তোকে দিয়েছি মন পর্ব ১৭+১৮

তোকে_দিয়েছি_মন❤
১৭.১৮
পর্ব – ১৭
Writer: Sidratul muntaz

অয়ন্তি আপু কিছুক্ষণ আগে যেই কথাগুলো বলে গেলেন এই রকম আরো অনেক গল্প আমি ভাইয়ার মুখেও শুনেছি। ইশান ভাইয়া ক্যাম্পাসের সবচেয়ে ভদ্র ছেলে…….উনি কখনো মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকান না…. ক্যাম্পাসে হাটার সময় দৃষ্টি সবসময় নিচের দিকে থাকে….. ভুল করেও ডানে বামে চোখ যায়না….. আর সারাজীবন শুধু লেখাপড়া ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে চিন্তাও করেন নি…. প্রেম পিরিতি তো বোহাত দূর কি বাত হ্যায়। প্রত্যেক মেয়ের থেকে কমপক্ষে এক হাত দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলেন। একমাত্র অয়ন্তি আপুর সাথেই উনি কিছুটা ফ্রী। মেয়েরা নাকি উনাকে দেখলেই গায়ে পড়া ভাব শুরু করে দেয়…. যে কারণে উনি আরো বেশি অপছন্দ করেন মেয়েদের সঙ্গ। খুব বেশি আনইজি ফীল করেন মেয়েদের আশেপাশে থাকতে। এই সকল কথা ভাইয়ার কাছেই জানা। এসব শুনেই তো উনার প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেয়েছিলাম আমি। আর এখন অয়ন্তি আপুও ঠিক সেইম কথাগুলোই আমাকে মনে করিয়ে দিল। ভাইয়া আর অয়ন্তি আপু তো ইশান ভাইয়ার অনেকদিনের ফ্রেন্ড। উনাদেরই তো ইশান ভাইয়ার ক্যারেক্টার সম্পর্কে ভালো জানার কথা। তাহলে জায়মার সাথে উনাদের মতবাদের কোনো মিল পাচ্ছি না কেনো?? সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মতবাদ দিচ্ছে দুই পক্ষের মানুষ। এমন টা কেনো??. হোয়াই?? উত্তরটা তো জায়মাই দিতে পারবে। তাই শাড়ির আচলটা কোমড়ে গুজে নিয়ে জায়মার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আপাতত কান্নাকাটির পরিকল্পনায় জল ঢেলে রহস্য উদঘাটনের মিশনে মনোযোগী হওয়া দরকার। কি চলছে আমার দৃষ্টির অগোচরে?? আমার জানা- অজানার অন্তরালে?? জানতে হবেই। আমি ওভার স্পিডে ড্রয়িং রুমের দিকে ছুটতে লাগলাম। জায়মা ওখানেই থাকতে পারে। কয়েক পা এগুতেই কারো পায়চারীর প্রতিধ্বনি কানে এলো আমার। কৌতুহল নিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলাম ইশান ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসছে। উনাকে দেখে আমি ঝড়ের বেগে সামনের দিকে হাটা দিলাম। আর উনি?? তড়িৎ বেগে আমাকে এসে ধরে ফেললেন। শুধু তাই নয়…. আমার হাতে হেচকা টান দিয়ে আমাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে উনি আমার উপর ঝুকে পড়লেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই আমার বেধগম্য হলো না। শুধু এইটুকু বুঝলাম যে উনার সাথে যদি কোনোদিন আমার দৌড় প্রতিযোগিতা হয় তাহলে আমার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ০%. ইশান ভাইয়া উনার এক হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরলেন। উনার চোখ বর্তমানে আগুনের লাভার থেকেও ভয়ংকর। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার দুঃসাহস না দেখিয়ে আমি নিজের চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনি উরাধুরা ধমকানো শুরু করলেন আমাকে–

তোমাকে দাড়াতে বলছিলাম না?? এভাবে চলে আসলে কেনো?? আবার ড্রয়িং রুমের দিকে ছুটে যাচ্ছো?? সবাই তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করবে মহিষ টা কোথায়…. তখন কি বলবে শুনি??

