তোর চোখে আমার সর্বনাশ পর্ব – ২

তোর চোখে আমার সর্বনাশ

২.

সময় টা সকাল দশ টা। তারা কে বাড়িতে এনেছে প্রায় রাত একটার কাছাকাছি। মেলে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কেউ একজন ওকে হাস্পাতালে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফিরার পর নার্সের কাছ থেকে ফোন নিয়ে বাড়িতে জানালো। জীবন যুদ্ধে জয়ই হয়ে এলো ও প্রিয় মানুষ টাকে এখন ও দেখল না তারা। নাহিয়ানের ফোন বন্ধ রাত থেকেই সবাই কল দিচ্ছে পাচ্ছে না। এখন ছেলে টা কই গেল? তার মায়ের আ’হা’জারি। বেলা এগারোটার দিকে ফিরে এলো নাহিয়ান। তা’লমা’টাল হয়ে হাঁটছে কয়েক বার পড়ে যেতে নিয়ে ও নিজেকে সামলে আবার হাঁটতে থাকে। মিরাজ হন্তদন্ত হয়ে নাহিয়ান কে ধরল। ম’দ খায় নি তারপরে ও নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে৷ শামীমা আখতার কাঁদতে কাঁদতে ছেলে কে জড়িয়ে ধরলেন। তার একটা মাত্র মানিক। নাহিয়ান বিরক্ত হয়ে বলল ,

” মরে যাই আমি এত কাঁদছো কেনো? ”

শামীমা আখতার থামলেন না। কেঁদেই যাচ্ছেন। ইফতেখার সারাফাত গম্ভীর স্বরে বললেন ,

” শামীমা কান্না থামাও , মিরাজ ওকে ফ্রেশ হতে সাহায্য কর। তার পরে নিয়ে যাও। ”

‘ তার পরে নিয়ে যাও ‘ বলতে তারা কাছে নিয়ে যেতে বুঝালেন উনি। এখন যদি শুনে তারা বাড়িতে আছে এই অবস্থায় তারার কাছে চলে যাবে। মিরাজ বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে সায় দিল। সুফিয়া হানজালা শামীমা আখতার কে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল।

চুপটি মেরে বেডের মাঝ বরাবর শুয়ে আছে তারা। পিঠের ব্যথা থেকে মনের ব্যথা বেশি অনুভব করল। নাহিয়ান কে দেখতে চাইছে খুব করে। কোথায় তার নাহিয়ান? ভাবনার মাঝেই হুট করে কাঙ্ক্ষিত মানুষ টা এসে ওকে শোয়া থেকে টেনে তুলে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরল। দুইজন কে স্পেস দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে মিরাজ , ফারাহ্ , সানজিদা , সুফিয়ান। নাহিয়ান ফ্রেশ হয়ে বের হতেই মিরাজ সব খুলে বলল তারার ব্যাপারে। সব শুনে এক ছুটে তারার রুমে চলে আসে।

