তোকে দিয়েছি মন পর্ব ১৩+১৪

তোকে_দিয়েছি_মন💔
১৩.১৪
পর্ব – ১৩
Writer: Sidratul muntaz

জায়মা আমার দুই গাল শক্ত করে ধরে বলল—

তারু তুই ঠিকাছিস??

আমি চোখ পিটপিট করে অস্পষ্ট ভাবে বললাম–

উনি তোকে কোলে তুলে নিলেন??

জায়মা আমার গাল ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে নিল। মাথা নিচু করে বলল–

হুম।

বুকের মধ্যে টনটন ব্যথা করছে। সেই ব্যথার কষ্ট চেপে রেখে বললাম— তারপর কি করেছে??

কথাটা বলতে বলতে হালকা কেদে উঠলাম আমি। তারপর নিজের কান্না সামলে রেখে জায়মার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। জায়মা কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল–

তুই আর আমি মাঝে মাঝে ঝিলপাড়ে আড্ডা দিতে যেতাম না?? ঝিলপাড়ের জঙ্গলের ভিতরের জায়গাটার দিকে অনেক গুলো আসন পাতা থাকে খেয়াল করেছিস কখনো?? জায়গাটা খারাপ বলে সেখানে আমরা যেতাম না। মনে আছে?

আমি হ্যাসূচক মাথা নাড়লাম। কথা বলার শক্তিটুকুও পাচ্ছিলাম না। গলার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে কান্নাগুলোও বেরিয়ে আসতে চাইছে। যেগুলো আমি খুব ধৈর্য্য ধরে আটকে রেখেছি। সেই কান্না নামক কষ্ট গুলো যেন রীতিমতো যুদ্ধ করছে আমার গলা ছেদ করে বেরিয়ে আসার জন্য। অশ্রু হয়ে বৃষ্টির মতো ঝরে যেতে চাইছে কষ্ট গুলো। কিন্তু আমি ঝরে যেতে দিচ্ছি না। জোর করে হলেও চেপে রাখছি। এখনো কষ্টের পাল্লা আরো অনেক ভারি হওয়া বাকি। সব কষ্ট একসাথে বিসর্জন দিতে চাই আমি। কিন্তু সেটা হবে কি?? তার আগেই বরফের মতো জমে যাবে না তো কষ্ট গুলো?? অলরেডি জমতে শুরু করেছে। তাইতো গলার উপরের অংশটা এমন যন্ত্রণা করছে। যেন শুকনো কাঠ গলায় বিধে আছে আমার।

জায়মা আবার সেই বিষাক্ত শব্দগুলি আওরাতে লাগল। আমার শুনতে ভীষণ ভয় হচ্ছে। কষ্ট পাবার ভয়। এতো আঘাত মেনে নিতে পারবো তো আমি??

— ইশান ভাইয়া আমাকে কোলে তোলার আগে ওই রাস্তাটাই অতিক্রম করছিলাম আমরা। উনি হুট করেই আমাকে কোলে নিয়ে একটা আসনের উপর বসিয়ে দিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। উনি আমার হাতে হাত রেখে কেমন অন্যরকম একটা দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখছিলেন। উনার সেই চাহনি তে ছিল অন্যরকম এক বার্তা। যেটা উপেক্ষা করা আমার জন্য কঠিন ছিল।

আমি অবাক দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালাম। আমার তাকানো দেখে সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মাথা নিচু করল। বুঝতে পারলাম বিশ্বাসঘাতকা করেছে। ওর চোখের মধ্যে বিশ্বাস ভাঙার অনুশোচনা টা স্পষ্ট দেখতে পারছি আমি। জায়মা বিব্রত হয়ে বলল–

হ্যা তারু আমি স্বীকার করছি আমার মন বদলে গিয়েছিল। আমিও উনার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম। তোর কথা একবারের জন্যেও মনে হয়নি তখন। ভেবেছিলাম উনি তো আমাকে ভালোবাসে….. তাহলে তোর কেনো হবে?? আমিই উনাকে ডিজার্ভ করি। তুই নস।

