখানের সবকিছু তোমরা সামলাবে। আর এই অনুষ্ঠানে কে কি করছে তার সম্পূর্ণ লিস্ট আমাকে আজকে সন্ধ্যার মধ্যে দিবে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”

স্পর্শীরা স্মিত হেসেই সম্মতি জানায়। কেন না, এইখানে কাজ করতে ইচ্ছুক না-হলেও কিছু করার নেই। তারা বাধ্য নির্বাণের কথা শুনতে।

_________________

সায়াহ্নের শেষ প্রহর। পুঞ্জিভূত মেঘের আড়ালে রক্তিমা আকাশে হরিদ্রা সূর্যটির প্রায় ডুবি ডুবি অবস্থা। বাতাসে তখনও তপ্ততা বিরাজমান, গরম পড়েছে বেশ। মাহিন পকেট থেকে রুম বের করে কপালের ঘামটুকু মুছলো। নীরবে অডিটোরিয়ামের এক কিনারে বসে পুনরায় নিজের করা লিস্টের দিকে ভালোমত চোখ বুলালো। কাপালে ঈষৎ ভাঁজ, মনে ভয়। লিস্টের কোথাও কোন ভুল নেই তো? তার থেকে এক হাত দূরত্বেই কেয়া আর স্পর্শী তাদের কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলছে। আরও তিন-চার আছে তাদের সাথে কিন্তু কাজের দরুণ তারা বেশ দূরত্বেই অবস্থানরত আছে। বাকিরা কাজ শেষ করে আগেই চলে গিয়েছে। হঠাৎ নিধি ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে আসে, হাতে থাকা কিছু কাপড়ের কুণ্ডলী মেঝেতে ফেলে দিয়ে মাহিনের পাশে বসে পড়ে। হায়-হুতাশ করতে করতে একটু জোরেই বলে,

— হিটলারের জ্বালায় আর বাঁচলাম না রে। এইবার আমি সত্যি মরেই যাব। একদম ফিনিশ! এত কাজ দুইদিনের মধ্যে কিভাবে সম্ভব? চব্বিশ ঘণ্টার জায়গায় ছাব্বিশ ঘন্টা খেটেও তো পারুম না।

নিধির উচ্চরোল কন্ঠ দূরত্বে অবস্থিত ছেলে-মেয়েদের কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হতেই তারা নিধির দিকে ঘুরে বাঁকা চোখে তাকায়৷ মাহিন তা দেখে নিধির মাথায় চাপড় মেরে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,

— এমন বাঁশ গলা কেন তোর? গলার স্বর একটু নিচু করা যায় না? বুঝে-শুনে কথা বল একটু, তোর জন্য কবে না জানি নির্বাণ স্যারের হাতে বাঁশ খাই।

নিধি মন্থর কন্ঠে বলে, “আমি কি ওদের খেয়াল করে বসে আছি নাকি? আজীব!”

মাহিন বিরবির করে বলে, “তা দেখবি কেন, বেদ্দব?”

এর মাঝেই স্পর্শী আর কেয়া ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিধি ওদের দেখে বলে, “আমি নিশ্চিত হিটলারে আমার পুরো কথাই শুনছিল৷ তাই তো আমাদের এখন গাধার মত খাটাচ্ছে৷ এত কাজ কেমনে করে মানুষ? আমি বাসায় যামু ভাই। ভাল্লাগেনা আর!”

কেয়া রোষা কন্ঠে বলে, “স্যার শুনেছি কি-না জানি না তবে তুই যদি এখন তোর ভ্যাদভ্যাদানি অফ না করিস আই সোয়ের তোকে আমি এখন একটা আছাড় মারবো।”

“এমনে বলিস কেন? তোর কি মায়া হয় না আমার উপর?”

মাহিন বিরক্তিকর কন্ঠে বলে, “মাথা খাইস না বইন। এমনেই কাজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে আছি। হিটলার আর লেডি হিটলারের জ্বালায় জীবন তেজপাতা আমার।”

কেয়া ফাজলামো করে বলে, “তবে দুইজনের বিয়ে হলে সেই হবে রে। এক হিটলার আরেক হিটলারেই টাইট দিতে পারবো।”

নিধি নাক কুঁচকে বলে, “কিন্তু ভবিষ্যতে যে হিটলারের বংশধর হইবো তার কি? পরে তো আমার নাতি-নাতনিটির জান খাইবো। যেমন এখন আমার খাইতাসে।”

স্পর্শী কথাটা শুনে নিধির দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকায়, “হইসে থামবি তোরা? আমার আর ভাল্লাগতাসে না।”

কেয়া হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তোর আবার কি হলো?”