______

কেটে গেল এক সাপ্তাহ। ইন্ডিয়া যাওয়া একবার ক্যান্সেল করলে ও পরে আবার যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। আগামীকাল রওনা দিবে ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে। আজকে প্যাকিং করছে সবাই। তারা এখন সূর্ম্পণ সুস্থ। কেটে গেল আরো একটি দিন। আজকে পালা ইন্ডিয়া যাওয়ার। টুরিস্টের জন্য বেস্ট জায়গা ইন্ডিয়া। পুরো বিশ্ব ঘুরে ও যদি ইন্ডিয়া না ঘুরে কেমন খালি খালি লাগবে। আর বিশ্ব না ঘুরে যদি ইন্ডিয়া ঘুরা হয় মনে হবে পুরো বিশ্ব ঘুরেছে। কি নেই ইন্ডিয়া – মেঘালয় , দার্জিলিং , তাজমহল , গোয়া , কাশ্মীর , সিকিম , ম্যানার , দীঘা , রাজস্থানের মরুভূমি , যগ ফলস , ডুয়ার্স , উমিয়াম লেক , রেড ফোর্ড , কুতুব মিনার , সামার হিল , অ্যাকোয়াটিকা পার্ক , রবীন্দ্র ভারতী মিউজিয়াম , চেরাপুঞ্জি , শিলং , পেলিং , টাইগার হিল , সাঙ্গু লেক আরো কত কি! বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র ইন্ডিয়া যা ভারত নামে ও পরিচিত সবার কাছে। প্রকৃতির অপার রূপে ভরপুর ভারতের দার্শনীয় স্থানের সংখ্যা অসংখ্যাক। ইন্ডিয়া বাংলাদেশের পার্শবর্তী দেশ হওয়ায় কম খরচে অনেকই ভ্রমণ করতে যায়। টাকা বা খরচ বড় কথা নয়! যা পুরো বিশ্ব জুড়ে আলাদা আলাদা দেশে থাকে তা শুধু ইন্ডিয়া তে এক জায়গায়তেই সব আছে। হয়তো আকারে ছোট বা পুরো মিল না। যেমন ইন্ডিয়া রাজস্থানের মরুভূমি ‘র সাথে ডুবাই’র মরুভূমি খানিক টা হলে ও মিল। তেমনি অনেক কিছু যা ঘুরতে গেলেই দেখা যায় বা ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই দেখা যায়।

ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো তারা। অনেকের স্বপ্নের শহর কানাডা থাকে ফ্রান্স থাকে নিউজিল্যান্ড থাকে আমেরিকা থাকে আর ওর ইন্ডিয়া। চোখ বন্ধ করে নতুন দেশের স্বপ্নের দেশের ঘ্রাণ নিচ্ছে। কতক্ষণ এভাবে ছিল জানা নেই চোখ খুলে নাহিয়ান কে দেখে থমকে যায়। ওর দিকে মুগ্ধকর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন ছুড়ল ,

” তুমি কখন এলে? ”

” অনেক খানি আগে? ”

তারা রুমের দিকে উঁকি মেরে বলল ,

” ফারাহ্ ছিল রুমে কই গেল? ”

” সুফিয়ানের সাথে হোটেল ঘুরে দেখতে গেল। ”

তারার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে স্লো ভয়েজে বলল ,

” তারারানী এখানে এসে তুমি রুম শেয়ার করছো কেনো? ফারাহ্ কে অন্য রুমে শিফট করে দাও আমার সুবিধা হবে। ”

” নাহিয়ান পা’গল তুমি! নতুন জাগায় সবাই রুম শেয়ারিং আছে তুমি আর মিরাজ ও তো রুম শেয়ারিং -এ আছো আর আমার আর ফারাহ্’র বেলায় সমস্যা না। ”

” রাগছো কেনো __”

তখনই বাহির থেকে রিয়ানের আওয়াজ এলো ,

” শালা বাবু প্রেম পরে করো লাঞ্চ করতে এসো। ”

তারা নাহিয়ানের বেবি ফেস দেখে হাত ধরে মুচকি হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হল। সবাই হোটেলর নিচে গিয়ে লাঞ্চ করতে বসল। এখন মিসিং ফারাহ্ , সুফিয়ান। রিয়ান বলল ,

” এদের ও মনে হয় আমাকে ডাকতে হবে। ”

রিশাব ঝট করে দাঁড়িয়ে বলল ,

” ভাইয়া তুমি বসো আমি খুঁজে আনছি। ”

” তারাতাড়ি তুই ও হারিয়ে যাস না। ”

কিছু ক্ষণ খুঁজার পর পেয়ে গেল ফারাহ্ কে। হোটেলের সামনে ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে পোস দিচ্ছে তার ঠিক কিছু দূরে সুফিয়ান ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে। রিশাব গিয়ে ফারাহ্’র পাশে দাঁড়ালো। সুফিয়ান থেমে নেই নতুন জুটির ছবি তুলতেই ব্যস্ত। ফারাহ্ বিরক্ত বোধ করে কোমড়ে হাত দিয়ে মেকি রা’গ নিয়ে বলল ,

