তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে পর্ব -১২+১৩

#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১২
#সুমাইয়া_মনি

‘হ্যালো সোহানা..’
‘তুই আস্তে আস্তে কথা বলছিস কেন?’
‘আমার কথা পা আই মিন রাদ সব শুনতে পায় বাহির থেকে। আমি তো জোরে জোরে কথা বলি। এজন্য আস্তে আস্তে কথা বলছি।’
‘আর কি কি বলছে পা’দে বল শুনি।’
‘বাহিরে দেখা হলে বলব। এখন তুই রাখ।’
‘আরে শোন। মুরাদ আমার নাম্বার কোথায় পেলো? তুই দিয়েছিস?’
‘বাহিরে গেলে কথা বলব বলছি না। রাখি!’ কথা এড়িয়ে ফোন কেটে দিলো ইসানা। সরু নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
‘নাম্বার তো দিলাম আজই। ভালো হয়েছে এড়িয়ে গিয়েছি। নয়তো বকা শুনতে হতো।’ ফোন বিছানায় রেখে বেলকনিতে এলো ইসানা। স্বচ্ছ চাঁদের পানে চেয়ে মৃদু হাসলো। গোলাকৃতি চাঁদ কতদূর অব্দি আলো দিচ্ছে। এ উজ্জ্বল আলোতে হাঁটা চলা করা যায় বিনা আধুনিক যুগের ইলেকট্রনিক লাইটের সাহায্যে। ইশ! চাঁদের মতো যদি কেউ তার জীবনে সুখ, ভালোবাসা দিয়ে উজ্জ্বল আলোর রশ্মি ছড়িয়ে দিতো। কতোই না ভালো হতো। ছোট থেকেই অন্ধকার জীবন অতিবাহিত করেছে। ছোট বেলায় যদি মায়ের বদলে তার মৃত্যু হতো, তবে হয়তো জীবনের ওপর থেকে এত ঝড়ঝাপটা যেতো না৷ ভাবতে ভাবতে চোখের কোণায় নোনাজল এসে ভর করল। শাহাদাত আঙুল দ্বারা মুছে নিলো। হঠাৎ দরজায় করাঘাত হয়। ইসানা চোখ ঠিকঠাক ভাবে মুছে বের হলো। সে জানে এ মুহূর্তে কে দরজায় আওয়াজ করেছে। দরজা খুলে বাহিরে পা রাখার পরপরই টাইসন চিল্লিয়ে উঠে। ইসানা মুখে হাত রেখে পিছিয়ে যায়। টাইসন লেজ জাগিয়ে তুলে রাগে রাদের পায়ের কাছে ঘুরছে। ভুলক্রমে ইসানা না দেখেই টাইসনের লেজে পা রেখেছে। যার দরুন ব্যথায় কুঁকড়ে আছে টাইসন। রাদ টাইসনের ওপর থেকে নজর সরিয়ে ইসানার পানে ক্রোধ চোখে তাকায়।
ইসানা এখনো টাইসনের দিকেই অপরাধী চোখে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ টাইসন ঠিকিই তাকে কামড়ে দিতো। রাদের জন্য আপাতত রক্ষে হয়েছে। ইসানা রাদের উপর নজর পড়ে। রাগি রাগি চোখ দেখে দ্রুত বলল,
‘আমি ইচ্ছে করে দেই নি। জরিমানা নিবেন না প্লিজ স্যার!’
‘টাইসনের ট্রিটমেন্ট করুন এক্ষুণি।’ গমগম স্বরে বলল।
‘যদি কামড় দেয়?’
