তোমাতে পর্ব ১

জিসান ভাই হাতা ফোল্ড করতে করতে বলেন, “হ্যা, কি যেন বলছিলি?”

ভয়ে জড়সড় হয়ে এদিক ওদিক তাকাই। পালানোর জন্য পাশে জায়গা অনেকখানি আছে। কিন্তু সেদিক দিয়ে দৌড়ে পালাতে জিসান ভাইয়ের পাশ কাটাতে হবে। যার আত্মপ্রত্যয় বিন্দু পরিমাণও আমার মধ্যে নেই। ডান গাল ধরে তাই কাঁদোকাঁদো মুখে উনার দিকে তাকালাম, বিনীতভাবে বললাম, “কি কিছু না তো।”

“আরেকটা লাগাব! বল কি বলছিলি!”

এবার সত্যিই কেঁদে দিলাম। যে রাম চড় একটু আগে খেয়েছি সেই চড় আরেকটা পরলে ইহজীবন ত্যাগ করব আজকেই। তিনি এগিয়ে আসেন কাছে। আমি দেয়াল ঘেষে দাঁড়াই। তিনি ভ্রু কুচকে আমার বাম কাধের কিছু ওপরে দেয়ালে হাত রাখেন। মুখের ওপর ঝুকে এসে ডান হাতে ঘাড়ে হাত বুলানোর ভঙ্গিমায় বলেন, “কি যেন ছিল লাইনটা। তাতে আপনার বাপের কি! না কি যেন?”

“ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া! আর হবে না!”

তিনি তীর্যক দৃষ্টি তাক করেন। আমি ভেজা চোখে উসখুস করতে থাকি। কি আশ্চর্য আমার চোখে আর পানি আসছে না! এমনি সময় উপচে পরে। চোখের পানি ট্যাঙ্ক কি খালি হয়ে গেল? নাকি ট্যাঙ্ক থেকে সরাসরি আসা পাইপ লাইনের সংযোগ কেউ ছিন্ন করে দিয়েছে? উঁউঁ এখন কি হবে! এহেন দুর্দশায় উনি আমাকেই নাট্যকলা প্রদর্শন করছি বলে দাবি করবেন! ছেলেটাও বা কি ভয় পাচ্ছি জেনেও ঝুকে মজা নিচ্ছে!

গম্ভীরমুখে, “যাই হোক। ইফাজের সাথে নাকি তোর চিঠি বিনিময় হচ্ছে আজকাল!?”

চোখের পাতা এবার দ্রুত কাঁপতে থাকে। কাঁপতে থাকে ঠোঁট, হাত-পা। ফ্যাকাশে মুখটা আরও ফ্যাকাশে হয় উনার ধমকে, “উত্তর দিচ্ছিস না কেন! এমনি সময় খুব লাফালাফি, আমি জিজ্ঞেস করলেই কথা উড়ে যায়! কানের দু ইঞ্চি নিচে মারলে না সব ভূত চলে যাবে!”

এ সময় অবতারের মতো দরজায় এসে দাঁড়ায় শিফা। আমাদের দেখে ভড়কে যায়। ওর ভড়কানো দৃষ্টিতে জিসান ভাই ধীরে সরে দাঁড়ান। সাহস কিছুটা ফিরল। শ্বাসকষ্টের রোগীদের মতো আমি দ্রুত শ্বাস নিতে থাকি। মেয়েটা এতে চোখ বড় বড় করে তাকায়। জিসান ভাই চরম বিরক্ত। ধমকে উঠেন, “নক না করে ঢুকেছিস কেন!?”

শিফা গাল ফোলায়, “আম্মু নাশতা বানিয়েছে সন্ধ্যার। তোমাদের বসার ঘর থেকে এত ডাকল কেউই সারা দিচ্ছ না। তাই আমাকে পাঠিয়েছে।”

“হ্যা, তাতে তুই নক না করে ঢুকে পরলি!”

“ভুল হয়ে গেছে এতে এত বকাবকি করছ কেন? তুমি যাও না আমার রুমে?”

