টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ৩

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িমের বাড়ি ফিরার মাঝে ঘটল আরেক বিপত্তি। প্রডিউসার ও কয়েকজন জানায় তারা নায়িমকে নিয়ে নাইট ক্লাবে যেতে চায়। নায়িম খোশামোদি করলে প্রডিউসার সাহেব তার ভারী শরীর দুলিয়ে হেসে বলে,
“এমন শুরু করসো বাড়িতে বউ অপেক্ষা করছে! ব্যাচেলর ছেলে তুমি এত কীসের প্যারা?”

সূক্ষ্ম ঘাম বেয়ে পড়ে নায়িমের ললাট থেকে। দামী এসির মাঝেও ঘামতে তৎপর সে। তার মনে আজ বহুকাল পর কাজ করছে চেনা ভয়।

“বাসন্তী যেমন অবাধ্য হতে শুরু করেছে, কবে যেন এই বিয়ের কথা পুরা বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয়। তাহলে তো আমার পুরো মোস্ট ইনোসেন্ট এন্ড ডিসেন্ট ব্যাচেলর এর ইমেজই নষ্ট হয়ে যাবে। না, না, যেভাবেই হোক মেয়েটাকে আবার হাতের মুঠোয় আনতে হবে।”

“কী হলো নায়িম? এত কী ভাবছো? আরে বেটা চলো, এখনই তো সময় ইঞ্জয় করার জীবনটাকে।”

ঘোর ভাঙে তার। প্রডিউসারের কথায় বিরক্ত হলেও, তা লুকিয়ে মিথে সায় জানায়। অতঃপর সবাই প্রডিউসারের বিশাল গাড়িতে চড়ে বসে। সবাই গল্পগুজুব ব্যস্ত থাকলেও নায়িম গভীর ভাবনায় ডুবে।

“তারপরও যদি বাসন্তী বলে দিতে চায় তাহলে আর কী! খুব একটা সমস্যা হবে না। কারণ শুধু ধর্মীয় দিক থেকে আমরা বিবাহিত। তবে এ কথা ও কখনো প্রমাণ করতে পারবে না।
ওর সাথে আমার বিয়ের কোনো লিগেল পেপার নাই, না ওর ফোনে আছে কোনো বিয়ের ছবি। আংশিক তো মানহানি হবে বটে। তবে ওর সম্মান যাবে এর চেয়ে হাজার গুণ বেশি।
আর মেয়ে যাবে কই আমাকে ছেড়ে? রাস্তার কুকুর যখন মানুষ পোষ বানাতে যায় তখন কিন্তু তার দাঁতটা আগে ভেঙেই নেয়। আমিও তাই করেছি, কাঙালকে নিঃস্ব করে পোষ মানিয়েছি।”

খুব দ্রুতোই দ্বিতীয় ফন্দী এঁটে নেয় সে। তার মুখেও ফুটে উঠে জয়ের হাসি। এবার সেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে আড্ডাবাজী করছে।

___

বাসন্তীর হঠাৎ করেই মনে হলো তার এখন হাতে হাত রেখে বসা উচিত না। পালিয়ে যাওয়া উচিত বহু দূরে, নিরাপদে। হাতে তার একটা কানাকড়িও নেই। রাস্তাঘাট কিছুই সে চেনে না। কীভাবে যাবে? কোথায় যাবে? তার একমাত্র আশ্রয় নায়িমই।

“মৈত্রী ভাবি? সে হয়তো ফেরাবে না।” কথাটা উপলব্ধি করেই মৈত্রীকে কল করে বাসন্তী।

“হ্যালো, বাসন্তী বলো। ঠিক আছো তো তুমি?”

খাণিক আমতা আমতা করে বাসন্তী বলে,
“জী। আপনার অজানা নয় আমার অবস্থা। আমি আর এখানে থাকতে চাই না। আপনি কি কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন আমার দূরে কোথাও থাকা? অথবা, যদি কোনো কাজ খুঁজে দিতেন বা কিছু টাকা…?”

