চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -১৭+১৮+১৯+২০

##চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৭

বিয়ের কার্যক্রম শেষ করে ফিরতে ফিরতে স্পর্শীদের প্রায় রাত হয়ে যায়। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা আর কিঞ্চিৎ গুরুজনেরা আগে-ভাগেই এসে ঘরবাড়ি গুছিয়ে নববধূকে বরণ করার প্রস্তুতি নিয়ে নেন। অতঃপর বাকিরা এসে পৌঁছাতেই বরণ করা হয় বর ও নববধূকে। আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি মেনে বধূকে বসিয়ে আসা হয় ফুলে সজ্জিত রুমে। সকলে কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টা করে চলে আসে বাহিরে। মাহিনকে হেনেস্তা করতে তার আসার পূর্বেই দরজার সামনে গোল হয়ে দাঁড়ায় সকলে। স্পর্শী সেখান থেকে চলে আসতে চাইলেও নাহিদের জন্য পারে না। অগত্যা সকলের সাথে দরজা ধরে দাঁড়ায়। অনন্তর, মাহিনের দেখা মিলতেই সকলে হামলে পড়ে তার উপর। জানায়, মোটা অংকের টাকা না নিয়ে তারা কোনভাবেই তাকে ভিতরে ঢুকতে দিবে না। মাহিন প্রথমে রাজি না হলেও সকলের পীড়াপীড়িতে অবশেষে রাজি হয় টাকা দিতে। টাকা পাওয়া মাত্রই সকলে হৈ-হুল্লোড় করে দরজা ছেড়ে দেয়। সকলের উচ্ছাস দেখে মাহিন মুখ বাঁকিয়ে বলে,

“যত মজা করার করে নে। এই দিন ফুরিয়ে আমার দিনই আসবে। সেদিন আমিও বুঝাবো মজা।”

নাহিদ দাঁতের পাটি বের করে বিস্তৃত হেসে বলে, “আগে আসুক তোমার দিন, তারপর কথা বইলো। আমাদের দিনে তোমার কথা বলা সাজে না। এখন চুপচাপ বাসর ঘরে গিয়ে নিজের কাজ করো, যাও!”

মাহিন কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “আমার কথা বাদ দে। সামনে না নির্বাণের বিয়ে? নিজের ভাইয়ের থেকে চার আনা বের করতে পারোস কি-না দেখুম। যদি না পারসোস টাকা বের করতে, তোর একদিন কি আমার একদিন।”

নাহিদ ভাব নিয়ে বলে, “টাকা না দিলে ভাইয়ের বাসরই হইতে দিমু না আমি। ভাবীরে কিডন্যাপ করে হলেও টাকা হাতাবো আমি।”

মৃদুল বলে, “স্লোগান তাইলে কি হবে? টাকা দাও, বউ নাও নাকি বাসর করিতে হলে আমাদের দাবি মানতে হবে, কোনটা?”

স্লোগান শুনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠে। এদিকে, নির্বাণের নাম উঠতেই স্পর্শীর মেদুর গালে ছড়ায় রক্তিমা। মাথা নুইয়ে যায় লজ্জায়। ভাই একটা দুনিয়ার বদরাগী, আরেকটা পুরাই লাগামহীন। কাদের মাঝে যে চলে আসলো স্পর্শী, আল্লাহ মালুম। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

“মাহিন তুই এখনো বাহিরে কেন? আর কি নিয়ে মজা হচ্ছে?”

নির্বাণের কন্ঠস্বর সকলে সনাক্ত করতে পেরে মুহূর্তেই জমে যায়। তটস্থ হয়ে পিছনে ঘুরে তাকায় সকলে। নির্বাণের গাম্ভীর্য পূর্ণ অভিব্যক্তি দেখেই সকলেই ফাঁকা একটা ঢোক গিলে নেয়। এদিক, মাহিন নির্বাণকে দেখামাত্র চওড়া হাসি দেয়। মনে মনে নাহিদ এবং সকলকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটে নিয়ে বলে, “আরেহ তোর কথাই হচ্ছিল। ওরা বলছিল…”

চোখের পলকেই নাহিদ মাহিনের পেটে কুনোই দিয়ে আঘাত করে মাহিনকে অর্ধেক কথার মাঝেই থামিয়ে দেয়। মাহিন ব্যথায় পেট চেপে ধরে নাহিদের দিকে রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়। নাহিদ সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে কিঞ্চিৎ হেসে নির্বাণকে বলে,

“কিছু না ভাই। মাহিন ভাই আজাইরা প্যাচাল পারে খালি, আমরা তো শুধু তাকে বাসর ঘরে ঢুকাচ্ছিলাম। কি ঠিক না বল সবাই?”

বাকিদের দিকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে নাহিদ। পরক্ষণেই সকলে সেই কথায় সমর্থন জানায়। কেন না, এইখানে কম বেশি সকলেই নির্বাণের রাগ সম্পর্কে অবগত। নিজে বা অন্যকে নিয়ে কোন রকমের ব্যঙ্গার্থক উক্তি নির্বাণের পছন্দ নয়। একবার এক কাজিন মজার ছলেই নির্বাণকে নিয়ে মজা করেছিল, অতঃপর নির্বাণের ঝাড়ির বর্ষণেই তার একশো দুই ডিগ্রি জ্বর উঠে কুপোকাত অবস্থা। সেই থেকেই তারা কখনো নির্বাণের সামনে মজা করার দুঃসাহসিকতা করে না। তৎক্ষনাৎ সকলের এরূপ পরিবর্তনে স্পর্শী বেশ চমকায়। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে তাদের। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

“আচ্ছা! মাহিন তুই এখন ভিতরে যা আর বাকি সব নিজ নিজ রুমে যা।”

সকলে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়৷ মাহিন পুনরায় কিছু বলতে নিলে নাহিদ মাহিনকে ঠেলে রুমের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে চাপা কন্ঠে বলে, “প্রতিশোধ নিলে অন্যভাবে নাও। আমাদের বাঘের মুখে ফেলার ফন্দি আঁটছো কেন? এখন এদিক-সেদিক না দেখে সোজা মন দিয়ে বাসর করো, যাও!”

কথাটা বলেই নাহিদ কিঞ্চিৎ শব্দ করে দরজা আঁটকে দেয়। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নাহিদ সকলকে নিয়ে কেটে পড়ে। নির্বাণ এইবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর পানে, “রুমে চল।”

স্পর্শী মাথা দুলিয়ে পিছন পিছন যায় নির্বাণের। যাওয়ার মাঝে নির্বাণের ডাক পড়ে। নিলুফা ডাকছেন। নির্বাণ স্পর্শীকে রুমে যেতে বলে, চলে যায় নিলুফার রুমে। স্পর্শী রুমে এসে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়৷ আঁখিপল্লব ভর্তি নিদ্রা বিরাজমান। মিনিট দুই-এক না পেরুতেই চোখ লেগে আসে স্পর্শীর। বেশ কিছুক্ষণ পর তন্দ্রাঘোরেই অতি পরিচিত পুরুষালী কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পায় স্পর্শী। পিটপিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করে সে। আধ-নিভন্ত চোখে তাকায় সামনে, মুখের সামনে নির্বাণের প্রতিচ্ছবি দেখে মন্থন কন্ঠে বলে,

” কি হয়েছে? ঘুমাতে দিন না!”

“উঠো আগে! এইভাবে কেউ ঘুমায়? কিছুই তো চেঞ্জ করো নি। ফ্রেশ হয়ে তারপর ঘুমাও।”

স্পর্শী একরোখা কন্ঠে বলে, “আমি এইভাবেই ঘুমাবো।”

“উফফ! উঠো তো।”

নির্বাণ এক প্রকার টেনেই স্পর্শীকে উঠালো। স্পর্শী ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থায় নির্বাণের দিকে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো। নির্বাণ সেই দৃষ্টি আমলে না নিয়ে নিজ উদ্যোগেই একেক করে স্পর্শী গহনাগুলো খুলে দিল। অতঃপর ব্যাগ থেকে এক সেট জামা বের করে ধরিয়ে দিল স্পর্শীর হাতে। কিছুটা অসন্তোষজনক কন্ঠেই বলল, “এতটা পথ জার্নি করে এমন নোংরা অবস্থায় কিভাবে কেউ ঘুমাতে পারে? এখনই গিয়ে শাওয়ার নিবে তুমি, যাও।”

স্পর্শী অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে, “এইবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এত রাতে শাওয়ার?”

