টুকরো স্মৃতির অতলে পর্ব -০৬

#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤
#পর্ব_০৬
#লেখনীতেঃআহানিতা

ফুসকার স্টলের সামনে টুল টেনে তিনজনই বসে পড়লাম।তখন রাত নয়টা। শীতের রাতের ঠান্ডায় জমে আসছে আমার হাত পা।ঠান্ডা পিনপিনে বাতাস সুয়েট্যার থাকা স্বত্ত্বেও শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে।ঠোঁটজোড়া হালকা কাঁপিয়েই হাতজোড়া ঘষতে ঘষতে এদিক ওদিক তাকালাম।আহি আর রায়হান যার যার মতো চুপচাপ বসে আছে।রায়হানের চুপচাপ স্বভাবটাই কেন জানি মেনে নেওয়া যাচ্ছে নাহ।যে ছেলেটা কথার ছলে মাথায় চাটি মারত সে এতটা সভ্য হলো কবে?আর এতটাও চুপচাপও তো কখনো ওকে দেখিনি আমি।তবে?চুপচাপ হওয়ার পেছনে কারণ কি?ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।তখনই বারো-চৌদ্দ বছর বয়সী একটা ছেলে এসে ফুসকার প্লেট এগিয়ে দিল।আমি ফুসকার প্লেটটা ছেলেটার থেকে এগিয়ে নেওয়ার আগেই পেছন থেকে কোন এক ভদ্রলোক আমার উপর দিয়ে ঝুকেই হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল প্লেটটা।তৎক্ষনাৎ ঘাড়ে আঁচড়ে পড়ল তার উষ্ণ নিঃশ্বাস।সেই নিঃশ্বাসের স্পর্শেই নিজের মাঝে কম্পন বয়ে চলতেই লোকটি কানের কাছেই বলে উঠল,

‘ উনার জন্য আরেক প্লেট আনো।’

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে পা বাড়াল।পেছনের লোকটার কন্ঠ শুনেই বুঝে নিয়েছি উনি কে।আচ্ছা উনার কি ঝোাকাঝুকি ছাড়া আর কোন কাজ নেই?তাও একেবারে আমার কাছে এসেই ঝুকেন কেন উনি?আজব!কপালের চামড়ায় ভাজ ফেলেই উনার দিকে তাকালাম।কিঞ্চিৎ বিরক্ত নিয়েই বলে উঠলাম,

‘ আপনি?এখানে?আর আমার ফুসকার প্লেট নিলেন কেন?’

অর্কভাই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আরেকটা টুল টেনে আরামে বসতেই আহি প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ ভাইয়া?তোকে আব্বু আম্মু পাঠিয়েছে?কিন্তু তখন তো পাঠাল নাহ তবে এখন?আমরা এখানে না নামলে তো এতক্ষনে মেহুল আপুর বাসায় চলে যেতাম।তোর আসাটা তো তাহলে বৃথাই যেত।’

আমি আহির দিকে তাকিয়ে অর্কভাইয়ের দিকে তাকালাম।উনি প্লেট থেকে তুলে একটা ফুসকা গালে ফুরেছেন মাত্র।এমনভাবে চিবিয়ে খাচ্ছেন যেন এই মুহুর্তেই তার ধ্যান জ্ঞান সব ঐ ফুসকাতেই।ফুসকা নামক খাদ্য ছাড়া এই মুহুর্তে কোন খাদ্যই খাদ্য নাহ।ফুসকাটা খেয়ে এক ঢোক পানি খেয়েই রায়হানের দিকে হাত বাড়ালেন উনি।আমাদের কোন প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই রায়হানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন,

‘ হাই রায়হান।হোয়াটস আপ?’

রায়হান মৃদু হেসেই বলে উঠল,

‘ এই তো ভালোই ভাইয়া।’

অর্কভাই হাসলেন।রায়হানের দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন,

‘মুড অফ?নাকি পছন্দের মানুষ হারানোর কষ্টে ব্যাথিত?’

