চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -২৫+২৬+২৭+২৮

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৫

সায়াহ্নের প্রহর কাটিয়ে গম্ভীরতা ছড়ালো পশ্চিমাকাশে। অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তরিক্ষে এক ফালি চাঁদ পরিলক্ষিত হলো নিবিড়ভাবে। কিঞ্চিৎ আলোয় তার ধরণীকে চন্দ্রস্নান করানোর দৃঢ় প্রচেষ্টা। বাহিরের পরিবেশ স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ হলেও ভিতরকার অবস্থা যে তিক্ততায় ঘেরা। হসপিটালের ভিতরকার অবস্থা আজ একটু বেশি নীরব, নির্জন। ফেনাইলের কড়া গন্ধে মো মো করছে চারিদিক। সার্জিক্যাল ঔষধের গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে নির্বাণের, তবে সেটা নিজের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ হতে দিচ্ছে না সে। শীতল, শান্ত চাহনিতে থাকিয়ে থাকলো ২০৩ নাম্বার রুমটির দিকে। ভিতরেই সাদা চাদরে মোড়ানো বিছানায় শুয়ে আছে স্পর্শী, পাশেই নার্সরা তাকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে চলেছে। মাঝে মধ্যে স্পর্শীর ব্যথাতুর কন্ঠ ভেসে আসছে, বমি করার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে বারংবার কিন্তু প্রতিবারই বিফলে যাচ্ছে না। সারাদিন পানাহার থেকে পেটে আদৌ কিছু অবিশিষ্ট আছে গল-গহ্বর দিয়ে বেরিয়ে আসার? নির্বাণ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো, বুকের বা-পাশটায় বেশ সময় ধরেই সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার।
স্পর্শীর অ্যাপেন্ডিসাইটিস ধরা পড়েছে। এর লক্ষণ আগেই স্পর্শীর মাঝে দেখা দিয়েছিল কিন্তু স্পর্শী বিষয়টা এতটা আমলে নেয়নি। কখনো গ্যাস্টিক বা ফুড পয়সনিং মনে করে নিজের মত যত্ন নিয়ে, ঔষধ খেয়ে নিয়েছে। কাউকে বলার বা ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। যার দরুন, জিনিসটা এখন গুরুতর আকার ধারণ করেছে। অপারেশন না করে উপায়ান্তর নেই। এইতো আর কিছু সময়ের ব্যবধানে স্পর্শীকে ‘ল্যাপারোস্কোপিক অ্যাপেনডেকটমি’ করতে নিয়ে যাওয়া হবে। সকল ব্যবস্থা প্রায় হয়েই গিয়েছে। সাধারণত অ্যাপেনডেকটমি করার আগে আট ঘন্টা না খেয়ে থাকতে হয় এবং বেশ কিছু নিয়মাবলি মানতে হয়, এরপরই অ্যাপেনডেকটমি করা হয়। কিন্তু স্পর্শী যেহেতু রোজা থাকার কারণে সারাদিন না খেয়েই ছিল আর ইন্টারনাল কানডিশন নিয়ন্ত্রণেই ছিল সেহেতু ডাক্তাররা যতদ্রুত সম্ভব অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। বলতে, একপ্রকার তাড়াহুড়োর মধ্যেই সবটা হচ্ছে।
নির্বাণের প্রথমে স্পর্শীর উপর প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। ইচ্ছে করেছিল তখনই স্পর্শীর গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিতে।একটা মানুষ এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কিভাবে হতে পারে? নিজেকে নিয়ে সামান্যতম আশঙ্কা থাকলে একবারের জন্য হলেও ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন৷ অথচ এই মেয়েটা দেখ, দীর্ঘ সময় ধরে একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল তবুও চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসেছিল। কাউকে কিছু বলার পর্যন্ত দরকারবোধ করেনি সে৷ কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় নির্বাণ নিজের রাগ চেপে হসপিটালের সকল বাহ্যিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

হঠাৎ পাশ থেকে নাহিদ একটা প্যাকেট নির্বাণের সামনে এগিয়ে দিয়ে স্মিত কন্ঠে বলে, “ভাই নে তোর মাস্ক, পড়ে নে জলদি।”

নির্বাণ সচকিত দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকালো। একপলক নাহিদের দিকে তাকিয়ে মাস্কটা হাতে নিয়ে নিল। প্যাকেটটা পাশের ডাস্টবিনে ফালিয়ে দিয়ে মুখে মাস্কটা পরিধান করে নিল। অবশেষে যেন কিয়ৎ স্বস্তি মিললো তার মনে। হসপিটালে বিদ্যমান গন্ধ সে ছোটবেলা থেকেই তেমন একটা সহ্য করতে পারে না। কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি, যার দরুন যতদ্রুত সম্ভব নাহিদকে দিয়ে মাস্ক আনিয়েছে। নাহিদ নির্বাণের কাঁধে হাত রেখে বলে, “তোর কোন সমস্যা হচ্ছে?”

“না ঠিক আছি আমি।”

নাহিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “চিন্তা করিস না, ভাবীর কিছু হবে না। দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”

“হুম।”

নির্বাণ একপলক নিজের ডান দিকের বিপরীত পাশে তাকালো। মিজান,সাহেলা, নিলুফা চিন্তিত মুখে বসে আছেন স্টিলের তৈরি চেয়ারের উপর। কপালে তাদের গভীর ভাঁজ। বুঝার অবকাশ নেই তারা ঠিক কতটা দুশ্চিন্তায় আছেন স্পর্শীকে নিয়ে। নির্বাণ দৃষ্টি ঘুরালো, থুতনি চিবুকে ঠেকিয়ে তাকালো মেঝের দিকে। মনে মাঝে ঘুরছে অপ্রীতিকর ঘটনা। কিয়ৎক্ষণ পর ডাক্তার এসে জানায় ওটি রেডি হয়ে গিয়েছে, একটু পরই স্পর্শীকে সেখানে শিফট করা হবে। নির্বাণের মনটা হুট করেই আনচান করে উঠলো। সে কারো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিন্তা না করে ডাক্তারের কাছ থেকে অনুমতি চাইলো স্পর্শীকে একবার দেখার জন্য। প্রথমে ডাক্তার না করলেও পরবর্তীতে রাজি হলেন। অনুমতি পেয়ে নির্বাণ ছুটলো স্পর্শীর কেবিনের দিকে। কেবিনে ঢুকতে দেখতে পেল বিছানার উপর স্পর্শী ব্যথায় কাতরাচ্ছে, দুই হাত দিয়ে পেট জড়িয়ে মৃদু আর্তনাদ করছে। মুহূর্তেই নির্বাণের ভিতরটা কেমন করে উঠলো, ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। স্পর্শীর কাছে গিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় তার একটি হাত বন্দী করে নিল, আরেক হাতটি স্পর্শীর চুলের মাঝে গলিয়ে দিয়ে বলল, “এইতো আরেকটু সহ্য করো, এরপর ঠিক হয়ে যাবে তুমি। কিছু হবে না তোমার।”

স্পর্শী কথা বলতে পারলো না, শুধু সিক্ত দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। মানুষটাকে বাহির দিয়ে শান্ত দেখালেও তার ভিতরকার অবস্থা যে কতটা দুরবস্থ তা যদি স্পর্শী অনুভব করতে পারতো তাহলে হয়তো নিমিষেই নিজের সকল ব্যথা ভুলে যেতে পারতো।

_____________

কেবিনের সামনে রাখা চেয়ারে ক্লান্ত দেহটা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে নির্বাণ। অভিব্যক্তি প্রচন্ড শীতল তার, মনের মাঝে থাকা ভয়,ভীতি ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে তার, তবে আশঙ্কা কমেনি। কিছুক্ষণ আগেই স্পর্শীকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। অপারেশন সাকসেসফুলি হয়েছে, কোন ধরনের কম্পলিকেশন হয়নি। তবে স্পর্শীর পরিশিষ্টটি ফেটে যাওয়ার কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা আছে বলে কিছু সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে ডাক্তার। নার্স কেবিনের সকল কিছু ঠিক-ঠাক করে দিয়ে বেরিয়ে আসে, আর জানায় তারা এখন রোগীকে দেখতে পারবেন। আর কিছু ঔষধের কথা বলে দিল, এইগুলো দ্রুত নিয়ে আসতে। নার্সের কথা শুনে নির্বাণ উঠে দাঁড়ায়, বাহির থেকেই একনজর স্পর্শীকে দেখে নার্সের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে চলে যায় ঔষধ আনতে। আর বাকিরা কেবিনে চলে যায় স্পর্শীকে দেখতে।

___________

নিশুতি রাত। চারদিকে পিনপতন নীরবতা, মাঝে মধ্যে বাহির থেকে ভেসে আসছে নিশাচর প্রাণীর হাঁক। স্পর্শী তখন তন্দ্রাঘোরে বিভোর, না খেয়ে থাকার কারণে বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছে শরীরটা। স্পর্শী নিদ্রার মধ্যে পাশ ফিরতে চাইলে হাতে টান অনুভব করলো। সে সাথে সুক্ষ্ণ ব্যথা। ধীরে ধীরে চোখ খুললো স্পর্শী। অবচেতন মনে চারদিকে চোখ বুলালো, কিছুটা সময় লাগলো তার নিজের অবস্থান বুঝতে৷ আবছা অন্ধকার রুমে নিজের ডান হাত উঠাতেই আবার টান অনুভব হলো তার, মৃদু শব্দ করে উঠলো সে। ডান হাতে ক্যানোলা লাগানো তার, স্যালাইন চলছে। স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেলতে না ফেলতে পাশ থেকে কেউ উৎকন্ঠা সুরে বলে উঠে,

“কি হয়েছে স্পর্শী? কোথাও কি ব্যথা করছে? সমস্যা হচ্ছে তোমার?”

