চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -২১+২২+২৩+২৪

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২১

বিছানার উপর পা তুলে বসে আছে স্পর্শী। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। নির্বাণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু দিয়ে বারংবার গালে ঘর্ষণ চালাচ্ছে আর বিরবির করে কিছু একটা বলেই চলেছে। মাঝে মধ্যে ঘুরে স্পর্শীকে জিজ্ঞেস করে উঠছে, “পরিষ্কার হয়েছে?” স্পর্শী হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেওয়া সত্ত্বেও ক্ষান্ত হচ্ছে না সে, বার বার গাল ঘষেই চলেছে। ইতিমধ্যে গালের সেই অংশটুকু রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কিয়ৎক্ষণের বেশি এইভাবে চলতে থাকলে হয়তো জায়গায়টা ছুঁলে যাবে। নির্বাণের এমন কান্ড দেখে স্পর্শী বিকেলের কথা মনে পড়ে যায়। সে সময় নাহিদ নির্বাণকে জড়িয়ে না ধরলেও মাস্কের ভেতর দিয়ে গালে হালকা কাঁদা ছুঁয়ে দেয়। এই নিয়ে নির্বাণের যে কাণ্ড। বকে-টকে রাখেনি নাহিদকে। তবে, সারা শরীরে কাঁদা লেগে থাকায় নাহিদ মাইর থেকে বেঁচে যায়। অন্যথায় নির্বাণের হাতে হয়তো আজ সে শহিদ হয়েই যেত। মেলা থেকে নির্বাণ কোনমতে তড়িঘড়ি করে বাসায় এসে দু’বার ফ্রেশ হয় তবুও যেন তার মনের খুঁতখুঁতানি ভাবটা অতিক্রম করে উঠতে পারেনি। সে যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কার্য চলমান রেখেছে তো রেখেছেই।
স্পর্শীর ভাবনার মাঝেই নির্বাণ চতুর্থবারের মত জিজ্ঞেস করে উঠে,

“দেখ তো, পরিষ্কার হয়েছে কি-না?”

স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়৷ অবসন্ন সুরে বলে, “বলছি তো হয়েছে। এই নিয়ে চারবার একই কথা জিজ্ঞেস করলেন, এখন আর কিভাবে বুঝাই আপনাকে আমি?”

নির্বাণ অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে একবার স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় আয়নাতে তাকালো। হাতের টিস্যুটা ফেলে আবার নতুন টিস্যু নিয়ে পূর্ণ উদ্যোমে গালে ঘষা শুরু করলো। স্পর্শী এইবার হতাশাজনক নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো, শব্দহীনভাবে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই আবার ফিরে আসলো সে, বাটিতে বরফ নিয়ে৷ বাটিটা বিছানার উপর রেখে এগিয়ে গেল নির্বাণের দিকে। নির্বাণের চলন্ত হাতের কব্জি ধরে মন্থর কন্ঠে বলে, “হয়েছে, আর কত? জায়গায়টা কেমন লাল হয়ে আছে দেখেছেন? আরেকটু হলে তো চামড়া ছিলে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। থামেন এবার।”

কথাটা বলে স্পর্শী নির্বাণের হাত থেকে টিস্যুটা নিয়ে ফেলে দিল। অতঃপর নির্বাণকে টেনে বিছানায় বসালো। বাটি থেকে এক টুকরো বরফ নিয়ে চেপে ধরলো গালে। সপ্তপর্ণে গালের চারপাশে হিম পরশ বুলিয়ে দিতে থাকলো। কন্ঠে তীব্র রাগ মিশিয়ে বলল,

“আপনি না বলেন, অতিরিক্ত কিছুই ভালো না? তাহলে নিজের বেলায় কেন মানেন না? সামান্য কাঁদা লেগেছে। কোন ক্ষতিকারক এসিড না যে আপনি এমন করছেন। ইশশ কি অবস্থা করেছেন জায়গাটার, দেখেছেন একবার?”

নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না, নীরব রইলো। নিভৃতে তাকালো স্পর্শীর দিকে। দুইজনের মাঝে দূরত্ব কিঞ্চিৎ, দূরত্ব ঘুচে গেলেই তীব্রভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি গণনা করা যাবে। ক্ষণে নির্বাণের ইচ্ছে করলো দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিতে। ভাবনাটা কার্যকরী করতেই নির্বাণ কিঞ্চিৎ সময় বিলম্ব না করে স্পর্শীর কোমর চেপে ধরে তাকে নিজের দিকে টান দেয়। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠার আগে স্পর্শী ঝুঁকে পড়ে নির্বাণের দিকে, দুই আঙ্গুলের ফাঁক থেকে ছুটে পড়ে বরফের টুকরোটি। ভর সামলাতে হাত গিয়ে ঠেকে নির্বাণের বুকে। এক গাছি চুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুখে, বৃহৎ বিস্ময়ান্বিত দৃষ্টি তাকায় সে। নির্বাণ ধীর হাতে স্পর্শীর মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়,

“নিজের স্যারের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছ? মনে ডর-ভয় নেই? এখন আমি যদি তোমায় শাস্তি দেই, মানা করার সাধ্য আছে তোমার?”

স্পর্শী অস্ফুটস্বরে বলে, “এইটা ভার্সিটি না, আর না আপনি এখন আমার স্যার।”

“তাহলে আমি এখন কি তোমার? সেটা বুঝে না-হয় শাস্তি দিব তোমায়।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। লজ্জায়,সংশয়,সংকোচে মেদুর গালে ছড়ায় রক্তিমা। শব্দ,বাক্য হয় নিরুদ্দেশ। নির্বাণ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হয় নাহিদের কন্ঠ। ভড়কে উঠে দু’জনেই। নির্বাণ তৎক্ষনাৎ কোমর থেকে হাত সরাতেই স্পর্শী লাফিয়ে সরে দাঁড়ায় নির্বাণের নিকট হতে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায় দরজার দিকে। পরমুহূর্তে নাহিদ এসে বলে,

“ভাবী আপনাকে মা ডাকছে আর ভাই মা তোকে সব গুছিয়ে রাখতে বলেছে। রাতের খাবার খেয়েই রওনা হবো আমরা।”

স্পর্শী কোনমতে মাথা দুলিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে শয়নকক্ষ ত্যাগ করে। স্পর্শী যেতেই নির্বাণ রাগান্বিত নয়নে তাকায় নাহিদের দিকে, ক্ষণেই নাহিদের অভিব্যক্তি পাংশুটে হয়ে যায়। নির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তুই একবার ঢাকা চল। সব হিসাব-নিকাশ যদি সুদে আসলে না চুকিয়েছি আমি তাহলে দেখিস।”

নির্বাণের কথার শুনে নাহিদ ধরে নিল নির্বাণ তাকে বিকেলের ঘটনার জন্যই শাসাচ্ছে। সেই ঘটনার রেশ ধরে নাহিদ আমতা-আমতা সুরে বলে, “আরেহ ভাই সরি না, আমি ফাজলামো করতে চাচ্ছিলাম শুধু। তোকে কাঁদা লাগানোর কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না, সব ভুলবশত হয়েছে। এইবারের মত মাফ করে দে, জীবনেও আর তোর ধারের কাছে ঘেষবো না। প্রমিস!”

নির্বাণ পুনরায় চোখ রাঙানো মাত্র নাহিদ মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে, “মৃদুল আমায় বিছানায়, ধুর! রুমে ডাকছে। আমি যাই!”