“আমার কথা আলাদা। তুই ছোট তোর রুমে যেতেই পারি!”

এ সুযোগে আমি জিসান ভাইকে পাশ কাটিয়ে শিফার কাছাকাছি দাঁড়ালাম। লজ্জাও বোধ হচ্ছে কিছুটা! শিফা ঝগড়া থামিয়ে নাক ফুলিয়ে আমার হাত ধরে বসার ঘরে চলে এল। পেছনে আসলেন জিসান ভাইও। বসার ঘর আর ডাইনিং রুম একটাই। আমরা পৌছুতে আন্টি হাতে বাটি ধরিয়ে দেন। আমরা চেয়ার টেনে বসি। আন্টি জিজ্ঞেস করেন, “পড়া কেমন হচ্ছে ঝুম!?”

আমি আড়চোখে জিসান ভাইয়ের দিকে তাকালাম। পড়া না ছাই! পুরো দুইঘন্টাই লস! মাঝখানে নিরীহ আমি নির্যাতিত হই বিনা কারনে। আন্টির জবাবে দুপাশে মাথা নাড়ি। কি বলেছি নিজেরই বোধগম্য হলো না। আন্টি তৃপ্তমুখে মাথায় হাত বোলান, বলেন, “কিসে পড়ার শখ তাহলে? মেডিক্যাল না ইঞ্জিনিয়ারিং? মেডিক্যালে পড়লেই ভাল শাফির সাথেই আসা যাওয়া করতে পারবে!”

গলায় খাবার আটকে গেল। কাঁশতে লাগলাম। আন্টি পিঠ থাপড়ে পানি এগিয়ে দেন, স্নেহকোমল কণ্ঠে বলেন, “আস্তে খাও মেয়ে। তাড়াহুড়ার কি আছে!?”

আমি ধাতস্থ হয়ে মাথা নিচু করে গিলতে থাকি। আর এক মুহূর্তও বেশি থাকা যাবে না। লাগবে না আমার ফিজিক্সে পাস মার্ক! ফেল করব! তবু আর এদিক মারাব না। বহুত হয়েছে নির্যাতন সহ্য করা। ধমকি শোনা। জিসান ভাই সামনে বরাবর বসে ছিলেন। শান্ত দৃষ্টি আর ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলেন, “পড়েই না ফেল্টুমার্কা ছাত্রী। এ পড়বে মেডিক্যালে!”

রাগে ফুসে উঠে উনার দিকে তাকালাম। উনার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। গা জ্বলে গেল পুরো। আন্টি ধমকান, “এসব কেমন কথা শাফি!”

জিসান ভাই মুখ বেকান। তবু তাচ্ছিল্যের হাসিটা যেন ঝলকে যাচ্ছে বারবার রাগটাকে উস্কে দিতে। খাওয়া শেষে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুখ কাচুমাচু করে বলি, “আমি আজকে আর পড়ব না আন্টি। ভাইয়াকে ছুটি দিতে বলেন না।”

“আন্টি আন্টি করলেই হবে না। গতদিন বাড়িকাজ দিয়েছি নিশ্চয় করেনি। মা তুমি একে মোটেও আস্কারা দিবে না। সব ফাকি দেয়ার ধান্ধা!”

আমি অসহায় মুখে একবার শিফা একবার আন্টির দিকে তাকাই। আন্টির হয়ত মায়া হলো। তিনি কোমল কণ্ঠে বলেন, “ছেড়ে দে আজকে। কাল নাহয় পুষিয়ে নিস বেশি পড়িয়ে। কি ছোট হয়ে এসেছে মুখটা দেখ।”

আমার মুখটা মুহূর্তে হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠল। তিনি বললেন, “পরে ফেল করলে দোষ সব আমার হোক! ওকে!”

শিফা বলে, “ভাইয়া নিজেকে কি ভাবো তুমি? একা তুমিই শুধু ইন্টালিজেন্ট!?”