স্পর্শী মুখ ঘুচে বলে, “কিছু না।”

কেউ আর এই বিষয় নিয়ে এত একটা ঘাটলো না, চুপ হয়ে গেল। অতঃপর যে যার মত কাজ গুছিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলো। হঠাৎ মাহিন স্পর্শীর কাছে এসে বলে, “স্পর্শী এই লিস্টটা তুই একবার চেক কর তো। সব ঠিক আছে কি-না দেখ। কোন কিছু বাদ পড়ে নাই তো? আমি বুঝতাসি না।”

স্পর্শী লিস্টটা হাতে নিয়ে ভালোমতো একবার চোখ বুলায়, “ঠিকই তো লাগছে।”

“তাহলে একটু কষ্ট করে স্যারকে গিয়ে একটু দিয়ে আয় না। আমি এখন বাসায় যাব রে, আর্জেন্ট কাজ আছে।”

স্পর্শী ইতঃস্তত কন্ঠে বলে, “কিন্তু…”

“যা না প্লিজ। লিস্টটা স্যারকে দিয়ে তুই একবারে বেরিয়ে যাইস। আমারও এখন চলে যাব।”

স্পর্শী কিছু বললো না। দৃষ্টির অগোচরেই তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।

_________________

টিচারস রুম এখন প্রায় ফাঁকা। দুই-তিন টিচার বাদে কেউ নেই বললেই চলে। সাধারণ এই সময় ভার্সিটি পুরো ফাঁকা থাকলেও অনুষ্ঠানের কার্যবলীর জন্য এখনো জনমানবহীন হয়নি পরিবেশ। স্পর্শী গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়ায় রুমের সামনে, হালকা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে কে কে আছে রুমে। নির্বাণ ব্যতীত রুমে আরও দুইজন টিচারকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্পর্শী। অতঃপর মৃদুস্বরে অনুমতি চায় ভিতরে আসার। অনুমতি পাওয়ার পর মুহূর্তেই স্পর্শী ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নির্বাণের দিকে। নির্বাণ তখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ দেখতে ব্যস্ত। স্পর্শী নিঃশব্দে নির্বাণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, লিস্টটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, “স্যার আপনি যে লিস্টটা চেয়েছিলেন। দেখেন সব ঠিক আছে কি-না।”

নির্বাণ চোখ তুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর পানে। অতঃপর ওর হাত থেকে লিস্টটা নিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সেটা। এরই মাঝে বাকি দুইজন টিচার কোন এক কাজে উঠে বাহিরে চলে যায়। রয়ে গেল শুধু স্পর্শী আর নির্বাণ। স্পর্শী সেটা আড়চোখে খেয়াল করলেও বাহিরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভিতরে ভিতরে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। পুরো রুম জুড়ে তখন অন্যরকম নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ পর নিসাড় পরিবেশটাকে অবকাশ দিয়ে নির্বাণ বলে, “হ্যাঁ সব ঠিক আছে।”

স্পর্শী গোপনে ছোট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “আচ্ছা। তাহলে আমি এখন আসি?”

নির্বাণ কিছু না বলে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্পর্শীর পানে। স্পর্শীর এতে বেশ অস্বস্তিবোধ করে। সে এক হাতের মুঠোয় আরেক হাত পুরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। মানুষটার সামনে আসলেই এখন তার যত অস্বস্তি, উৎকন্ঠা,ব্যগ্রতা কাজ করে। আগে তো করতো না, এখন কেন করে কে জানে?
হঠাৎ নির্বাণ বলে উঠে, “রাত হয়ে এসেছে প্রায়। তুমি পার্কিং-এ গিয়ে অপেক্ষা কর, আমি বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।”

কথাটা কর্ণধারে এসে বারি খেতেই স্পর্শী কিছুটা ভড়কে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে, “তার দরকার নেই। আমি যেতে পারব।”

নির্বাণ তীক্ত কন্ঠে বলে, “জিজ্ঞাসা করিনি আমি। চুপচাপ গিয়ে দাঁড়াও, আসছি আমি।”

স্পর্শী পুনরায় মানা করতে চাইলেও নির্বাণের দৃঢ় দৃষ্টি দেখে কিছু বলল না। নির্বাণের ব্যবহার সে প্রচন্ড অবাক হলেও অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ করলো না। কোনমতে মাথা হেলিয়ে বাহিরে চলে আসলো।

_________________

বড় রাস্তায় গাড়ি উঠতেই ফাঁকা রাস্তার দেখা মিলে, গতি বাড়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ। হিম অনলের ছোঁয়া পেতেই স্পর্শী খুব সপ্তপর্ণে জানালার কাঁচটা আরেকটু নামিয়ে নেয়। মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দেয় জানালার দিকে। পুরো গাড়ি জুড়েই নিদারুণ নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ নিভৃতে,নীরবে কেটে যেতেই নির্বাণ মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“আমি মানুষটা কি আসলেই তোমার বড্ড অপ্রিয়?”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৭

“নিষিদ্ধ জায়গায়গুলো এইভাবে উন্মুক্ত রাখতে নেই, দৃষ্টি বেসামাল হয় কারো।”

