#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২১.
.
“সাদিকের মুখে তোমার অনেক কথা শুনেছি। তোমার আঙ্কেলও তোমার কথা মাঝে মাঝে বলে, সেদিন আসার পর থেকে। তুমি আসলেই অনেক মিষ্টি মেয়ে।”
আন্টির কথায় লজ্জা লাগলেও অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে যাচ্ছি বারংবার। সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে ভীষণ বিরক্ত লাগছে। মেয়েটাকে দেখে বিরক্ত লাগছে বললে ভুল হবে, মূলত মেয়েটার কান্ডকর্ম দেখে বিরক্ত লাগছে। মেয়েটা সাদিক ভাইয়ার ছোট বোন। দেখে মনে হচ্ছে আমার থেকেও বছর দুয়েকের বড় হবে। বাড়ির ভেতরে আসার পরেই নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের কার্ড এবং সাদিক ভাইয়ার জামা কাপড় গুলো দিয়ে দিলেন তাসফি ভাই। আন্টির সাথে দু’ একটা কথা বলতেই মেয়েটা আসলো বসার রুমে। আমাদের সাথে পরিচয় হবার পর সেই যে তাসফি ভাইয়ের দিকে ক্যাবলাকান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে থেকেই খ্যান্ত হয় নি, থেকে থেকে নানার অযুহাতে কথা বলে যাচ্ছে। যেটা মোটেও ভালো লাগছে না আমার। বজ্জাত লোকটাও কেমন দাঁত কেলিয়ে হেঁসে হেঁসে কথা বলে যাচ্ছে। কই আমার সাথেও তো এতটা হেঁসে হেঁসে কথা বলে না। আসলে ছেলে মানুষগুলো এমনি, সুন্দরী মেয়ে দেখলে বাকি সব ভুলে যায়।
“ইস্! আমার যদি আরও একটা ছেলে থাকলে রিফার সাথে সাথে তোমাকেও আমার কাছে নিয়ে আসতাম। কিন্তু সেই ভাগ্যটা তো আমার আর নেই মা, তবে তোমার বাবা চাচার সাথে কথা বলে আমার বোনের ছেলের জন্য তো আনতেই পারি। কি আসবা না?”
আন্টি আমার এক হাত টেনে নিয়েই কথাটা বলে উঠলেন। সাথে সাথে অবাক চোখে আন্টির দিকে তাকালাম। বসার রুমের সবাই কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে আমার দিকে, এতে লজ্জা আর অস্বস্তিটা যেন আরও বেড়ে গেছে আমার। তাসফি ভাই এদিকে তাকিয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলেন, সাথে বসে থাকা সাদিক ভাইয়াও। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আরেকটা আন্টি এসে আমার কাছে বসলেন। কোন সময় না নিয়েই বলে উঠলেন,
“তুমি একদম আমার মনের কথাটা বলেছো আপা। মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো একে যদি কাছে রাখতে পারতাম। সাদিকের বউয়ের সাথে সাথে একেও নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করো আপা। দুই বোন এক বাড়িতে আসলে ক্ষতি কি?”
তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালাম আমি। কেমন জানি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন, না রাগ, না ক্ষোভ কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আন্টিদের কথাগুলো যে ওনার পছন্দ হয় নি, সেটা ঠিকই বুঝতে পারলাম। কিন্তু হঠাৎই মনে মনে ভীষণ হাসি পেল ওনাকে দেখে।
আন্টিরা আবারও কিছু বলতে চাইলে সাদিক ভাইয়া থেমে দিলেন এবার। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
“তোমাদের কোন কিছুর ব্যাবস্থা করতে হবে না, আমার একমাত্র ছোট শালিকার ব্যাবস্থা অলরেডি হয়ে গেছে। তোমরা না জেনে শুধু শুধু আমার শালিকার সংসারে আগুন লাগাচ্ছো।”
সবাই কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো সাদিক ভাইয়ার দিকে। আন্টি বলে উঠলেন,
“মানে? কিসের সংসার, কিসের আগুন?”