‘দিবে না। আমি ধরছি ওঁকে। আপনি ওর লেজে ব্যথার স্প্রে দিয়ে দিন।’
‘জি।’ ইসানা দ্রুত ছুটে যায় ফাস্ট এড বক্স আনতে। রাদ টাইসনকে কোলে তুলে সোফায় বসে। ইসানা স্প্রে দিয়ে দেয় আলতো ভাবে। টাইসন ব্যথায় চিৎকার করলে রাদ সামলে নেয়। ব্যথা একটু বেশিই লেগেছে লেজে। দু’জনে এক সঙ্গে লেজে হাত রাখার সময় আঙুল স্পর্শ হয় তাদের। রাদ আড়চোখে তাকালেও ইসানা তাকায় না। রাদের কপাল কুঁচকে আসে কিঞ্চিৎ! মাঝেমধ্যে ইসানাকে দেখে তার কাছে অদ্ভুত লাগে। সে ভাবে তার মধ্যে অনুভূতির ছিঁড়ে ফোটাও নেই। আছে শুধু দায়িত্বপালনের ভূমিকা।
ইসানা বক্স হাতে চলে যেতে নিলে রাদ না তাকিয়ে বলল,
‘আজকে টাইসনকে আপনার কাছে রাখবেন। রাতে ওর যত্ন নিবেন।’
ইসানা দৃষ্টি নত রেখে রাজি হয়ে সম্মতি জানায়। টাইসনকে আপাতত সঙ্গে নিয়ে রাদ রুমে ফিলে। ইসানা রুমের দিকে পা বাড়াতেই মনে পড়ে রাদ কেন তাকে ডেকেছিল। রাদের দরজার নিকটে এসে নক করলে রাদ দরজা খুলে।
‘বলুন?’
‘কেন ডেকেছিলেন তখন?’
রাদ মনে করার চেষ্টা করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে। তারপর ইসানার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এখন মনে পড়ছে না। পরে বলব।’
ইসানা শুনে চলে যায়। রাদ দরজা ভিড়িয়ে দেয়।
_
‘আপনি আমাকে জ্বালাতন করছেন কেন? বিরক্তিতে বার বার কল কেটে দিচ্ছি বুঝতে পারছেন না?’
‘কথা না শুনে কল কেটে দিলে এমনই হবে মিস।’
সোহানা রাগে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বলে,
‘ওকে, কি বলবেন বলেন।’
‘এত তাড়া কিসের মিস? বয়ফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে হোয়াটসঅ্যাপে?’
‘আজাইরা কথা না বলে যেটা বলতে চান, সেটা বলুন।’
‘কাল দশটায় আমার সঙ্গে দেখা করবেন মিস।’
‘কোথায়?’
‘আরএফসি গার্ডেনে।’
‘পারব না।’
‘আপনার বাসার নিচে আছি। রাজি না হলে সোজা বাসার ভেতরে প্রবেশ করব মিস।’
‘কী?’ বিস্মিত হয়ে।
‘জানালা দিয়ে উঁকি দিন মিস।’
সোহানা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে সত্যি সত্যি মুরাদ গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখা মাত্রই হাত জাগিয়ে ‘হ্যালো’ জানায়। সোহানা সরে যায়। ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে বলল,
‘আমি আসব দেখা করতে। আপনি চলে যান এখান থেকে আপাতত।’
‘কথা দিতে হবে আমায় মিস।’
‘দিলাম।’
‘প্রমিজ?’
‘হ্যাঁ! প্রমিজ। ওকে বাই, দেখা হবে আগামীকাল মিস।’
মুচকি হাসি দিয়ে কল কেটে গাড়ি টান দিয়ে চলে গেল মুরাদ । জানালা দিয়ে সেটি দেখে সোহানা স্বস্থির নিশ্বাস নেয়। একটুর জন্য বেঁচেছে।
মনে মনে কার ওপর রাগ হবে বুঝে উঠতে পারছে না। কে তার এমন সর্ব’নাশ করল? নাম্বার, বাড়ির এড্রেস মুরাদকে কোন শুভাকাঙ্ক্ষী দিয়েছে তাকে খুব প্রয়োজন এই মুহূর্তে!
.
সকালে রাদ ইসানা এক সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে আসে। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে ইসানার। সারারাত টাইসন ও রাদের জন্য ঠিকঠাক ভাবে ঘুমাতে পারে নি। এক, দু ঘন্টা অতিবাহিত হতেই রাদ এসে টাইসনের খবরা-খবর নিচ্ছে। তার ওপর লাইট জ্বালানো ছিল সারারাত। যার ফলে ঘুমের ঘার্তি দেখা দিয়েছে। হাই তুলতেই ল্যান্ড লাইনে কল আসে। কল রাদ দিয়ে কফি বানানোর বার্তা পেশ করে। ইসানা কফি বানিয়ে রাদের কেবিনে প্রবেশ করে। রাদ ইসানার শুকনো মুখশ্রী দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। মুখ খুলে কিছু বলার পূর্বেই লিসা তড়িঘড়িতে ভেতরে প্রবেশ করে। হাতে ছিল মাঝারি আকারের একটি টিফিন বাটি। ডেস্কের ওপরে রেখে মুচকি হেসে রাদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আজকের হালুয়া একদম পারফেক্ট হয়েছে রাদ। খেয়ে দেখো।’
‘তুমি টেস্ট করেছো?’ ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল রাদ।
‘চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি চাই তুমি আগে টেস্ট করো। প্লিজ!’ অনুরোধ স্বরে বলল লিসা।
রাদ খেতে চাইছে না। লিসার মনরক্ষার্থে খেতে হবে তাকে। লিসা দু’টি চামিচ নিয়ে এসেছে। রাদের দিকে একটি তাক করে ধরেছে। রাদ সেটি নিয়ে বাটির ঢাকনা সরিয়ে মুখে দিলো। মুখ নাড়াচাড়া করার ভঙ্গি দেখে লিসা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ঠিক আছে তো রাদ?’
সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে রাদ উত্তর দিলো,
‘চমৎকার!’
‘সত্যি?’ খুশিতে লাফিয়ে উঠল লিসা।
‘হুম।’
‘উফ! যাক আমার রান্না স্বার্থক হয়েছে। তুমি খাও আমি আন্টিকে ধন্যবাদ দিয়ে আসি। তিনিই আমাকে সাহায্য করেছে হালুয়া বানাতে।’ দ্বিতীয় চামিচটি ডেস্কে রেখে লিসা বেরিয়ে গেল। রাদ অপর চামিচটি হালুয়ার পাশে রেখে বাটিটি ইসানার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ট্রাই করুন।’
‘আপনার জন্য এনেছ…’
‘খা’ন বলছি।’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শুধালো রাদ।
ইসানা রাদের নির্দেশ যথারীতি পালন করে এক চামিচ মুখে দিলো। তৎক্ষনাৎ রাদের দিকে তাকিয়ে চামিচ আগের স্থানে রেখে দিলো। রাদ ইসানার পানে তাকান অবস্থায় চেয়ারে হেলান দিলো। সে ইসানার মুখ থেকে লিসার বানানো হালুয়ার প্রশংসা শুনতে চায়। সেজন্য সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
ইসানা নজর নত করে মিনমিন কণ্ঠে বলল,
‘অতিরিক্ত চিনি হয়েছে।’
‘আপনি তো জানেন আমি সুগার লাইক করি খুব কম।’
‘তবে তাকে মিথ্যে কেন বললেন?’
রাদ ঘাড় হালকা কাত করে ইসানার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘খুশি করতে না পারলেও, কষ্ট দিয়ে কথা বলা অনুচিত। তাই মিথ্যে তারিফ করলাম। আপনার তরিকা অবলম্বন করলাম। অবশ্য এতে লিসা খুশি হয়েছে।’
ইসানা চোখ তুলে রাদের চোখের দিকে তাকায়। পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় হয় সেকেন্ড কয়েক।
ইসানা বিনাবাক্যে কেবিন ত্যাগ করল। কেবিনে এসে থুতনিতে ঠেস দিয়ে হাত রেখে রাদের বলা কথাটি পুনরাবৃত্তিতে আওড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
কয়েকদিন যাবত রাদের আচার-আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। হঠাৎ রাদের পরিবর্তন তাকে ভাবিয়ে তুলছে।

সোহানা দ্রুত পায়ে মুরাদের কাছাকাছি এসে তেজি কণ্ঠে বলল,
‘বলুন কেন আসতে বলেছেন?’
মুরাদ সানগ্লাস খুলে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের ওপর থেকে গোলাপের বুকে হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘আপনার জন্য মিস!’
সোহানা রাগী মুডে বুকেটি হাতে তুলে নেয়। পুনরায় বলে,
‘এবার বলুন।’
‘আমাকে এড়িয়ে চলছেন কেন মিস?’