নির্বাণ কঠিনচিত্ত কন্ঠে বলে উঠে, “যা বলেছি তা করো, যাও। ধুলোমাখা শরীর নিয়ে আর যাই হোক তুমি আমার পাশে ঘুমাতে পারবে না।”

“আচ্ছা তাহলে আমি মায়ের রুমে যাচ্ছি। তার সাথেই ঘুমাবো আমি আজ।”

কথাটা বলে স্পর্শী দরজার দিকে যেতে নিলে নির্বাণ তার বাহু ধরে টান দেয়। স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “এক পাও যদি রুম থেকে বাহিরে যাওয়ার জন্য চালিয়েছ আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। ফ্রেশ হতে যাও এখনোই।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করতে চাইলো তবে নির্বাণের দৃঢ়ভাব দেখে দমে গেল। সেই সাথে খানিকটা অভিমান হলো নির্বাণের দৃঢ় ব্যবহারে। অগত্যা এক রাশ অভিমান নিয়েই চলে গেল ফ্রেশ হতে। স্পর্শী যেতেই নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর স্পর্শীর গহনা গুলো বিছানা থেকে তুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে, বিছানা ঝাঁট দিয়ে নিল। রুমে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে মেরে নিজে বেরিয়ে গেল রুম থেকে নিলুফার রুমের উদ্দেশ্যে। তার এখন আবার ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন।

স্পর্শী বেরিয়ে এসে সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখে ভ্রু কুঁচকালো। তবে, বিষয়টা এতটা আমলে নিল না। কোন রকম চুল মুছে দ্রুত গা এলিয়ে দিল বিছানায়। নিদ্রায় কাবু সে, নয়ন দুইটি নিমজ্জিত আঁধারে। স্পর্শী শুয়ে পড়তেই নির্বাণ রুমে এলো। প্রখর দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর দিকে। উল্টোমুখ করে শুয়ে আছে সে। চুল বেয়ে তার তখনও টপটপ করে পানি ঝড়ছে। ভিজে যাচ্ছে নীলাভে আবৃত বালিশ, বিছানা। সিক্ত জামা আড়ষ্টভাবে লেপ্টে আছে পিঠের সাথে। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। হাতে থাকা তোয়ালেটা নিয়ে এগিয়ে গেল স্পর্শীর দিকে। ফের টেনে উঠালো তাকে। স্পর্শী এইবার আকাশ ছুঁই ছুঁই রাগ নিয়ে বলল, “কি সমস্যা? বার বার আমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করছেন কেন? ঘুমাবো আমি।”

নির্বাণ চিন্তামগ্ন কন্ঠে বলে, “মাথা মুছোনি কেন ঠিক মত? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”

স্পর্শী নির্বাণের কথা অগ্রাহ্য করতে চাইলে নির্বাণ স্পর্শীকে নিজের বুকের সাথে ঠেশ্ দিয়ে ধরে। খুব সপ্তপর্ণে চুলগুলো মুছে দিতে থাকে। ঘুমের তাড়নায় স্পর্শীও নিভৃতে গুটিয়ে আসে নির্বাণের দিকে। ক্লান্ত থাকায় ঘুমন্ত কুমারী সে অবস্থাতেই পাড়ি জমায় বিভোর রাজ্যে। নির্বাণ বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারলো আরও পরে। স্পর্শীকে এইভাবে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে নির্বাণ স্বল্প প্রশস্তে হেসে বলে, “মেয়েটা এত ঘুমকাতুরে কেন?”

___________________

মেহেদী রাঙ্গা বিকেলের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি ছোট দিঘির বুকে। মৃদু বাতাসের দোলে কম্পিত আকাশ। দিঘির ঠিক পূবদিকে পদ্ম গাছের কচি লতা-পাতা ছড়িয়ে আছে বিশৃঙ্খলভাবে। বর্ষার আগমনে দেরি বলে অভিমানী ফুল ফুটেনি এখনো। সকালে কালবৈশাখি ঝড়ে আগমন হওয়ায় বাতাসে এখনো কাঁচা মাটি ও বুনোফুলের সুবাস বিদ্যমান। দিঘির পাড়ে বসেই পড়ন্ত বিকেলের অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করছে এক দল কিশোরী। তার মধ্যে স্পর্শীও অন্তর্ভুক্ত। নিবার্ণের কাজিনদের সাথেই এইদিকটায় আসা তার। জায়গায়টা কোলাহলমুক্ত হওয়ায় সেখানেই জমে গেল আড্ডা৷ অকস্মাৎ স্পর্শীর ইচ্ছে হলো দিঘির জলে পা ভেজাতে। নিজের ইচ্ছাকে হেলায় যেতে না দিয়ে পাড়ে কাঠ দিয়ে বাঁধানো উঁচু জায়গায় বসে সপ্তপর্ণে পা ডুবিয়ে দিল শীতল জলে। স্পর্শীকে দেখাদেখি কয়েকজন এগিয়ে এসে একই কাজ করলো। গল্প-গুজবে সময় কাটলো কতক্ষণ। অতঃপর সাঁঝ নেমে আসতেই সকলে উঠে দাঁড়ালো একেক করে। তবে স্পর্শী উঠলো না, বসে রইলো। তার ভালো লাগছে এইখানে। খোলা আকাশের নিচে, নির্মল বাতাসে। নিবিড় দৃষ্টি স্থির হলো মিলিত আকাশের পানে। স্পর্শীকে এইভাবে বসে থাকতে ইমদাদুলের বড় মেয়ে সুবর্ণা বলে উঠে,

— ভাবী, ভিতরে যাবে না? একটু পরই আযান দিবে, এর আগে বাসায় না ফিরলে মা বকবে।

স্পর্শী মন্থর কন্ঠে বলে, “আমি এইখানে আরেকটু থাকতে চাই। তোমরা যাও, আমি না-হয় একটু পর আসছি।”

রাসেলের কনিষ্ঠ মেয়ে রামিশা বলে, “তোমাকে না নিয়ে ফিরলে আমরা সবাই বকা খাব। এইভাবেই মা বলে, সন্ধ্যার সময় দিঘির পাড়ে থাকতে নেই। জ্বীনে-ভূতে ধরে। তুমি চল না আমাদের সাথে।”

স্পর্শী পুনরায় বলে, “বকবে না। আমি বলবো নে আমি থাকতে চেয়েছিলাম বলেই তোমরা ফিরে গিয়েছ। তোমাদের দোষ নেই।”

সকলে আরও কয়েকবার স্পর্শীকে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বলে। কিন্তু শেষে স্পর্শীকে রাজি করাতে না পেরে ব্যর্থ হয়েই চলে যায় তারা। কিঞ্চিৎ সময় পরই প্রতিধ্বনিত হয় আজানের মিষ্ট ধ্বনি।ধীরে ধীরে রঙিন আকাশ আবৃত হয় কৃষ্ণের রঙে। স্পর্শী মাথায় দেওয়া ঘোমটা আরেকটু টেনে নিয়ে পুনরায় মন দেয় আকাশের রূপান্তর দেখাতে৷ কিছু সময় অতিবাহিত হতে না হতেই পিছন থেকে নির্বাণের কন্ঠ ভেসে আসে।

“তুমি এখনো এইখানে কি করছো?”

স্পর্শী ফিরে তাকায়। নির্বিকার কন্ঠে বলে, “আকাশ দেখছি।”

“দেখা হলে, ভিতরে চল। এখন দিঘির পাড়ে থাকা নিরাপদ না।”

স্পর্শী হেসে বলে, “কেন? আপনিও কি জ্বীন-ভূতে বিশ্বাস করেন?”

নির্বাণ ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে, “বখাটে ছেলের দল বের হয় এইসময়। এদিকটায় আসে বেশির ভাগ। ”

স্পর্শী ঠোঁট গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”

“হুম, চল।”

স্পর্শী কথা না বাড়িয়ে উঠতে নেয়। তা দেখে নির্বাণ এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে, “আস্তে-ধীরে উঠো, পড়ে যাবে না-হলে।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করে না তবে কিঞ্চিৎ হাসে৷ মনটা আজ তার হৃষ্টচিত্ত। নির্বাণের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো সে। স্পর্শীর হাতে ও পিছনে মাটি লেগে থাকায় ঝাড়া দিল। নির্বাণ সেটা লক্ষ্য করে পকেট থেকে রুমাল বের করে স্পর্শীর হাত টেনে ধরলো। খুব যত্নসহকারে হাত দু’টো মুছে দিতে রুমালটা পানিতেই ফেলে দিল। স্পর্শী তা দেখে বলল, “ফেললেন কেন?”

“এইভাবেই! চল এখন।”

স্পর্শী পাল্টা প্রশ্ন করতে চাইলো কিন্তু কিছু একটা ভেবে আর করলো না। সিক্ত পায়ে জুতো চড়িয়ে হাঁটা দিল নির্বাণের সাথে। বাগানের পথ ধরে কিছু দূর এগোলেই শেখ বাড়ি। ভেজা ঘাসের উপর স্পর্শীকে অসাবধানতার সাথে হাঁটতে দেখে নির্বাণ বলল, “আস্তে হাঁটো। জায়গায়টা ভেজা, পড়ে যাবা।”

নির্বাণের কথাটা বলতে দেরি তবে স্পর্শীর স্লিপ কাটতে নয়। নির্বাণ দ্রুত ওর হাত টেনে ধরে। স্পর্শী নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নির্বাণ বলে, “বলেছিলাম না?”

