টক ঝাল মিষ্টি পর্ব -০৩

#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা

তিন দিন পরের শুক্রবারেই বিয়ের তারিখ ধার্য্য করা হলো। উদ্ভুত পরিস্থিতির সাথে লাবণ্য মানসিকভাবে নিজেকে এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি। হুট করেই যেন সব ঘটে যাচ্ছে। মা এমন বলেই থাকেন ভেবে প্রথমে তেমন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু যখন থেকে রাজি হয়েছে তখন থেকে মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। অনিকেতের কথা মনে হলে সেই অস্বস্তি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সবসময় ভেবেছে ক্ষুরধার ব্যক্তিত্বের কেয়ারিং একটা ছেলে ওর জীবনসঙ্গী হবে, যে ওর ছোট-বড় প্রত্যেকটা অনুভূতির মূল্য দেবে। কিন্তু অনিকেত যে এসবের ধার ধারে না, এটা এখনই স্পষ্ট। যাকে কিছুক্ষণের জন্য সহ্য করা যায় না, তাকে সারাজীবন সহ্য করবে কী করে ভাবতেই হাহাকার করে উঠে ভেতরে।

জানালার গ্রিলে মাথা এলিয়ে শূন্যে তাকিয়ে ভবিষ্যতের ভাবনায় মগ্ন ছিল লাবণ্য, রিংটোনে সচকিত হলো। অনিকেত ফোন করেছে দেখে ভারি অবাক হলো।

“লাবণ্য, শুনুন। আমার কিছু কথা ছিল।”
“বলুন।”
“দেখুন, যেভাবেই হোক বিয়েটা যেহেতু ঠিক হয়েই গেছে, পরবর্তী সময়টা তো একসাথেই কাটাতে হবে। তাই বলছিলাম যে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে..” এটুকু বলে অনিকেত একটু থেমে বড় করে একবার শ্বাস টানল।

লাবণ্য নিজেও এমন কিছু ভাবছিল, এখন মনে হচ্ছে যাক এই ছেলের তবে সুমতি হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী কথাটা শুনে মুহূর্তেই জ্বলে উঠা আশাটুকু টুপ করে নিভে গেল। সাথে এটাও বুঝে গেল ওর হবু বর মহাশয় শোধরাবার মানুষ নয়।

“আগেই বলি কথাটাকে অন্যভাবে নেবেন না প্লিজ। সত্যি কথা না বললে ভালো লাগে না, ঠিক স্বস্তি পাই না।”

“এত ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে না বলে সরাসরি বলুন তো?” লাবণ্য তাড়া দেয়।

“আপনি যদি আপনার বদমেজাজটাকে একটু নিয়ন্ত্রণ করতেন তাহলে ভালো হতো।”

অনিকেতের কথায় লাবণ্যর মাথা গরম হলেও আপাতত সেটা সামলে নিয়ে বলল, “আপনার নিজের কোনোকিছু চেঞ্জ করতে হবে না?”

“আমি আবার কী চেঞ্জ করব? আপনি মেজাজ কমালে ঘরে এমনিতেই শান্তি থাকবে।”

“আপনি কি সত্যিই এমন আজাইরা লোক নাকি আমাকে রাগানোর জন্য এসব উদ্ভট কথা বলছেন?”

“আমি একটা শান্তিচুক্তি করতে চাইছি, শান্তিপ্রিয় মানুষ আমি। কিন্তু আপনি আমাকে রীতিমতো অপমান করছেন।”

“আপনি কী বলছেন সেটা আপনি নিজেও জানেন না। শফিক আঙ্কেল আপনাকে মাকাল ফল বলেছেন, এটা একদম সত্যি। আপনার মাথায় ঘিলুর বদলে গোবর ঠাসা আছে। আপনি অতি নিম্নস্তরের ফালতু লোক।”

হড়বড়িয়ে কথাগুলো বলে কল কেটে ফোন বিছানায় আছড়ে ফেলল। অনিকেতের ভাগ্য ভালো যে সে এখন লাবণ্যর সামনে নেই৷ সামনে থাকলে আজ ওর ঘাড়ে মাথা থাকত না!