স্পর্শী অন্যপাশ ফিরে, মুখের সামনে একটি পুরুষালী অবয়ব দেখে সে থমকায়। নির্বাণ স্পর্শীর আরেকটু কাছে ঝুঁকতেই আবছা অন্ধকারের মাঝে নির্বাণের চোখ দুইটি ঝলঝল করে উঠে, স্পর্শীর এক মুহূর্ত বিলম্ব হলো না মানুষটিকে চিনতে। নির্বাণ পুনরায় বলে উঠে, ” চুপ করে আছো কেন? খারাপ লাগছে, ডাক্তার ডাকবো?”

স্পর্শী মৃদু কন্ঠে বলে, “না, ঠিক আছি আমি। হাতে তখন একটু টান লেগেছিল আর কিছু না।”

নির্বাণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, নিজের মুখের মাস্কটা খুলে পিছন দিক থেকে টুলটা টেনে নিয়ে স্পর্শী কাছে এসে বসলো। স্পর্শীর এক হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বসে পড়লো সে। স্পর্শী জিজ্ঞেস করে, “বাকি সবাই কোথায়?”

“বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি তাদের।”

“অহ!”

নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলে, “হুম! ঘুমোও তুমি, আমি আছি পাশে।”

“ঘুম আসছে না এখন।”

“আচ্ছা, তাহলে চুপ করে থাকো। বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই, আর কোন সমস্যা হলে জানাবা আমাকে।”

স্পর্শী একপাশে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, কোন সমস্যা হলে সে বলবে। নির্বাণ ক্ষান্ত হয়ে স্পর্শীর হাত শক্ত করেই বসে রইলো। কিছু সময় নীরবে, নিভৃতে কেটে যেতেই স্পর্শীর পেটের ভিতরে থাকা ইঁদুরগুলো বজ্রকন্ঠে গর্জে উঠে জানান দিল তার খিদে লেগেছে। তাও মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে। শব্দটা একটু বেশি জোরেই গুঞ্জিত হয়েছিল বলে মনে হলো স্পর্শীর, নির্বাণ বোধহয় শুনতে পেরেছিল সে শব্দ। লজ্জায় দৃষ্টি নত হয়ে আসে স্পর্শীর। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “খিদে পেয়েছে?”

স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে দ্রুত দৃষ্টি নামালো। কোনমতে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে, “হ্যাঁ কিছুটা।”

“অপারেশনের পর আট ঘন্টা কিছু খেতে পারবে না তুমি। পাঁচ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে আর তিন ঘন্টা বাকি, এরপর খেতে পারবে তুমি।”

স্পর্শী আতঙ্কিত সুরে বলল, “ততক্ষণে তো খুদার জ্বালায় মারা যাব আমি।”

“যাবা না।”

স্পর্শী কাতর কন্ঠে বলে, “একটু কিছু কি খাওয়া যাবে না?”

নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “গেলে কি আমি এতক্ষণ বসে থাকতাম?”

স্পর্শী কিছু বলল না, মুখ ছোট করে নিচে তাকিয়ে থাকলো। নির্বাণ স্পর্শীর চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিল, “আর কিছু সময়, একটু ধৈর্য ধরো। ঘুম দাও, দেখবে সময় এমনেই চলে গিয়েছে।”

স্পর্শী কিছু বলল না। খিদার চোটে নিজের ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলো সে। অতঃপর নির্বাণের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল, “আপনি রাতে খেয়েছেন?”

নির্বাণ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “হ্যাঁ খেয়েছি।”

স্পর্শী নিষ্পলক নয়নে তাকালো, সময় গড়ালো আপন গতিতে। তার বুঝতে দেরি নেই নির্বাণ মিথ্যা বলছে। ক্ষণেই কন্ঠে অপার বিস্ময় মিশিয়ে বলে উঠলো সে, “তার মানে কি সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত আপনি না খাও? কিছু খান নাই আপনি? কিন্তু কেন?”

“ঠিক আছি আমি।”

স্পর্শী অসন্তোষ নয়নে তাকায়,”আপনি কি পাগল? এতক্ষণ কেউ না খেয়ে থাকে? ইফতারও তো আমার জন্য ঠিক মত খেতে পারেন নাই।”

নির্বাণ শীতল দৃষ্টিতে তাকায়, “না খেয়ে তো তুমিও আছো।”

“আমার হিসাব আলাদা। আপনি যান, এখনই দিয়ে খেয়ে আসেন।”

“খাব নে, তুমি এখন ঘুমাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

“বলছি না আপনাকে খেতে যেতে? আরেকটু পর আযান দিবে, রোজা রাখবেন না? সেহেরিটা করে আসেন গিয়ে। আমি আছি এইখানে।”

নির্বাণ কিছু বলতে যাবে এর আগেই একজন নার্স প্রবেশ করলেন রুমে। তিনি সব ঠিক আছে কি-না সেটা পরোক্ষ করতে এসেছেন। নির্বাণ উঠে দাঁড়ালো, নার্সকে জায়গা দিল এদিকে আসার। স্পর্শী নার্সকে দেখা মাত্র বলে উঠে, “আপু একটু শুনেন।”

নার্সটি স্পর্শীর দিকে ঘুরে তাকালো, “জ্বি বলুন।”

“ক্যান্টিন কি এখনো খোলা আছে?”

“হ্যাঁ আছে।”

“আচ্ছা! তাহলে আপনি একটু কষ্ট উনাকে সাথে নিয়ে যেতে পারবেন সেখানে?”

“জি অবশ্যই।”

স্পর্শী মিষ্টি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলল,”তার সাথে যান, আর ভালো মত খেয়ে আসবেন।”

নির্বাণ কাঠিন্য কন্ঠে বলে, “আমি ক্যান্টিনের খাবার খেতে পারি না।”

“তাই বলে না খেয়ে থাকবেন?”

নির্বাণ কিছু বলার আগেই নাহিদ রুমে আসে। নাহিদ দেখামাত্র নির্বাণ বলে উঠে, “তুই এইখানে কি করছিস?”

নাহিদ সামনের দিকে এগুতে এগুতে বলে, “মা, খাবার পাঠিয়েছে তোর জন্য। সেটাই এনেছি। তুই তো আবার ক্যান্টিনে খেতে পারিস না। আর ভাবির জন্য কিছু ফল পাঠিয়েছে।”

নির্বাণ ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে বলে, “মাও না।”

“মায়ের বড় ছেলে না খেয়ে আছে, সে কি এখন আর তাকে রেখে ছোটজনকে ভাত দিবে? নে ধর তোর খাবার, খেয়ে নিস।”

নির্বাণ কিছু বলল না, চুপচাপ খাবারটা নিয়ে নিল। নাহিদ খাবারটা দিয়ে স্পর্শী খোঁজ খবর নিল। অতঃপর কিছুটা সময় থেকে চলে গেল। নাহিদ যেতেই স্পর্শী বলে-কহে নির্বাণকে খাওয়ালো। ভাবা যায় মানুষটা ওর জন্যই এতক্ষণ না খেয়ে ছিল?

_______________

পরেরদিন স্পর্শীর খবর পেয়ে সামান্তা এলো দেখা করতে। তাকে দেখে কিছুটা সময় কাটিয়ে গেল। সামান্তা যাওয়ার পর পরই নিধি আর কেয়া এলো সেখানে। সকালে নিধি ফোন করেছিল স্পর্শীকে, ফোনটা তখন স্পৃহার কাছে থাকায় সে ফোন ধরে এবং স্পর্শীর অসুস্থতার সম্পর্কে জানায়। স্পর্শীর অবস্থা জানা মাত্রই নিধি সবাইকে এই খবর জানায়। মাহিন, সামি ইতিমধ্যে রমজানের ছুটি গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছে বলে তৎক্ষনাৎ আসতে পারলো না। কেয়া এইখানেই ছিল বলে নিধির সাথেই চলে আসে স্পর্শীকে দেখতে।

স্পর্শীর খোঁজ খবর নেওয়া শেষে তারা ক্ষান্ত হয়। নিধি টুল টেনে বসে বলে, “জানিস! তোর খবর শুনে কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি? কি তাড়াহুড়োর মধ্যে এসেছি তা আর নাই বললাম।”

কেয়া বলে, “যাক, এখন ভালো আছিস দেখে শান্তি লাগলো। কি চিন্তায় না ছিলাম ভাই।”

স্পর্শী স্মিত হাসে, “এত টেনশন নেওয়ার কিছু নেই, ছোট একটা অপারেশন হয়েছে মাত্র।”

নিধি ভ্রু কুঁচকে তাকায়, “হ্যাঁ, অপারেশন তো বার্গার খাওয়ার মত ইজি তাই না? আজাইরা!”

