ডায়েরি পর্ব ২

#ডায়েরি_পর্ব_২

জান্নাতুল জান্নাত

রাত সাড়ে বারোটায় ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরলাম৷ ততক্ষণে অনিতা আর অর্নব ঘুমিয়ে পড়েছে৷ বৃদ্ধা শ্বাশুড়ি ফোনে আলাপ আলোচনা করে চলেছেন শ্যুটিংএর সিডিউলের বিষয়ে৷ কান পেতে সেটা শুনে নিলাম৷ শ্বাশুড়িকে আমার হাফ পি.এ. বলা চলে৷ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্বামীর কক্ষে গেলাম৷ নাহ্ রুটিনের কোন পরিবর্তন হয়নি৷ আজও বেশ কয়েক পেগ হুইস্কি নিয়েছে মনে হয়৷ বাহিরের পোশাকে সোফার উপর অর্ধেক শরীর দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে৷ বিরক্তকর লোক একটা৷ একবার ভাবলাম এগিয়ে গিয়ে বিছানায় তুলে দিবো আর পোশাক বদলে দিবো কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম কি লাভ এসব করে? দু’টো নষ্ট শরীরের নষ্ট মানুষগুলো আলাদা থাকাই ভালো৷ পোশাক পাল্টে টেবিলে রাখা স্যালাড খেয়ে রান্নাঘরে গেলাম কফি বানাতে৷ ফ্লাক্সে কফি নিয়ে চলে গেলাম স্ট্যাডি রুমে৷ দরজা আটকে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে গোপন কুঠুরি থেকে ডায়েরি বের করে লিখতে বসলাম৷

২রা আগস্ট রাত দেড়টা যদিও হিসেব মতো এখন ৩রা আগস্ট৷

অঞ্জনদা জম্মদিনে আমাকে ডায়েরি দিয়েছেন৷ শুধু কি ডায়েরি? আমার এই অভিনয় জীবনের সবকিছুই তার দেয়া৷ আর অঞ্জনদা? অঞ্জনদার হাতে আমাকে সমর্পন করেছেন আমার স্বামী সুব্রত রায় চৌধুরী৷ হ্যাঁ, আমি এই রায় চৌধুরী বাড়ির বৌ৷ দশ বছর আগে এই লোকটার হাতে বাবা আমাকে সমর্পন করেছিলেন৷ আমার ভালো মন্দ ইজ্জত সব তার হাতে৷ রক্তরঙা লাল সিঁদুর পড়িয়েছিলেন লোকটা আমার সিঁথিতে৷ সিঁদুর সেদিন সিঁথির চেয়ে নাকের উপরই বেশি পড়েছিলো৷ সবাই বলেছিলো স্বামী সোহাগী হবো৷ হ্যাঁ হয়েছি তো! নাহলে কি আর অঞ্জনদার মতো মানুষের হাতে সমর্পন করে আমাকে? পৃথিবীতে ক’জন স্বামী আছে স্ত্রীকে সমর্পন করতে পারে৷ এদিক থেকে আমি পরমা ভাগ্যবতী বটে৷

এই দশ বছরে আর কখনো সুব্রত আমায় সিঁদুর পড়িয়েছে বলে মনে পড়েনা৷ হয়তো স্মৃতিভ্রম হয়েছে আমার৷ আমার রিসিপশন অনুষ্ঠানটা বেশ বড় করে হয়েছিলো৷ ব্যবসায়ী স্বামী দেশবিদেশে তার কত পরিচিত লোক আছে সবাইকে ইনভাইট করেছিলেন সেদিন৷ অবাক করা বিষয় ছিলো সেদিন কিন্তু আমি বেনারসি পড়ে ট্রিপিক্যাল বউয়ের মতো সাজিনি৷ সেদিন পার্টি পোশাক আর পার্টি মেকআপ নিয়েছিলাম৷ বান্ধবীদের থেকে শুনেছিলাম বিয়ের পর নাকি সবসময় শাড়ি পড়ে থাকতে হয় কিন্তু আমার বেলায় হলো উল্টো৷ আমি কিন্তু বেশ উপভোগ করেছিলাম বিষয়টা৷ কয়টা মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে আমার মতো স্বাধীনতা পায়? খুব ভালোভাবেই পার্টিটা উতরে গেলো৷