স্পর্শী লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলে, “আসলে,খেয়াল করিনি।”

নির্বাণ কিছু বলল না। নিভৃতে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে স্পর্শীর হাত নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরলো। বাকিটা পথ আর হাত ছাড়লো না সে

#পর্ব-১৮

ড্রয়িংরুমে বসেছে আজ জমপেশ আড্ডা। বাড়ির ছোট-বড় সকলেই এক জোট হয়ে নানান কথার সুর তুলছে। মাঝেমধ্যে হাসির রোল পড়ছে উচ্চস্বরে। কথায় কথায় জানা গেল মাহিনের বিয়ের জন্যই নির্বাণের বিয়েটা চটজলদি সাড়তে হয়েছে। শেখ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বড় ছেলের আগে ছোট ছেলে বিয়ে করতে পারবে না। আর শেখ বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে নির্বাণকেই ধরা হয়। কয়েক বছর ধরেই নির্বাণকে বিয়ের জন্য বলা হচ্ছিল কিন্তু নির্বাণ বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয় বলে তারা কথা আগাতে পারেনি। এর মাঝে মাহিন এসে ওর পছন্দের কথা জানায়। পাত্রীপক্ষের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো থাকায় বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। কিন্তু বিয়েটা আটকে থাকে নির্বাণের বিয়ের জন্য। অবশেষে নির্বাণও সম্মতি জানায় বিয়ের জন্য আর পুরো ব্যাপারটাই সে ছেড়ে দেয় নিলুফা ও রাদিনের উপর। কেন না, তার ভরসা ছিল তাদের পছন্দের উপর। ঘটকের মাধ্যমে স্পর্শীকে নাকি রাদিন-ই পছন্দ করেছিলেন নির্বাণের জন্য। অতঃপর নির্বাণকে বিষয়টা জানানো হলে সে পাত্রীকে না দেখেই তাদের সাথে যাওয়ার জন্য রাজী হয়ে যায়। কথা ছিল তাদের মেয়ে পছন্দ হলে আংটি পড়িয়ে রাখবেন আর খুব দ্রুত আয়োজন করে বিয়ের পর্ব চুকিয়ে নিবেন। এরপর মাহিনেরটা। কিন্তু পাত্রীপক্ষ চাইছিলেন বিয়েটা পড়েই হোক তাই দুই পক্ষ সেদিনই বসে পরামর্শ করে সিন্ধান্ত নেন নির্বাণ আর স্পর্শীর কাবিন করিয়ে রাখবেন এবং পরবর্তীতে আয়োজন করে নিবেন।

সব শুনে স্পর্শী ধাতস্থ হয়ে বসেছিল। নির্বাণের সাথে তার বিয়ে কাকতালীয়, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই হয়েছিল তা সে পূর্বেই বুঝেছিল। তবে আগেরকার মত এখন তার বিশ্রী অনুভূতি হয় না সম্পর্কটা নিয়ে। অপ্রিয় মানুষটাকেও আর অসহ্য লাগে না। বরং অন্যরকম এক মগ্নতা,স্নিগ্ধতা কাজ করে। ভালোলাগার ফুল ফুটে মনে। নিজের এমন পরিবর্তন স্পর্শী সনাক্ত করেছে ঠিক-ই কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। নামবিহীন অনুভূতিগুলো অতি মিষ্ট হয় বলে হয়তো৷

আড্ডা ভাঙ্গে রাত ন’টা নাগাদ৷ গৃহকর্মীরা ছুটে রান্নাঘরে দিকে, রাতের আয়োজন এখনো বাকি৷ ছোট, বড় সকলে উঠে চলে যায় নিজ নিজ রুমে। কয়েকজন দিয়ে বসে টিভির সামনে, বাকি অবসর কাটাতে। স্পর্শীও চলে যায় নিজের রুমে। রুমে এসে সর্বপ্রথম তার চোখ যায় বিছানার দিকে, কোলে একটা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে নির্বাণ। দৃষ্টি স্থির ল্যাপটপের স্ক্রিনে, কিছুক্ষণ পর পর নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বিরবির করছে। স্পর্শী একপলক সেদিক তাকিয়ে রুমে প্রবেশ করে। ক্ষণেই নির্বাণ বলে উঠে,

“ফ্রেশ না-হয়ে বিছানায় আসবা না। একবারে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে দ্যান আসবে৷”

স্পর্শী সচকিত দৃষ্টিতে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেনো?”

” দিঘিপাড় থেকে এসে ফ্রেশ হয়েছিলে? হওনি, এসে সোজা আড্ডায় বসে গেলে। দেখো এখনো জামায় নোংরা কাঁদামাটি লেগে আছে।”

স্পর্শী দ্রুত পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে জামা টেনে দেখার চেষ্টা করলো এখনো মাটি লেগে আছে কি-না। জামার এক কর্ণারে সামান্য মাটি লেগে আছে, যা চোখে পড়ার মত নয়। স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, চেঞ্জ করে নিচ্ছি।”

নির্বাণের ল্যাপটপের স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে বলে, “একবারে শাওয়ার নিয়ে আসবে।”

স্পর্শী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, “আবার শাওয়ার কেন?”

“মাটিতে বসেছিলে, শরীরে কত জীবাণু নিয়ে ঘুরছ সে হিসাব আছে? ”

স্পর্শী সরু কন্ঠে বলে, “তাই বলে এই রাত-বিরেতে শাওয়ার নিতে হবে? বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”

নির্বাণ প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “মোটেও না! আমার সাথে থাকতে হলে হাইজেন মেইনটেইন করতে হবে। এমন নোংরা থাকা যাবে না।”

স্পর্শী রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তাহলে আমি থাকবো না আপনার সাথে।”

“আমি ছাড়া তোমার কোন গতি নেই। থাকতে তোমাকে আমার সাথেই হবে। তাই কথা না বাড়িয়ে যা বলেছি তা কর, যাও।”

নির্বাণের প্রথম দিকের কথাগুলো শুনে স্পর্শী থমকালো। গোলগাল চোখে দেখতে থাকলো শ্যাম মানবটিকে। পরবর্তীতে আগের কথা রেশ ধরে মুখ ফুলালো সে, বিতৃষ্ণা মুখ ঘুরিয়ে নিল। দৃঢ় কন্ঠে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, এমন একরোখা মানুষকে আদৌ কিছু বলে লাভ আছে? অবশেষে না পেরে স্পর্শী ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল ফ্রেশ হতে৷

__________________

তোয়ালে দিয়ে ভালোমতো চুল মুছে স্পর্শী বিছানায় এসে বসলো। আড়চোখে একবার তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণ তখনও ল্যাপটপ নিয়েই ব্যস্ত। স্পর্শী আনমনে নির্বাণকে কিছু কটুক্তি শুনিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল৷ অতঃপর মোবাইল হাতে নিতেই রিংটোন বেজে উঠলো তার। সালেহা কল করেছেন। স্পর্শী কল রিসিভ করে কিয়ৎক্ষণ তার সাথে কথা বললো। তাদের কথার মাঝেই স্পৃহা এসে সালেহা থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কথা বলা শুরু করলো,

“আপু, তুমি কবে আসবে?”

স্পর্শী কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “এইতো দুই-তিনের মধ্যে এসে পড়ব, কেন কি হয়েছে? পার্শিয়া জ্বালাচ্ছে?”

“জ্বালাচ্ছে মানে? পুরো ঘর উঠিয়ে রেখেছে৷ ঘন্টাখানেক পর পর তোমার রুমে গিয়ে দেখে আসে তুমি আছো কি-না। তোমায় না পেলে তোমার ছবির সামনে গিয়ে যে চিল্লানি দেয়৷ আল্লাহ!”

“এ আর নতুন কি? তা কিছু খাওয়াতে পেরেছিস?”