আমি কাপা কাপা কণ্ঠে বললাম–

কি আবার বলবো?? যা সত্যি তাই!

উনি রেগেমেগে উচ্চারণ করলেন–

তাই না?? একটা চড় দিবো…

উনার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ছোটোখাটো একটা চিৎকার দিলাম। কারণ বলা তো যায়না….. যদি সত্যি সত্যি চড় দিয়ে বসে! কিন্তু আমার ধারণা সঠিক হলো না। উনি চড় তো দিলেনই না….. বরং চড়ের নাম করে আমার গাল চেপে ধরে একটা টাইট কিস দিলেন গালে। ব্যাপারটা আমি যেই মুহুর্তে বুঝতে পারলাম ঠিক সেই মুহুর্তে ৪০০ ভোল্টের শক খেয়ে আমার চোখ বৃত্তাকৃতি ধারণ করল। বিস্ময়ের ঠেলায় মুখটা হা করে উনার দিকে তাকালাম আমি। উনি মুচকি হেসে বললেন–

বুঝেছি। তোমাকে এইভাবে ছেড়ে রাখা যাবে না। পরে দেখা যাবে সত্যি সত্যি মুখ খুলে আমাকেই ফাসিয়ে দিচ্ছো। তার থেকে চলো তোমাকেও কিডন্যাপ করে নেই। সেই ভালো।

কথাগুলো উনি যত দ্রুত বললেন….. তার চেয়েও দিগুন দ্রুতগতিতে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে হাটতে শুরু করলেন। আর আমি?? নিজেকে বেচারি মনে হচ্ছিলো তখন। এতোগুলো শক একসাথে খেয়ে হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হেবলার মতো তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই উরাধুরা চিৎকার শুরু করলাম আমি। আমার এই চেষ্টাও ব্যর্থ করে দিয়ে উনি আমাকে কোল থেকে নামিয়ে আমার মুখ সাদা রুমাল দিয়ে বেধে দিলেন। তারপর আবার কোলে নিয়ে হাটা শুরু। এবার আর ছটফট করা ছাড়া কোনো উপায়ন্তর খুজে না পেয়ে সেই কাজটাই খুব মনোযোগের সাথে করতে লাগলাম আমি। আচ্ছামতো কিল ঘুষি চিমটি খামচি দেওয়া শুরু করলাম উনার নাকেমুখে,,চোখে,, ঠোটে,, হাতে। কিন্তু উনার গায়ের চামড়া যে গন্ডারের চামড়ার থেকেও ভয়ংকর সেটা কিভাবে জানবো?? এদিকে আমার নখ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে….. আর ওদিকে উনার যেন কোনো রেসপন্সই নেই। রাগে কান্না আসছে আমার। ইচ্ছে করছে ভ্যা ভ্যা করে কেদে দেই। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার গলা দিয়ে ভ্যা ভ্যা আওয়াজ বের হবে না। যাই করিনা কেনো কোনো শব্দই বের হবে না। মুখটাও যে বেধে রাখা হয়েছে আমার! কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হল উনি আমাকে এইভাবে ধরে বেধে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?? কেনোই বা নিয়ে যাচ্ছেন?? জায়মার মতো আমাকেও কি……. ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। চোখ দিয়ে সত্যি সত্যি পানি বেরিয়ে এলো এবার। না জানি কি দুর্গতি আছে কপালে। আচ্ছা আজকেই আমার জীবনের শেষ দিন হবে না তো?? উনি যদি সবকিছু ফাস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমাকে মেরে ফেলেন? তখন কি হবে আমার?? মনের মধ্যে হাজারো দুশ্চিন্তার জাল বুনতে যখন আমি ব্যস্ত….. ঠিক তখনই ইশান ভাইয়ার গলার আওয়াজ কানে এলো আমার। আমি চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম। খেয়াল করলাম আমরা পাহাড়ের চূড়ায় দাড়িয়ে আছি। আমি বিস্মিত হওয়ার আগেই উনি আমায় কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। আমার মুখের বাধন খুলে দিলেন। আর আমি?? স্তব্ধ হয়ে চারদিকটায় চোখ বুলাতে লাগলাম। অনেক অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় মনখারাপ হলে আমি এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে থাকতাম। কারণ এইটা আমাদের এলাকার সব থেকে ছোট্ট পাহাড়। আর এই পাহাড়ের সিড়িও আছে। যে কারণে এইটা আমার প্রিয় পাহাড়ের উপাধি অর্জন করেছে। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে ইশান ভাইয়া আমাকে এখানে কেনো নিয়ে আসলেন?? উনার দিকে প্রশ্নের ঢিল ছুড়তে যাব….. তার আগেই উনি পকেটে হাত গুজে সামনের দিকে তাকিয়ে খুব আবেগী কণ্ঠে বলে উঠলেন–