স্বামী আমার মহা ব্যস্ত মানুষ৷ প্রতিরাতে বাসায় ফেরারও সময় হয় না৷ বিয়ের পর যখন আমাকে অষ্টমঙ্গলা নিয়ে গিয়েছিলো তখন ঘন্টাকয়েক পরেই নিয়ম শেষ হতেই এসে পড়েছিলো সুব্রত৷ দু’দিন পর আমার বাসায় গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো ফেরার জন্য৷ আমি বাসায় ফিরে অবাক৷ বাসায় অনেক অতিথি৷ কই সুব্রত কিছু বললো না আমাকে৷ যা হোক অতিথিদের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর জানলাম অঞ্জন দত্ত একজন প্রডিউসর৷ আমাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে৷ তিনি আমাকে অভিনয়ে নিতে চান৷ আমি বোবা পুতুলের মতো শুধু শুনছিলাম৷ কিছুই বুঝতে পারিনি তখন৷ আমি করবো অভিনয়? কোনোদিন কল্পনাও করিনি৷ রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ার জন্য এসবের চিন্তা কোনদিন মাথায় আনতেও ভয় পেয়েছি৷ তারমধ্যে আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে৷ স্বামী শ্বাশুড়ি নিশ্চয়ই চাইবেন না তাদের ঘরের বউ অভিনয়ে নামুক৷ এসব ভাবতে ভাবতে তাদের কথাগুলো প্রথমে শোনা হয়নি কিন্তু পরের কথাগুলো শুনে বুঝলাম আমার শ্বাশুড়িমা ভীষণ খুশি হয়েছেন অঞ্জনদার এ প্রস্তাবে৷ স্বামীর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ইনি তো মহাখুশি৷ আমারও বেশ ভালো লাগলো৷ খুব ভালো শ্বশুরবাড়ি পেয়েছি৷ সত্যিই এদের তুলনা হয় না৷ কিন্তু দ্বিমত পোষণ করে অঞ্জনদাকে বললাম আমি তো এসব কখনো করিনি কোন অভিজ্ঞতা নেই৷ আপনি বিপদে পড়ে যেতে পারেন আমাকে নিয়ে৷ তিনি বললেন “আমি জানি আপনি আগে কখনো অভিনয় করেননি৷ তাতে সমস্যা নেই৷ আমি ও আমার দল আপনাকে গড়েপিঠে নিবো৷”

আমার যে খুশি আর ধরে না৷ আহ্ আমি নায়িকা হবো!!! কন্ট্রাক্ট পেপার রেখে অঞ্জনদা সেদিনের মতো চলে গেলেন৷ একদিন সময় দিয়ে গেলেন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য৷ পরেরদিন আসতেই খুশিমনে কন্ট্রাক্ট পেপার না পড়েই সিগনেচার করে দিলাম৷ স্বামী পাশে থাকলে ভয় কি!! তাছাড়া অঞ্জনদা তো সুব্রতর পরিচিতই৷

আগেই বলেছি আমার বয়সের চেয়ে পরিপক্কতা কম তাই অনেককিছু তখন বুঝিনি৷ কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝে গেছি৷ যখন বুঝেছি তখন জড়িয়ে গিয়েছি আষ্ট্রেপৃষ্ঠে৷ বেরুবার উপায় নেই আর৷