কোন আগন্তুকের মিইয়ে যাওয়া কন্ঠ স্পর্শীর কর্ণকুহরে ঝংকার তুলতেই ঈষৎ কেঁপে উঠে সে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে যায় শীতল শিহরণ। স্পর্শী কিছু বুঝে উঠার আগেই আগন্তুকটির পুনরায় বলে উঠে,

“পিছন দিয়ে শাড়ি ঠিক কর।”

কন্ঠস্বরটা এইবার বড্ড চেনা লাগে স্পর্শীর কিন্তু ঠিক ধরতে পারলো না কন্ঠটা কার। তৎক্ষনাৎ পিছন ঘুরে দাঁড়ায় সে, কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। ঈগল দৃষ্টি চারদিকে নজর বুলিয়ে, বোঝার চেষ্টা করে কথাটা আসলে তাকে কে বলেছে। কিন্তু ভিড়ের মাঝে আগেই আগন্তুকটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যার দরুন, স্পর্শী বুঝতেই পারলো না কে তাকে সেই কথাগুলো বলেছিল৷ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের দিকে তাকালো, পিছনে নিয়ে গেল হাত। কোমরের পাশে লাগানো সেফটিপিনটা টানে খুলে গিয়েছে, যার ফলে কোমরের একাংশ প্রদর্শিত হয়ে আছে বহির্ভাগে। ক্ষণেই স্পর্শী লজ্জায় নিমজ্জিত হলো। কাজে এতটাই মগ্ন ছিল কখন শাড়ির পিন খুলে গিয়েছে বুঝতেই পারে নি৷ স্পর্শী দ্রুত পিছন দিক দিয়ে আঁচল টেনে নিজেকে আবৃত করলো। পুনরায় চারদিকে চোখ বুলালো পরিচিত কাউকে খুঁজতে। আশপাশে কাউকে না পেয়ে স্পর্শী সামনের দিকে এগিয়ে গেল কিছুটা। সামনে নিধিকে দেখতে পেয়ে স্পর্শী ওর নাম ধরে ডাকে। ডাক শুনে নিধি কাছে আসতেই স্পর্শী সবটা বলে, ওকে নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।

নিজ কার্য শেষে স্পর্শী আর নিধি বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। স্পর্শী মন্থর কন্ঠে বলে,”থেংক্স রে।”

নিধি তটস্থ সুর বলে,”থেংক্স পরে দিস, এখন তারাতাড়ি চল। বহুত কাজ বাকি আছে ভাই। সব ঠিকমত না হলে স্যার পরে আমাদের ক্যালাবে।”

“হুম চল।”

স্পর্শী আর নিধি কিছুদূর যেতেই পাশ থেকে কেউ শিস বাজিয়ে উঠে। স্পর্শী সেটা উপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে কেউ বলে উঠে,

“রূপে বুঝি আজ পা মাটিতেই পড়ছে না তোমার। আমাকে না দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যাচ্ছ।”

স্পর্শী এইবার থমকায়। পাশ ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্রের দিকে। কঠোর কন্ঠে বলে, “রাস্তার লোককে দেখার মত কি আছে?”

রুদ্র বাঁকা হেসে বলে, “মানলাম আমি রাস্তার লোক। তবে, এই রাস্তার লোকের সাথেই এককালে অনেক সময় কাটিয়েছ। ভুলে গেলে?”

“মুখ সামলে কথা বল।”

“মুখ সামলেই কথা বলছি, জাননন!”

শেষের কথাটা একটু টান দিয়ে বলল রুদ্র। স্পর্শী কিছু বললো না, শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্রের দিকে। নিধি একবার রুদ্রের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্পর্শীর হাত ধরে চলে আসার জন্য বললো। এমন সময় রুদ্রের আর কিছু বন্ধু এসে দাঁড়াল সেখানে। সকলের অভিব্যক্তি গা-জ্বালানোর মত। একজন রুদ্রের কানে কিছু ফিসফিস করতেই রুদ্র অতি বিশ্রী চাহনিতে তাকায় স্পর্শীর পানে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার ভালো মত দেখে নিয়ে বলে,

“একরাতের জন্য মন্দ নয়।”

কথাটা কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হতেই স্পর্শীর ক্রোধ সকল সীমা পেড়িয়ে গেল। সে উচ্চস্বরে বলে, “মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ রুদ্র। আজ বারাবাড়ি করলে খারাপ হয়ে যাবে বলছি।”

রুদ্র পুনরায় হেসে বলে, “খারাপ কি বললাম? সাধারণ একটা বাক্য বলেছি তাতে এত জ্বলার কি আছে? আর আমি তো তাও একরাতের কথা ভেবেছি, অন্য কেউ হলে ফিরেও চাইতো না। তোমার মত কালো মেয়েকে কেই বা চাইবে?”

