ডায়েরি পর্ব ৩

#ডায়েরি_পর্ব_৩

জান্নাতুল জান্নাত

কফিতে চুমুক দিতে দিতে দরজা খুলে বারান্দায় গেলাম৷ রাত প্রায় দু’টো৷ শেষ কবে জ্যোৎস্না দেখেছিলাম আর প্রকৃতি দেখেছিলাম ভুলে গিয়েছি৷ আজ বোধ হয় পূর্ণিমা৷ তবে ভরা পূর্ণিমা নয়৷ কিন্তু চাঁদটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে৷ কেন এতো সুন্দর লাগছে তা বুঝতে পারছি না৷ আজকের মতো এতো মুগ্ধতা নিয়ে কখনো চাঁদকে দেখিনি৷ এ চাঁদকে নিয়ে লেখা হয়েছে কত কবিতা, কত গান, কত গল্প কিন্তু তার জন্য এর কোনো অহমিকা নেই৷ এতো সুন্দর হওয়া সত্বেও চাঁদের গায়ে কলঙ্ক সেখানে আমরা সাধারণ মানুষ কি? কলঙ্ক তো আমাদের নিত্যসাথী৷

সুব্রত ছেলে হিসেবে খারাপ নয়৷ সুব্রতর না হয় একটু মেয়েদের প্রতি ঝোঁক আছে৷ মাঝেমধ্যে একেকজনকে নিয়ে একেক জায়গায় থাকে৷ তাতে কি? ওর তো টাকা আছে৷ ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এটা কিছু নয়৷ এমন হতেই পারে৷ এটা স্বাভাবিক বিষয় যেমনি আমাদের ক্ষিধে পায়, জল তেষ্টা পায় তেমনি৷ বরং এমন না হওয়াটাই অস্বাভাবিক৷ একটু ড্রিংকস করে৷ এটাও কোন দোষের নয়৷ নিজের স্ট্যাটাস বোঝাতে কয়েকটি বিষয় নিজের মধ্যে রাখা উচিত তার মধ্যে ড্রিংকস এক নম্বরে৷ ড্রিংকস, মেয়ে লোক, কুকুর পোষা, মাঝে মধ্যে বাইরে রাত কাটানো কমন বিষয়৷ এর জন্য ওকে খারাপ বলা চলে না৷ তাই এসব জেনেও বাবা আপত্তি করেননি বিয়েতে৷ মেয়েতো রানীর হালে থাকবে৷ তবে তার মেয়েটাকেও যে টাকা উপার্জনের মেশিন হতে হবে তা হয়তো তিনি বোঝেননি৷ যা হোক তাকে দোষ দেবো না৷ ভাগ্য তো ভাগ্যবিধাতাই লিখেছেন৷ হয়তো এমনটাই তার ইচ্ছে ছিলো৷

তাছাড়া বাহির থেকে দেখে মানুষ যদি চেনা যেতো দিনের পর দিন এতো মানুষ ঠকতো না৷ মানুষের চেহারার আড়ালে অমানুষগুলোকে চেনার যদি কোন মেশিন তৈরি হতো৷ তাহলে হয়তো পৃথিবীতে মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায় হতো৷ ভাগ্যিস এমন কোন মেশিন আজও তৈরি হয়নি৷ পৃথিবীতে শুধু মানুষ নামক প্রাণীগুলোই এমন৷ দেখতে মানুষের মতো হলেও আসলে এরা সবাই মানুষ নয়৷ কিন্তু পৃথিবীর সব কুকুর, বিড়াল, গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল সব এক৷ উফফ পাঁচটা নরিয়াম খেলাম তারপরও কেন ঘুম আসছে না? শুনেছি তরল কিছুর সাথে মিশিয়ে খেলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসে৷ আমি তো কফিতেই মিশিয়ে খেলাম৷ ছবিতে অভিনয়ের সময় খাওয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ার অভিনয় করি৷ আহ্ অভিনয়ের মধ্যেও যেনো অভিনয়৷ এই ছোট্ট বিষয়টাই যেখানে বাস্তবের সাথে মিলে না বড় বিষয়গুলো আর কি করে মিলবে?