১৮ই এপ্রিল ২০০৫ আমাকে প্রথমবারের মতো আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় অভিনয়ের জন্য৷ স্ক্রীপ্ট কয়েকদিন আগেই দিয়েছিলো কিন্তু কিছুই মনে থাকে না৷ বারবার শুধু ভুলে যাই৷ ভয়ে হাত পা অসাড় হয়ে আসে৷ ভেবেছিলাম সুব্রত যাবে আমার সাথে কিন্তু ওর নাকি অফিসে অনেক কাজ তাই যেতে পারেনি৷ অঞ্জনদা আমাকে নেয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন৷ যদিও স্ক্রীপ্টগুলো মুখস্ত হয়নি৷ অঞ্জনদা নিজেই বারবার দেখিয়ে দিয়ে বারবার কেটে কেটে অল্প অল্প করে শট নিচ্ছিলেন৷ আমার বিপরীতে অভিনয় করেছিলো একজন মুসলিম৷ নাম তার নাবিদ ইসলাম৷ উনি পাকা অভিনেতা৷ বেশ বন্ধুভাবাপন্ন৷ ভালোই লাগছিলো তার সাথে কাজ করতে৷ অন্তরঙ্গ তেমন কিছু তখনও আসেনি৷ সপ্তাহ্ খানিক পর দাদা বললেন এখন কয়েকদিন গানের শ্যুট হবে৷ আর যেহেতু ছবিতে বিয়ে আর হানিমুনের বিষয়টা আছে তাই আমাদের পুরো টিমকে দেশের বাইরে যেতে হবে শ্যুটিং করতে৷ ভেবেছিলাম বাহিরে হয়তো যেতে দিবে না সুব্রত কিন্তু সুব্রত কোন বাঁধাই দিলো না৷ অঞ্জনদা যেনো আমাদের ঘরের লোক৷ যেহেতু সুব্রত ব্যস্ত মানুষ তাই শ্বাশুড়িকে অনুরোধ করলাম আমার সাথে যেতে কিন্তু রাজি হলেন না তিনি৷ এতোগুলো অপরিচিত লোকের সাথে দেশের বাহিরে যাবো তাও প্রায় পনেরো বিশদিনের জন্য ভাবতেই গা শিউরে উঠছে৷ কিন্তু অঞ্জনদা আছে ভেবে রাজি হলাম৷

আগে শুনেছিলাম অভিনয়ের মধ্যে জড়িয়ে ধরার বিষয়গুলো নাকি ক্যামেরার কারসাজি কিন্তু অভিনয় করতে গিয়ে বুঝলাম মোটেও ক্যামেরার কারসাজি নয় বরং সবটাই বাস্তব আর অতিমাত্রায় বাস্তব৷ শর্ট ড্রেস পড়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো, শরীরের এখানে সেখানে হাত দিয়ে, কখনো জড়িয়ে, বিভিন্ন অন্তরঙ্গ দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে বারবার পিছিয়ে আসছিলাম৷ বারবার দাদাকে কাট বলতে হচ্ছিলো আমার ইতস্ততার জন্য৷ ক্লোজ দৃশ্যগুলো কিছুতেই করতে পারছিলাম না৷ সেদিনই প্রথম অঞ্জনদার চোখে রাগ দেখেছিলাম৷ খুব রাগারাগি করেছিলেন সেদিন৷ নাবিদ ইসলাম তো রেগে চলেই গিয়েছেন শ্যুটিং স্পট ছেড়ে৷ তখনকার মতো আমিও রুমে চলে আসি৷ খুব কেঁদেছিলাম৷