স্পর্শী ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো, রাগে তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। স্পর্শীর এখন ইচ্ছে করছে কাঠিন্যে পরিপূর্ণ কয়েকটা বাক্য রুদ্রের দিকে ছুঁড়ে দিতে কিন্তু পারছে না। কন্ঠস্বর কেমন নিম্প্রভ হয়ে পড়েছে, শব্দ সব যেন দলাপাকিয়ে বসে আছে কণ্ঠনালীতে। স্পর্শী নিধির এক হাত শক্ত করে ধরে। নিধি এইবার চেঁচিয়ে বলে,

“জাস্ট সাট আপ রুদ্র। আর কত নিচে নামবে তুমি? তোমাকে তো আজ আমার পশুর সাথেও তুলনা করতে ঘৃণা হচ্ছে।”

রুদ্র বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে, “সত্যি সবসময় গায়েই লাগে।”

স্পর্শী এইবার নিজেকে ভিতরে ভিতরে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে শক্ত গলায় বলে, “সত্যি গায়ে লাগে কি-না জানি না। তবে কুকুরের ঘেউ ঘেউ এট লিস্ট আমার গায়ে লাগে না। অন্যের লাগলে লাগতে পারে।”

ক্ষণেই রুদের অভিব্যক্তি বদলে যায়। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী আবার বলে,

“একটা কথা কি জানো? কুকুরের অভ্যাস হলো যেখানে সেখানে মুখ দেওয়া। একশ এক জায়গায় মুখ দিয়ে, মুখে ঘা করা। তুমিও হচ্ছ সেই কুকুর৷ সময় থাকতে ঠিক হয়ে যাও, নাহলে কোথায় কোন ঘা হবে বুঝতেও পারবে না। আর আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করার কিছু নেই। আমার জীবনের গতি ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে।”

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে, “গতি বলতে?”

“বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার আর আমার বর আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”

কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না স্পর্শী। নিধির হাত ধরে বড় বড় পা ফেলে সে জায়গায় থেকে চলে আসলো।

_______________

ফাঁকা একটা ক্লাসে নতজানু হয়ে বসে আছে স্পর্শী। শক্ত মন হয়ে পড়েছে নিস্তেজ। চোখের কানায় জমে এসেছে লঘু অশ্রুজল। যেকোনো সময় নিজ সীমানা পেরিয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়বে গাল,চিবুক বেয়ে। তারই পাশে নিধি আর কেয়া। স্পর্শীকে এইটা সেটা বলে বুঝ দিচ্ছে। তারই অন্যপাশে মাহিন ও সামি দাঁড়িয়ে নিষ্প্রভ চাহনিতে দেখিছে সব। সকল ঘটনা শুনে তারা স্তব্ধ। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ঈষৎ পূর্বেই। মানুষ এত নিকৃষ্ট কিভাবে হয়?

অকস্মাৎ স্পর্শী মাথা তুলে, এক ফোঁটা জল আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে৷ অযত্নে লেপ্টে গেল চোখের কিনারে লেগে থাকা কাজলটুকু। অস্ফুটস্বরে সে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি আসলেই দেখতে এতটা কুৎসিত, কালো? আমাকে কি সত্যি কেউ চাইতে পারে না?”

নিধি এইবার ধমকে উঠে, “কিসব বাজে বকছিস তুই? তুই কুৎসিত বা কালো হতে যাবি কেন? তুই হচ্ছিস পরিস্ফুটিত গোলাপ। যার মধ্যে কোন দাগ নেই, কোন কৃত্রিমতা নেই। কুৎসিত তো ওই জা****বাচ্চা। ওর তো সবই কালা।”

কেয়া স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “ওই গাধা! তুই কালো আর উজ্জ্বল শ্যামলার মধ্যে পার্থক্য বুঝিস না? নিজেকে তোর কোনদিক দিয়ে কালো মনে হয়? এত মিষ্টি একটা চেহারা কুৎসিত লাগে তোর? থাপড়িয়ে সব দাঁত ফেলে দিব, ফাজিল মেয়ে। ওই আবালের কথা কানে নিয়ে বসে আছিস কেন? ওর কথার দাম আছে কোন?”

সামি এগিয়ে এসে বলে, “একদম কাঁনবি না। এই চোখের জল কার জন্য ফেলিস? ওকে না তুই ভালোবাসিস না? তাহলে ওর কথা তোকে ইফেক্ট কেন করছে? আর কালো হলেও কি? কালো মানুষ কি সুন্দর না? যে যার রূপে সুন্দর। গায়ের রঙ দিয়ে সুন্দর, কুৎসিত যাচাই করাটা বিকৃতি মস্তিষ্ক মানুষের কাজ।”

স্পর্শী মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “আমি জানি সেটা। কিন্তু তবুও আজ ওর কথাগুলো কেন যেন ইফেক্ট করছে আমাত। তবে ভুলতে পারছি না কথাগুলো।”