“তা না! আমি সেভাবে বলতে চাইনি।”

স্পর্শী নিজের কথা পরিষ্কার করে উপস্থাপন করতে চাইলো কিন্তু নিধি সেই সুযোগ না দিয়ে বলল, “থাক হইসে আর বলা লাগবে না৷ তোমাকে চেনা আছে আমাদের।”

স্পর্শী কিছু বলল না, নীরব রইলো। হঠাৎ কেয়া বলে উঠলো, “এই তোর জামাই আসে নাই তোকে দেখতে? কই সে? তোর অবস্থার কথা জানে সে?”

স্পর্শী কেয়ার দিকে তাকালো, “হ্যাঁ জানে। কাল সারারাত আমার সাথেই ছিল।”

কথাটা শুনে নিধি ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠে, “আরেহ তাই নাকি মামা! জল তাহলে গড়িয়ে এত দূর চলে গেসে আর আমরা জানি এই না? ভালোই ভালোই! তা দুলাভাইকে কি আমাদের দেখাতি না? সারাজীবন কি আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখবি?”

কেয়াও নিধির সঙ্গ দিয়ে বলে, “সেটাই তো? পরিচয় করাবি না আমাদেরকে ভাইয়ার সাথে? কোথায় সে?”

স্পর্শী কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে দেখে নির্বাণ দরজা দিয়ে ঢুকছে৷ সামান্তাদের সাথে বের হয়েছিল সে তাদের এগিয়ে দিতে, সে সাথে স্পর্শীর জন্য কিছু মেডিসিন কিনে আনতে। নির্বাণ ভিতরে ঢুকে হাতে প্রেসক্রিপশন নিয়ে দেখতে দেখতে স্পর্শীর উদ্দেশ্যে বলে উঠে, “তোমার এখন মেডিসিন আছে। সুপ যে-টা খেতে দিয়ে গিয়েছিলাম খেয়েছিলে?”

গুরুগম্ভীর এক পুরুষালি কন্ঠ শুনে নিধি আর কেয়া দ্রুত পিছন ঘুরে তাকায়। মুহূর্তে নির্বাণকে দেখামাত্র ভূত দেখার মত চমকে উঠে দুইজনেই। নিজের বিস্ময় ভাব ধরে রাখতে না পেরে আচমকাই নিধি বলে, “স্যার আপনি এইখানে কি করছেন?”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৬

“তোমার এখন মেডিসিন আছে। সুপ যে-টা খেতে দিয়ে গিয়েছিলাম খেয়েছিলে?”

গুরুগম্ভীর এক পুরুষালি কন্ঠ শুনে নিধি আর কেয়া দ্রুত পিছন ঘুরে তাকায়। মুহূর্তে নির্বাণকে দেখামাত্র ভূত দেখার মত চমকে উঠে দুইজনেই। নিজের বিস্ময় ভাব ধরে রাখতে না পেরে আচমকাই নিধি বলে, “স্যার আপনি এইখানে কি করছেন?”

নির্বাণ দৃষ্টি তুলে তাকায়। সামনে নিধি আর কেয়ার বিমূঢ় মুখশ্রী দেখে ভ্রু সংকুচিত হয়ে এলো তার। গভীর দৃষ্টিতে তাকালো নিধির পানে। ক্ষণেই নিধি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, আমতা আমতা সুরে বলল, “না মানে, আপনি হসপিটালে যে? কাউকে কি দেখতে এসেছেন?”

নির্বাণ একপলক তাকালো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী এতক্ষণ নির্বাণের দিকেই তাকিয়ে ছিল, নির্বাণ তাকানো মাত্রই সে দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়৷ স্পর্শী জানে, নির্বাণ নিধি ও কেয়ার সামনে তাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিবে না। বিয়ের প্রথম রাতেই বলে নির্বাণ দিয়েছিল, সে তার প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফ আলাদা আলাদা রাখতে চায়। এখন সে যদি তাকে স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দেয় তাহলে হয়তো বিষয়টা কিছুটা হলেও ঘেটে যাবে। স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, আনমনে তাকায় নিজের পায়ের বৃদ্ধা আঙুলটির দিকে।
নির্বাণের দৃষ্টি সরালো, নিধির প্রশ্নের প্রেক্ষিতে উত্তর দিল, “হ্যাঁ! তোমরা এইখানে কেন?”

নিধি বলে, “স্পর্শী অসুস্থ, ওকেই দেখতে এসেছিলাম। আপনি চিনেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়ে, ইফাত আরা স্পর্শী।”

কথাটা বলে নিধি হাত দিয়ে স্পর্শীর দিকে ইশারা করে। তা দেখে স্পর্শী হকচকিয়ে উঠে, গোলগোল দৃষ্টিতে তাকায় নিধির দিকে। নির্বাণ মৌনব্রত থেকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর পানে৷
কেয়া মনে কিঞ্চিৎ সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করে, “স্যার আপনি কাকে দেখতে এসেছেন এইখানে? কে এডমিট?”

নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, “আমার বউ!”

নিধি সে সময় স্পর্শীর কথায় বিশ্বাস করে নি যে নির্বাণ বিবাহিত, সে ভেবেছিল স্পর্শী এইভাবেই ফাজলামো করছে৷ যার দরুন নির্বাণের মুখ থেকে নিজের বউয়ের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না। অকস্মাৎ সে মুখ ফসকে বলে উঠে, “তার মানে আপনি সত্যি বিবাহিত?”

নির্বাণ স্পর্শীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিধির দিকে স্থাপন করে। ভ্রু দু’টি পুনরায় সংকুচিত করে রুক্ষ কন্ঠে বলে, “মিথ্যে বিবাহিত আবার কিভাবে হয়?”

নিধি এইবার থতমত খেয়ে যায়। কিছু বলার পূর্বেই কেয়া পাশ থেকে নিধির পেটে হালকা গুঁতো দিয়ে চাপা কন্ঠে বলল, “কার সামনে কি বলছিস তুই? একটু বুঝে শুনে তো কথা বলবি।”

নিধি অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় কেয়ার দিকে। কেয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে, “ওর কথা ধরবেন না স্যার। কখন কি বলে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। বাদ দিন! তা ম্যাম এর কি হয়েছে? এখন কেমন আছেন তিনি?”

‘ম্যাম’ সম্মোধন শুনে স্পর্শীর বিষম খাওয়া উপক্রম।
নিবার্ণ গম্ভীরমুখে বলে, “অপারেশন হয়েছিল কাল, ভালো আছে এখন।”

কেয়া বলে, “আলহামদুলিল্লাহ! তবে স্যার, আপনি বোধহয় ভুল কেবিনে চলে এসেছেন। এইটা স্পর্শীর কেবিন, ম্যাম হয়তো অন্য কেবিনে আছেন।”

নির্বাণ চোখ ঘুড়িয়ে তাকালো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী ঠোঁট চিপে হাসছে৷ নির্বাণ শাণিত দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী ঠোঁট দু’টো আরও চেপে ধরে, হাসি থামানোর অসাধ্য চেষ্টা। সেই সাথে অপেক্ষা, নির্বাণের উত্তর শোনার। কি বানোয়াট কাহিনী শুনাবে নির্বাণ এখন কে জানে?
নির্বাণ একবার কেয়ার দিকে তাকায়। শান্ত কন্ঠে বলে, “নাহ! আমি ভুল কেবিনে আসিনি। তোমাদের ম্যাম এই কেবিনেই আছে।”

নিধি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলে উঠে, “মানে? এই কেবিনে কোথায়?”

“এই কেবিনের রোগীই আমার বউ। সাথে তোমাদের ম্যাম।”

কথাটা শোনামাত্র কেয়া আর নিধি গোলগোল চোখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিষয়টা হজম করতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এইদিকে, ঘটনাক্রমে স্পর্শী নিজেও স্তম্ভিত। সে ভাবেনি নির্বাণ তাকে এইভাবে পরিচয় করিয়ে দিবে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নির্বাণের মুখ পানে। নিধির একবার স্পর্শীর দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার নির্বাণের দিকে। অকস্মাৎ নিধি স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “ঘটনা কি সত্য?”

স্পর্শী থতমত খেয়ে বলে, “কিসের ঘটনা, কিসের সত্য?”

“তুমি কি সত্যি স্যারের বউ?”

স্পর্শী এইবার নির্বাণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বলেন, আমি কি আপনার বউ?”

কথাটা বলে স্পর্শী দ্রুত গতিতে বাম হাত নাড়াতে নিলে খুব জোরে ক্যানোলাতে টান পড়ে, সাথে সাথে সে ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠে। আর্তনাদ শোনামাত্র নির্বাণ দ্রুত স্পর্শীর দিকে এগিয়ে আসে, হাতের ব্যাগগুলো বেডের পাশে মেঝেতে রেখে স্পর্শী ডান হাতটা সন্তপর্ণে নিজের হাতে নিয়ে শাণিত কন্ঠে বলে, “সাবধানে হাত নাড়াচাড়া করতে পারো না? এত কিসের তাড়া তোমার? পেলে তো ব্যথা এখন। সকালেও একই কান্ড করেছ।”

স্পর্শী মুখ ছোট করে বলে, “ঠিক আছি আমি।”

নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না। খুব সতর্কতার সাথে স্পর্শীর হাত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। সকালে টান খেয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল স্পর্শী, এখন আবার এমন হলে রগ ফুলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এইদিকে নিধি আর কেয়া দৃশ্যটা কোন রকম হজম করে যাচ্ছে, নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পাচ্ছে না তারা। সবকিছুই তাদের নিকট কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কেয়া চাপা কন্ঠে নিধিকে বলে উঠে, “তার মানে, স্পর্শী বিয়ে তখন নির্বাণ স্যারের সাথেই হয়েছিল? এই জন্যই স্পর্শী বলেছিল, আমরা তার বরকে চিনি।”

নিধি বলে, ” কিন্তু কেমনে কি? স্পর্শী কিভাবে নির্বাণ স্যারের বউ হয়? যেখানে স্পর্শী স্যারকে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না, সেখানে তারা বিয়ে করে সংসার করতাছে? কেমনে সম্ভব ভাই?”

