ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ১০

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -১০

আস্তে আস্তে দিন পার হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে কস্ট গুলো কেমন জানি হালকা হয়ে যাচ্ছে। টাইম উইল চ্যাঞ্জ এভরিথিং মনে হয় এর জন্যেই বলে। শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।নিজেকে নিজের কাছে অনেক ছোট মনে হয় মাঝে মাঝে। নিজের খরচ চালানোর জন্যে আবার টিউশনি শুরু কর‍তে হয়েছে। বিয়ের আগে তো ভাইয়া পাঠাতো। হয়তো ভেবেছিলো সাব্বির অথবা শশুরবাড়ি থেকে পাঠাবে।
আমি কি এতোই অবহেলার পাত্রি? যার জন্যে সাব্বির লাস্ট ১ মাসে একটা ফোনও দেয়নি? খরচ দিবে তো দূরে থাক। ভাগ্যিস বিয়েতে সালামি হিসেবে কিছু টাকা পেয়েছিলাম। না হলে কার কাছে চাইতাম।

কোরবানি ঈদের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ পরেছে ১২ দিন। হলও বন্ধ হয়ে যাবে। বাসায় যেতে হবে।

কাউকে কোনো কিছু না বলে আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে এলাম। বাড়িতে বড় ভাবি আর ভাবির ৩টা ছেলে মেয়ে ছাড়া কেউ থাকে না।বড় ভাইয়া জবের জন্যে কুমিল্লা থাকে। আম্মু আব্বু থাকতে তারা থাকতো। আম্মু মারা যাওয়ার পর আব্বু মাত্র ২ মাস বেচে ছিলো।
এতো বড় বাড়ি অথচ থাকার মতো কেউ নেই। অথচ এই বাড়িতে একদিন আমরা ৪ বোন আর ৩ ভাইয়ের কোলাহলে গমগম করতো। আর আজ!!!
বিশাল বাহিরের উঠান পেরিয়ে বাড়ির ভিতরের উঠানে ঢুকতেই বড় ভাইয়ার ৪ বছর বয়সি মেয়েটা ছোট ফুপি বলে দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো।
– সোহা আম্মু কেমন আছো তুমি?
-ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? তুমি নাকি আমাদের
বাড়িতে আর আসবে না?
-কে বললো? বলে ওকে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলাম।
-আম্মু বলছে।
“ফুপি!!!” তাকিয়ে দেখি নুহা, বড় ভাইয়ার ৭ বছর বয়সি বড় মেয়েটা, আর কোলে পিচ্চি ছেলেটা আয়ান।
-জি আম্মু। আমার আব্বুটা কেমন আছে, বলেই ৪ মাস বয়সি গোলটু টাকে কোলে নিলাম।

“ওমা!! মেহের দেখি!!” দেখি বড় ভাবি হাস্যজ্জ্বল হয়ে এগিয়ে আসছে।
-একাই আসছো? সাব্বির আসে নাই?
-না ভাবি একাই আসছি।
-ঈদের আগে এসে নিয়ে যাবে বুঝি?
একমুহূর্তের জন্যে থমকে গেলাম। আমার মনেই ছিলো না যে এখন থেকে কোনো ঈদ আর এইবাড়িতে করা হবে না। আমি তো এতো কিছু
– ভাবি এখন থেকে যে শশুরবাড়িতে ঈদ করতে হবে আমি ভুলে গেছিলাম।
ভাবি আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। আমার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো, আহারে,আচ্ছা থাক, চলেই যেহেতু আসছো এইখানেই এবার ঈদ কর। এমনিতেই এইবার বাড়ি পুরো খালি। আগের বার তো আম্মা, আব্বা তুমি ছিলা। এইবার তো আম্মা নাই, আব্বাও নাই। তোমারও হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো।
-তোমরাই তো জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলা।
-মেয়ে মানুষের জীবনটাই এমন মেহের। আমার বিয়েও তো আম্মা যেদিন মারা গেলো তার পরের দিনই হলো। ভাইয়ারা একটাদিনও ওয়েট করে নাই।
আমিও মন খারাপ করে বললাম, হুম ভাবি ঠিকই বলছো।
-তারপর কি খাবা বলো। কি রান্না করবো।
ভাবির কথা শুনে চোখে পানি চলে আসছে। আগে আম্মু থাকতে এই প্রশ্ন করতো।
-এইরকম ইমোশনাল ভাবে তাকিয়ে আছো কেন? খুশি হয়ে লাভ নাই। বাচ্চা গুলারে তুমি রাখবা।
-নো প্রব্লেম ভাবি। তোমার যা মনে চাই তাই রান্না কর। এইগুলাতো আমার হাতের নিচে ঘুইরা বেরাবে।
আচ্ছা বলে ভাবি হাসি মুখে চলে গেলো।
কে কখন চ্যাঞ্জ হয় কিছুই বলা যায় না। আম্মুর সাথে বড় ভাবির সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিলো না। সেই ভাবি আজকে আমাকে কতটা কেয়ার করতেছে।

