তোকে দিয়েছি মন পর্ব ১৫+১৬

তোকে_দিয়েছি_মন❤
১৫.১৬
পর্ব – ১৫
Writer: Sidratul muntaz

পাত্রের মা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন–

আচ্ছা তারিন। তুমি কি টকদই আর টোমেটো ক্যাচআপ দিয়ে গরুর মাংস রান্নার রেসিপিটা পারো??( মিষ্টি হেসে)

আমি আমার চিন্তা জগৎ কাটিয়ে উঠে একটু অবাক চোখে ভদ্রমহিলার দিকে তাকালাম। হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন করার কারণ খুজে পাচ্ছি না। পাত্রের বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি নিজের স্ত্রীর প্রশ্নে যথেষ্ট ইতস্তত বোধ করছেন। আর পাত্র?? মানে আমার হবু স্বামী?? সে তো খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত। তাই নিজের মায়ের করা এমন অদ্ভুত প্রশ্ন উনার কানে গিয়ে পৌছেছে বলে মনে হচ্ছে না। পাত্র কে দেখে মনে হচ্ছে সে মেয়ে দেখতে আসেনি। দাওয়াত খেতে এসেছে। লোকটা যে খুব ভোজনরসিক মানুষ……সেটা উনার ভুড়ি দেখলেই বোঝা যায়। আমি পাত্রের মায়ের প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলতে যাব তার আগেই দাদী বলে উঠলেন–

পারবো না ক্যান?? আমাগো মাইয়া সব পারে। গরুর মাংসের শুটকি ভুনাও পারে। আর এইডা পারবো না? এইডা তো হের লাইগা মামুলি ব্যাপার।

বলেই দাত বের করে হাসতে লাগল বুড়িটা। বুড়ির হাসিটা দেখে আমার কেনো জানি খুব বিছরি লাগে। পান খেয়ে খেয়ে দাতের সর্বনাশ করেছে। ত্যারাবাকা দাতগুলোর ফাকে ফাকে পানের বিদঘুটে লাল ছাপ। নোংরা অবস্থা।

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। পাত্রের মা খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন–

তাহলে তো বেশ ভালোই হলো। আসলে আমার ছেলেটা গরুর মাংস খেতে এতো পছন্দ করে…। আর এখন যে রেসিপিটার কথা বললাম….. ওইটা ওর সবচেয়ে প্রিয় খাবার। তাইনা বাবা।

পাত্র মানে ভুড়িওয়ালা বেটা রসগোল্লা মুখে পুরে উত্তর দিল–

হুম হুম! দারুন!

শাহাদাত আঙুল আর বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে বৃত্ত বানিয়ে বোঝালো দারুন।

তারপর একটু নড়েচড়ে বসে ভুড়িওয়ালা বলল–

আসলে আরেকটা রেসিপি আছে গরুর মাংসের। ওইটা অবশ্য অনেক জ্বাল দিয়ে রান্না করতে হয়। একদম শুকনো শুকনো হয়ে যায়। নামটা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না..( ভ্রু কুচকে মাথা চুলকে)

মা বলল– কালাভুনার কথা বলছো??

ভুড়িওয়ালা চোখমুখ উজ্জ্বল করে মায়ের দিকে আঙুল ইশারা করে বলল–

কালাভুনা!! ইয়াহ ইয়াহ রাইট। কালাভুনা কালাভুনা। খুব মজার একটা খাবার। মা খুব ভালো রান্না করে এটা। খেতে কি অপূর্ব স্বাদ! আহা! (চেখ বন্ধ করে) বিদেশে থাকতে খুব মিস করেছি মায়ের হাতের রান্না।

