চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -০৯+১০+১১+১২

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৯

কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথির রজনী। দেখা নেই স্নিগ্ধ চাঁদের, নেই তার কোন স্পর্শ। আঁধারে নিমজ্জিত সমস্ত নগরী। অকস্মাৎ চৈত্রের ভ্যাপসা গরমে তপ্ত হওয়া শহুরে এক বুক শীতলতা বয়ে আনলো হিম অনলের ঢেউ। প্রশান্ত হলো উগ্র মন, ছেদ করলো কারো ভাবনায়। স্পর্শীর একপলক তাকালো বাহিরের দিকে। হিম বাতাসে বারান্দার পর্দাগুলো তিরতির করে কাঁপছে। সে সাথে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে দরজার এক কোনে রাখা আর্ট পেপারগুলো। পার্শিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে স্পর্শী আনমনেই উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেল বারান্দার দরজার দিকে। দরজা, ফ্যান বন্ধ করে এসি ছেড়ে দিল। মেঝে থেকে কুড়িয়ে পেপারগুলো বিন্যস্ত করে রাখলো নিজ স্থানে। হঠাৎ মনে রং-তুলির জোয়ার উঠলো, শুভ্র ক্যানভাসকে রঙে-বেরঙে সাজিয়ে তুলার প্রবণতা বাড়লো৷ স্পর্শী আর এক মুহূর্ত ভাবলো না, রং-তুলির সরঞ্জাম সাজিয়ে বসে পরলো নিজের মনের সমাদর রাখতে।
হাত চলতে থাকলো সাদা ক্যানভাসের উপর অবিশ্রান্ত। পার্শিয়া বিছানার উপর আরাম ভঙ্গিতে শুয়ে একধ্যানে দেখতে থাকলো স্পর্শীকে। মাঝে মধ্যে স্পর্শীকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মৃদুস্বরে ডেকে উঠলো। অতঃপর একসময় স্পর্শীকে দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে অবস্থায়। স্পর্শী গিয়ে ক্ষান্ত হলো আরও ঘন্টা দুয়েক পর। রেস্টুরেন্টে বসে থাকা কোন এক যুগলের মিষ্টি মূহুর্তগুলো কাঠ পেন্সিলের সুক্ষ্ম আঁচড়ের সাথে রং-তুলির সংমিশ্রণে ফুটিয়ে তোলার ক্ষীণ প্রচেষ্টা। তবে পোট্রের্টটা এখনো অসম্পূর্ণ। বাকি আছে আরও অনেক কাজ। যার দরুন, সম্পূর্ণ বিষয়টি ফুটে উঠতে চেয়েও উঠলো না। সম্পূর্ণতা পেলে হয়তো দারুণ কিছু হতো। স্পর্শী অবসন্ন নিঃশ্বাস ফেললো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো অসমাপ্ত ক্যানভাসে, ক্ষণেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো সে। মনের আরশিতে ভেসে উঠলো, নির্বাণের সাথে কাটানো রেস্টুরেন্টের মূহুর্তগুলো। মূলত সেই দৃশ্যের একাংশই কৃত্রিমভাবে বন্দীর করার চেষ্টা করছিল স্পর্শী, কিন্তু সফল হলো না তাতে।
স্পর্শী আনমনে ভাবতে ভাবতে একসময় নির্বাণকে নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দেয়। নির্বাণের সাথে কাটানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত মনে পড়তেই নিজের অজান্তে ভরাট গালে ছেয়ে গেল রক্তিমার দাঢ় প্রলেপ। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো লজ্জালু হাসির সরু রেখা। হঠাৎ মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো রুদ্র নামটি। মনে পড়ে গেল রুদ্রকে বলা তার শেষ উক্তিটি,

“বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার আর আমার বর আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”

বিয়ের কথা সত্যি হলেও, ভালোবাসার কথা তো সত্য নয়। রুদ্রকে উচিৎ জবাব দিতেই সে বলেছিল তার বর তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আদৌ কি এইটা সম্ভব হবে? অগোছালো, অবিন্যস্ত, অনিশ্চিত সম্পর্কটা নির্বাণ গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও আদৌ সে তাকে ভালোবাসতে পারবে কি-না কে জানে? সেই বা কি পারবে নির্বাণকে বাসতে ভালো? উফফ! তার জীবনটা এমন কমপ্লিকেট কেন হলো? স্পর্শী বিতৃষ্ণায় বিরবির করলো,

“সম্পর্কের সমীকরণটা যেখানে অনিশ্চিত, ভালোবাসা সেখানে বিলাসতা।
আর এমনেও আমার ভালোবাসা বলে কিছু নেই, তাই এইসব নিয়ে মাথা ঘামিয়েও লাভ নেই। আমার জীবন ডুবার হলে ডুববেই, নাহলে নতুন দমে উদয় হবে।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাতের থাকা তুলি আর রঙের প্যালেটটা স্টাডি টেবিলের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো স্পর্শী। ওয়াশরুমে গিয়ে রঙে মাখোমাখো হাতটি পরিষ্কার করে নিল। অতঃপর ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পূর্বেই দরজায় কেউ কড়া আঘাত করলো। স্পর্শী সেদিক অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, এগিয়ে গেল। দরজা খোলার পর মুহূর্তেই এক যুবতী নারী বিকট শব্দে বলে উঠল,

“এতক্ষণ লাগে তোর দরজা খুলতে? সেই কখন দরজা পিটাচ্ছি আমি।”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে ক্ষণেই স্পর্শীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি এক হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে সে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

“তুমি আসলে কবে সামান্তা আপু? আর তুমি যে বাসায় আসবে তা আমাকে আগে জানাও নি কেন?”

সামান্তার রুক্ষ কন্ঠে বলে, “রুমবন্ধ করে বসে থাকলে দেখবি কিভাবে কখন আসছি? আর তোকে না বলে কি এই বাসায় আসা যাবে না?”

“এত রাগছ কেন আজিব?”

সামান্তা ভেংচি কেটে বলে, “রাগবো না তো কি করবো? রুম বন্ধ করে করিসটা কি?”

“পেন্টিং করছিলাম। আচ্ছা, ভাইয়া আসেনি?”

স্পর্শী দরজার কাছ থেকে সরে আসতেই সামান্তা রুমের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “এসেছিল, তবে চলে গিয়েছে। ঘন্টাখানেকের মাঝে চলে আসবে।”

স্পর্শী অসন্তোষজনক কন্ঠে বলে, “এ কি? আমাকে তুমি বা মা ডাকবা না? ভাইয়া কি মনে করলো বলতো?”

সামান্তা বিছানার এক কোণে বসে পার্শিয়ার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, “সে এইসব নিয়ে এত একটা ঘামায় না। পরে আসলে দেখা করে নিস।”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুম গুছিয়ে নিতে থাকলো। সামান্তা ক্ষণে বলে উঠলো, “শুনলাম বিয়ে করেছিস। আমাকে ছাড়াই বিয়ে করে ফেললি? আমি ইন্ডিয়ায় ছিলাম বলে আমার কথা একবারও ভাবলি না?”

স্পর্শী একপলক তাকালো সামান্তার পানে, স্মিত কন্ঠে বলল, “তুমি কি আমার বর নাকি যে তোমাকে ছাড়া বিয়ে করা যাবে না?”

“বর না হই বোন তো নাকি?”

স্পর্শী নিজের কাজ করতে করতে বলে, “বিয়েটা হুট করেই হয়েছে। নিজেই তো জানতাম না সেদিন আমার বিয়ে তোমায় কিভাবে জানাবো? আর তুমিও তো তখন নেটওয়ার্কের বাহিরেই ছিলে। জানাতাম কিভাবে?”

“হ্যাঁ মামীর কাছে শুনলাম, এনগেজমেন্ট হওয়ার বদলে তারা নাকি ডায়রেক্ট আকদ করে রেখে গিয়েছে। তবে, ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড নাকি খারাপ না।”

“হুম।”

সামান্তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “বিয়েটা কি তুই স্বেচ্ছায় করিস নাকি মামা-মামীর জোরাজুরিতে?”