“মানে টা হলো রূপার বিয়ে অনেক আগেই ঠিক হয়ে আছে, আমার বিয়ের পরেই ওর বিয়ের শানাইও বেজে যাবে।”
“কি বলিস এসব? আমরা তো কিছুই জানি না।”
“জানবে কেমনে? এই বিষয়ে কি কথা হয়ছে আগে? কিছু না জেনে অযথা ওদের সংসার শুরু হবার আগেই ভেঙে দিতে চাইছো।”
“ভাইদের বলে যদি ও…..”
“একদমই সেই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো আম্মু। শালিকা আমার দূরে কোথাও যাচ্ছে না, একদম বাড়ির মানুষের কাছে থাকবে।”
এবার বিষ্ময় নিয়ে তাকালো সবাই। একবার আমার দিকে তো একবার সাদিক ভাইয়ার দিকে। জানতে চাইলে কে সে? কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। সবার কথা শুনে হেঁসে উঠলো সাদিক ভাইয়া। বললেন,
“জামাই তো তোমাদের সামনেই বসে আছে। জামাইয়ের সামনেই তার বউয়ের বিয়ে দিতে চাও? এটা কিন্তু ঠিক না আম্মু।”
সাদিক ভাইয়ার কথায় আরেক দফা অবাক হলো সবাই। এবার সবাই আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালো। সকলের দৃষ্টি ওনার উপর পরতেই উনি ফট করে বলে উঠলেন,
“সত্যি আন্টি, আমার সামনেই আমার বউয়ের বিয়ের প্ল্যান করছো, এটা কিন্তু তোমরা মোটেও ঠিক করছো না।”
বলেই একটু থামলেন উনি, আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাসলেন। বলে উঠলেন,
“এমনিতেই ওর বাবা, চাচা, ফুপার অত্যাচারে বউটাকে কাছে আনতে পারছি না, এবার তোমারও যুক্ত হচ্ছো? এমন হলে তো দেখা যাচ্ছে সাদিক নাতি নাতনি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি বাবা-ই হতে পারলাম না।”
চোখ দুটো আপনা আপনিই বড় বড় হয়ে গেল আমার। স্থির হয়ে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। না রাগ, না বিরক্ত, কোন কিছুই যেন আনতে পারলাম না ওনার প্রতি। শুধু ভাবতে থাকলাম, একটা মানুষ ঠিক কতটা নি*র্লজ্জ আর অ*সভ্য হলে এধরণের কথা বলতে পারে? বাসায় বলেন সেটা মানা যায়, কিন্তু এখানে এসেও?
আন্টিরা হেঁসে উঠলো সবাই। আন্টির বলা কথার জন্য আফসোস করতে লাগলো। বাকিরাও এটা ওটা বলতে লাগলো। হঠাৎ কি জানি মনে করে সাদিক ভাইয়ার বোনের দিকে তাকালাম। কেমন জানি মুখটা শুকনো করে আছে। হয়তো তাসফি ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের কথাটা শুনেই মুখটা শুকনো হয়ে গেছে।
.
একটু পরেই সাদিক ভাইয়াদের বাড়ি থেকে চলে আসতে চাইলেও আসতে দিলো না কেউ আমাদের। জানিয়ে দুুপুরের খাবারের পর তবেই আসতে দিবেন আমাদের। অগত্যা থাকতে হলো আমাদের। তাসফি ভাইয়া বাসায়ও জানিয়ে দিলেন আমাদের ফিরতে দেরি হবে।
দুপুরের খাবারের পর প্রায় এক ঘন্টা পর সকলের থেকে বিদায় নিলাম যাবার জন্য। তাসফি ভাইও আমাকে ভবিষ্যতের জন্য অনেক দোয়া করলেন, আমাকে জড়িয়েও ধরলেন। হঠাৎ ছাড়িয়ে নিয়ে গালে হাত দিলেন। চিন্তিত মুখে বলে উঠলেন,
“রূপা মা, তোমার গা এত গরম কেন? জ্বর-টর আসলো নাকি?”