***
“দেখলি কী বলল? তারপরও ওর সাফাই গাইবি তুই?”

মুহিতের উদ্দেশে কথা ছুঁড়ে দিল অনিকেত। সে-ই জোর করে বন্ধুকে রাজি করিয়েছে হবু স্ত্রীর সাথে কথা বলতে, যেন কিছুটা হলেও তিক্ততা কমে যায়। কিন্তু এখন হিতে বিপরীত হয়ে গেল।

“তোকে কী বলতে বললাম আর তুই কী বললি?”

“শান্তির কথাই তো বললাম।”

“তার আগে আজাইরা কথাটা কেন বললি? এটা বলতে পারলি না যে দুজনেই মানিয়ে চলার চেষ্টা করব? তা না করে ওরে ব্লেইম দিলি। ও যা বলেছে ঠিকই বলেছে।” গলায় বিরক্তি ঝরছে মুহিতের।

“ওই মেয়েরে তুই চিনিস না, তাই এভাবে বলছিস। সে এমনিতেই নিজেকে মহারানী ভিক্টোরিয়া মনে করে। এখন আমি আমার দোষের কথা স্বীকার করলে, যদিও আমার দোষ সেভাবে নেই, তাহলে সে আমাকে কী করবে তুই ভাবতেও পারবি না! নির্ঘাত শূলে চড়াবে।” অনিকেতের গলায় অনিশ্চয়তার সুর।

“তাহলে তুই ফোন করলি কেন? ঝগড়া উস্কে দেওয়ার জন্য?”

“সেটা কেন করব? তুই দেখলিই তো আমার উপরে চড়াও হলো। আমি উত্তরই দিতে পারলাম না। তবে মনে থাকবে এটা, পরে অবশ্যই মোক্ষম একটা সুযোগ পাওয়া যাবে, তখন কাজে লাগবে।”

মুহিত কপাল চাপড়ে বলল, “তোর কপালে দুর্গতি আছে। নিজের দোষটা একটু দেখ। নিজের জন্য যারা গর্ত খুঁড়ে, তাদের গর্তে পড়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারে না।”

অনিকেত বিষদৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকাল, কোথায় ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলবে তা না, শত্রুপক্ষের দলে নাম লিখিয়েছে।

“আমার মাথায় গোবর থাকলে তোমার মাথায় তারচাইতে খারাপ কিছু আছে।”
মনে মনে লাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল অনিকেত!

***
বিয়ের আগেরদিন রাতে লাবণ্যর বাবা জামান আর মা শায়লায় মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। রীতিমতো মুখ দেখাদেখি বন্ধ এমন অবস্থা। কোনো শুভকাজ হবে আর তারা শান্তি শান্তি সেটা করে ফেলবে এমন কখনো হয়নি। ঝগড়ার সূত্রপাত, মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে শায়লা নিজের জন্য দুটো শাড়ি কিনেছেন, সেগুলো হাতে নিয়ে এসে জামানকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আচ্ছা দেখো তো, বিয়ের দিন কোনটা পরব?”

জামান ক্যালকুলেটর নিয়ে মেয়ের বিয়ের খরচের হিসাব কষছিলেন। তিনি চোখ না তুলেই বললেন, “আমি যেটা বলব সেটা তো পরবে না। শুধু শুধু নিয়ে এসেছো কেন?”

