তোকে দিয়েছি মন পর্ব ২১+২২

তোকে_দিয়েছি_মন❤
২১.২২
পর্ব – ২১
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ড্রেসিং টেবিলে বসে চুলে চিড়ুনি চালাচ্ছি। কিন্তু চুলের প্রতি তেমন কোনো মনোযোগ নেই আমার। আমার এই অবচেতন মন শুধু একটা বিষয় নিয়েই চিন্তা করছে। সত্যিই কি বিয়েটা হয়ে গেল আমার?? এখন কি তাহলে আমি বিবাহিত?? কাল সকালে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমায়? ভালোবাসার এই শহরের মায়া ত্যাগ করে একটা অচেনা অজানা শহরে কিভাবে থাকব আমি? এসব কথা চিন্তা করতে গেলেও যে বুকটা ভার হয়ে আসছে। চোখের কোণটা ভরে আসছে….সিক্ত হয়ে আসছে চারিপাশ। আচ্ছা বিয়েটা কি আসলেই এতো সহজ? শুধু কাগজে কলমে একটা সই….. আর মুখে উচ্চারিত একটা শব্দের এতো জোড়? একটা মেয়ের মা বাবা ভাইবোন এক কথায় সমস্ত আপনজনকে পর বানিয়ে দিতে পারে এক নিমেষে! আমি চাইলেও আর যখন তখন মায়ের কাছে এসে মাকে জড়িয়ে ধরতে পারবো না। ভাইয়ার কাছে গিয়ে আইসক্রিম ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরতে পারবো না। লুডু খেলায় হার জিৎ নিয়ে তর্কাতর্কি আর হবে না ভাইয়ার সাথে। অভিমান করে ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকলে দরজার বাহিরে খাবারের প্লেট হাতে দাড়িয়ে থাকবে না কেউ। জোর করে মুখে তুলে খাবারও খাইয়ে দিবে না। বুড়িটা কেও যে খুব মিস করবো এবার। হাটতে চলতে প্রতিটা পদে পদে কে আমার ভুল ধরিয়ে দেবে? কে বলে দেবে –” ওই ছেমরি! এমন করিস না মাইনসে কি কইবো?” কথাটা মনে করে অজান্তেই ঠোটের কোণটা এক চিলতে হাসিতে পূর্ণ হয়ে উঠল আমার। বুড়ির ঝাঝালো কণ্ঠে উচ্চারিত কথাগুলোও যে এতোটা মধুর হতে পারে….. বিয়ে না হলে সেটা বুঝতামই না আমি। আচ্ছা? আমি চলে গেলে আমার টায়রার কি হবে? টায়রাকে কি আমি আমার সাথে নিয়ে যেতে পারবো? মা তো বলেছিল বাপের বাড়ি থেকে মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে একদম খালি হাতে যেতে হয়। একটা কাপড়ের টুকরো পর্যন্ত সাথে নেওয়া যায় না। তাহলে কি টায়রাকেও নিয়ে যেতে পারবো না? ভেজা গালটা মুছে নিয়ে একবার পুরো ঘরটায় চোখ বুলালাম আমি। আজ অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করছে পুরো ঘর জুড়ে। ঘরের প্রতিটা জিনিস দেখে মনে হচ্ছে আমার চলে যাওয়ার বিরহে তারাও আজ ব্যথিত হ্রদয় নিয়ে কাদছে। তাদেরও মনটা আজ দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। পারলে আমায় বেধে রাখে তারা। আর আমিও বাধা পড়ি ভালোবাসার স্মৃতি বিজরিত এই ছোট্ট ঘরে। বুকফেটে কান্না আসতে চাচ্ছিল ঠিক এমন সময় আয়নাতে খেয়াল করলাম ইশান ভাইয়া দুম করে এসে আমার বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। উনাকে দেখে এক প্রকার ভয়েই আতকে উঠলাম আমি। উনি এইখানে কেনো তাও আবার এই রাতের বেলা? ভাইয়া দেখে ফেললে যে সর্বনাশ হবে! এই ভেবে কিছু বলতে যাবো ঠিক সেই মুহুর্তে আমার মনে পরল….. উনি তো এখানেই থাকবে আজ থেকে। আমার এই ছোট্ট বিছানার এক পাশটা যে উনি অধিকার করে নিয়েছেন। চাইলেও উনাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলতে পারবো না আমি। আর না পারবো উনার সাথে এক বিছানায় শুয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। মুখটা মুছে নিয়ে একবার পেছন ফিরে দেখলাম আমি। চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে এক হাটু ভাজ করে শুয়ে আছেন উনি। আমার ছোট্ট বিছানাটা দৈর্ঘ্যে এতোটাই ছোট…. যে লম্বা পা গুলো বেরিয়ে আছে উনার। জায়গা নিচ্ছে না বিছানায়। উনি খুব ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে একটু ক্লান্ত। চিড়ুনিটা টেবিলের উপর রেখেই উঠে দাড়ালাম আমি। ঠিক সেই মুহুর্তে ইশান ভাইয়া আমার নাম ধরে ডাকলেন–