‘আপনি আমার কোনো রিলেটিভ না। সের্ফ অচেনা একজন পার্সন।’
‘প্রিয় পার্সন হতে চাই আপনার মিস।’
‘মাথায় সমস্যা হয়েছে বাড়ির সবাই জানে? দেখুন, আপনি আমার বয়সে ছোট। আপনি বলে সম্বোধন করছি সম্মান করে। সে-ই মান রাখার চেষ্টা করুন।’
‘আপনি থেকে তোমার তুমি হতে চাই মিস।’
‘অসম্ভব!’ ঝাড়ি দিয়ে বলল সোহানা।
মুরাদ সোহানার কাছে এগিয়ে গিয়ে গালে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে নেয়। নরম কণ্ঠে বলল,
‘আমি আপনার প্রেমে পড়েছি মিস। এর থেকে আমাকে কেবল আপনিই উদ্ধার করতে পারবেন।’ এতটুকু বলে থেমে সোহানার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নেয়। ফিসফিস করে বলে,
‘আমাকে ভালোবাসুন মিস। আমি আপনার হৃদয় দখল করতে চাই। তীব্রভাবে ভালোবাসতে চাই আপনাকে।’
সোহানার সর্বাঙ্গে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বুকের মধ্যে থাকা যন্ত্রটা দ্রুতগতিতে টিমটিম করছে। এ কোন অনুভূতিতে হাতড়াচ্ছেন তিনি। হাতের মুঠোয় বুকেটি খামচে ধরে। ঠোঁট ঈষৎ নড়াচড়া করছে। কিন্তু বাক্যগুলো ভেতর থেকে বের হচ্ছে না কিছুতেই। মুরাদ দুরত্বে চলে আসে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,
‘আশা করি আপনি আমাকে বাঁচাবেন মিস।’ মৃদু হাসি প্রধান করে মুরাদ রেস্টুরেন্ট ত্যাগ করে। সোহানার ঘুরে তাকায়। মুরাদের যাওয়ার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির বাহিরে যেতেই সোহানা আশেপাশে তাকায়। পুরো রেস্টুরেন্টটি খালি ছিল। কোনো কাস্টোমার ছিল না সেখানে। তবে কি মুরাদ তার জন্য পুরো রেস্টুরেন্টটি কিছুক্ষণের জন্য ভাড়া নিয়েছে?
.
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৩
#সুমাইয়া মনি

দুপুরে ইসানাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হয়। কেননা টাইসন আহতথাকার কারণে রাদের কথা অনুযায়ী তাকে বাড়িতে ফিরে দেখাশোনা ও খাওয়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে। বাড়িতে ফিরে ইসানা টাইসনকে তার ছোট বিছানায় দেখতে পায়। সেখানেই আয়েশ করে শুয়ে ছিল। ইসানা আগে টাইসনকে খাবার দিয়ে নেয়। টাইসন খাবার খেয়ে পুনরায় বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকে। একটু পর ইসানা টাইসনের খাবার খাওয়া শেষ হয়েছে কি-না দেখতে এসে মেজাজ তুঙ্গে ওঠে যায় তার। টাইসব খাবার চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেছে। এমনটা কখনোই করে না। আজ এরূপ কৃতকর্ম দেখে ইসানা রাগে শক্ত হয়ে রয়। টাইসনের পানে রাগী দৃষ্টি ফেলে ফ্লোর মুছে দেয়। রাতের রান্না শেষ হয় চারটার দিকে। গোসল সেরে টাইসনকে ডাকতে আরম্ভ করে রাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে।
টাইসন ইসানার ডাক শুনেও চুপচাপ বসে থাকে। কোমড়ে হাত রেখে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইসানা চলে এলো।
রাদ দশটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে। সঙ্গে ছিল মুরাদ। মুরাদ ইসানার রুম নক করে ভেতরে প্রবেশ করল। রাদ মুরাদকে ডাকতে এসে ইসানার রুমে ওঁকে দেখে মুখ কিছুটা ঘুচে এলো। ফ্রেস হতে না গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। মূলত তাদের কথপোকথন শোনার জন্য এখানে বসেছে। তার হৃরয়ে জলন অনুভব করছে ঠিক সেদিনের মতো। বার বার তির্যক নজরে তাকায় রুমের পানে। দশ মিনিট পর মুরাদ ইসানাকে নিয়ে বাহিরে এসে দেখে রাদ গুরুগম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে বসে রয়েছে। রাদ দু’জনের পানে চেয়ে গলার টাই খুলতে খুলতে মুরাদের নিকটে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে তার রুমে নিয়ে এসে দরজা লক করে দেয়। ইসানা আহাম্মক হয়ে চেয়ে রয়। রাদের এরূপ আচরণ ইসানার বোধগম্য নয়।
মুরাদ রাদের পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘হোয়াট সমস্যা?’
‘তার সঙ্গে কী কথা বললি?’
