তোমার প্রণয় নগরে পর্ব -১৫+১৬

তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ১৫

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

ধানমন্ডির নামীদামী রুফটপ রেস্টুরেন্টে তারা সবাই। খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির মাঝে কৃত্রিম আলোয় ঘেরা সুন্দর মনোরম সুদৃশ্য জায়গা। এখানকার সচ্ছ বিশুদ্ধ হাওয়া মনের সকল তিক্ততাকে মিলিয়ে দিয়েছে। সায়রার মন এখন অনেকটাই ভালো। সবার সাথে আড্ডায় মজে সে। টেবিলে আরসাল সায়রা রিদ্ধি সায়ন বসে। তুর্জয় এখনো পৌঁছায়নি। সামান্য দূরে পাখি বাচ্চাদের মত স্লিপারে বসে আছে। পিয়াস পাখির ছবি তুলে দিচ্ছে। আরসাল সায়রা মুখোমুখি। সায়রা যথাসম্ভব আরসালের দৃষ্টি এড়ানো চেষ্টা করছে।
আড়চোখে মাঝেমাঝে আরসালকেও দেখে নিচ্ছে। গাড়ির কথা মনে করে ভীষণ লজ্জিত সে। এভাবে আরসাল ভাইয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদা মোটেও উচিত হয়নি তার। তার উপর নিজের বোকা বোকা প্রশ্ন! উফফ! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। না জানি আরসাল ভাই কি ভাবছে? সায়রার মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করছে। হুট করে আরসাল ভাই বদলে গেল কেন? উনার সেই রগচটা স্বভাব, বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিলো কেন? হুট করে সায়রার প্রতি এত সহানুভূতি কেন? এখন কি আরসাল ভাই তাকে আর ঘৃণা করে না?
সায়রার হুশ ফিরল হাসিঠাট্টার আওয়াজে। তুর্জয় ততক্ষণে এসে গেছে। তুর্জয় দৃষ্টি কাউকে খুঁজছে। সায়রা বেশ বুঝতে পারছে আরমিনকে খুঁজছে তুর্জয়। সায়রা তুর্জয়ের কাছে এগিয়ে ধীর স্বরে বলল,

–” সরি ভাইয়া, আপুকে নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু দাদী আসতে দেয়নি!”

তুর্জয়ের মন খারাপ হলো। প্রকাশ করল না। মলিন হেসে জবাব দিলো,

–” ইট’স ওকে। ডোন্ট বি সরি!”

জমিয়ে আড্ডা চলছে সবার। সায়ন সায়রাকে নিজেদের সাথে বাড়িতে যেতে বেশ পিড়াপিড়ি করছে। তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বাড়িতে রাজি হলেও এখন মন টানছে না সায়রার। আরমিনের মন ভালো নেই। এসময় সায়রা বাড়িতে না থাকলে আরমিন একা একা আরো বেশি মন খারাপ করবে। তাই যেতে চাইছে না সায়রা। ভার্সিটির বাহানা করে এড়িয়ে যেতে চাইছে সে। সায়ন তা মানতে নারাজ । আড্ডার মাঝে মজার স্বরে জিজ্ঞেস করল সায়ন,

–” ঘটনা কি বলতো সায়রা? ভার্সিটিতে যাওয়ার এত তাড়া কেন তোর? ভার্সিটিতে বিশেষ কেউ আছে নাকি?”

সাথে রিদ্ধিও তাল মিলাল,

–” হু হু সত্যি করে বলতো বিশেষ কেউ আছে নাকি?”

