তোমারই আমি আছি পর্ব ৪

#তোমারই_আছি_আমি
পর্ব-০৪
#Sara_Mehjabin
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম খেয়াল নেই। পায়ে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুমেই বুঝতে পারলাম কেউ আমার দড়ির বাধনগুলো খুলে দিচ্ছে। তারমানে আকাশভাইয় ছেড়ে দিচ্ছে আমাকে!
ব্রাউন কালার গেন্জি পড়া একটা ছেলে মাথা নিচের দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার পায়ের দড়িগুলো খুলছে। আমার বাধা পা’দুটো তার কোলে রাখা। আস্তে আস্তে সে আমার পায়ের দড়ি খুলে দিল।
ছেলেটাকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এটা তো আকাশভাইয়া নয়। তাহলে কে? আকাশভাইয়া ঘরটায় তালা দিয়ে গেছিল সে ঢুকল কিভাবে?
:ক-কে, কে আপনি? কিছুটা ভয় নিয়েই প্রশ্ন করলাম তাকে।
আমার প্রশ্ন শোনার সাথে সাথে ছেলেটি মাথা উঁচু করল। সরাসরি আমার চোখে চোখে তাকাল।
ছেলেটার চেহারা দেখে আমি আশ্চর্যের চরমে পৌঁছে গেলাম!! হচ্ছে কি আমার সাথে? ফেলে আসা অতীতের হারিয়ে যাওয়া চরিত্ররা সবাই ফিরে আসছে। তাও এক-ই দিনে। কেন?
: নিবিড়ভাইয়া তুমি? তুমি বেঁচে আছো?? ওরা সবাই খুব ভেঙে পড়েছে তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর। খালামনি এখনো আশা করে তুমি ফিরে আসবে। কোথায় ছিলে এতদিন? আর এখানেই বা আসলে কিভাবে?
: “ওয়েট পুতুল ,ওয়েট” নিবিড়ভাইয়া হাত তুলে থামিয়ে দেয় আমায়। “একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলে আমি কোনটার উত্তর দেব? পুতুল,এখনো ছোট্টটাই আছিস তুই- সবকিছুতেই ওভার এক্সাইটেড হয়ে পড়িস।” (বলতে বলতে আমার গালে হাত রাখল)
এক ঝটকায় নিবিড়ভাইয়ার হাতটা সরিয়ে দিলাম। “খবরদার ভাইয়া। আবার আমাকে পুতুল ডাকছ? এই নামটা শুধু আকাশভাইয়ার। এই নামে ডাকার অধিকার আর কারো নেই। আমি শুধু আমার আকাশভাইয়ার পুতুল।”
আমার কথা শুনে নিবিড়ভাইয়া হাসল শুধু।
:আচ্ছা বাবা এখন না’ই ডাকতে দিলি। যেদিন ডাকার সময় হবে সেদিন ডাকব নাহয়। এখন চল্ তোকে নিয়ে যাই। দড়িটা খুব শক্তভাবে বাধা ছিল রে। তোর অনেক কষ্ট হয়েছে। হাঁটতে পারবি না। আয় কোলে করে নিয়ে যাই।
আমাকে তোলার জন্য নিবিড়ভাইয়া এগিয়ে এল।
“নিবিড়ভাইয়া একদম টাচ করবে না বললাম।”
“আরে টাচ্ না করলে তোকে কোলে কিভাবে নেব পাগল?”