তারা!

আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। বিব্রত গলায় বললাম–

কি?

খুব টায়ার্ড লাগছে। আমার পাশে এসে একবার বসবে তারা? মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে?

কি নিঃসংকোচ আবদার! অবশ্য এইরকম আবদার যখন তখন উনি করতেই পারে। আর আমিও মেনে নিতে বাধ্য। তাই কোনো শব্দ না করে উনার মাথার কাছে গিয়ে বসে পড়লাম। ঘন চকচকে ঘাসের মতো চুলগুলোতে বিলি কাটতে লাগলাম। ইশান ভাইয়া যেন আরো বেশি আরাম করে এবার বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে আমার কোলের উপর উনার মাথার ভর চাপিয়ে দিলেন। ব্যাপারটায় আমি কেপে উঠলাম খানিকটা। সাথে কিছুটা অস্বস্তিতেও পড়ে গেলাম। উনি আমার যতই কাছে আসে ততই জায়মার বলা কথাগুলো কানে বাজতে থাকে আমার। আমি সহ্য করতে না পেরে কান চেপে ধরি। চোখ বন্ধ করে নেই। তখন আমার অবচেতন মন আমায় মনে কয়ার জায়মার ক্ষত বিক্ষত শরীর। যেটা চিন্তা করলেই গলাটা ধরে আসে আমার। শরীরের লোমগুলো পর্যন্ত শিউরে ওঠে। কিন্তু ইশান ভাইয়ার নির্মল মুখটার দিকে তাকালে এ সবকিছু স্বপ্ন মনে হয় আমার কাছে। আমার কোলের উপর মাথা চাপিয়ে শুয়ে থাকা আশ্চর্য রকম এই সুন্দর ছেলেটি কি সত্যিই এতোটা হিংস্র হতে পারে? সত্যিই কি উনি জায়মার সাথে….. মুখ চেপে ধরে কেদে চলেছি আমি। উনাকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না এই কান্না। সেই উদ্দেশ্যেই চাপা আর্তনাদ গুলো দমিয়ে রাখছি খুব সাবধানে। ইশান ভাইয়ার মুখটা কি নিষ্পাপ লাগছে। ভারি পল্লবে ছেয়ে আছে চোখের চারপাশ। নিখুত এই মুখে গোলাপী ঠোট দুটো যেন অত্যাবশ্যকীয় সুন্দর। এই চিকন ঠোট দুটোর নিচে জমে আছে একটু খানি খোচা খোচা দাড়ি। খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখে দাড়িগুলো পুরো গাল পর্যন্ত বিস্তৃত। যা উনার সৌন্দর্য্য হাজার হাজার গুণে বাড়িয়ে দেয়। আরো বাড়িয়ে দেয় আমার কান্নার পরিমাণটাও। চাপা আর্তনাদগুলো দমিয়ে রাখা আরো বেশি দুঃসাধ্য হয়ে উঠে আমার জন্য। হঠাৎ ইশান ভাইয়ার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি। চোখ বন্ধ রেখেই উনি বলে উঠলেন–