“সেটা বাদ দে, আগে ভাব স্যারের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কি? আমরা তার স্টুডেন্ট নাকি শালিকা? আর তাকে এখন কি ডাকবো আমরা? দুলাভাই নাকি ভাইয়া নাকি স্যার? স্যারকে স্যার ডাকলে স্পর্শীকে আবার ম্যাম ডাকতে হবে। আবার স্পর্শীকে ওর নাম ধরে ডাকলে স্যারকে দুলাভাই বা ভাইয়া ডাকতে হবে৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, স্যারকে ভাইয়া কিভাবে ডাকি? আবার স্পর্শীকে ম্যাম কিভাবে ডাকি?”

“বইন তুই থাম। মাথা ঘুরাইতাসে আমার, জ্ঞান হারাবো আমি। ধর আমায়!”

কেয়া নিধির কথার তোয়াক্কা না করে নির্বাণ ও স্পর্শীর দিকে তাকায়। নির্বাণ স্পর্শীর হাত ভালো মত দেখে সরে আসে। মন্থর কন্ঠে বলে, “আমি নার্সকে ডেকে নিয়ে আসছি, সে একবার চেক করলে বুঝা যাবে সব ঠিক আছে কি-না। তুমি বেশি হাত নাড়াচাড়া করবে না।”

স্পর্শী আপত্তিকর কন্ঠে বলে,”নার্সকে ডাকতে হবে না, আমি ঠিক আছি।”

“ঠিক আছো বলেই তো আজ এই অবস্থা। তাই না?”

নিবার্ণের খোঁচা শুনে স্পর্শী ঘুচে বসে রইল। প্রত্যুত্তর করলো না। নির্বাণ স্পর্শীর দিকে একপলক তাকিয়ে অতঃপর কেয়া এবং নিধির দিকে তাকালো, “তোমরা থাকো, আমি আসছি একটু পরে।”

কথাটা বলে নির্বাণ লম্বা লম্বা পা ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নির্বাণ বেরিয়ে যেতেই নিধি আর কেয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্পর্শীর উপর। নিধি অস্ফুট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি কি নির্বাণ স্যার তোর জামাই?”

স্পর্শী নির্বিকার কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ, আমারই জামাই।”

কেয়া বলে, “এত বড় কথা আমাদের একবার জানাইলিও না তুই? এমন মীরজাফরগিরি করলি?”

নিধি হতাশাজনক স্বরে বলে, “বইন আমাকে একটু বুঝাবি তুই হিটলারে বউ কিভাবে হলি? হাও?”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। ধীরে সুস্থে একদম শুরু থেকে সবই বলে গেল তাদের। সবটা শুনে কেয়া বলে উঠে, “তোর কাহিনীর সামনে বাংলা সিনেমাও ফেইল। এমন কাকতালীয় ঘটনা আদৌ জীবনে ঘটে?”

স্পর্শী নির্বিকার কন্ঠে বলে, “কে জানে?”

নিধি বলে, “আচ্ছা শুন না, আমার না একটা প্রশ্ন আছে।”

স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে, “কি?”

“স্যার আর তোর বাচ্চা আমাকে কি ডাকবে?”

কেয়ে হাসতে হাসতে বলে, “গুড কুয়েশ্চন!”

স্পর্শী রাগান্বিত নয়নে নিধির দিকে তাকিয়ে বলে, “আগে বাচ্চা হোক তারপর ভাবিস তোকে সে কি ডাকবে। বাচ্চার হওয়ার খবর নাই সে আসছে তাকে আমার বাচ্চা কি বলে ডাকবে জানতে।”

নিধি কিছু বলতে যাবে তার আগে নির্বাণ একজন নার্স নিয়ে ফিরে আসে৷ যার দরুন, নিধি ভদ্র বাচ্চার মত চুপ হয়ে যায়।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৬ [বর্ধিতাংশ]

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই নির্বাণ স্যারের বউ।”

দীর্ঘ আলাপের শেষ পর্যায়ে এসে আকস্মিক নিধি কথাটা বলে উঠলো। নিধির কথা শুনে কেয়াও সেই কথায় সাঁই জানিয়ে বলে, “সেম আমারও। সব স্বপ্ন লাগছে।”

নিধি ও কেয়ার কথা শুনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “তো এতে আমি কি করব?”

নিধি জিহ্বার ডগা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে, “এমন কিছু করে দেখা যাতে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই তুই স্যারের বউ। মানে তোকে আর স্যারকে পাশাপাশি দেখে যেন স্বামী-স্ত্রী ভাইবটা আসে।”

স্পর্শী ক্রুদ্ধ নয়নে নিধির দিকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “চুমু খাই তাকে সবার সামনে? তখন নিশ্চয়ই পিউর স্বামী-স্ত্রী ভাইবটা পাবি। কি বল! ডাকব নাকি তোদের নির্বাণ স্যারকে?”

মুহূর্তেই নিধি মুখ বিকৃতি করে বলে, “আস্তাগফিরুল্লাহ দোস্ত! কিসব নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা বলোস তুই? বেডরুমের কার্যকলাপ পাবলিকে ফাঁস করতে চাস। ছিহ! তোকে আমার ফ্রেন্ড বলতেও লজ্জা করছে।”

স্পর্শীর লেগ পুল করার উদ্দেশ্যে কেয়াও নিধির সঙ্গ দিয়ে বলল, “আজ তুই বিবাহিত বলে আমাদের মত সিঙ্গেলদের এইভাবে হেনেস্তা করছিস? ভুলে যাস না একদা তুইও সিঙ্গেলই ছিলি।”

নিধি সুক্ষ্ম কন্ঠে বলে, “বিয়ে হতে না হতেই তোর মধ্যে বিবাহিত মহিলাদের ভাবসাব এসে পড়েছে ভাই। তোর সাথে এখন আর মিশা যাবে না, নাহলে দেখা যাবে তোর সঙ্গ দোষে আমরা নষ্ট হয়ে গিয়েছি।”

কেয়া নিধির কথায় তাল মিলিয়ে বলেই, “একদম খাঁটি কথা বলেছিস। স্পর্শীর সাথে আসলেই মিশা যাবে না এখন।”

স্পর্শী রোষানল দৃষ্টিতে তাকায়। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, “মিশবি না, তাই না? যা এখনই বের হো এইখান থেকে। যাহ!”

নিধি বিদ্রুপের সুরে বলে, “না গেলে কি করবি? আমাদের বায়োলজির মূল বিষয়বস্তু প্রেকটিক্যালি দেখাবি?”

কথাটা বলে শেষ করতে না করতে নিধি আর কেয়া উচ্চস্বরে হেসে উঠে। ওদের হাসি দেখে স্পর্শীর নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করলো।এমন হারামি বন্ধুদের সামনে টু আওয়াজ করাই যেখানে দায় সমান সেখানে সে তো তাদের এলাহি কান্ড করার সুযোগ দিয়ে দিয়েছে৷ এরা কি এখন আর মৌন থাকবে? স্পর্শী নিজের রাগ সংযত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “নিধির বাচ্চা তোকে তো আমি…”

স্পর্শী নিজের শেষ করার পূর্বেই দরজার দিকে তার নজর গেল। সেখানে নির্বাণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে আপনা-আপনি নীরব হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য মাথায় চিন্তা এলো, “নির্বাণ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে, সে সব শুনে ফেললো না তো?” পরমুহূর্তে ভাবলো, “নাহ! সে হয়তো মাত্রই এসেছে।” কথাটা ভেবেই ক্ষান্ত হলো সে।
স্পর্শীকে চুপ হতে দেখে কেয়া আর নিধির পিছন ঘুরে তাকালো। নির্বাণকে দেখামাত্র তারাও দ্রুত ভদ্রভাবে বসে, ঠোঁটের কোণে সরু হাসি ফুটালো। নির্বাণ একমুহূর্ত অপেক্ষা করে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো, নিঃশব্দে স্পর্শী কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা ফ্রুটসের প্লেটটা এগিয়ে দিল, “এইগুলো খেয়ে নাও। মেডিসিন খেয়েছ অনেক সময় হয়ে গিয়েছে।”

কথাটা বলে বিচক্ষণ দৃষ্টির সহিতে স্পর্শীর মাথার উপর ঝুলতে থাকা স্যালাইনটা পর্যবেক্ষণ করে নিল। আর কতটুকু বাকি। এমন সময় চারদিকে মিষ্টি এক কলধ্বনি গুঞ্জিত হলো। আছরের আযান দিচ্ছে। মুহূর্তেই কেয়া কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে ঘড়ি দেখলো। তারা এইখানে এসেছে প্রায় তিন ঘন্টা হতে চললো। তৎক্ষনাৎ কেয়া চাপা স্বরে বলে উঠলো, “আয় হায়! এত দেরি হয়ে গিয়েছে, খেয়ালই তো করিনি।”

কেয়ার চাপা আর্তনাদ শুনে নিধিও একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো। আসলেই দেরি হয়ে গিয়েছে দেখে সেও তাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইফতারের আগে বাসায় ঢুকতে হবে তাদের। এমনেই এখন বের হলেও জ্যামে পড়তে হবে নির্ঘাত। সব বিবেচনা করে নিধি ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “স্পর্শী, আজ যাই৷ পরে বাসায় এসে দেখা করে যাব নে একদিন।”

স্পর্শী মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, সাবধানে যাস।”

নিধি স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে ছোট করে “হুম” বলল, অতঃপর নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ তাহলে আসি স্যার ভাইয়া।”

অদ্ভুত এক নামে নিজের সম্মোধন শুনে নির্বাণ কপালে তিনটি সুক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়লো। সে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার ভাইয়া মানে?”