পাত্রের মা একটু হেসে বলল– আসলে আমার ছেলেটা আমার রান্নার ভীষণ ফ্যান। যতদিন দেশে থাকে…. আমাকে জ্বালিয়ে মারে শুধু। মা এইটা রান্না করো ওইটা রান্না করো। আর প্রচুর মুড সুইং হয়। দুপুরে যদি বিরিয়ানি রান্না হয়…. তাহলে রাতে আর সেটা খাবে না। আবার নতুন করে কিছু রান্না করতে হবে। মানে এক কথায় ছেলের জন্য রান্না করতে করতেই আমি অস্থির। তাই ভাবলাম একটা বউ নিয়ে আসি। যাতে আমার একটু স্বস্তি হয়।

ছেলে নিচের দিকে তাকিয়ে দাতে নখ আটকে তার মায়ের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আর মিটিমিটি হাসছে। যেন পাত্রের মা ঠিক পাত্রের প্রত্যাশিত কথাগুলোই আওরাচ্ছে। যদিও এসব কথা আমার কাছে হাস্যকর ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। জীবনে রান্নাঘরের আশেপাশে উকি মেরে দেখিনি। আর আমাকে নাকি নিয়ে যাচ্ছেন রান্না করার জন্য।

পাত্রের বাবা হয়তো আমার মনের ফিলিংস টা বুঝতে পারলেন। তাই একটু হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলেন–

আরে কি তোমরা মা- ছেলে খালি রান্নাবান্না নিয়ে পড়ে আছো। আরও অন্যান্য কত বিষয় আছে কথা বলার মতো। তারিনকে জিজ্ঞেস করো ওর কি খাবার পছন্দ…. কি করতে ভালো বাসে… আর ওর আমাদের ছেলেকে পছন্দ হয়েছে কিনা সেটাও জিজ্ঞেস কর। তবেই না বিয়ের ব্যাপারটায় আমরা এগোতে পারব।

ছেলের মা বলল–

হ্যা। তোমার কথায় ও বলবে ছেলেকে পছন্দ হয়েছে কিনা। এসব তো প্রাইভেট কথা। এইখানে সবার সামনে কি বলা যায় নাকি??

ছেলের বাবা বলল– এতো প্রাইভেসির কি আছে?? একটা নরমাল ব্যাপার। ( আমার দিকে তাকিয়ে) মা তুমি কিন্তু একদম সংকোচ করবে না। তোমার মনের কথা নির্দ্বিধায় বলবে।

মনের কথা শুনে মুখটা মলিন হয়ে এলো আমার। মন বলে যে কিছু আছে…..সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকবার তাকালাম নীল শার্টের উপর কালো কোর্ট পড়া ভুড়িওয়ালার দিকে। ছেলেটার চেহারা টা ভালোই…. কেমন একটা হাসিখুশি ভাব। শুনেছি যারা ভোজনরসিক হয় তারা নাকি মনের দিক থেকে খুব সরলও হয়। ইনিও কি তাই??

বুড়ি হঠাৎ বলে উঠল–

যদি কোনো অসুবিদা না থাকে তাইলে জামাই আর তারু একটু আলাদা ঘরে বইয়া কতা কউক। ওই ঘরটায় যাইবার দেই হেগো??

বুড়ির কথায় কপাল কুচকে তাকালাম আমি। আশ্চর্য তো!! চিনি না জানিনা এই বেটার সাথে আমি আলাদা কথা বলতে যাব কোন দুঃখে??

ছেলের মা খুব উৎসাহ নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল–

যাবি বাবা??

ছেলে হয়তো আমার মনের কথাটা বুঝতে পারল। তাই একটু আমতা আমতা করে বলল–

এই জায়গাটা কিন্তু খুব সুন্দর। খুব খোলামেলা মাঠ….আর উচু উচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। বিদেশে তো এইরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্পর্শ খুব কমই পাওয়া যায়। তাই আমি একটু পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে চাইছিলাম আর কি।( সবার দিকে তাকিয়ে)

আমি বেটার মতলব বুঝতে পেরেছি। বেটা হয়তো আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চাইছে। অবশ্য এই আইডিয়াটাও খারাপ না…. বদ্ধ ঘরে যাওয়ার থেকে বাহিরে গিয়ে একটু প্রশান্তির বাতাস নেওয়াটাই শ্রেয়। এতে বুকের ভিতরটাও হয়তো একটু হালকা লাগবে।
.