তাদের লেগপুলিং-এ সায়রা দমল না। বরং দ্বিগুণ উৎসাহী স্বরে বলল,

–” তোমরা কোনো কথাই বলো না। আমি তোমাদের উপর ভীষণ রেগে। তোমরা আমার হক মেরে খেয়েছ! কই ভেবেছিলাম রিদ্ধিদির বিয়ে হবে সুদর্শন একটা দেবর থাকবে! তার সাথে চুটিয়ে প্রেম করব। বাইকের পিছনে বসে পুরো শহর ঘুরে বেড়াবো। কিন্তু হলো কি? না আছে রিদ্ধিদির সুদর্শন দেবর, আর না আছে সায়ন ভাইয়ের সুদর্শন কোন বন্ধু! দি তুমি কি প্রেম করার জন্য এই সায়ন ভাইয়াকেই পেলে? উফ আমার বোনগত অধিকারটা ফালাফালা করে দিলে! ”

সায়ন ভেবেছিল কথার মারপ্যাঁচে ফেলে সে সায়রাকে দমিয়ে দিবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো, সায়রা নিজেই তাদেরকে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে দিয়েছে! ড্যাবড্যাব করে সায়রার দিকে তাকিয়ে আছে সায়ন । সায়রা সবাইকে দমিয়ে দিয়ে বুক ফুলিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। অপর পাশ থেকে কারো নিরস কর্কট দৃষ্টি সায়রাকে দেখছে। চোখে দিয়ে যদি কাউকে ভস্ম করা যেত সায়রা এতক্ষণে ভস্ম হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। সায়রা আশেপাশে দেখছিল- আরসালের দিকে চোখ যেতেই সে থমকে গেল। কটকট দৃষ্টিতে সে সায়রাকে দেখছে। যেন গিলে খাবে। সায়রা রাগের কারণ খুঁজছে। সে এমন কি করেছে যে আরসাল ভাই এমন ভয়ংকর রেগে?

ডিনার সেরে বের হচ্ছে সবাই। সায়রা সবার আগেই নিচে নেমে সায়নের গাড়িতে উঠে এক কোণায় চুপটি করে বসে থাকে। আরসালের সাথে বাড়ি ফিরতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক নয় সে। যা ভয়ংকর রেগে আছি দেখা যাবে অর্ধেক রাস্তায় যেয়ে সায়রাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে। মনে মনে দোয়াদরুদ পড়তে শুরু করেছে সে। আরসালের সাথে যেন তাকে না যেতে হয়। কিন্তু কথায় আছে না? যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আসার সময় সায়নের গাড়িতে রিদ্ধি সায়ন পাখি পিয়াস এসেছে। পেছন সিটে তিনজন বেশ আরাম করে বসা যায় কিন্তু পাখি পিয়াস তা করবে না। দুজনের প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে। বাড়ি অবধি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাবে। এই নিয়ে দুভাই বোন ঝগড়া শুরু করেছে সায়রাকে আরসালের সাথে যেতে বলছে। সায়রা নাছোড়বান্দা সে যাবে না তো যাবে না। অমনি আরসাল আর সায়ন এলো। বিনা ভণিতায় সোজাসুজি সায়রাকে বলল,

–” গাড়ি থেকে উঠে আয় সায়রা, তুই আমার গাড়িতে যাচ্ছিস।”

সায়রা ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিল। আরসালের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বড় হাই তুলে বলে সায়রা,

–” আমি নামতে পারবো না আরসাল ভাই। আমার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে! আপনি পিয়াসকে সাথে নিয়ে যান।”

–” পিয়াস না তুই যাবি! ”

পিয়াসও আরসালের সাথে তাল মিলিয়ে খুশি গদগদ করে বলল,

–” হ্যাঁ হ্যাঁ আরসাল ভাই ওকে নিয়ে যান। যেভাবে এসেছি ঐভাবেই বাড়ি ফিরবো!”