নির্বাণের গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠ শুনে নিধি কিছুটা চুপসে গেল। সে কেন ভুলে গেল এইটা তাদের হিটলার স্যার। তার ফাজলামো করার দুঃসাহসিকতা দেখানো মানেই বাঘের মুখে হাত দেওয়া। নিধি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বকা খাওয়ার ভয়ে মাথা নুইয়ে বলে, “না মানে, আপনি তো এখন আমাদের দুলাভাই প্লাস স্যারও। আপনাকে ঠিক কি বলে ডাকব বুঝতে না পেরে ভাবলাম, স্যার ভাইয়া ডাকি। সরি স্যার! আর এমন হবে না।”

নিধির সহজ-সরল স্বীকার নির্বাণের অভিব্যক্তি নম্র হলো, “ভার্সিটি এরিয়াতে আমি সবার জন্যই স্যার। এর বাইরে তোমরা ভাইয়া বলে সম্মোধন করতে পারো, সমস্যা নেই।”

কথাটা নিধির কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র সে মাথা তুলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে নির্বাণের পানে তাকালো৷ কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ঢুকার পর থেকেই সে এবং সবাই সর্বদা নির্বাণকে গম্ভীর অথবা কর্কশ কন্ঠেই কথা বলতে দেখেছে, তাকে নম কন্ঠে কথা বলতে দেখেছে এমন সংখ্যক মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যাবে। যার দরুন, নির্বাণের কোমল কন্ঠে বলা কথাটি হজম করতে নিধির বেশ বেগ পেতে হলো। বিষয়টা এমন ঠেকলো, এ যেন বাঘের মুখে মধুচ্ছন্দা। কেয়ার অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। নিধি কোনরকম নিজের ডানে-বামে হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালো।
অতঃপর কেয়া,নিধি সৌজন্যতার খাতিরে নির্বাণকে নিজের বাসায় দাওয়াত দিয়ে বেরিয়ে গেল নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে৷

নিধি, কেয়া চলে যেতেই নির্বাণ স্পর্শীর কাছে টুল টেনে বসলো। নিজ হাতেই স্পর্শীকে ফল খায়িয়ে দিয়ে, পানি খায়িয়ে দিল। অকস্মাৎ স্পর্শী বলে উঠে, “এই গরমের মধ্যে মাস্ক পড়ে থাকতে সমস্যা হয় না আপনার?”

নির্বাণ মাস্কের আড়ালে কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “না! অভ্যাস আছে।”

স্পর্শী নিচু স্বরে বলল, “আপনি বাসায় চলে যান, আজ থাকার প্রয়োজন নেই।”

“কেন?”

“হসপিটালে থাকতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাসায় যান, বিশ্রাম নিন। গতকাল থেকে হসপিটালেই পড়ে আছেন। এমনেও আজকের রাতটাই ব্যাপার, কালকে তো বোধহয় ডিসচার্জ হয়েই যাব আমি। মা থাকবে নে আমার সাথে।”

নির্বাণ নিজের পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে সপ্তপর্ণে স্পর্শীর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা পানির বিন্দুগুলো মুছে দিল। ধীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে বেশি বুঝতে বলেনি কেউ। আমি ঠিক আছি, বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন নেই আমার।”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, কথা বাড়ালো না। নির্বাণ স্মিথ হেসে হঠাৎ স্পর্শীর খুব নিকটে এসে কানের কাছে মুখ স্থির করে বলে, “এমনেও, তোমার মনের নিষিদ্ধ ইচ্ছাটা পূরণ করতে হলে তো আমার থাকা লাগবেই।”

নির্বাণের ঠান্ডা,শীতল কন্ঠের ফিসফিসানিতে স্পর্শী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। অস্ফুটস্বরে বলে, “মানে? কিসের ইচ্ছে? কিসের কি?”

“মানে এইটাই রোজা আছি বলে বেঁচে গিয়েছ, অন্যথায় বায়োলজির প্রেকটিক্যাল ক্লাসটা এখনই নিয়ে নিতাম।”

নির্বাণের কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসে, মেদুর গালে ছড়ায় এক মুঠো রক্তিমা। তার মানে অসভ্য লোকটা তখন তাদের সব কথাই শুনেছে। কি লজ্জার বিষয়! স্পর্শী এক হাত দিয়ে আলতো করে নির্বাণের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “কথার কি শ্রী! ছিহ!”

নির্বাণ স্পর্শীর নিকট থেকে সরে এসে ভ্রু কুঁচকে বলে, “তুমি বললে ঠিক আর আমি বললেই ছিহ?”

স্পর্শী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলল, “ঘুম পাচ্ছে আমার, ঘুমাবো আমি। আপনি নামাযে যান, ওয়াক্ত পেড়িয়ে যাচ্ছে।”

কথাটা বলেই স্পর্শী ধীর গতিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো, নির্বাণ দ্বিরুক্তি করলো না। সে জানে মেয়েটা লজ্জায় সংকীর্ণ হয়ে আছে। তাকে এখন কিছু বলা মানেই রক্তজবার আবরণে গভীরভাবে আবৃত করা।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৭

করিডরের সামনে এসে কানের নিচ থেকে ফোন রেখে সামনে এগুতেই খুব জোরে কারো সাথে ধাক্কা খেল স্পৃহা। ধাক্কা জোরে খাওয়ায় মুহুর্তেই নিজের ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে বসে পড়লো সে। হাতের মুঠোয় পুরে থাকা ফোনটি ছিঁটকে পড়লো কয়েক হাত দূরেই। নাকের ডগায় ঝুলতে থাকা চশমা হলো অনড়। স্পৃহা চোখ পিটপিট করে কিঞ্চিৎ মুহূর্ত ব্যয় করলো ঘটনাটা বুঝে উঠার জন্য। অতঃপর বুঝতে পেরে ঝটপট মাথা তুললো৷ সামনে সুঠাম, চওরা বুকের অধিকারী এক শ্যাম মানবকে দেখামাত্র তার ভ্রু কুঁচকে এলো। চশমাটা হাতের তর্জনী দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে গলা খাঁকাড়ি মেরে বলল,

“দেখে চলাফেরা করতে পারেন না নাহিদ ভাই? এত তাড়া কিসের আপনার? পড়ে গেলাম তো আমি।”

স্পৃহার ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে নাহিদের কপালের মধ্যভাগে সুক্ষ্ম তিনটি ভাঁজ পড়লো। রসিকতার সুরে বলল, “ইন্দুর সমান মানুষ হলে, তাকে কি আর চোখে দেখা যায়? আমার সামনের রাস্তা তো ফাঁকাই দেখেছিলাম।”

নাহিদের ঠাটারি শুনে স্পৃহার বিরক্তিতে চোখ-মুখ ঘুচে এলো৷ সেই সাথে রাগে চোখ অগ্নিশিখার ন্যায় ঝলঝল করে উঠলো। সে একটু খাটো সে জানে, হয়তো নাহিদের তুলনায় একটু বেশি। কিন্তু তাই বলে সে ইন্দুর নয় বা এমন ছোটও নয় যে তাকে চোখেই পড়বে না। সে সাথে, তাকেই পরোক্ষভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। স্পৃহা ফোঁস ফোঁস করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, ক্ষণেই কোমরের দিকে সুক্ষ্ম এক ব্যথা আঁচ করতে পেরে মৃদু কন্ঠে আর্তনাদ করে পুনরায় বসে পড়ে সে৷ চোখ দু’টি খিঁচে বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করলো। অতঃপর চোখ খুলে পুনরায় উঠার চেষ্টা করার পূর্বেই সামনে থেকে একটি হাত কেউ এগিয়ে দিল, “হাতটা ধরে উঠো।”

স্পৃহা একপলক নাহিদের মুখপানে তাকিয়ে, হাতের দিকে তাকায়। খানিকটা ইতস্তত করলো সে, “লাগবে না। উঠতে পারবো আমি।”

নাহিদ এইবার রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো, “হাত ধরতে বলেছি তোমায়। ধরো!”