জায়মার কথায় চোখ বন্ধ করে দাতে দাত চেপে ধরলাম আমি। শেষ মেষ জায়মাও?? অবশ্য এতোবড় কষ্টের কাছে এই কষ্ট টা কিছুই মনে হচ্ছে না। এখন যদি জানতে পারি তারিফ ভাইয়াও এসবের সাথে জড়িত….. তাহলেও হয়তো অবাক হবো না আমি। কারণ বিশ্বাস নামক জিনিসটাই যে উবে গেছে আমার। এই চূ্ণ বিচূর্ণ মনটা জীবনে আর কোনোদিন কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে কিনা আমি জানিনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাপা আর্তনাদগুলোকে দমিয়ে রাখার ছোট্ট প্রচেষ্টা চালালাম। অজান্তে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল গুলো এবার মুছে নিয়ে জায়মার দিকে তাকালাম। সে হয়তো বুঝতে পারল আমি বাকিটা শুনতে চাইছি। তাই আবারও শুরু করলে বিশ্বাসঘাতকতার গল্প বলা–

উনি আমাকে প্রপোজ করেছিলেন। এই লকেট টাও তখনি দিয়েছিলেন আমাকে। (লকেটে হাত দিয়ে)

আমি একবার চিন্তা করলাম ইশান ভাইয়ার ব্যাগ চেক করব। আরো কত লকেট এইরকম লুকিয়ে রেখেছে কে জানে?? আর কত নিষ্পাপ মেয়ের মন ভাঙার কারণ হয়েছে উনি?? আর কার কার অভিশাপ মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন??? যদিও আমি চাইলেও উনাকে অভিশাপ দিতে পারছি না। উনাকে ঘৃণা করতে পারছি না। এটাই তো আমার কষ্টের মূল কারণ। যেদিন উনাকে সত্যিই ঘৃণা করতে পারবো….. সেদিন হয়তো মনের এই যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি পেয়ে যাব।

— তারু??

আমি ঘোর কাটিয়ে উত্তর দিলাম– হ্যা তুই বল।

জায়মার দিকে তাকাচ্ছি না আমি। কারণ জানি আমি ওর দিকে তাকালে ও অপ্রস্তুত হয়ে যাবে। এমন একটা ঘৃণ্য কাজ করে ফেলেছে সে। যে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস টুকুও যোগাড় করতে পারছে না। জায়মার কথার শব্দ কানে আসতে লাগল–

আমি ইশান ভাইয়াকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করেছিলাম। আসলে আমার মনের মধ্যে একটা অহংকার জন্মে গিয়েছিল। যে ইশান ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে! সেই অহংকারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তখন এইটাই ভুলে গিয়েছিলাম যে অহংকারই পতনের মুল। তারিফ ভাইয়ার হলুদ সন্ধ্যায় বারবার লাইট অফ হয়ে যাচ্ছিল মনে আছে??

আমি গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম — হুম।

সেইটা কিন্তু ইশান ভাইয়ার জন্যই হচ্ছিল। উনি ইচ্ছে করেই বারবার লাইট অফ করে আমাকে….( থেমে গিয়ে) আমিও বিষয়টা খুব ইনজয় করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম উনি আমার জায়গায় তোকে…..( কেদে দিয়ে)। আমি উনার কাছে এর কৈফিয়ত চাইলে উনি বললেন “তোকে” নাকি “আমি” ভেবে নিয়েছিলেন।

আমি শব্দ করে বললাম— আমাকে “তুই” কি করে ভাবল?? আমি পড়েছিলাম শাড়ি। খয়েরী শাড়ি। আর তোর গায়ে ছিল হলুদ কামিজ।

সেটা আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বলেছিলেন অন্ধকারে বুঝতে পারেনি। কিন্তু তবুও আমার সন্দেহ হয়। আর তারপর যখন রাতের বেলা মাঠে আড্ডা দেওয়ার সময় তুই চা নিয়ে এসেছিলি? উনি তোর দিকে কিভাবে যেন তাকাচ্ছিল। গান গাওয়ার সময় তুই চলে যেতে চাইলে উনি বাধ সেধে বলেছিলেন তারা না দেখে গান গাইতে পারেন না। কেউ না বুঝলেও আমি বুঝেছিলাম যে তোকে বলেছে। এই নিয়ে উনার সাথে সেদিন রাতে অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছিল আমার। আর তারপরেই…..

তারপর কি??