কথাটা বলেই নাহিদ কেটে পড়ে। নির্বাণ সেদিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় গিয়ে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। তার মনে এখনো আশঙ্কা আছে তার গাল পরিষ্কার হয়নি।

_____________________

নিস্তব্ধ রাত্রি। অনিলের তীক্ষ্ণতা পেরিয়ে হাইওয়ের রাস্তা ধরে শা শা শব্দে চলছে গাড়ি। গাড়ির ইনার লাইট অফ থাকায় বুঝা যাচ্ছে না ভিতরকার অবস্থা। বাহিরে হতে মাঝে মধ্যে সোডিয়াম লাইটের টুকরো টুকরো আলো গাড়ির জানালা ভেদ করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে স্পর্শীর ঘুমন্ত মুখশ্রীতে। শ্যামময়ী নারীর ঘুমে ব্যাঘাত আনার প্রবল চেষ্টা যেন। পিছনে নিলুফা আর নাহিদও তন্দ্রাঘোরে বিভোর। নির্বাণ রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিমর্ষচিত্তে তাকালো স্পর্শীর পানে। ঘুমন্ত মানবীর মুখশ্রী জুড়ে তখন আদুরে ভাব বিরাজমান। আর কিঞ্চিৎ প্রহর আছেই তারা একসঙ্গে, অতঃপর পুনরায় দুইজনে দুই প্রান্তে। ফের কবে একত্রে আসবে দুইজনে কে জানে? যত গাড়ি এগুচ্ছে ততো নির্বাণের হৃদয়ে দহনক্রিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কয়েকদিনের ব্যবধানেই মানুষটা যে অজান্তেই তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে, সেই অভ্যাস এখন কি করে ছাড়াবে সে? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো নির্বাণ৷

কিঞ্চিৎ প্রহর পরেই পূবাকাশে অগ্নিপিণ্ডের স্নিগ্ধ আভার দেখা মিললো। কৃষ্ণ আকাশ আবৃত হলো নীলাভ-সাদা চাদরে। পাখিদের কলধ্বনি গুঞ্জিত হলো চারদিক। নির্বাণ নাহিদ ও নিলুফাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ছুটলো স্পর্শীর কোলানির দিকে৷ দেখতে দেখতেই গাড়ি এসে থামলো ‘ব্যাংক টাউন’ কোলানির সামনে। নির্বাণ সিটবেল খুলে ঘুরে বসলো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী তখনও ঘুমে কাঁদা। আলতো স্বরে ডাকলো নির্বাণ। কিয়ৎকাল পর গোঙানির মত শব্দ করে স্পর্শী পিটপিটিয়ে চাইলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,

“কি হয়েছে? এত সকালে ডাকচ্ছেন কেন?”

নির্বাণ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “তোমার বাসা এসে গিয়েছে। উঠো!”

কথাটা কর্ণপাত হওয়ার মাত্র স্পর্শী টনক নাড়লো। চোখ টানটান করে তাকালো চারিপাশে। নিজের কোলানীর সামনে গাড়ি দেখে স্থির হলো সে। অতঃপর পিছন সিটের দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মা আর নাহিদ ভাই কোথায়?”

“বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছি।”

স্পর্শী চমকিত হবে বলে, “কখন? আর আমাকে ডাকেননি কেন? মা কি ভাবছে বলুন তো? বিদায়ও নিতে পারলাম না।”

“কিছু ভাবছে না সে। মা এইসব বিষয় এত একটা গুরুত্ব দেয় না। চিন্তার বিষয় নেই।”

স্পর্শী অপ্রসন্ন হয়, “তাও তো!”

কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকে সে। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “আচ্ছা, আমি যাই।”

নির্বাণ তখন স্পর্শীর দিকেই তাকিয়ে ছিল। মুহূর্তে চোখাচোখি হলো তাদের। স্পর্শী লজ্জায়,সংকোচে দৃষ্টি নামালো। নির্বাণ অকস্মাৎ বলে উঠে, “স্পর্শী!”

নির্বাণের মোলায়েম কন্ঠে সম্মোধনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “জি?”

“সাবধানে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো।”

“আপনিও রেখেন।”

নির্বাণ কিছু বলল না। নীরবে এগিয়ে এলো স্পর্শীর মুখের সম্মুখে৷ নির্বাণ এগিয়ে আসতে দেখে স্পর্শী পিছালো না, সে জানে নির্বাণ তার সিটবেল খুলে দেওয়ার জন্যই এগুচ্ছে। খামাখা মাথা পিছিয়ে ইজ্জতের ধূলিসাৎ করার মানে হয়-না। কিন্তু নির্বাণ স্পর্শীর ভাবনার উর্ধ্বে গিয়ে এক অপ্রকাশিত কাজ করে বসল। নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া আলতোভাবে চেপে ধরে স্পর্শীর ললাটে। অনন্তর, খুব আদুরে ভঙ্গিতে স্পর্শীর গালে হাত রেখে বলে, “আমার অভ্যাসগুলো এইভাবেই পরিবর্তন না করলেই পারতে।”

কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীর সিটবেল খুলে দিয়ে সরে আসে সে। দৃষ্টি স্থির করে সামনে। ঘটনাক্রমে স্পর্শী বিমূঢ়,বিহ্বল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকায় সামনে৷
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২২

বিছানার একপার্শ্বে দেয়ালে মেরুদণ্ড ঠেকিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে বসে আছে স্পর্শী। দৃষ্টি তার স্থির উড়ন্ত নীলাভ পর্দার দিকে। পর্দার আস্তরণ ভেদ করে এক মুঠো রোদ হামাগুড়ি খাচ্ছে শুভ্র মেঝেতে। নিদ্রাভর নয়নে ভাসছে শ্যামপুরুষের স্নিগ্ধ মুখশ্রী, মনের দুয়ারে বিচরণ করেছে তার সাথে কাটানো স্মৃতি। কিঞ্চিৎ সময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মৃতি চারণ হতেই স্পর্শী নিজ অজান্তে হাত ছোঁয়ায় কপালের মধ্যভাগে। মানুষটার অকৃত্রিম স্পর্শ লেগে আছে এইখানে। মুহূর্তে লালাভ রঙটি নিবিড়ে খেলা করে যায় ফুলো দু’টি গাল জুড়ে। হেসে উঠে সে। তবে, ঘটনার আকস্মিকতা তখনও তার মাঝে বিরাজমান। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলে উঠে,

— কি রে হাসছিস কেন এইভাবে?

চমকে উঠে স্পর্শী। দরজার ধারে সালেহাকে দেখে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে, “কিছু না এইভাবেই।”

সালেহা সন্দিহান দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে চুলে হাত খোপা করতে করতে বলেন, “নির্বাণের পরিবার কেমন ছিল? আর তাদের ব্যবহার?”

“সব ভালো ছিল মা, চিন্তা কর-না। দেখো, আসার সময় নানাজান আমাকে দু’জোড়া স্বর্ণের চুড়ি দিয়েছেন।”

কথাটা বলে স্পর্শী নিজের দুই হাত সামনের দিকে তুলে ধরে। সালেহা সেটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, ঠোঁটের কোণে ফুটে তার তৃপ্তির হাসি। প্রফুল্ল কন্ঠে বলে,

“ভালো হলেই তো ভালো। তা চুড়ি দুইটা বেশ সুন্দর। সাবধানে রাখিস নিজের কাছে, হারিয়ে ফেলিস না। এখন, খাবার দিয়েছি খেতে আয়।”

স্পর্শী মাথা দোলায়, “আচ্ছা।”

“আর শুন, ব্যাগ থেকে বাসি জামাগুলো নামিয়ে রাখিস। বুয়া আসলে ধুতে দিয়ে দিব।”

“আচ্ছা।”

সালেহা আর কিছু বলেন না, নীরবে রুমটা প্রস্থান করেন। স্পর্শী হাতের কাজটুকু সেড়ে বাহিরে চলে আসে। টেবিলের নিকট আসামাত্র পার্শিয়া উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে উঠে। স্পর্শী পার্শিয়ার দিকে তাকানো মাত্র সে দৌড়ে আসে। স্পর্শী মিষ্টি হেসে হাটু গেঁড়ে বসে হাত দু’টো মেলে ধরতে পার্শিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কোলে। স্পর্শী বেশ আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দেয় পার্শিয়ার ধূসর রঙ্গের কেশে। তবে, পার্শিয়ার চেঁচানো থামে না। নিজ ভাষায় যতটুকু সম্ভব অভিযোগ জারি করছে সে। অভিমানী কন্ঠে যেন প্রশ্ন করছে, “আমাকে ফেলে তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি জানো না আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না? তাহলে আমাকে একা রেখে গেলে কেন?”