সায়রা পিয়াসের দিকে কটকট রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। যেন চোখ দিয়েই তাকে গিলে খাবে। ইশারায় বুঝিয়ে দিলো বাড়ি ফিরে তার খবর আছে। পিয়াস তা দেখে ভয়ে ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেল। আরসাল কিছু বলবে তার পূর্বেই গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে নিলো সায়রা। ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,

–” আমার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে নড়ার শক্তি পর্যন্ত নেই। আপনি পিয়াসকে নিয়ে যান আরসাল ভাই। । ”

রিদ্ধি এতক্ষণ সব দেখছিল। রিদ্ধি বুঝছে না আরসাল এভাবে ক্ষেপে আছে কেন? সায়রাকে চোখ বুজে নিতে দেখে রিদ্ধির ভীষণ মায়া হলো। আদুরে স্বরে বলে উঠল,

–” থাক না আরসাল! বাচ্চা মেয়ে ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। তুই বরং পিয়াসকে নিয়ে যা।”

সায়রা পিটপিট দৃষ্টি মেলে চুপিচুপি দেখছে। আরসাল রাগে নিশ্বাস ফেলল। এদিকওদিক তাকিয়ে ফিচেল হেসে আওড়াল,

–” কে বাচ্চা মেয়ে? এই মেয়ে? ও বাচ্চা মেয়ে না, পাকনা মেয়ে!
এ বয়সেই প্রেম করার কি শখ তার!”

সায়রার কপাল কুঁচকে এলো। মনে মনে বলল, ” বলুন , আরসাল ভাই আপনার সাথে কি পাকনামো করেছি? ফেয়ন্সি হবার স্বত্বেও কোন দিন আপনাকে ফোন দিয়ে জ্বালাতন করেছি? নাকি রিদ্ধিদির চাচাতো বোনদের মত আপনার উপর নজর দিয়েছি! হুহ! আপনি বললেই তো আমি পাকনা হয়ে যাবো না?”
রিদ্ধি সায়ন এতক্ষণে বুঝল আরসাল ঠিক কি কারণে রেগে। আরসাল জেলাস? সায়ন ঠোঁট টিপে হাসল। আরসাল গাড়ির দরজা খুলতেই সায়রা লাফিয়ে উঠল। রিদ্ধি অসহায় সুরে,

–” আরসাল…”

রিদ্ধির কথা শেষ করতে না দিয়ে আরসাল বলে উঠল,

–” ভয় নেই তোর বাচ্চা বোনকে খেয়ে ফেলব না। ঠিকঠাক ভাবে বাড়ি পৌঁছে দেব।”

রিদ্ধির কিছু বলার অবকাশ নেই। আরসাল সায়রার হাত টানতে টানতে নিজের গাড়িতে উঠাল। সায়রা আরসালের পাশে ফ্রন্ট সিটে চুপচাপ বসে আছে। কোন সাড়াশব্দ নড়বড় করছে না সে। অন্ধকার রাস্তা। গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে। আশেপাশে তেমন কোন গাড়ি নেই। হুট করেই গাড়ি থামল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সায়রা ছোট ঢোক গিলল। অন্ধকার কোন মাঠে গাড়ি থেমেছে। আকাশ ভরা তারা। গোল থালার মত চাঁদ। যার উজ্জ্বল দ্রুতিতে চারিদিক মধুর সৌন্দর্যে মেখে। ঢেউয়ের কলকল শব্দ ভেসে আসছে। আশেপাশে নিশ্চয় কোন নদী আছে। জনশূন্য নিরিবিলি চারিদিক। অচেনা এক ভয় কাজ করছে সায়রার মনে। সায়রা এদিকওদিক তাকিয়ে মাথা নুয়ে সায়রা ফিসফিসে বলে,

–” এখানে এসেছেন কেন আরসাল ভাই?”

আরসাল জবাব দিলো না। গাঢ় চোখে সায়রার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। জবাব না পেয়ে আবারো ফিসফিসিয়ে বলে উঠল সায়রা,

–” বাড়ি যাবো!”

আরসাল এবার মুখ খুলল। গম্ভীর স্বরে আওড়াল,

–” তখন কি জানো বলেছিলি? ইচ্ছে ছিল প্রেম করবি, বাইকের পেছনে বসে সারা শহর ঘুরবি! আর কি কি ইচ্ছে আছে বল আজ তোর সব ইচ্ছের কথা এক এক করে শুনবো। স্পিক আপ!”