স্পৃহা অবসন্ন কন্ঠে বলে, “প্রথমদিন একবারেই খাওয়াতে পারিনি। পরেরদিন নিজ থেকে এসেই খেয়েছে। আপু শুনো, শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় এই আপদটারে নিয়ে যাবে। একে আমি পালতে পারবো না।”

স্পর্শী এইবার আড়চোখে নির্বাণের দিকে তাকায়। মনে পড়ে যায় তার বিয়ের দ্বিতীয় দিনের কথা। কিভাবে নির্বাণ পার্শিয়াকে রুম থেকে বের করে দিতে বলেছিল। যতটুকু সে বুঝেছে ইহকালে নির্বাণ পার্শিয়াকে নিজের বাসায় ঢুকতে দিবে না৷ স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “দেখা যাক।”

স্পৃহা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দেয়৷ কিয়ৎক্ষণ পরেই আঁধার আকাশ গর্জন করে উঠলো, বাতাসের বেগ বাড়লো হু হু করে। বৈশাখী ঝড়ের আর্বিভাব ঘটলো ধরণীর বুকে। স্পর্শী একপলক জানালার বাহিরে তাকালো। কাঁচা মাটির সুবাস নিঃশ্বাসে মিশে যেতেই মন প্রফুল্লচিত্ত হলো। স্পর্শী স্থিরচিত্তে এগিয়ে গেল জানালার দিকে, লোহার গরাদের মধ্য দিয়ে হাত বের করে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। দখিনা বাতাস চলতে শুরু করলে শীতল কণাগুলো খুব আদুরে ভঙ্গিতে এসে পরশ বুলায় স্পর্শীর চোখে মুখে। জানালার ধারে লাগোয়া কাঠগোলাপের গাছটি কেঁপে উঠে, নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকায় শ্যামময়ী নারীর সিক্ত হাতের পানে। নারীর বাহুর প্রেমে পড়েই কয়েকটি শুভ্রে মোড়ানো ফুল লুটিয়ে পড়ে তার বাহুতে। স্পর্শী চমকায়, বেশ চমকায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রফুল্লচিত্তে হেসে উঠে।অকস্মাৎ পিছন থেকে কেউ স্পর্শীর বাহু টেনে ভিতরে নিয়ে আসে। বেসামাল হয়ে উঠায় হাত থেকে ছুটে নিম্নে অতুল আঁধারে হারিয়ে যায় ফুলগুলো৷ স্পর্শী ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় পাশে। নির্বাণ জানালা আঁটকে স্পর্শীর দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“এই অবেলার বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।”

স্পর্শী কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “বৃষ্টির জন্য কি-না জানি তবে আপনার খুঁতখুঁত স্বভাবের জন্য আমার ঠিকই ঠান্ডা লেগে যাবে। তাই খামাখা বৃষ্টিকে দোষা করবেন না।”

মুহূর্তেই নির্বাণ দুইজনের মাঝে দুরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে স্পর্শীর ওড়নার একাংশ নিয়ে খুব সপ্তপর্ণে স্পর্শীর মুখে পড়ে থাকা বৃষ্টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথাগুলো মুছে দিল।
অতঃপর স্পর্শী থেকে সরে এসে বলল, “সেটা আমার জন্য না তোমার ঠিক মত চুল না মুছার জন্য লাগবে। একদিনও ঠিক মত চুল মুছো না তুমি৷ এখনো তোমার চুল ভেজা। দেখো!”

স্পর্শী প্রথমে নির্বাণের কাছে আসায় ধাতস্থ হলেও তার পরবর্তীতে কথাতে একদফা নিজের আর্দ্র চুলের দিকে তাকিয়ে থমকালো। অতঃপর নিজের দোষ ঢাকতে বলে, “সেটাও তো আপনার জন্যই। না আপনি এত রাতে আমাকে শাওয়ার নিতে বলতেন, আর না আমার চুল ভেজা থাকতো।”

নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে বলে, “নিজের দোষ আমার উপর চাপাতে চাচ্ছ?”

স্পর্শী থমথম খেয়ে বলে, “একদম না। যেটা সত্য সেটাই বলছি।”

ক্ষণে রাতের খাবারের জন্য আলিয়ার ডাক পড়তেই
নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলল, “ঝগড়া করার ইচ্ছে হলে পড়ে করিও৷ এখন চল খেতে, নানাজান দেরি করা পছন্দ করেন না।”

কথাটা বলেই নির্বাণ বেড়িয়ে যায়। স্পর্শীও দ্বিরুক্তি না করে মাথার ওড়নাটা ঠিক করে ছুটলো নির্বাণের পিছু পিছু৷ কিন্তু এই ফাঁকে স্পর্শী বুঝলোই না নির্বাণের প্রতি থাকা সংশয়, জড়তা, অস্বস্তি সে আজ কাটিয়ে উঠেছে৷ ধীরে ধীরে সেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে নির্বাণের সহিতে।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৯

তীব্র বর্ষণের ধারা গিয়ে থামলো প্রভাতের ঠিক পূর্বে৷ হিম অনলে ছড়ালো বুনো ফুলের স্নিগ্ধতা। সিক্ত কাঠগোলাপের দল মাধুর্য পেল সূর্যের প্রথম আলো গায়ে পরশ বুলাতে। কিয়দংশ সময় গড়াতেই টুংটাং শব্দ ভেসে এলো পুবদিকে অবস্থিত রান্নাঘর থেকে। জ্বলে উঠলো চুলো। ধীরে ধীরে জাগ্রত হলো শেখ বাড়ির সকলে। শান্ত পরিবেশ হলো গমগমে। ব্যস্ততায় নিমজ্জিত হলো সময়। দুপুরে মাহিনের বউভাত বলে।

ব্যস্ততা থেকে অবকাশ মিলতেই নির্বাণ রুমে আসে।স্পর্শী তখন আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজের সাজ ঠিক করতে মগ্ন। নির্বাণের আবির্ভাব তার বোধগম্য হয়নি। নির্বাণ একপলক সেদিক তাকালো, দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো শাড়ির ফাঁকে নিষিদ্ধ এক স্থানে। সংযতচিত্তে দ্রুত সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ব্যাগ থেকে নিজের শার্ট-সুট বের করে নিল। বিছানায় সেগুলো রেখে শুভ্র শার্টটি হাতে নিল প্রথমে। ব্যাগের চাপে শার্টটির ভাঁজ প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নির্বাণ বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিলুফার রুমের সামনে গিয়ে মন্থর কন্ঠে বলে উঠে, “মা, আয়রনটা কোথায়?”

নিলুফা তখন চশমা ঠিক করে মাত্র বিছানায় বসেছিলেন। নির্বাণের কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই তিনি চোখ তুলে তাকান। শান্ত কন্ঠে বলেন, “আলিয়া ভাবীর রুমে থাকার কথা।”

“মামীকে একটু বল দিতে, আমার শার্ট আয়রন করতে হবে।”

“আচ্ছা, তুই যা। কাউকে বলে আমি তোর রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

নির্বাণ ছোট করে ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়৷ রুমে এসে বসতেই নাহিদ হুড়মুড় করে নির্বাণের রুমে ঢুকে। উচ্চকিত কন্ঠে বলে, “ভাবী! ফুলের মালাটা সুবর্ণা পাঠিয়েছে তোমার জন্য। নাও।”

স্পর্শী ফিরে তাকায়। মিষ্টি হেসে বলে, “ধন্যবাদ ভাইয়া।”

নাহিদও প্রত্যুত্তরে মিষ্টি হেসে রজনীগন্ধার মালাটা এগিয়ে দেয় স্পর্শীর নিকটে। স্পর্শী সেটা হাতে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের এক প্বার্শে রেখে দিয়ে পুনরায় নিমগ্ন হলো নিজ কাজে। নাহিদ একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তুই এইভাবে মেয়েদের মত বসে আছিস কেন? রেডি হবি না?”

নির্বাণ শান্ত কন্ঠে বলে, “শার্টের আয়রন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শার্ট আয়রন করে রেডি হয়ে যাব।”

নাহিদ বিছানার কাছে এসে শুভ্র শার্টটা হাতে নিয়ে বলে, “কই নষ্ট হয়েছে? সামান্য একটু কুঁচকে গিয়েছে তাও নিচের দিক দিয়ে। এইটাকে আবার আয়রন করা লাগে? শার্ট তো কোর্টের নিচের থাকবে ভাই, দেখবে কে?”

নির্বাণ স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “তোকে এত কথা বলতে কেউ বলিনি৷ যাহ এখন এইখান থেকে।”

নাহিদ প্রত্যুত্তর করার আগেই আলিয়ার ছোট ছেলে ফাহিম আসে রুমে। নির্বাণকে আয়রন দিয়ে চটজলদি চলে যায়। নাহিদ তা দেখে আফসোসের সুরে বলে, “এত খুঁতখুঁতে স্বভাব ভালো না, বুঝলি। তোর এই স্বভাবের জন্য কবে না জানি আমার কিউট ভাবী পালিয়ে যায়। দেখ, আগেই বলে রাখছি ভাবী যদি পালায় না আমি তোর নামে ক্যাস ঠুকে দিব। ”

নির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তোর ভাবীরটা জানি না তবে তুই যদি এখনই আমার সামনে থেকে দূর না হোস তাহলে…”

নির্বাণের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই নাহিদ বলে উঠে, “রাগিস কেন ভাই? মজা করছিলাম তো।”

“তোকে মজা করতে বলেছে কেউ?”

“টিচারদের এই এক সমস্যা, কথায় কথায় সিরিয়াস হয়ে যায়। অ্যাই! তোকে টিচার হতে কে বলেছিল? চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা হতে পারলি না?”

নির্বাণ চড়া গলায় বলে, “যাবি তুইই!!”

নাহিদ দ্রুতপায়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলে, “যাচ্ছি!”