“আমার উপর কি কারো জোর চলে? নিজের ইচ্ছাতেই করেছি বিয়েটা।”

সামান্তা কিছুটা বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে রুদ্র? ওর সাথে না তোর প্রেম ছিল।”

‘রুদ্র’ নামটা শুনেই স্পর্শীর বিরক্তিতে মুখ ঘুচে আসে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে সে বলে,”ওর নাম নিবা না তো। ওর নাম শুনলেও এখন আমার গা ঘিন ঘিন করে।”

“কি হয়েছে? কোন ঝামেলা কি হয়েছে? বল আমায়।”

স্পর্শী কিছুটা সময় চুপ থেকে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। সব গোছানো শেষে নীরবেই গিয়ে বসলো সামান্তার কাছে। দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে সব শুরু থেকে বলতে থাকলো। সবটা শুনে সামান্তা থ মেরে বসে থাকে। দৃষ্টিতে তার অপার বিস্ময়।

“তার মানে ওই ছেলে পুরো ছয়টা মাস তোর পিছে একটা বাজির জন্য ঘুরেছিল? ভালোবাসার অভিনয় করেছিল?”

স্পর্শী তিক্ত কন্ঠে বলে, “বিছানায় নেওয়ার জন্যও বটে।”

“মানুষ ঠিকই বলে, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।”

“হুম।”

কিছুটা সময় নিঃশব্দে কেটে যাওয়া পর সামান্তা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা! তুই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিলি কেন? রুদ্রের উপর রাগ করে?”

“রুদ্রের উপর রাগ ছিল তবে তার চেয়েও বেশি আমার কষ্ট হচ্ছিল এইভেবে ওই রাস্কেলটার জন্য আমি দুইটা মাস প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের কাছে মিথ্যা বলেছি। মা বার বার বারণ করা সত্ত্বেও রিলেশনে গিয়েছি এবং তাকে জানাইওনি। প্রতারণা করেছি তাদের সাথে। অথচ তারা কত ভরসা করতো আমায়, কখনো কোন কিছুতে বাঁধা দিত না। আমি যখন যা চেয়েছি তাই দিয়েছি। নিজের মত চলতে দিয়েছে। সব ভেবেই তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল মনের ভিতর। প্রত্যেক্ষভাবে না হোক পরোক্ষ ভাবে তো বাবা-মাকে কষ্ট দিয়েছিলাম আমি। তাই বাবা যখন বললো তিনি আমার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করেছেন তখন আমি জেনে না শুনে, না দেখেই ওই সম্বন্ধের জন্য হ্যাঁ বলে দেই। পুরো বিষয়টা ছেড়ে দেই বাবা-মায়ের সীদ্ধান্তের উপর। চাইছিলাম এর মাধ্যমেই সকল হিসাব একত্রে চুকিয়ে দিতে। সাথে নিজের মনকে শান্ত করতে। কিন্তু তাও তো শান্তি মিললো না। পোড়া কপাল আমার।”

“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়েছেই। তা ভেবে এত লাভ নেই। বিয়েটা তুই এখন মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর। হুট করে সব হয়ে যাওয়ায় সবকিছু হয়তো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।”

“বিষয়টা বিয়ে পর্যন্ত হলেও হতো। কিন্তু এইখানে বিষয়টা ভিন্ন।”

“শুন! বিয়ে বিষয়টা এতও সহজ না। ‘বিয়ে’ শব্দটা ক্ষুদ্র হলেও এর পরিধি কিন্তু অসীম। দায়িত্ব, কর্তব্য অনেক৷ বললেই সব হয়ে যায় না। উপরন্ত, তোর বিপরীত পাশের মানুষটি কেমন প্রকৃতির সেটাও তোকে দেখতে হবে। ধৈর্য ধরতে হয় আর অন্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। তবে আমার ভয় এইখানেই তুই নতুন কাউকে ভরসা করতে পারবি কি-না। যে ধাক্কাটা তুই খেয়েছিস।”

স্পর্শী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “ভরসা করতে পারবো কি-না জানি না তবে ওই মানুষটাকে আমার বড্ড ভরসাযোগ্য মনে হয়। কিন্তু তাও কোনকিছু ঠিক ভাবে ঠাওর করতে পারছি না আমি। সম্পর্কটা আমাদের এখনো অগোছালো।”

“তা কেন?”

“আমার বরই আমার ডিপার্টমেন্টের টিচার। মানে একদিক দিয়ে আমি তার বউও, আবার ছাত্রীও।”

সামান্তার মুখ এইবার বিস্ময়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ফাঁক হয়ে যায়। সে আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলে, “মানে কি ভাই? তুই আগে খোঁজ খবর নিস নি? মামা-মামী জানে বিষয়টা?”

“নিলে কি বিয়েটা হতো? দুইজনের কেউ এই সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। একবারে বিয়ের দিনই দুইজনে দুইজনকে দেখেছি। আর বাবা-মা জানে তিনি অন্য ডিপার্টমেন্টের স্যার, আমার না। জানলে তো হয়েছিলই।”

সামান্তা হেসে বলে, “বাহ! ব্যাপারটা জোস তো৷ তা এইখানে কি সিনেমার মত টুইস্ট আছে নাকি? তোর বর আবার তোকে আগে থেকে পছন্দ করতো নাতো? বিয়ের কারসাজিই ওরই যদি হয়?”

স্পর্শী বিরক্ত হয়ে বলে, “বিয়ের প্রস্তাব ঘটক এনেছিল বইনা। এসব কারসাজি ঘটকের আর কাজী ব্যাটার।”

“আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু এখন তোর সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যা এইখানেই সে আমার স্যার। তাকে আজীবন আমি স্যার চোখেই দেখেছি তাও আবার অপ্রিয় স্যার হিসাবে। হুট করে কিভাবে তাকে বর মানি? তার উপর যতবারই তার সামনে পড়ি বিব্রতবোধ করি। কি রকম এক বিশ্রী অবস্থা।”

“আচ্ছা, স্যারদের কি বিয়ে করা নিষেধ? তোর বর তুই বাদে যাকেই বিয়ে করতো সেও তো স্টুডেন্টই হতো। হয়তো তার না বা অন্য কোরো। বা সে যদি তোর ডিপার্টমেন্টের স্যার না হতো তাহলে কি তোর ভাবনা এক হতো? হতো না। কাকতালীয় ভাবে এখন তোদের ভাগ্য মিলে গিয়েছে। এতে কি করার আছে? এই একটা বিষয়ের জন্য সম্পর্কটা তো আর ঝুলিয়ে রাখা যায় না। যদি তুই সত্যি মুভ অন করতে চাস, নিজের লাইফ গুছিয়ে নিতে চাস তাহলে এইসব বিষয় নিয়ে এত ভাবিস না। মাঝে মধ্যে আমাদের ভাবনার বাহিরেও অনেক কিছু ঘটে কিন্তু আমরা ঠিকই সবকিছুর সাথে কথা ক্ষাপ খায়িয়ে ফেলি। সবটাই সময়ের ব্যাপার। একটু সময় দে, সব দেখবি ঠিক হয়ে গিয়েছে।”

স্পর্শী মন দিয়েই শুনলো কথাগুলো। ভাবলোও বেশ। অতঃপর ক্লান্ত কন্ঠে বলল, “দেখা যাক কি হয়।”

“এইসব নিয়ে এত ভাবিস না। এখন বাহির চল, তোর জন্য কিছু জিনিস এনেছিলাম আমি। চল!”

_________________

এক কাপ ধোঁয়া উঠা চা নিয়ে স্পর্শী বেঞ্চিতে বসলো। গ্লাসে ছোট এক চুমুক বসিয়ে সে মাহিনের দিকে তাকালো, “সামি আর কেয়া কই রে?”

মাহিন বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, “সামির এখন ক্লাস আছে আর কেয়া মনে হয় লাইব্রেরি গিয়েছে।”

“তুই কি পড়ছিস?”

মাহিন প্রত্যুত্তর করার পূর্বেই নিধি এক প্লেট খিচুড়ি নিয়ে বসলো স্পর্শী পাশে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “পরশু লেডি হিটলার ক্লাস টেস্ট নিবে বলছিল না? মোটু তো ওই টপিকের ক্লাস মিস করে গিয়েছিল তাই এখন নিজে নিজে পড়ে দুনিয়ায় উল্টে ফেলছে।”

স্পর্শী চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলে, “অহ আচ্ছা। তা নন্দিতার কি খবর রে? বরিশাল থেকে আসে নাই এখনো?”

মাহিন প্রত্যুত্তরে বলে, “না। পরশু ফোন দিয়েছিলাম ওকে৷ আসতে নাকি আরও এক সপ্তাহ লাগবে।”

নিধি মুখ ভর্তি খাবার নিয়েই বলে, “মাইয়া যে কি করতে গিয়েছে ওইখানে কে জানে? কিছু জিগাইলে কয়ও না। বেদ্দব একটা!”

স্পর্শী বলে, “ওর বাবা অসুস্থ জানিসই তো। তাহলে এইভাবে বলিস কেন?”