সায়রা আমতা আমতা করে বলে,

–” সবাই তো প্রেম করে আরসাল ভাই। আমার বয়সি সবাই তো প্রেম করছে। আমার বান্ধবী ইরা এই নিয়ে চার চারটা প্রেম করেছে। পাঁচ নাম্বার রানিং। তাহলে আমি প্রেম করলে দোষ কোথায়?”

দাঁত কিড়মিড়ে আরসালের গম্ভীর উত্তর,

–” তুই প্রেম করতে পারবি না সায়রা। তোর সেই অধিকার নেই!”

সায়রা ভ্রু কুঁচকে নিলো। রাগ হলো তার। জোর গলায় প্রতিবাদী সুরে বলে উঠল সায়রা,

–” প্রেম করার অধিকার নেই, বিয়ে করার অধিকার নেই। করবোটা কি আমি? আমি কি করব, না করব সবটা কি আপনি ঠিক করবেন আরসা্ল ভাই?”

আরসাল ভয়ংকর ক্ষেপে গেল। চট করে সায়রাকে নিজের কাছে টেনে আনল। শক্ত ভাবে হাত চেপে কটকট দৃষ্টিতে তাকাল সায়রার দিকে। সায়রা মাথা নুয়ে আছে। আরসাল অন্যহাতে সায়রার থুতনি ধরে মুখ উঁচু করল। দুজনের দৃষ্টি মিলিত হলো। আরসালের অদ্ভুত মোহিত দৃষ্টি। চোখে মুখে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। নিভৃত অনুভূতি পূর্ণ এই দৃষ্টি। কেঁপে উঠল সায়রা। দুজনের মাঝে খুব একটা দূরত্ব নেই।
আরসালের ভারী ভারী তপ্ত নিশ্বাস সায়রার মুখে উপর পড়ছে। থরথর কাঁপছে সায়রা। বন্ধ গাড়িতে মুখোমুখি দুজন। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। অপলক চেয়ে আড়ষ্ট স্বরে প্রশ্ন করল আরসাল,

–” আমাকে তোর ভয় হয়না সায়রা? এই নিরিবিলি জনশূন্য পরিবেশে শুধু তুই আর আমি। আশেপাশে ক্রোশ দূর কেউ নেই। এই মুহূর্তে যে কোন কিছু ঘটতে পারে। যেকোন কিছু মানে তো বুঝিস?”

সায়রা ড্যাবড্যাবে আরসালের দিকে তাকিয়ে। যেন কোন মন্ত্রমোহে বিলিন সে। ঘোর লেগে গেছে তার চোখে। আনমনে তোতাপাখির মত করে বলল,

–” আপনাকে ভয় হচ্ছে না আরসাল ভাই। আপনার এই ভয়ংকর নেশাল দৃষ্টিকে ভয় হচ্ছে আমার। ভয় হচ্ছে, এই দৃষ্টির অতলে ডুবে না যাই!”

আরসাল এক হাতে সায়রার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরল, নিজের আরো কাছে টেনে আনল। আবেশে আঁখিদ্বয় বুঝে নিলো সায়রা। প্রবল বেগে নিশ্বাসের উঠানামা। সায়রার হাত জোড়া নিজের বুকের কাছে মিলিয়ে নিলো আরসাল। বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। শুধু হৃদপিন্ডের ধুকধুকানির ধপধপ আওয়াজ। সায়রার কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে চোখ বুজে নিলো আরসাল। সায়রার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। ঠকঠক কাঁপছে সে। খানিক বাদে আরসালের অস্থির কাতর আওয়াজ ভেসে এলো,