‘সোহানার বিষয়ে কথা বলেছি। প্রপোজের বিষয়।’
‘রুমে গিয়ে বলার কী প্রয়োজন ছিল?’
‘তো?’
‘তো-টো জানি না। আজকের পর থেকে তুই তার সঙ্গে আলাদাভাবে একা কথা বলতে পারবি না।’
‘হোয়াই?’ ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলল।
‘আমি নিষেধ করেছি তাই।’
মুরাদ চোখ পিটপিট করে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে বলল,
‘মেবি জ্বলছে কিছু?’
রাদ চোখ ছোট ছোট তাকায়। মুরাদ আঙুল তুলে বলল,
‘তোর হৃদয় জ্বলছে শিওর?’ বলে হেসে দেয়।
রাদ মুরাদকে মা’র’তে উদ্যত হতেই বিছানায় উঠে দাঁড়ায় মুরাদ। বলে,
‘জোক ইয়ার!’
‘আউট!’
‘আচ্ছা।’ বিছানায় থেকে নেমে হেঁটে দরজার নিকটে এসে বলল,’তাকে বিদায় বলে যাই।’
‘নাহ!’ বলে এগিয়ে আসতে নিলে মুরাদ এক ছুঁটে পালিয়ে যায়৷ রাদ টাইসনকে কোলে তুলে নেয়। কিছুক্ষণ আদর বিনিময় করে ফ্রেশ হতে যায়।
_
পরদিন শুক্রবার ছিল। তাই রাদ ফ্যাক্টরিতে যায় নি। ইসানাকেও যেতে নিষেধ করেছে। টাইসনের লেজ এখন কিছুটা আহত মুক্ত। সে বিভিন্নভাবে ইসানাকে বিরক্ত করে। রাদের জন্য ইসানা এখনো দমে আছে। নয়তো কি যে করতো নিজেরও জানা নেই। কিচেনের কাজকর্ম সেরে রুমে এলো। কাল সারাদিন সোহানার সঙ্গে কথা হয়নি। ফোনটি হাতে তুলে সোহানার নাম্বারে কল দেয়। সোহানা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আনমনে মাথা আঁচড়াচ্ছিল। তার আনমনার কারণ মুরাদ। সোহানা মুরাদের ভালোবাসা জড়িত আবেগপ্রবণ কথাগুলো ভাবছে। কাল মুরাদ কল দেয়নি আর। এখন সকাল দশটা বাজে। এখনো সে-ই মানুষটির ফোন না আসায় চিন্তিত হয় সোহানা। এসব ভাবতে ভাবতে একবার কল কেটে যায়। দ্বিতীয় বার ফোন বেজে উঠায় ভাবনা ফেলে ফোন রিসিভ করে।
‘কল ধরছিস না কেন? কাল সারাদিনও তো কল দিলি না। কিছু হয়েছে নাকি?’
সোহানা ইসানার প্রশ্নের উত্তর ঘুরিয়ে বলল,
‘মুরাদকে নাম্বার, বাসার এড্রেস তুই দিয়েছিস?’
‘হ্যাঁ!’
সোহানা চুপ করে রয়। মনঃক্ষুণ্ন হয় তার কিছুটা। ইসানা বলে,
‘তার প্রপোজ করার বিষয়টি আমি জানি। মুরাদ তোকে ভালোবাসে। তুই তার ভালোবাসা এক্সেপ্ট কর।’
‘তোর দিক থেকে ভাব না! তুই করতে পারবি এক্সেপ্ট?’
‘অবশ্যই!’ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
‘মুরাদ নয়, রাদের কথা বলেছি। রাদ যদি তোকে প্রপোজ করে তুই তাকে মেনে নিতে পারবি?’