“একমাস হতে চললো ভাই, ওই লাপাত্তা। এমনে কমু না তো কেমনে কমু কো?”

মাহিন একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আগে মুখের খাবার গিলে নে, তারপর কথা বল। খাবারের ছিটা গায়ে আসে ভাই।”

নিধি তীক্ষ্ণ চোখে একবার মাহিনের তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিল। মাহিনও সে দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে বইয়ের মাঝে ডুব দেয়। স্পর্শী নিজের চা শেষ করে বলে, “তোরা থাক, আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছি। কেয়ার সাথে একটু দরকার আছে আমার, আবার কিছু বইও কালেক্ট করতে হবে।”

নিধি মুখভর্তি খাবার চিবুতে চিবুতে বলে, “আচ্ছা যা।”

স্পর্শী ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় লাইব্রেরির দিকে।

______________

লাইব্রেরিতে এসে আগে স্পর্শী কেয়ার খোঁজ করলো। কিন্তু কোথাও ওকে না দেখে নিজের বইগুলো খুঁজতেই ব্যস্ত হলো। লাইব্রেরিতে আজ এত মানুষ নেই, মধ্য দুপুর বলেই হয়তো। স্পর্শী সেদিকে এত একটা ধ্যাণ দিল না, আপন মনে নিজের কাজ করতে থাকলো। একদম লাস্ট কিনারে এসে সে থমকালো। ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকালো সামনে। একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে সবচেয়ে উঁচু সেল্ফের উপরে কিছু একটা খুঁজছে নির্বাণ। ঘর্মাক্ত শরীরে ইন করা চেক শার্টটি শ্যাম বর্ণ গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। মুখে কাপড়ের তৈরি কালো রঙের একটি মাস্ক। মাস্ক পরিধান করা সত্ত্বেও স্পর্শী কিভাবে যেন একপলকেই চিনে ফেললো নির্বাণকে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো তাকে, আনমনেই এগিয়ে গেল কয়েক কদম। যেতে যেতে নির্বাণের খুব নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
হঠাৎ কারো অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরে নির্বাণ নিচে তাকায়। পরমুহূর্তেই স্পর্শীকে তার নিকটে দেখে ভড়কে যায় সে। যার দরুণ, টুলটা নড়েচড়ে উঠে। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে ফেলবে এমন দশা। নির্বাণকে পড়ে যেতে দেখে স্পর্শী কি করবে বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধির মত দু’হাত দিয়ে নির্বাণের পা শক্ত করে ধরে। এতে নির্বাণ আরও বেসামাল হয়ে পড়ে, কোন মতে বইয়ের সেল্ফটা ধরে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখে। অতঃপর স্পর্শী দিকে তাকিয়ে ধমকের বলে,

“পা ধরেছ কেন ইডিয়ট? টুল ধরো।”

নির্বাণের ঝাড়িতে স্পর্শীর টনক নাড়ে। সে দ্রুত নির্বাণের পা ছেড়ে দিয়ে টুল ধরে। নির্বাণ এইবার আস্তেধীরে নিচে নেমে আসে৷ অতঃপর স্পর্শীর দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে বলে,

“কমনসেন্স নাই তোমার? তুমি টুল না ধরে আমার পা ধরেছ কোন আক্কেলে? এখনই তো পড়তাম আমি।”

স্পর্শী এইবার বিব্রতবোধ করে বলে, “না মানে..”

“আমার পদধূলি নিয়ে আমাকে সম্মান জানাতে হলে বাসায় গিয়ে নিও, এইখানে আমার হাড়-গোড় ভেঙে নিতে হবে না।”

কথাটা বলেই নির্বাণ দ্রুত পায়ে হেটে চলে যেতে থাকলো। আর স্পর্শী সেদিকেই হা করে তাকিয়ে থাকলো। সম্পূর্ণ ঘটনাই যেন তার মাথার উপর দিয়ে গেল। কিছু বুঝার উঠার আগে নির্বাণ পুনরায় ফেরত আসলো। কন্ঠস্বর নামিয়ে শানিত ভাবেই বলল,

“ভুলেও কোন টুলে উঠবা না। কোন বই যদি উপরে থাকে তাহলে লাইব্রেরিয়ানকে বলবা৷ নিজে মাতব্বরি করতে যাবে না।”

স্পর্শীকে পুরো বিষয়টা হজম করে প্রত্যুত্তর করার সুযোগ না দিয়েউ নির্বাণ আবার হাঁটা দেয়। দেখতে দেখতে দৃষ্টির আড়ালও হয়ে যায় সে। স্পর্শী কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। নিজের কপাল নিজেই চাপড়ে বলে,

“এইটা কি হলো? ওই সময় টুল না ধরে পা ধরলাম কেন আমি? কেন? এই হাঁদার মত কাজ কেন করলাম আমি? উফফ! কি এক বিশ্রী অবস্থা। আমি এখন মুখ দেখাবো কিভাবে স্যারের সামনে?”

নিজের উপর নিজেই প্রচন্ড বিরক্ত হলো স্পর্শী।নিজেকে এখন কয়েকটা থাপ্পড় মারতে পারলে শান্তি পেত। কোন কুলক্ষণ সময়ে যে এসেছিল লাইব্রেরিতে আনমনে বিরবির করল,

“মানুষের লাইব্রেরিতে প্রেমের সূচনা হয় আর আমার ইজ্জতের প্লাস্টিক সার্জারি হয়।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১০

রঙিন ফুলের আঁকেবাঁকে সবুজ পাতাগুলো জানান দিচ্ছে চৈত্রের বিদায়ের। বসন্তের শেষবেলায় সোনাপাতি ফুলের মতো চারদিক আলোকিত করা পুষ্পরাজি সোনারঙের সৌন্দর্যের বাহার ছড়িয়ে গিয়েছে। বাতাসে ভাসছে বৈশাখের সৌরভ। বাংলা নতুন বৎসরকে বরণ করতেই মেতে উঠেছে বাঙ্গালী। জাবির প্রাঙ্গণ সজ্জিত হয়েছে আজ নতুন দমে। শুভ্র-রক্তিমের ছড়াছড়ি চারদিকে৷ স্পর্শী আজও গায়ে আটপৌরে শাড়ি জড়িয়ে নিজ কাজে মগ্ন। আশেপাশের কোনদিকে তার ধ্যান নেই। তারই বেখেয়ালির সুযোগ নিয়ে আড়ালে থেকে নিজের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে দূরান্তে অবস্থিত প্রেমিক পুরুষের মনটি। দৃষ্টির কোনায় কোনায় ছেঁয়ে আছে তার বেহায়াপনা। তার অতি চরিত্রবান পুরুষের সার্টিফিকেটটি আজ হয়তো মেয়াদউত্তীর্ণ হয়েই গেল। বিরবির করল সে,

— এই মেয়ে দেখছি আমাকে কলঙ্কিত না করে ছাড়ছে না। চরিত্রে বুঝি এইবার আমার কলঙ্ক লেগেই গেল। এই জন্যই মানুষ বলে, মেয়েলি দোষ পুরুষজাতির অধঃপতনের মূল।

অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিল সে। অনেক কাজ বাকি।

______________

সময় এসে মধ্যাহ্নে স্থির হয়তেই বেড়ে যায় রোদের প্রখরতা। বাতাসেও যেন কারফিউ জারি হয়ে যায়, উত্তপ্ততায় এইবার ঘেমে-নেয়ে উঠে সমস্ত নগরী। কিঞ্চিৎ আরামের আশায় বটতলার ছাউনির নিচে জড়ো হয় সকলে। তপ্ত হয়ে আসা অন্তরকে শান্ত করতে ছুট দেয় কোমল পানীয়র খোঁজে। মাহিন হাতে পাঁচটা ঠান্ডা কোকাকোলা নিয়ে হাজির হতেই সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর। হাতে একটা বোতল পাওয়া মাত্রই নিজের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুটা সময় পর স্বস্তি অনুভব করতেই নিধি বলে,

“জানে জান আইলো এইবার। গরমে তো বয়েল মুরগী হয়ে গেসিলাম।”

কেয়া অবসন্ন কন্ঠে বলে, “আসলেই আজকে অনেক গরম পড়েছে রে। বুঝি না, বৈশাখের প্রথম দিনই এত গরম পড়ে কেন?”