স্পর্শী হাসে। নিবিড় বন্ধনে পার্শিয়াকে আবদ্ধ করে আহ্লাদী সুরে পার্শিয়াকে ভুলাতে থাকে। একটা সময় গিয়ে পার্শিয়া শান্ত হয়। মমতাময় পরশ পেতে মাথা হেলিয়ে স্পর্শী বা বাহুতে ঘেষে।

________________

সাঁঝ শেষে আঁধারে আবৃত হয় নীলাভ আকাশ। শুভ্র মেঘ রূপান্তরিত হয় কৃষ্ণবর্ণে। তীব্র অনিলের আনাগোনায় ঝমঝম শব্দ করে উঠে বৃক্ষের দল। সময় নিয়ে ডেকে উঠে মেঘদূত। ঝড় আসার আশঙ্কা। কিন্তু আবহাওয়া নিয়ে যে স্পর্শীর কোন ধ্যাণ নেই। সে নিমগ্ন অন্য কাজে। দীর্ঘ বিরতির পর আজ আবার তার হাতে উঠেছে রঙ-তুলি। গভীর মনে সে আঁকতে ব্যস্ত কারো মুখশ্রী। এই প্রথম প্রচেষ্টা তার। আগে কখনো কারো মুখশ্রী আঁকার ক্ষীণ চেষ্টাও করেনি সে। তবে এইবার কেন করছে কে জানে? টানা তিনঘণ্টা ক্যানভাসে কাঠ পেন্সিলের সুক্ষ্ণ,পুরু আঁচড়ে অর্ধেক স্কেচ সম্পন্ন হয়। ক্লান্তিমাখা নিঃশ্বাস ফেলে নাক অবধি আঁকা স্কেচটির দিকে একমনে তাকায় স্পর্শী। মানবটির মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো, চোখের মনিতে দৃঢ়তা,প্রখরতা স্পষ্ট। চোখের নিজে কিঞ্চিৎ খাদ, নাকের দিকে বসন্তের গাঢ় দাগ। প্রতিচ্ছবিটি অর্ধাংশ হলেও পরিস্ফুট নির্দেশ করছে এক ব্যক্তির দিকেই। মানুষটি স্পর্শী বড্ড কাছের। বড্ড!
স্পর্শী হাসে। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার মন তীব্রভাবে চাইছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কন্ঠ শোনার, তার মুখ দর্শন করার। সে যতই অস্বীকার করুক না কেন, নিভৃতে মানুষটা তারও অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাও বাজে এক অভ্যাসে। কিছু সময় স্পর্শী ভাবলো। ফোন দিবে কি-না, ফোন দিয়ে কি বলবে? ফোন দেওয়া কি ঠিক হবে তার? বুঝে উঠতে পারলো না সে। কিয়ৎক্ষণ অস্থিরচিত্তে কাটিয়ে স্পর্শী উঠে দাঁড়ায়। বিছানার উপর থেকে নোংরা হাতেই ফোনটি মুঠোয় পুরে নিল। ডান হাতের তর্জনীর সাহায্যে কন্ট্রাক্ট লিস্ট স্ক্রোল করলো সে, নির্বাণের নাম্বার স্ক্রিনে রেখে ভাবলো আবার। অতঃপর লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ডায়াল করলো নির্বাণের নাম্বারে।

__________________

দুপুরে খেয়ে ভাতঘুম দেয় নির্বাণ। সেই ঘুম গিয়ে ভাঙ্গে সন্ধ্যার নামার ঠিক পড়ে। তন্দ্রাঘোর কাঁটামাত্র নির্বাণের মাঝে অদৃশ্য এক ব্যাকুলতা ঘিরে ধরে। মন জুড়ে বিচরণ করে এক কৃষ্ণময়ী নারী আর কিছু অশোভন চিন্তাধারা। যা কি-না পীড়িত করছে নির্বাণের অন্তঃস্থলকে। তবে, ভিতরে ভিতরে সে দগ্ধ হলেও বাহির দিয়ে তার অভিব্যক্তি নিত্যদিনকার মতই শীতল। নিজের অনুভূতি থেকে ছাড় পেতে ব্যস্ততায় নিজেকে নিমজ্জিত করার চেষ্টা করে।
কখনো রুম জুড়ে পায়চারি করে, তো কখনো বুকশেলফ থেকে পছন্দের বইটি বের করে মনোযোগ স্থির করার চেষ্টা করে। কখনো বা ভার্সিটির লেকচার গুছিয়ে, কখনো স্লাইড তৈরি করে৷ কিন্তু সবই যেন আজ বিফলে যাচ্ছে, মন বসছে না কোথাও। উৎকন্ঠা, ব্যগ্র মন কি আর খোরাক মিটা না পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। মোবাইল হাতে নিতেই আগমন হলো নাহিদের, “কি করছো ভাই?”

নির্বাণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, “কিছু না। কেন কোন দরকার?”

“খালি যেহেতু আছিস সেহেতু আমার কিছু উপকার করে সোয়াব কামা।”

বিস্তৃত হেসে বললো কথাটা নাহিদ। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কি চাই তোর?”

“আমাকে এই ট্রামগুলো বুঝিয়ে দে। আগামাথা কিছু বুঝতাসি না।।”

“কোন বই এইটা?”

“নিউক্লিয়ার ফিক্সিস।”

নির্বাণ মোবাইল পার্শ্বে রেখে নাহিদের কাছ থেকে ফোনটা হাতে নেয়৷ ম্যাথ আর ক্যালকুলেশনে একবার চোখ বুলিয়ে নাহিদকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করে। বোঝানোর শেষে নাহিদ বলে উঠে, “তোর এতটুকু মাথায় এত এত থিওরি, ম্যাথ,ইকুয়েশন রাখোস কিভাবে? এত স্টোরেজ আমদানি কোথা থেকে করোস? তোকে দেখলেই আমার ডিপ্রেশন মোড অন হয়ে যায়।”

“কাজ শেষ হলে চোখের সামনে থেকে বিদায় হো।”

নাহিদ ভেংচি কেটে বলে, “দোয়া দিতে চাইসিলাম যে, এক হালি বাচ্চার বাপ হো। কিন্তু তুই ওইটার যোগ্যই না। ইশশ! আমার ভাবীর জীবনটাই গেল তোর সাথে বিয়ে হয়ে। এই জন্যই বলে, একটি ভুল সারাজীবনের কান্না।”

নির্বাণ রোষানল দৃষ্টিতে তাকালো। তা দেখে নাহিদ ভ্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে, “আরেহ আমার ভাইটা কত কিউট,সুইট। একদম শিম্পাঞ্জির মত, ভাবী তোকে পেয়ে খুব লাকি।”

কথাটা বলেই নাহিদ কেটে পড়ে। নাহিদ কেটে পড়তেই নির্বাণের অস্থিরতা দ্বিগুণ। নিজের সাথে প্রায় এক প্রকার যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে ফোন লাগায় স্পর্শীর নাম্বারে। তবে রিং ঢোকা মাত্র অতি মিষ্ট সুরে এক নারী বলে উঠে, “আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন তা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার কল করুণ।”