.
প্রায় এক হাত দূরত্ব বজায় রেখে আমি আর মিঃ ভুড়িওয়ালা সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হাটছি। লোকটা পকেটে হাত গুজে আশেপাশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। আর আনমনে কি যেন একটা চিন্তা করছে। আমার সাথে কোনো কথা বলেনি এখনো। হয়তো অপেক্ষায় আছে আমি কখন কথা বলবো। লোকটার অ্যাটিটিউড বেশ ভালোই লাগছে আমার কাছে। দেখতে শুনতেও ভালো……লম্বা…. গায়ের রঙ উজ্জল শ্যামলা….গালভরা চাপ দাড়ি….আর বয়সও তেমন একটা বেশি মনে হয়না। হাসিখুশি স্বভাবের। মনটাও নিশ্চয়ই ভালোই হবে। অন্তত ওই ইশান নামক কীটের থেকে হাজার গুণ ভালো। সুন্দর চেহারার মানুষের চরিত্র যে এতো ভয়ংকর হয়…..ইশানের মতো আবর্জনাকে না দেখলে আমার জানা হতো না। তাই এখন থেকে সৌন্দর্য্য ঘৃণা করি আমি। আমার জন্য এই ভুড়িওয়ালাই ঠিকাছে। আর যাই হোক অন্তত চরিত্রহীন হবে না। রাজি হয়ে যাবো নাকি বিয়ের জন্য?? হ্যা অবশ্যই রাজি হওয়া উচিৎ। ইশানের মতো হারামিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও রাজি হওয়া উচিৎ। আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে ভুড়িওয়ালার দিকে তাকালাম। উদ্দেশ্য উনার সঙ্গে ভাব জমানো। তাই বলে উঠলাম–

আচ্ছা আপনি কি পাহাড় খুব পছন্দ করেন??

লোকটা মৃদু হেসে বলল–

আগে করতাম না। কিন্তু এখন করি। এইখানে আসার পর বুঝতে পারলাম পাহাড়ের সৌন্দর্য্য কাকে বলে। সত্যিই অপূর্ব। সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশের মাখামাখি। একদম হ্রদয় জুড়ানো পরিবেশ।

ভদ্রলোক দেখছি প্রকৃতিপ্রেমী। অবশ্য এখানে যারাই আসে সবাইই প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে যায়। ইশানের মধ্যেও এই লক্ষণ টা ছিল। কিন্তু ইশান নামক কালপ্রিট টা প্রকৃতির থেকে আমার প্রতি প্রেমটাই বেশি দেখিয়েছে। এই ভদ্রলোক অবশ্য সেটা করছে না। তাই উনাকে বিশ্বাস করাই যায়। আমি আবার বললাম–

আচ্ছা বিয়ের পর আমরা হানিমুনে কোথায় যাবো? সমুদ্রের কাছাকাছি?? নাকি পাহাড়ের চুড়ায়??

কথাটা বলেই থমকে গেলাম আমি। হায় হায় কি বললাম। কথাটা অন্যরকম ভাবেও বলা যেতো কিন্তু আমি যে সরাসরি বলে দিলাম। এখন ইচ্ছে করছে করল্লার জুস খেয়ে আত্মহত্যা করতে। লোকটার দিকে চোখ তুলে দেখলাম উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার চাহনি দেখে লজ্জাটা আরো বেড়ে গেলো আমার। উনি হয়তো সেটা বুঝতে পারলেন। তাই হেসে দিয়ে বলে উঠলেন–

আসলে সেরকম চিন্তা এখনো করিনি। আর এই বিয়েটা যে সত্যিই হবে সেটা নিয়েও নিশ্চিত ছিলাম না আমি।

আমি কৌতুহলী কণ্ঠে বললাম–

কেনো??

লোকটা এবার দাড়িয়ে গেল। হাত ভাজ করে একটা অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–

কারণ আমি কখনো ভাবিনি যে আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে।

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম–

আপনি আগে থেকেই কি করে জানতেন আমি সুন্দরী??