তারা!! তুমি কি কোনোদিন পাহাড়ের কান্না শুনেছো??

আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম। পাহাড়ের কান্না আবার শোনা যায় নাকি?? আর পাহাড় কাদবেই বা কেনো?? পাহাড়ের জীবনেও কি ইশানের মতো কালপ্রিট আছে যে পাহাড়কে কাদাবে?? উনি আবার বললেন–

মন দিয়ে শোনা তারা! কান পেতে শোনো। তুমিও শুনতে পাবে পাহাড়ের কান্না।

আমি অবাক হয়ে বললাম–

পাহাড় কি সত্যিই কাদে??

ইশান ভাইয়া মাথা নাড়লেন–

হ্যা কাদে। পাহাড়ের আছে এক অন্যরকম নিরবতা। নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতার অন্তরালেই পাহাড়ের কান্না লুকিয়ে আছে। এর আরেকটি উদাহরণ কি জানো??

আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম– কি?

ঝর্ণা। ঝর্ণা হলো পাহাড়ের চোখের পানি। যা জমতে জমতে একসময় ঝর্ণা হয়ে নামে। সেই ঝর্ণার সৌন্দর্য্য আমরা উপভোগ করি। বিলাস করি। কিন্তু সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একরাশ কষ্ট টা আমরা উপলব্ধি করিনা কখনোই। সেটা আমাদের অজানাই থেকে যায়। আজ সেই কষ্ট টাই কান পেতে শুনবো আমরা। তুমি আমি আর পাহাড়ের কষ্ট।

কথাগুলো বলতে বলতে উনি হাটুর উপর ভর দিয়ে বসে পড়লেন। আমার এই মুহুর্তে উনাকে আস্তো একটা রহস্যের ভান্ডার মনে হচ্ছে। উনার মতো রহস্যময় মানব জীবনে দুটো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। উনার মাথায় যে কখন কি ঘোরে….. আর উনি কখন কি চায়….. কিছুই বুঝতে পারিনা আমি। যেমন এখনো বুঝতে পারছিনা। আমাকে ঘর থেকে ধরে বেধে এইখানে নিয়ে এসে বলছে পাহাড়ের কান্না শোনো। এইটা হলো কিছু?? ধ্যাত! আমি বিরক্ত হয়ে আসন পেতে বসলাম। আর উনি?? যেন ধ্যানে বসেছে। আমি উনার ধ্যান ভাঙানোর উদ্দেশ্যে বললাম–

আচ্ছা আমরা কি এখানে পাহাড়ের কান্না শুনতে এসেছি??

ইশান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–

উহুম! তোমার মন ভালো করতে এসেছি।

আমার মন ভালো করতে? কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন আমার মনখারাপ?

তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত। তোমার চোখেমুখে আগের মতো সেই হাস্যজ্জল ভাবটা আর নেই। কেমন একটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তোমার কি হয়েছে তারা? একটু বলবে প্লিজ!