মাহিন ক্লান্ত স্বরে বলে, “গরম তো গরম। তার উপর কাজের বাহার। আজ কাজ করতে করতে বেহাল দোষা আমার। যতসব ফাংশনের দায়িত্ব আমাদের উপর এই আসে। শালা, ঠিক মত অনুষ্ঠানও ইনজয় করতে পারি না।”

সামি হেসে বলে, “ভাগ্যিস! আমি তোদের ডিপার্টমেন্টের না। নাহলে জীবন আমার তেজপাতা থেকে কয়লার কারখানা হতে সময় নিত না।”

নিধি তিক্ত কন্ঠে বলে, “কাঁটা গায়ে নুন দিতে বলসে তোকে কেউ? মুখ বন্ধ রাখ নাইলে চাপা ভেঙে দিব আমি তোর।”

স্পর্শী বোতলে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে বলে, “পটর পটর কম কর, আগে কিছু খেয়ে নে। আবার ভলেন্টিয়ারের কাজে যেতে হবে।”

কথাটা শোনামাত্র সামি ব্যতীত সকলের মুখ কালো হয়ে যায়। তারা সম্মতি জানিয়ে নিজের মনমত খাবার অর্ডার দিল। স্পর্শী এক প্লেট খিচুড়ি অর্ডার দিয়ে নিজ জায়গায় এসে বসতেই ওর ফোনের মেসেজ রিংটোনটা বেজে উঠে। স্পর্শী মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করে। নির্বাণের মেসেজ,

“পাঁচটার দিকে গাড়িতে গিয়ে বসো।”

স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে নিজের ফোনের দিকে তাকায়। আনমনে বলে, “আবারও!”

_______________

গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দু’টি বন্ধ করে শুয়ে আছে স্পর্শী। বিতৃষ্ণায় মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে তার। ঘর্মাক্ত শরীরে আড়ষ্টভাবেই লাল পাড়ের শুভ্র শাড়িটি জড়িয়ে আছে। গরমের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতেই স্পর্শী উঠে বসে খোলা চুল গুটিয়ে নিয়ে হাতখোঁপা নেয়। সামনে রাখা বক্স থেকে টান দিয়ে পরপর দু’টা টিস্যু নিয়ে সিক্ত কপাল,নাক,গলদেশে ছোঁয়ায়। অপেক্ষার কাটা মিনিট দশেক পেরিয়ে পনেরোর ঘর ছুঁইছুঁই। অথচ আজও নির্বাণের খোঁজ নেই। ইতিমধ্যে গরমে স্পর্শীর বেহাল দশা, দমবন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। স্পর্শী নির্বাণকে ফোন করবে বলে ফোন হাতে নিতেই নির্বাণ এসে হাজির হয়। গাড়িতে উঠে বসতেই স্পর্শী অধৈর্য্য হয়ে বলে,

“কোথায় ছিলেন? এত দেরি লাগে আসতে? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। এখন, দ্রুত এসিটা ছাড়ুন প্লিজ। গরমে আমার জান যায় যায় অবস্থা।”

অকস্মাৎ স্পর্শীর কথার আক্রমণে নির্বাণ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় তার পাণে। স্পর্শীর কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। সাথে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অধিকারবোধ৷ আজ স্পর্শী অধিকার খাটিয়েই নির্বাণকে প্রশ্ন করছে, তার কাছে কৈফিয়ত চাইছে। বিষয়টা নির্বাণের নিকট কেমন যেন ঠেকলো।
ঘটনাক্রমে বুঝতে পেরে নির্বাণ কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “আমার বউ হওয়ার প্র‍্যাকটিস কি এখন থেকেই শুরু করছো নাকি? কৈফিয়ত চাইছো আমার কাছে।”

নির্বাণের এহেন প্রশ্নে স্পর্শী ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। গোলগাল চোখে তাকিয়ে থাকে নির্বাণের পানে। অতঃপর কিছুক্ষণ পূর্বেই বলা তার কথাগুলো মনে পড়তে স্পর্শী মিইয়ে গিয়ে বলে,

“না মানে.. আমি আসলে..”

“আসলে নাকি নকলে জানতে চাইনি। সরল একটা প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর চেয়েছি।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর না করে দৃষ্টি নত করল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকেই মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, “বউ হওয়ার প্র‍্যাকটিস করবো কেন? আমি তো অলরেডি আপনার বউই।”

স্পর্শীর এমন উত্তরে নির্বাণ ভিতরে ভিতরে খানিকটা অবাক হলো। তবে অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করলো না। কিঞ্চিৎ হেসে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করলো সে। অতঃপর এসিটা ছেড়ে দিয়ে বলল,

“সামনের সপ্তাহে আমার একটা কাজিনের বিয়ে আছে সিলেটে। সেখানে আমরা সবাই যাচ্ছি। তো মা চাইচ্ছেন তুমিও যাতে আমাদের সাথে সেখানে চল।”

স্পর্শী অবাক হয়ে বলে, “আমি? আমি কিভাবে?”

“কিভাবে আবার কি? বউ তুমি আমার, সে পরিচয়ে যাবে। আর মাও চাইছেন সকলের সাথে তোমাকে একবারে পরিচয় করিয়ে দিতে।”

‘আমার বউ তুমি’ কথাটা কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতেই স্পর্শী বুকটা ধ্বক করে উঠে। অজানা শিহরণ খেলে যায় মনের মাঝে। স্পর্শী কতক্ষণ থম মেরে বসে থেকে নিজেকে ভিতরে ভিতরে গুছিয়ে নিয়ে বলে,
“বিষয় সেটা না। সামনেই তো আমাদের ক্লাস টেস্ট, সে সাথে আমার আবার ল্যাবে প্রেকটিক্যাল ক্লাসও আছে। সেগুলো রেখে আমি কিভাবে যাব?”

“সব করেই তারপর যাবে। বিয়ে এপ্রিলে ঊনত্রিশ তারিখ। মা আর নাহিদ আগেই যাবে, তবে আমি না। এক্সামের জন্য আমি দেরিতে যাব। তাই তোমার এক্সাম আর প্রেকটিক্যাল শেষ হলে আমার সাথেই যাবে তুমি।”

স্পর্শী কিছুটা সময় নীরব থেকে বলে, “আমি বাসায় না জানিয়ে কিছু বলতে পারছি না। মাকে আগে…”

স্পর্শীর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই নির্বাণ বলে উঠে, “সেটা মা বুঝে নিবে। তোমাকে এই বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না।”

স্পর্শী কথা বাড়ালো না। দু’দিকে মাথা হেলিয়ে শুধু সম্মতি জানালো। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কেটে যেতেই নির্বাণ ধীর গতিতে স্পর্শীর দিকে ঝুঁকলো। নির্বাণকে ঝুঁকতে দেখে স্পর্শী কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিচলিত হলো। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বেই নির্বাণ স্পর্শীর পাশ থেকে সিটবেল টেনে এনে লাগিয়ে দেয়। অতঃপর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্পর্শীর পানে। মাঝে মধ্যে দৃষ্টি গিয়ে থমকায় কাজল কালো চোখে ও রক্তিমা প্রলেপে আবৃত ঠোঁট জোড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই অতিবাহিত হয়ে যেতে নির্বাণ স্পর্শীর নিকট হতে সরে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
“এই লিপস্টিকটাই তুমি সেদিন দিয়েছিলে না? স্বাধীনতা দিবসের দিন?”

স্পর্শী থতমত খেয়ে বলে, “মনে হয়।”

“তুমি আর কখনো এই লিপস্টিকটা দিবে না।”

স্পর্শী হতবিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মানে? কেন?”

“আমি বলছি তাই।”

“মানে কি?”

নির্বাণ এইবার কন্ঠস্বরে একরাশ কাঠিন্যতা মিশিয়ে বলে, “মানে এইটা তোমার এই লিপস্টিকের কালার আমার সহ্য হয় না। বেসামাল হয়ে যাই আমি।”

শেষের কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে গাড়ি স্টার্ট দিল। মুহূর্তেই গাড়িটি চলতে শুরু করলো। যার দরুন স্পর্শী শেষ উক্তিটির আংশিকও ঠিক মত শুনতে পেল না। শুধু হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নির্বাণের পানে। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। বলার মত উপযুক্ত কিছু পেলই না সে, কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১১

ফিনফিনে কালো রঙের ইয়ারফোনটি কানে গুঁজে, হাতে এককাপ ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে বারান্দায় এসে বসে স্পর্শী। শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় সাঁঝ আকাশে। এক ফোটা রক্তিমা ছেঁয়ে আছে শুভ্র মেঘের কোলে। উড়ন্ত পাখির দল ছুটছে নিজ গন্তব্যে। স্পর্শী সেদিকে তাকিয়েই আনমনে কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মুহূর্তেই জিহ্বা পুড়ে যায় তার কফির উত্তাপে। বিতৃষ্ণায় স্পর্শী কফি কাপের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, যেন সব দোষ কফির। কিছুক্ষণ সেই ভঙ্গিতেই তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে। পুনরায় ঠোঁট ছোঁয়ায় কফিতে। হঠাৎ তার হাতে থাকা মুঠোফোনটি বেজে উঠে। স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়। কৃত্রিম আলোকরশ্মি পর্দায় ইংরেজি অক্ষরে টাইপ করা ‘নিধি’ নামটি ভাসছে। স্পর্শী ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার পূর্বেই বলে উঠে,

— দোস্ত! আমি বিয়া করুম। এই পড়ালেখা আমার দ্বারা হচ্ছে না।

স্পর্শী বিরক্তিতে মুখ গুচে বলে, “আবার শুরু হইসে তোর ঘ্যানঘ্যানানি?”