নাহিদ যেতেই নির্বাণ শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। এইদিকে দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে স্পর্শী ঠোঁট চেপে হাসছে। নির্বাণ ঘুরে স্পর্শীর দিকে তাকাতেই স্পর্শী বলে উঠে, “দেন, আমি আয়রন করে দিচ্ছি।”

“দরকার নেই, হাতে লাগিয়ে ফেলবে তুমি। আমি করে নিচ্ছি।”

স্পর্শী অনড় কন্ঠে বলে, “কিছু হবে না, দেন আমায়। করে দিচ্ছি!”

নির্বাণ ভরাট কন্ঠে বলে, “স্পর্শী না করেছি না আমি?”

নির্বাণের ভরাট কন্ঠের পৃষ্ঠে দমে গেল স্পর্শী। হতাশাজনক নিশ্বাস ফেলে নিজের কাজ করতে থাকলো।

_______________

ওয়াশরুম থেকে একবারে তৈরি হয়ে বের হলো নির্বাণ। বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে বা-হাতার বোতামটা লাগাতে লাগাতে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সামনে। স্পর্শী একমনে নিজের খোঁপায় রজনীগন্ধার মালা গাঁথতে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে হেয়ারপিনের সাহায্যে মালাটা সুন্দরভাবে খোঁপায় এঁটে দেওয়ার কিন্তু বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। যতবারই সে ব্যর্থ হচ্ছে ততবারই সে পাতলা ঠোঁট দু’টি নাড়িয়ে বিরবির করে উঠছে। নির্বাণ তা দেখে আনমনে হাসলো, হাতার বোতাম লাগিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সেদিকে। স্পর্শীর পিছনে দাঁড়িয়ে বলে, “দাও, আমি সাহায্য করছি।”

স্পর্শী আয়নার মধ্য দিয়েই নির্বাণের পানে তাকালো। অভিমানী কন্ঠে বলল, “লাগবে নাহ! আমি পারবো করতে।”

স্পর্শীর অভিমান বুঝতে পেরে নির্বাণ ঠোঁট কামড়ে হাসে। মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে নির্বাণ স্পর্শীর খুব নিকটে এসে দাঁড়ায়। স্পর্শীর হাত থেকে হেয়ারপিনগুলো নিয়ে নেয়, “তুমি না বললেই আমায় শুনতে হবে?”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর না করে মাথা নুইয়ে দাঁড়ায়। নির্বাণের নৈকট্য স্পর্শীর বক্ষঃস্পন্দনের গতানুগতিক ধারায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। কণ্ঠনালীতে আঁটকা পড়েছে কথাগুলো। উত্তর না পেয়ে নির্বাণ পিনগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, “এইগুলো লাগায় কিভাবে?”

নির্বাণের প্রশ্নে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনমতে শব্দ টেনে বের করে কণ্ঠনালী মধ্য হতে। বুঝিয়ে দেয় কিভাবে হেয়ারপিনগুলো ব্যবহার করতে হয়। নির্বাণ নির্দেশনাগুলো শুনে, বুঝে খুব সপ্তপর্ণে স্পর্শীর খোঁপায় মালা চেপে হেয়ারপিনগুলো এঁটে দিতে শুরু করে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃতভাবেই নির্বাণের আঙ্গুল ছুঁয়ে যায় স্পর্শী গলদেশ, কাঁধ। মুহূর্তেই ভিতর থেকে কেঁপে উঠে স্পর্শী। অজানা ভালোলাগায় আবৃত হয় মন,চিত্ত।

মালা গাঁথা শেষে নির্বাণ স্পর্শীর কাঁধের কাছে মুখ আনতেই তপ্ত নিঃশ্বাসের দল আঁচড়ে পড়ে স্পর্শীর গলদেশে। শাড়ির উপর দিয়ে আলতো হাতে স্পর্শীর কোমর জড়িয়ে ধরতেই স্পর্শী কেঁপে উঠে। আয়নার মধ্য দিয়ে বৃহৎ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে। নির্বাণ কিঞ্চিৎ হেসে স্পর্শীকে দ্বিগুণ অবাক করে ওষ্ঠ্য ছোঁয়ায় তার কাঁধে। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “কৃষ্ণময়ীর অলঙ্কার লাজুকলতা, অভিমান নয়।”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই স্পর্শী স্থির হয়ে যায়। নিজ সহিতে মেদুর গালে ছঁড়ায় স্নিগ্ধতা। অভিমানী মন গলে নিরুদ্দেশ হয় আকাশে। এই কথার পর কি আদৌ অভিমান থাকার দুঃসাহসিকতা করে?
কিয়ৎক্ষণ পর সরে আসে নির্বাণ। বিছানার উপর থেকে কোর্ট নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলে, “তাড়াতাড়ি এসো, বাহিরে অপেক্ষা করছি আমি।”

________________

চারদিকের কোলাহলে স্পর্শীর মাথা ধরে আসতেই নীরব এক জায়গায় খুঁজে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে নেয়। অতঃপর পার্সব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করে ফেসবুক স্ক্রোল করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই চলে যেতেই অকস্মাৎ স্পর্শীর ফোন বেজে উঠে। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে তার। কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে কলটা রিসিভ করে সালাম দেয় স্পর্শী। কিয়ৎকাল নীরবতায় অতিবাহিত হয়ে অপরপাশ থেকে সালামের উত্তর আসে। সে সাথে একটি প্রশ্ন,

“আমার নাম্বার সেভ কর-নি এখনো?”

কন্ঠস্বরের মালিককে সনাক্ত করতে পেরে স্পর্শীর অভিব্যক্তি বিবর্ণ হয়ে উঠে। শুকনো গলায় ঢোক গিলে বলে, “ভুলে গিয়েছিলাম।”

অপরপাশ থেকে নির্বাণ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “কোথায় তুমি?”

“বা-দিকটায় আছি। মাথা ধরেছিল তাই নিরিবিলি জায়গায় দেখে এইখানে এসে বসেছি।”

নির্বাণ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “ঠিক আছো তুমি?”

“হ্যাঁ, এখন ঠিক আছি। চিন্তা করার বিষয় নেই।”

“আচ্ছা, তুমি থাকো আমি আসছি।”

স্পর্শী ‘আচ্ছা’ বলে কান থেকে ফোন নামিয়ে নেয়। ফোন কাটার জন্য আঙুল স্ক্রিনে ছোঁয়ানোর আগেই পাশ থেকে একজন বলে উঠে, “এক্সকিউজ মি মিস!”

স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “জি?”

হাস্যজ্বল মুখশ্রীর অধিকারী এক ছেলে বলে উঠে, “আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

“বলুন!”

“আগে পাশে বসি, তারপর না-হয় বলি?”

স্পর্শী ইতস্তত করলো। ছেলেটা উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা না করেই বসে পড়লো। স্পর্শী তা দেখে নিজের সিট ছেড়ে এক সিট পিছিয়ে বসলো৷ ছেলেটা তা দেখে হেসে বলল, “আমি দেখতে কিন্তু এতটাও খারাপ নই যে আপনাকে ভয়ে পিছিয়ে যেতে হবে।”

স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকালো ছেলেটার দিকে। ছেলেটা চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলল, “জানি আমি কিছুটা অদ্ভুত টাইপ। কিন্তু খারাপ না।”

স্পর্শী কোনরকম ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করে, “আমার সাথে আপনার কি যেন কথা ছিল?”

“ছিল তো! তবে এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।”

স্পর্শী বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “যেহেতু ইচ্ছে করছে না সেহেতু এখন আসতে পারুন।”

“রেগে গেলেন বুঝি? আচ্ছা, ভণিতা করছি না আর। সোজা পয়েন্টে আসি, আপনাকে কয়েকদিন ধরেই নোটিস করছিলাম। বলতে পুরো বিয়েতে আমি আপনাকেই দেখে গিয়েছি। যতটুকু বুঝেছি আপনার প্রতি আমি কিছু ফিল করি, কিন্তু সেটা কি রকম ঠিক জানি না। আজকের পর আপনার সাথে আমার দেখা হওয়ার সুযোগ তেমন নেই, তাই আপনাকে একা দেখে ভাবলাম মনের কথাটা বলে দেই।”

কথাগুলো লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো ছেলেটা। অতঃপর স্পর্শীর চোখে চোখ রেখে বলল, “আই লাইক ইউ!”

স্পর্শী কাঠ কাঠ গলায় বলে, “আর কতজনকে এই কথা বলেছেন?”

ছেলেটা অবাক হয়ে বলে, “কতজন মানে? আপনাকেই প্রথম বলেছি।”

স্পর্শী বিরক্তিকর কন্ঠে বলে, “চেনা নাই, জানা নেই হুট করে কাউকে বললেই হলো আই লাইক ইউ? আর মেয়েরাও বুঝি নাচতে নাচতে আপনাকে হ্যাঁ বলে দিবে, এত সস্তা মনে হয় মেয়েদের?”