আমি ভ্রুজোড়া কুঁচকে তাকালাম দুইজনের দিকে।পছন্দের মানুষ হারানো?আমার জানামতে রায়হানের কোন জি এফ ছিল না।আর না কোন পছন্দের মেয়ে যাকে ও ভালোবাসত।তবে?পছন্দের মানুষ হারানোর কষ্ট বলতে কি বুঝালেন উনি?আমি রায়হানের দিকে তাকিয়েই ওর পিঠে ধপাধপ দুটো কিল লাগিয়ে বলে উঠলাম,

‘ তোর পছন্দের মানুষ আছে রায়হান?বলিস নিতো।বললে কি খেয়ে নিতাম আমি?তোর জি এফ কে নিয়ে পালিয়ে যেতাম?’

রায়হান বিরক্ত নিয়ে আমার দিকে তাকাল।কপালের চুল সরিয়ে বলে উঠল,

‘ আমার আশেপাশেই তো আছে।আশেপাশে থাকতও।কখনো খুঁজে দেখলে পেয়ে যেতি।খুঁজিস নি তাই জানিস নাহ সিম্পল।’

রায়হানের ব্যবহারের বিরক্ত লাগছিল।কান্না পাচ্ছিল।রায়হান তো এমন ছিল না? তবে এমন আচরণ করছে কেন ও?কেবল আমার সাথেই করছে নাকি মেঘার সাথেও করে?কি জানি।আমি হালকা নিঃশ্বাস ছাড়লাম।অর্কভাই হেসে বলে উঠলেন,

‘ বাদ দাও রায়হান।ও বুঝবে নাহ।ওর সে মাথাই নেই।তো তুমি কি এই কষ্টে ব্যাথিতই থাকবে? এন্জয় করছো না কেন সময়টা?’

রায়হান ঠোঁট টেনে হেসে বলল,

‘ আপনার মতো পছন্দের মানুষকে নিজের করে নিতে পারলে এঞ্জয় করতাম ভাইয়া।’

উনি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

‘ ওকে,মুভ অন করাটা তোমার ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় যাকে পাবে নাহ তাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিলেই ভালো হয়।শুধু শুধু তার জন্য সময় নষ্ট করে লাভ আছে কি কোন?চুজ এনাদার গার্ল এন্ড লাভ হার মোর এন্ড মোর।আমার মনে হয় তুমি এমন একজন পেয়ে যাবে জীবনে।রাইট?’

রায়হান হাসল।পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েই বলে উঠল,

‘ থেংক্স ভাইয়া।বাট কি বলুন তো,আমি মুভ অন করতে পারছি নাহ।চাইলেও অন্য কোন মেয়েকে আমার কাছে ভালো লাগছে নাহ।খুঁজে দিতে পারবেন এমন একজন যে আমাকে তাকে ভুলতে সাহায্য করবে?আমার হৃদয়ে কোন শূণ্যতা রাখবে না?’

অর্কভাই মুচকি হাসলেন।বললেন,

‘ ঐ যে বললাম,আই থিংক তুমি পেয়ে যাবে এমন একজন।হুট করে খুঁজে দিলে তো তার প্রতি ভালোবাসা জম্মাবে নাহ তোমার।ভালোবাসাটা যেমন হুট করে হয় সেও হুট করেই আসবে তোমার জীবনে।সেদিন তোমার এই কষ্টে ব্যাথিত হওয়াটা কিছুই মনে হবে নাহ দেখো।ঐ নারীকেই তোমার ভালো লাগবে শুধু এবং শুধু।’

রায়হান প্রতিউত্তরে কিছু বলল নাহ।হেসে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে লাগল।আমি সরু চোখে সেভাবেই তাকিয়ে ছিলাম।যেখানে আমি কিছুই জানি নাহ সেখানে অর্কভাই রায়হানের সম্বন্ধে এত কিছু জানেন?কিন্তু কিভাবে? সেদিক পানে তাকিয়ে ভাবতেই আহির কন্ঠ ভেসে আসল কানে,

‘ আরেহ ঐ,কি যেন নাম?ছ্যাঁকাখোর।মিঃ ছ্যাঁকাখোর?’