মাহিন বলে, “তোর মত মেয়ে আমি অনেক কম দেখেছি স্পর্শী। তুই সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে না। যেহেতু আজ তোর উপর কারো কথা ইফেক্ট করছে, সেহেতু কথাগুলো তোর মনে গভীর দাগ কেটেছে বুঝতে পারছি। দেখ, যে যার মত সুন্দর৷ আল্লাহর সৃষ্টি কি কখনো কুৎসিত হতে পারে? আর তুই দেখতে একদমই বাজে না। বরং একটা মিষ্টি আর হাস্যজ্বল চেহেরার অধিকারী তুই। তোর ব্যক্তিত্ব সর্ব্দাই তোকে সবার আলাদা করে। তোকে যে পাবে সে অনেক ভাগ্যবান হবে রে। এইটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।”

সকলের কথায় স্পর্শী একটু স্বাভাবিক হয়। মন খারাপের মেঘগুলো সরে যেতে শুরু করে। সে হালকা হেসে বলে, “মাখন দেওয়া ভালোই শিখেছিস মোটু।”

মাহিন বিরাগপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, “আমার মনের কথাগুলো তুই মাখন বলে চালিয়ে গেলি? এই তোর বিচার?”

সামি বিদ্রুপ কন্ঠে বলে, “ভালো কথা বলেছিস তো তাই গায়ে লাগে নাই মাইয়ার। তোর বলা উচিৎ ছিল, স্পর্শী তোর মত তেতো মেয়ে আমি একটাও দেখিনি। তোর ত্যাড়া চোখের চাহনি, তোর আঁকাবাঁকা হলুদ দাঁতের হাসি সবাইকে আহত করে রে। তোর সোলার ঝাড়ুর মত চুলে উকুনের বাসা দেখিতে সবাই উতলা হয় পড়ে। তোর মত একটা মেয়ে যার জীবনে যাবে তার জীবন কয়লার কারখানা হয়ে যাবে।”

সামির কথা শেষ হতেই সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠে। কেয়া বলে, “সেই বলেছিস ইয়ার। উফফ! পুরাই জোস।”

স্পর্শী হাসতে হাসতে বলে, “থাক ভাই, মাফ কর আমায়। আমার রূপের গুণগান আর তোকে গাইতে হবে না। বুঝলি আমি মেলা সুন্দর।”

নিধি বলে, “এই তো বাছা লাইনে আসছো। এরপরের বার খালি আজেবাজে কথা শুনে সেন্টি খাইস তুই। মিটাইয়া সেন্টু গেঞ্জি বানিয়ে ফেলুম।”

নিধির কথায় স্পর্শী হেসে বলে, “আচ্ছা বানাইস।”

অতঃপর অযত্নেই চোখের কোনে জমে থাকা জলটুকু মুছে নেয়। লেপ্টে যাওয়া কাজল আরেকটু ছড়িয়ে হয় কিন্তু সেদিকে স্পর্শী নজর দেয় না। কেয়া এইবার তাড়া দিয়ে বলে, “অনেক কথা হলো, এইবার উঠ তাড়াতাড়ি। নির্বাণ স্যার যদি একবার ধরতে পারে আমরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছি তাহলে আমরা ফিনিশড বস।”

সকলে কেয়ার কথায় সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়ে, এগিয়ে যায় বাহিরের দিকে। এমন সময় স্পর্শীর মেসেজ টোন বেজে উঠে। স্পর্শী হাতে থাকা মুঠোফোনের দিকে একনজর বুলায়।

“অনুষ্ঠান শেষে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসবে। তোমার সাথে কথা আছে আমার।”

অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা এই মেসেজটা দেখে ক্ষণেই স্পর্শীর ভ্রু কুঁচকে আসে। অন্তর্নিহিত মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারলো না বার্তাটির প্রেরক কে? পুনরায় মেসেজ টোন বেজে উঠতেই দৃষ্টি গিয়ে থমকালো স্ক্রিনে।

“আমি নির্বাণ।”