“তুই পিচ্চি মানুষ চুপ থাক। বড়দের ব্যাপারে নাক গলাবি না। এমনিই কি তোর নাক বোচা!?”

“মা!?”

আন্টি ত্যক্ত মুখে দুজনকেই ধমকান, “তোরা দুটাই হাড়ে বদ!”

আমি পেছন থেকে ফোড়ন কাটি, “বড়টা বেশি।”

জিসান ভাই জ্বলাচোখে তাকান। উনার খাওয়া এখনো শেষ হয়নি। আমি দ্রুত উনার রুম থেকে আমার বই খাতা নিয়ে এলাম। আন্টি, শিফাকে বলে হেলেদুলে নবাবী চালে উনার সামনেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসি। সিড়ি দিয়ে নামছি। পেছনে থেকে গলা আসে, “যা বাড়িকাজ ছিল তা কালকে দুইবার করে লিখে আনবি!”

বিস্ময়ে আমি থ। মানে মগের মুলুক নাকি? কি বড় বড় একেকটা ইকুয়েশন! ধারেকাছে না থাকায় সাহসে মনটা ভরপুর, বললাম, “পারব না!”

“কি বললি!”

“পা_র_ব না!”

তিনি দরজা ছেড়ে কয়েক কদম এগিয়ে আসেন, “তখনের ডোজ মনে নেই তাই না?”

আমি মুখ ভেঙাই। নিরাপদ দুরত্ব ঠিক করে বলি, “কি বলছিলেন যেন! আমি ইফাজের সাথে চিঠি আদান প্রদান করি কিনা ব্লা ব্লা! ইয়েস, আমি চিঠি আদান প্রদান করি। আগামীতে মনটাও আদান প্রদান করব। আপনার টিকির কাছঘেষে আপনার হ্যান্ডসাম বন্ধুর সাথে রিলেশনেও যাব আপনি টেরও পাবেন না!” গালে হালকা করে হাত বুলিয়ে, “উঁ বেহুদা কি চড়টাই না দিলেন। একশবার বলব, “আমি যাই করি তাতে আপনার বাপের কি আর আপনারই বা কি!?’ আসছে গুরু গিরি দেখাতে চাল ফোট!”

তিনি দরজা থেকে একেবারে বেরিয়ে তেড়ে আসেন, “দাঁড়া আবার তেড়ামি হচ্ছে। তখনই তিন চারটা একসাথে লাগানো উচিত ছিল।”

আমি দ্রুত সিড়ি দিয়ে নামতে থাকি। পেছনে তিনিও হয়ত কিছু সিড়ি টপকেছেন। ভয়ে দুই তিনটে করে সিড়ি টপকাতে গিয়ে পরে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস রেলিং ছিল। নিজ ফ্ল্যাটের সামনে এসে দেখি দরজাটা হাট করে খোলা। মিশেল আপু সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে। আমি পেছনে ঘুরলাম জিসান ভাই সিড়ির রেলিঙে দাঁড়িয়ে রক্তিমমুখে ফুসছেন। পড়তে যাওয়ার আগে ব্যাগে ভুল করে নতুন কেনা কেচি নিয়ে গেছিলাম। মনে পরল। ব্যাগ থেকে বের করলাম। উনি তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিলেন আমাকে। উনাকে দেখিয়ে বড় কেচিটার দু’হাতলে ধরে কয়েক পোজ দিলাম। উনার মুখটা এতে আরও শক্ত হল। আমি পৈশাচিক হাসিতে মুখ ভেংচালাম। উনার কুটিল দৃষ্টি বলছে কাল পড়তে আসো চান্দু ক্লাস নিয়ে তখনই সিটি নিব! সেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বাসায় চলে আসি। বেটা তোর কাছে আর পড়লে তো পাবি ঝুমকে! হাহ!

কিন্তু ভাগ্যের কলকাঠি কখনোই আমার পক্ষে থাকে না। পরদিন_____

#তোমাতে
সূচনা পর্ব
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল

[😕এটা কি চলবে? নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here