কিছু মানুষ থাকে যারা কথা দিয়েই অপরকে সহায়তা করবে, অনুভূতিতে, সহানুভূতিতে। মুখে অপরের জন্য অনেক কিছু ফেলবে। কিন্তু এদের কথায় বিশ্বাস রাখতে নেই, কথায় ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে সহায়তা করারই তাদের ঠাঁই নেই।

তেমনই একজন মানুষ মৈত্রী। বেশ হচকচিয়েই যায় বাসন্তীর কথা। এই যুবতীকে একটু বেশিই ফুলিয়ে ফেলেছিল ভেবে নিজের উপরই রাগ হলো।

“আমি সবে মাত্র একটা চাকরি পেয়েছি। তোমার ভাইয়াও খুব বেশি কামায় না, দুটো বাচ্চা… আমরাই আছি কোনোরকম। তোমাকে কীভাবে…?”

এটুকু কথাতেই সব বুঝে গেল বাসন্তী। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল তার ম্লান মুখশ্রীতে।

“থাক, সমস্যা নেই। আমি বুঝেছি ভাবি।”
কলটা কাট করে দিল সে। তাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মৈত্রী।

যুবতী আনমনেই ভাবল,

“বহু ধরনের মানুষের বাস পৃথিবীতে না কি একই মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রূপ এঁকে চলে? আমি তো জানি এরা এমনই হয়। সবাই মুখ দিয়ে করে একদম ধুয়ে ফেলে, কিন্তু আসল কাজে কাউকে পাওয়া যায় না। তিনি তো দুপুরে খুব সুন্দর ভাবে বলল সন্তানের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে। কী করে দিব?

জীবনটা কি কোনো সিনেমা না কি? আজ এখানে আছি, মার খেয়েও বেঁচে আছি। বাহিরে বের হলে হয় জানোয়ারগুলো খুবলে খেয়ে মারবে নাহয় ক্ষুধা-প্রয়োজনের তাড়নায় এমনেই শেষ হয়ে যাব। যেই ভুলটা আমার আম্মা করেছিল, তা আমি করব না। পরের কথা শুনে সর্বস্ব হারাব না।”

মনে পড়ে যায় বাবা নামক মানুষটার ধূসর ও ঘোলাটেময় স্মৃতি। মানুষটার যতটুকু স্মৃতি তার মনে আছে। ততটুকুর পুরোটাই মমতাময়, হাসি-খুশি জীবনের স্মৃতি। মায়ের সাথে এতকিছু হলেও তাকে কখনো বকেছে কি না সন্দেহ।

সে যখন খুব বেশি হলো বছর দশের তখনই বাবা আর মায়ের তালাক হয়। সবটাই হয়েছিল মায়ের একান্ত উদ্যোগে।
বাসন্তীর বাবা ছিলেন নিম্নবিত্ত একজন জেলে আর মা ছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। যার বাবাত টাউনে দুটো দোকান, বেশ ভালোই অবস্থা। তাহলে কেন বিয়ে করল নিম্নবিত্ত জেলেকে? প্রেমের বিয়ে ছিল না কি?

বাসন্তীর মা বদরুন্নেসা কয়লা রঙা এক নারী, স্বভাবও ছিল তার উড়নচণ্ডী, পাড়ায় পাড়ায় তার দুর্নাম আচার-ব্যবহারের জন্য। তার জন্য ছেলে পাওয়াই যেখানে অসাধ্য, সেখানে গরীব-ধনী, টাকা-পয়সা দেখার সাহস ছিল না। অতঃপর গরীব ঘরের সুদর্শন পুরুষ মাসুদের সাথে বিয়ে হয়।

