তুমি বললে আজ ২ পর্ব -২২

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২২.

.
বাতাসের দাপটে হেলে হেলে পড়ছে গাছ পালার ডালগুলো, দমকা হওয়ার সাথে বৃষ্টির দাপটও অধিকতর বেড়ে যাচ্ছে। বড় একটা গাছের নিচে বৃষ্টির কবল থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষাটা কিছুতেই হচ্ছে না। বাতাসের দাপটে ঠিকই বৃষ্টির পানিতে গা ভিজিয়ে যাচ্ছে। তাসফি ভাইয়ের হিমশীতল শরীরে জড়িয়ে ধরে, ওনার ভেজা বুকে মুখ গুঁজে থেকে থেকে কেঁপে চলেছি আমি। পানির ঝাপটা শরীরে পরার সাথে সাথে কাটা দিয়ে উঠছে পুরো শরীর, একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছেন উনি আমাকে।
বাইক ঠেলে নিয়ে কিছুদূর আসতেই বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টির মাত্রাটাও বেড়ে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে আশ্রয় নেবার মতো কোন জায়গা না পেয়ে আমাকে দ্রুত পা চালিয়ে আসতে বলে বাইক টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। ততক্ষণে অনেকটাই ভিজে গিয়েছিলাম আমার। আরও একটু আসতেই রাস্তার পাশে এই বড় আকারের গাছটা নজরে আসে। বাইকটা রেখে গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পরেন আমাকে নিয়ে। একটুপর যখন কেঁপে উঠছিলাম তখন ওড়নার পিন দু’ পাশ থেকে খুলে দিয়ে মাথাসহ পুরো শরীর ঢেকে দেন তাসফি ভাই। তারপর জড়িয়ে ধরেন নিজের সাথে। দমকা হওয়ার মাঝেও ওনার আলিঙ্গনে কিছুটা হলেও উষ্ণতা ঘিরে ধরেছে। এভাবে যে কতক্ষণ ছিলাম, ঠিক জানা নেই আমার।
হঠাৎ নিজ থেকে তাসফি ভাই বলে উঠলেন,
“ও শিট! কি করে ভুলে গেলাম এটা আমি?”

হালকা মাথা তুলে তাকালাম ওনার মুখের দিকে। চিন্তিত ভাব স্পষ্ট ফুটে আছে ওনার চোখে মুখে, পুরো মুখ জুড়ে বৃষ্টির ফোঁটায় বিদ্যমান। ওনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে উঠলাম,
“কি হয়েছে?”

“সকালে…. সকালে রাহার আর সাগর বইকটা নিয়ে বেরিয়েছিলো। বলেছিলাম ট্যাং ফুল করে ডিজেল তুলতে, নিশ্চিত ওরা করে নি। আমারই ভুল, আসার সময় চেক করা উচিত ছিলো।”

বলেই থামলেন উনি, একহাত আমার গালে রেখে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“বেশি খারাপ লাগছে?”

মাথা ঝাঁকালাম আমি, বোঝালাম লাগছে না। এমনিতেই ভীষণ চিন্তিত আছেন উনি, এই মানুষটাকে আর চিন্তায় ফেলতে চাই না আমি। কিছু বললেন না উনি, নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। ওনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম,
“এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো কিছুই হচ্ছে না, তার চেয়ে বরং একটু এগিয়ে যাই। এখন তো বাতাসের মাত্রাটাও কমে এসেছে।”

সহসায় কিছু বললেন না উনি। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন,
“হাঁটতে পারবি তো?”

সাথে সাথে মাথা ঝাঁকালাম আমি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার তো কোন মানে হয় না, তার চেয়ে বরং একটু এগিয়ে যাওয়ায় ভালো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেও খুব একটা দেরি নাই। এগিয়ে গেলে যদি কোন কিছুর দেখা মিলে।

.
মিনিট বিশেক হাঁটার পর হঠাৎই শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো আমার। দু’ কদম হাঁটাও যে দুরষ্কর হয়ে উঠলো আমার জন্য। জ্বর জ্বর শরীরে এতক্ষণ বৃষ্টির পানিতে ভেজার পর যেন বরফের ন্যায় জমে যেতে লাগলো পুরো শরীর। তাসফি ভাই হওয়া তো বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। বাইকটা রেখে এগিয়ে এসে ধরলেন আমাকে। গালে হাত রেখে বলে উঠলেন,
“এ্যাই রুপু! রুপু, কি হয়েছে? বেশি খারাপ লাগছে? তাকা আমার দিকে….”