আজ আমার মনে হয় পাঁচটাতে আর হচ্ছে না৷ আরো পাঁচটা ট্যাবলেট কফির সাথে মিশিয়ে স্ট্যাডিরুমে বসে খেতে লাগলাম৷ আবারও ডায়েরি বের করলাম৷ তবে এবার অন্য একটা৷ আসলে কথায় কথায় একদিন অঞ্জনদাকে বলেছিলাম আমার ডায়েরি লেখার খুব শখ৷ তারপর থেকে প্রায়ই তিনি আমাকে ডায়েরি আর কলম গিফট করতেন৷ অনেকগুলো ডায়েরি জমেছে৷ ভাবছি সবগুলোতেই আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে লিখবো৷ ক্যানাডা থেকে আনা দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম দু’টো চল্লিশ বেজেছে৷

রাত ২টা বেজে ৪০ মিনিট৷ সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে৷ তবে কিছু নিশিকণ্যারা তাদের উপার্জনের পথ খুঁজছে৷ আমিও তাদের থেকে আলাদা নই৷ পার্থক্য তারা নিশিকণ্যা আর আমি দিবাকণ্যা৷ উপস আরো পার্থক্য আছে তাদের সমাজ খারাপ দৃষ্টিতে দেখে আর আমাকে সমাজ ভালো দৃষ্টিতে দেখে৷ আচ্ছা তার আর আমার কাজে কোন পার্থক্য আছে? নেই তো৷ তারা হাতে গোণা কয়েকজনকে আনন্দ দেয় আর আমরা দেই অগুণিত লোককে৷ তারা করে সস্তার মেকআপ আর আমি করি ব্রান্ডেড মেকআপ৷ যে কাজ করে সে পতিতা সেই একই কাজ করে আমি সেলিব্রেটি৷ তাকে দেখে লোকে নাক কুচকায় আর আমাকে দেখে অটোগ্রাফ চায়৷ আমিও অটোগ্রাফ প্রার্থীদের হতাশ করিনা৷ ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকুক অঘোষিত পতিতার নাম৷

আজ থেকে কয়েক বছর পর যদি কেউ এটা পড়ে আমাকে থু থু দিবে৷ নিজেকে পতিতা বলছি বলে৷ আমি কি পতিতা নাকি? তারা জানে না আমি কি৷ কিন্তু প্রতিটি অঞ্জনা জানে তাদের রক্ষণশীল অঞ্জনা থেকে সেলিব্রেটি অঞ্জনা হয়ে উঠার গল্প৷ লিখে রাখছি হয়তো আমাকে দেখে আমার আট বছরের মেয়ে অনিতাও চাইবে সেলিব্রেটি হতে কিন্তু আমি চাই ও এই ডায়েরি পড়ুক৷ ও জানুক অঞ্জনারা শুধু অঞ্জনা নয় আরো বেশি কিছু৷ আজ আমাকে আমার সন্তান টিভিতে দেখে চিনে৷ টিভির পর্দাতে আমি সেরা মায়ের পুরষ্কার পাই অথচ আমার সন্তানদের আমি কোনদিন মুখে তুলে খাইয়ে দেইনি৷ একবার আমার সন্তানকে জিজ্ঞেস করুক উত্তর পেয়ে যাবে এ পৃথিবী আমি আসলে মা হিসেবে কতটা ব্যর্থ৷ আমার সন্তান আমাকে দেখে টিভির পর্দায় অন্য কোন বাচ্চাকে আদর করতে, অন্য কোন পুরুষের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে, অন্য পুরুষকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার কথা বলতে শোনে৷ এগুলো কি ওর মনে একটুও আঁচড় কাটে না? ছবিতে বিবাহবার্ষিকী পালন করতে দেখে অথচ আমার বাস্তব বিবাহবার্ষিকী কবে সেটা আমি ভুলে গেছি৷ ওরা জানেনা ওদের বাবা মা শেষ কবে একসাথে হেসেছিলো৷ আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি তার সম্পূর্ণ উল্টোটা পাচ্ছে আমার ছেলে মেয়ে৷

অনিতা আর অর্ণব তোদের জন্যই এ ডায়েরি৷ তোদের দু’জনেরই নাম আমি ইচ্ছে করে আমার সাথে মিলিয়ে রেখেছি৷ ঐ লোকটার ছায়াও তোদের জীবনে দেখতে চাই না৷ জানি এটার পড়ার পর আমাকে তোরা খুব ঘৃণা করবি তবুও তো ভালো মন্দ বিচারটা শিখতে পারবি৷ আমার মতো তোরা নিজেকে ধ্বংসের পথে দিবি না৷ আমি তোদের বড্ড ভালোবাসি কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না৷ বিশ্বাস কর অনিতা আমি যখন অভিনয়ে কোন বাচ্চাকে খাইয়ে দেই, আদর করি তোদের খুব মিস করি৷ তোদের আমি সেভাবে কোনদিন আদর করতে পারিনি৷ জম্ম ঠিকই দিয়েছি কিন্তু মা আর হয়ে উঠতে পারিনি৷ বিশ্বাস কর এতে আমার কোন হাত ছিলো না৷

