তুমি বললে আজ ২ পর্ব -২০

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২০.

.
বাংলাদেশের অভিনেতা জোভানের বিখ্যাত একটা ডায়লগ আছে, ‘আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই, সব দুঃখ হয়ে যায়।’ আমার জীবনটাও ঠিক সে রকমই, কিন্তু কথাটার মাঝে একটু ভিন্নতা আছে। ‘আমি মন দিয়ে যা ভাবি, সব তার উল্টো হয়ে যায়।’ প্রতিটা পদে পদেই সেটা অনুভব করতে পারি। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। গত কয়েক দিনে ভেবেই নিয়েছিলাম তাসফি নামক বজ্জাত লোকটার আশেপাশেও খুব একটা যাবো না, শুধু প্রয়োজন ছাড়া। কিন্তু আজকে সারাদিন ওনার সাথেই কাটাতে হবে। অবশ্য বাইকে করে ঘোরাঘুরিও তো হবে। বাইকে করে ঘোরাঘুরি করার নেশাটা সেই ছোট থেকেই, বাইকে করে কোথাও যাবার কথা শুনলে আর না করতে পারি না। এই অভ্যাসটাও তাসফি ভাইয়ের জন্যই হয়েছে। শুধু গত কয়েকটা বছর-ই তেমন একটা ঘোরাঘুরি করা হয় নি। যেটাও গিয়েছি, সেটা কাজের জন্য রাহাতের সাথে। তাসফি ভাইয়া ছাড়া কেউ সেভাবে বাইকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে নি। তাসফি ভাই ধমকে ধামকে বারণ করলেও আমার বায়নার কাছে একসময় ঠিকই হার মেনে নিয়েছেন, বাইকে করে আমাকে নিয়ে ঘুরিয়েছেন সারা বেলা।

ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা হিজাবটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে চলেছি। এই গরমের মাঝে এতটা জার্নিতে হিজাব বাঁধবো কি না, সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। মিনিট পাঁচেক সেভাবেই ভাবনার মাঝে হঠাৎ দরজা খুলে রুমে ঢুকলেন তাসফি ভাই। আমার দিকে না তাকিয়েই এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠলেন,
“এই কার্ড গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নে, তাড়াতাড়ি চল। দেরি হয়ে যাবে অনেক।”

হাতের কার্ডগুলো বিছানায় রেখে এবার তাকালেন আমার দিকে। অবাক হয়ে আবারও বলে উঠলেন,
“তুই এখনো রেডি হোস নি রুপু? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

“না… মানে, আমি তো….”

“কি মানে মানে করছিস? এতক্ষণ রুমে ঢুকে কি করলি? বেয়াদব! আজকেই কি বিয়ে খেতে যাচ্ছিস, এতো সাজগোজের কি আছে?”

বলেই থামলেন উনি। কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললেন,
“সত্যি করে বল তো রুপু, কার জন্য এত সাজগোছ করছিস? আমার জন্য তো নয়।”

“আজব তো, কার জন্য সাজতে যাবো আমি? আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, সেজেছি?”

“মাথাতেও আনবি না। কি সব আটা ময়দা দিয়ে সাজগোছ করিস, সব আমার জন্যই করবি। তোর ওই পেতনী সাজ দেখে ছোট খাটো হার্ট অ্যাটাক করলেও সহ্য করে নিবো।”

বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল আমার। বলে উঠলাম,
“উফ্! থামবেন আপনি তাসফি ভাইয়া। এমনিতেই বুঝতে পারছি না কি করবো….”

“কি এমন রাজকার্য ভাবছিস যে, কি করবি বুঝতে পারছিস না?”

“এই গরমে হিজাব বাঁধবো কি না, সেটাই বুঝতে পারছি না। সাথে এতদূরের জার্নি।”

আমার অসহায়ত্বে বলা কথাটা শুনে উনি একটু চুপ হয়ে গেলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন,
“চুলগুলো ভালোভাবে কাঠি দিয়ে বেঁধে নে, হিজাব পরতে হবে না আজকে।”

অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। ধমক না দিয়ে এত নরম সুরে হিজাব বাঁধবো বারণ করলেন, সেটা যেন ঠিক হজম হলো না আমার। তবুও মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম, আমার কনফিউশান দূর করে দেবার জন্য।
সময় নষ্ট না করে চুলগুলো আঁচড়ে ঢিলা করে কাঠি দিয়ে বেঁধে নিলাম। ওড়নাটা দু’ কাঁধের পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে ভালোভাবে পিন আপ করে নিলাম। বিছানার কাছে এসে কার্ডগুলো ব্যাগে ঢুকতে ঢুকতে তাসফি ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলাম,
“চলেন তাসফি ভাইয়া, আমার হয়ে গেছে….”

ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই হঠাৎ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। এতক্ষণে যেন ভালোভাবে খেয়াল করলাম ওনাকে। গায়ে কালো রঙের শার্ট, কনুই পর্যন্ত শার্টের হাত গুটিয়ে রাখা, ফর্সা হাতের কালো লোমগুলো খুব করে নজর কারছে, ছোট বড় চুলগুলো আঁচড়ে রাখা তবুও কিছু চুল কপালে এসে পরেছে। একদম হিরো লুক অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার এই চাহনিতে প্রতিটি মেয়েই প্রেমে পড়তে বাধ্য। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হলো না, আবারও হয়তো প্রেমে পরে গেলাম ওনার। হয়তো না, সত্যি সত্যিই প্রেমে পরে গেলাম। টিপটিপ শব্দধ্বনি করে উঠলো বুকে, অদ্ভুত বাজে এক ভাবনা মন ও মস্তিষ্কে খেলে গেল। ছুটে গিয়ে ওনার গলা জড়িয়ে টপাটপ কয়েকটা চুমু খাওয়ার বাসনা জাগলো।

চমকে উঠলাম কিছুটা। ছি! কি সব চিন্তা ভাবনা মাথায় আনছি? সকলের সাথে সাথে আমিও মনে হয় অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। না… না, বাসায় এসে অজু করে আজকেই তওবা করতে হবে। কিছুটা স্বাভাবিক করে নিলাম নিজেকে। আস্তে করে বলে উঠলাম,
“ক্..কি হলো? চলেন… এখন দেরি হচ্ছে না?”

প্রতিত্তোরে কিছু না বলেই হুট করে এগিয়ে এলেন আমার অতি নিকটে। হাত বারিয়ে আলতো করে জড়িয়ে তাকালেন আমার মুখের দিকে, তারপর টপাটপ কয়েকটা চুমু দিলেন দু’ গালে। বিস্মিত হয়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল ওনার কান্ডে। ছটফটিয়ে ওনার থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই মাথাটা একটু নিচু করে গলার ভাঁজে মুখ নিলেন, ঠোঁট দিয়ে টুকরো টুকরো ভাবে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলাম আমি, স্থির হয়ে গেলাম একেবারে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর মাথা উঠিয়ে নিলেন। চোখ দুটো বন্ধ থাকায় দেখতে পেলাম না ওনার চেহারার ভাবভঙ্গি। আবারও গালে আলতো ভাবে স্পর্শ দিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“আমি আবার ভালো মানুষ, তাই এতটুকু তেই কন্ট্রোল করে নিলাম, তা না হলে রিফার বিয়ে ছেড়ে আমাদের বিয়ের আয়োজনটাই সবার আগে হতো।”

বলেই ছেড়ে দিলেন আমাকে। চোখ খুলে হাজারো লজ্জা ও অস্বস্তি নিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। অদ্ভুত হেঁসে তাকিয়ে আছেন। একটু সময় নিয়ে মাথা ঝুকিয়ে এনে বলে উঠলেন,
“তবে এতটাও ভালো মানুষ নই, যে সবসময় নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো।”

.
একরাশ লজ্জা ও অস্বস্তি নিয়ে নিচে এসে গেইটের কাছে এসে দাঁড়াতেই, বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মি. বজ্জাত তাসফি কে চোখে পড়লো। লোকটা যে এতটা বজ্জাত, সেটা ওনার ইনোসেন্ট ফেস দেখে বোঝা বড়ই কঠিন। ওনার সব অ*সভ্যতা কি আমার সামনেই করতে ইচ্ছে হয় কি না, সেটাও বোঝা দায়।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠলেন উনি, তাড়াতাড়ি করে বাইকে উঠে বসতে বললেন। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই আবারও ধমকে উঠলেন উনি।

“যেভাবে হাঁটছিস মনে হচ্ছে দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পেটের মধ্যে তিন চারটা লাফালাফি করছে, এনি টাইম ডেলিভারি হয়ে যাবে।”

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম ওনার দিকে। এই মানুষটার মুখে কি কিছুই আঁটকায় না? কিছু বলার ভাষায় যেন ভুলে গেলাম আমি, ঠিক কি বলবো সেটাই যেন খুঁজে পেলাম না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বললেন,
“কি…. দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কোলে উঠবি? অবশ্য আমার কোন সমস্যা নেই, তুই বললে এখুনি কোলে নিচ্ছি….”