ছেলেটা থমথম কন্ঠে বলে, “তা না ভুল বুঝছেন আপনি। আমি সেটা বুঝাতে চাইনি। আচ্ছা, আপনার সমস্যা এইটাই তো আমরা অপরিচিত? ওকে আমি পরিচয় বলছি আগে, আমি কনের খালাতো ভাইয়ের বন্ধু আদিত্য। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। এইবার আপনার পরিচয় বলুন।”

স্পর্শী কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে নির্বাণের কন্ঠ ভেসে আসে, “তার পরিচয়, সে আমার একমাত্র বউ এবং বরের বড়ভাবী।”

কথাটা শুনে স্পর্শী আর আদিত্য দুইজনেই পিছনে ঘুরে তাকায়। নির্বাণ কান থেকে ফোন নামিয়ে কল কেটে এগিয়ে এসে স্পর্শী হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলে, “প্লাস ও তোমার সিনিয়রও। ভুল জায়গায় ট্রায় মারছো ব্রাদার।”

নির্বাণের কথায় আদিত্যের মুখ হা হয়ে আসে। সে বিমর্ষচিত্তে একবার স্পর্শীর দিকে তাকায়, আরেকবার নির্বাণের দিকে। অতঃপর কোনমতে উঠে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে, “সরি ভাইয়া! আসলে বুঝতে পারিনি,এক্সট্রিমলি সরি।”

কথাটা বলে আদিত্য দ্রুত কেটে পড়ে। নির্বাণ একপলক সেদিকে তাকিয়ে স্পর্শীর দিকে তাকায়। স্পর্শী আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে মিনমিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি? এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

“ভাবছি, আমার সামনে ভিজাবিড়াল থাকা মেয়েটা আসলে ভিজাবিড়াল নয়।”

স্পর্শী থমথম দৃষ্টিতে তাকায়। অস্ফুটস্বরে বলে, “তেমন কিছু না।”

কথাটা বলে দ্রুত দৃষ্টি নামায় সে। সে জানে, সকলের নিকট কঠোর হলেও নির্বাণের সম্মুখে সে কঠোর হতে পারে না। চেয়েও কথার খই ফুটাতে পারে না। লজ্জায় আবৃত এবং অন্যরকম অনুভূতির শিহরণে জর্জরিত থাকে। কিন্তু এইটা কি আর স্বীকার করা যায়?

নির্বাণ বলে, “তা না-হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি এখন সেটা নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি তোমার নতুন পরিচয়ের কথা।”

স্পর্শী কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আবার কোন পরিচয়?”

নির্বাণ মুচকি হেসে স্পর্শীর নিকট কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে, “তোমার আরেকটা পরিচয় হচ্ছে, তুমি আমার না হওয়া বাচ্চার মা।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসে। সে দ্রুত নির্বাণের কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “আপনাকে আমি ভালো জানতাম।”

নির্বাণ হেসে বলে, “তো এখন খারাপ জেনে নাও”

স্পর্শী আনমনে নির্বাণকে বকাঝকা করে চলে যেতে নিলে নির্বাণ পিছন থেকে স্পর্শীর হাত ধরে বলে, “আমার সাথে সাথেই থাকবে এখন৷ আসো!”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২০

নিশীথের সময়। আকাশে পূর্ণ চাঁদের আবির্ভাব। শৈত্য বাতাস সুক্ষ্ম আঁচড় কাটছে সবুজাভ পাতার কাগজি গায়ে। জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার দল। নির্বাণ পায়চারি করতে করতে এসে দাঁড়ালো জানালার ধারে। ক্ষণেই এক মুঠো স্নিগ্ধতা হুমড়ি খেয়ে পড়লো শ্যামপুরুষের ছোঁয়া পেতে। লেপ্টে গেল মুখশ্রী,চিবুক,গলদেশের সহিতে। নির্বাণ মোবাইলের কৃত্রিম পর্দায় সময়টা দেখে নিল একবার। একটার উর্ধ্বে সময় গড়িয়ে গিয়েছে অথচ স্পর্শীর কোন খোঁজ নেই। অনুষ্ঠান থেকে আসার পর সে যে চোখের আড়াল হলো তো হলো। ভুলেও ধরা দিল না নির্বাণের সন্নিধানে৷ হঠাৎ এমন আচরণের মানে বুঝতে পারলো না নির্বাণ। কিঞ্চিৎ প্রহর অপেক্ষা করে নিজ থেকে স্পর্শীর খোঁজ করেছিল কয়েকবার কিন্তু লাভ হয়নি। ধরা দেয়নি ফাঁকিবাজ মেয়েটা।
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই বিতৃষ্ণায় ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করলো নির্বাণ। বিরক্তির সাথে তাকালো একবার আকাশের পানে, অতঃপর বেরিয়ে এলো রুম থেকে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে রওনা দিল নিলুফার রুমের দিকে। নিলুফার রুমের সামনে আসতেই শুনতে পেল কারো রিনরিনে কথার এবং হাসির শব্দ। নির্বাণ বিরবির করলো,

“আমাকে দহনে দগ্ধ করে দেখো কি নিশ্চিন্তে হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে মেয়েটা।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল, আলতো হাতে খুললো দরজা। স্পর্শী তখনও নিলুফার সাথে কথা বলায় মশগুল। বুঝতে পারেনি নির্বাণের উপস্থিতি। নির্বাণ গলা ঝেড়ে নিলুফার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখনো ঘুমাও নি কেন মা? রাত দেখেছ কয়টা বাজে?”

নিলুফা ও স্পর্শী দু’জনে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো দরজার পানে। নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। স্পর্শী দ্রুত দৃষ্টি সরালো। নিলুফা নিজের চশমা ঠিক করে বলে, “এইতো ঘুমাতে যাচ্ছিলাম।”

নির্বাণ কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে, “তোমাকে না ডাক্তার বলেছে রাত না জাগতে? তাও কথা শুনো না। রাতে ঔষধ খেয়েছ?”

নিলুফা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন, “হ্যাঁ খেয়েছি।”

“আচ্ছা তাহলে এখন শুয়ে পড়।”

নিলুফা কিছু বলতে যাবেন তার আগেই নির্বাণ পুনরায় বলে উঠে, “স্পর্শী রুমে আসো।”

স্পষ্ট আদেশবাণী। স্পর্শী দৃষ্টি নত রেখেই মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। নির্বাণ এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। নিলুফা তা দেখে বলেন, “কাল কথা হবে নে। এখন যাও, ডাকছে তোমায়।”

স্পর্শী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নিলুফাকে কোনরকম শুভরাত্রি জানিয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে আনমনে ভাবে,”এমন অদ্ভুত কেন মানুষটা? মায়ের সামনে এইভাবে কেউ রুমে যেতে বলে? উফফ! মায়ের সামনে কি এক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হলো। মানুষটা স্পষ্টভাষী জানতো কিন্তু তা যে এতটা সেই ধারণা তার ইহকালেও ছিল না।”

অনুষ্ঠান থেকে এসে স্পর্শী ইচ্ছে করেই নির্বাণের সামনে পড়েনি। চক্ষুলজ্জায় নাকি অস্বাচ্ছন্দ্যে সেটা জানা নেই তার। তবে আজ নির্বাণের কথা ভাবনায় আসলেও উৎকন্ঠা, ব্যগ্রতা, ব্রীড়ানতায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। যার দরুন চোখের আড়ালে থেকেই দিনটা কাঁটিয়ে দিয়েছিল, ভেবেছিল রাতটা আজ কথায় কথায় নিলুফার রুমেই কাঁটিয়ে দিবে। কিন্তু তা আর নির্বাণ হতে দিল কোথায়? নৈরাশ্যজনক নিঃশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকলো সে। চোখের পলকেই নিজেকে কারো দৃঢ় বন্ধনে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। মুহূর্তেই ভড়কে উঠলো, বিমূঢ় নয়নে তাকালো সামনে। নির্বাণ রোষাগ্নি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“সন্ধ্যা থেকে কোথায় ছিলে?”

স্পর্শী ফাঁকা ঢোক গিলে বলে, “এইতো এইখানেই।”

“এইখানে বলতে কোনখানে?”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। তা দেখে নির্বাণ তার আর স্পর্শীর মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে দাঁড়ায়। মন্থর কন্ঠে বলে, “পালিয়ে বেড়াচ্ছ আমার থেকে? কিন্তু কেন? কি করেছি আমি?”

স্পর্শীর প্রায় রুদ্ধশ্বাস অবস্থা এইবার। শব্দ,বাক্য নিঃশ্বাস সব যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে কণ্ঠনালীর মধ্যখানে। টু শব্দ পর্যন্ত করা এখন দায় সমান স্পর্শীর নিকটে। কোনমতে অস্ফুটস্বরে সে বলে উঠে, “তেমন কিছুই না। ভুল বুঝছেন আপনি।”

নির্বাণ কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে বলে, “পরেরবার যেন না দেখি তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। না-হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ছাড়া পেয়ে স্পর্শীর দীর্ঘশ্বাস নেয়, এতক্ষণে তার জানে জান আসলো বোধহয়। আনমনে আওড়ালো, “আছি তো আপনার সাথে শুধু আজকের রাতটা। পরে আমাকে পাবেন কোথায়?”