কেনো এভাবে কাদছো তারা?
🍂

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ২২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ইশান ভাইয়ার প্রশ্নে বুকটা ধক করে উঠল আমার। তুমুল গতিতে চোখের পানি নাকের পানি মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। গলা খাকারি দিয়ে কণ্ঠস্বর ঠিক করলাম যেন কথা বললে কান্না কান্না ভাবটা প্রকাশ না পায়। ইশান ভাইয়া কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে আমার উত্তরের অপেক্ষা করছিলেন। আমার নিরবতা উনাকে কি বোঝালো জানিনা…. কিন্তু হঠাৎ আমার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসলেন উনি। আমার দিকে তাকিয়ে আমার অঙ্গভঙ্গি পরিমাপ করার চেষ্টা করছেন। উনার চোখে চোখ রাখার সাহস আমার হলো না। আমি মাথা নিচু করে রাখলাম। আচমকাই ইশান আমাকে টেনে উনার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন–

কিসের এতো কষ্ট তোমার? কেনো এইভাবে কাদছো? তোমার কান্না দেখলে যে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় তারা! যখন দেখি আমার মিষ্টি তারার মুখে তার মিষ্টি হাসির বদলে এক ঝাক কষ্টের ছাপ লেগে আছে….. তখন এই মনটা যে মেনে নিতে পারেনা। মনে হয় বুকের বামপাশটায় কেউ খঞ্জর চালিয়ে দিচ্ছে। কষ্ট হয় খুব। আমি থাকতে তুমি কাদবে?? এইটা আমি কিভাবে সহ্য করবো বলো? এর থেকে তো আমার জন্য মরে যাওয়াও সহজ। তোমার কি হয়েছে শুধু একবার বলো। কে তোমাকে কাদাচ্ছে?? আমি খুন করে ফেলবো তাকে। সত্যিই খুন করে ফেলবো।

আমি শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে উনার বুক থেকে মাথা সরিয়ে নিলাম। নিজেকে মুক্ত করে এক দৌড়ে উঠে চলে যেতে চাইলাম উনার নাগালের বাহিরে। কিন্তু সেটা হল না। আমি উনার নাগালের বাহিরে যাওয়ার আগেই উনি আমার বাম হাতটা টেনে ধরলেন। এক টানে আমাকে কাছে এনে উনার কোলের উপর বসালেন। আমি ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হলো না। শুধু শুধু শরীরের শক্তি ক্ষয় হলো। ইশান ভাইয়া এক হাত দিয়ে আমার কোমড় চেপে ধরলেন। অন্যহাত আমার গালের উপর রেখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন–

কথার উত্তর না দিয়ে কোথাও যাবে না তুমি। তোমাকে বলতেই হবে কি হয়ছে। বলো।

আমি হু হু করে কেদে দিলাম এবার। আমার অসহায়ের মতো কান্নায় উনার স্পর্শ কোমল হল কিছুটা। টলমলে দৃষ্টিতে উনি আমার দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বললেন–

তারা প্লিজ! এই অসহ্য অত্যাচার বন্ধ করো। আমি সত্যিই নিতে পারছি না। দরকার হলে আমাকে মেরে ফেলো। তবুও কেদো না প্লিজ!

আমি এবার চোখটা মুছে উনার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। জোরপূর্বক ঢোক গিলে গলাটা স্বাভাবিক করেই বলে উঠলাম–

আপনি আমাকে একটা কথার উত্তর দিতে পারবেন?

বলো।

আপনি কি জায়মাকে ভালোবাসেন?

আমার কথায় উনি ভ্রু কুচকালেন। খানিকটা অবাক হয়ে বললেন—

না……. জায়মাকে আমি কেনো ভালোবাসবো। আর এইটা কি ধরনের প্রশ্ন?

আমি আবার কড়া গলায় বললাম–

সত্যি আপনি জায়মাকে ভালো বাসেন না??

উনি আবার বড় করে উচ্চারণ করলেন– না!

আচ্ছা তাহলে এটা বলুন। আপনারা যেদিন ঢাকা থেকে এসেছিলেন….. সেদিন ভাইয়া অয়ন্তি আপু সাফিন ভাইয়া আর আয়মান ভাইয়াদের নিয়ে আগে চলে এসেছিলেন। কিন্তু আপনি তারও কয়েক ঘণ্টা পর এসেছিলেন। কেনো??