— আরেহ দোস্ত এইবার আমি সিরিয়াস। একদম পাক্কা সিরিয়াস। শেখ হাসিনা যেমন পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সিরিয়াস তেমনই আমিও বিয়া নিয়া সিরিয়াস। বিয়া আমি এইবার কইরাই ছাড়ুম।

— কারে করবি বিয়ে শুনি?

— এখনো ঠিক করে নি তবে অতি দ্রুত করে ফেলবো। আর তোরা আছিস কি করতে? আমার জন্য এখনই ছেলে দেখা শুরু কর। জটপট!

— পরীক্ষা আসলেই তোর বিয়ে করার ক্যারা উঠে কেন শুনি?

–শুন, পরীক্ষা দেওয়ার চেয়ে বিয়ে করে সংসার সামলানো বেশি সহজ বুঝলি। সংসার চালাতে এট লিস্ট এই বিক্রিয়ার চক্করে মস্তিষ্কের বিস্ফোরণ তো হয় না।

স্পর্শী এইবার রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “তুই আমার মাথা না খাইয়া পড়তো। পড়বি না তো কিছু না, আমার মাথাটা খাবি। রাখ ফোন!”

— আচ্ছা শুন না! পঞ্চম অধ্যায়ের লাস্ট বিক্রিয়াটা বুঝিয়ে দে না।

স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে বলে, “তুই পঞ্চম অধ্যায় দিয়ে কি করবি? পরীক্ষা তো সপ্তম অধ্যায় আর ম্যামের দেওয়া নোটসের উপর।”

নিধি তটস্থ কন্ঠে বলে, “এ্যাঁহ! আমি তাইলে হুদাই এতক্ষণ লাগাইয়া এই অধ্যায় করতাম?”

স্পর্শী নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

নিধি এইবার কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে, “দোস্ত এইবার আমি সত্যি বিয়াই করুম। পড়ালেখা জাস্ট আমার দ্বারা একদমই হবে না। বিশ্বাস কর।”

স্পর্শী নিঃস্পৃহ কন্ঠে নিধিকে একটা কটুকথা শুনিয়ে ফোনটা খট করে কেটে দেয়। উগ্র মেজাজেই ঠোঁট ছোঁয়ায় কাঁপে। পরক্ষণেই বুঝতে পারে নিধির চক্করে কফি চিনির শরবত হয়ে গিয়েছে। চিনি ব্যতীত স্বাদ নেই কোন। স্পর্শী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়, রান্নাঘরের দিকে এগোয় কফিটা গরম করতে।

রান্নাঘরে এসে চুলোয় কফি চড়াতেই সাহেলা এসে হাজির হন। একপলক চুলোর দিকে তাকিয়ে বলেন,

— কাজ শেষে রুমে আসিস তো কথা আছে।

স্পর্শী চুলোর দিকেই মনোযোগ দিয়ে বলে, “আচ্ছা।”

সাহেলা চলে যেতেই স্পৃহা আসে রান্নাঘরে। আড়চোখে একবার স্পর্শীকে দেখে এগিয়ে যায় শেল্ফের দিকে। উপরের থাক থেকে একটা প্লাস্টিকের বক্স নামিয়ে তার ভিতর থেকে এক প্যাকেট চিপস নিয়ে বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত না হতেই আবার ফিরে আসে সে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

“আপু আমার বায়োলজি প্রেকটিক্যালটা একটু করে দিবা?”

স্পর্শী কাপে কফি ঢেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় স্পৃহার দিকে। নিঃস্পৃহ কন্ঠে বলে, “নিজের কাজ নিযে কর, আমাকে বলিস কেন? বিনা বেতনের চাকর পাইছিস যে তোর সব কাজ করে দিব?”

“এমন করিস কেন? একটু দে না।”

স্পর্শী স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে, “আমি এখন ব্যস্ত। পরীক্ষা চলছে আমার। কোন রকম প্রেকটিক্যাল-মেকটিক্যাল করার টাইম নাই আমার। এখন ফুট এইখান থেকে।”

স্পৃহা কথা বাড়ালো না। ভেংচি কেটে বিরবির করতে করতেই জায়গাটি প্রস্থান করলো। স্পর্শীও কফির কাপটি হাতে নিয়ে ছুটলো সাহেলার রুমের দিকে।

___________________

“নির্বাণের মা চাইছেন তুই যেন তাদের সাথে তার আত্মীয়ের বিয়েতে যাস। তোর কি কোন আপত্তি আছে যেতে?”

সাহেলার প্রশ্নে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়। নির্বিকার কন্ঠে বলে, “সমস্যা নেই তবে আমার পরীক্ষা চলছে। এখন যেতে পারবো না।”

সাহেলা ধাতস্থ হয়ে বলেন, “হ্যাঁ জানি। বলেছিলাম তাকে, তিনি বললেন নির্বাণও নাকি এখন যাচ্ছে না। পরে যাবে। আর যাওয়ার সময় তোকে সাথে নিয়েই যাবে বলেছে।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না, নীরবেই মাথা নাড়ালো শুধু। সাহেলা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার প্রশ্ন করলেন, “তোর নির্বাণের সাথে যেতে কোন সমস্যা আছে? আমি কি বলবো তুই যাচ্ছিস?”

স্পর্শী অনুরাগহীন কন্ঠে বলে, “না নেই। তুমি বলে দাও তাদের।”

সাহেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। অতঃপর কিঞ্চিৎ হেসে স্পর্শীর তাকিয়ে বলেন, “আচ্ছা তাহলে আমি তাদের জানিয়ে দিচ্ছি।”

________________

শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে বের হতেই স্পর্শী অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় চারদিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে বন্ধুদের আড্ডামহলে। বাকিরা আগে ভাগেই পরীক্ষা শেষ করে ছুটেছে বটমূলের দিকে।
যাওয়ার পথেই কিঞ্চিৎ দূরবর্তী একস্থানে স্পর্শীর দৃষ্টি আঁটকায়। নিমগাছের শৈথিল্য ছাউনির নিচে দাঁড়ানো তাপসি আর নির্বাণের দিকে। কোন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে দুইজন। তাদের দুইজনকে একত্রে দেখামাত্র স্পর্শী থমকায়, প্রগাঢ় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে দুইজনকে। একমনে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের পানে৷ বেশ কিছুটা সময় এইভাবেই অতিক্রম হওয়া মাত্র কোথ থেকে কেয়া এসে হাজির হয় স্পর্শীর সামনে। ডান হাতে তুরি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কি রে এইখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

স্পর্শী একপলক কেয়ার দিকে তাকিয়ে পুনরায় নির্বাণের দিকেই তাকিয়ে বলে, “এভাবেই।”

কেয়া স্পর্শী দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে বলে, “কাকে দেখছিস তুই?”

স্পর্শী দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “কাউকে না।”

কেয়ার নজর হঠাৎ তাপসি আর নির্বাণের উপর এসে স্থির হতেই সে বলে উঠে, “এই এইটা হিটলার আর লেডি হিটলার না?”

স্পর্শী স্মিথ কন্ঠে বলে, “হুম, হয়তো।”

“এই দুইজন এইখানে কি করে? এক্সামে বাঁশ দিয়ে মন ভরে নাই যে এখন আমার নতুন প্ল্যানিং করতে লেগে পড়সে?”

“চুপ থাক।”

“চুপ থাকলেও কি হবে? জানিস আমার পরীক্ষার অবস্থা যাচ্ছে তাই। এত হার্ড প্রশ্ন কেউ দেয়? এই দুইজনের কোন পাঁকা ধানে মই দিসিলাম আমি? এমন শুক্রামিপানা করে কে?”