রায়হান চোখ ফিরিয়ে পেছনে তাকাল।আহির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাতেই আহি বলে উঠল,

‘ আপনার মোবাইলটা রেখে যাচ্ছিলেন। প্রেমিকার শোকে কাতর হয়ে দেখছি সবই ভুলে যাচ্ছেন। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছেন।’

রায়হান কপাল কুঁচকে পকেটে হাত দিল।হয়তো মোবাইল না পেয়ে দু পা বাড়িয়ে কাছে এসে দাঁড়াল।ভ্রু বাঁকিয়ে টেবিলের উপর মোবাইল দেখে সেটা হাতে নিল। তারপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘প্রেমিকার শোকে না তবে সে আমার পছন্দের কেউ ছিল।’

আহি ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাল।ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ প্রেমিকা ছিল না বলছেন?’

‘ সে কথা তো বলিনি।’

রায়হানের প্যাঁচ লাগানো কথা আমারই মাথায় কিছু ডুকছে নাহ আহির মাথায় ডুকা তো দূর।আহি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই বলল,

‘ তাহলে কি বললেন?’

‘ কিছুই তো বলিনি।’

‘ মানে?’

রায়হান মৃদু হেসেই বলল,

‘ মানে কিছুই নাহ।থেংক্স মোবাইলের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।’

আহি এবার ফিক করে হাসল।মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ থেংক্সের কি প্রয়োজন?

‘ প্রয়োজন নেই বলছেন?’

আহি মুচকি হেসে বলল,

‘ সে কথা তো বলিনি।’

রায়হান হাসল।বুঝল আহি ওর কথা ওকেই ফেরত দিচ্ছে।তারপর পেঁছন ফিরে হাঁটা ধরল।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আমার সাথে তেমন কোন কথাই বলল না ও?কথা বলাটা কি অনুচিত ছিল?অথচ অর্কভাইয়ের সাথে তো দিব্যি অনেক কথা বলল।আর আমি ওর ক্লোজফ্রেন্ড হয়েও আমায় কিছু বলল নাহ?আমি কি ওর প্রেমিকাকে ভাগিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতাম?

.

তখন সকাল!চারদিকে ঘন কুয়াশা।সামনের গাছগুলোর পাতা থেকে শিশির গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে।মাঠের ঘাসগুলোও শিশিরে মিটিমিটি হয়ে জ্বলছে।ঘাসের সাথে সেইরকমই বোধ হলো শিশিরবিন্দু গুলো।আমি আর আহি বাসা থেকে বেরিয়ে পথ ধরেই হাঁটছিলাম।সামনেই শিউলি গাছ!রোদ উঠার সাথে সাথে আস্তে আস্তে ঝরে পড়বে শিউলি গুলো।সাদা রংয়ের কমলা বোঁটার ফুলগুলোর সুভাসে চারদিক যেন অন্যরকম লাগছিল।গাছের পাতা বেয়ে কয়েকটা ফুল গড়িয়ে পড়লও মাঠের এককোণে।শিশিরে ভেজা ঘাসে শিউলি বেশ ভালোই মানাচ্ছিল। কিন্তু কেন জানি সেগুলোকে কুড়িয়ে হাতে না নিলে শান্তি লাগছিল নাহ।আহি সহ সেখানে গিয়েই একে একে ফুল কুড়োতে লাগলাম।হাতজোড়া মুঠো করে কিছু ফুল কুঁড়িয়েই হাফ ছাড়লাম।মাঠের পাশে সিমেন্টের তৈরি বসার জায়গায়টয় দুইজনে গিয়েই বসলাম।তখনই আহির ফোন বাঁজল।ও বেশ মনোযোগ নিয়ে কথা বলেই আমার দিকে তাকাল।মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ আপু?একটু রাস্তার মোড়ে যেতে হবে।যাবে?আসলে ভাইয়া আসবে।অফিস যাওয়ার পথে আমার চশমাটা দিয়ে যাবে।চশমা ছাড়া তো মাথা ব্যাথা করে, প্রবলেম হয় তাই।’