স্পৃহা অসন্তোষ নয়নে তাকালো তবে কথা বাড়ালো না, নাহিদের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো৷ ইফতারের পরবর্তী সময় হওয়ায় মানুষজনের আনাগোনা তেমন একটা নেই৷ যার দরুন, মান-সম্মান একটু হলেও রক্ষিত আছে স্পৃহার। উঠে দাঁড়ানোর পর কোমরে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো সে। বেশি জোরে না পড়ায় ব্যথাটা সহ্যনীয়, তবে পরে পেইনকিলার না খেলে উপায় হবে না। স্পৃহার মুখের অদ্ভুত আর উদ্ভট অভিব্যক্তি দেখেই নাহিদ বলে উঠলো, “বেশি লেগেছে বেয়াইন সাহেব? মালিশ করে দিব?”

স্পৃহা কটমট দৃষ্টিতে তাকালো, “ফাজলামো পেয়েছেন? একে তো আপনার জন্য পড়লাম আমি, তার উপর সরি পর্যন্ত বললেন না আপনি।”

নাহিদের গা ছাড়া ভাব, “সারাদিন বান্দরের মত লাফালাফি করলে এমনটাই হবে। বিয়েতেও তো স্থির ছিলে না এক জায়গায়, সারাক্ষণ টো টো করছিলে এদিক সেদিক।”

প্রথমে ইন্দুর আর এখন বান্দর সম্মোধন শুনে স্পৃহা প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠলো৷ রোষানল দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যাই করি না কেন আপনার সমস্যা কি?”

নাহিদ রসিকতার সুরে বলে, “সমস্যা যে আছে। আপনি হচ্ছেন আমার একটা মাত্র বেয়াইন, আপনার কিছু হলে এই বেয়াই মানুষটার-ই তো সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে। নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে সে।”

স্পৃহা চোখ ছোট করে বলে, “ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে?”

নাহিদ ঠোঁটের কোণে চমৎকার এক হাসির রেখা টেনে বলে, “তোমার তাই মনে হলে, তাই-ই। হ্যাঁ, করছি আমি ফ্লার্ট।”

স্পৃহা ফুঁসে উঠলো, কড়া কন্ঠে দুইটি বাণী বলার প্রস্তুতি নিতে যাবে তার পূর্বেই নিজের ফোনের দিকে দৃষ্টি গেল তার। ফোনের স্ক্রিনে আড়াআড়িভাবে লম্বাটে একটি দাগ পড়ে আছে। ফোনটির করুণ অবস্থা দেখা মাত্র দ্রুত সে-টি তুলে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হলো। ফোনটা হাতে নেওয়া মাত্র উৎকন্ঠা সে বলে উঠে,

“ডেম ইট! এখনই নষ্ট হতে হলো ফোনটা।”

নাহিদ সচকিত দৃষ্টিতে একবার তাকালো স্পৃহার দিকে। ভাবলো, এখনই স্পৃহা হয়তো রাগে ফেটে পড়বে। কিন্তু না তার ধারণা ভুল করে দিয়ে স্পৃহা একবারে শান্ত হয়ে গেল, টু শব্দ পর্যন্ত করলো না আর। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ মুঠোফোনের ভাঙা ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর কোন দ্বিরুক্তি না করে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। নাহিদ অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো স্পৃহার চলে যাওয়ার পানে।
স্পৃহা সাহেলার সাথে এসেছিল স্পর্শী আর নির্বাণের জন্য খাবার নিয়ে। কথা ছিল একসাথেই ইফতার করবে তারা। নাহিদ আসরের পর থেকেই হসপিটালে হওয়ায় দেখা হয়ে যায় তাদের। অতঃপর স্পৃহার ফোন আসায় সে বাহিরে চলে যায়, ঠিক তখন নাহিদও তার ব্যক্তিগত কাজে বের হয়। আর করিডরে আসতেই সেই ঘটনাটা ঘটে যায়।

কিয়ৎক্ষণ পর, নিজের কার্য শেষে নাহিদ স্পর্শীর কেবিনে আসলে জানতে পারে স্পৃহা সন্ধ্যার ঘটনার পর পরই চলে গিয়েছে। স্পৃহা চলে গিয়েছে শুনে নাহিদের মন আপনা-আপনি ক্ষুণ্ণ হয়ে গেল। অনুশোচনাবোধ হলো নিজের মাঝে। খেয়াল হলো, দোষটা বোধহয় ওরই ছিল।

_____________

স্পর্শীকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে কিয়ৎ প্রহর পূর্বেই। ডাক্তার আপাতত বাসায় কয়েকদিন বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন। স্পর্শীর খেয়াল রাখতে নির্বাণ লাজশরম ভুলে নিলুফাকে বলে ওদের বাসায় চলে আসে। কিছুদিন স্পর্শীর সাথে থাকবে বলে। স্পর্শী প্রথমদিকে এই বিষয় নিয়ে প্রচন্ড লজ্জা পেলেও পরবর্তীতে ঠিক হয়ে যায়।
রাতে সাহেলা স্পর্শীকে খায়িয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর নির্বাণ রুমে আসে। ঔষধের বক্স হতে রাতের ঔষধগুলো বের করে স্পর্শীকে দেয় খাওয়ার জন্য। ঔষধের বক্স পুনরায় নিজ স্থানে রাখার উদ্দেশ্যে নির্বাণ সেদিকে যাওয়া মাত্রই পার্শিয়া মৃদু শব্দ করে রুমে প্রবেশ করলো। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে এলো স্পর্শীর দিকে। কাছে আসতেই খুব আদুরে ভঙ্গিতে স্পর্শীকে ডাকতে শুরু করল৷ স্পষ্ট কোলে উঠার আহ্বান তার। স্পর্শী স্মিত হাসলো, হালকা ঝুঁকে হাত নিম্নে নিয়ে পার্শিয়ার মাথায় হাত বুলালো। বেশি ঝুঁকলো না পেটের সিলিতে টান পড়বে বলে। স্পর্শী পার্শিয়ার উদ্দেশ্যে কিছু বলার পূর্বেই নির্বাণ বলে উঠে,

“ওকে রুম থেকে বের কর।”

স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “ওর থেকে আপনার এত কি সমস্যা শুনি? কি করেছে ও?”

“ডাস্ট এলার্জির সমস্যা আছে আমার, বিড়ালের সংস্পর্শ সয় না আমার। আর এমনেও বিড়াল আমার পছন্দ না। বের কর ওকে।”

স্পর্শী নাক ফুলিয়ে কিছু বলার পূর্বেই পার্শিয়া উচ্চস্বরে ‘মিয়াও!মিয়াও!” করে চিল্লিয়ে উঠল। ক্ষণেই চমকে উঠল দু’জনেই৷ পার্শিয়া গা ঝামটা মেরে পিছন দিক দেখিয়ে রুম থেকে চলে গেল৷ পার্শিয়ার এহেন কর্মে নির্বাণ হতবিহ্বল নয়নে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে, “এমন করলো কেন?”

স্পর্শী কিছু হেসে উঠে বলে, “বেচারা রাগ করেছে আপনার উপর। তাই এমন করল।”

“তাই এমন? অদ্ভুত!”

“একটা কথা বলে রাখি, আমাকে আপন করার আগে কিন্তু আপনাকে পার্শিয়াকে আপন করে নিতে হবে। না-হলে কিন্তু বউ পাবেন না।”

নির্বাণ ঠোঁট দু’টি গোল করে চিন্তামগ্ন হওয়ার অভিনয় করে বলে, “কিন্তু… বউকে যে আমি অনেক আগেই আপন করে নিয়েছে, এখন কি হবে? আমি কি বিবাহিত ব্যাচেলর বলে গণ্য হব তখন?”

নির্বাণের কথার অর্থ বুঝতে পেরে স্পর্শীর শ্যামবর্ণ গালে রক্তজবার গাঢ় রঙ আলতোভাবে মেখে গেল। অস্ফুটস্বরে বলে, “আপনি চরম অসভ্য।”

নির্বাণ দরজায় খিল দিতে স্পর্শীর দিকে এগিয়ে এসে বলে, “হ্যাঁ শুধু তোমারই জন্য।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। নির্বাণ স্পর্শীর কাছে এসে ওর হাত টেনে ধরলো, হাতের মধ্যখানে হ্যান্ড-স্যানিটাইজার ঢেলে দিয়ে বলল, “হাত ভালো মত রাব করে নাও। পার্শিয়াকে ধরেছ তুমি।”

কথাটা শোনামাত্র স্পর্শী অসন্তোষ নয়নে তাকায়, তবে কিছু বলে না। কারণ সে জানে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নির্বাণের মাথাব্যথা সীমাহীন। তাকে বলেও কাজ হবে না। তাই সে, নিভৃতেই নির্বাণের কথা মেনে নিল৷ নির্বাণ স্মিত হেসে রুমের বাতি বন্ধ করে নীলাভ আলোটি জ্বালিয়ে দিল। সন্তপর্ণে স্পর্শীর নিকটে এসে শুয়ে ওকে আলগাভাবে জড়িয়ে ধরলো। তৎক্ষনাৎ স্পর্শীর অধরের শেষপ্রান্তে উপস্থিত হলো একরাশ হাসি। কিয়ৎক্ষণ নিভৃতে কেটে যেতেই নির্বাণ মিহি কন্ঠে বলে উঠে, “রাতে কোনপ্রকার সমস্যা হলে আমাকে জাগিয়ে বলবে। নিজে নিজে মাতব্বরি করবে না, অন্যথায় আমার সাবজেক্টে তোমার নাম্বার কাটতে কোন কৃপণতা করবো না আমি।”