ফ্রেশ হয়ে তিন পিচ্চিকে নিয়ে উঠানের পাশে বড় আমগাছের নিচে গিয়ে বসলাম। ফোনের রিংটোনের শব্দে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে। নুহার দিকে তাকাতেই ও হাসি দিয়ে বললো যাইতেছি কিন্তু একটা চকোলেট দিবা। মাথা ঝাকাতেই ফোকলা দাতে হাসি দিয়ে নুহা ফোন আনতে গেলো।

নুহা ফোন নিয়ে আসতে আসতে ফোন টা ২বার বেজে কেটে গেলো। সাব্বির কল দিয়েছে!! ও কল দিলেই কেনো জানি ভয় লাগে। কল ব্যাক করার আগেই আবার কল দিলো। ফোন রিসিভ করেই উল্টা পাল্টা কথা শোনার জন্যে দাত মুখ খিচে রেডি হলাম।
-ভালো আছিস বাবু?
এতো আবেগি গলায় আমার নিকনেম ধরে অনেক দিন পর কেউ ডাকলো। সাব্বির আজকে যতই বাজে কথা বলুক আমি মন খারাপ করবো না। এটার জন্যে সব মাফ। সবার ছোট ছিলাম বলে সবাই আদর করে বাবু ডাকতো। বড় হবার পরে আম্মু আব্বু আর মেজো ভাইয়া ছাড়া কেউ ডাকেনি। এখন মেজো ভাইয়াও আর ডাকে না।
-কিরে কথা বলবি না?
-হুম বলো। ভালো আছি।
-কি করিস?
-কিছু না। সোহা নুহা আর আয়ানকে নিয়ে বসে আছি।
-তুই তোদের গ্রামের বাড়িতে? খানিকটা বিস্ময় আর রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো ও
-হুম। তোমাদের বাড়িতে যেতে হবে ভুলে গিয়েছিলাম।
-হুম তুই তো অনেক কিছুই ভুলে যাস। ভুল করে ফয়সালের সাথে ল্যাবেও একা একা কাজ করিস।
ওর সাথে এই মুহুর্তে তর্ক করা মানে একটা গরুর সাথে তর্ক করা।
-হুম গিয়েছিলাম।
-ঈদের ৩দিন পরে উকিলের কাছে যাবো। ঢাকায় চলে আসিস।
গলায় কান্না আটকে আসছে। খুব কস্টে বললাম কেনো?
-তোকে ডিভোর্স দিবো তো তাই।
-আচ্ছা। কাবিনের টাকা টা দিয়ে দিও।
সাব্বির ফোনটা কেটে দিল। লাস্ট কথাটা শুনতে পেয়েছে কিনা যে জানে।

বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আম্মু আর আব্বুর কবরের মাঝখানে বসে অনেক গল্প করলাম তাদের সাথে। এতোদিন কার ভিতরে চেপে রাখা কথা শেয়ার করলাম। ইচ্ছে করছে একটা বালিশ নিয়ে তাদের মাঝখানে শুয়ে পড়ি। ঠিক ছোটবেলায় যেমন করে থাকতাম। খুব কি দরকার ছিলো এইভাবে আমাকে একা করে দিয়ে চলে যাওয়ার। পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে দেখি মেজো ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।
-মেজো ফুপি অনেক অসুস্থ। তোকে ঢাকায় যেতে হবে এখনি। ওদের বাসায় তো কেউ নেই। সাব্বির আর শব্দ ছাড়া।
-আচ্ছা
ভাইয়া তো জানে না। ঐ বাসায় আমার আর বেশিদিন যেতে হবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here