“তারা সবসময়ই হার্ড কুয়েশ্চন করে। জানা কথা।”

“হুম! জীবনটাই তেজপাতা করলো এরা। দোয়া দিলাম এদের কপালে যেন দজ্জাল বা শাকচুন্নি জীবন সঙ্গী পড়ে। অথবা দুইজনের সাথে দুইজনের বিয়ে হয়ে হিটলার ময় জীবন হয়।”

কথাটা শুনে স্পর্শী চোখ পাকিয়ে তাকায় কেয়ার দিকে। কর্কশ কন্ঠে বলে, “বাজে বলা বন্ধ কর।”

“তোর গায়ে লাগে কেন এত? তোরে কিছু কইসি আমি?”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। শুধু নীরব দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো নির্বাণকে। অকস্মাৎ কেয়া বলে উঠে, “তবে দুইজনকে খারাপ মানায় না পাশাপাশি। কাপল হিসাবে ভালোই লাগবে তাদের।”

কথাটা স্পর্শী কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র স্পর্শী ক্রোধে ফেটে পড়ে। তীব্র কন্ঠে বলে, “তুই যা তো এখন সামনে থেকে নাহলে আমার হাতে সেই কেলানি খাবি।”

“আরেহ ভাই করলামটা…. ”

সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বেই কেউ এসে জানায় কেয়াকে আফসানা মিস খুঁজছে। কেয়া সেটা শোনামাত্র স্পর্শীকে বিদায় জানিয়ে ছুটে আফসানা মিসের কেবিনের দিকে। কেয়া চলে যেতেই স্পর্শী পুনরায় প্রখর দৃষ্টিতে তাকায়। নির্বাণের ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা সুক্ষ্ম হাসিটি চোখে বিঁধে তার৷ সেই সাথে তাপসির প্রসন্নচিত্তের হাসি দেখে গা জ্বলে উঠে। কেয়ার বলা কথাটা পুনরায় টনক নারতে ঈষৎ ঈর্ষা কাজ করতে শুরু করে মনের মাঝে। ক্ষণেই সে ক্রোধিত কন্ঠে বিরবির করে বলে,

“কাপল হিসাবে তাদের অতি জঘন্য দেখায়। পাশাপাশি একটুও মানায় না তাদের।”

কথাটা বলেই স্পর্শী লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় মূল সড়কে দিকে।

________________

বাসায় এসেই স্পর্শী নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। রাগে তখনও সে ফুঁসছে। এত রাগ কেন বা কিসের প্রতি সে জানে না। তবে রাগে তার মন-মস্তিষ্ক অচল হয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতেই স্পর্শী দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রেশ হয়ে রুমের দরজা-জানালা বন্ধ করে পর্দাগুলো টেনে দেয়। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রাখে সে। অতঃপর কম্বল মুড়ি দিয়ে পাড়ি জমায় ঘুমরাজ্যে।
দুপুরের পর দেওয়া ভাতঘুমটা গিয়ে একবারর ভাঙ্গে সূর্যাস্তের ঠিক কিঞ্চিৎ প্রহর পরে। দরজায় কড়া আঘাতের শব্দে। স্পর্শী ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখে পিটপিটিয়ে তাকায়। আলসে দেহটাকে কোনমতে টেনে নিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে৷ দরজা খুলতেই সাহেলা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,

“এত সময় লাগে গেট খুলতে? কি করছিলি?”

স্পর্শী পরপর দু’বার হামি তুলে বলে, “ঘুমিয়ে ছিলাম। কেন কি হয়েছে?”

সাহেলা হাতের ফোনটা স্পর্শীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “নির্বাণ করেছে। তোকে চাইছে নে কথা বল।”

কথাটা কর্ণপাত হওয়ার পর মূহুর্তেই স্পর্শী কপালে ভাঁজ পড়ে। সে স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে, “কি বলছো এইসব? সে কেন আমাকে চাইবে? ভুল শুনেছ হয়তো বা।”

সাহেলা এইবার রেগে গিয়ে বলেন, “কলে আছে ওই। ধর তুই ফোন, কথা বল ওর সাথে।”

স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত রেখেই ফোনটা হাতে নেয়। কানের কাছে ফোন নিয়ে ‘হ্যালো’ বলা মাত্র নির্বাণ ভরাট কন্ঠে বলে উঠে, “ফোন কই তোমার? কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি কোন খেয়াল আছে?”

অকস্মাৎ নির্বাণের গম্ভীর কন্ঠ শুনে স্পর্শী হকচকিয়ে যায়। চোখের কোনে লেগে থাকা অবশিষ্ট ঘুম ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয় অজানার উদ্দেশ্য। সে তটস্থ চোখে তাকায় সাহেলার দিকে। সাহেলা কিছু না বলে নীরবে নিজ স্থান ত্যাগ করেন।
স্পর্শীকে নিরুত্তর দেখে নির্বাণ পুনরায় বলে, “কি হলো কথা বলছো না কেন?”

স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে, “ঘুমিয়ে ছিলাম।”

কথাটা শুনে নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধাতস্থ হয়ে বলে, “ফ্রেশ হয়েছ?”

নির্বাণের কন্ঠ নেমে আসতে স্পর্শী কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে, “না।”

“ফ্রেশ হয়ে আসো, তারপর কথা বলছি।”

“না! সমস্যা নেই৷ আপনি বলুন।”

“কাল রাতে আমরা সিলেটে যাব। সো তুমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।”

“আমরা সেখানে কতদিন থাকবো?”

“এক সপ্তাহ।”

স্পর্শী বেশি কিছু না বলে ছোট করে “আচ্ছা” বলল।

নির্বাণ বলে, “আমি তোমাকে তোমার বাসা থেকে রাত এগারোটার দিকে পিক করে নিব। রেডি থেকো, লেট করবে না।”

“জি আচ্ছা।”

নির্বাণ বেশ কিছুটা সময় চুপ থেকে বলে, “আচ্ছা রাখছি তাহলে।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর না করে শুধু ‘হুম’ বলে। স্পর্শীর উত্তর পেতেই ওপর পাশ থেকে তীব্রভাবে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ সাথে। নিঃশ্বাসের শব্দ স্পর্শী উপলব্ধি করতেই তার গায়ে অজানা শিহরণ বয়ে যায়। ব্যগ্র হয়ে উঠে মন। অতঃপর অপরপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ না পাওয়া স্পর্শী কান থেকে ফোনটা নামায়। কল কেটে গিয়েছে। স্পর্শী এইবার এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। নিজের ফোনটা হাতে নিতেই পর্দায় ভেসে উঠে কাঙ্ক্ষিত মানুষের বিশটি মিসকলড।

________________________

আঁধারিয়া আকাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্রের অজস্র মেলা। এক ফালি চাঁদের অস্তিত্বে প্রসন্ন রজনী। হিম হাওয়ায় ভাসমান অজানা ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা পরিবেশ। বাতাসের বেগ পেরিয়ে গাড়ি উঠে পড়ে হাইওয়ে রোডে। সহস্র গাছ, বিস্তৃত মাঠ-আকাশ পেরিয়ে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে চলছে গাড়িটি। গাড়ির ভিতরের পরিবেশ কিছুটা ছমছমে। ইনার লাইট অফ থাকায় আকাশ হতে আঁধার নেমে এসেছে ভিতর অব্দি। এসি চালু থাকায় ভিতরকার পরিবেশ হিমায়িত। ক্ষণেই নীরবতা ঠেলে স্পর্শী বলে উঠে,

“আপনি কি সারারাত ড্রাইভ করতে পারবেন? সমস্যা হবে না আপনার?”