“তোমার পছন্দ সবসময় খারাপ হয়, তাই যেটা বলবে সেটা বাদ দিয়ে অন্যটা যে ভালো হবে এটুকু জানি। বাদ দেয়ার জন্য হলেও মতামত দরকার।”

“যেটাই পরো, কোনোটাতেই ভালো লাগবে না। কারণ একসময় তুমিও আমার পছন্দ করা ছিলে।”

এই কথাটাই যথেষ্ট ছিল শায়লাকে তাতিয়ে দিতে। রুক্ষ গলায় শায়লা বললেন,
“রাত পোহালেই মেয়ের বিয়ে, এখনো তোমার আক্কেল হয়নি, আর কোনোদিন হবেও না৷ আমার হাড় জ্বালাতন করার এখনো বাকি আছে তোমার।”

“এত রাগার মতো কিছু বলিনি তো। আচ্ছা ওই সবুজ শাড়িটা পরতে পারো। জামদানীটা মনে হয় না তোমাকে তেমন মানাবে, বয়স বাড়ছে, মুটিয়ে যাচ্ছো।”

“তুমি আর কোনোদিন কথা বলবে না আমার সাথে। কেন যে তোমার কাছে এসেছিলাম।”

এরপর থেকেই দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। লাবণ্যর চোখের সামনেই পুরো ব্যাপারটা ঘটল। এত স্বাভাবিক ঘটনা এটা, তবুও এই উৎসবের মধ্যে এমন হওয়ায় বেশ খারাপই লাগল।

বিয়েরদিন দেখা গেল শায়লা জামদানীটাই পরেছেন, জামান দূর থেকে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি জানতেন তার পছন্দের কথাটা বললে সেটা গৃহীত হবে না, তাই বরাবরের মতো মিথ্যেমিথ্যি অন্যটার কথা বলেছেন। এত বছর পরেও যে তিনি এত মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন, এমন মুগ্ধ হবার মতো চমৎকার উপলক্ষ তৈরি করার জন্য এমন দুই একটা ছোটখাটো নির্দোষ মিথ্যে বলা বোধহয় খারাপ না!

“আচ্ছা, মেয়েটা সুখী হবে তো? ওর তো মত ছিল না।” শায়লা এগিয়ে এসে জামানকে কথাটা বললেন। কথা না বলার অঙ্গীকার কত সহস্রবার করেছেন আবার ভেঙেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

“তুমি আমি কি খুব বেশি খারাপ আছি? ওরাও ভালো থাকবে! খুব ভালো থাকবে, তুমি দেখো।”

শায়লা অস্ফুটস্বরে বললেন, “আল্লাহ, তাই যেন হয়।”

বৈপরীত্য ভুলে বাবা-মা সম্মিলিতভাবে মেয়ের জন্য শুভকামনা ঢেলে দিলেন।

***
অত্যন্ত ধুমধাম করে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বর-কণে ছাড়া সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে এই বিয়েটা হতে যাচ্ছে। তাই কিছুদিন আগে থেকেই অতিথি সমাগম শুরু হয়েছিল।

অনিকেত আগে থেকেই বিয়ের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করলেও লাবণ্য সেই সুযোগটা পায়নি। সময় এমন দুজন মানুষকে একসাথে বেঁধে দিল যারা কখনো নিজেদের চায়ইনি। হাত ধরলেও তাই সেভাবে প্রাণ থাকল না, মন থেকে যে দুজন লক্ষ যোজন দূরে! মন একে অপরকে খুঁজে নিল না, নানা অলিগলি ঘুরে যার যার স্থানে ফিরে গেল। এভাবে দুটো ছন্নছাড়া মন আঁতিপাঁতি ঘুরতে ঘুরতে হয়তো মুখোমুখি হবে কখনো, প্রবল সংঘর্ষ হবে দুটো প্রাণের, তখনই না প্রলয় আসবে। মিষ্টি ভালোবাসার প্রলয়!

তবে দুটোই যে বোকা মন, একে অপরের গন্তব্যের ঠিকানাই এখনো জানে না!