জায়মা মুখ কুচকে বলল–

তারপরের টা না হয় নাইই জানলি! কিন্তু এরপরের দিন আমি নিজেকে একটা কুঠুরিতে আবিষ্কার করলাম। খুব অন্ধকার একটা গুহা। এতোটাই অন্ধকার….. যেখানে বেঝাও যায়না দিন নাকি রাত! দম বন্ধ হয়ে আসে। বিদঘুটে পরিবেশ। ভয়ংকর অবস্থা।

কথাগুলো শুনে একটুও অবাক লাগছে না আমার। এখন যেন কোনোকিছুতেই যায় আসছে না আর। ভেতরটা অনুভূতি শুন্য হয়ে পরেছে। পাথর হয়ে গেছি আমি।

আমি বললাম– তারপর কি হয়েছে??

–ওইখানে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল। নিশ্চিত জানতাম না যে কে আমায় আটকে রেখেছে। কিন্তু আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে এইটা কার কাজ হতে পারে। ইশান ভাইয়া আমাকে কেনো এইরকম জায়গায় আটকে রাখলেন তার কারণটাও পরিষ্কার ছিল আমার কাছে। কারণ তুই তখন উনার টারগেট হয়ে গিয়েছিলি। যেখানে আমি ছিলাম এক বড় বাধা। আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে উনি মেরে ফেলবে। জীবনটা এইখানেই শেষ। কিন্তু আমার জীবন শেষ হয়নি। পালিয়ে আসতে পেরেছি আমি। বেচে ফিরতে পেরেছি। আর তোকেও বাচাতে চাই এবার। ( আমার গায়ে হাত দিয়ে) তোর তো এখনো কোনো ক্ষতি হয়নি। ( একটু থেমে) উনি তোকে কিস করেছে তাইনা??

আমি একটু চমকে উঠে বললাম– হ্যা…..কিন্তু তুই কি করে বুঝলি??

— অনেক কিছুই বুঝি এখন তারু! তোর ঠোটের আচড় দেখেই বুঝে গিয়েছি।

অজান্তেই ঠোটে হাত রাখলাম আমি। নিজেকে এবার ভীষণ নোংরা লাগছে আমার। বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে। নষ্ট মনে হচ্ছে। কেনো এমন হয়ে গেল?? আজকের দিনটা কেনো আসলো আমার জীবনে?? যদি কোনোভাবে এই দিনটা জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারতাম! কতই না ভালো হতো! কিন্তু সেটা সম্ভব না। আমি চাইলেও এই দিন মুছে ফেলতে পারব না। আর না পারব এই দাগ মুছে ফেলতে। এই দাগ টা তো খুব ছোট….. কিন্তু মনের ভিতরটা যে বিশাল বিশাল ক্ষতের সমন্বয়ে ঢেকে আছে…. সেটা কিভাবে সরাবো আমি?? মুখে হাত দিয়ে কাদতে লাগলাম। খুব রাগ লাগছে। ঘৃণা লাগছে। নিজেকে…..নিজের আশেপাশের সবকিছু ঘৃণা লাগছে। বিষের মতো লাগছে সবকিছু। কি বিষাক্ত!! আমি জোরে চিৎকার করে টেবিলের উপর ল্যাম্পটা লাথি মেরে ফেলে দিলাম।