বলেই কোন সময় নিলেন না আন্টি। কপালে গালে হাত দিয়ে দেখতে লাগলেন। চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“তাই তো, জ্বর আসছে বলে মনে হচ্ছে। ইস্! এতক্ষণে একদম খেয়াল করি নি।”
“এটা তেমন কিছু না আন্টি, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। কয়েক সপ্তাহ ধরে এমনি থেকে জ্বর আসছে, আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। সমস্যা নাই।”
“তা বললে কি হয় মা? নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে তো?”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না আন্টি। তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মেয়েটার দিকে একটু যত্ন নিও তাসফি, মনে তো হয় না নিজের কোন যত্ন নেয়?”
“সারাদিন লাফালাফি করে সময় কা*টানোর পর যদি সময় পায়, তবেই তো নিজের যত্ন নিবে, তাই না আন্টি? তাকে তো বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে খাওয়াতে পারলে হয়।”
ওনার কথায় উপস্থিত সকলে হেঁসে উঠলো। রাগে কটমট চোখে ওনার দিকে তাকালেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না যেন। আন্টি হাসতে হাসতেই বলে উঠলেন
“সেটা আর বলতে, আজকে ওর খাওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি। তবে তোমাকেই কিন্তু সামলাতে হবে ওকে।”
“বাচ্চা কাচ্চা বউ বিয়ে করলে তা তো একটু হবেই আন্টি। তবে সমস্যা নাই, একদম মানুষ করে ফেলবো।”
আবারও সবাই শব্দ করে হেঁসে উঠলো। মনে কঠিন একটা গালি দিলেও মুখে কিছু বলতে পারলাম না। মনে হচ্ছে এখুনি গাছের একটা ডাল ভেঙে এলে বারি দিয়ে ওনার মাথা ফাটিয়ে দেই। তবুও যেন এই বজ্জাত লোকটার মুখ একটু বন্ধ হয়।
আরও দু’ একটা কথা বলে বাইকে গিয়ে উঠলাম। তাসফি ভাই সবাইকে বিয়ের দিন অবশ্যই যেন যাও সেটা আবারও জানিয়ে দিলেন। আমাকে ভালোভাবে ধরে বসতে বলেই বাইক স্টার্ট দিলে।
.
“আপনার মুখে কি কিছুই আঁটকায় না, তাসফি ভাইয়া? এত অ*সভ্য কেন আপনি?”
সাদিক ভাইয়াদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূর যেই এক প্রকার ধমকে বলে উঠলাম আমি। উনি কিছু না বলে নিরুত্তর হয়েই বাইক চালিয়ে গেলেন। মেইন রোডে উঠেই হঠাৎ বাইক থামিয়ে দিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে হালকা তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“গায়ে জ্বর আসছে আমাকে বলিস নি কেন? এতটা জার্নি করে না আসলেই তো হতো।”
“আমি কি আসতে চেয়েছি নাকি? আপনাদের জন্যই তো আসতে হলো।”
“গায়ে জ্বর আসছে আগে বললেই তো হতো, বেয়াদব! তাহলেই তো আর তোকে নিয়ে আসতাম না। তোর মাথায় কি কিচ্ছু নেই? গাধী কোথাকার!”
ওনার ধমকে মিইয়ে গেলাম কিছুটা। ইস্! তখন বললেই তো হতো। কিন্তু তখন তো এতটাও জ্বর ছিলো না। এখন বেশি হলে আমি কি করবো? মিনমিনে গলায় আস্তে করে বললাম,
“কিন্তু তখন তো এতটাও জ্বর ছিলো না, আমার কি দোষ?”
জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন উনি। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“শরীর কি বেশিই খারাপ লাগছে?”
সাথে সাথে মাথা ঝাঁকালাম আমি। বোঝালাম না, একদমই শরীর খারাপ লাগছে না। উনি আর কিছু না বলে সামনের দিকে ফিরলেন, ওনাকে শক্ত করে ধরতে বলে আবারও বাইক স্টার্ট দিলেন।
.