তোরা তো নিষ্পাপ তোদের কাছে যেতে আমার নিজের ইতস্তত লাগতো৷ যদি আমার পাপগুলো তোদের গায়ে লাগে৷ আমি তো নোংরা হয়ে গেছি৷ এই নোংরাগুলো তোদের গায়ে লাগাতে চাই না তাই দূরে থাকি৷ তোরা কি জানিস তোরা যখন ঘুমিয়ে থাকিস আমি তখন তোদের কাছে যাই৷ ঘন্টার পর ঘন্টা তোদের দেখি ৷ খুব ইচ্ছে করে তোদের জড়িয়ে ধরি৷ তোরা আর তোদের বাবাকে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো৷ ধর সমুদ্রে কিংবা পাহাড়ে৷ কাজের সূত্রে তো কত জায়াগাতেই যাই কিন্তু মন পড়ে থাকে তোদের কাছে৷ আমার গর্ভজাত সন্তানদের একটু একটু করে বড় হওয়াটা আমি দেখতে পারিনি৷ যখন তোরা ছোট সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় তোরা ঘুমিয়ে থাকতি আবার বাসায় ফিরে দেখতাম ঘুমিয়ে পড়েছিস৷ তোদের কি দোষ? বাচ্চারা অতো রাত অব্ধি জেগে থাকতে পারে নাকি? অনিতা মারে একটু যখন বড় হলি মানে কার্টুন দেখার বয়স হলো তখন তুই নাকি একদমই কার্টুন দেখতি না৷ সারাদিন নাকি মাম্মামের ছবি দেখবি৷ সারাদিন আমার ছবির সিডি চলতো বাসায়৷ আমার ছবি হাতে নিয়ে ঘুমাতি৷ আমি এসে দেখতাম৷ খুব কাঁদতাম তোকে সময় দিতে পারতাম না বলে৷ জানিস ওখানে যারা অভিনয় করতো অনেকেই আসতো যেতো কিন্তু আমি যেনো বাঁধা লোক৷ আসতেই পারতাম না৷ তোর প্রতি জম্মদিনে কখনো হাজার টাকার কখনো লাখটাকার উপহারও তোকে দিয়েছি৷ তুইও হেসেছিস কিন্তু আমি জানি সে হাসিতে প্রাণ ছিলো না৷ কোনদিনই আমি নিজ হাতে তোকে উপহার দিতে পারিনি৷ তোর বিছানার পাশে রেখেছি৷ ঘুম থেকে উঠে দেখেছিস৷ হয়তো দেখেই ছুটে এসেছিলি আমাকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু সেখানে পেতি শুধু আমার রাতের বাসি কাপড়৷

আমার খুব ইচ্ছে করে তোর জম্মদিনটা খুব বড় করে করবো৷ ঠিক করেছি তোর দশ বছরের জম্মদিনটাই করবো৷ তোর বাবা হয়তো সেদিনও থাকবে না কারণ তোর বাবা কখন কোথায় থাকে তার নিশ্চয়তা নেই৷ আমি নিজে হাত ধরে তোর সাথে কেক কাটবো প্রথম কেক আমি তোকে খাওয়াবো আর পায়েস রাঁধবো তোর জন্য আর সেটা নিজের হাতে খাইয়ে দিবো৷ তুই জানিস না প্রতিবছর তুই যে পায়েসটা খেতি সেটা আমি রাধতাম৷ ঘৃণা করিস না মা, আমি স্নান করে ঠাকুর পূজো করে তবেই রাধতাম৷ জানি পুরোপুরি পবিত্র হতে পারতাম না কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি৷

আমার উপার্জনের একটা বড় অংশ তোর বাবা নিয়ে যায় তারপরও তোদের দুই ভাইবোনের জন্য আমি টাকা লুকিয়ে রাখি৷ পাপের টাকা বলে ফেলে দিসনা৷ ব্যাংকে রাখলে ঝামেলা তাই ব্যাংকে নয় আমার এই গোপন কুঠুরিতে রাখি৷ তোকে একদিন আমার এই গোপন কুঠুরির সন্ধান দিবো৷ তুই যখন আরেকটু বড় হবি সবকিছু বুঝবি তখন জানতে পারবি৷ তুই বড় অর্ণব ছোট তাই অর্ণবের বিষয়টাও তোর দেখতে হবে৷ তোদের আমি এ দেশে রাখবো না৷ বিদেশ পাঠিয়ে দিবো৷ সুব্রত এর কোন ছায়া আমি তোদের গায়ে পড়তে দিবো না৷ আমি জীবনে যা পারিনি তোরা তা পারবি৷ তোকে পারতে হবে মা৷ আমার এই বারোটা বছরের চোখের পানির দাম তোর বাবার থেকে আদায় করতে হবে৷ বল না মা পারবি না? তোকে আরো অনেককিছু লেখার আছে৷ অন্যকোনদিন লিখবো৷ হাতটা কাঁপছে, চোখে ঝাপসা দেখছি৷ হ্যাঁ ঔষধে কাজ করা শুরু করেছে……..
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here