***
বিয়ে, বৌ-ভাত মিলিয়ে গত দুই দিন লাবণ্য অনিকেতকে একেবারেই পাত্তা দেয়নি। এমনিতেই বউ সেজে বসে থাকার যে ঝক্কি সামলাতে হয়েছে তাতে সে ভীষণ ক্লান্ত ছিল, সেটা ফালতু তর্ক করে বাড়াতে চায়নি। তবে অনিকেতের নাক ডাকার যন্ত্রণায় দুই দিনই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে। লাবণ্য ঘুমের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। নিজের বিছানা, নিজের বালিশ, পরিচিত পরিবেশ ছাড়া ঘুম হয় না, একটু শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যায়। সেখানে এই নাক ডাকার শব্দ একেবারেই সহ্য করার মতো নয়। অনিকেতের মাথা নাড়িয়ে দিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রেহাই মিলেছে, কিন্তু ঘুম আর হয়নি সেভাবে।

অনিকেতের ছুটি শেষ হয়ে গেছে, আগামীকাল থেকেই অফিস। মাকে এর আগে বহুবার ওর সাথে যেতে বললেও তিনি যাননি। এবার লাবণ্যও বলল,
“মা, আপনিও চলুন আমাদের সাথে। একা একা থাকবেন আমাদের ভালো লাগবে না।”

“তোমরা যাও মা। আমি এখানে একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে তোমাদের সঙ্গী হব।” হেসে বললেন রাহেলা।

“মা, তোমার আর কবে গোছানো হবে? দুই মাস হলো মেস ছেড়ে বাসায় উঠেছি, তোমার সময়ই হচ্ছে না।” অনিকেতের গলায় অভিমানী সুর।

রাহেলা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “পাগল ছেলে, এত বছরের পরিচিত গণ্ডি। এত সহজে এর মায়া কাটানো যায়! তাড়াতাড়িই যাব, তখন গিয়ে তোদের সুখে ভরা সংসারটা চোখ ভরে দেখব।”
বলতে বলতে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, চোখ ভিজে গলা কেঁপে ওঠে।

লাবণ্যর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, “তুই তো এখন আমার মেয়ে। ছেলেটা আমার বড্ড অগোছালো, ছেলেমানুষ। পাগলটাকে একটু গুছিয়ে দিস মা।”

অনিকেতের কান মলে দিয়ে বললেন, “লাবণ্যর পিছে একদম লাগবি না বলে দিলাম কিন্তু।”
দুজনের কেউই মাকে কষ্ট দিতে চাইল না বলে হাসিমুখে বিদায় নিল।

শফিক ওদের বাসস্ট্যান্ডে তুলে দিতে এলেন। বাসে উঠার আগে আগে বললেন, “তোরা দুজনেই এখনো ছেলেমানুষ। জীবনের অনেককিছু দেখিসনি। একটু মানিয়ে নেবার চেষ্টা করিস, তাহলে দেখবি একসময় খুব সুখী হবি।”

“মামা, তুমি ওকে মেজাজ কমাতে বলো তাহলেই হবে।”

লাবণ্য অগ্নি দৃষ্টি হেনে বলল, “আঙ্কেল, দেখলে তো তোমার মাথামোটা ভাগ্নের কথা বলার ধরন। এর সাথে মানিয়ে চলা যাবে?”

“আমি মোটেও মাথামোটা নই! বরং আপনার মাথার তার ছেড়া আছে।”

শফিক এবার মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “থাম তোরা, নতুন সংসারে পা দিতে যাচ্ছিস। অথচ দেখে মনে হচ্ছে কোনো যুদ্ধে নামছিস। আসল যুদ্ধের আগে ওয়ার্মআপ করে নিচ্ছিস। এতটাও বাচ্চা না, যথেষ্ট বড় হয়েছিস। সম্পর্কের মানে বুঝতে চেষ্টা করিস। নিজেদের বুদ্ধির পরিচয় দিস একটু।”

দু’জনেই মাথা নিচু করে ফেলল, শফিক বললেন, “আসি, নিজেরা বেশি মাতব্বরি করবি না। যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে আগে আমাকে জানাবি।”

“মা’কে দেখে রেখো, মামা। আসি।”

শফিক সদ্য পরিণয়ে আবদ্ধ বর-কণেকে বিদায় দিলেও আশঙ্কা গেল না৷ তবুও প্রবল শঙ্কা পাশ কাটিয়ে মনে মনে আশীর্বাদ করলেন তাদের দীর্ঘস্থায়ী সুখী একটা সংসারের জন্য!
………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here