” আপনি কেনো এলেন? দেখছেন না আমি ছবি তুলছি। ”

” ছবি পরে ও তুলতে পারবেন ম্যাডাম আগে খেতে চলুন। ”

তার পর সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল ,

” ব্রো চল খেতে। ”

” চলুন ভাই আর জীবনে ও এই কু’ট’নি কে নিয়ে ঘুরতে বের হবো না। ”

” ওই কি বললি তুই আমি কু’ট’নি! ”

” প্লিজ তোমরা আবার শুরু হয়ে যেও না খেতে চলো। ”

খাওয়ার টেবিলে বসে রা’গে ফুসছে ফারাহ্। নাহিয়ান বিষয় টা লক্ষ করে গুরু গম্ভীর কন্ঠে বলল ,

” তোর কোনো সমস্যা হচ্ছে ফারাহ্? ”

জবাব দিল না ফারাহ্। তাকে নির্বকার থাকতে দেখে কপাল কুচকে ফেলল নাহিয়ান। ওইদিন চ’ড় দেওয়ার পর থেকে খেয়েল করছে ওর সাথে কথা বলে না মেয়ে টা। সুফিয়ান মজ সুরে বলল ,

” ছবি তুলতে পারে নি তাই রা’গে টগবগ করছে। ”

” এক দম ঠিক হচ্ছে না ফারাহ্’র সাথে ফারাহ্ আমি কথা দিচ্ছি খাওয়া শেষে অনেক ছবি তুলে দিব তোমায়। ”

রিয়ানের কথার পৃষ্ঠে ফারাহ্ সামান্য হেসে বলল ,

” থাংকু দুলাভাই। ”

” থাংকু টা কি? ”

” এটা ও জানেন না থাংকু , থ্যাঙ্ক ইউ ভার্সন। ”

” ভ’য়ং’কর ভার্সন। ”

রিয়ানের কথায় হাসি ধুম পড়ল সবার মাঝে। ফারাহ্ ও মুচকি হাসল। হুট করে রিশাব ফারাহ্ প্লেটে আরেক পিস মুরগী দিয়ে ক’ড়া করে বলল ,

” একদম তুলবে না এটা কি খাও হ্যাঁ খালি খালি। ”

ফারাহ্ কাচুমাচু করে খেতে শুরু করে। সুফিয়ান বলল ,

” ভাই সব সময় আপনি ওর সাথে খেতে বসিয়েন তাহলে যদি মোটা হয়। ”

রিশাব একবার ফারাহ্ দিকে তাকিয়ে খাওয়া মনোযোগ দিল। বড়’রা সবাই এক সাথে রয়েছেন। আর ইয়াং’রা এক সাথে। লাঞ্চ শেষ করে কিছু সময় রেস্ট করল। এরপর ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হল। একটা মাইক্রো যেটাতে বড়’রা আর সানজিদা ওর বাচ্চাদের নিয়ে বসল। আরেক টা জিপ ওটা তে নাহিয়ান’রা বসেছে। সবাই মিলে আগে কাশ্মীর যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। ভুস্বর্গ কাশ্মীর মূলত হিমালয়ান পর্বতমালার দুটি রেঞ্জের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। ১৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আর ৩২ কিলোমিটার প্রস্থের এ উপত্যকার একপাশে হিমালয়ের মিডল হিমালয় এবং অন্য পাশে গ্রেটার হিমালয়। মধ্যখান দিয়ে বয়ে গেছে ঝিলাম নদী যা জেহলাম নামেও পরিচিত। এর দক্ষিণে অনন্তনাগ যাকে স্থানীয়ভাবে বলে ইসলামাবাদ, সোপিয়ান, কুলগাম ও পুলওয়ামা। মধ্যখানে বাডগাম ও গ্যান্ডারবাল ও শ্রীনগর এবং উত্তরে বারামুলা, বান্ডিপুরা ও কপুওয়ারা। এই দশটি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত এ উপত্যকা। ভৌগোলিক ভাবে কাশ্মীরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, সেন্ট্রাল, নর্থ ও সাউথ কাশ্মীর। বর্ষার শেষে সবুজ কাশ্মীরকে উপভোগ করার ফিলটাই অন্যরকম। সাথে বাগান ভরা আপেল, জাফরান, আখরোট প্রভৃতি তো আছেই। সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে গাছ ভরা আপেল বাগানের দেখা মিলে। বর্ষার যে আলাদা একটা সৌন্দর্য্য আছে সেটা আরও দ্বিগুন হয়ে যায় কাশ্মীরে। তাই এটার সৌন্দর্য্য ভিন্ন।