আন্টি আমাকে আপনার ছবি দেখিয়েছিল।

আন্টি কে??

যিনি আপনার দাদী….. উনি আমার আন্টি হয়। দুঃসম্পর্কের আন্টি।

মনে মনে ভাবলাম এইজন্যই তাহলে বুড়িটা এই বিয়ে দিতে উঠে পরে লেগেছে। নিজের আত্মীয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা পাকা করতে চাইছে। এমনিতে তো এইখানে এসে জালিয়ে শান্তি হয়না উনার। এবার বিয়ের পর ঢাকায় গিয়েও আমাকে জালিয়ে আসবে কুচুটে বুড়িটা। ভ্রু কুচকে লোকটার দিকে তাকালাম। উনি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষন করতে। আমি উনার মনোযোগ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে বললাম–

আচ্ছা এখন তো জেনে গেছেন যে আমি বিয়েতে রাজি। এখন কেমন মনে হচ্ছে??

ইশ! আবার করে ফেললাম একটা আবালের মতো প্রশ্ন। উনি কি ভাববেন এবার?? অবশ্য যাই ভাবুক তাতে আমার কি?? আমার মনে যেটা আসবে সেটা তো আমি বলবোই। লোকটা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল–

এখন আমার একটা জিনিসই ইচ্ছে করছে।

কি??

লোকটাকে দেখলাম পকেট থেকে একটা লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট বের করছেন। আমি একটু বিস্মিত হলাম। আমাকে কি সিগারেট খাওয়াবেন নাকি এবার?? আমার বিস্ময়কে বাড়িয়ে দিয়ে উনি লাইটার টা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন—

নিন ধরুন।

আমি এটা দিয়ে কি করবো??

আমি সিগারেট টা ধরিয়ে দিবেন। আমার ইচ্ছা প্রথমদিনেই হবু বউয়ের হাতে ধরানো সিগারেট খাবো। যদি বউয়ের সম্মতি থাকে তো।( সিগারেট টা ঠোটে আটকে)

আমি একটু হাসলাম। ইন্টারেস্টিং তো!! ট্রাই করাই যায়। আমিও হাসি দিয়ে লাইটারে আগুন ধরালাম। লাইটার টা উনার ঠোটের কাছে নিতে যাব……তার আগেই দমকা বাতাসে নিভে গেল আগুন। আমি আবার জ্বালালাম। এবারো নিভে গেল। অদ্ভুত তো! কিছুই বুঝতে পারছি না। যতবার লাইটার ধরাচ্ছি ততবারই এই বাতাসটা এসে আগুন নিভিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কথা হলো বাতাসটা আসছে কোথ থেকে?? ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুকে বললেন–

আপনি আরেকবার লাইটার ধরান।

আমি উনার কথামতো আরেকবার লাইটারে আগুন জ্বালাতে যাবো তার আগেই কোথা থেকে যেন একটা পাথর এসে পরল ভদ্রলোকের মাথা বরাবর। উনি ব্যথায় কুকিয়ে উঠে মাথায় চেপে ধরলেন। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। আতঙ্কে আমার হাত থেকে লাইটার পড়ে গেল। দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে উনার দিকে চোখ গোল করে তাকালাম আমি। দেখতে দেখতে বেচারা মাটিতে লুটিয়ে পরল। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়েছে। চোখের পলকে এসব কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। হঠাৎ উদ্ভট হাসির শব্দ শুনে এদিক ওদিক তাকালাম। শব্দের উৎস বরাবর উপরের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম ইশান ভাইয়াকে। মাচার উপর বসে হাতে গুলতি নিয়ে উল্লাসের হাসি হাসছে উনি। পাগল হয়ে গেছে নাকি?? আমার মনে হচ্ছে উনি মাচা থেকে এখনি পড়ে যাবে। আপাতত ভদ্রলোকের চিন্তা বাদ দিয়ে উনার পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক আমার মনে বাসা বাধলো। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে উনাকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ধপ করে নেমে পড়লেন উনি। একদম আমার সামনে দাঁড়িয়ে গুলতিটা পকেটে ভরতে ভরতে বললেন