তোকে_দিয়েছি_মন💔
পর্ব – ১৪
Writer : Sidratul muntaz

টেবিল ল্যাম্পটা ফ্লোরে পড়ে যাওয়ায় খুব তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ সৃষ্টি হল। ফ্লোর গড়িয়ে যেতে যেতে আলমারির কোনার সাথে বারি খেয়ে আরেকটু শব্দ তরঙ্গ কানে বেজে উঠল। ল্যাম্পের মাথাটা ভেঙে পড়ে আছে…. ভিতরে থাকা কাচের বাল্ব টা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ঠিক আমার মনটার মতোই। মুখে হাত দিয়ে ভেঙে পড়ে থাকা ল্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। ভাঙচুর জিনিসটা সবথেকে অপছন্দ আমার। কেউ কিছু ভুল করে ভেঙে ফেললেও কমপক্ষে এক সপ্তাহ সেই জিনিসটার জন্য আফসোস লাগে মনে। কিন্তু এখন তো সেই মনটাই ভেঙে গেছে…. তাই আফসোস টা আর লাগছে না। পুরো ঘরে যা কিছু আছে সব ভেঙে ফেললেও কোনো আক্ষেপ থাকবে না আমার। বরং এতেই শান্তি লাগবে। খুব শান্তি!! হঠাৎ খেয়াল করলাম মা আর দাদী দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। হয়তো আমার চিৎকারের আওয়াজ…. আর এই ভাঙাভাঙির শব্দ শুনেই ছুটে এসেছে। বুড়িটা কোমড়ে হাত রেখে মুখ বাকা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মায়ের চোখে মুখে আতঙ্ক। মাকে দেখেই মনে পরল আমার চেহারা অবস্থা। সাথে সাথে শাড়ির আচলটা দিয়ে মুখটা ভালোভাবে মুছে নিলাম আমি। সোজা হয়ে বসে চেহারার অঙ্গভঙ্গি স্বাভাবিক করলাম। খুব কষ্ট হচ্ছে মায়ের কাছে মনের ব্যাথাগুলো আড়াল করতে। ইচ্ছা করছে মাকে হুড়মুড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে কাদতে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে। কপালে চুমু একে দিবেন। তারপর আমি ঘুমাবো। খুব শান্তিতে ঘুমাবো। আর সকালে উঠে দেখবো….. এই সবকিছু স্বপ্ন ছিল…। ইশান….জায়মা নামের কেউ নেই আমার জীবনে। আমি এখনো ছোট। বাবাও বেচে আছেন। আবার সেই আট বছর বয়সে ফিরে যাব আমি। কতই না সুন্দর জীবন ছিল তখন। বাবা,, মা,, ভাইয়া আর ছোট্ট আমি মিলে ছিল আমাদের সোনার সংসার। যেখানে কষ্ট নামক জিনিসটার কোনো ঠাই ছিল না। যেখানে সবাই আমাকে সত্যি ভালোবাসতো। কেউ মিথ্যে ভালো বাসার নাটক করতো না। বিশ্বাস টা ছিল প্রবল। বাবা আর ভাইয়ার হাত ধরে তো আমি জাহান্নামেও চলে যেতে পারতাম….. এই বিশ্বাস নিয়ে যে তারা আমার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। সেদিন ইশান ভাইয়ার হাত ধরে পাহাড়ে উঠেও যে একইভাবে ভরসা করে ফেলেছিলাম উনাকে। ভেবেছিলাম উনিই হয়তো আমার জীবনের সেই তৃতীয় পুরুষ। যে আমাকে ভাইয়া আর বাবার মতোই ভালো বাসে। কিন্তু আমার সেই ধারণা কতটা ভুল ছিল…… ভাবতেই ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছে আমার। কেনো এতোটা বোকা আমি?? মানুষ আমাকে মুখোশের আড়ালে থেকেই ঠকিয়ে যায়….