আমি উনার কথায় বেশ অবাক হলাম। আমার মনের খবর এইভাবে হয়তো আমার মাও রাখে না। আর উনি?? উফফ আমি এবারও কিছু বুঝতে পারছিনা। সব যেন জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। গোলক ধাধার মতো লাগছে সবকিছু। আমি কোনটা বিশ্বাস করবো আর কোনটা অবিশ্বাস করবো?? অয়ন্তি আপুর মুখের কথা নাকি জায়মার চোখের পানি নাকি উনার এই চোখের ভাষা?? যেটা এই মুহুর্তে আমার কাছে খুব বেশিই সত্য বলে মনে হচ্ছে। ইশান ভাইয়া আবার ডাকলেন আমায়–

তারা! বলো কি হয়েছে??

না তেমন কিছুনা।

বলেই মাথা নিচু করে নিলাম আমি। উনি সামান্য হেসে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। উনার এই হাসির মানে বুঝতে পারলাম না আমি। খুবই রহস্যময় হাসি। কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব দর্শকের মতো পাহাড়ের সৌন্দর্য্য পর্যবেক্ষন করলাম। যদিও পাহাড়ের কান্না আমার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না তবুও কেনো জানি একটা অন্যরকম কষ্ট অনুভব হচ্ছে মনে। জানিনা কেন। এই কষ্ট নামক কান্নাগুলো আমার চোখের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে বারবার। আর আমি মুছে নিচ্ছি খুব দ্রুত। উদ্দেশ্য হলো ইশান ভাইয়াকে বুঝতে না দেওয়া। উনি বুঝতে পারলেন কিনা আমি জানিনা। আচ্ছা উনি আমার মন ভালো করার জন্য পাহাড়ের কান্না শুনতে কেনো নিয়ে আসলেন?? এতে তো মন আরো খারাপ হওয়ার কথা। বরং পাহাড়ের হাসি শুনলে মন ভালো হয়ে যাওয়া উচিৎ। পাহাড় যেমন কাদতে পারে….. তেমন কি হাসতেও পারে?? আমি ইশান ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম–

আচ্ছা! পাহাড়ের কান্না শুনলে আমার মন কি করে ভালো হবে?

ইশান ভাইয়া আবেগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন–

পাহাড়ের কান্না শুনে তুমি নিজের কষ্ট ভুলে যাবে। কারণ বিশাল এই কষ্টের কাছে তোমার নিজের কষ্ট টা তুচ্ছ মনে হবে। খুব সামান্য মনে হবে।

উনার কথায় আমি নিজের মনে হাসলাম। সত্যিই কি এই কষ্ট সামান্য?? এতো তুচ্ছ?? না কিছুতেই না। আমার মনে যে বিশাল কষ্টের পাহাড় জমে আছে তা এতো সহজে টলবে না। উনাকে কি করে বোঝাবো আমি?? আমার ভাবনার টনক নাড়িয়ে ইশান ভাইয়ার ফোন বেজে উঠল হঠাৎ। উনি ফোনটা পকেট থেকে বের করেই দাড়িয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন–

উফফ তোমাদের এখানে নেটওয়ার্কের এতো প্রবলেম কেনো বলোতো??