কারণ ওরা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল আমি তার বিপরীত রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল একটু ঘোরাঘোরি করার। তাই!

আপনি তো এখানকার কিছুই চিনতেন না। তাহলে কিভাবে গেলেন?

জায়মাও গিয়েছিল আমার সাথে।

জায়মাকেই কেনো নিতে হলো আপনার সাথে আর অন্য কেউ ছিলনা? আপনি তো তারিফ ভাইয়ের সাথেও যেতে পারতেন।

হ্যা যেতে পারতাম। আর আমি তো তারিফকেই নিতে চেয়েছলাম। ইনফেক্ট আমি সবাইকেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অয়ন্তির পায়ে ব্যথা ছিল। আর সাফিন আয়মানও খুব টায়ার্ড ছিল। তাই ওরা যেতে রাজি হয়নি। তখন জায়মাই আমাকে অফার করল যাওয়ার জন্য। আর তারিফও আমাকে জায়মার সাথে যাওয়ার জন্য বলেছিল। তাই আমিও আর না করিনি! ( একটু থেমে) কিন্তু এসব কথা এখন কেনো আসছে?? এর জন্যেই কি তোমার মনখারাপ?

আপনি সত্যি বলছেন তো??

তারা আমি মিথ্যা কেনো বলবো? আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি তারিফ অয়ন্তি…. আয়মান সাফিন সবাইকে জিজ্ঞেস করো। সবাই তো আর মিথ্যা বলবে না।

আচ্ছা সেটা না হয় বুঝলাম। তাহলে লাস্ট একটা কুয়েশ্চন। জায়মাকে কি আপনি মাঝরাস্তায় কোলে তুলে নিয়েছিলেন??

ইশান ভাইয়া কিছুটা বিব্রত গলায় বলল–

তারা তুমি কথাগুলো এভাবে কেনো জিজ্ঞেস করছো?

আপনি আমার কথার উত্তর দিন।( দাতে দাত চেপে)

হ্যা নিয়েছিলাম।

আমার চোখমুখ কঠিন হয়ে আসল এবার।

আপনি জায়মাকে কোলে তুলে একটা নিরিবিলি জায়গায় আসন পেতে বসিয়েছিলেন।

ইশান ভাইয়া চোখ বন্ধ করে বললেন–

হ্যা বসিয়েছিলাম। কিন্তু সেটার যথেষ্ট কারণ ছিল।

আমি ভ্রু কুচকে বললাম–

কি কারণ??

জায়মার পায়ে কাটা বিধেছিল। খুব ব্লিডিং হচ্ছিল। তাই আমি ওকে একটা নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে পায়ের কাটা বের করতে হেল্প করছিলাম যাস্ট।

কাটা বিধেছিল?? কই জায়মা তো আমাকে এমন কিছু বললো না। আপনি মিথ্যা বলছেন।

মিথ্যা কেনো বলবো? তোমার বিশ্বাস না হলে তুমি আন্টি মানে জায়মার মা কে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমি জায়মাকে ওর বাসা পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিলাম। আহত অবস্থায় হাটতে পারছিল না তাই।

আপনি জায়মাদের বাসাতেও গিয়েছিলেন?

হুম।

আচ্ছা আপনি কি জায়মাকে কোনো লকেট গিফট করেছেন?

লকেট? না তো!

আমি উচ্চশব্দে বললাম–

মিথ্যা কথা বলছেন আপনি। আপনি জায়মাকে লকেটও দিয়েছেন প্রপোজও করেছেন।

হোয়াট! তারা একটা চড় দিবো মানুষের কথা শুনে আমাকে সন্দেহ করতে আসবে তো। এসব ফালতু কথা কে বলেছে তোমাকে? আর তুমি বিশ্বাসই বা করলে কি করে? মাথায় কোনো ঘিলু নেই তোমার? বুদ্ধি নেই কোনো? আজিব মেয়ে মানুষ! ইডিয়েট একটা।

ধমকের সুরে কথাগুলো বলতে বলতে উনি ঠাস করে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বিছানায় বসালেন। মেজাজ দেখিয়ে বড় বড় পায়ে বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমি বোকার মতো বসে রইলাম শুধু।
🍂

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here