” ওহ আল্লাহ এতো সুন্দর, আরো আগে আসা উচিৎ ছিল। ”

ফারাহ্’র কথার মাঝে রিশাব বলল ,

” বাচ্চা মেয়ে আরো আগে এলে এমন মজা করতে পারতে মায়ের কোলে থাকতে। ”

” আপনি সব সময় আমার কথার মধ্যে ডুকেন কেনো? ”

” তুই এমন কথা বলো উত্তর না দিয়ে থাকতে পারি না। ”

” কান বন্ধ রাখলে তো হয়। ”

সুফিয়ান দু’জন কে থামিয়ে বলল ,

” ফারহ্ বোন আমার জিপে আমরা ড্রাইভার কি বলবে? চল তোর ছবি তুলে দি তাও ঝগড়া করে মন খারাপ করিস না ইনজয় কর। ”

তারা বলল ,

” টিউলিপ , বরফে মোড়ানো থাকলে আরো ভালো লাগতো। ”

নাহিয়ান ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখে তারা কথা শুনে সনাট হয়ে দাঁড়িয়ে বলল ,

” তার জন্য বসন্তকাল হবে পারফেক্ট সময়। ওই সময় টিউলিপ , গাছে গাছে ফুল , বরফ কারন ওই সিজনের শুরুতে বরফ থাকবেই। টিউলিপ এবং বরফ দুটোই একসাথে পেতে চাইলে মার্চের শেষর সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্ল্যান করা লাগে। ”

” ওহ , এখন কোথায় যাচ্ছি? ”

” শ্রীনগর রাত টা ওখানেই থাকবো। ”

শ্রীনগরের গাড়ি যখন ডাল লেকের পাশ দিয়ে চলা শুরু করলো, সেই সারিবদ্ধ পপলার, ঘাটে ঘাটে সুসজ্জিত শিকারা, উন্নত শির প্রস্ফুটিত পদ্মবন, অন্দিন্দ‍্যসুন্দর কাশ্মীরি মানুষজন। কত প্রিয়, কত চেনা এই সুন্দর নগরী যেন হাসিমুখে বললো, যাও ইচ্ছেমতো ঘুরে এসো। ঘন্টা চারেক পরে এসে পৌঁছালো রাত কাটানোর জন্য বরাদ্দ করা হোটেলের সামনে। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে সবাই হোটেলে প্রবেশ করতে গেলে বাধা সাজলো ফারাহ্।

” আমি হোটেলে যাবো না। ”

” তো কি রাস্তা থাকবি? ”

নাহিয়ানের এমন কথায় ফারাহ্ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ,

” না। ”
তার পর ঠান্ডা গলায় ফের বলে উঠে ,
” আমরা কোথায় সব সময় শ্রীনগরে আসছি! ”

এহসান সারাফাত বললেন ,

” মামুনি তুমি কি বলতে চাও। ”

” আব্বু আমি একটু আগে নেটে সার্চ দিলাম শ্রীনগরের উপরে , এখনে সবচেয়ে সুন্দর আর জনপ্রিয় জায়গা হল ডাললেক। আমি এখন ডাললেকে যাবো। ”