আমি মৃদু হাসলাম।তারপর বললাম,

‘ কেন যাব নাহ?অল্প একটুই তো পথ।চল হাঁটা শুরু করি।’

‘ নাহ এক্ষুনি নাহ।এখন এখানেই বসি।ভাইয়া আসতে আরেকটু লেট আছে।’

ওর কথামতো আরো কিছুটা সময় সেভাবেই বসে থাকলাম।তারপর উঠে হাঁটলাম।রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন হওয়ার পর ও অর্কভাইয়ের গাড়ি বা অর্কভাই কোনটারই দেখা পেলাম নাহ।অবশেষে আরো পনেরো মিনিট পর উনি হাজির হলেন।মুখে চোখে তীব্র বিরক্ত নিয়ে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে আহির দিকে চশমাটা এগিয়ে দিলেন।ধমকি দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ এতই যখন বেড়ানোর শখ তো নিজের জিনিস নিজে আনতে পারিস নাহ?তোর জিনিস দিতে আবার আমাকে আসতে হচ্ছে কেন? ‘

আহি মুখ ভেঙ্গাল।আমি তাদের ভাইবোনের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালাম।অর্কভাই নজরটা এবার আমার দিকে ফেললেন।সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো চোখজোড়া।আমি তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।চোখাচোখি হওয়া আসলেই বিব্রতকর!কেমন যেন অস্বস্তি চোখে চোখে তাকিয়ে থাকায়।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে একইভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেই অর্কভাই বলে উঠলেন,

‘ মেহুল,মেঘা কোথায়?’

আমি আচমকা চমকে তাকালাম উনার দিকে।মেঘার খোঁজ নিচ্ছেন কেন উনি?আর মেঘা কোথায় মানে?বাসায় ই তো থাকার কথা।প্রতিদিনই তো ওর সাথে আমার কথা হয়। ও তো বাসায়ই আছে আমার জানামতে।তবে?

‘ মেঘা কোথায়?’

অর্কভাইয়ের আবারও একই কথা বলাতে অবাক না হয়ে পারলাম নাহ।চোখজোড়া বড়বড় করে তাকিয়েই বললাম,

‘ বাসায়। কেন?’

অর্কভাই ক্ষ্রিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালেন।যার অর্থ আমার উত্তরে উনি সন্তুষ্ট হন নি।হয়তো অন্যকোন উত্তর আশা করেছিলেন কিন্তু আমার যে অন্য কোন উত্তর জানা নেই।যা জানা আছে তাই উগড়ে দিলাম আমি।অর্কভাই গাড়ি থেকে নেমে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। পরনে,কালো রংয়ের ব্লেইজার, ইন করা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট।হাতা গুলো বরাবরের মতোই কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা।মাথার চুল কপালে ঝুকেছে।ডান চোখের ভ্রু কিছুটা উঁচু করে প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ মেঘার চাচাত ভাই কে?চিনিস?’

আমি আবারও আহাম্মকের মতো তাকালাম।মেঘার চাচাতো ভাই?আমি কি করে চিনব কে সে।ভ্রু জোড়া কুঁচকেই প্রশ্ন করলাম,

‘ কেন?’

উনি প্যান্টের পকেটে হাত ডুকিয়েই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ তোকে যা প্রশ্ন করছি উত্তর দে।চিনিস?’

‘ নাহ।’

উনি এবার বিরক্তি নিয়ে তাকালেন।আমার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে রেখেই বিরক্তির সাথে বললেন,

‘ কি চিনিস?’

আমি বোকার মতো চেয়ে থেকেই বললাম,

‘ কি চিনব?না চিনলে না বলব নাহ?’