জুলাইয়ে মাঝামাঝি সময়। হুটহাট কখন ঝড় বৃষ্টি ও ঠান্ডা আবহাওয়ার আগমন ঘটে তা বোঝা মুশকিল। এতক্ষণে রোদের তুখোড় উত্তাপ থাকলেও কিছুটা এগিয়ে যেতেই মৃদু বাতাসের আগমন ঘটলো। আস্তে আস্তে ধূসর মেঘের নিচে সূর্যটাও চাপা পরে গেল। বাসাতের মাত্রা বাড়তেই গা শিরশির অনুভব হতে লাগলো যেন। হালকা কেঁপে তাসফি ভাই কে জড়িয়ে বুকে থাকা হাতে উঠে খামচে ধরলাম ওনার শার্ট। মিনিট দুয়েকের মাঝে বাইকের গতিটা কমিয়ে এনে এক সময় থামিয়ে দিলেন। জানতে চাইলেন শরীর খারাপ লাগছে কি না? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝালাম। তবুও যে মানলেন না উনি, বাঁকা হয়ে গালে কপালে হাত রেখে আঁতকে উঠলেন যেন। নরম গলায় ধমকের সুরে বললেন,
“শরীর খারাপ লাগছে তবুও মিথ্যা বলছিস কেন? জ্বর তো মনে হচ্ছে আরও বেড়ে গেছে।”
প্রতিত্তোরে কিছু না বলে চুপ করেই রইলাম। শরীরটা সত্যিই কেমন জানি লাগছে, কিন্তু ওনাকে বললেই তো উত্তেজিত হয়ে উঠবেন। এখনো অনেকটা পথ বাকি, মাত্র আধা ঘন্টার পথ পেরিয়ে এসেছি। উনি ভালোভাবে ধরতে বলে আবারও বাইক স্টার্ট দিলেন। ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে ওনার পিঠে মাথা এলিয়ে দিলাম। উনি আগের চেয়েও আরও জোরে বাইক চালাতে লাগলেন।
বাতাসের রেশটা যখন বাড়তে লাগলো, তখন হঠাৎ করেই বাইকটা থেমে গেল। ঝড় বৃষ্টির আগমনী বার্তায় ফাঁকা রাস্তায় কাউকেই নজরে এলো না। তাসফি ভাই দু’ তিন বার বাইক স্টার্ট করার চেষ্টা করতেই যখন হলো না, তখন মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালাম। আরও কয়েকবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন।
“কি হয়েছে? চালু হচ্ছে না কেন?”
বলতেই উনি ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা তাকালেন আমার দিকে। চোখে মুখে অসহায়ত্ব এনে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“কি যে? বুঝতে পারছি না, হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল।”
“এখন কি হবে? মনে তো হচ্ছে এখুনি বৃষ্টি নামবে, কত জোরে বাতাস হচ্ছে।”
“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না? এতক্ষণ তো ভালোই চলছিলো, হঠাৎ কি যে হলো।”
বলেই আরও কয়েকবার চেষ্টা করতে লাগলেন বাইক চালু করার। কিন্তু কোন কাজই হলো না। এর মাঝেই টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগে, সাথে বাতাসের মাত্রা। বৃষ্টির ঠান্ডা পানির ফোঁটা গায়ে পড়তেই গা ঝাঁকিয়ে কেঁপে উঠলাম। সাথে সাথে উনি বলে উঠলেন,
“রুপু তাড়াতাড়ি নাম, দেখি আশেপাশে আশ্রয় নেবার কিছু পাই কি না।”
সময় নিলাম না আমি, নেমে দাঁড়াতেই উনিও নেমে দাঁড়ালেন বাইক থেকে। আমাকে সাথে আসতে বলে বাইকটা ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলেন।
.
.
চলবে…..
সবাই পাঠন মূলক মন্তব্য করবেন, রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। অতিরিক্ত রেসপন্স না করলে পরবর্তী পর্ব বুধবারে দিবো। রি-চেকই দেওয়া হয় নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🙂