তোমার স্মৃতি পর্ব -০৬

#তোমার_স্মৃতি
#পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা

সেইদিন যখন নিবিড় সানজিদা বাসায় গিয়ে পৌছায় তখনও সানজিদার বাসার দরজা বন্ধ ছিল। আর শশী দরজায় অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিলো। নিবিড়ের মনে এক অজানা ভয় কাজ করলো।

সে আর কিছু না ভেবে দরজা ভেঙে ঢুকে পরলো। ঢুকতেই অবাক হয়ে গেল ওরা কারণ সানজিদা জ্ঞান হারিয়ে নিচে পড়ে আছে।

নিবিড় গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। বাসা থেকে বের হতে নিবে তার আগেই বাড়িআলা লোকটি চলে আসে। খারাপ খারাপ কথা বলতে লাগলো। নিবিড় চেচিয়ে কিছু কথা শুনিয়ে দেয়।

তারপর শশী গিয়ে সানজিদার সব জিনিসপত্র নিয়ে আসে। নিবিড় সেইদিন শশীকে নিজের কেবিনে ডাকে সে সানজিদার অতীত জানতে চায়।

তখন শশী নিবিড়কে একটা খয়েরী রঙের ডায়েরি দেয়। আর বলে “ওর অতীতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। খুব কষ্ট সহ‍্য করেছে ও। ওর জীবনে হয় তো সুখ নামক আলো কখনোই আসবেনা। যাইহোক আপনি এই ডায়রিটা পড়ে সবকিছু জানতে পারবেন।” বলেই শশী চলে গেল।

নিবিড় বাসায় চলে আসে। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে সেই ডায়রিটা নিয়ে বসে তার যে জানতেই হবে সানজিদার অতীতের সব ঘটনা। ডায়েরিটি খুলতেই প্রথম পৃষ্ঠায় সে দেখতে পেল সুন্দর করে লেখা সানজিদা ইসলাম। তারপর সে এক এক করে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকলো আর পড়তে লাগলো। ডায়রিটিতে লেখা ▪▪আজ আমার ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। সকালেই খুব খুশি ছিলাম কারণ আমি অনেক ভালো একটা রেজাল্ট করেছি। কিন্তু দুপুরে যখন বাড়িতে আসি তখনই মামি এসে আমার হাতে একটা লাল শাড়ি দিয়ে যায়। আর আমার নাকি আজ বিয়ে। আমি অবাক হয়ে যাই মামির কথায়। আমি চেয়েছিলাম নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হতে। বাবা মার স্বপ্ন ছিল আমাকে অনেক উপরে উঠতে দেখতে। আমার কি তাহলে আর বাবা মার স্বপ্ন পূরণ করা হবেনা। কান্না করতে করতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তখনই আমার রুমে আবার মামি আসে। সে এসে অনেক কথা শুনিয়ে চলে যায়। আমি ভেবে দেখলাম আমার পাঁচ বছর বয়স থেকে ওনারা আমাকে মানুষ করেছেন। বাবা মা মারা যাওয়ার পরে ওনারাই তো মানুষ করেছে আমাকে। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েটা করতে যাই আমি। আমার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার নাম রোহান আহমেদ। সে একটা ভালো কম্পানিতে জব করে। আমার খুব ভয় করছিলো। সে কেমন হবে এই নিয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু না প্রথমদিন থেকেই সে আমার সঙ্গে অনেক ভালো ব‍্যবহার করে। সে আমার অনেক কেয়ার করতো। আমার ছোট ছোট ইচ্ছে আল্লাদ পূরণ করতো সে। প্রতিদিন বাসায় আসতো আমার পছন্দের বেলী ফুলের মালা নিয়ে। সেটা নিজের হাতে পরিয়ে দিতো আমাকে। প্রথমদিন থেকে সে আমাকে তার বুকে আকরে ধরে ঘুমাতো। প্রথমের দিকে অসস্থি লাগলেও পরে অভ‍্যাস হয়ে যায়। অনেক ভালোই যাচ্ছিল আমাদের বিবাহিত জীবন। কিন্তু কে জানতো আমার কপালে সুখ জিনিসটা ক্ষণস্থায়ী হবে।

একদিন হঠাৎ রোহান বাড়িতে একটা মেয়ে নিয়ে আসে। আমি যেন অবাকের চরম পর্যায় পৌঁছে যাই। আমি কখনো কল্পণাও করিনি রোহান এমনটা করবে। এরপর সে প্রতিনিয়ত ওই মেয়েটাকে নিয়ে আসতো। মেয়েটির নাম ছিল লিজা। রোহান আমার সঙ্গে অনেক খারাপ ব‍্যবহার করতে লাগলো। কিন্তু আমি কিছু বলতাম না। কারণ আমি যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। আমি সহ‍্য করতে পারছিলাম না লিজা আর রোহানকে একসঙ্গে দেখে। লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করতাম অনেক। প্রতিদিন ড্রিংকসও করে আসতো রোহান। আমি মেনে নিতে পারছিলাম না এসব।

হঠাৎ একদিন লিজাকে ছাড়াই রোহান বাসায় আসে। সেইদিন ড্রিংকসও করেনি সে। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। হয় তো এখন রোহান ভালো হয়ে যাবে।