মুহূর্তেই নির্বাণের ভ্রু কুঁচকে গেল। পরপর পাঁচবার কল মিলালো সে। তবে, প্রতিবারই একটি কথা প্রতিধ্বনিত হলো, “কলটি এখন ব্যস্ত আছে।” নির্বাণ বুঝে উঠতে পারলো না স্পর্শী এত কথা বলছেটা কার সাথে? নির্বাণ আরও কয়েকবার ফোন মিলালো কিন্তু ফলাফল সেই আগের ন্যায় রইলো। বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুচে এলো নির্বাণের। তীব্র আক্ষেপ নিয়ে কিছু একটা বিরবির করলো। শেষে রাগ সংযত করতে ন পেরে ফোনটা উল্টো করে ফেললো বিছানার উপর। ক্ষণেই ফোনটা চাপ খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল। অপরপ্রান্ত হতে কেউ শুনতে পেল “সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না” -এর মত তীক্ত ধ্বনি। অথচ নির্বাণ জানলোই না অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটিও দীর্ঘসময় যাবৎ তার নাম্বারেই কল মিলাতে ব্যস্ত ছিল।

__________________

ঝাঁজালো বর্ষণের রাত। চারিপাশ আদ্রতায় ঘেরা।
রাস্তার ভাঙা, নিচু অংশে জমে আছে কাঁদা পানি। ঘড়ির কাটা তখন এগারোটা বেজে সাঁইত্রিশের ঘরে পদার্পণ করেছে সবে। স্পর্শী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ মনে বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ উপভোগ করছিল, ঠিক সে সময় কর্কশ কন্ঠে স্পর্শীর ফোনটা বেজে উঠে। রিংটোন শুনে স্পর্শী বারান্দা থেকে রুমে আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে নির্বাণের কল। নির্বাণের নামটি দেখামাত্র অভিমানের পুঞ্জীভূত মেঘ প্রগাঢ়তা পায়। সেসময়, কতবারই না কল করলো সে নির্বাণকে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যস্ত বলছিল তার ফোন, এরপর বন্ধ। উপরন্ত, একটিবারের জন্যও নির্বাণ তাকে কল-ব্যাক করেনি। এই দ্বায়িত্ব তার স্পর্শীর প্রতি?

স্পর্শী ঠিক করলো সে কোনক্রমেই ফোন ধরবে না। মানুষটাও বুঝুক অপেক্ষা জিনিসটা ঠিক কতটা দীর্ঘ এবং কষ্টদায়ক। তবে, কথাটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না সে। তৃতীয়বারের মত ফোন বেজে উঠতেই কলটা রিসিভ করলো স্পর্শী। কিছু বলার পূর্বেই কাঠিন্য কন্ঠে নির্বাণ বলে উঠে, “নিচে নামো এখনই। ফাস্ট!”

কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার সুযোগ পেল না স্পর্শী। তার আগেই ফোন কেটে গেল। স্পর্শী বিহ্বল, বিচলিত, উৎকন্ঠিত স্তব্ধ হয়ে থাকলো কিয়ৎকাল। অতঃপর বাহিরে না গিয়ে আগে ছুটলো বারান্দার দিকে। সেখান থেকে বাড়ির সামনের রাস্তাটা সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। বারান্দায় এসে স্পর্শী রাস্তার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি স্থির হয় কালো রঙের গাড়িটির দিকে। গাড়িটি সে চিনে, বেশ ভালো করেই চিনে। স্পর্শী নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তবে, পরমুহূর্তেই রাস্তার ধারে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে তীব্র বর্ষণের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুদ্ধিভ্রষ্ট,বিমূড় প্রায়। নির্বাণ তখন নিবিড়ভাবেই স্পর্শীর বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, যার দরুন স্পর্শী ওর দিকে তাকানো মাত্র দৃষ্টি বিনিময় তাদের। ক্ষণেই যেন দুই মরুর বুকে নামে এক পশলা বৃষ্টি। তৃষ্ণা মিটায় অশান্ত মনের। হাতের ইশারায় নির্বাণ পুনরায় স্পর্শীকে নামতে বলে। কিন্তু স্পর্শী তখনও স্থির, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সিক্ত পুরুষের প্রণয়ী অনুভূতি জাগ্রত করা কর্মকাণ্ডে।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৩

স্পর্শী খুব সুক্ষ্ম নজরে নির্বাণকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। বা-হাতে তোয়ালে নিয়ে ক্লান্ত হাতে মাথার তালুতে সংঘর্ষ চালাতে ব্যস্ত নির্বাণ। শ্যামবর্ণ মুখশ্রীটি প্রায় পাংশুটে, নয়ন যুগল তার মাত্রাতিরিক্ত লাল। খয়েরী অধর দু’টি চেপে ধরে আছে, কদাচিৎ নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। লোকটার যে ইতিমধ্যে ঠান্ডা লেগে গিয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্পর্শী বুঝতে পারলো না, এই অবেলার বৃষ্টি মুখোর রাতে এইখানে আসার মানেটা কি? সে সাথে, কতক্ষণ ধরে যে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টিতে ভিজেছে কে জানে? উপরোক্ত প্রশ্নগুলো করার অবকাশ পায়নি সে। তখন নির্বাণকে দেখা মাত্র স্পর্শী ঝটপট বাসা থেকে নেমে পড়েছিল। নির্বাণের নিকট আসামাত্র তার রক্তহীন,ফ্যাকাশে মুখ-চোখ দেখে স্পর্শীর বক্ষপিঞ্জরের বন্দী যন্ত্রটা ছ্যাৎ করে উঠে। বৃষ্টি বেগ তখনও নিরলস। ক্ষান্ত হওয়ার কোন নাম-গন্ধ নেই। স্পর্শী কোনপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে নির্বাণকে টেনে বাসার ভিতর নিয়ে আসে। অতঃপর বাসায় এসে এইটা বলে সামাল দেয় যে, নির্বাণ কোন এক কাজে সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল। কিন্তু পরে ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য আঁটকে যায়। তার উপর, সামনের দিকে রাস্তা ব্লকড থাকায় বাসায়ও যেতে পারছিল না। নির্বাণর যেখানে ছিল সেখান থেকে তার বাসা কাছে ছিল তাই সে তাকে বাসায় আসতে বলেছে। নির্বাণ প্রথমে আসতে না চাইলেও তার জোড়াজুড়িতে এসেছে। আর বাসার ভিতর ঢুকতে ঢুকতেই সে পুরো ভিজে গিয়েছে। তবে, সকলে স্পর্শীর বানোয়াট কাহিনিতে এত একটা ধ্যান দেয়নি। নির্বাণকে দেখামাত্রই তারা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল ঘরের জামাইকে আপ্যায়ন করতে। সাহেলার তো উৎকন্ঠার শেষ নেই। বিয়ের পর এই প্রথম জামাই এসেছে, কিন্তু বাসায় ভালো-মন্দ তেমন কিছুই নে। এই রাতে কি করবেন, কি খেতে দিবেন তা নিয়ে তার ঢেড় মাথাব্যথা। মিজান সাহেব তাড়া দিলেন, দুইজনকে দ্রুত রুমে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। স্পর্শী কথামতো তাই করলো। নির্বাণের ফ্রেশ হওয়ার সকল প্রকার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজেও জামা বদলে নিল। তারপর, ছুটলো রান্নাঘরের দিকে। তবে অবাক করার বিষয় হলো, নির্বাণ পুরোটা সময়ই নির্বাক,শান্ত ছিল। দরকার ব্যতীত সামান্য শব্দও অপচয় করেনি সে। নির্বাণের এমন ব্যবহার স্পর্শীকে বেশ ভাবায় কিন্তু সেটা নিয়ে সে ঘাটে না তেমন। পরবর্তীতে শান্তিপূর্ণ ভাবে কথা বলে নিবে এইভেবে।

স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেললো, হাতে থাকা রঙ চায়ের পেয়ালাটি বেড সাইড টেবিলে রেখে নির্বাণের হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে নিজেই ভালোমত মাথা মুছে দিতে থাকলো। কন্ঠে তিক্ততা মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এতরাতে এইখানে আসার মানে কি? আর এসেছেন ভালো কথা, কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজা কি আবশ্যক ছিল? লাগলো তো এখন ঠান্ডা।”

স্পর্শীর কথা শেষ হতে না হলে নির্বাণ স্পর্শীর কব্জি ধরে টান দিল। রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর চোখে চোখ রেখে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্পর্শী বিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে নির্বাণের কাঁধে হাত রাখলো। নির্বাণ জিজ্ঞেস করে, “ফোন ব্যস্ত থাকে কেন তোমার? এত কিসের কথা?”