কথাটা শোনামাত্র স্পর্শীর অধরের কোণে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু উবে যায়। সে অভিযোগের সুরে বলে, “এটার সাথে নাম্বারের কি সম্পর্ক? বর বলে আপনি এমন দূর্নীতি করতে পারেন না, এইটা অন্যায়। তার উপর বউকে থ্রেট তো গুরুতর অন্যায়।”

“তোমার মত ত্যাড়া মানুষকে সোজা করতে মাঝে মধ্যে দূর্নীতিবাজ হওয়াই যায়। আর এমন থ্রেট না দিলে বউ জীবনেও কথা শুনবে না।”

স্পর্শী বিরবির করে বলল, “স্যারকে বিয়ে করার এমন সাইড ইফেক্টস থাকবে জানলে আমি জীবনে এই বিয়ে করতেই রাজী হতাম না।”

নির্বাণের কর্ণকুহরে কথাটা গিয়ে পৌঁছাতেই নির্বাণ বলে উঠে, “রাজী যেহেতু হয়েছ সেহেতু ভোগান্তি তো ভুগতেই হবে। ইউ হ্যাভ নো আদার চয়েস।”

“হুহ!” স্পর্শী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নির্বাণ তা দেখে ধীর গতিতে নিজের মুখটা স্পর্শীর গ্রীবাদেশে নিয়ে আলতোভাবে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে, “সাইড ইফেক্ট নিয়ে চিন্তা না করে সুস্থ হও আগে। এরপর বেনিফিটও দেখতে পাবে।”

“বেনিফিট কি কি একটু শুনি।”

নির্বাণ স্পর্শীর কান বরাবর মুখ স্থির করে মিহিস্বরে বলে, “তোমাকে মা ডাক শুনাবো।”

পরক্ষণেই স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসতেই স্পর্শী বলে, “লাগবে না আমার কোন বেনিফিট। ঘুমান তো আপনি।”

নির্বাণ আরও কিছু বলতে চাইলো তবে সময় কাঁটা টুকটুক করে একের পর এক ঘর পেরিয়ে যেতে নির্বাণ কথা এগুতে চাইলো না। তাই ছোট করে বলল, “আচ্ছা ঘুমোও। রাত হয়েছে অনেক।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৮

রৌদ্রজ্বল আকাশে শুভ্র মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা। প্রকৃতি কেমন ঝিম ধরে বসে আছে। অতি ব্যস্ততা শহরের মাঝেও যেন ছেঁয়ে আছে নিস্তব্ধতা। ঘড়ির কাঁটা মৃদু শব্দ করে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। ঠিক বারোর ঘরে এসে বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। এমন সময়ই ইউসিসি কোচিং সেন্টার থেকে স্পৃহা বেরিয়ে রাস্তার ধারে আসে। নাকের ডগা হতে চশমাটা পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে রিকশা খুঁজতে উদ্যোগী হয় সে। রোজায় ধরেছে আজ তাকে, সব কেমন ছন্নছাড়া লাগছে। তার উপর অসহ্যনীয় এই গরম। কোনমতে এখন বাসায় যেতে পারলেই বাঁচে সে। সে এদিক সেদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে নিলে হুট করেই তার চোখ গিয়ে আটকায় রাস্তার অপারে দাঁড়িয়ে থাকা নাহিদের দিকে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে সে স্পৃহার পানেই তাকিয়ে আছে। দুইজনের দৃষ্টি একে অপরের সাথে বিনিময় হতেই নাহিদ রাস্তা পার হয়ে এদিক আসে। স্পৃহা এই মধ্যদুপুরে নাহিদকে নিজের কোচিং-এর সামনে দেখে বেশ অবাকই হলো। নিজের আশ্চর্যান্বিত ভাব লুকাতে না পেরে সে সালাম দিয়ে বলে উঠে, “আপনি এখানে কি করছেন নাহিদ ভাই? কোন দরকারে এসেছেন কি?”

নাহিদ সালামের উত্তর দিয়ে বলে, “হ্যাঁ দরকারেই এসেছি।”

স্পৃহা ঠোঁট গোল করে বলল, “অহ আচ্ছা। তা বাসায় চলেন।”

“না অন্য কোনদিন।”

নিত্যদিনের তুলনায় নাহিদকে আজ বেশ গম্ভীর, শান্ত দেখাল। স্পৃহা ভাবলো নাহিদ হয়তো তাড়ায় আছে, তাকে দেখেছে বলে ভদ্রতার খাতিরে দেখা করতে এসেছে। তাই সে নাহিদকে বাসায় যাওয়ার জন্য আর জোর করলো না, ব্যস্ত ভঙ্গিতে রিকশা খোঁজায় মনোযোগী হলো। আকস্মিক নাহিদ বলে উঠে, “সেদিন জন্য সরি। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কাটা দেয়নি সেদিন, অনিচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কাটা লেগেছিল।”

স্পৃহা চোখ তুলে তাকালো। নিজের চশমা ঠিক করে বলল, “জানি নাহিদ ভাইয়া। তবে চিন্তা করবেন না, আমি কিছু মনে করিনি। ভুল আমাদের দুইজনেরই ছিল।”

নাহিদ কিঞ্চিৎ হাসলো। ডান হাতে থাকা প্যাকেটটা স্পৃহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। এখন এইটা নাও।”

স্পৃহা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “জি?”

নাহিদের নির্লিপ্ত কন্ঠ, “তোমার জন্য এটা, নাও।”

স্পৃহা বিস্ময়কর কন্ঠে বলল, “আমার জন্য? কি?”

নাহিদ প্রত্যুত্তর করলো না। খুব সন্তর্পণে স্পৃহার হাতটা টেনে ধরে ওর হাতের মুঠোয় ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “রাখো।”

স্পৃহা ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলো ভিতরে একটি মোবাইল সেটের বক্স। স্পৃহার বুঝতে দেরি নি এটা কিসের জন্য তাকে দেওয়া হয়েছে। সে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত ব্যাগটা নাহিদের হাতে ধরিয়ে দেয় এবং বিনয়ী কন্ঠে বলে, “আমি এইটা নিতে পারব না ভাইয়া, আপনি নিয়ে যান।”

“তোমাকে ফোনটা আমি বিনা কারণে দিচ্ছি না। আমার জন্য তোমার ফোন নষ্ট হয়েছে বলেই দিচ্ছি।”

“আমি তো বলছি সমস্যা নেই৷ ওই ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছি তাই বলব আপনিও ভুলে যান। সেটা একটা এক্সিডে ছিল অনুশোচনা করার প্রয়োজন নেই, ফোনটা নিয়ে যান আপনি।”

নাহিদ অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার দিকে। কিছু বলার পূর্বেই পিছন থেকে স্পৃহার ডাক পড়ে। স্পৃহা ডাকা সাড়া দিতে পিছন ঘুরে তাকায়। তার ক্লাসমেট মৃন্ময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে। ছেলেটাকে দেখা মাত্র নাহিদের দৃষ্টি প্রখর হলো। স্পৃহা প্রত্যুত্তর করতেই মৃন্ময় সামনে এগিয়ে এলো মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “স্পৃহা তোমার কাছে গতকালকের নোট আর শিটগুলো হবে? আমি মিস দিয়েছিলাম কাল ক্লাস।”

স্পৃহা স্বল্প হেসে বলে, “হ্যাঁ আছে। তুমি নিতে পারো আমার থেকে।”

কথাটা বলে স্পৃহা একবার আড়চোখে নাহিদকে পর্যবেক্ষণ করে নিজের ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর কয়েকটা শিট বের করে মৃন্ময়ের হাতে তুলে দিল। মৃন্ময় বিস্তৃত হেসে বলে, “বাঁচালে আমায়। থ্যাংকস আ লট!”

স্পৃহা স্মিত হাসলো। মৃন্ময় নোটগুলোর দিকে নজর বুলাতে বুলাতে বলে, “আমার সাথে না-হয় ফটোকপির শপে চল, এখনই সব কপি করে তোমাকে নোটসগুলা ফিরিয়ে দিচ্ছি। অন্যথায় বাসায় নিয়ে গেলে আমি আবার ফেরত দিতে ভুলেও যেতে পারি।”

স্পৃহার কয়েকটা শিট আজ দরকার ছিল বলে মৃন্ময়ের প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে যায়। অতঃপর নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আসি ভাইয়া, ভালো থাকবেন। আর বাসায় এসেন কিন্তু।”

নাহিদ নিরুত্তর রইলো, তবে প্রখর দৃষ্টি অনড় থাকলো। স্পৃহা কোন উত্তর না পেয়ে পুনরায় একই কথা বলল। নাহিদ এইবার প্রত্যুত্তরে শুধু বলল, “যাও!”

স্পৃহা কোন সময় বিলম্ব করলো না মৃন্ময়ের সাথে সামনের দিকে হাঁটা দিল। নাহিদ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। পিছন থেকে শুনতে পেল ছেলেটা জিজ্ঞেস করছে, “ভাইয়াটা কে?”