ভয় পেও না তারা! কিচ্ছু হবে না। আই উইল ম্যানেজ।

কথাটা বলেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন উনি। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমার দুই গাল স্পর্শ করে বলে উঠলেন–

তুমি কান্নাকাটি করেছো তাইনা?? এতো বোকা কেনো তুমি?? আমি কি মরে গিয়েছিলাম?? একবার আমাকে বলেই দেখতে পারতে বিয়ের কথাটা। তারপর দেখতে আমি কি করি!! তা না করে এভাবে কেদে গা ভাসাবে?? ইডিয়েট একটা! তোমার মুখে বিরহের ছাপ একদম মানায় না। তোমার জন্মই হয়েছে শুধু হাসার জন্য। মিষ্টি হাসি হেসে আমার বুকের বামপাশটা শীতল করার জন্য। সেটা না করে এইভাবে কেদে কেদে চোখ লাল করে ফেলছো?? তাও আবার আমি থাকতে?? আমার বুকের ভেতরটা যে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে সেটা তুমি বোঝো না?? প্লিজ আর কোনোদিন এভাবে কাদবে না তারা!

কথাগুলো বলতে বলতে আমার কপালে চুমু একে দিলেন উনি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু।

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ১৬
Writer: Sidratul muntaz

ইশান ভাইয়া আমার দুই হাত উনার দুই হাতের সাথে মুষ্ঠিবদ্ধ করে বললেন–

এখনো মনখারাপ?? মনখারাপ করোনা তারা! এই বিয়ে কিছুতেই হতে দিচ্ছি না আমি। এইবার মিষ্টি করে একটু হেসে দেখাও তো?

উনার কথার উত্তরে কি বলা উচিৎ আমি জানিনা। একটা মানুষ এতো ভালো অভিনয় কি করে করতে পারে ভাবতেও অবাক লাগছে। ইচ্ছে করছে আমার বাম হাতটা দিয়ে উনার বাম গালটায় কষিয়ে একটা চড় লাগিয়ে বুকের ভিতর বয়ে চলা এক কষ্ট নদী জলাঞ্জলি দিতে। কিন্তু সেটা হবে কি?? উনাকে চড় দিলেই কি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবো আমি?? উনি আমার কাধ ঝাকিয়ে আবার বললেন–

কি হয়েছে তারা তোমার?? এমন লাগছে কেনো?? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?? বিয়ে করার জন্য জোড় করেছে? ভয় পেও না। গিভ মি সাম টাইম। তারিফের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে দেবো আমি। ( ভুড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে) আর এই বেটাকে তো এখনো থেরাপি দেওয়া বাকিই আছে।