অগ্নিময় চাহনির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা শীতল উপলব্ধি করতে পেরে স্পর্শী ঈষৎ কেঁপে উঠলো। পরক্ষণে ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলল, “ফোন আমার ব্যস্ত থাকে নাকি আপনার? অযথা মিথ্যা আরোপ আমার উপর জারি করবেন না।”

মুহূর্তে নির্বাণের কপালে তিনটি রেখার সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো, “মানে?”

“মানে যা তাই। এসেছেন কেন আপনি এইখানে?”

স্পর্শীর কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাণের শাণিত কন্ঠ, “কথা ঘুরাবে না। ঠিক কি বুঝাতে চেয়েছ তা বল।”

“এইটাই যে, ফোন আমার না আপনার ব্যস্ত ছিল। রাতে আমি অনেকবার ফোন করেছি কিন্তু প্রতিবারই ব্যস্ত বলেছে সেটা।”

নির্বাণের কপালের ভাঁজ তীব্র হলো। স্পর্শী তা দেখে নির্বাণের হাতের মুঠো হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সটান হয়ে দাঁড়ালো। বিছানার উপর থেকে মুঠোফোনটা তুলে নিয়ে কললিস্ট বের করে দেখালো নির্বাণকে, “দেখেন!”

নির্বাণ নীরব রইলো। অতঃপর বলল, “কল তো আমিও করেছিলাম….”

কথাটা সম্পূর্ণ করলো না নির্বাণ। কথা শেষ করার পূর্বেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। স্পর্শী চোখ পিটপিট করলো। অতঃপর ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে বলল, “তার মানে আপনি আর আমি ঠিক একই সময় দুইজন দুইজনকে ফোন করেছিলাম?”

নির্বাণ ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। স্পর্শী নিজের কপাল চাপড়ালো, তার কিছু বলার ভাষা নেই৷ এমন কাকতালীয়তাও যে হয় সে-টা তার জানা ছিল না। স্পর্শী মাথা তুললো, “তাহলে এইখানের আসার কারণটা?”

“বউ নিরুদ্দেশ হলো কি-না দেখতে এসেছিলাম।”

নির্বাণ সহজ স্বীকারোক্তি। স্পর্শী এক মিনিটের জন্য থমকালো, নেত্রপল্লব ফেললো বার কয়েক। নির্বাণ টেবিলের উপর থেকে অর্ধ-ঠান্ডা চায়ের পেয়ালাটা হাতে নিয়ে চারদিকে একবার নজর বুলাই, “তুমি এত আগোছালো কেন? রুমের কি হাল করে রেখেছ।”

নির্বাণের কথা শুনে স্পর্শী চারপাশে তাকালো। তখন পেন্টিং করে উঠার পর আর জিনিসপত্র গোছগাছ করা হয়নি। আলসামিতে ধরেছিল। স্পর্শী লজ্জাবোধ করলো, নিজের দোষ ঢাকতে বললো, “আমার রুম আমি যেমন ইচ্ছা তেমন রাখতেই পারি। আপনার কি?”

“আমি আমার বউকে বলছি তোমার কি?”

কথাটা বলে নির্বাণ দাঁড়ালো। তখনই দরজার পিছনে ঠেস দিয়ে রাখা অর্ধেক সম্পূর্ণ একটি স্কেচের দিকে তার নজর গেল। কিঞ্চিৎ মুহূর্তও লাগলো না তার বুঝে উঠতে স্কেচটি কার। বিস্ময় না হয়ে পারলো না, কিয়ৎকাল পর ঠোঁটের কর্ণদ্বয়ে ভীড় করলো এক সুক্ষ্ম হাসির রেখা। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলল না সে। স্পর্শী তখনই রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠে, “আপনার বউ মানে তো আমিই নাকি?”

নির্বাণ দৃষ্টি ঘুরালো, “কি জানি।”

কথাটা বলে নির্বাণ ড্রয়িংরুমের দিকে চলে গেল। নির্বাণের এমন হেয়ালি কন্ঠে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকালো, ভিতরে ভিতরে ফোঁস করে উঠলো। কিন্তু পরমুহূর্তে নির্বাণের ‘বউ’ সম্মোধনের কথা মনে পড়তেই এক রাশ মুগ্ধতা বিরাজ করলো মনের কোণে।

________________

রুমে নীলাভ রঙের বাতিটি জ্বালিয়ে দিয়ে স্পর্শী নির্বাণের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ক্ষণে শীতল শরীরের সংস্পর্শে তীব্র উত্তাপ অনুভব করতেই পাশ ফিরলো সে। শোয়া থেকে আধশোয়া হয়ে উঠে বসে সে, চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত ছোঁয়ায় নির্বাণের গালে,কপালে। গা বেশ গরম, জ্বর উঠছে। স্পর্শী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো, সে নির্বাণের হাবভাব দেখে আগেই বুঝেছিল রাতে জ্বর আসবে তার। তাই খাবারের টেবিলে সে বার বার বলেছিল নির্বাণকে প্যারাসিটামল খেয়ে নিতে। নির্বাণ শুনেনি। মানুষটা বড্ড একঘেয়ে।
কারো শীতল হাতের ছোঁয়া পেতেই নির্বাণ চোখ খুলে তাকায়। চোখাচোখি দুইজনের। স্পর্শী শাণিত কন্ঠে বলে, “বলেছিলাম না তখন ঔষধ খেতে, খেলেন না। দেখেন এইবার জ্বর এলো তো। কি হতো আমার কথা শুনলে?”

নির্বাণ নিরুত্তর রইলো। গভীর দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর চিবুকের উপরে। স্পর্শী প্রখর কন্ঠে আরও কিছু কড়া কথা শুনাতে যাচ্ছিল কিন্তু তার পূর্বেই নির্বাণ তার হাতের তর্জনী উঁচিয়ে ধরে স্পর্শীর অধরের মাঝ বরাবর চেপে ধরে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলো, “হুসস! কোন কথা না।”

স্পর্শী থমকালো, পিটপিট করে তাকালো। পরমুহূর্তেই নির্বাণের গভীর দৃষ্টির ফাঁদে বাঁধা পড়লো সে। দুইজনের মধ্যকার দূরত্ব একবারেই ক্ষীণ। নির্বাণের অবাধ্য আঙুলের ডগা কিয়ৎক্ষণ বিচরণ করলো স্পর্শীর অধরের চারপাশে। তপ্ত সেই স্পর্শ। হঠাৎ কি হলো কে জানে, চোখের পলকেই নির্বাণ স্পর্শীর হাত ধরে টেনে তাকে নিজের উপর ফেলে। স্পর্শীর গলদেশে হাত গলিয়ে সন্তর্পণে স্পর্শীর অধরে নিজের অধর ছুঁয়ে দেয়। কাল ক্রমে স্পর্শী অবাক হওয়াও যেন ভুলে গেল। বিবশ,ব্যগ্র,বিমূঢ় অনুভব সব মিশ্রিত হওয়া মাত্র স্পর্শ নিবিড় হলো। ক্ষণেই নেত্রপল্লব বন্ধ হয়ে এলো তার। কিয়ৎকাল পর নির্বাণ সরে আসতেই স্পর্শী লম্বা নিঃশ্বাস নিল। লজ্জায় চোখ তুলতে পারলো না ভুলেও৷ প্রথম প্রেমালিঙ্গণ, প্রেমানুভূতি, প্রথম স্পর্শানুভূতি যে তীক্ষ্ণ, প্রখর,শাণিত হয় তা স্পর্শী জানা ছিল না। নির্বাণ স্পর্শীর মুখপানে তাকালো, নীল রাঙ্গা আলোয় স্পর্শীর রক্তিম মুখটি স্পষ্ট ঝলঝল করছে। নির্বাণ বেসামাল হলো। নিভৃতেই মুখ গুঁজলো স্পর্শীর গলদেশে। মুহূর্তে গাঢ় প্রণয়ের লালাভ স্পর্শ স্থাপন করলো সেখানে।