অথচ আমি টেরও পাইনা। বাবা তুমি না বলতে আমি তোমার সাহসী মেয়ে?? আমাকে সাইকেল কিনে দিয়ে বলেছিলে একদিন শুধু সাইকেল না….. প্লেনও চালাবো আমি। ডিফেন্সে যাব। আমাকে পাইলট বানাবে। তোমার সেই স্বপ্ন যে পুরণ হবে না বাবা!! তোমার ছোট্ট মেয়েটা যে এখনো সেই ছোট্টই রয়ে গেছে। এখনো নির্মম বাস্তবতাটা মেনে নিতে শেখেনি সে। যেই ছোট্ট মেয়েটার কান্না শুনলে তোমার বুকে ব্যথা হতো….. সেই ছোট্ট মেয়েটা যে এখনো কাদছে! আজও কি বুকে ব্যথা হচ্ছে তোমার বাবা?? তুমি কি শুনতে পারছো আমার আর্তনাদ?? তাহলে কেন ছুটে আসছো না আমার কাছে?? কেনো কোলে তুলে নিয়ে বলছো না — কাদে না তারু মা! বাবা এসে গেছে। এখন আমরা মেলায় যাব। পুতুল কিনবো। আজ আমায় পুতুল কিনে দেবে না বাবা?? আমার কান্না থামানোর জন্য ছোট্ট পাখিটার গল্প শোনাবে না?? সেই ছোট্ট পাখিটা কি তার বাসা খুজে পেয়েছিল?? খুব জানতে ইচ্ছে করছে বাবা! আজ তোমার কাধে মাথা রেখে সেই অবুঝ দিনের গল্পগুলো শুনতে ইচ্ছে করছে। বিশ্বাসঘাতকতার গল্প শুনে শুনে এই কানটা যে বিষিয়ে উঠেছে…. তোমার আদুরে গলায় গল্প শুনে কানগুলো আজ রেহাই পেতে চায়। ক্ষতবিক্ষত মন টা তৃপ্ত হতে চায়। তোমার ছোট্ট তারু আরেকবার সেই ছোট্ট তারুই হতে চায়। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমায় একা রেখে চলে কেন গেলে বাবা?? একবারও কি ভাবলে না তোমার ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে এই কঠিন জীবনে লড়াই করে বেচে থাকবে?? মানুষ যে আমার মন নিয়ে খেলছে বাবা। এই কোমল মনটাকে আঘাতে আঘাতে ভরিয়ে দিচ্ছে। আমি তো সহ্য করতে পারছি না। খুব ইচ্ছে করছে তোমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে সব কষ্ট ভুলে যেতে। আমায় নিয়ে যাবে বাবা তোমার সাথে?? নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে বেচে থাকার ইচ্ছে আমার নেই। ঘৃণা লাগছে বাবা। এই পৃথিবীটাকে আজ সত্যিই ঘৃণা লাগছে। আস্তো এক আবর্জনার স্তুপ মনে হচ্ছে পৃথিবীটাকে। যেখানে ভয়ংকর সব কীট পতঙ্গের বসবাস। এই কীটগুলো যে তোমার ছোট্ট মেয়েটাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে নিচ্ছে….তাদের ধারালো দাতের আঘাতে ছিন্নবিন্ন হয়ে যাচ্ছে তোমার মেয়েটা। আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাও বাবা! তোমার সাথে নিয়ে যাও।
চোখ দিয়ে অবিরত নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে আমার। বাবাকে খুব বেশি মনে পড়ছে আজ। বাবার মুখের অমায়িক হাসিটা দেখার জন্য পুরো পৃথিবী দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কখন যে শব্দ করে কাদতে বসেছি…. তা নিজেও টের পাইনি। দাদীর কথার আওয়াজে সেই খেয়াল আমার হল। দাদী মাকে উদ্দেশ্য করে খুব ধারালো গলায় বলছেন–