কথাটা বলতে বলতে পাহাড়ের সিড়ি বেয়ে নেমে যেতে লাগলেন উনি। আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। এখন যদি চিৎকার করে কান্না করা যেতো….. কতই না ভালো হতো। সত্যিই ইচ্ছে করছে মন ভরে কাদতে। আমার কান্নার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে বহুদূর পর্যন্ত। সেই প্রতিধ্বনি কানে আসতেই আবার কেদে ভাসাবো আমি। আমার চোখের পানিগুলো পাহাড়ের মাটিটাও নরম করে ফেলবে। কিন্তু আমার এই মনের ভার হালকা হবে না কিছুতেই। আমার কান্নার অভিযান শুরু হওয়ার আগেই ইশান ভাইয়া চলে আসলেন। একদম আমার গা ঘেষে বসে পড়লেন উনি। ফোন থেকে কিছু একটা দেখাতে চাইছেন। আমি ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই মিঃ ভুড়িওয়ালাকে দেখতে পেলাম৷ গাছের সাথে বেধে রেখে মাথায় বিরাট এক বরফ খন্ড চাপিয়ে রাখা হয়েছে উনার। চোখমুখ আধখোলা অবস্থায় রেখে ব্যথায় কোকাচ্ছেন উনি। কনকনে শীতের মধ্যে এ কেমন ধরণের টর্চার। আমি অবাক দৃষ্টিতে ইশান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি ডেভিলমার্কা হাসি দিয়ে ফোনটা পকেটে পুরে নিলেন। আমি রাগী কণ্ঠে জানতে চাইলাম–

কি হচ্ছে এসব?? আপনি উনার সাথে এমন কেনো করছেন??

কারণ এই মহিষের বাচ্চা তোমাকে সুন্দরী বলেছে। হবু বউ বলেছে। এতোবড় দুঃসাহস দেখানোর পরেও আমি ওকে সহজে ছেড়ে দেবো ভেবেছো?? যতক্ষণ আমার মনে শান্তি না আসছে ততক্ষণ এই টর্চার চলতেই থাকবে।

উনি আমাকে হবু বউ বলেছে এতে উনার কোনো দোষ নেই। তখন আমি উনার হবু বউই হতে যাচ্ছিলাম। আর সুন্দর লাগলে সুন্দরী বলবে না?? এতে দোষের কি আছে?? তাই বলে আপনি উনাকে…

আমার কথা শেষ করার আগেই ইশান ভাইয়ার ধমক শুনতে হল–

দোষ আছে। অবশ্যই আছে। কেউ সুন্দরী বলতে পারবে না তোমাকে। শুধু আমি বলবো। তুমি বউ হলে শুধু আমার হবে। আর কারো না।

আমি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। ইশান ভাইয়াকে এবার শুধু ক্যারেক্টারলেসই না একজন সাইকো মনে হচ্ছে আমার কাছে। উনি একটা সাইকো। উনার পাগলামিগুলো যে সেটা এতোটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে আমি সত্যিই ভাবিনি। এখন ওই লোকটার যদি কিছু হয়ে যায়?? যদি মরেই যায়?? আমি ইশান ভাইয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম–

উনার যদি এবার কিছু হয়ে যায় তখন কি হবে??

সেইরকম কিছু হবে না। (একটুথেমে) তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে নাকি?

আমি দাতে দাত চেপে বললাম–

আমার কষ্ট হওয়াটা বড় কথা না। আপনি উনাকে কখন ছাড়বেন সেটা হচ্ছে বড় কথা।

আমরা যখন বাসায় পৌছাবো….. তার হাফ এন আওয়ার আগেই ছেড়ে দিবো।

উনি যদি সবাইকে সবকিছু বলে দেয় তখন কি হবে??

কিচ্ছু বলবে না। কারণ মহিষটার কিছু মনেই থাকবে না!

কথাটা উচ্চারণ করেই আত্মবিশ্বাসের সাথে হাসলেন ইশান ভাইয়া। আমি কটমট চোখে তাকিয়ে রইলাম শুধু।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। আমি আর ইশান ভাইয়া সদর দরজার সামনে দাড়িয়ে আছি। ভিতরে ঢোকার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। কারণ উঠানের ঠিক মাঝখানটায় জড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে সবাই। কারো চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ আবার কারো মুখ রাগে অগ্নিশর্মা। অয়ন্তি আপু সাফিন ভাইয়া আয়মান ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা দুশ্চিন্তায় আছে। তারিফ ভাইয়ার চোখ দুটো যেন রাগে লাল হয়ে আছে। মা আমার দিকে সন্দেহ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আর বুড়ি?? সে তো সবসময়ই মুখ বাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন গিলে খেয়ে ফেলবে আমাকে। এখনো সেভাবেই তাকিয়ে আছে। জায়মাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা কি আবার লাপাত্তা হয়ে গেল?? আমার ভাবনার মাঝখানেই তারিফ ভাইয়া এগিয়ে আসলেন। উনাকে অগ্রসর হতে দেখে মনে হচ্ছে এখনি আমার গালে একটা চড় বসাবেন। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বরং তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু হল। তারিফ ভাইয়া গম্ভীর কণ্ঠে ইশান ভাইয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন–