–” আমি সুদর্শন নাহ! আমার সাথে কি প্রেম হয় না? কথা দিচ্ছি, রোজ বাইকে করে পুরো শহর ঘুরবো দুজন। চিরকাল তোর এই সচ্ছ সরল চোখে ডুবব, ভাসবো! বল হবি তুই আমার প্রেয়সী? ”
তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ১৬

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

সেইরাতে সায়রা আরসালকে কোন উত্তর দেয়নি। ঘুমের ভণিতা করে আরসালের প্রণয় স্বীকারোক্তি ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গেছে। মন মস্তিষ্ক কোনভাবেই শান্ত করতে পারেনি সে। সারা পথ গাড়ীর সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে থরথর কাঁপছিল। আরসাল অবশ্য বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সায়রা নিজেকে শক্ত করে রেখেছে। চোখ খুলবে না তো, খুলবেই না। তারপর বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই সায়রা চট করে চোখ খুলে একপ্রকার দৌড়ে পালায়। সেই যে আরসালের দৃষ্টির আড়াল হলো, আজ তিনদিন আরসালের সামনে আসেনি সায়রা। কয়েকবার ফোন করেছিল আরসাল। সায়রা ফোন তুলেনি।

নভেম্বরের শেষ সাপ্তাহ। শীত পড়তে শুরু করেছে। আজকাল সন্ধ্যা নামতেই চারিদিকে কুয়াশায় আঁধার নেমে আসে। ভোরে ঘাসের উপর বিন্দু বিন্দু শিশির কণা মুক্তার মত চকচক করে। সকাল থেকে মনটা বেশ ‘কু’ ডাকছে সায়রার। খুব শীঘ্রই ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে তার সাথে। ঠিক কি কারণে ঘটবে সেটাও মনে মনে খানিক আন্দাজ করতে পারছে সে।
আগামী শুক্রবার ভার্সিটির পিঠা উৎসব। ভার্সিটিকে নতুন রঙে, নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে। রাখাল চন্দ্র ভবনের সামনে আনমনে আল্পনা আঁকছে সায়রা। বড় আম গাছটার পাতার আড়াল থেকে সকালের স্নিগ্ধ সোনালি রোদ সায়রার মুখশ্রীতে চুয়ে চুয়ে পড়ছে। রঙ দিয়ে হাত মুখ মাখামাখি তার। হিম শীতল হাওয়ায় অবাধ্য চুল গুলো বারবার মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। পরনের লাল কামিজ। গায়ের সাদা ওড়নাটায়ও রঙে মেখে। একজোড়া পা দ্রুত গতিতে সায়রার দিকে এগিয়ে আসছে। পা জোড়া আল্পনার সামনে এসে ঠেকল। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। মাথা তুলে পিটপিট দৃষ্টি মেলতেই থমকে রইল সে। চোখে মুখে বিস্ময় আশ্চর্য ভিড় করল তার। এ সময়, আরসাল ভাই এখানে কেন? উনার তো এ সময় রহিতা আপুর সাথে থাকার কথা! তবে কি উনি সেখানে যায় নি?
কন্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে জিজ্ঞেস করল সায়রা,

–” আরসাল ভাই! আপনি এসময় এখানে?”

আরসাল কঠোর দৃষ্টিতে সায়রাকে দেখছে। চোখ মুখ রক্তিম। সায়রা শুকনো ঢোক গিলল। টিস্যু দিয়ে হাতে লেগে থাকা রঙটুকু মুছে আরসালের দিকে এগিয়ে এলো সায়রা। আরসালের দৃষ্টি আগের তুলনায় আরো তুখোড় হলো। সায়রার দিকে দু’কদম এগিয়ে আসল। গালে লেগে থাকা রঙটুকু মুছে দিতে দিতে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” আমার এখন কোথায় থাকা উচিত সায়রা?”

সায়রা মিনমিনিয়ে জবাব দিলো,

–” রেস্টুরেন্টে। রহিতা আপু সাথে!”