নিবিড়ভাইয়া আমার দিকে এগোতে থাকে।
তখনই আকাশভাইয়ার আগমন। নিবিড়ভাইয়াকে দেখে চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারন করেছে। আমার একটা হাত টেনে আমাকে কোলে তুলতে নিয়েছে সেইমুহুর্তেই নিবিড়ভাইয়ার হাত চেপে ধরল‌।
নিবিড়কে একটানে ওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল আকাশভাইয়া। ওর মাথাটা বারকয়েক ওয়ালের মধ্যে ঠুকে দিল। তারপর ওকে চেপে মাটিতে ফেলে ওর ওপর চড়ে বসে ওকে এলোপাতাড়ি চড়-কিল-ঘুষি মারতে লাগল। চোখগুলো লাল টকটক করছে আকাশভাইয়ার। কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। নিবিড়ভাইয়াকে মারছে ঠিকই কিন্তু হাত দুটো অনবরত কাঁপছে। এগুলোও আকাশভাইয়ার রাগের লক্ষণ। আকাশভাইয়া শাস্তি দিতে চেয়েছিল আমায়। আর নিবিড়ভাইয়া আমাকে বাঁচাতে চেয়েছে। এজন্যই বোধহয় এতো রাগ তার। কিন্ত একটা জিনিস আমি বুঝছি না নিবিড়ভাইয়া হারিয়ে গিয়েছিল অনেক বছর আগে। সবাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম ও মারা গেছে। আকাশভাইয়ার তাকে দেখে অবাক হওয়ার কথা ছিল যেমন আমি হচ্ছি। কিন্তু আকাশভাইয়ার মধ্যে তেমন পরিবর্তন দেখলাম না। তাহলে এমন না তো আকাশভাইয়া জানত নিবিড় কোথায় আছে! না, এসব কি আবোলতাবোল ভাবছি।
আকাশভাইয়া নিবিড়কে অনেক মেরেছে। রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে ওর শরীর থেকে। আকাশভাইয়া হঠাৎ আমার দিকে খেয়াল করল। দেখল আমি ভয়ে কাঁপছি। শ্বাস নিচ্ছি টেনে টেনে। আকাশভাইয়া জানে আমার মারাত্মক ব্লাডফোবিয়া। কারো শরীর থেকে ব্লাড যেতে দেখলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তারপর অজ্ঞান হয়ে যাই। এটা বুঝেই আকাশভাইয়া পকেটের টিস্যু দিয়ে নিবিড়ের ব্লাড মুছে জায়গাটা বেঁধে দিল‌।
আকাশভাইয়া: পিরিত না তোর? খুব বেশি পিরিত, হ‍্যা? এতোই যখন পিরিত বিয়ে করছিস না কেন? নাকি বিয়ের পরের সবকিছু বিয়ের আগেই করে ফেলেছিস?
কথাগুলো বলে আকাশভাইয়া রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। যেন পারলে আমাকে চোখ দিয়েই গিলে খায়।
আকাশভাইয়ার কথায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
আকাশভাইয়া নিবিড়ের মাথাটা চেপে বলল, যতোই পিরিত থাক্ আমার কাজ না হওয়ার আগে ওকে টাচ করারও চেষ্টা করিস না।
নিবিড়: সারাকে এখনি এখান থেকে নিয়ে যাবো আমি। আমার সামনে সারাকে কিভাবে টাচ করো আমিও দেখি।
বলেই নিবিড় উঠে আমার কাছে আসতে চেষ্টা করে। আকাশভাইয়া ওকে আবারও মাটিতে ফেলে আমাকে বেঁধে রাখার দড়িটা দিয়ে নিবিড়কে বেঁধে ফেলল।
তারপর ঐ রক্তবর্নের চোখ দুটো নিয়ে এগিয়ে আসল আমার দিকে। আকাশভাইয়া একেক পা এগিয়ে আসছে আর আমার হৃৎস্পন্দনের গতি কমছে। আজ ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
আমার শরীরে নড়ার শক্তি নেই। আকাশভাইয়া যেভাবে চেয়ারে বসিয়ে গিয়েছিল সেভাবেই আছি। আকাশভাইয়া চেয়ারের কাছটায় এসে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল।
তারপর আলগোছে আমার পা’দুটো কোলের ওপর তুলে পকেট থেকে একে একে তুলো, ওষুধ, এ্যান্টিসেপ্টিক সবকিছু বের করে তুলোর মধ্যে ওষুধ নিয়ে ধীরে ধীরে আমার পায়ে লাগাতে থাকে। তুলো লাগতেই পায়ে আমি এক চিৎকার দিলাম, আহহহহ
আকাশভাইয়া দাঁতমুখ খিচিয়ে ধমক দিল, কি সমস্যা? ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছিস কেন? দেখছিস না একটা কাজ করছি। বলেই আবার আমার পায়ে তুলোটা লাগাতে চায়।
আমি: কি করব? লাগে তো…
আকাশভাইয়া: সারা তুই কি এখনো বাচ্চা? লাগলেই ষাড়ের মতো চিল্লাবি?? এ্যান্টিসেপ্টিক দিলে জ্বলে তুই জানিসনা?