বদরুন্নেসা মানিয়ে নিতে পারছিলেন না ভরা সংসার থেকে হুট করেই অভাবে এসে। মাসুদও প্রথম প্রথম এমন কালো রঙা নারীকে মানতে পারছিল না স্ত্রী রূপে। কিন্তু এক ছাদের নিচে থাকার মায়া, কবুলের মায়ার শক্তি যে রূপের মোহের চেয়ে বহু বেশি। তবে হয়তো বেশি হয়নি অভাবে থাকার অতৃপ্ততার চেয়ে।

বদরুন্নেসা সারাক্ষণ খ্যাচখ্যাচ করতেন। মাসুদ বাড়ি আসলে তো রীতিমতো আছড়া-আছড়ি শুরু করতেন জিনিস-পত্র। মুখ তো চালুই আছে। মাসুদের খাটনিতে এমনিতেই মেজাজ চটে থাকত, আরও চটে যেত স্ত্রীর কাণ্ডে। ধুরামধুরাম মার লাগিয়ে দিতেন স্ত্রীর গায়ে। অতঃপর মার খেয়ে শান্ত হতেন বদরুন্নেসা, আর দিয়ে শান্ত হতেন তিনি নিজেও।

তবুও জোয়ার-ভাটা পেড়িয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ঐ যে তৃতীয় পক্ষের অভিব্যক্তি, তা একদম ডুবিয়ে দিল তাদের। বাসন্তীর মামী-খালারা আসলেই বলতেন,

“ছাইড়া দে ঐ বেটার সংসার। তোরে আমরাই রাখতে পারুম। আর কত মাইর খাবি?”

নানা-মামাদেরও একই সুর। নানী অবশ্য ভিন্ন সুরে ছিলেন। আস্তে আস্তে তিক্ততায় জড়িয়ে ধরে বদরুন্নেসাকে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তালাক নেওয়ার। মাসুদ রাজি না হলে রোজ রোজ যথাসম্ভব চেষ্টা করে তাকে উত্যক্ত করার। তারপর উত্যক্ত হয়ে মারলে শালিস বসান। তালাক হয়ে যায় তাদের।

বদরুন্নেসা মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন বাপের বাড়ি। প্রথমদিকে ভালো ব্যবহার করলেও বছর ঘুরতেই তার মূল্য বাড়িতে পাহাড়া দিতে থাকা কুকুরের চেয়ে নিচু হয়ে যায়। যে যখন তখন যা তা শুনিয়ে যায়, সারা বাড়ির কাজ তার করত হয়। ছোট্ট বাসন্তীও বাদ যায়নি। ভুল হলেই মার পড়ত তার ছোট্ট দেহে। নানাও ভিষণ বিরক্ত তাদের উপর। ভেবেছিল কোনো বড়লোক, অর্ধবয়স্ক লোকের কাছে আবার বিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি।

অপরদিকে বছর ঘুরতেই টুকটুকে বউ নিয়ে আসে মাসুদ। সে ভুলে যেতে থাকে স্ত্রীর স্মৃতি। নতুন সন্তানের মায়ায় ধোয়াশা হয়ে যায় নিজের রক্তের সন্তানের স্মৃতিও।

বদরুন্নেসা প্রায়শয়ই কাঁদতেন নিজের কর্মের জন্য। কারণ ঐখানে থেকে মার খেলেও সম্মান ছিল, তার সন্তান ভালো ছিল। দোষ তো তারও কম ছিল না… কিন্তু তালাকের পর এখানে এসে সে শুধু নিজেই নয় তার মেয়েও হয়েছে বাবাহারা, সম্মানহীন আশ্রিতা ও মূল্যহীন চাকরানি।

___

ক্লাবে ঢুকে বসতেই, একঝাঁক সুন্দরী উঠতি বয়সী নারী এসে আঁকড়ে ধরে তাকে। সে বিরক্ত হয়, তবুও মুখশ্রীতে তা বিন্দুমাত্র আনে না। বাংলাদেশি মানুষ প্রচণ্ড আবেগী, একটু থেকে একটু হলেই বড় বড় শব্দে কাল নিউস ছেপে যাবে “ভক্তকে অপমান করা অহংকারী গায়ক”।