রাত ন’টায় আমাকে অঞ্জনদা তার রুমে ডেকে পাঠালেন৷ ভয়ে ভয়ে গেলাম৷ যেতেই বললেন
-তোমার সমস্যা কি?
-দাদা ঐ দৃশ্যগুলোতে উনি আমার গায়ে হাত দিচ্ছিলেন তাই…
-তাই কি? তাই বলে তুমি সরে যাবে? এটা অভিনয় আর এটুকু তো তোমাকে করতেই হবে৷ আচ্ছা বাদ দাও বুঝলাম আজ তোমার এটুকুতেই খারাপ লাগছে কিন্তু এরপর যখন আরো অন্তরঙ্গ দৃশ্য দিবো তখন? তখনও পালাবে?
-দাদা আমি এসব করতে পারবো না৷ আপনি আমার বদলে অন্য কাউকে দেখুন৷
-আরে বলে কি মেয়ে? পাগল নাকি? কিছুতেই না৷ আমার মার্কেটিং হয়ে গেছে৷ এখন আমি সব শেষ করতে পারবো না৷ আর তুমি আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ৷ এসব লাইনের ভাষা এখনও বোঝো না হয়তো তুমি৷ সুব্রত তোমাকে কিছু বলেনি? আর সুব্রত কি বলবে কন্ট্রাক্ট পেপারে তো সব লেখা ছিলো৷ তুমি পড়োনি? এখন এসব কথা আসছে কোথা থেকে?
-না আমি তো পড়িনি৷
-বোকা মেয়ে বলে কি! তুমি না পড়ে সিগনেচার করেছো? আমি তো তোমার বাসায় রেখে এসেছিলাম তুমি যাতে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারো তাই৷
-আমি পড়িনি৷ কি লেখা ছিলো সেটাতে?
-ওয়েট৷ আমি তোমাকে এর একটা কপি দিচ্ছি৷ এখন এটা পড়ো৷ আর প্রতিদিন একবার করে এটা পড়বে৷ আজ থেকে বারো বছর৷ কারণ তোমার সাথে আমার চুক্তি বারো বছরের৷ সুব্রত সবটাই জানে তাই আমি ভেবেছি তোমাকে বলেছে৷ যাই হোক করার কিছু নেই৷ নাও পড়ো৷

আমি অঞ্জনদার হাত থেকে কন্ট্রাক্ট পেপারটা নিলাম৷ এবার পড়লাম৷ আর পড়ে বসে পড়লাম নিচে৷ এসব কি লেখা? সুব্রত একবারের জন্যও আমাকে বলেনি? বারোবছরের জন্য আমাকে বিক্রি করে দিলো এর কাছে? ফেরার কোন পথ নেই আমার৷ আমি অঝোড়ে কাঁদতে লাগলাম৷ জানি বারোটা বছর এমনই যাবে৷ বারো বছরের কান্না এখন কেঁদে নিচ্ছি৷ প্রায় আধঘন্টা পর অঞ্জনদা আমাকে ধরে উঠালেন, চোখের পানি মুছে দিয়ে, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলেন খেতে৷ ফোন করে ড্রিংকস অর্ডার দিলেন তার জন্য হার্ড আমার জন্য সফট৷ কিন্তু আমার শরীরের মধ্যে একটা পশু জেগে উঠেছিলো সেসময়৷ বয় যখন ড্রিংকস নিয়ে আসলো আমি হার্ড ড্রিংকসগুলো এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেললাম৷ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো কন্ঠনালি, খাদ্যনালী, পাকস্থলি সব কিন্তু আমি খেয়েই চলেছিলাম৷ অঞ্জনদাকে আরো অর্ডার দিতে বললাম তিনিও অর্ডার দিলেন আবারও খেলাম৷ চোখ বন্ধ করার আগমুহুর্ত মনে আছে অঞ্জনদা আমাকে আমার রুমে শুইয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিলো৷ তবে দেখেছিলাম কন্ট্রাক্ট পেপারটা টেবিলে ওয়েট পেপার দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি৷ আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা৷

আর পারছি না লিখতে৷ আজও হাতটা অসাড় হয়ে আসছে৷ চোখে আগুণ জ্বলে পুড়ে কিন্তু জল আসে না৷ ডায়েরি বন্ধ করে রেখে দিলাম গোপন কুঠুরীতে৷ মগে কফি ঢাললাম৷ নরিয়াম 10mg পাঁচটা দিয়ে দিলাম গরম কফিতে৷ চুমুক দিতে দিতে অঞ্জনদাকে মেসেজ করলাম৷
“কাল শ্যুটিং বিকেলে করেন আমি সকালে পারবো না৷ আমার ফোন বন্ধ থাকবে৷ কাউকে দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করবেন না৷ একটু ঘুমোতে চাই৷”
কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি আর দু’টো বছর৷ তারপর আমার মুক্তি……….
চলবে……

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here