ইশান! তুই কি তারিনকে বিয়ে করবি?? রাজি থাকলে বল। কালকের মধ্যেই বিয়ে সম্পন্ন হবে।

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ১৮
Writer: Sidratul muntaz

ভাইয়ার কথা শুনে ইশান ভাইয়া কতটুকু অবাক হয়েছে জানিনা…… কিন্তু আমি রীতিমতো অবাকের শীর্ষে অবস্থান করছি। সবকিছু অবাস্তব মনে হচ্ছে আমার কাছে। ভাইয়া আমার সাথে ইশান ভাইয়ার বিয়ে দিতে চাইছে?? ঠিক শুনলাম তো আমি? কিন্তু কেন? কি উদ্দেশ্য ভাইয়ার?? মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা একদম স্বাভাবিকভাবেই দাড়িয়ে আছেন। যেন ভাইয়ার কথায় একটুও অবাক হয়নি মা। বরং মাও ইশান ভাইয়ার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। ইশান ভাইয়ার উত্তর পজিটিভ হওয়াই যেন মায়ের একমাত্র প্রত্যাশা। ইশান ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি। ব্যাপারটায় উনার সুন্দর মুখটাও কেমন মলিন হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছেন উনি। আচ্ছা ভাইয়াকে উনি এতো ভয় পায় কেনো?? এইটা কি ফ্রেন্ডশিপ হারানোর ভয়?? নাকি ফ্রেন্ডশিপে বিশ্বাস হারানোর ভয়?? হবে হয়তো এমন কিছুই। ইশান ভাইয়ার উত্তর দেওয়ার সুযোগ হলো না। তার আগেই পেছন থেকে বুড়িটা বলে উঠল–

ওই তারিফ!! তোর কি মাতা খারাপ হইয়া গেসে?? এই পোলার লগে তুই তারুর বিয়া দিবি ক্যা?? আমি যেই সম্বন্ধ আনসিলাম হেইডা কি খারাপ আসিল??

তারিফ ভাইয়া পেছনে না তাকিয়েই খুব কঠিন গলায় বললেন–

তুমি কোনো কথা বলো না দাদী। আমি যেটা করছি বুঝে শুনেই করছি। তারুর ভালোর জন্যই করছি। তারুর বিয়ে কালকের মধ্যেই হওয়া জরুরি। এবার ইশান যদি রাজি থাকে তাহলে ইশানের সাথেই বিয়ে হবে। আদারওয়াইজ মিঃ আরিয়ানের ফ্যামিলিকে আবার আসতে বলবো।

মিঃ আরিয়ান বলতে যে ভাইয়া মিঃ ভুড়িওয়ালাকে মিন করছে সেটা আমি বুঝে গেলাম। আর এই ব্যাপারটা হয়তো ইশান ভাইয়াও বুঝতে পেরেছে। তাইতো উনার চোখেমুখে কেমন একটা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা উনি যে ভুড়িওয়ালার সাথে এমন ভয়ংকর কান্ড করেছে সেটা আবার ফাস হয়ে যায়নি তো? না এমন টা হবে না। কারণ এমন কিছু হলে তো আর ভাইয়া আমার সাথে ইশানের বিয়ে দিতে চাইতো না। নিশ্চয়ই এর থেকেও সিরিয়াস কিছু হয়েছে। কিন্তু সেটা কি? আমার ভাবনার মাঝপথেই ভাইয়া আবার প্রশ্নের ঢিল ছুড়ল ইশান ভাইয়ার দিকে–