‘প্রশ্নই আসে না। রাদ এটা কখনোই করবে না।’
‘যদি এমনটা হয়।’
‘আমার জীবন, তোর জীবন এক না। আমি ডিভোর্সি মেয়ে।’
‘তুই ডিভোর্সি, কিন্তু এখনো কুমারীই আছিস। আমার ভাবনা থেকে ভেবে দেখ।’
‘এখানে আমাদের টপিক টেনে ব্যাপারটা কঠিন করছিস তুই।’
‘আমি মেনে নিলাম। কিন্তু আব্বু-আম্মু তো মানবে না। তখন কি কষ্ট হবে না আমার।’
‘ফিউচার পরে ভাব। আগে সামনে যে আছে, তার ভূমিকা পালন কর।’
‘নো নিড।’
‘ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড সোহানা…।’
খট করে ফোন কেটে দিলো সোহানা। তার প্রচুর কান্না পাচ্ছে। এমন একজনকে সে মনে রাখতে চাইছে যার অস্তিত্ব জীবনে পরবর্তীতে আসবে কি-না জানা নেই তার। কষ্টে হাতের মুঠোয় চিরুনি চেপে ধরে।
ওপর প্রান্তে ইসানা সোহানার বাক্যগুলো ভাবছে। রাদের নিকট থেকে প্রপোজাল পাওয়া অসম্ভব! কিন্তু সত্যি যদি এটি বাস্তবে রূপ নেয় তখন? এসব ভাবতে চায় না সে। বাহির থেকে তখনই রাদের আওয়াজ ভেসে আসে।
‘আপনি একটু বাহিরে আসুন।’
ইসানা বেরিয়ে দেখে রাদ একটি কাঁচের বাটিতে ডিম ফেটছে। টেবিলে আটা, লিকুইড দুধ, চকোলেট এসেন্স সহ আরো অনেক কিছু রাখা। ইসানা বুঝতে পারে রাদ কেক বানাচ্ছে।
রাদ ইসানার উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,
‘আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’
‘আমার কাছে দিন আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’
‘প্রয়োজন নেই। আপনি শুধু দেখবেন।’
ইসানা জবাবে ‘হুম’ বলে।
রাদ সব কিছু ঠিকমতো দিয়ে কেকের তরল মিশ্রণ তৈরি করে ফেলে। পরিশেষে ইসানার ওপর নজর ফেলে বলে,
‘সব ঠিকমতো ছিল?’
‘হ্যাঁ!’
‘আমি অল্পস্বল্প রান্না করতে পারি। মামনি বাড়িতে যখন থাকত না। আমিই রান্না করতাম।’
‘রাধুনি ছিল না?’
‘ছিল। তবুও শখের বশে রান্না করতাম। অবশ্য সার্ভেন্ট রা আমাকে রান্নাঘরে যেতে নিষেধ করতো মামনির নিষেধাজ্ঞা ছিল তাই।’
ইসানা নিরুত্তর থাকে। রাদ পুনরায় বলল,
‘পাপা মারা যাবার পর মামমি আমাকে সময় দিতে পারতো না। বেশিরভাগ সময় ফ্যাক্টরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কাজের লোকরা ছাড়াও আমাকে আমার কাজ গুলো একা একা করতে হতো। মামনির সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাও বন্ধুত্বসুলভ না। আমার সঙ্গে মামনি সব সময় গম্ভীর আচরণে কথা বলত। তাকে এমন দেখতে দেখতে আমি নিজেও গম্ভীর স্বভাবের হয়ে উঠে। আমি কারো সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না। মামনি আমাকে ভালোবাসা দিয়েছে। কিন্তু সেটা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না। একটি বাচ্চার সঠিকভাবে ভেড়ে উঠার ক্ষেত্রে আদর-স্নেহ, ভালোবাসা খুবই প্রয়োজন।’
মনোযোগ দিয়ে রাদের কথাগুলো শুনছে ইসানা। রাদের মাঝেও ভালোবাসার কমতি উপলব্ধি করতে পারছে ইসানা।
উপর থেকে রাদকে দেখলে বোঝার উপায় নেই তার মধ্যেও সুপ্ত ভালোবাসার কমতি রয়েছে।
রাদ এবার হালকা কেশে বলে,
‘সোহানা আপু কি মুরাদের প্রপোজাল এক্সেপ্ট করেছে?’