আমার চোখটা কেন জানি টলমল হয়ে আসল। চোখের কোণটা আলতো করে মুছে নিয়ে আমি বললাম–

কেনো? উনার কি দোষ?? উনাকে কেনো মারলেন আপনি?? উনি তো কোনো অপরাধ করেনি।

ইশান ভাইয়া বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকালেন–

অপরাধ করেনি মানে? বিরাট অপরাধ করেছে এই বেটা। প্রথমত এই মহিষের মতো শরীর নিয়ে এসেছে পিচ্চি একটা মেয়েকে বিয়ে করতে। তাও আবার আমার পিচ্চিটাকে। এইটাই তো সবথেকে বড় অপরাধ। আর দ্বিতীয়ত তোমার হাতে লাইটার ধরিয়ে সিগারেট টানতে চেয়েছিল। কি শখ শালার! তোমার সামনে ধোয়া উড়িয়ে সিগারেট টানলে সেই মারাত্মক ধোয়া তোমার নাকেমুখে যেতো। তারপর তোমার যদি কোনো ক্ষতি হতো?? তখন আমার কি হতো?? আমাকে দেবদাস বানানোর প্ল্যান। এইবার এই মালকে আমি কিভাবে ভোগে পাঠাই সেটাই শুধু দেখো। এমন ট্রিটমেন্ট দিবো…..তুমিসহ তোমার চেহারা, নাম সবকিছু ভুলে যাবে। জীবনে আর কোনোদিন বিয়ের নাম মুখে না এনে চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিবে। যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে শিষ বাজালেন উনি।গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আয়মান আর সাফিন ভাইয়া। দুজনের মুখেই মাস্ক পড়া। মাস্কটা উঠিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দুজন হাসলো একবার। সেই হাসিতে চমকে উঠে ইশান ভাইয়ার কাছে গিয়ে দাড়ালাম আমি। ইশান ভাইয়া আমার কাধ ঠেলে আমাকে উনার বুকের কাছে নিয়ে আসলেন। আয়মান আর সাফিন ভাইয়াকে ইশারা করে বললেন মিঃ ভুড়িওয়ালাকে উঠিয়ে নিতে। দুজন চ্যাঙদোলা করে ভুড়িওয়ালাকে উঠিয়ে নিলেন। মনে হচ্ছে এই সবকিছুই প্রী-প্লেনড ছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না এখনো। উনার বুকের সাথে মিশেই দাড়িয়ে রইলাম সাফিন আর আয়মান ভাইয়ার চলে যাওয়া পর্যন্ত। উনারা দৃষ্টির অগোচরে হারিয়ে যেতেই ইশান ভাইয়াকে ছেড়ে একটু দূরে সরে দাড়ালাম আমি। উনার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলাম উনি দাত কেলানো হাসি দিয়ে আমাকে দেখছেন। আমি রাগী কণ্ঠে বললাম–

আপনার কি সমস্যা হ্যা?? এসব কি শুরু করেছেন আপনি?? সাফিন আর আয়মান ভাইয়া উনাকে কোথায় নিয়ে গেছে??

সেটা তো বলা যাবে না! আপাতত জেনে রাখো এই শালা কিডন্যাপ হয়েছে। তোমাকে যেইই বিয়ে করতে আসবে সেইই এইভাবে কিডন্যাপ হয়ে যাবে। আর সেই দোষ কার ঘাড়ে পড়বে জানো?? তোমার দাদীমার ঘাড়ে। কারণ সম্বন্ধ উনিই আনেন। তারপর দেখবে দাদীমাও তোমার জন্য আর কোনো সম্বন্ধ আনছেন না। ব্যাপারটা দারুণ না??

আমি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললাম–

মোটেও দারুণ ব্যাপার না। জঘন্য ব্যাপার।

বলেই সামনের দিকে হাটা দিলাম। এবার আমি ঘরে গিয়ে কাদবো। খুব কাদবো। কেদে কেদে মনে জমে থাকা বিশাল পাহাড়টা টলিয়ে ফেলবো। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হতে না দিয়ে আমার হাত টেনে ধরলেন ইশান ভাইয়া।

কোথায় যাচ্ছো?? এখন কিছুতেই বাসায় ঢোকা যাবেনা তারা! তোমাকে সবাই উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করবে। জিজ্ঞেস করবে তোমার সাথে মহিষ টা কোথায়।