মেসেজটা আনমনে পড়া মাত্র স্পর্শী থমকে যায়। বিস্ময়ে চোখ কোটর হয়ে আসে তার।

_________________

ক্লান্ত অপরাহ্ণে পরিবেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। বাতাসেও ছেঁয়ে আছে অলসতা৷ সূর্যও নিস্তেজ হয়ে হেলে পড়েছে পশ্চিমা আকাশে। ভ্যাপসা গরমের এই বিকেলে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই মিনিট দশেক হলো স্পর্শী নির্বাণের গাড়ির ভিতর বসে আছে। অথচ নির্বাণের কোন খবরই নেই। গাড়ি খোলা রেখে কোথায় গিয়েছে কে জানে? প্রচন্ড গরম লাগা সত্ত্বেও গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে রেখেছে সে, যাতে তাকে কেউ দেখে না ফেলে। এসি যে অন করবে সেই উপায়ও নেই। বিতৃষ্ণায় এইবার মুখ ঘুচে এলো স্পর্শীর। মনে মনে ঠিক করলো, আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে এরপরও যদি নির্বাণের দেখা না মিলে তাহলে সোজা বাসায় চলে যাবে।
কথাটা আনমনে আওড়িয়ে মাথাটা সিটে এলিয়ে দিল। আঁচলটা ধরে সামনে টেনে এসে কপাল ও গলার ঘামটুকু মুছে বাতাস করতে থাকলো। নয়ন দু’টির কপাট বন্ধ করে অপেক্ষারর প্রহর গুনতে থাকলো। মিনিট দুই-এক না গড়াতেই গাড়ির দরজা খুললো,কেউ এসে বসলো তার পাশের সিটে। শব্দ পেয়ে স্পর্শী তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকালো। সামনে নির্বাণকে দেখামাত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। নির্বাণ একপলক তাকালো স্পর্শীর ঘর্মাক্ত মুখশ্রী পানে। নাকের ডগায় মুক্তার ন্যায় ঘামের বিন্দুগুলো চিক চিক করছে। চোখের নিচের কাজল খানিকটা লেপ্টে আছে, গাঢ় রঙের লিপস্টিকটি কিনার দিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ছড়িয়ে গিয়েছে। হঠাৎ নির্বাণের মনে নিষিদ্ধ এক ইচ্ছা নাড়া দেয়। তার ইচ্ছে করে স্পর্শীর নিকটস্থ হয়ে খুব সপ্তপর্ণে লেপ্টে যাওয়া কাজলটুকু মুছে দিতে। ছড়িয়ে যাওয়া লিপস্টিকটুকু আরেকটুকু ছড়িয়ে দিতে। ইচ্ছেগুলো মাথা চাড়া দিতেই নির্বাণ দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে, নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানায় এই অশোভন চিন্তা ভাবনার জন্য। প্রখর ব্যক্তিত্বের যেন আজ কলঙ্ক লেগে গেল।জীবনে এই প্রথমবারের মত কোন কলঙ্ক লাগলো তার গায়ে। আগে তো কখনো এমন ইচ্ছা জাগে নি তার মনে, তাহলে আজই কেন? মন আজ এত বেহায়াপনা করছে কেন?
ভাগ্যিস! সামনের মানুষটি তার মনের কথা শুনতে পায় না। না-হলে কি এক বিড়ম্বনাতেই না পড়তো হতো তাকে। স্বচ্ছ চরিত্রের প্রতিচ্ছবি হয়তো ধূলিসাৎ হয়ে যেত।

“কি ভাবছেন এত?”

স্পর্শী অকস্মাৎ প্রশ্নে নির্বাণ চোখ খুলে তাকায়। নিজেকে স্বাভাবিক করেই বলে,

“কিছু না।”

কথাটা বলে নির্বাণ ইঞ্জিন স্টার্ট করলো। এসিটা দ্রুত অন করে, পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। ক্ষণেই হিম শীতল বায়ু স্পর্শীর গায়ে পরশ বুলাতে শিথিল হয়ে পড়ে শরীর। স্পর্শী মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“আমার সাথে আপনার কি যেন কথা ছিল?”

নির্বাণ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে, “হুম ছিল, তবে এইখানে নয়।”

স্পর্শী কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কোথায়?”

“গেলেই দেখতে পাবে।”

কথাটি বলা শেষ হতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। স্পর্শী এইবার আর পাল্টা প্রশ্ন করলো না, নীরবেই গা-টা এলিয়ে দিল সিটে।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৮

সূর্য নিমজ্জিত পশ্চিমাকাশের গহীনে। শেষ আকাশে সরু লালাভ আভার রেখা মিইয়ে যাচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্নে। রাস্তার ধারে সোডিয়াম লাইটের হলুদ আলোয় আবৃত রাস্তা-ঘাট। ফাঁকা রাস্তায় সাঁই সাঁই করে গাড়ি চলছে। শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এক রেস্টুরেন্টে বসে আছে স্পর্শী। একদম কিনারে, দেয়াল ঘেঁষে। বা-পাশের পুরো দেয়াল স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি হওয়ায় বাহিরের রাস্তা সাচ্ছন্দ্যেই দেখতে পারছে সে। স্পর্শী একমনে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। রাস্তার অপর পাশে ফুটপাতে একটি কুকুর আর বিড়ালের সাংঘাতিক ঝগড়া চলছে, সেটাই অতি মনোযোগ সহকারে দেখছে সে। তাকে যে অতি সময় ধরে কেউ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সেদিকে বিন্দুমাত্র ধ্যাণ নেই তার। সে তো মগ্ন আপন ভাবনায়।
হঠাৎ কারো ভরাট কন্ঠে তার ধ্যান ভাঙ্গে। বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকায় সে।

“কি খাবে বল?”

স্পর্শী দৃষ্টি নত করে বলে, “আপনার যা ভালো লাগে অর্ডার দিন। আমার কোন সমস্যা নেই।”

নির্বাণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে, “এলার্জি আছে কিছুতে? বা সাইড-ইফেক্ট?”

স্পর্শী মাথা দুলিয়ে না-সূচক উত্তর বলে, “তেমন কিছুতে নেই। তবে..”

নির্বাণ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলে, ” কি?”