ইশান তুই সিদ্ধান্ত নে। তোর হাতে খুব বেশি সময় নেই। আধ ঘণ্টা সময় আমি তোকে দিতে পারি ভাবার জন্য। এর মধ্যে তুই আন্টি আঙ্কেল কে ফোন করে জানা…. নিজে চিন্তা কর….সবটাই তোর উপর। কিন্তু বিয়েটা কালকেই হবে। আসলে আমি এমনই একটা বিপদে পড়েছি যে তারুর বিয়ে দেওয়া ছাড়া সেই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই। তুই রাজি হয়ে গেলে আমার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। কিন্তু রাজি না হলে অন্য পাত্র খুজতে হবে তারুর জন্য।

ইশান ভাইয়ার চেহারার অবস্থা খুবই শোচনীয় মনে হচ্ছে এখন। উনি কি করবে আর কি করবে না সেই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে ভুগতে হার্ট অ্যাটাক না করে ফেলে। আচ্ছা আমি যেটা ভাবছি উনিও কি সেটাই ভাবছে?? আমার তো মনে হচ্ছে ভাইয়া আমাদের সম্পর্ক টা নিয়ে সন্দেহ করছে। আর সেই সন্দেহ ঠিক কতটা সঠিক সেটা বোঝার জন্যই ভাইয়া ইশান ভাইয়াকে এইভাবে ফাদে ফেলছেন। ইশান ভাইয়া যদি এখন বিয়ের জন্য না করে তাহলে ভাইয়া আমার বিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে দিবে। কিন্তু উনি যদি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যায়…. তাহলেও ভাইয়ার কাছে ধরা পড়ে যাবে। বেশ ভালোই প্যারাডোক্স সাজিয়েছে ভাইয়া। আমার ভাইয়ার মাথায় যে এতো বুদ্ধি সেটা আমি আগে জানতাম না। ইশানের মতো ছেলেকেও কেমন কনফিউজড বানিয়ে দিল মুহুর্তেই। আমি বেশ মজা নিয়েই ইশান ভাইয়ার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। উনি কিছুক্ষণ মাথা চুলকালেন….. মুখে হাত দিয়ে চিন্তা করলেন…. নখ কামড়ালেন….. হাত ভাজ করে দাড়িয়ে রইলেন…..কখনো বা সাফিন আয়মান ভাইয়ার দিকে তাকালেন। কখনো বা ভাইয়ার কঠিন দৃষ্টিতে চোখ বুলালেন। প্রায় পাচ ছয় মিনিট পর উনার মুখে কথা ফুটল–

কিন্তু তারিফ…….কাল না তোর বিয়ে হওয়ার কথা। একসাথে দুটো বিয়ে….. কিভাবে কি?

তারিফ ভাইয়া মুচকি হাসলেন–

তার মানে কি তুই রাজি??

দেখ তুই আমাকে তোর বিয়ের দাওয়াতে এইখানে নিয়ে এসেছিস। তোর জন্যই স্পেশালি আমি আমার ফ্যামিলি ট্রিপ মিস করে এতোদূর এসেছি। শুধুমাত্র তোর অনুরোধ রাখতে। কারণ তোর কথা আমি ফেলতে পারি না। এখন তুই যদি বলিস বিয়ে না খেয়ে বিয়ে করতে…. তো সেটাও করবো নো প্রবলেম!! আফটার অল তোর কথা আমি ফেলতে পারিনা দোস্ত!