তারপর আমি আপনার নাম বলে দিবো। বলবো আপনি মহিষ কিডন্যাপ করেছেন।

আমার উত্তরে হো হো করে হাসলেন উনি। সেই সুযোগে আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগালাম ঘরের দিকে। পেছন থেকে উনার নাকেমুখে আমার নাম ধরে ডাকাডাকির তোয়াক্কাও করলাম না। ঘরের দিকে আসতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যেতে চাইলাম। কিন্তু হঠাৎ আমাকে থেমে যেতে হল অয়ন্তি আপুর গুনগুন আওয়াজ শুনে। হাতে কয়েকটা পেয়ারা নিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে হাটছে সে। একটা পেয়ারা সে খাচ্ছে…. আর বাকিগুলো মুঠোয় নিয়ে রেখেছে। আমি পেছন থেকে ডেকে উঠলাম অয়ন্তি আপুকে। আমার ডাক শুনতে পেয়ে অয়ন্তি আপু এগিয়ে আসলো। আমি যে কি কারণে তাকে ডাকলাম সেটা আমি নিজেও জানিনা। শুধু ডাকতে ইচ্ছে হলো। মেয়েটাকে বেশ ভালোই লাগে আমার। কথাবার্তায় কেমন কিউট কিউট ভাব। অয়ন্তি আপু আমাকে পেয়ারা সাধলো। আমি না বললাম। যেখানে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত গলা দিয়ে নামতে চাইছে না….সেখানে পেয়ারা খাওয়া আমার জন্য বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার। আচ্ছা অয়ন্তি আপুকে একবার ইশানের ক্যারেক্টার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কেমন হয়?? অয়ন্তি আপু তো উনার অনেকদিনের ফ্রেন্ড। কিছু না কিছু তো নিশ্চয়ই জেনে থাকবে। আমি অয়ন্তি আপুকে জিজ্ঞেস করলাম–

আচ্ছা অয়ন্তি আপু! একটা কথা বলবে??

হুম বলো।

ইশান ভাইয়াকে তুমি কতদিন ধরে চেনো??

( হালকা হেসে)ইশানকে?? ওকে তো সেই ছোট্টবেলা থেকে চিনি আমি। আমার চাইল্ডহুড ক্রাশ বলতে পারো। ক্লাস সিক্স থেকে। কেনো বলোতো??( ভ্রু কুচকে)

আচ্ছা…. উনার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে??

আমার কথা শুনে অয়ন্তি আপুর গলায় পেয়ারা আটকে গেল। নাকেমুখে বিষম খাওয়া শুরু করলো সে। আমি তড়িঘড়ি করে অয়ন্তি আপুকে বিছানায় বসিয়ে পানি খেতে দিলাম। আমার হাত থেকে ছো মেরে পানির গ্লাস টা নিয়েই ঢকঢক করে পুরো গ্লাস ফাকা করে ফেললো এক নিমেষে। তারপর বুকে হাত দিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে বলে উঠলো—

উফফ!! দেখেছো…..আরেকটু হলেই হেচকি উঠে যেতো আমার।

অয়ন্তি আপু ছোট ছোট শ্বাস ছাড়তে লাগল। হঠাৎ আমার করা প্রশ্নটা হয়তো উনার মাথায় বারি খেল তাই আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল–

আচ্ছা তুমি কি জিজ্ঞেস করছিলে?? ইশানের গার্লফ্রেন্ড??

আমি আগ্রহ নিয়ে মাথা নাড়লাম। অয়ন্তি আপু মুখ টিপে হেসে দিল। একটু সময় নিয়ে হাসতেই লাগল। হাসতে হাসতে থেমে গিয়ে কি একটা মনে করে আবার হাসি শুরু। আমি বোকার মতো হাসি দেখে যাচ্ছি। এই হাসি হাসি খেলা ভালো লাগছে না। হাসি বাদ দিয়ে কথা কখন বলবে তার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার অপেক্ষার কারণ টা বুঝতে পেরে অয়ন্তি আপু নিজ দায়িত্বে হাসি থামিয়ে সোজা হয়ে বসলো এবার। ওরনাটা ঠিক করতে করতে বললো–

তোমার প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। আগে একটা গল্প বলি শোনো।

এই অবস্থায় গল্প শুনতে একদমই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু অয়ন্তি আপু খুব আগ্রহ নিয়ে গল্পটা বলতে চাইছে বলে শুনতে বাধ্য হলাম আমি। অয়ন্তি আপু বলল–