“মাশরুম আর বাদাম জাতীয় খাবার খেতে পারি না আমি, কিছুটা সমস্যা হয়।”

“আচ্ছা।”

নির্বাণ ওয়েটারকে ডেকে নিজ থেকেই অর্ডার দেয়। অর্ডার দেওয়া শেষে ওয়েটারকে সে সতর্ক করে দেয়, তাদের খাবারে মাশরুম বা বাদাম জাতীয় কোন উপকরণ ব্যবহার না করা হয়। ওয়েটার টুকরো এক হাসি দিয়ে আশ্বস্ত করে নির্বাণকে। অতঃপর অর্ডার নিয়ে চলে যায় সে। এর সবটাই স্পর্শী নীরবে দেখলো। অভিব্যক্তিতে কিছু প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে সে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছে। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানবটি আজ এত কোমল। আদৌ ভাবা যায়? এ যেন তার স্বভাবের উল্টো প্রকৃতির কোন এক মানব৷ তবে নির্বাণের এই ছোট ছোট কেয়ারগুলো মন্দ লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে, কেউ তো খেয়াল রাখছে তার।
ক্ষণেই সরু হাসির রেখা ফুটে উঠলো স্পর্শীর ঠোঁটের কোনে। নির্বাণ সেটা খেয়াল করে বলে,

“হাসছো যে?”

স্পর্শী দ্রুত নিজের হাসিটুকু মিইয়ে নিয়ে দৃষ্টি নত করে বলে, “না! তেমন কিছু না।”

নির্বাণ ঠোঁট গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”

“হু।”

কথাটা বলে স্পর্শী কিছুটা আঁটসাঁট হয়ে বসে। নির্বাণ তা দেখে বলে, “একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”

স্পর্শী দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বলে, “জি বলুন।”

নির্বাণ ধীর কন্ঠে বলে, “তুমি কি বিয়েটা মানো?”

স্পর্শী কিছু প্রহর নীরব থেকে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, মানি।”

“আর আমাকে স্বামী হিসেবে?”

তৎক্ষনাৎ স্পর্শী তুলে তাকায়, বিব্রত তার দৃষ্টি। আচমকা এমন প্রশ্নের আক্রমণের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা সময় লাগে তার নিজেকে সামলে উঠতে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“মানি তবে কোথাও একটা জড়তা রয়ে যায়। আপনাকে সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।”

“ভেবে বল কিন্তু। একবার যদি তুমি এই সম্পর্কে কমিটেড হয়ে যাও তাহলে কিন্তু পিছ পা হওয়ার সুযোগ নেই।”

“বিয়ে তো ছেলেখেলা না, তাই না? আমি যেহেতু সম্পর্কটা ভাঙতে ইচ্ছুক নই, সেহেতু চেষ্টা আমার পক্ষে থেকে থাকবেই। সময় দিন মানিয়ে নিব সবটা আমি।”

নির্বাণ কিছু প্রহর চুপ থেকে মৃদু স্বরে বলে, “বেশ! তবে মানিয়ে নিতে না পারলেও তোমায় আমি ছাড়ছি না।”

কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুলতেই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্পর্শী। থম মেরে যায় সে। নির্বাণের কন্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ। যা ক্ষণেই স্পর্শীকে ভাবিয়ে তুলছে। নির্বাণ কি তাহলে এই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জুড়ে যাওয়া সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস হচ্ছে? আগ্রহ দেখাচ্ছে তার প্রতি? নাহ! আর ভাবতে পারছে না স্পর্শী। স্পর্শী নির্বাণকে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই নির্বাণের ফোন বেজে উঠে। নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। নির্বাণের ফোনালাপের মাঝেই চাপা পড়ে যায় স্পর্শীর কথা।

________________

আনমনা হয়ে বসে আছে স্পর্শী। দৃষ্টি তার খাবারের প্লেটের দিকে হলেও মন-মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরছে অন্য চিন্তা-ভাবনা। ছুরি আর কাটা চামচ দিয়ে সাজানো-গোছানো থালির এক কোনে অনবরত আঁকিবুঁকি করেই চলেছে সে। সাত আইটেমের থালি থেকে শুধু মাত্র ফ্রাইড রাইসটুকুই মুখে তুলেছে স্পর্শী। বাকিসব আগের ন্যায় পড়ে আছে। স্পর্শীর এমন ভাবভঙ্গি দেখে নির্বাণ জিজ্ঞেস করে,

” কোন সমস্যা? খাচ্ছো না যে?”