আমি:আমি দিব না। আমি আপনার কাছে কিচ্ছু ওষুধ দিব না।
আকাশভাইয়া: থাপড়ায়ে গাল ফাটায়া দিব। অনেক জায়গায় কেটে গেছে তোর। এ্যন্টিসেপ্টিক না দিলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।
আমি: হলে হবে। আমি মরে যাই। তাতে আপনার কি?
আকাশভাইয়া: তোর কি থাপ্পড় খাওয়ার অনেক শখ?
আমি দুইপাশে মাথা নাড়লাম।
আকাশভাইয়া: তাহলে চুপ হয়ে বসে থাক। একদম চুপ।
আমি: আকাশভাইয়া আমার ব‍্যথা লাগছে। অনেক ব‍্যথা লাগছে।
আকাশভাইয়া আমার পায়ে ওষুধ লাগাচ্ছে আর আমি জ্বালায় আকশভাইয়ার হাত খামছি দিয়ে ধরে কাঁদছি।
আকাশভাইয়া পকেট থেকে ললিপপ বের করল।
আকাশভাইয়া: ধর্, চাটতে থাক্।
ললিপপ দেখে খুশিতে লাফ মারতে নিয়ে থেমে গেলাম। ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে হাতে-পায়ে ব‍্যথা পেলে আমাকে কিছুতেই ওষুধ লাগানো যেত না। অন‍্যরা দূরে থাক, আকাশভাইয়া নিজের কোলে বসিয়েও ওষুধ লাগাতে পারত না। ওষুধ লাগানোর আগেই আমি চিৎকার। আমি ব‍্যথা পেলেই আকাশভাইয়া চকলেট এনে দিত। আমি খাওয়ায় ব‍্যস্ত‌ হলেই ওষুধ দিতে পারে আর আমি ব‍্যথাটা টের না পাই।
স্মৃতি মনে পড়তেই কান্না চলে আসল। আকাশভাইয়া কতদিন তুমি আমাকে এভাবে ভালবাসো না। অন‍্যদিকে মুখ রেখে বললাম, আমি খাব না আপনার দেওয়া কিছু।
আকাশভাইয়া: না খেলে না খাবি। কিন্তু ওষুধ লাগানোর সময় আমার একটুও ডিস্টার্ব হলে থাপ্পড় একটাও গালের বাইরে হবে না। যে কয়টা চিৎকার দিবি সেই কয়টা থাপ্পড়।
আকাশভাইয়ার হাত থেকে আস্তে আস্তে ললিপপ নিলাম। ললিপপ খাচ্ছি আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আকাশভাইয়ার দিকে। নিচের দিকে থাকায় আকাশভাইয়ার মুখ দেখা যাচ্ছে না। চোখভর্তি পানি চলে আসছে আমার।। আকাশভাইয়া তোমার মধ্যে আমি কোন রাগ-ঘৃনা খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার হাতের প্রতিটা স্পর্শে তোমার পুতুলের জন্য তীব্র ভালবাসা। এত ভালবাসায় ভরে আমার সেবা কেন করছ যখন তোমার মনে আমার জন্য এতটাই ঘৃনা?
আকাশভাইয়া আমার হাত-পায়ে ওষুধ লাগিয়ে আমার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিল। ছেলেমেয়গুলো আমার জামার দুই পাশ ছিঁড়ে ফেলেছে। এই অবস্থায় আমি কিছুতেই বাইরে যেতে পারতাম না।
চাদরটা গায়ে জড়িয়ে আকাশভাইয়া বলল, যা এখন।
আমি আকাশভাইয়ার দিকে তাকালাম। অন‍্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দৌড়ে আকাশভাইয়ার পা জড়িয়ে ধরলাম,,,,,
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here