জবাব দিতে পারলাম না আমি ওনার কথার, একবার ওনার দিকে তাকিয়ে মাথা এলিয়ে ওনার বুকে রাখলাম। বৃষ্টির মাত্রাটা কমে এলেও বাতাসের মাত্রাটা কমে নি। এতক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, কালো মেঘের ঘনঘটায় রাত নেমেছে বলে মনে হচ্ছে। মিনিট দুয়েক পর আস্তে করে ডাকলেন আমাকে, কথা না বলে মাথা উঠিয়ে তাকালাম। ওনার অসহায়ত্ব মুখটা দেখে ভাবলাম, না এভাবে ওনাকে চিন্তায় ফেলা যাবে না। এমনিতেই অনেকটা চিন্তায় আছে মানুষটা। নিজেকে শক্ত করে সরে এলাম ওনার থেকে, আস্তে করে বললাম ঠিক আছি আমি, হাঁটতে পারবো। কিছু বললেন না উনি, কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে ছেড়ে দিলেন, ওনার হাত জড়িয়ে হাঁটতে বললেন। গায়ে কিছুটা শক্তি জমিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম ওনার হাতের বাহু ধরে।
আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর সামনে কয়েকটা বাড়ি দেখা গেলো। তাসফি ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ওখানে গিয়ে হয়তো কোন সাহায্য পাওয়া যাবে। আমিও আর দ্বিমত পোষণ করলাম না। এতক্ষণে বৃষ্টির মাত্রাটাও অনেকটা বেরে গেছে, সাথে বাতাসের দাপট।

রাস্তার সাথেই বাড়িটার সামনে বাইকটা এক সাইড করে রাখলেন তাসফি ভাইয়া। এগিয়ে এসে আমাকে আঁকড়ে নিলেন, ওনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে কেঁপে উঠলাম বেশ কয়েকবার। উনি কোন রকম দু’হাতে আমাকে আগলে নিয়ে এগিয়ে এলেন দরজার কাছে। এক হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজায় ধাক্কাতে লাগলেন। দরজার উপরে খরের চালা দেওয়ায় বৃষ্টি গায়ে পড়া থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেলাম। কিন্তু বাতাসের ঝাপটায় ঠান্ডার রেশটা দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হতে লাগলো।
বার কয়েক ধাক্কা দিলেও দরজা খুললো না কেউ। বৃষ্টির শব্দে হয়তো শুনতে পেল না কেউ। তাসফি ভাই করুন চোখে তাকালেন আমার দিকে। অসহায়ত্ব গলায় বলে উঠলেন,
“এখন কি করবো?”

আমি আস্তে করে বললাম চলে যাই। উনি প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। মিনিট দুয়েক পর সেখান থেকে চলে আসতে নিতেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ এলো, সাথে ভেসে উঠলো অপরিচিত এক কণ্ঠেস্বর।

“কে আপনারা, কাকে চাই?”

দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন এক মাঝ বয়সী লোক। কথাটা শুনেই সময় ব্যায় করলেন না তাসফি ভাইয়া। সাথে সাথে বলে উঠলেন,
“অনেক বিপদে পড়েছি চাচা, মাঝ রাস্তায় বাইকটা বন্ধ হয়ে গেছে, হয়তো তেল নেই। সাথে এই ঝড়বৃষ্টি।”

লোকটা পরখ করে দেখতে লাগলেন আমাদের। হয়তো ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না আমাদের। হুট করে ঝড়বৃষ্টির রাতে এমন অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস না করাটাই স্বাভাবিক। যদিও এখন রাত না বলে সন্ধ্যা রাত বলা চলে। মাঝ বয়সী লোকটা কিছু বলার আগেই তাসফি ভাইয়া বলে উঠলেন,
“যদি একটু সাহায্য করতেন চাচা। ওর অনেকটা জ্বর, এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।”

“কে…. কে আইছে মিনুর বাপ?”

বলতে বলতে মাঝ বয়সী একটি মহিলা এগিয়ে এলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে আবারও লোকটাকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইলে, কে এগুলো। লোকটাও তাসফি ভাইয়ের বলা কথাগুলো বলে গেলেন। যতদূর মনে হলো ওনারা স্বামী স্ত্রী। আমাদের দিকে তাকিয়ে আন্টিটা তাসফি ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“তা বাপু বিপদে পরছো ভালা কথা, সাহায্য করমু। কিন্তু আজকালকার যে যুগ আইছে বাপু, কাউরেই বিশ্বাস নাই।”

“আপনারা যেমনটা ভাবছেন তেমন না, প্রয়োজনে টাকা দিবো। তবুও একটু সাহায্য করেন চাচী, মেয়েটার গায়ে অনেকটা জ্বর, এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।”

এবার কিছুটা নরম হয়ে এলেন উনি। বললেন,
“তা এই মাইয়া তোমার কি হয়? দেখো বাপু, পরে কিন্তু কোন ঝামেলায় পড়তে পারমু না।”

“ও আমার বউ! আই থিক সমস্যা হওয়ার কোন কথা নয়?”