________________

আকাশটা আজ ধোয়াটে৷ কৃষ্ণ মেঘে আবৃত আকাশ। কাঁদা মাখো রাস্তাঘাট জানান দিচ্ছে বর্ষা এসে গিয়েছে। ক্ষণেই দমকা হাওয়ার দল এসে মাটিতে পড়ে থাকা স্পর্শীর ওড়নার শেষাংশটুকু শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। স্পর্শী দ্রুতগামী হাতে ওড়নাটা হাতে পুরে নিয়ে অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় কলাভবণের বারান্দার দিকে। সেখানে স্পষ্ট দুইজন ব্যক্তিকে একত্রে হাসতে এবং কথা বলতে দেখা যাচ্ছে৷ মাঝে মধ্যে হাঁটা থামিয়ে কিছু আলাপ-আলোচনাও করছে। তাদের এমন ভাব স্পর্শীর সহ্য হলো না। মনে ঈর্ষার আগুন জ্বলে উঠলো। সে দৃষ্টি সরাতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। বারংবার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো সেখানেই। সপ্তাহখানেক হতে চললো নির্বাণ কাজের অজুহাতে এদিক-সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। দু’মিনিট কথা বলারও অবকাশ নেই স্পর্শীর সাথে। অথচ এখন দেখো, ঠিকই তাপসি মিসের সাথে কিভাবে হেসে-খেলে কথা বলছে সে। রাগ হলো স্পর্শীর, তার চেয়ে বেশি অভিমান। সময় যত গড়ালো অভিমানের পাল্লা যেন ভারী হলো। মানুষটার আশেপাশে কেন শত মাইল দূরেও কোন অবস্থান করুক সেটা তার বোধগম্য নয়। অকস্মাৎ পাশ থেকে নিধি বলে উঠে,

“শুনলাম, তাপসি ম্যামের বিয়ে সামনে।”

স্পর্শী দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিধির দিকে তাকালো। পাশ থেকেই মাহিন গরম গরম সিঙ্গারায় একটা কামড় বসিয়ে বলল, “হ্যাঁ, শুনলাম তো। কিন্তু আমার না তার বরকে দেখার খুব ইচ্ছা। আমি দেখতে চাই কোন হতভাগার কপাল ফাটলো।”

সামি হেসে বলে, “যারই ফাটসে, সে যে সারাজীবন কেঁদে কূল পাবে না তা নিশ্চিত।”

কেয়া সন্দিহান কন্ঠে বলে, “আমার না সন্দেহ হচ্ছে। তাপসি ম্যামের বর আমাদের নির্বাণ স্যার না-তো? কয়েকদিন যাবৎ ধরে তাদের একসাথে বেশি দেখা যাচ্ছে। আর আমার জানা মতে, নির্বাণ স্যার এখনও ব্যাচেলর-ই। চান্স আছে!”

নিধির কৌতূহলী কন্ঠ, “হলে হতেও পারে। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ রহস্যময়ী। তবে, দুইজনের বিয়ে হলে একদম ফাস্টক্লাস হবে৷ হিটলারের ভাগ্যে হিটলারই জুটবে।”

নিধির শেষ উক্তিটি শুনে স্পর্শীর মেজাজ বিগড়ে গেল। সে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “সারাক্ষণ আজাইরা প্যাচাল না পারলে হয়-না তোর? কার সাথে কার জোড়া লাগাস তুই?”

নিধি অবাক হয়ে বলে, “আরেহ ভাই, এত রাগতাছিস কেন তুই? এইখানে রাগার কি-বাই আছে? মজা করছি সকলে।”

স্পর্শী কপট রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়ালো, “রাগ হওয়ার মত কথা বললে রাগবো না-তো কি লুঙ্গি ডান্স দিব? পরবর্তীতে আমার সামনে এইসব আজেবাজে কথা বলবি না। এন্ড ফর ইয়্যুর কাইন্ড ইনফরমেশন, নির্বাণ স্যার অলরেডি মেরিড। তার বউ আছে।”

অতঃপর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে নিজের ব্যাগ কাঁধে চেপে লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের ক্লাসের দিকে চলে। আপাতত, মেজাজ তার আগ্নেয়গিরিত উচ্চতর মাত্রার উত্তাপে তপ্ত হয়ে আছে৷ কখন যে কে এর বিস্ফোরণের স্বীকার হবে কে জানে?

_______________

ক্লাস শেষ হতে হতে আকাশ বুক চিরে আবির্ভাব হলো এক পশলা বৃষ্টির। প্রকৃতি মেতে উঠলো বৃষ্টিস্নাতে। স্পর্শী হাতের মুঠোয় ছাতা চেপে ধরে দাঁড়ালো কাঁদা-পানি বিশিষ্ট স্যাঁতসেঁতে রাস্তার ধারে। খোঁজ করলো রিকশার। কিন্তু পেল না একটাও। যাও দুই- একটা রিকশা পেয়েছিল, সেটার মধ্যে একজন ভাড়া চাচ্ছিল আকাশ সমান। আরেকজন যাবে না। স্পর্শী ভীষণ বিরক্ত হলো, অবশেষে না ধৈর্য্যে কুলাতে না পেরে হাঁটা দেয় সামনের দিকে। পাঁচ মিনিটের পথ হাঁটার পর পরই স্পর্শীর পাশে এসে একটি গাড়ি দাঁড়ায়। স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, কালো রঙের গাড়িটিতে একবার নজর বুলিয়ে পুনরায় হাঁটা দেয়। গাড়িটি পিছন থেকে দুই-তিনবার হর্ণ বাজায়। কিন্তু স্পর্শী সেটা আমলে নেয় না। আবার হর্ণ বাজাতেই স্পর্শী থামে, ক্ষিপ্ত হয়ে পিছন ফিরে তাকায়। কিছু বলার পূর্বেই গাড়ির দরজা খুলে নির্বাণ নেমে আসে। বৃষ্টির শৈথিল্য ভেজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৃষ্ণমানবটির আয়রন করা সবুজাভ শার্টটি। নির্বাণ স্পর্শীর কাছে এসে ওর হাত চেপে ধরে বলে, “গাড়িতে উঠো।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৪

“গাড়িতে উঠো।”

স্পর্শী একবার অভিমানী দৃষ্টিতে নির্বাণের পানে তাকালো। বৃষ্টির বেগ খানিকটা তীব্র দেখে নিভৃতে ধরে থাকা ছাতাটা কিছুটা হেলিয়ে দিল নির্বাণের দিকে। অতঃপর খুব সতর্কতার সাথে নির্বাণের হাতের মুঠো হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি একা যেতে পারবো, আপনি যান।”

স্পর্শীর কর্মকাণ্ড দেখে নির্বাণের ভ্রু কুঁচকে এলো। হাতের বন্ধন দৃঢ় করে অধিকার সহিত কন্ঠে বলে, “স্পর্শী, উঠতে বলেছি না আমি তোমাকে?”