স্পৃহা উত্তর দিল, “আপুর ছোট দেবর হয় তিনি। কোন কাজে এসেছি একটায়, হুট করে দেখা হলো তাই কথা বলছিলাম।”

পরবর্তীতে মৃন্ময়, স্পৃহা দূরে চলে যেতে আর কোন কথা নাহিদের কর্ণগোচর হলো না। তবে নাহিদের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। ভিতরকার অনুভূতি রূপ নিল বিশ্রী। নিজের সীমাহীন রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে খুব জোরে সামনে পড়ে থাকা ইটের টুকরোতে লাথি মারে। হঠাৎ করা এমন কর্মকান্ডের কোন ব্যাখা পেল না সে। এত রাগের উৎস পেল না। তার রাগটা আসলে কিসের জন্য? স্পৃহা তার দেওয়া গিফট নেয়নি বলে নাকি স্পৃহা অন্য একটা ছেলের সাথে আছে বলে নাকি স্পৃহা তাকে বোনের দেবর বলে সম্মোধন করেছে বলে? কে জানে!

__________________

বড় সড়কের দিকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নির্বাণ। পাশেই স্পর্শী বসে ঝিমুচ্ছে। প্রায় সকাল সকালই ঘুম পূর্ণ হওয়ার আগেই নির্বাণ তাকে ঘুম থেকে তুলে উঠিয়েছে, হসপিটালে যাবে বলে। আজ তিন হলো তাকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করা হয়েছে,তাই রেগুলার চেকাপ এখন আবশ্যক। স্পর্শী আজ যেতে না চেলেও নির্বাণ তাকে বলতে প্রায় ধরে বেঁধেই নিয়ে এসেছে। এতে স্পর্শী গাল ফুলালেও নির্বাণের মন গলেনি। যাই হোক না কেন, স্পর্শীর স্বাস্থ্যের সাথে নির্বাণ কোন ধরনের হেলা করতে প্রস্তুত নয়।

হসপিটালের সামনে পার্কিং এরিয়াতে গাড়ি পার্ক করে নির্বাণ আগে গাড়ি থেকে নামে। স্পর্শীর সিটের দিকে ঘুরে এসে দরজা খুলে স্পর্শীকে নামতে সাহায্য করে সে। অতঃপর গাড়ি লক করে স্পর্শীর হাতে ফাইল দিয়ে তাকে এক হাত দিয়ে ভালোমত জড়িয়ে ধরে এবং আরেক হাতের মুঠোয় স্পর্শীর হাতটি শক্ত করে ধরে। তার পুরো চেতনা এদিকেই নিবদ্ধ, স্পর্শীর যাতে বিন্দুমাত্র কষ্ট না হয়। আশেপাশে অনেকেই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, চাহনিতে কারো বিস্ময় তো কারো মুগ্ধতা তো কারো ঈর্ষা। কিন্তু তাদের বা তাদের চাহনির দিকে নির্বাণ বা স্পর্শী কেউই বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ডাক্তারের কেবিনের দিকে।

চেকাপ করিয়ে বের হওয়ার সময় একটা ওয়ার্ডবয়ের সাথে স্পর্শীর ধাক্কা লাগলো। সাথে সাথে ওয়ার্ডবয়ের হাত থেকে দু’টো কাঁচের শিশি পড়ে ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। নির্বাণ দ্রুত স্পর্শীকে পিছনের দিকে টেনে আগলে নিল। ব্যাকুল, উৎকন্ঠা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ঠিক আছো? কোথাও ব্যথা পাও নি তো?”

ঘটনাক্রমে স্পর্শী ভয়ে কিছুটা আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নির্বাণ কন্ঠ শুনে সে চোখ তুলে তাকায়। নিজেকে শান্ত করে আশ্বস্ত সুরে বলে, “ঠিক আছি আমি।”

স্পর্শী ঠিক আছে শুনে কিছুটা শান্ত হলে সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই গলা উঁচু করে ওয়ার্ডবয়ের উদ্দেশ্যে ল বলে উঠলো, “দেখে চলা ফেরা করতে পারেন না?”

নির্বাণের অতি গাম্ভীর্যপূর্ণ উচ্চকণ্ঠ শুনে ওয়ার্ডবয় ভয়ে কেঁপে উঠে। পরিবেশটাও হঠাৎ শান্ত হয়ে যেতে ওয়ার্ডবয় ঘাবড়ে যায়, অস্ফুটস্বরে বলে, “স..সরি স্যার! সরি ম্যাম! আমি খেয়াল করিনি।”

নির্বাণ রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “খেয়াল করিনি মানে কি? এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কিভাবে হয় মানুষ? এখন আমার ওয়াইফ যদি পড়ে যেত বা কাঁচ তার শরীরে বিঁধে যেত তখন কি হতো? এর দায়ভার কি আপনি নিতেন নাকি অথোরিটি নিত?”

ওয়ার্ডবয় অত্যন্ত ভয়ার্ত কন্ঠে বলে, “সরি স্যার! আমার ভুল হয়ে গিয়েছে এমন আর হবে না। প্লিজ স্যার এবারে মত মাফ করে দিন।”

নির্বাণ আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্পর্শী নির্বাণের বাহু টেনে ধরে অত্যন্ত ভীতু গলায় বলে, “নির্বাণ থাক না! বলছে তো ভুল হয়ে গিয়েছে৷ মাফ করে দেন। আপনি এখন যান ভাইয়া আর দ্রুত ফ্লোর পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নিন।”

শেষ কথাটি স্পর্শী ওয়ার্ডবয়ের উদ্দেশ্যে বলল। নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে পুনরায় ওয়ার্ড বয়ের দিকে তাকালো। ওয়ার্ড এর ফাঁকে, “ধন্যবাদ ম্যাম! আমি এখনই সুইপারকে পাঠাচ্ছি পরিষ্কার করে দিতে জায়গাটা।”

কথাটা বললেই ওয়ার্ডবয় কোনমতে দৌড়ে পালালো। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো অতঃপর স্পর্শী কে শক্ত করে ধরে সে জায়গা থেকে আস্তে আস্তে সরে আসলো। সাবধানতা এত যে ফুলের টোকাও যেন স্পর্শী ত্বক স্পর্শ না করতে পারে৷ হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসতেই নির্বাণ সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো একজন মধ্যবয়স্ক লোক কানে ফোন চেপে কথা বলতে বলতে আসছে। গায়ে এপ্রোন ঝুলছে তার। মানুষটিকে দেখামাত্র নির্বাণের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো লোকটার দিকে, ক্রোধে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। সামনের মানুষটিও নির্বাণকে দেখামাত্র থমকে দাঁড়ালো, কিছু একটা বলে ফোন কানের নিচ থেকে নামিয়ে নিল। নির্বাণ আর দাঁড়ালো না দ্রুত পা চালালো সামনের দিকে। লোকটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সে বলে উঠে, “কেমন আছো?”

নির্মাণ এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। এভাবেই নির্বাণের মেজাজ চওড়া ছিল তার উপর এই লোকের সাক্ষাৎকার যেন তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। তবুও সে নিজেকে প্রচন্ড শান্ত রাখার চেষ্টা করে কাঠকাঠ কন্ঠে বলল,”আমি কেমন আছি সে-টা জেনে আপনার কোন কাজ নেই। সো মাইন্ড ইউর ওউন বিজনেস।”

কথাটা বলে নির্বাণ আর কোন সময় ব্যয় করে দ্রুত সে স্পর্শীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। স্পর্শী তখন পুরোটা সময়-ই নীরব থেকে পর্যবেক্ষণ করে যায়। এমনকি গাড়িতে উঠার পরও সে কোন প্রকার টু শব্দ করে না। প্রশ্ন করে না, নির্বিকার থাকে৷ কেন না, নির্বাণের মুখশ্রী দেখেই তার বুঝতে দেরি নির্বাণ ঠিক কি পরিমাণ রেগে আছে। আর তার রাগ যে কত ভয়াবহ তা স্পর্শীর থেকে ভালো কে বাই জানে? এখন অল্প কিছু হলেই সে রাগে ফেটে পড়বে আর তার ভোগান্তির শিকার হতে হবে স্পর্শীকে। তাই সে চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলো। তবে মনে মাঝে বুনতে শুরু করলো অজানা অজস্র প্রশ্ন। মিললো কিছু সমীকরণ। সেই লোকটার আর নির্বাণের মুখ আকৃতিতে কিঞ্চিৎ মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। দুইজনের মধ্যে পরিচিতি তো নিশ্চয়ই আছে কিন্তু সে-টা কি তাই অজানা।

গাড়ি যখন হসপিটালের তীর-সীমানা থেকে কয়েক মাইল দূরে এসে অবস্থান করে তখন স্পর্শীর মনের মাঝে কিছুটা সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “লোকটা কে ছিল?”

নির্বাণ তাকালো না স্পর্শীর পানে৷ রাস্তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “তার পরিচয় দেওয়ার মত কোন সম্পর্ক বা পরিচয় আমার কাছে নেই।”

স্পর্শী নিম্ন স্বরে বলল, “জি আচ্ছা।”

“তবে…. তাকে আমি একদা বাবা বলে জানতাম।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here