‘নাহ!’ ছোট্ট করে জবাব দেয় ইসানা।
দু’জনার মাঝে নীরবতা এসে ভর করে। রাদ কেকের বাটিটি নিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। ওভেনের মধ্যে রেখে অন করে ড্রইংরুমে ফিরে এসে ইসানাকে সেই স্থানেই দেখতে পায়। বলে,
‘ওভেন অন করে দিয়েছি কেক হয়ে গেলে নামিয়ে নিবেন। আমার অনলাইনে মিটিং আছে বায়ারদের সঙ্গে।’
‘আচ্ছা আপনি যান।’
রাদ এগিয়ে গিয়েও থেমে বলল,
‘আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।’
‘আপনিই ঠিক আছে।’
‘ওকে, তবে স্যার বলে ডাকবেন না। বাড়িতেও না, ফ্যাক্টরিতেও না।’
ইসানা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানায়। রাদ মৃদুহাসি প্রধান করে চলে যায়৷ রাদের প্রধান করা মৃদু হাসি ইসানার ভালো লাগে। ওর ঠোঁটেও মুচকি হাসি চলে আসে। ইসানা রান্না বসিয়ে দেয়। কিন্তু বারে বারে সোহানার বলা কথা গুলো তাকে চিন্তিত করে তুলছে। রুম থেকে ফোনের রিংটোন শুনতে পায় ইসানা। চুলার আঁচ কমিয়ে তড়িঘড়িতে রুমে এসে স্ক্রিনে সোহানার নাম দেখে দ্রুত রিসিভ করে। ইসানা হ্যালো বাক্যটি সম্পূর্ণ করার পূর্বেই সোহানা গমগম আওয়াজে বলে,
‘বিকেল চারটায় আমার সঙ্গে রমনাপার্কে দেখা করবি। সময় যেন এদারওদার হয় না। ঠিক চারটায়।’ বলে তৎক্ষনাৎ ফোন রেখে দেয় সোহানা। ইসানা এবারও বলার সুযোগ পায় না।
চিন্তায় কপাল কুঁচকে আসে তার। সরু নিশ্বাস টেনে কিচেকে ফিরে।
_
চারটার দিকে দু বান্ধবী এক সঙ্গে দেখা করে রমনায়। প্রথমে তো দু’জনেই চুপ করে তাকে। পরক্ষনেই সোহানা মুরাদের টপিক তুলে কথা বলে,
‘আমি তার সঙ্গে কোনো প্রকাশ সম্পর্কে জড়াতে চাই না। তুই তাকে ক্লিয়ার করে বলে দিবি।’
‘সমস্যা কী?’ কিছুটা জোর গলায় জানতে চাইলো ইসানা।
সোহানা তড়াক করে ঘুরে তেজি কণ্ঠে বলে,
‘সমস্যা কী তুই জানিস না? নাটক করিস আমার সঙ্গে।’
‘না আমি নাটকের হিরোইন, না তুই। তো এটা নাটক হয় কীভাবে?’
‘কথা ঘুরানোর চেষ্টা একদম করবি না।’
‘রাজি হতে সমস্যা কী তোর?’
‘আমার পরিবার যেখানে আমাকে বিয়ে দিবে আমি সেখানেই বিয়ে করব।’
‘তো রাজি হয়ে যা।’
‘আব্বু কখনোই রাজি হবে না। বুঝতেছিস না কেন ইসা।’ চিল্লিয়ে বলল সোহানা।
‘আঙ্কেল রাজি আছে ব’ল’দা মহিলা।’
সোহানা থ হয়ে যায়। কপালে তিন-চারটি ভাঁজ পড়ে। উঠে দাঁড়াতেই ইসানা হাত ধরে বসিয়ে হেসে হেসে বলে,
‘আঙ্কেল সেদিন আমার কাছ থেকে মুরাদের বিষয় সব জেনেছে। তারপর সেদিন যখন মুরাদ আমাকে তোর ব্যাপারে কথা বলতে ক্যান্টিনে ডেকেছিল, তখন আঙ্কেলকে লাইনে রেখে মুরাদের বলা কথা গুলো শুনিয়েছি। মুরাদকে আঙ্কেল পছন্দ করেছে। বয়স ফ্যাক্ট না। ওর মনমানসিকতায় আঙ্কেল মুগ্ধ হয়েছে। সঙ্গে তোর প্রতি এত ভালোবাসা দেখেও সে বিমোহিত।’
সোহানা মাথা নিচু করে মন খারাপ করে ফেলে। খুশিতে তার এই মুহূর্তে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চটজলদি ঝাপটে ধরে ইসানাকে। বলে,
‘আমি আমি…’ কথাগুলো মুখে আঁটকে যাচ্ছে সোহানার।
‘কিচ্ছু বলার প্রয়োজন নেই। একটু পর মুরাদ ভাইয়া আসবে তাকেই বলিস।’ সোহানা ইসানাকে ছেড়ে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
‘তুই আসতে বলেছিস?’
‘হুম।’
সোহানা মনে মনে খুশি হলেও ইসানার সামনে সেটি প্রকাশ করে না।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here