নির্বাণ দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখেই বলে, “হ্যাঁ পারবো। এর আগেও কয়েকবার গাড়ি দিয়েই সিলেট গিয়েছি আমি।”

স্পর্শী দৃষ্টি নুইয়ে বলে, “তাও সাবধানে চালাবেন।রাতের জার্নি সেফ না।”

নির্বাণ স্মিথ হেসে বলে, “চিন্তা নেই, তোমায় গায়ে আমি একটা আঁচড়ও লাগতে দিব না। ”

কথাটা শুনে স্পর্শী থমকায়। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের দিকে। অজানা এক ভালো লাগার ঢেউ খেলে যায় মনের সমুদ্র পাড়ে। স্পর্শী কিছু বলে না, নিভৃতেই মাথা এলিয়ে দেয় সিটে। সময় গড়িয়ে প্রহরে পদার্পণ করতেই স্পর্শী অতুল ঘুমে তলিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে ঘুমের ঘোরেই এসির হিম বাতাসে তার শরীর কাঁপণ ধরে যায়। নির্বাণ আড়চোখে সেটা খেয়াল করে গাড়ি হাইওয়ের এক সাইডে দাঁড় করায়। অতঃপর সিটবেল খুলে পিছন সিট থেকে নিজের ট্রেভেল ব্যাগটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসে। ব্যাগ থেকে তার একটি জ্যাকেট বের করে সপ্তপর্ণে স্পর্শীর গায়ে জড়িয়ে দেয় আর এসির পাওয়ারটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ কমিয়ে দেয়। অতঃপর ব্যাগটা পুনরায় পিছনে রেখে স্পর্শীর দিকে তাকায়। আঁধারে স্পর্শীর মুখশ্রী স্পষ্ট ফুটে না উঠায় ইনার লাইটটা জ্বালায় নির্বাণ। একান্ত তার মানুষটির ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখার লোভে। হঠাৎ লাইটের অস্পষ্ট আলো স্পর্শীর উপর পড়তে সে ভ্রু কুঁচকে নড়েচড়ে উঠে। কিন্তু পরমুহূর্তে উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। স্পর্শী মাথা এইবার বা দিকে আরেকটু হেলে যায়, মুখের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই কয়েক গাছি চুল এসে ঘাপটি মেরে বসে। ঘুমের মাঝেই স্পর্শী একটু পর পর ঠোঁট উল্টাচ্ছে। তা দেখে নির্বাণ নিঃশব্দে হাসে। ডান হাতের তর্জনী উঠিয়ে খুবই সপ্তপর্ণে স্পর্শীর মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে কানের পিছে দিয়ে দেয়৷ ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঈষৎ ফুঁ দেয় স্পর্শী ভারী পল্লবের উপর। ক্ষণেই সে খানিকটা কেঁপে উঠে। নির্বাণ পুনরায় হাসে,

— কারো চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে নির্বিঘ্নে কিভাবে ঘুমাও তুমি? ঘুমে ব্যাঘাত হয় না?

কথাটা বলে নির্বাণ ধীর গতিতে স্পর্শীর সিটটা পিছনে দিকে হেলিয়ে দেয় যাতে স্পর্শীর ঘুমাতে অসুবিধা না হয়। অতঃপর ইনার লাইটটা অফ করে স্পর্শীর দিকে হালকা ঝুঁকে তার ললাটে নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ ছুঁয়ে দিয়ে উঠে বসে। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে মৃদুকন্ঠে বলে,

— ঘুমোও তুমি, আমি আছি পাহারা দিতে।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১২

নিশীথের শেষলগ্ন পেরিয়ে পুবাকাশে আর্বিভাব হলো প্রভাতের। নির্মল অনিলে ভাসছে পাখিদের মিষ্ট কন্ঠ। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বিকট শব্দ করে রাস্তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে দানব আকৃতির ট্রাকগুলো। সেই শব্দেই ব্যাঘাত ঘটলো স্পর্শীর ঘুমে। ঈষৎ নড়েচড়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো সে। তন্দ্রা কাটেনি তখনও তার, চোখের পাতা বুঝে আসতে চাইছে বারংবার। বহু কষ্টে চোখের কপাট মেলে ধরলো সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো নিজের অবস্থান। নিশ্চল মস্তিষ্কে মনে করার চেষ্টা করলো গতরাতের কথা। নিজের গন্তব্যের কথা মনে পড়তেই পাশ ফিরলো স্পর্শী। কপালে একহাত ঠেশ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নির্বাণ। নির্বাণকে দেখে স্পর্শী নিজের অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর আশেপাশে তাকালো। রাস্তার ধারে কোন এক রেঁস্তোরার সামনে গাড়িটি থামানো। একটানা ড্রাইভ করার পর হয়তো বিরতি নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এইখানে গাড়ি পার্ক করেছে নির্বাণ, ধরে নিল স্পর্শী৷ সে আড়মোড়া ভেঙে উঠতে নিলে নিজের গায়ে জড়ানো কালো রঙের জ্যাকেটটি দেখে থমকালো। স্তম্ভিত, বিমূঢ়, কৌতূহলী চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নিজের দিকে। বিরবির করলো,

“এইটা কার? রাতে তো আমি গায়ে কিছু জড়িয়ে ঘুমাই নেই।”

পরক্ষণেই তাকালো নির্বাণের মুখপানে। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে স্পর্শীর বেগ পেতে হলো না। উপরন্তু, জ্যাকেটের গা থেকে আসা পুরুষালি সুগন্ধি জানান দিয়েই দিচ্ছে নিজ মালিকানার। অজ্ঞাতসারে স্পর্শীর ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসি। পরক্ষণে খেয়াল করলো, তার সিটটি বেশ হেলানো। যেটাও সে করে নি। স্পর্শী পুনরায় তাকালো নির্বাণের দিকে। হাসিটা সমৃদ্ধ হলো এইবার। ধাতস্থ হলো মন, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ছেঁয়ে গেল মুগ্ধতা। সে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। মুখে ক্লান্তির রেশ বুঝা যাচ্ছে প্রখরভাবে। চুলগুলো আগোছালো হয়ে পড়ে আছে কপালে। বাদামী ঠোঁট দু’টি হাইড্রোজেনের অভাবে মরুভূমির দশা। রুক্ষ,শুষ্ক। ধূসর রঙ্গের ফুলস্লিভ শার্টটির হাতা কুনোই অব্দি গোটানো। এই প্রথমবারের মত স্পর্শীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো শ্যাম পুরুষটিকে। মোহগ্রস্ত হলো আগোছালো মানুষটির উপর। সুপ্তভাবেই মনের একাংশ জায়গায় বরাদ্দ হলো একান্ত মানুষটির নামে।
অকস্মাৎ নির্বাণ চোখ খুলে। পাশ ফিরে স্পর্শীর দিকে তাকাতেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মুহূর্তেই স্পর্শী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তটস্থ,ব্যগ্রতা ঘিরে ধরতেই দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকায় সে। নির্বাণ তা দেখে কিঞ্চিৎ হাসে, মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “ঘুমন্ত আমিটার থেকে তার চোখ সরে না আর জাগ্রত আমিটাকে তার চোখে পড়ে না। কি অদ্ভুদ!”

কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র স্পর্শীর মেদুর গালে ছেঁয়ে গেল রক্তিমা। চোখে লজ্জার স্পষ্ট জানান। অভিব্যক্তি ঠিক হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়া চোরের ন্যায়। স্পর্শী দৃষ্টি নত করে নিল, নিজেকেই আনমনে বকলো। কেন সে বেহায়ার মত এতক্ষন তাকিয়ে ছিল তার দিকে? আর নির্বাণই বা কেমন? মুখের উপর কিভাবে বলে দিল কথাটা? এইসব ভেবে পরক্ষণেই নিজের দোষকে লুকায়িত করার বৃথা চেষ্টা করে অস্ফুটস্বরে বলল,

“ভুল বুঝছেন আপনি, আমি আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম না।”

নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে বলে, “আমি কখন বললাম তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে?”

স্পর্শী এইবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে, “তখন না বললেন?”

“আমি তো কারো নাম উল্লেখ করেনি। তুমি কিভাবে বুঝলে কথাটা আমি তোমাকে বলছি? তাহলে কি আমি ধরে নিব তোমার দৃষ্টিতে আমাতে নিবদ্ধ ছিল?”

স্পর্শী তটস্থ হয়ে তাকায় নির্বাণের পানে। মানুষটা যে নিদারুণভাবে কাউকে কথার জাল ফাঁসাতে পারে তা স্পর্শীর জানা হয়ে গিয়েছে। নির্বাণের সাথে কথা বাড়ানো মানেই নিজের পায়ে কুড়াল মারা৷ স্পর্শী নিজের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে নিরুত্তর বসে থাকে। তা দেখে নির্বাণ ঈষৎ হেসে জিজ্ঞেস করে,
“কখন উঠেছ?”

স্পর্শী দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির রেখে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “এইতো কিছুক্ষণ আগেই।”

“আচ্ছা! ফ্রেশ হবে?”