” কালকে ঘুরিস আজকে রেস্ট কর। ”

সুফিয়া হানজালার কথার পিঠে ফারাহ্ কাঁদো কাঁদো হয়ে শুধায় ,

” না আমি আজকে যাবো আর রাতে ডাল লেকে থাকা হাউস বোর্টে থাকবো। ”

তারা মায়াময় হয়ে বলে উঠে ,

” বুড়ি যখন এত করে বলছে তখন যাই না এমনি আমরা তো এখানে ঘুতেই এসেছি না। ”

ইফতেখার সারাফাত বললেন ,

” আচ্ছা তোমরা বাচ্চারা যাও আমরা রাত হোটেলেই থাকবো। নাহিয়ান , মিরাজ , রিয়ান , রিশাব তোমরা ওদের প্রতি খেয়াল রেখো। বেশি রাত বাহিরে থেকেও না। ”

ফারাহ্ কথা টাই সত্যি এখনে সবচেয়ে সুন্দর আর জনপ্রিয় জায়গা হচ্ছে ডাল লেক। এই ডাল লেক জুড়েই শ্রীনগর শহর টি বিস্তার লাভ করেছে। ডাল লেকে থাকার জন্য রয়েছে জলের উপর ভাসমান হাউস বোর্টের ব্যবস্থা আছে। ওরা ডাল লেকে আসল আধ ঘন্টা আগে। গোধূলি নামল বলে। স্বচ্ছ পানিতে সূর্যের রশ্মি নেচে বেড়াচ্ছে। নাহিয়ান পুরো নৌকা একটা ভাড়া করে নিল। সুফিয়ান একটু দূরের নৌকা টা দেখিয়ে বলল ,

” নাহিয়ান ভাই ওখানে দেখো মাছ ধরছে আমি ও ধরবো। ”

” তুই এখানে মাছ বিক্রি করবি? ”

” সমস্যা কি করলে? ”

সানজিদা সানা কে কোলে রেখে ধুলাতে ধুলাতে বলল ,

” আসলে নাহিয়ান সমস্যা কি! একেক জায়গার একেক সুন্দর। ”

” ওকে ভাই আমি দেখছি , বড় আপা বলেছে কি করে কথা ফেলি! ”

শব্দ করে হাসল সানজিদা। নাহিয়ানের বাহুতে হালকা ধাক্কা মেরে বলল ,

” নাহিয়ান। ”

প্রায় ছয় মিনিটের মাথায় নাহিয়ান দু’টো মাছ ধরার সিপ নিয়ে ফিরে এলো। সুফিয়ানের হাতে একটা সিপ দিয়ে বলল ,

” ১৫০০ টাকার বিনিময়ে দু’টো সিপ ফেলাম। ”

” তার মানে কি একটা সিপ ৭৫০ টাকা? ”

” হ্যাঁ এত অবাক হচ্ছিস কেনো? চল নৌকায় উঠি এবার নৌকা চড়ার সাথে শিকার করে মন প্রাণ ভরে উপভোগ কর। ”

২৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে প্রসারিত এই লেকটি স্বচ্ছতা এবং নির্মলতার জন্য প্রসিদ্ধ। ওরা সবাই ইচ্ছে মত আনন্দ করল। ছবি তুলা খাওয়া দাওয়া। সব শেষ করে রাত আট টায় হাউস বোর্টে উঠল। নাহিয়ান , মিরাজ এক কক্ষে। রিশাব , সুফিয়ান এক কক্ষে। ফারাহ্ , তারা এক কক্ষে। সানজিদা , রিয়ান বাচ্চাদের নিয়ে এক কক্ষে। মোট চারটে কক্ষে নিল ওরা।