অকস্মাৎ নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলে উঠে, ” লাইট অফ করে ঘুমোতে এসো।”

স্পর্শী সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের অভিমুখে। অতঃপর লাইট অফ করে বিছানার দিকে যেতে শব্দহীনভাবে বলল, “হিটলার একটা।”

________________

রক্তিম অপরাহ্নে হরিদ্রাভ মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা। দূরে এক ঝাঁক পায়রা উন্মুক্ত আকাশে ঘূর্ণমান গতিতে উড়ে বেড়াচ্ছে। ভ্যাপসা গরমের আবৃত পরিবেশে ঘাম ঝরছে তিরতির করে। স্পর্শী হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপাল এবং ঠোঁটের উপরিভাগে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিল। ভিড়-ধাক্কায় দমবন্ধ হয়ে আসছে তার, এগুতে চেয়েও এগুতে পারছে না। অবসন্ন দৃষ্টিতে আশেপাশে নাহিদ এবং বাকিদের খোঁজ করলো কিন্তু পেল না তাদের। ভিড়ের মাঝে হয়তো ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে সকলে। বাড়ি থেকে দশ মিনিটের দূরত্বেই একটি মেলা বসেছে। নাহিদ এবং বাকিরা সেখানে ঘুরতে যাবে শুনে স্পর্শীও যোগ দেয় ওদের দলে। নির্বাণ আসেনি সাথে, তার নাকি ভিড়বার জায়গায় পছন্দ নয়। তবে, নির্বাণ বারন করেছিল স্পর্শীকে যেতে। কিন্তু স্পর্শী সে কথা আমলে নেয়নি, নিভৃতে এসে পড়েছিল নাহিদদের সাথে। কিন্তু এইখানে যে এত ভিড় হবে এবং ভিড়ে সে হারিয়ে যাবে তা কি আর সে জানতো? জানলে হয়তো নির্বাণের কথা অমান্য করে এইখানে আসার দুঃসাহসিকতা দেখাত না।

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে, চেষ্টা করলো ভিড় থেকে বেরিয়ে আসার। এমন সময় পিছন থেকে এক জোড়া পুরুষালি হাত এসে স্পর্শীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। দৃঢ়ভাবে আগলে নেওয়ার ক্ষীণ চেষ্টা করে। ঘটনাক্রমে স্পর্শী ভড়কে উঠে, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায় কিয়ৎক্ষণের জন্য। এরপর মুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার, ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করে উঠে। স্পর্শী পিছনে না ঘুরেই কুনই দিয়ে মানুষটির পেটে আঘাত করতে নিলে সে তার হাত ধরে ফেলে। কাঠ কাঠ গলায় বলে,

“হাত চালানোর আগে দেখে তো নিবে কার উপর হাত চালাচ্ছো? ষ্টুপিড!”

অতি পরিচিত কন্ঠটি কর্ণকুহরে এসে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র স্পর্শী চটজলদি পিছন ঘুরে তাকায়। মুখে কালো মাস্ক পড়ে থাকা সত্ত্বেও স্পর্শী কিভাবে যেন চিনে ফেললো মানুষটিকে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো, “নির্বাণ আপনি?”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২০ [বর্ধিতাংশ]

“হাত চালানোর আগে দেখে তো নিবে কার উপর হাত চালাচ্ছো? ষ্টুপিড!”

অতি পরিচিত কন্ঠটি কর্ণকুহরে এসে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র স্পর্শী চটজলদি পিছন ঘুরে তাকায়। মুখে কালো মাস্ক পড়ে থাকা সত্ত্বেও স্পর্শী কিভাবে যেন চিনে ফেললো মানুষটিকে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো, “নির্বাণ আপনি?”

স্পর্শীর সম্মোধন শুনে নির্বাণ এক মুহূর্তের জন্য থমকায়। অতঃপর অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে, “আমি না-হলে কে হবে? আমি বাদে কি আরও আট-দশটা বর আছে তোমার?”

স্পর্শী থতমত খেয়ে বলে, “তা থাকতে যাবে কেন?”

নির্বাণ স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “আমি কি জানি?”

স্পর্শী অসন্তোষজনক দৃষ্টিতে তাকায়। নির্বাণের ত্যাড়া উত্তরগুলো তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। হঠাৎ পিছন থেকে ধাক্কা লাগতেই নির্বাণ স্পর্শীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে। অনিচ্ছাকৃতভাবেই দৃঢ় হয় বন্ধন। স্পর্শী এইবার যেন মিইয়ে যায়, ব্যগ্র দৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকায়। নির্বাণ তা দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে খুব সপ্তপর্ণে আগলে নেয় স্পর্শীকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় সামনে। আপাতত এইখান থেকে বের হতে পারলেই বাঁচে তারা। নির্বাণের তীব্র প্রচেষ্টা ফুলের টোকাও যেন ছুঁতে না পারে স্পর্শীকে। কিয়ৎকালের ব্যবধানেই নির্বাণ ও স্পর্শী বেড়িয়ে আসে ভিড় থেকে। খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পরক্ষণে। কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানেই ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা নির্বাণের। আকাশী বর্ণের শার্টটি কুঞ্চিত হয়ে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। নির্বাণ পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিল। অতঃপর রোষানল দৃষ্টি তাকালো স্পর্শীর পানে,

“এত অবাধ্য কেন তুমি? তোমাকে না আমি এইখানে আসতে মানা করেছিলাম? তারপরও কোন সাহসে এসেছ তুমি? দেখলে তো কি বিশ্রী অবস্থা? এই জন্যই মানা করেছিলাম তোমাকে আসতে।”

স্পর্শী স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে, “আমি জানতাম না-কি এইখানকার অবস্থা এমন হবে?”

“তুমি না জানতে বাকিগুলা তো জানতো। তাও কেন নিয়ে আসলো তোমাকে?”

কথাটা বলে নির্বাণ এক মুহূর্ত চুপ থেকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর দিকে, “এক মিনিট, বাকিরা কোথায়? আর তুমি ওই ভিড়ে একা কি করছিলে শুনি?”

স্পর্শী এইবার বিচলিত দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে। শুকনো গলায় কয়েকবার ঢোক গিলে অস্পষ্ট সুরে বলে, “না মানে… আমি আসলে… ”

“বলবে ওরা কোথায়?”

স্পর্শী চোখ খিঁচে বন্ধ করে গড়গড় করে বলে উঠে, “ওরা কোথায় জানি না। ভিড়ের মাঝে পড়তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি।”

নির্বাণ এইবার শানিত কন্ঠে বলে উঠে, “লাইক সিরিয়াসলি! তুমি বাচ্চা না-কি? এত বড় হয়েও ভিড়ের মাঝে হারায় কিভাবে মানুষ? আর হারিয়েছ ভালো কথা, ওদের ফোন করবে না? কমনসেন্স নেই তোমার?”

স্পর্শী মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “ফোন বাসায় ভুলে রেখে এসেছি।”

নির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “নিজেকে ভুলে রেখে আসতে পারলা না? তাহলেই তো হতো।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না, বিমর্ষচিত্তে গুটিয়ে দাঁড়ালো। আনমনে ভাবলো, “এত বকার কি আছে? মানুষ মাত্রই ভুল। এখন, ভুল মানুষ করবে না-তো কি কুকুর-বিড়ালছানা করবে?”

স্পর্শীকে নীরব থাকতে দেখে নির্বাণ বলল, “আমি যদি না আসতাম তাহলে কি করতে তুমি? ভেবেছ একবার? এত কেয়ারলেস কেন তুমি?”

স্পর্শী এইবার চটে গিয়ে বলে, “নাই-বা আসতেন। আসতে কে বলেছিল আপনাকে? এসেছেন কেন আপনি?”

স্পর্শীর তীব্র প্রশ্নের বিপরীতে নির্বাণের শীতল উত্তর, “বউ লাপাত্তা হলে, না এসে উপায় আছে?”

এই কথার পৃষ্ঠে স্পর্শী চেয়েও প্রত্যুত্তর করতে পারলো না। শিথিলতা কাজ করলো মনের মাঝে। স্পর্শী না পেরে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল স্পর্শী। নির্বাণ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাহিদকে ফোন করলো। কয়েকবার রিং হতেই নাহিদ ফোন তুললো। নির্বাণ দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কই তুই?”

নাহিদ আমতা-আমতা করে বলে, “এইতো ভাই মেলাতে। কেন, কি হয়েছে?”

“তোর ভাবী কোথায়?”

“আছে এইখানেই।”

কথাটা শুনে নির্বাণের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে৷ একপলক সে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে, “আচ্ছা! তাহলে সবাইকে নিয়ে বটতলার এদিকে আয়। আমি অপেক্ষা করছি তোদের জন্য।”

নাহিদ ভড়কে উঠে বলে, “তুই মেলাতে এসেছি? কেন, না মানে হঠাৎ? তুই তো সহজতর আসিস না মেলাতে।”

নির্বাণ অটল কন্ঠে বলে, “আসি না বলে কি আসতে পারবো না-কি?”