স্পর্শী এইবার আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। অপ্রস্তুত ভাবেই কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলে, “এইতো খাচ্ছি।”

কথাটা বলেই বিফ স্টেকটা কাঁটা চামচ দিয়ে ধরে তারউপর ধারালো ছুরির ঘা বসালো। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো মাংসটির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো করার। কিন্তু হাহ! স্টেকটি যেন দুইখন্ড হতে নারাজ। কিছুটা সময় অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টার পরও যখন ফলাফল শূন্যে কোঠায় তখন বিরক্তিতে স্পর্শী মুখ ঘুচে এলো। সে ছুরি-চামচ ব্যবহারে অতো দক্ষ নয়। কিন্তু নিজের ত্রুটি না মেনে সে মনে মনেই স্টেক নামক জিনিসকে একদফা গালি দিয়ে নিল। আরেক দফা গালমন্দ করলো রেস্টুরেন্টের মালিককে। আমরা ভাই বাঙালি মানুষ, খাব হাত দিয়ে। খামাখা ইংরেজের বংশধরদের মত কাঁটা-চামচ-ছুরি দিয়ে কেন খেতে হবে ভাই? নেহাৎ নির্বাণ পাশে না থাকলে স্পর্শী হাত দিয়েই খাওয়া শুরু করে দিত। কিন্তু নির্বাণ আছে বলে সেটা পারছে না। প্রেস্টিজের ব্যাপার-স্যাপার আছে তো নাকি? স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আহত চোখে তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণ নির্দ্ধিধায় ছুরি-চামচের ব্যবহার করে মাংসের টুকরো করেই চলেছে। সেটা দেখে স্পর্শীর মনে ঈষৎ ঈর্ষা জাগলো। মানুষটাকে সবকিছুতে পটু কেন হতে হবে? একটু অপটু হলে ওর মত পাবলিকের এত সমস্যার সম্মুখীন হতে হত না। বিতৃষ্ণায় এইবার স্পর্শীর মুখ ছোট হয়ে আসে। উপায়ন্তর না পেয়ে, স্টেক বাদে অন্যসকল উপকরণ দিয়ে কাজ চালানোর পরিকল্পনা আঁটে।
হঠাৎ নির্বাণ স্পর্শীর সামনে থেকে ওর থালিটা সরিয়ে নিয়ে নিজের থালিটা এগিয়ে দেয়। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

“নাও! খাও এইবার।”

স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে নির্বাণের দেওয়া থালির দিকে তাকায়। স্টেকের ছোট ছোট টুকরো করা তাতে। বিস্ময়ে এইবার স্পর্শীর মুখ কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আসে। নির্বাণ তা দেখে বলে,

“নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতে শিখো। সামনের মানুষ মাঝে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নেই যে তুমি না বললেও সে সবসময় বুঝে যাবে।”

স্পর্শীর ঠোঁটের কোনে নিজের অজান্তেই ছোট এক হাসির রেখা ফুটে উঠে। সে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় অতঃপর নীরবেই খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষে স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকাতেই দেখে নির্বাণ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। স্পর্শী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নির্বাণের দিকে তাকাতে, নির্বাণ ডান হাতের তর্জনী উঠিয়ে স্পর্শীর ঠোঁটের কিনারে নিয়ে যায়৷ খুব সপ্তপর্ণে এঁটো খাবারের ছোট দানা হাতে তুলে নেয়। ঘটনাক্রমে স্পর্শী হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নির্বাণের পানে। হঠাৎ সে উপলব্ধি করতে পারলো, তার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে। শরীর ঈষৎ পরিমাণ কাঁপছে।
হঠাৎ নির্বাণ বলে উঠে, “যাওয়া যাক এইবার?”

স্পর্শী হতবুদ্ধির মত শুধু মাথা দুলায়। নির্বাণ উঠে দাঁড়াতেই স্পর্শী সব গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নির্বাণ ও স্পর্শী রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ির সামনে আসতেই স্পর্শীর টনক নাড়ে বিল তো দেওয়া হয়নি। সে তটস্থ সুরে বলে,

“আপনি বোধহয় বিল দিতে ভুলে গিয়েছেন।”

নির্বাণ ঘাড় ঘুরে তাকিয়ে বলে, “না, ভুলি নি।”

স্পর্শী নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, “কিন্তু আপনাকে তো বিল দিতে দেখিনি আমি। সারাক্ষণ তো আমার সামনেই বসে ছিলেন।”

“নিজ রেস্টুরেন্টে টাকা দিয়ে খাব?”

“মানে?”

নির্বাণ কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “এইটা তোমার শাশুড়ি মার রেস্টুরেন্ট। মা আর আমি এইখানকার ওনার।”

মুহুর্তেই স্পর্শীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। ক্ষণেই মনে পড়ে গেল তখন স্টেক কাঁটতে না পারায় সে রেস্টুরেন্টের ওয়ানকে গালমন্দ করেছিল। নিজের কপাল এখন নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করলো স্পর্শীর। শেষে কি-না নিজের বর আর শ্বাশুড়িকেই গালমন্দ করলো? হায় খোদা! আল্লাহ মাফ করুক। স্পর্শী কোন মতে বলে উঠে, “অহ আচ্ছা।”

“হুম। চল এখন, রাত হচ্ছে।”

স্পর্শী কোনমতে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়, হাঁটা দেয় গাড়ির দিকেই।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here