‘ নাহ, বলবি নাহ।’

আমি সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম।উনি কি একটু আজব নয়?আচরণ, কথাবার্তা সবই কি অদ্ভুত!কথায় কথায় এত রাগ আসে কোথায় থেকে?আর সব রাগ কি উনি আমার উপরই ঝারেন?আজব!

‘ শোন, বাসায় গিয়ে মেঘা কোথায় আছে তা জেনে আমায় বলবি।ওকে?এন্ড ওর চাচাতো ভাইয়ের ঠিকানাও বলবি আর ওর চাচাতো ভাইয়ের একটা ছবিও পাঠিয়ে দিবি।পারবি?’

উনার কন্ঠ শুনেই সরু দৃষ্টি ফেললাম।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই
বললাম,

‘ কেন?’

‘ আহনাফ মাহমুদ অর্ক কৈফিয়ত দিতে পছন্দ করে নাহ।’

‘ কিন্তু ওর চাচাতো ভাইকে তো আমি চিনি নাহ অর্কভাই।কোথায় থেকে উনার ছবি আর ঠিকানা সংগ্রহ করব?মেঘা কোথায় আছে তা নাহয় বলে দিতে পারব কিন্তু বাকিগুলো পারব নাহ।’

অর্কভাই বাঁকা হাসলেন।আমি সেই হাসির অর্থ খুঁজে পেলাম নাহ অবশ্য।উনি আমার দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়েই বললেন,

‘ সবগুলোই পারবি।না পারলে ডাবল কাজ দিব।কাজ না করলে ভয়ানক শাস্তি!’

আমি হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম।ভয়ানক শাস্তি?এই কাজ না করার জন্য ভয়ানক শাস্তি দিবেন উনি আমায়?এটা এতটাই ইম্পোর্টেন্ট কাজ উনার কাছে?উনাকে প্রশ্নটা করব ভাবতেই উনি চটফট উঠে পড়লেন গাড়িতে। চোখের সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে হাওয়াও হয়ে গেলেন মুহুর্তেই।আমি সেদিকে তাকিয়েই আহির দিকে তাকালাম।আহির কানে ফিসফিসিয়েই বলে উঠলাম,

‘ আহি?উনি কি পাগল টাগল?এত রাগ জেদ সবসময় সবার সাথেই দেখায়? ‘

আহি আমার কথা শুনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।দাঁত বের করে বলল,

‘ উহ!মোটেই নাহ।জাস্ট কখনো কখনো রেগে যায় আর কি।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘ আমার তো মনে হয় উনি সবসময়ই এমনই থাকে।ভাল্লাগে নাহ!’

আহি হাসল।কিছুটা সময় চুপ থেকেই বলল,

‘ আচ্ছা মিঃ ছ্যাঁকাখোরের বাড়ি কি এদিক সেদিকই?কোথাও যাচ্ছিলেন একটা পুঁচকে মেয়ে নিয়ে দেখলাম।’

আমি হা হয়ে তাকালাম।রায়হান? হ্যাঁ ওর বাসা তো এদিকেই।কিন্তু পুঁচকে মেয়ে? সে আবার কে?এত সকালে কোন পুঁচকেকে নিয়ে বেরিয়েছে ও?আমি মৃদু হেসেই এদিক সেদিক তাকিয়ে বললাম,

‘ হ্যাঁ, এদিকেই তো বাসা ওর।কিন্তু পুঁচকে তো ওর কেউ নেই তেমন।তুই হয়তো ভুলে দেখেছিস।এত সকালে কোন পুঁচকেকে নিয়ে বেরোনো যায়?যে কুয়াশা!’

আহি হালকা হেসেই বলল,

‘ হতে পারে!’