সময় না নিয়ে ফট করে বলে বলে উঠলেন উনি। চমকে উঠলাম আমি। ‘আমার বউ’ কথাটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতে লাগলো আমার কানে। মাঝ বয়সী লোকটা বলে উঠলো,
“সত্যিই অনেক বিপদে পরছে মিনুর মা, দেখো না জিভা কি হয়ছে। ঘরে নিয়া চলো ওদের।”

“হু.. হু আসো ভিতরে। আহারে মাইয়াডা কাঁপতাছে কেমনে। কিছু মনে কইরো না বাবা, গায়ের মানুষ আমরা, থাকি রাস্তার সাথে একলা বাড়িডে দুইডা মানুষ, অচিন মানুষ দেখলে একটু তো ভয়ডর লাগবোই।”

“না… না চাচী কিছু মনে করি নি, এটাই তো স্বাভাবিক।”

বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আঙ্কেলটা বললেন বাইকটাও ভেতরে আনতে। তাসফি ভাই তাতে সায় দিতেই আন্টি এসে আমাকে ধরলেন, নিয়ে গেলেন একটা রুমে। ছোটখাটো দুই রুমের মাটির বাড়ি। রুমে নিয়ে গিয়ে মোছার জন্য একটা গামছা এনে দিলেন। জামা কাপড় পাল্টে নিতে বলতেই খেলাল হলো পড়ার মতো তো কিছু নাই, আন্টি কিছু না বলে বেরিয়ে গেলের রুম ছেড়ে। মিনিট দুয়েক পর একটা শাড়ি, ব্লাউজ আর ছায়া এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন শাড়িটা তার নিজের, বর ব্লাউজ আর ছায়া ওনার মেয়ের। মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় জামা কাপড়গুলো এখানে নে, আগের যেটা ছিলো সেটায় নিয়ে এসেছেন। আমাকে পাল্টে নিতে বলে বেরিয়ে গেলেন আন্টি, দূর্বল শরীরে কিছুটা শক্তি জুগিয়ে জামাটা পাল্টে নিতে লাগলাম। শাড়ি পড়াটা শেষ হয়ে এলেই ঘরে ঢুকলেন তাসফি ভাই। সোজা আমার কাছে এসে দাড়ালেন। গায়ে হাত দিয়ে দেখতে লাগলেন শরীরে তাপের মাত্রাটা। বলে উঠলেন,
“জ্বর তো আরও বেরে গেছে, অনেক খারাপ লাগছে? বিছানায় শুয়ে পর, আমি দেখি চাচা চাচীকে বলে ওষুধের ব্যাবস্থা করতে পারি কি না।”

“উহুম…. লাগবে না।”

অস্পষ্ট সুরে বলেই ওনার বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম, থেমে থেমে কয়েকবার কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। উনি কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন আমাকে, জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। ওনার বুকে মাথা গুঁজেই অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“তখন ওটা বললেন কেন?”

“কখন? কি বলেছি?”

“তখন কেন বললেন, আমি আপনার বউ?”

সহসায় জবাব দিলেন না উনি। আগের চেয়েও শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। আমার কানের কাছে মুখটা এগিয়ে এনে বললেন,
“যেটা সত্যি সেটাই তো বলেছি। তুমি তো আমার বউ। আমার একমাত্র বিয়ে করা বউ।”

টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠলো আমার বুকে, সেটা টিপটিপ শব্দের ধ্বনিটা হয়তো ওনার কানেও গেল। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেল আমার শরীর ও মন জুড়ে। সত্যিই তো আমি ওনার বউ, উনি তো আর মিথ্যে কিছু বলেন নি। অনেক আগেই তো ওনার সাথে বিয়ে নামক সেই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। জুড়ে গিয়েছি একে অপরের সাথে।

.
.
চলবে…..

#বিশেষ_বার্তাঃ কেউ এরিয়ে যাবেন না লেখাটা। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগায় দু’দিন থেকে আমি কিছুটা অসুস্থ। আজকে সকাল থেকে অবস্থা খারাপ একটু বেশিই বলে মনে হচ্ছে। নিশ্বাসের সমস্যা হওয়ার কারণে এন্টিবায়োটিক খেতে হচ্ছে, যার ফলে দূর্বলতায় ঘিরে হাত পা কাঁপছে শুধু। আজকে অনেক কষ্টে অনেকটা সময় নিয়ে লিখেছি। আজকের পর্বটা একদম খাপছাড়া হয়েছে।
তাছাড়াও আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সিজন ১ এর মতো করে তাসফির ভালোবাসার গভীরতা সিজন ২ এ আমি তুলে ধরতে পারছিনা। তাসফির ঠোঁট কা*টা কথা, দুষ্টুমি, অভিমান গুলো প্রকাশ পেলেও তাদের ভালোবাসাটা ঠিক ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না। সিজন ১ যারা ভালোভাবে পড়েছেন, তারা বিষয়টা ধরতে পারবেন, আশা করি। গল্পের এলোমেলো ভাবটা গুছিয়ে নিতে আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। তাই ভেবেছি ৩-৪ দিন গল্পটা দিবো না। কয়েকদিনে সুস্থ হয়ে, গল্পের এলোমেলো ভাবটা গুছিয়ে এনে তবেই দিবো। আশা করি কেউ ভুল বুঝবেন না। সুস্থ থাকলে আগামী শনিবার থেকে আবারও রেগুলার দিবো ইনশাআল্লাহ।

আজকের পর্বে অনেক ভুল থাকতে পারে, ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালোবাসা রইলো সবাইকে।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here