_______

পরের দিন সকালে নাস্তা সেরে বড়দের কাছে হোটেলে গেল নাহিয়ান’রা। উনারা সহ কিষনসার লেক গেল। আকাশ পরিষ্কার হয়। অপূর্ব সুন্দর কিষনসার লেক পার হয়ে সবুজ ঢেউ খেলানো এক উপত্যকায় চলার পরে একসময় পৌঁছাই গাদসার (Gadsar) পাসের নীচে। পান্নাসবুজ দুটি লেক মনমোহিনী হয়ে বিভিন্ন বাঁকে দৃশ্যমান হয়। যেন অপূর্ব লাস্যে হাতছানি। পৌঁছে গেল গাদসার পাসে। এর মাঝেই ট্রেকের দ্বিতীয় পাস অতিক্রম করল। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে উপস্থিত সকলের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে সবার। আজকে সারা দিন কিষনসার লেকেই কাটালো ওরা। সন্ধ্যার দিকে নাস্তা করে একটা হোটেলে উঠে। ইয়াং’রা নিজেদের মতো আড্ডায় মেতে উঠে। পরের দিন – সাতসার (Satsar) আজকে সকাল সকাল এসে পৌঁছালো সাতসারের লেক। অসাধারণ সুন্দর একটি জায়গা। একদিকে ঘন নীল আকাশের নীচে ঢেউ খেলানো ঘন সবুজ উপত্যকা আর অন্যদিকে সেই নীলিমাকে স্পর্শ করে থাকা সুউচ্চ পর্বতমালা। ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে অনুভব করছে সকলে। তারার ভিতর থেকে সেই দুরন্ত বন্য মেয়েটি বেরিয়ে এসে গোটা প্রান্তর সবুজ ওড়না উড়িয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় নেচে বেড়াচ্ছে। যা নাহিয়ান দু’চোখ ভরে হৃদয়ের পিঞ্জরায় স্বযত্নে গেঁথে নিচ্ছে। প্রত্যেকে ভীষণ মাত্রায় ভালোলাগা উপভোগ করছে। বিকেলের দিকে গঙ্গাবল লেক গেল আজকে শেষ দিন এখানে । জীবনের কোনো বড়ো বাধা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আসা সুখের মতোই সেই সূর্যের আলো নরম, সুগন্ধী উষ্ণতায় স্বাগতম জানায় আমাদের প্রত্যেককে। পথের কাদায় সেই উত্তাপের ছোঁয়া যেন আমাদের বুঝিয়ে দেয়, এভাবেই পায়ের তলার জমিকে নরম করে আমাদের কষ্ট লাঘব করার জন্যই প্রকৃতি-মা কাল রাতের এত আয়োজন সাজিয়েছিলেন। ক্ষুদ্র মানুষ আমরা, চর্মচক্ষে সামনে যতটুকু ভালো-মন্দ দেখি, তাই নিয়ে সুখ-দুঃখের হিসেব কষি। তাঁর লীলা, বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে সুগভীর পটপরিবর্তন কোন বৃহত্তর ভালো-মন্দের দ্যোতনায় বিন্যস্ত, তাকে উপলব্ধি করার সাধ্য কি আমাদের আছে! তাই, এরপরের নদী পার হওয়া, আর্মি ক্যাম্পে হাজিরা, ধাবায় চা-ম্যাগি খাওয়া, নারানাগ পৌঁছানো, আপেল বাগান পরিক্রমা, জনবহুল শ্রীনগর, মুঘল দরবার, ওয়াজওয়ান, ডাল-লেক, কাশ্মীর , এয়ারপোর্ট, বাড়ি, অফিস – সমস্তকিছু এক সমুদ্র-হৃদয় মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা নিয়ে ওখানেই থেকে যাই। ঐ সবুজ পাহাড়, ঐ উচ্ছল নদী, ঐ ঢেউ খেলে যাওয়া উপত্যকার প্রান্তে পাইন বনের সারি, ঐ সোনালী সূর্যোদয়, ঐ ঘন নিবিড় মেঘের দল, ঐ ঝমঝমে বৃষ্টি – এই সবকিছুর স্পর্শে আজন্ম ঋণী করা প্রকৃতি।