তারপর আহিকে একপাশে রেখে ওকে বলেই একপাশে সরে আসলাম আমি।মেঘাকে কল দিতে লাগলাম বহুবার।আহিকে দূরে রেখে আসার কারণ যাতে কল ধরলে কি কথা বলি তা না শুনতে পায়।কেন জানি কারো সামনে কলে কথা বলতে কেমন অস্বস্তি লাগে।তাই ওকে দাঁড়াতে বলেই ওর থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে আসলাম।শেষবার কল দিতেই মেঘা কল ধরল।আমি সঙ্গে সঙ্গেই ঝটফটিয়ে বলে উঠলাম,

‘ এই, এই?তুই কোথায় বলতো?কালতো ভার্সিটি আসিস নি।আজও কি আসবি নাহ?’

মেঘা আমার সব প্রশ্নের উত্তর একটা কথাতেই দিয়ে দিল,

‘মেহুল,কাল আমার বিয়ে।’

আমি স্তব্ধ হয়ে তাকালাম।বিয়ে মানে?বললেই বিয়ে হয়ে গেল নাকি?কই আমাকে তো বলেইনি ওর যে বিয়ে।আমার বিয়ের কথা বলিনি বলে তো খুব চটফট করল এখন ওর বিয়ের কথাই বলল নাহ?আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলাম।চোখ টলমল করে উঠল।কাছের বন্ধুগুলোকেই কেমন অচেনা লাগছে।যেন কত দূরত্ব!কাল রায়হানও আমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলেনি।আজ মেঘার কাছ থেকেও এমন একটা তথ্য পেতে হবে আশাই করিনি।আমি চোখ খিচে তপ্ত শ্বাস ফেলেই বললাম,

‘ বললি নাহ তো?’

‘ বলার সিচ্যুয়েশনই তো ছিল নাহ মেহুল।হুট করেই,…’

বাকিটা বলতে না দিয়েই বললাম,

‘ থাক।বলতে হবে নাহ। রাখছি।’

কথাটা বলে কল কাঁটতে যাব ঠিক তার আগেই মেঘা আবারও বলল,

‘ মেহুল?’

‘ বল।’

‘ আমার যে বিয়ে এই কথাটা একবার কোনভাবে উনাকে আই মিন ইহানকে বলতে পারবি?কোনভাবে খবরটা উনায় দিতে পারবি?প্লিজ?আর হ্যাঁ, বলবি, মেঘা এই বিয়েতে খুব খুশি। তার হবু বরকে সে খুব ভালোবাসে।বলতে পারবি?’

আমার কলিজা ধ্বক করে উঠল।আবারও কান্না পেল আমার।মেঘা তো ইহান ভাইকে পছন্দ করত।ভালোও বাসত!তবে কি ও বিয়েতে রাজি নয়?আমার মতোই কি ওকেও জোর করেই বিয়েটা মেনে নিতে হচ্ছে?আমি মৃদু কন্ঠেই বললাম তৎক্ষনাৎ,

‘ মেঘা?রাজি তো তুই এই বিয়েতে?নাকি আঙ্কেল আন্টি জোর করে বিয়ে দিচ্ছে তোকে?’

মেঘা হয়তো হাসল।বুঝতে পারলাম নাহ এপাশ থেকে আমি।তারপরই বলল,

‘ রাজিই।রাখছি মেহুল।প্লিজ উনাকে বলে দিস।’

‘ এক মিনিট প্লিজ!তোর বিয়েটা কার সাথে হচ্ছে?বলবি?আর তুই কোথায় এখন? প্লিজ!’

ও চটফট করেই বলল,

‘ বাড়িতে।বাড়ির ঠিকানা তো জানিসই।বিয়েটা আমার এক কাজিনের সাথেই হচ্ছে।বাই।’