প্রায় দুই বছর আগের কথা। আমি,, সাফিন,, ইশান, আর তারিফ মিলে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে বসে ডিসকাশন করছিলাম। আমাদের ডিসকাশনের মূল বিষয় ছিল ভার্সিটির নবীন বরণের ফাংশন। একটা মেয়ে তখন আমাদের ভার্সিটিতে একদম নতুন ছিল। মেয়েটার নাম ছিল সুইটি। ওকে আমরা তেমন একটা চিনতাম না…. তবে আমার সাথে সুইটির মোটামোটি পরিচয় ছিল। তো যখন আমরা ডিসকাশনে ব্যস্ত…. ঠিক সেই সময় হুট করে ইশানের উপর একটা ঢিল এসে পরলো। আসলে কাগজে মোড়ানো ঢিল। ঢিলের ভেতরে ছিল ছোট্ট নুড়ি পাথর। আর কাগজে ছিল লভ লেটার। ঢিলটা কিন্তু সুইটিই ছুড়েছিল ইশানকে উদ্দেশ্য করে। সেই ঢিল গিয়ে লাগল ইশানের মাথায়। ইশানের মেজাজ তখন আকাশচুম্বী। রাগে পুরো ক্যাম্পাস কাপিয়ে চেচিয়ে উঠল সে– “ওই ঢিল কে মেরেছে?? সাহস থাকে তো সামনে আয়” আমরা ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এইটা একটা মেয়ে। কিন্তু ইশান আমাদের কথা না শুনেই যেখান থেকে ঢিল ছোড়া হয়েছে…. সেই বরাবর একটা বিশাল ইট ছুড়ে মারল। আর সেই ইট গিয়ে পরল সুইটির পায়ের উপর। পুরো রক্তারক্তি অবস্থা।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম–

কিন্তু উনি ইট কেনো মারলো??

অয়ন্তি আপু হেসে দিয়ে বলল–

কারণ মেয়েটা ওকে ঢিল মেরেছে!

কিন্তু মেয়েটা তো উনাকে প্রপোজ করার জন্য ঢিল মেরেছে।

অয়ন্তি আপু আরও এক দফা হেসে বললো–

সেটা বুঝলে তো হয়েই যেতো। ও তো লভ লেটার টা খুলেও দেখেনি। মেয়েটা যে ওকে প্রপোজ করেছে সেটা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ওর কথা হল ঢিল কেনো ছুড়বে।

আবার হাসতে লাগল অয়ন্তি আপু। হাসতে হাসতে আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল–

জানো! সুইটি সাতদিন ভার্সিটি আসেনি পায়ের জন্য। পরে ইশান ওর বাসায় গিয়ে সরি বলে এসেছিল। তারপর থেকে ইশানকে কোনো মেয়ে প্রপোজ করার আগেও দশবার চিন্তা করে। সুইটির ব্যান্ডেজ করা ওই পায়ের দিকে তাকায়। এখন তুমিই বলো এই ছেলের কি গার্লফ্রেন্ড থাকার সম্ভাবনা আছে??

আমি না চাইতেও মাথা নেড়ে না বললাম। অয়ন্তি আপু হেসে হেসে বললো–

ইশান অলওয়েজ পিওর সিঙ্গেল। ওকে যেই মেয়ে পাবে….. সেই মেয়ের লাইফ তো ঝিঙ্গালালা!! বিশুদ্ধ ভার্জিন ছেলের একমাত্র সংজ্ঞা হচ্ছে আমাদের ইশান।

কথাগুলো বলতে বলতে খাটের উপর থেকে পেয়ারা গুলো তুলে নিল অয়ন্তি আপু। বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল–

আচ্ছা আমি যাই হ্যা?? এই প্রথম গাছ থেকে পেয়ারা পেরেছি। আন্টিকে বলবো পেয়ারা ভর্তা বানাতে। তুমি খাবে পেয়ারা ভর্তা??

আমি আরেকবার না করলাম। অয়ন্তি আপু হতাশ হয়ে আবার গুন গুনিয়ে হাটতে লাগল পেয়ারা নিয়ে। পেয়ারা পাগলি একটা! কিন্তু আমার মাথায় এখনো জায়মার বলা কথা গুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। জায়মার সাথে বোঝাপড়া টা দ্রুত অতীব জরুরি ভিত্তিতে সেরে নেওয়া দরকার।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here