“তা-না..”

“চুপচাপ যেখানে আসতে বলেছি সেখানে আয়। দেরি করলে খবর আছে তোর।”

কথাটা বলে নির্বাণ কল কেটে দেয়। মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে তাকায় স্পর্শীর দিকে। স্পর্শীকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে দেখে নির্বাণ বলে উঠে, “এদিক তাও!”

স্পর্শী কথাটা শুনেও না শোনার ভাণ করে রইলো। লজ্জায় নাকি অভিমানে কে জানে? মুহূর্তে নির্বাণের দৃঢ় কন্ঠ কুহরিত হলো, “স্পর্শী! তাকাতে বলেছি না আমি? তাকাও।”

বাধ্য হয়েই স্পর্শী পাশ ফিরলো। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো নির্বাণের পানে। নির্বাণ এককদম এগিয়ে এসে স্পর্শীর হাতের কব্জি চেপে ধরলো, “পরবর্তীতে আর কখনোই ভিড়বার জায়গায় যাবে না, মনে থাকে যেন।”

স্পর্শী নিরুত্তর থেকে শুধু মাথা দোলালো। নির্বাণ এইবার স্পর্শীকে নিয়েই হাঁটা দিল বটতলার দিকে। যেতে যেতে স্পর্শী দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো রাস্তার ধারেই বসা চুড়িওয়ালার দিকে। বিশাল আকৃতির ঝুড়িতে হরেকরকমের রেশমি চুড়ি সাজিয়ে বসেছেন তিনি। স্পর্শী থমকে দাঁড়াতেই হাতে টান পড়লো। যার দরুন, নির্বাণও দাঁড়িয়ে পড়লো। সে পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? কোন সমস্যা? হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”

স্পর্শী মৃদুস্বরে বলল, “ওদিকে যাব একটু।”

কথাটা বলে হাতের তর্জনী উঠিয়ে চুড়িওয়ালার দিকে ইশারা করলো। নির্বাণ এক নজর সেদিকে তাকিয়ে স্পর্শীর হাত ছেড়ে দিল, “আচ্ছা যাও। তবে, দেড়ি যাতে না-হয়।”

স্পর্শী সম্মতি জানিয়ে চলে যায় সেদিকে। নির্বাণও যায় পিছু পিছু। স্পর্শী ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে হাঁটু ভেঙে বসলো নিচে, একমনে দেখতে থাকলো চুড়িগুলো। চুড়ির প্রতি সে বেশ দূর্বল, বিশেষ করে রেশমি এবং খাঁজকাটা চুড়ির প্রতি। যখন বা যেখানেই চুড়ি পাবে সে একমুঠ কিনে আনবেই আনবে সে৷ স্পর্শী নিজের জামার সাথে মানানসই একমুঠ চুড়ি নিল। কিন্তু টাকা দিতে নিলে বুঝতে পারলো স্পর্শী মোবাইল সহিতে টাকাও আনতে ভুলে গিয়েছে৷ মন ক্ষুণ্ণ হলো স্পর্শী, নিজেকে দু’গালে দুইটা চড় দিতে ইচ্ছে করলো খুব জোরে। নির্বাণ ঠিক বলে, আসলেই সে কেয়ারলেস। স্পর্শী একপলক তাকালো নির্বাণের পানে, নির্বাণ তখন মোবাইলে কিছু একটা করছে। স্পর্শী একবার ভাবলো নির্বাণের কাছে টাকা ধার চাইবে। কিন্তু পরমুহূর্তে বিষয়টা বিশ্রী ঠেকল বলে আর চাইলো না। যতই হোক এখনো তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক সে-রকম গড়ে উঠেনি। উপরন্তু, কথাটা বলতেও তার কেমন লজ্জা,আড়ষ্টতা কাজ করছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চুড়িগুলো ফিরিয়ে দেয় সে। উঠে যেতে নিলে লোকটি বলে উঠে,

“আফামনি, চুড়ি লইবেন না?”

স্পর্শী ক্ষীণ হেসে বলে, “না চাচা। অন্য একদিন এসে নিব নে।”

হঠাৎ পাশ থেকে নির্বাণ বলে উঠে, “নিবে চাচা! আপনার আপামনি যে চুড়ি পছন্দ করেছে ওইটার চার মুঠ দেন।”

লোকটা একগাল হেসে বলে, “আইচচা ভাইজান।”

স্পর্শী গোলগাল চোখে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি নিব না চুড়ি। আপনি কেন কিনছেন?”

নির্বাণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “তোমাকে কথা বলতে বলিনি আমি।”

স্পর্শী কিছু বলতে যাবে তার আগেই নির্বাণ লোকটিকে বলে, “চাচা, চুড়িগুলো এইভাবেই দেন। সে পড়ে যাবে।”

“আইচচা দাঁড়ান, আমি চুড়ি ভাগ কইরা দিতাসি।”

কথাটি বলে লোকটি চারমুঠ চুড়ি ভাগ করে নির্বাণকে দেয়। নির্বাণ সেটা নিয়ে স্পর্শীর এক বাহু টেনে ধরে, খুব সপ্তপর্ণে পড়িয়ে দেয় চুড়িগুলো। মুহূর্তে দু’হাত আবৃত হয় স্বচ্ছ রঙিন প্রণয়ে। অধরের শেষ প্রান্তে খিললো হৃষ্টচিত্তের হাসি।

________________

বটতলার সামনে আসতেই দেখা মিললো নাহিদদের। নির্বাণের সাথে স্পর্শীকে দেখে নাহিদ লাফিয়ে উঠলো। উৎকন্ঠা হয়ে বলল, “ভাবী আপনি ভাইয়ার সাথে? আর আপনাকে কোথায় কোথায় খুঁজছি জানেন? একটুর জন্য জানটা কবজ হয়নি আমার। বলে গেলেই হতো একবার, আমরা কি কাবাব ম্যায় ঠ্যাং হতাম বলেন?”

নির্বাণ নাহিদের সামনে এসে ওর কান মলা দিয়ে ধরে বলে, “বেশি কথা না বললে তোর হয় না? আর ওকে এনেছিস যেহেতু দেখে রাখতে পারলি না? কারো দায়িত্ব নিতে না পারলে সাথে নিয়ে আসিস কেন তুই? ও ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল।”

নাহিদ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বলে, “ভাই ছাড়! ব্যাথা পাচ্ছি আমি।”

নির্বাণ নাহিদের কান ছেড়ে দিতেই নাহিদ দ্রুত পিছনে সড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পায়ের নিচে কাঁদা পড়ায় পা পিছলে যায় তার, যার দরুন নাহিদ সোজা গিয়ে পড়ে গন্ধযুক্ত কাঁদার মাঝে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে সে। সকলে সে দৃশ্য দেখে উচ্চশব্দ করে হেসে উঠে। নাহিদ মুখ-চোখ ঘুচে বলে, “এই না হেসে আমাকে উঠা। উফফ! আমার কোমর। ”

কথাটা শুনে দ্রুত মৃদুল ও আরেকজন এগিয়ে আসেম ধরে উঠায় নাহিদকে। নাহিদ উঠে দাঁড়াতেই নির্বাণকে উদ্দেশ্য করে বলে, “সব তোর দোষ! তোর জন্য আমি কাঁদাতে পড়লাম।”

নির্বাণ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, “তোর কর্মের ফল এইটা।”

নাহিদ দুই কদম এগিয়ে এসে বলে, “তাই না? তাহলে তুইও পাবি তোর কর্মের ফল। দাঁড়া!”

নাহিদকে এগিয়ে আসতে দেখে নির্বাণ কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “সামনে আসবি না তুই, তোর শরীর কাঁদা দিয়ে ভরা।”

নাহিদ দাঁত কেলিয়ে হাসে, “জানি ব্রো! কিন্তু আমার না এখন তোকে একটা টাইট হাগ দিতে ইচ্ছে করছে। আফটার অল তোকেও তো আমার ফল দিতে হবে তাই না?”

কথাটা বলে নাহিদ এগিয়ে আসতেই নির্বাণ দ্রুত পায়ে পিছে সরে যায়। উচ্চস্বরে বলে, “আমার সামনে আসলে তোর খবর আছে নাহিদ।”

“আজকে যাই বলো আমি কারো কথা শুনবো না।”

এই বলে নাহিদ এগিয়ে আসতে থাকলে নির্বাণ অন্য দিকে চলে যেতে থাকে। নাহিদও নাছোড়বান্দা ন্যায় নির্বার্ণের পিছু পিছু ছুটা শুরু করে। এইদিকে, দুই ভাইয়ের কীর্তিকলাপ দেখে স্পর্শী এবং বাকিরা পেট জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকে। ফুল অন সার্কাস!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here