এবার সবটা পরিষ্কার।অর্কভাই কেন হুট করে মেঘার কথা জিজ্ঞেস করল তাও স্পষ্ট।কাজিনটা হয়তো ওর চাচাতো ভাইই হবে তাই হয়তো অর্কভাই তার ঠিকানা চাইলেন, ছবি চাইলেন।আমি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছন ফিরে তাকালাম।আহিকে দেখলাম নাহ।এদিক ওদিক তাকিয়েও দেখলাম নাহ ওকে আমি। একটা মেয়ে হুট করে কি উধাও হয়ে যাবে?হেঁটে দু পা এগোতেই মেইন রোডের ধারে দেখতে পেলাম আহিকে।কোলে ছোট্ট একটা মেয়ে।তার পাশেই রায়হান আর একটা শাড়ি পরিহিত মেয়ে।আমি ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়েই যা বুঝলাম তার সারমর্ম হলো, পিচ্চিটা রায়হানের ভাইয়ের মেয়ে।আর শাড়ি পরিহিত মেয়েটা ওর ভাবি। এখানে একটা কাজেই এসেছিল ওরা।রায়হানের কোলেই ছিল পিচ্চিটা।মাঝপথেই পিচ্চিটা কোল থেকে নেমে পড়েছিল।রায়হানের খেয়াল না থাকায় পিচ্চিটা একটা চলন্ত অটোর সামনেই চলে এসেছিল।আহি দেখতে পাওয়াতে ওই গিয়ে কোলে তুলে নেয় পিচ্চিটাকে।আমি মৃদু হেসে কিছু বলার আগেই আহি রায়হানের দিকে তাকিয়েই বলে উঠল,

‘ এই যে মিঃ ছ্যাঁকাখোর?কে সে আপনার প্রেয়সী যে এভাবে আপনাকে কষ্ট দিয়েছে বলুন তো?যে আপনি এতটাই অন্যমনস্ক। আপনাকে তো কোন ইম্পোর্টেন্ট কাজের দায়িত্বই দেয়া যাবে নাহ ।আজ তো আপনার এই অন্যমনস্কের জন্য আরেকটু হলেই দুর্ঘটনা ঘটত।’

রায়হান অপরাধী দৃষ্টিতে মাথা নিচু করে তাকিয়ে ছিল।রায়হানের ভাবি পিচ্চিটাকে কোলে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেই বলল,

‘ তোমরা রায়হানের পরিচিত?’

আহি হেসেই বলল,

‘ ঠিক নাহ।তবে মেহুল আপুর পরিচিত।ওরা ফ্রেন্ড।সেই সূত্রেই চিনি।’

‘ বাসা কোথায়?’

আমি মৃদু কন্ঠেই বললাম,

‘ এই তো পাশেই ভাবি।আপনাদের বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের পথ।আর আহি এই এক সপ্তাহ আমাদের বাসায়ই থাকছে।’

উনি হাসলেন।তারপর পিচ্চিটাকে কোলে তুলে নিয়েই বলল,

‘ তা বিকালে এসো না আমাদের বাসায়?আমার মেয়েটা তো ওকে ছাড়তেই চাইছে নাহ দেখছো না?তাছাড়া ও এতবড় উপকার করল আমার।আমি চাই তোমরা একদিন বাসায় আসো।প্লিজ।’

আমি হাসলাম।কপালের চুলটা সরিয়ে বললাম,

‘ অবশ্যই।আজই যাব।এমনিতেও মাঝে মাঝেই তো যাই আমি আর মেঘা রায়হানের বাসায়।হে হে!’

আহি হাসল।বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,

‘ মেহুল আপু না গেলেও আমি জোর করে নিয়ে চলে যাব পুঁচকেটার সাথে খেলার জন্য।আর একদিন আপনাদেন বাসা চিনে গেলে যতদিন এখানে থাকছি ততদিনই যাব আপনাদের বাসায়।আজ যাই তবে।’

আমি ও হাসলাম।আলতো হাতে বাচ্চাটার গালে হাত বুলিয়ে পা বাড়ালাম উল্টো পথে।রায়হানকে কেমন অচেনা লাগল।পাল্টে গেল ও?আমার এতটা ক্লোজ ফ্রেন্ড অথচ এখন এমন অপরিচিত মুখ যেন আমাকে সে চেনেই নাহ।অদ্ভুত!

#চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here