স্পর্শী চারপাশে একবার তাকালো, রাস্তায় মানুষজনের খুব কম আনাগোনা। তাদেরকে কেউ সে-রকমভাবে পরোক্ষ করছে না। কিন্তু তবুও, যদি ভার্সিটির কেউ যাতায়াতের সময় তাদেরকে একসাথে দেখে ফেলে তাহলে বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার-স্যাপার ঘটে যাবে৷ স্পর্শী সেই ভীতি নিয়েই কোন দ্বিরুক্তি না করে নির্বাণের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। মৌনতা বুঝিয়ে রেখে নিজেই নিজের সিটবেলটা লাগিয়ে নিল, নির্বাণকে সুযোগ দিল না তার কাছে ঘেঁষবারও। কিন্তু নির্বাণ কি আর দমবার পাত্র? সে গাড়িতে উঠা-মাত্র স্পর্শীর একপ্রান্তে ঝুলতে থাকা ওড়না টেনে নিয়ে নিজের আর্দ্র মাথা মুছতে উদ্যোগী হলো। স্পর্শী এক মুহূর্তের জন্য ভড়কে গেল, নয়ন যুগল বৃহৎ করে তাকালো। তবে টু শব্দ পর্যন্ত করলো না, নির্বিকার থেকে দেখে গেল সব। নির্বাণ নিজের কার্য শেষ করে সোজা তাকালো স্পর্শীর পাংশুটে মুখের দিকে। সে বেশ বুঝলো স্পর্শী তার উপর রাগান্বিত, কিন্তু ঠিক কোন কারণে সে-টা ধরতে পারলো না। নির্বাণ গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? এমন গাল ফুলিয়ে বসে আছো কেন?”

স্পর্শী নিজের ওড়না ঠিক করে পড়ে যাওয়া ঘোমটা পুনরায় মাথায় তুললো। নির্বাণের কথা সম্পূর্ণ অনাগ্রহ করে হেয়ালি দৃষ্টিতে তাকালো বদ্ধ জানালার বাহিরে৷ নির্বাণ স্পর্শীর কাণ্ডকারখানা দেখে স্পর্শীর চিবুকটি চেপে ধরে মুখটা নিজের দিকে ঘুরায়, “রাগ করে আছো কেন?”

স্পর্শী তবুও কথা বলল না। নির্বাণ ধৈর্য সহিত চিবুক হতে হাত সরিয়ে ধীর গতিতে কানের পৃষ্ঠে স্পর্শীর এলোকেশী গুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “কি কথা বলবে না?”

স্পর্শী এইবারও কিছুই বলল না। নির্বাণ বুঝলো, স্পর্শীর পেটে এখন বোমা ফেলেও কথা বের করানো যাবে না। মেয়েটা প্রচন্ড মাত্রায় রেগে আছে। তবে এইটা রাগ নাকি অভিমান সেই তফাৎ-টা নির্বাণ জানে না। তবে, আপাতত নীরব থাকাই শ্রেয়। তাই সে কথা দীর্ঘ না করে গাড়ি স্টার্ট দিতে মনোযোগী হলো। গাড়ি স্টার্ট হতেই স্পর্শী আড়চোখে একবার নির্বাণের দিকে তাকালো। নির্বাণের নীরবতা মুহূর্তেই স্পর্শীর রাগ দ্বি-গুণ বাড়িয়ে দিল। সে মুখ ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলো।

কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে বৃষ্টির বেগ তীব্র হতে তীব্রতর হলো। রাস্তা-ঘাট হলো ঘোলাটে,ধোঁয়াশে৷ এর মাঝে গাড়ি চালানো বিপদজনক বলে নির্বাণ কিছু দূর গিয়ে নীরব পরিবেশের সন্ধান পেতেই রাস্তার ধারে গাড়ি থামালো৷ অতঃপর তাকালো স্পর্শীর পানে, স্পর্শী তখনও শ্যামল ধরণীর বৃষ্টিস্নাত দেখতে বিভোর। মন নেই তার অন্য কোথায়। নির্বাণ বেশ কিছু মুহূর্ত নীরব থেকে স্পর্শীর বাহু ধরে টেনে নিজের দিকে টেনে ঘুরালো, “আর কতক্ষণ চুপ থাকবে? এত রাগ কিসের উপর শুনি?”

স্পর্শী চোখ তুলে তাকালো, দৃষ্টি তার অভিমানের কালো মেঘে ঢাকা। নির্বাণ বলল, “আচ্ছা, তুমি কি চাইছো আমি তোমার রাগ ভাঙ্গাতে কিছু করি? যদিও রাস্তায় সেসব সম্ভব না, তবে চুমু চলবে?”

নির্বাণের বেসামাল কথা শুনে স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসে, সে চোখ পাকিয়ে তাকায় নির্বাণের পানে। মানুষটা সেই রাতের পর থেকেই কেমন নির্লজ্জ,বেসামাল হয়ে উঠেছে। কথার লাগাম বলেও যে কিছু সে-টা যেন একদম খেয়ে-দেয়ে হজম করে বসে আছে।
স্পর্শীর রক্তিম মুখশ্রী দেখে নির্বাণ এইবার নিজের সিটবেল খুলে সত্যি সত্যি কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়লো স্পর্শীর দিকে, তা দেখে স্পর্শী দ্রুত অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। বিরবির করে বলল, “এখন আমার কাছে আসছেন কেন? তাপসি ম্যামের কাছে যান।”

কথাটা শুনে নির্বাণ থমকালো। মুহুর্তেই কপালে তিনটি ভাঁজ ফেলে বলল, “তার কাছে কেন যাব?”

স্পর্শী অন্য পার্শ্বেই মুখ ফিরিয়ে রেখে উত্তর দিল, “যেখানে আপনার পুরো সময় তার জন্যই নির্ধারিত সেখানে তার কাছেই যাওয়ার কথা নয় কি?”

কথাটা শুনে নির্বাণ স্তম্ভিত হয়ে তাকালো, “কি বলছ এইসব? আমার সময় তার জন্য নির্ধারিত হতে যাবে কেন?”

স্পর্শীর খাপছাড়া কন্ঠে বলল, “হবে না কেন? তার সাথেই তো আপনার উঠা-বসা, হাসি-তামাশা। আজকেও তো দেখলাম, কলা ভবনের নিচে কি সুন্দর হেসে-খেলে কথা বলছেন।”

নির্বাণ এক মুহূর্তে জন্য থমকালো, ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর কিছু একটা সরু হাসি হেসে বলে, “তাতে সমস্যা কোথায়? খারাপ কিছু তো করছিলাম না।”

স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, “নাহ, সমস্যা হবে কেন? যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে কথা বলেন, আমার কি?”

নির্বাণ মিহি হাসে, “তুমি কি আমাকে নিয়ে জেলাস ফিল করছো?”

“করলেও কি? আপনার এতে কিছু যায় আসে? বউয়ের সাথে দুই মিনিট কথা বলার সুযোগ পান না অথচ বাহির মানুষের সাথে কথা বলার ঠিকই সময় আছে আপনার। বউকে তো এখন আর ভাল্লাগেনা।”

“বউ বুঝি আমার সাথে কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে আছে? কই দিনে তো একবারও ফোন পাই না আমি তার কাছ থেকে।”

“ফোন বন্ধ থাকলে মানুষ কিভাবে বুঝবে কেউ আদৌ তাকে ফোন করেছিল কি-না? আর এমনেও আপনার মনযোগ অন্যতে সীমাবদ্ধ, আমাকে নিয়ে ভাবার সময় আছে আপনার?”