“হওয়া দরকার।”

“তাহলে বের হও। এইখান থেকে ফ্রেশ হয়ে একবারে নাস্তা সেরেই না-হয় আবার রওনা দিব।”

স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানালো। নির্বাণ নেমে পড়তেই স্পর্শীও নীরবে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।

________________

বিস্তৃত এক বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতেই স্পর্শী জানালার বাহিরে তাকায়। অতঃপর নির্বাণের দিকে তাকায় কৌতূহলী দৃষ্টিতে। নির্বাণ স্পর্শীর দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বলে,

“এসে পড়েছি আমরা।”

স্পর্শী এইবার ধাতস্থ হয়। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “বিয়েটা আসলে কার? মা বলেছিল, তবে আমার খেয়াল নেই। ”

“আমার মামাতো ভাইয়ের। এইটা আমার নানাবাড়ি।”

স্পর্শী ঠোঁট গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”

কিছুটা সময় নীরব থেকে নির্বাণ এগিয়ে এলো স্পর্শীর অতি নিকটে। নির্বাণকে কাছে আসতে দেখে স্পর্শী চোখ গোলগোল করে তাকায়। নির্বাণ সে দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে স্পর্শীর দিকে হালকা ঝুঁকে খুলে দিল সিটবেলটি। অতঃপর খুব সপ্তপর্ণে স্পর্শীর পড়ে যাওয়া ঘোমটাটুকু পুনরায় মাথায় তুলে দিয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “নাও পার্ফেক্ট!”

নির্বাণের এত কাছে আসায় স্পর্শীর প্রায় রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। অকস্মাৎ ভাবেই তার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায় কয়েক’শ গুণ। অনুভূতিগুলো জট পাকিয়ে আসে। নির্বাণ ওর কাছ থেকে সরে আসতেই স্পর্শী দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নেয়। নির্বাণ তা দেখে বলে,

” নামো এখন।”

স্পর্শী বিনাবাক্যে নেমে পড়লো। অভিব্যক্তি এমন সে আর এক বিলম্ব নির্বাণের নিকট অবস্থান করলে তৎক্ষনাৎ হার্ট এট্যাক করে মারা পড়বে। লজ্জালু ভাব ছেঁয়ে আছে মুখশ্রী জুড়ে৷ স্পর্শীর কর্মকাণ্ড দেখে নির্বাণ ঠোঁট কামড়ে আসে। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে, পিছন থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে এগিয়ে গেল ভিতরের দিকে। স্পর্শী তারই পিছু পিছু ছুটলো। কলিংবেল চাপতেই মধ্যবয়সী এক মহিলা এসে দরজা খুলে দেন। অতঃপর নির্বাণকে দেখতে পেয়ে স্মিত হেসে বললেন, “আরেহ নির্বাণ যে! পাশে কি বউ মা নাকি?”

নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলল, “হুম!”

আলিয়া স্পর্শীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী তাকে সালাম দেয়। আলিয়াও সালামের প্রত্যুত্তর করে তাদের ভিতরে নিয়ে আসে। ভিতরে আসতেই চারিদিকে চোখ বুলায় স্পর্শী। পরিবেশটা মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে নীরব। আশেপাশেও মানুষজন তেমন নেই। দুই-একজনকে দেখা যাচ্ছে ডায়নিং এর কাছাকাছি। বিয়ে বাড়ি হিসাবে যে আমেজ,কোলাহল,আড়ম্বর থাকে তার কিছুই নেই। উপরন্ত, রাতে হলুদ হওয়ার কথা। সে হিসাবে এত নীরব পরিবেশ ঠিক হজম হলো না স্পর্শী। সে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণের কপালেও তখন সুক্ষ্ম ভাঁজ। নির্বাণ কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“মেজো মামি,কিছু কি হয়েছে? সবাই কোথায়? পরিবেশ এত ঠান্ডা কেন?”

নির্বাণের সম্মোধন শুনে এতক্ষণে স্পর্শী জ্ঞাত হলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির পরিচয় সাথে। স্পর্শীও এইবার উৎসুক ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকালো আলিয়ার দিকে। আলিয়া স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে,

“বড় ভাইজান গতকাল সকালে স্ট্রোক করেছিলেন। তাকে দেখতেই অধিকাংশ মানুষ হসপিটালে গিয়েছে৷”

নির্বাণ বিস্ময়বিমূঢ় কন্ঠে বলে, “আমাকে আগে জানাও নি কেন? বড় মামার কি অবস্থা এখন?”

আলিয়া বলে, “তোর মা মানা করেছিল। চিন্তায় ফেলতে চায়নি তাই বলেনি কেউ তোকে। আর ভাইজান এখন মোটামুটি সুস্থ। মিনি স্ট্রোক করেছিলেন।”

“মা কোথায়?”

“তোর মা হসপিটালেই আছে। দুপুর হওয়ার আগেই হয়তো এসে পড়বে। তুই আসবি বলে আমি বাসায় ছিলাম।”

“কোন হসপিটালে নিয়েছে বড় মামাকে বল। আমি এখনই যাচ্ছি।”

আলিয়া আশ্বস্ত কন্ঠে বলেন, “আরেহ শান্ত হ। ভাইজানকে আজকের মধ্যে ছেড়ে দিবে, বাসায় আসলে দেখা করে নিস। এখন জার্নি করে এসেছিস, আগে হাত-মুখ ধুয়ে নে।”

নির্বাণ উৎকন্ঠা হয়ে বলে, “নামটা বলবে তুমি?”

আলিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হসপিটালের নামটা বলে দেন। কারণ সে জানেন, হসপিটালের নাম না জানা অবধি নির্বাণ ক্ষান্ত হবে না। নির্বাণ ঠিকানা পেয়ে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি একটু ওর খেয়াল রেখো৷ নতুন পরিবেশ, কখন কি দরকার পড়ে বলা যায় না। আর ব্যাগগুলো কাউকে দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিও। প্রচন্ড ভারী এইগুলা।”

আলিয়া আশ্বস্ত কন্ঠে বলে, “আচ্ছা তুই যা। আমি খেয়াল রাখব নে।”

আলিয়ার কথায় ভরসা পেয়ে নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে বলে,
“আমি এখন যাচ্ছি, কখন ফিরবো ঠিক নাই৷ তোমার কোন অসুবিধা হলে মেজো মামীকে বলবে।”

স্পর্শী দৃষ্টি নত করে বলে, “আমি যাই আপনার সাথে?”

নিবার্ণ একমুহূর্তের জন্য থমকে বলে, “আপাতত দরকার নেই। সারারাত জার্নি করেছ, ক্লান্ত তুমি। রেস্ট নাও। প্রয়োজন মনে করলে আমি এসে নিয়ে যাব তোমায়।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করতে গিয়ে করলো না। কিছু একটা ভেবে নীরব থাকলো। অতঃপর আলতো ভাবে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। নির্বাণ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। স্পর্শীও সেই পানে তাকিয়ে থাকলো এক দৃষ্টিতে।
নির্বাণ চলে যেতেই আলিয়া এগিয়ে এসে বলে, “তোমার নাম কি?”

আলিয়ার কন্ঠ কর্ণপাত হতেই স্পর্শী দৃষ্টি দরজা থেকে সরিয়ে নিয়ে আলিয়ার দিকে তাকায়৷ মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “ইফাত আরা স্পর্শী।”

আলিয়া স্মিত হেসে বলে, “তোমার মত নামটাও বেশ মিষ্টি। এখন আসো, আমি তোমাকে রুম দেখিয়ে দেই। মুখ-হাত ধুঁয়ে নাস্তা করে নিও।”

স্পর্শী আলতো ভাবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। আলিয়া ভিতরের দিকে যেতে যেতে বললেন, “ছেলেতা ছোট থেকেই বড় ভাইজানকে অনেক মান্য করে, বুঝলা। তাই তার অসুস্থতার কথা শুনে স্থির থাকতে পারলো না, ছুটে গেল।”

স্পর্শী ছোট করে বলল, “জি!”

আলিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “অবশ্য! বড় ভাইজান ওদের জন্য যা করেছেন এরপর মান্য না করে কি পারে? বাপছাড়া ছেলে দুইটার জন্য অনেক করেছেন তিনি৷ নিজের সন্তান থেকে কখনো কম ভাবেন নাই।”

কথাটার পৃষ্ঠে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে আসে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ কৌতূহল জাগে মনের মাঝে, তবে প্রকাশ করে না৷ নীরব থাকে। আলিয়া স্পর্শীকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে বলে যান, স্পর্শী কোন দরকার পড়লে তাকে যেন গিয়ে বলে। সে রান্নাঘরে আছে। আলিয়া চলে যেতেই একজন এসে নির্বাণ আর তার ব্যাগ রুমের মধ্যে দিয়ে যায়। লোকটি চলে যাওয়ার পর স্পর্শী দরজা ভিজিয়ে পার্স ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সাহেলাকে জানিয়ে দেয় সে পৌঁছে গিয়েছে। অতঃপর কিছুক্ষণ কথা বলে ব্যাগ থেকে এক সেট কাপড় বের করে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here