দেখছোনি কারবার?? তোমার মাইয়ারে তো বানাইসো নবাবজাদী! দুলালি!! ওহন বিয়ার কতা হুইন্না কেমন আয়োজন কইরা কানতে বইসে। ওই তারু!! যতই কান্দোস আর ভাঙ্গাভাঙ্গি করোস না কেন…. বিয়া কিন্তু হইবোই। আর এই পোলার লগেই হইবো। বেশি তেরিবেরি করলে ওক্ষনি বিয়ার ব্যবস্থা করাম আমি। আইজকাই হেরা কাবিন কইরা তুইলা লইয়া যাইবো। তারপর শশুরবাইত যায়া সারাদিন কান্দিস।

আমি অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। মা দাদীকে বললেন–

মা আপনি এখান থেকে যান। তারুকে আমি বুঝিয়ে নিয়ে আসছি। আপনি ততক্ষণে মেহমানদের সাথে বসেন। ওদের মধ্যে কেউ যেন এদিকে না আসে।

তোমার মাইয়ারে আগে কান্দোন থামাইতে কও। মাইনসে কি কইবো?? এতোবড় মাইয়া বিয়ার কতা হুইনা কান্দে!! পোলার মা বাপ শুনলে কি মনে করবো??

আচ্ছা মা আমি বুঝিয়ে বলছি তো! আপনি যান। প্লিজ।

বুড়ি কোমরে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে দেখতে চলে গেল। মা আমার কাছে এসে আমাকে জরিয়ে ধরল একবার। মাকে পেয়ে যেন কষ্ট গুলো আরেকবার কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো। আবার কাদতে লাগলাম আমি। হু হু করে কাদতে লাগলাম। মায়ের পরনে শাড়িটাও ভিজে যেতে লাগল আমার চোখের পানিতে। আজ মনে হচ্ছে মা বাবার থেকে আপন কেউ হয়না। তারা আর যাই করুক কোনোদিন ধোকা দেয়না। বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তাদের ভালোবাসাটাই যে একমাত্র স্বর্গীয় ভালোবাসা। যে ভালো বাসায় কোনো খাদ থাকে না। মা আমি তোমাকে খুব ভালো বাসি। বাবাকেও খুব ভালোবাসি। তোমরা আমাকে কোনোদিন কষ্ট পেতে দাওনি। বরং আমার কারণে নিজেরা কষ্ট পেয়েছো। অনেক জ্বালিয়েছি তোমাদের। আর তোমরা হাসিমুখে সব জ্বালানো সহ্য করে গেছো। তোমাদের আদরের একমাত্র মেয়ে কিনা আমি!! সেই মেয়েটাই যে আজকে খুব কষ্ট পাচ্ছে মা। আমার কষ্ট টা ভুলিয়ে দাও না মা। আর যে সহ্য হচ্ছে না। দাতে দাত চেপে আনার কান্নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আর্তনাদগুলো মা বুঝতে পারলো কিনা জানিনা। কিছুক্ষণ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জায়মাকে উদ্দেশ্য করে মা বলল—

জায়মা! তোকে না বললাম তারুকে একটু সাজিয়ে দিতে?? আর তুই কিনা বসে বসে ওর কান্না শুনছিস?? ও এতো কাদছে আমাকে ডাকলি না কেনো?? আমি বুঝিয়ে বলতাম! পাত্রপক্ষ যে কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। আর এদিকে মেয়েটার চোখমুখের কি অবস্থা হয়ে আছে।

আমি মায়ের কথা শুনে মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জায়মার দিকে তাকালাম। জায়মার ভাবভঙ্গি দেখে যা বুঝলাম…..জায়মা বিয়ের কথা আগে থেকেই জানতো। আচ্ছা এইটা না হয় মেনে নেওয়া যায়। এতোবড় একটা ধোকা যে দিতে পারে…. তার কাছে এ আর এমন কি?? কিন্তু তাই বলে মাও??? মাও জানতো বিয়ের কথা?? অথচ আমাকে একবারও বললো না? হায়রে জীবন! শেষমেষ মা পর্যন্ত রেহাই দিল না আমাকে?? বিশ্বাস নিয়ে মাও ছিনিমিনি খেলল?? এখন নিজেকে সত্যি আস্তো একটা গাধা মনে হচ্ছে। আশেপাশে সবাইকে নিজের শত্রু মনে হচ্ছে। সবাই শত্রু আমার। সবার চক্রান্তে আজ এই মন টা ভাঙতে ভাঙতেও ক্লান্ত হয়ে গেছে। মা নামক মমতাময়ীও যে আমার শত্রু হতে পারে ভাবতেও গা টা শিউরে উঠছে আমার। আমার এমন কান্না দেখে মায়ের যেন কোনো আক্ষেপ হচ্ছে না…..কোনো কষ্টই হচ্ছে না…. বরং মায়ের আক্ষেপ টা কোথায়?? পাত্র পক্ষ অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছে। এই জায়গায় মায়ের চিন্তা…..অথচ তার নিজের মেয়ের মনের অবস্থাটা নিয়ে একবারও বিবেচনা করার প্রয়োজন সে মনে করছে না। অভিমান হচ্ছে খুব মায়ের ওপর। রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় চোখটা ভিজতে ভিজতে কাহিল। মা আচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে দিল। কিছুক্ষণ আগেও মায়ের ছোয়া কতটা শান্তির মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন এটাও যেন বিষিয়ে গেছে। যন্ত্রণা দিচ্ছে আমাকে। মা আমার মুখ উচু করে ধরে বললেন—

এইভাবে কাদে না মা! তুই না চাইলে তোর বিয়ে কখনোই দিব না আমি। কিন্তু কি করার বল? তোর দাদীটা যে এমন হুট করে পাত্রপক্ষ বাড়িতে নিয়ে আসবে….সেটা কি করে জানবো বল?? এখন এসে যখন পড়েছে একবার না হয় বসলি গিয়ে ওদের সামনে। ক্ষতি কি?? দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায়না। পাত্রপক্ষ তোকে যতই পছন্দ করুক না কেন…..তোর যদি পছন্দ না হয়। সাথে সাথে বিয়ে ক্যান্সেল। তারিফও এটাই বলেছে। তাই এখন কান্না থামিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আয়। চুলগুলো একটু আছড়ে নে মা। ইশ! কি অবস্থা হয়ে আছে চুলের। দেখি…..