নির্বাণের সহজ স্বীকারোক্তি, “না নেই।”

স্পর্শী থমকালো, মিনিটের ব্যবধানে দৃষ্টি নম হয়ে এলো তার। অভিমানের প্রখর পরিশুদ্ধ বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠে মন। মুখ গুড়িয়ে সে দৃষ্টি বাহিরে স্থাপন করে। নির্বাণ হেসে স্পর্শীর বাম গালে হাত গলিয়ে দিয়ে নিজের দিকে ফিরায়, মন্থর কন্ঠে বলে,

“ভাবার সময় তো তখন পাবো যখন তুমি আমার ভাবনা থেকে দূরে যাবে৷ তোমাকে নিয়ে আমার কত দুশ্চিন্তা, জানো? তুমি চলাফেরা করো বড্ড হেয়ালিতে, এই যে পরশুদিন পেঁয়াজ কাঁটতে গিয়ে নিজের হাত কেঁটে ফেলেছ। আবার সেদিন, রিকশাতে উঠার সময় হাটুতে ব্যথা পেয়েছ। এতে আমি কতটা ব্যথিত হয়েছিল সেই খবর আছে? আবার কখন যে কি করে বসো সেই নিয়ে আশঙ্কায় থাকি আমি।”

নির্বাণ এইসব খবর কিভাবে জানে সেই কথাটা স্পর্শীর খেয়ালে এলো না। সে অভিমানে রেশ ধরেই একঘেয়ে কন্ঠে বলল, “আমাকে নিয়ে না ভাবলেই তো হয়, এত চিন্তার মানে হয় না।”

“মানে আছে কি-না জানি না তবে, তোমাকে নিয়ে আমার ভাবনার শেষ নেই। হোক সেটা ক্ষুদ্র বিষয়েও। আর আমার জীবনে এক নারী-ই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, আর সে-টা হচ্ছ তুমি। তোমার ইনসিকিউরড ফিল করার কোন দরকার নেই, আমি তোমারই।”

স্পর্শী তাও গললো না, স্থির বসে থাকলো। আজ যেন নির্বাণের কথা তার অন্তঃকরণ স্পর্শই করতে পারছে না। নির্বাণ বুঝলো স্পর্শীকে সব ব্যাখ্যা না করা পর্যন্ত সে গলবে না। বুঝবে না পরিস্থিতি। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পিছনের সিট থেকে একটা শপিং ব্যাগ টেনে সামনে আনে। ভিতর থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করে স্পর্শীর দিকে এগিয়ে দেয়,

“তখন মিস. তাপসি আমাকে তার বিয়েতে আমন্ত্রণ করছিল, ভদ্রতাসূচক তাকে নতুন জীবনের জন্যই শুভকামনা জানাচ্ছিলাম আমি। আর কিছুই না, সেচ্ছায় কথা বলতে যায়নি আমি। আর, আমি সত্যি ব্যস্ত ছিলাম এই কয়েকদিন, রেস্টুরেন্টের জায়গায় নিয়ে কিছু ইস্যু হয়েছিল তাই সেটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ির উপর থাকতে হয়েছে আমাকে। তাই তোমার সাথে তেমন একটা যোগাযোগ রাখতে পারিনি।”

স্পর্শী আড়চোখে বিয়ের কার্ডটার দিকে তাকালো, মুহুর্তে রাগটা পড়ে গেল জমিনে। অভিমানী মেঘগুলো সরে গেল নিভৃতে। স্পর্শী বলল, “সে-টা আগে বললেই হতো।”

নির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কার্ডটা পুনরায় ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে সেটা পিছনের সিটে রেখে দিতে দিতে বলল, “তুমি যে এত হিংসুটে আমার জানা ছিল না। দিনকার দিন তোমার আর কত রূপ যে দেখবো।”

স্পর্শী নাক ফুলিয়ে বলে, “বেশ! তবে, আজ যদি আমাকে কোন ছেলের সাথে হেসে-খেলে বেড়াতে দেখতেন তখন আপনি কি করতেন শুনি? তার সাথে আমার বিয়ে পড়িয়ে দিতেন?”

নির্বাণ স্পর্শীর সান্নিধ্যে এসে তার কানের কাছে মুখ স্থির করে বলে, “কি করতাম তখন-ই না-হয় দেখ। তবে, আমাকে ভালো মনে করো না। আমি কিন্তু তোমার ভাবনার চাইতেও বেশি খারাপ একজন কেউ।”

______________

সময় গড়ালো প্রবাহমান স্রোতের ন্যায়৷ দিন, কাল পেরিয়ে নতুন মাসের আর্বিভাবের সাথে আগমন হলো রমজান মাসের। পরিবেশটা হলো অন্যরকম, নিয়নসূচি বদলালো সকলের। ছাত্র-ছাত্রীদের ছুটির মৌসুম চলায় তাদের সময় যেন আরামেই যেতে শুরু করলো। রহমতের সপ্তম দিন শেষ হওয়ার মাত্র পরেরদিন স্পর্শীর বাসা থেকে ইফতারের দাওয়াত এলো নির্বাণদের জন্য। অবসর থাকায় নির্বাণ এবং কেউ-ই সেই দাওয়াত নাকচ করেনি।

সকাল থেকেই সাহেলা প্রচন্ড ব্যস্ত। একা হাতে সব সামলাতে না পেরে নিজের সাথে দুই মেয়েকেও কাজে লাগিয়েছেন তিনি। এক সময়, স্পৃহা কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে চেঁচামেচি শুরু করে। কিন্তু পরক্ষণেই সাহেলার জোরদার ধমক খেয়ে চুপ বনে যায়, নীরব মনে কাজ করতে থাকে। অন্যদিকে, স্পর্শী কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে হাঁসফাঁস করে উঠছে। তলপেটের ডান দিকটায় চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার, তবে তা সহ্যনীয়। গ্যাস্টিকের ব্যথা ভেবে স্পর্শী বিষয়টা আমলে নেয় না, নিজ মনে কাজ করতে থাকে। এমন ব্যথা প্রায়শই উঠে তার।
নির্বাণরা আসে বিকেলের দিকে। কথায় কথায় সন্ধ্যা নেমে আসতেই টেবিলে এসে বসে সকলে। স্পৃহা আর স্পর্শী ধীরে ধীরে টেবিল সাজাচ্ছে। নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকালো, মুখটা কেমন নির্জীব, রক্তশূণ্য দেখাচ্ছে। চোখে-মুখে কেমন ব্যাথাতুরে ছাপ। স্পর্শীকে দেখামাত্র সর্বপ্রথম নির্বাণের মাথায় এইটায় এলো, “মেয়েটাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ও কি অসুস্থ?”
এইদিকে, স্পর্শী তলপেটের ব্যথা যেন সময় গড়ানোর সাথে সাথে বিস্তার পাচ্ছে। ব্যথায় মরে যাচ্ছে এমন এক দশা, কিন্তু ব্যথাটা কিসের সে-টা সনাক্ত করতে পারলো না স্পর্শী। তবে, স্বাভাবিকভাবে প্রতি মাসে নিয়মমাফিক যে ব্যথা উঠে এইটা সে ব্যথা না। গ্যাস্টিকের ব্যথাও এত তীব্র হয় না। কিছুটা আশঙ্কা হলো তার বটে, কিন্তু তবুও কাউকে সে খবরের সন্ধান না দিয়ে সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সকল কাজ করেই গেল। কেউ আর ধরতেও পারলো না তার ভিতরকার অবস্থা। অবশেষে মাগরিবের আযান পড়তেই সকলে ইফতারের জন্য উদ্যোগী হয়। সবাইকে খাবার পরিবেশন করে স্পর্শী নিজেও বসে,দোয়া পড়ে খেজুর হাতে নেয়। তাতে ছোট এক কামড় বসানো মাত্র ব্যথাটা সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়। চেয়েও নিজের আর্তনাদ চেপে রাখতে পারলো না আর সে, নিজের পেট জড়িয়ে ধরে তীব্র সরে চেঁচিয়ে উঠলো সে। নির্বাণ তখন শরবতটা অর্ধেক শেষ করেছিল মাত্র, এর মাঝেই স্পর্শী আর্তনাদ শুনে থমকে যায় সে। হতভম্ব হয়ে তাকায় স্পর্শীর পানে। স্পর্শী নিজের ভারসাম্য রাখতে না পেরে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে নিলে নির্বাণ দ্রুত এসে ওকে নিজের বুকের সাথে ঠেস দিয়ে ধরে। স্পর্শীর লাল হয়ে আসা মুখে আলতো ভাবে হাত রেখে ব্যাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করতে থাকে, “কি হয়েছে, স্পর্শী? এইভাবে চিল্লালে কে?কোথাও কি সমস্যা হচ্ছে তোমার? এই স্পর্শী তাকাও আমার দিকে, বল।” কিন্তু ব্যথার তাড়নায় জবাব দিতে পারলো না স্পর্শী। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো সে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই পরিবেশটা যেতে শুরু করে প্রতিকূলে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here