কিন্তু না আমার ধারনা ভুল প্রমাণ করে রোহান আমার দিকে ডিভোর্স পেপার এগিয়ে দেয়। আমি হতভম্ব হয়ে যাই ওর কাজে। আমি যেন পাথর হয়ে যাই ওর কাজে। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। আমার যেন দুনিয়া ঘুরে উঠে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো কি বলবো। আমি সাইন করতে রাজি না হওয়ায় রোহান আমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে। সে পেন্টের বেল্ট দিয়ে আমাকে আঘাত করে। আমি কোনো টু শব্দও করি না। কারণ আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। আর আমি রোহানকে ভালোবেসেছিলাম। ও আমার প্রথম ভালোবাসা। আর প্রথম ভালোবাসা সবার কাছেই বিশেষ। আমার কাছেও ছিল। ওইদিন রাতে আমি ব‍্যাথায় কাতরাতে থাকি কিন্তু রোহানে এতে কোনো হেলদোল ছিল না। পরেরদিন আমাকে থাপ্পড় দিয়ে ঘুম থেকে জাগায়। আমি জ্বরে কাতর হয়ে ছিলাম। তার মধ্যে এতো জোরে থাপ্পড় খেয়ে আমার চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে। শরীরটা অনেক দুর্বল ছিল। তখনই আমি জ্ঞান হারাই।

আমার জ্ঞান যখন ফিরলো তখন আমি সেই আগের জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করি। আগের কথা মনে পরতেই আমি হাটুতে মুখ গুজে কান্না করতে থাকি। তখনই কেউ আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে। ব‍্যথায় আমি কুকিয়ে উঠে। রোহান তখন আমার গাল চেপে ধরে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিতে বলে।

এমনভাবে চলতে থাকে চারমাস। প্রতিদিন রোহান এসে আমার উপর নির্যাতন চালায়। আমি পারছিলাম না আর এসব সহ‍্য করতে। কষ্টে মরে যেতে মন চাইতো আমার। আগে তাও শুধু রোহান ঝামেলা করতো এখন ওর মা এই বাসায় এসে আমাকে মারধর করতে থাকে যৌতুকের জন‍্য। কিন্তু আমি কোথায় পাব টাকা। আমার যে তেমন কেউ ছিল না। মামা মামি আমাকে বিয়ে দেওয়ার পর আর যোগাযোগ রাখেনি। রাখবেই বা কেন তাদের দায়িত্ব তো শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে ছিলাম মানিয়ে চলার কিন্তু পারছিলাম না। গায়ের সব জায়গায় কাল সিটে দাগ পরে গিয়েছে। নতুন ক্ষত পুরোনো ক্ষত সব মিলেমিশে রয়েছে আমার গায়ে।

একদিন সবকিছুর সীমা অতিক্রম করে যায়। আমি আর পারছিলাম না। আমি রাগে ফেটে যাচ্ছিলাম। ওর এমন ব‍্যবহার আমি আশা করিনি। আমি আর মেনে নিতে পারলাম না। রাতের বেলায় ডিভোর্স পেপারে সাইন করে আমি বেরিয়ে আসি ওর বাড়ি থেকে।

অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায় একলা মেয়ে চলাটাও কতটা অনিরাপদ ওইদিন বুঝে যাই আমি। কিছু রাস্তার কুত্তা আমার পিছনে পরে যায়। আমার শরীর অনেকটা দুর্বল ছিল। কারণ রোহানের মাইর আর ঠিকমতো খাবার না পাওয়ায় আমি জোরে দৌড়াতেও পারছিলাম না। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি হঠাৎ করে পরে যাই।

যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি। আমাকে ওই পশুদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল শশীর বাবা। ওনি রাতে অফিস থেকে ফিরছিলেন তখন আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় পরে থাকতে দেখেন। ওনার গাড়ি দেখে ওই পশুগুলো পালিয়ে যায়।

তারপর শশীর বাবা আমাকে ওনার বাসায় নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে শশীর সঙ্গে আমার একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। শশীর মা মারা গিয়েছেন অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। আমি রোহানের সব কথা শশীকে বলে দিই।

অনেকদিন পর ওকে আমার অনেক আপন আপন মনে হচ্ছিলো। আঙ্কেল আমাকে ওনার বাসায় থাকতে বলে। কিন্তু আমি ওনাদের উপর বোঝা হতে চাইছিলাম না। ওনাকে অনেক বুঝিয়ে আমি একটা ফ্লাট বাসা ভাড়া নেই। আর কিছু প্রাইভেট করানো শুরু করি। ভার্সিটি পরীক্ষা দেই। তারপর ভর্তিও হয়ে যাই। নিজেকে কাজে ব‍্যস্ত করে ফেলি। কিন্তু রাতে একাকিত্ব ঘিরে ধরে আমাকে। প্রথম ভালোবাসার মানুষকে ঘৃণা করা যায় কী আর যাইহোক ভুলে থাকা যায় না। আমি যে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম রোহানকে।

এখন রোহানের কথা মনে পরতেই কেন যেন মাথা ব‍্যথা শুরু হয়। প্রচণ্ড মাথা ব‍্যথা হয়। মনে হয় সবকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। তখন আমি কিছু করতে পারিনা। ঘুমের ঔষধ খেয়েও ঘুমাতে পারিনা। মাথা ব‍্যথায় ছটফট করতে থাকি।

চলবে…….

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here