বেশিরভাগ তরুণী চলে গেলেও একজন থেকেই যায়। এই তরুণীলে সে চেনে, বিখ্যাত বিজনেস কোম্পানির মালিক কে.কে এর রক্ষিতা শবনম। একে কিছু বলা মানে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের বড় শত্রু পয়দা করা। শবনম আপন উদ্যোগে গল্প করতে শুরু করে নায়িমের সাথে। নায়িম নিজের আসল মনোবাসনা চেপে বেশ হেসে-খেলেই অংশগ্রহণ করে আলাপে। প্রডিউসার সাহেব তা দেখে চোখ মারেন।

বেশ খাণেক ক্ষণ ড্রিংক করার পর “এক্সকিউজ মি” বলে ওয়াশরুমের দিকে যায় যুবক। এদিকটা বেশ নীরব। ওয়াশরুম থেকে বের হলে মেয়েটা অকস্মাৎ তাকে ঝাপটে ধরে। গা ঘিনঘিন করে উঠে নায়িমের, তবুও চুপ থাকে সে।

“নায়িম বেব, চলো না একটু ইঞ্জয় করি আজ রাতে। কেউ জানবে না।”

“কিন্তু কে. কে.?”

“আরে ঐ বলদটার কথা ছাড়ো। আমাকে নিয়ে ভাব।”
কথাটা শেষ করতেই ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় তাকে নায়িম।

“বাসায় গিয়েই গোসল করতে হবে। না জানি দিনে কতজন পুরুষকে ছোঁয় এই মেয়ে। ইয়াক! বমি পাচ্ছে। কারো ইউজ করা বস্তুও তার পছন্দ নয়, সেখানে গোটা এক…” ভাবতেই সারা গা রি রি করছে।

“কাজটা তুমি ঠিক করো নাই নায়িম। আমি কে.কে কে বলে…”

“ডিয়ার বি*, আগে নিজের ভিডিও সামলাও।”
বলেই ক্রুর হাসি দিয়ে স্থান ত্যাগ করে নায়িম।

সে আগে থেকেই জানত এমনটা হবে। তাই তো ভিডিও ক্যামেরা অন করে বুক পকেটে ফোন রেখে ওয়াশরুমের দিকে এসেছিল। এই মেয়েটার ধ্বংসের কাউন্টডাউন শুরু এই মুহূর্ত থেকেই। শুধু কে.কে আর মিডিয়ার লোকদের মাঝে ভিডিও বিলিয়ে দিতে দেরি।

___

চৈতালির পরনে নেটের ফিনফিনে এক গেঁড়ুয়া রঙা শাড়ি। এই শাড়ি তার দেহ আড়াল করতে একদমই ব্যর্থ বলা চলে। যুবতী সুবিশাল আয়নায় নিজেকে উপর থেকে নিচ পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত।

সে জানে তার চেহারা আহামরি নাহলেও তার মাঝে যে লাস্যময়ী ও মায়াবি ভাব আছে তা যে কাউকে বশ করতে পারে। এই বিষয়টাকে কাজে লাগিয়েই পৃথিবীর বুকে আবহমান সকল সুখ নিংড়ে নিতে চায় সে।

“উহু, আমি কোনো অংশে কম নেই আমি। খেটে-খুটে মরার জন্য আমি নই। আমি এমন কেউ হতে চাই যার চর্চা মুখে মুখে থাকবে, যে হবে আলোছায়ার খেলার রাণী। এখন শুধু নায়িমকে পটাতে দেরি।”

আপন মনেই কথাগুলো বিড়বিড় করে হাসনাহেনার খুশবু সমৃদ্ধ পারফিউম গায়ে ছিটকে দিতে করতে শুরু করে চৈতালি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here