আরসাল থামল। ভ্রু কুঁচকে সায়রার ভীতু মুখখানা দেখে নিলো। ভেতর থেকে তপ্ত নিশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। আগের মত গম্ভীর স্বরে আওড়াল,

–” রহিতা কেন? কথা তো ছিল তুই আসবি। সকাল থেকে আমি তোর অপেক্ষা করছিলাম সায়রা!”

সায়রা চুপ। আরসাল শক্ত করে সায়রার হাত চেপে ধরে, বিনাবাক্যে মাঠের মাঝ বরাবর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগে। আশেপাশের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে ভীষণ লজ্জিত সায়রা। চাপা স্বরে বলে উঠে,

–” কি করছেন আরসাল ভাই? সবাই দেখছে!”

সায়রার আওয়াজ বোধহয় আরসালের কর্ণকুহরে পৌঁছাল না। টেনে হিচড়ে সায়রাকে গাড়িতে উঠাল আরসাল। সায়রা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করার মত সাহস নেই তার।চড়া গতিতে গাড়ি চলছে। ভেতর ভেতর ভয়ে কাঠ সায়রা। কাঁদোকাঁদো অস্পষ্ট স্বরে বলল,

–” গাড়ির স্প্রিড কমান, আমার ভয় করছে আরসাল ভাই!”

গাড়ির স্প্রিড কমে এলো। সায়রার বুকে যেন প্রাণ ফিরল। আড়চোখে একবার আরসালকে দেখে নিলো সায়রা। এখনো রাগে ফোঁসফোঁস করছে। চোখ ভয়ংকর লাল। গাড়ি চলছে নিরুদ্দেশ। কোথায় যাচ্ছে তারা? জিজ্ঞেস করতে চাইল সায়রা কিন্তু আরসালের কঠোর মুখশ্রী দেখে থেমে গেল। আরসাল যা ভয়ংকর রেগে আছে, দেখা যাবে কিছু জিজ্ঞেস করলে হিতের বিপরীত ঘটবে। খানিক বাদে পাশ থেকে আরসালের রাশভারী আওয়াজ ভেসে এলো,

–” রহিতা না কি জানো মেয়েটার নাম? যাই হোক। মেয়েটার সাথে আমাকে কেন দেখা করতে বলছে তুই জানিস?”

সায়রা মাথা নুয়িয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,

–” হ্যাঁ জানি”

–” কি জানিস?”

— ” রহিতা আপুর সাথে আপনার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আপনার চাচা ফুপুদের সবার তাকে বেশ পছন্দ।”

–” আমার , আমার বাবা মার কাকে পছন্দ তা নিশ্চয় জানিস?”

সায়রা চুপ। আরসাল শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল,

–” কাল সন্ধ্যায় যখন ম্যাসেজ করে রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা বলেছিস- খুশি হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম বিশেষ কোন কারণে হয়তো দেখা করতে বলছিস। তোর এই জঘন্য পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার বিন্দু মাত্র ধারণা ছিলনা সায়রা। তাহলে আমি কখনো সেখানে যেতাম না! নেভার এভার।”

সায়রা আমতা আমতা করে বলল,

–” বাড়ির অন্য সবাই আপনার বিয়ে নিয়ে বড়মা বড়বাবাকে প্রেসার দিচ্ছিল। আপনিও কারো সাথে দেখা করতে রাজি হচ্ছিলেন না , তাই আমি ভাবলাম….

–” তুই ভাবলি আমাকে রেস্টুরেন্টে ডেকে সেই মেয়েটার সাথে ডেটে পাঠাবি তাই তো? স্টুপিড! ”

আরসাল দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। সায়রা চুপ। আরসাল রাগে ফোঁসফোঁস করছে। আরসালের রাগের সাথে সাথে গাড়ির স্পিডও বাড়ছে। ভয়ে দরজার সাথে জড়সড়ভাবে বসে আছে সায়রা। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে তার। সায়রা আরসালের দিকে অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টি মেলে তাকাল। আরসাল নীরব গম্ভীর। সায়রা জড় স্বরে বলল,

–” রহিতা আপু ভীষণ ভালোমেয়ে। আমাদের ভার্সিটির সুন্দরীদের তালিকায় প্রথম সারিতে তিনি। পড়াশোনায় তুখোড়। অন্যান্য এক্টিভিটিতেও বেশ পারদর্শী।”

–” তো?”