“বজ্জাত লোক একটা, সারাদিন এত অ*সভ্য মার্কা কথা কিভাবে বলতে পারেন আপনি?”

“দিন দিন চরম লেভেলের বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস তুই? কত্তো বড় সাহস তোর রুপু, আমাকে ধমক দিস? না জানি আমার বাচ্চা কাচ্চার কি হাল করিস তুই। আমার ভবিষ্যৎ পুরাই অন্ধকার বানিয়ে দিবি তুই।”

“উফ্! থামবেন আপনি?”

ওনাকে আর বলার সুযোগ দিলাম না। এগিয়ে গিয়ে ওনার কাঁধে হাত দিয়ে বাইকে উঠতে লাগলাম। ওনার হিরো মার্কা বাইকে লাফিয়েই উঠে বসলাম। ওড়না ঠিক করতেই উনি বলে উঠলেন,
“তোরা আসলেই মীরজাফরের বংশধর। তোর বাপ চাচা বউয়ের শোকে শুকিয়ে মা*রার প্ল্যান করছে, আর তুই আমার ঘারে উঠে।”

“সেটাই তো করা উচিত আপনার সাথে। বজ্জাত লোক একটা।”

বিরবির করে কথাটা বলেই ঠিক হয়ে বসলাম। তাসফি ভাই কথাটা ঠিকঠাক ভাবে কথাটা না শুনলেও বলে উঠলেন,
“কি…. কি বললি তুই?”

“কি আবার…. বললাম আমার বাবা চাচা আপনার কি হয়? এভাবে বলছেন কেন? ফাজিল লোক!”

“কি হয় জানিস না? বেয়াদব! শ্বশুর হয় শ্বশুর, আর আমার বাচ্চা কাচ্চার নানা। তোর মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় এগুলো কি ঢুকবে? গাধী কোথাকার!”

“উফ্! অ*সহ্য। যাবেন আপনি, নাকি নেমে যাবো আমি?”

“আচ্ছা…. আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আমার ভালো মানুষ, তাই কিছু বললাম না।”

.
দুই ঘন্টার রাস্তায় প্রায় মিনিট পনের আগেই সাদিক ভাইয়ার গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। এত তাড়াতাড়ি যাবার কারণ ওনার হিরো মার্কা বাইক। আমাকে শক্ত করে ওনাকে ধরে বসতে বলে, সবকিছু উপেক্ষা করে অনেকটা জোরেই চালিয়ে এসেছেন। অবশ্য রাস্তার মাঝে বেশ কয়েকবার থামিয়েছেন আমার জন্য। একভাবে বসে থেকে হাত পা অবশ হয়ে এসেছিলো যেন।

বাড়ির সামনে বাইক থামাতেই লাফিয়ে নেমে গেলাম আমি। ওভাবে বসে থাকা আর যেন সম্ভব হচ্ছিলো না। নেমে দাঁড়াতেই ধমকে উঠলেন তাসফি ভাইয়া। বললেন,
“পেঙ্গুইনের মতো এভাবে লাফাচ্ছিস কেন? বেয়াদব! হাত পা ভেঙে আমার কোলে ওঠার ধান্দা?”

আমি কিছু বলার আগেই একজন মহিলা এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। কোথা থেকে এসেছি সেটা জানতে চাইলেন। তাসফি ভাই বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পরিচয় দিলেন। কিন্তু মহিলার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেলো হয়তো চিনতে পারে নি। পরে সাদিক ভাইয়ার শ্বশুর বাড়ির লোক কথাটা বলতে চিৎকার করে উঠলো, কাউকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। মিনিট দুয়েক পর কাউকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলেন মহিলাটি। সাথের মহিলাটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই হাসি ফুটে উঠলো মুখে। তাসফি ভাইয়া ওনাকে দেখে সালাম নিলেন, আমার দিকে তাকিয়ে আমাকেও ইশারায় সালাম দিতে বললেন। ওনার কথামতো সালাম দিয়েই চুপ হয়ে গেলাম। তাসফি ভাইয়া কথা বলতে লাগলেন আন্টিটার সাথে। ওনাদের কথার মাঝে যতদূর বুঝতে পারলাম এটাই হলেন সাদিক ভাইয়ার মা এবং রিফাপুর শ্বাশুড়ি। তাসফি ভাইকে এর আগেও দেখেছেন বলে চিনতে অসুবিধা হয় নি। আমাদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে ভেতরে নিয়ে যেতে উদ্যোগ হলেন।

.
.
চলবে…..

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালোবাসা সবাইকে।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here