ইশান ভাইয়া কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই পেছন থেকে সাফিন আর আয়মান ভাইয়ার চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল। আমারও ইচ্ছে করছিল হেসে দিতে। কিন্তু আমি হাসলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায় কিনা….. তাই হাসিটা দমিয়ে রাখলাম। এখন আমার প্রত্যাশা ছিল তারিফ ভাইয়াও হোহো করে হেসে উঠবেন। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো যখন দেখলাম তারিফ ভাইয়া অশ্রুসজল চোখ নিয়ে ইশান ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি রীতিমতো বেয়াক্কেল হয়ে গেলাম ভাইয়ার আচরণে। হঠাৎ এতো ইমোশোনাল হয়ে যাওয়ার কারণ কি?? আমি আরো অবাক হলাম যখন তারিফ ভাইয়া খুব সন্তুষ্টির সাথে ইশান ভাইয়াকে বললেন–

থ্যাঙ্কস দোস্ত। আমি জানতাম তুইই আমাকে এই সমস্যা থেকে বাচাতে পারবি। তোর কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। অনেক বড় একটা ফেভার করলি তুই আমার।

ইশান ভাইয়া তারিফ ভাইয়ার এক হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে ধরে রেখে অন্যহাত হাত দিয়ে ভাইয়ার কাধ স্পর্শ করে বললেন–

আরেহ এ আর এমন কি। আই ক্যান ডু অ্যানিথিং ফর ইউ। আর এইটা তো কোনো ব্যাপারই ছিলনা। এইটুকু করতে না পারলে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েছি কিসের জন্য?? তুই ভাবলি কি করে তোর বিপদে আমি তোর পাশে দাড়াবো না?? তুই একদম টেনশন নিস না। আর এতো ফরমালিটি কিসের রে?? তুই একবার আদেশ করলে তো জানটাও হাজির।

তারিফ ভাইয়া অশ্রুভেজা চোখেই আবার হেসে বললেন–

যাহাপণা! তু সি গ্রেইট হো। তোহফা কবুল কারো।

পেছন থেকে আয়মান ভাইয়া বললেন–

তোহফা না! বল মেরি বেহেন কো কাবুল কারো। ( রসিকতার সুরে)

ইশান আর তারিফ ভাইয়া দুজনেই হেসে দিলেন। মাকেও দেখলাম হাসছে। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছছে বাদামি শাড়ির আচলটা দিয়ে।

আমার মুখটা হা হয়ে গেল মুহুর্তেই। ওদের রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো জায়গা দিয়ে পচে গেছি। কিংবা বিরাট কোনো দোষ আছে আমার। ইশান ভাইয়া আমাকে বিয়ে করতে রাজি না হলে আর জীবনে বিয়েই হবে না আমার। আর ইশান ভাইয়াও এমন একটা ভাব করছেন যেন আমার প্রতি উনার কোনো ইন্টারেস্টই ছিলনা। এতোদিন যেন আমাকে বোনের চোখে দেখে এসেছে। আর এখন ছোট বোন হিসেবেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে শুধুমাত্র ভাইয়ার অনুরোধ রাখতে। অভিনয় টা তো বেশ ভালোই পারে দেখছি। সবার সামনে কেমন মহান হওয়ার প্রচেষ্টা। অথচ মনে মনে যে উনার লাড্ডু ফুটছে সেটা কে বলবে?? এইসব করে করেই বুঝি ভাইয়াকে পটিয়েছে। আমি আসলে বুঝতে পারিনা ভাইয়া কি অতিরিক্ত বোকা?? নাকি ইশান ভাইয়া অতিরিক্ত চালাক?? কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হলো বিয়েটা কি সত্যিই হচ্ছে তাহলে? বুড়িটা কিছু বলছে না কেন এখন?? এই প্রথম বার আমি চাইছি বুড়িটা কিছু বলুক। আর জায়মা টাই বা কোথায়? ইশান ভাইয়ার ক্যারেক্টার সম্পর্কেও তো ভাইয়াকে জানানো দরকার। আর সেটা জায়মাকে ছাড়া কিভাবে জানাবো আমি?? ভাইয়া কি আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে?? জায়মাই যে একমাত্র প্রমাণ ছিল। কিন্তু কোথাও তো দেখছি না জায়মাকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here