সায়রা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। আরসাল তার উত্তরের অপেক্ষায় নেই। সায়রা নিজে থেকেই ধীর আওয়াজ করল,

–” আপনি রহিতা আপুকে বিয়ে করে নিন আরসাল ভাই”

আরসালের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো। এই মেয়ে কি কিছু বুঝে না? না কি সব কিছু বুঝেও না বুঝার ভণিতা করছে?
সেইরাতে স্পষ্ট ভাষায় নিজের অনুভূতির স্বীকারোক্তি করল আরসাল।আর আজ সায়রা এমন দেখাচ্ছে যে সে কিছুই জানে নাহ! আরসালের জন্য মেয়ে দেখছে,আবার তার গুনগানও গাইছে! কত বড় সাহস! বিয়েও করতে বলছে। আরসাল নিজের রাগকে যথাসাধ্য দমানোর চেষ্টা করল, বলল,

–” আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি।”

সায়রা বিরক্ত হলো। মুখ থেকে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। চোখ মুখ খিঁচে অনবরত বলতে শুরু করল,

–” আরসাল ভাই ছেলে মানুষী করছেন কেন? সম্পর্ক হলো কাঁচের মত। যা একবার ভেঙে গেলে তা দ্বিতীয়বার জোড়া লাগানো সম্ভব না। জোড়া লাগালেও ভাঙার ছাপ রয়েই যায়।”

সায়রা আরো কিছু বলতে চাইল। কিন্তু তার পূর্বেই আরসালের শান্ত আওয়াজ,

–” গেট আউট”

আরসালের আওয়াজ কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মাথায় খেলল না সায়রার। হতভম্ব স্বর করল,

–” হু”

–” আই স্যে গেট আউট”

আরসালের জোর গলার ভয়ংকর ধমকে ভয়ে কেঁপে উঠল সায়রা। হতভম্ব হয়ে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে দাঁড়াল সে। সায়রা নামতেই ক্ষিপ্রগতিতে গাড়ি ছাড়ল আরসাল।এক পলকেই গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। সায়রা কিংকত্র্তব্যবিমূঢ়, বিস্মিত ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময়ই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামল। মুহূর্তেই, বৃষ্টির পানিতে সায়রা ভিজে একাকার। কাক ভিজা ভিজেছে সে! আচ্ছা, অক্টোবরের বৃষ্টিকে অক্টোবর রেইন বলে, তাহলে নভেম্বরের বৃষ্টিকে কি বলে? নভেম্বর রেইন! গম্ভীর হয়ে ভাবল সায়রা!

ঝুম বৃষ্টি দেখে আরসাল গাড়ি ঘুরাল। তখন সায়রার কাঁচ লোহার সম্পর্কের কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল আরসালের। এখন মাথা খানিক শান্ত হয়েছে। এই বৃষ্টির মাঝে সায়রাকে রাস্তায় ছেড়ে এসে ভীষণ খারাপ লাগছে তার। বেশ অনুতপ্ত সে। যদিও সায়রাকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছে সেখান থেকে বাড়ির দূরত্ব খুব একটা না। মাত্র পনের মিনিটের দূরত্ব। সেখানে ফিরে গিয়ে দেখল সায়রা নেই। ফোন দিলো সায়রাকে। অপর পাশ থেকে ফোন কেটে দিলো সায়রা। আরসাল তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” অপরাধ করে আবার রাগ দেখানো হচ্ছে! স্টুপিড! ”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here