মা আমার চুল গুছিয়ে দিতে লাগলেন। আর আমি মায়ের বলা কথাগুলো আরেকবার চিন্তা করতে লাগলাম। আমার পছন্দ না হলে বিয়ে হবে না?? আচ্ছা পছন্দ করার জন্যেও তো মন দরকার। সেই মনটাই যে আমার মরে গেছে।

.

.

পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছি আমি। খুব বেশি একটা সাজগোজ করিনি আজ। শুধু মুখটা ধুয়ে স্নো লাগিয়েছি। চোখে কাজল আর ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক দিয়েছি। গাঢ় লিপস্টিক দেওয়ার কারণ হল ঠোটের আচড়টাকে ঢেকে নেওয়া। নাহলে আবার শ্রদ্ধেও ছেলে আর ছেলের মা বাবা সন্দেহ করবে। ভাববে মেয়ের দোষ আছে। নিজেকে হাটবাজারের পশু মনে হচ্ছে আমার। কোরবানির গরু কেনার সময় যেমন মানুষ খুতিয়ে খুতিয়ে দেখে….গরু শরীর কেমন….মাংস হবে কিনা…. শরীরে কোনো আঘাত আছে কিনা….নিখুত গরু কিনা….. একটু খানি খুত পেলেই রিজেক্ট….. না হলে দর কষাকষি। দাম কমাতে হবে। আজ নিজেকেও সেই কোরবানির পশুই মনে হচ্ছে। পাত্রপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী ফরসা গায়ের রঙ….স্লিম ফিগার…..লম্বা ঘন চুল…… সুন্দর চোখ….. সুন্দর চেহারা…. অল্পবয়স…..এ সবকিছু আমার আছে। কিন্তু একটুখানি ঠোটের সামান্য আচড়ের জন্যেও রিজেক্ট হয়ে যেতে পারি আমি। আর যদি রিজেক্ট নাও হই…..তাহলে হয়তো যৌতুকের পরিমাণ টা বেড়ে যাবে। মনে মনে হাসলাম আমি। আমার শ্রদ্ধেয় হবু শাশুড়ী মা আমাকে এই পর্যন্ত অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করেছেন। এখনো করছেন। আর বাধ্য মেয়ের মতো জবাব দিয়ে যাচ্ছি। তাও আবার হেসে হেসে জবাব দিতে হচ্ছে। লজ্জা পাওয়ার ভান ধরতে হচ্ছে। অথচ আমার ভেতরটা যে আস্তো এক ধ্বংসাবশেষ হয়ে আছে…..বিশাল ভূমিকম্পে পৃথিবীর সবকিছু যেমন ভেঙে চুড়ে ধ্বংস নেমে আসে….ছারখার হয়ে যায় সবকিছু….. লাখো লাখো প্রাণ জীবন হারায় চোখের পলকে…. সেইরকম ভয়ংকর একটা ভূমিকম্প যে আমার মনের ভেতর দিয়েও বয়ে গেছে। মনের সেই ধ্বংসাত্মক অবস্থাটা মুচকি হাসির শক্ত খোলসে আড়াল করে রাখতে হচ্ছে আমার। অনেকটা মেহেদী পাতার মতো বলা যেতে পারে। উপরে সবুজ। অথচ ভেতরে রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত। সেই ক্ষত বিক্ষত রুপ টা আমি কাউকে দেখাতে পারছি না। দেখাতে হচ্ছে উপরের সুন্দর সবুজটা। বিশাল দুনিয়ার এই রঙ্গমঞ্চে আমিও তাহলে কি এক বড় অভিনেতা হয়ে গেলাম?? হাজার হাজার বুকফাটা কান্না আর বেদনা দমিয়ে রেখে হাসতে শিখে গেলাম??

( এই কান্নাকাটির খেলা এখন আমারই আর ভালো লাগছে না। তাই পরের পর্বে সব ঠিক করে দিবো। ❤)

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here