সূর্য উঠে নতুন আরেক টি দিনের সম্ভাবনা নিয়ে। গঙ্গাবল লেক থেকে সোজা দার্জিলিং -এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল ওরা। আজকে তৃতীয় দিন। তৃতীয় দিনটা কাটাবে দার্জিলিং-এ। এই আলো এই মেঘ তো এই নম্র বৃষ্টি শননে হাওয়ায় কনকনে ঠান্ডায় এখন ও আগের মতো মায়াবী রয়ে গেছে দার্জিলিং। নাহিয়ান ফোনে সময় দেখে বলল ,

” গাড়ি থামানো উচিৎ খিদা লেগেছে না সবার? ”

” ভাই মোটামুটি আরেক টু সামনে গিয়ে নামলে ভালো হয়। ”

নাহিয়ান ছোট্ট করে বলল ,

” আচ্ছা। ”

এভাবেই ঘুরতে লাগলো ওরা। একে একে করে দার্জিলিং , তাজমহল , কাশ্মীর , সিকিম , ম্যানার , রবীন্দ্র ভারতী মিউজিয়াম , চেরাপুঞ্জি , পেলিং সময়ের জন্য আব কিছু পেরে উঠা যায় না। সময় চলে এসেছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার। লম্বা ছুটিতে এসেছে ছিল। আজকে শেষ দিন শিলং পিক’এ গেল । এখান থেকে পুরো শিলং শহরটা দেখা যায়। মেঘালয় এসে যদি খাসিয়াদের পাহাড় না দেখে তা কি করে হয়! খাসি পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে তার জন্য উঠতে হবে মেঘালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ছয় হাহার ফুট উঁচুতে এই চূড়াকেই বলে শিলং পিক।

” আজকে শেষ দিন অনেক মিস এই শহর টা কে বিশেষ করে কাশ্মীর আর মেঘালয়। আমার ঘুরা বেস্ট। মেঘের শহর মেঘালয়। ”

তারা কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগলো। নাহিয়ান প্রিয়তমার চঞ্চলতা দেখে মৃদু হাসে। এদিকে ফারাহ্ ধোঁয়া উঠা চা খাচ্ছে৷ বিকাল বেলা চা টা বেশ মজা। এমনি ওয়েদার ঠান্ডা। হুট করে চোখ পড়ে তারার দিকে কথায় এত ব্যস্ত আশেপাশে খেয়াল নেই। দ্রুত গামী একটা গাড়ি আসছে ওর দিকে। চায়ের কাপ হাত থেকে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠল ,

” তারাপ্পি! ”

সবাই চমকে তাকালো তারার দিকে। নাহিয়ানের দরকারি কল আসায় ও একটু দূরে আছে সবার থেকে। যার কারণে ফারাহ্ কন্ঠ শুনে নি। ফারাহ্ কিছু না ভেবেই দৌড় দিল। যেই তারার কাছে যাবে তখনই আরেক টা গাড়ি এসে ফারাহ্ কে ধা’ক্কা মেরে চলে গেল। সাথে সাথে চিটকে পড়ে দেহ খানা। মাথা পেটে গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করে। তারা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সবাই চেঁচিয়ে বলছে ওকে সরতে। ঠিক তখনই যে গাড়ি টা তার দিকে আসছিল ওটা এসে তারা কে ধা’ক্কা দিয়ে দ্রুত চলে যায়। এক সাথে দু’টো এক্সিডেন্ট রাস্তায় অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেল। নাহিয়ান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওর কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছে না। সবাই তার আর ফারাহ্ নিথর দেহর কাছে বসে কাঁদছে। তারা চট লাগে নি। র’ক্তর চিটে ফোটা ও দেহ। ফারাহ্ অবস্থা গুরুতর মাথা থেকে অজস্র রক্ত বের হচ্ছে। ওদের দ্রুত হাস্পাতালে নিয়ে আসে। নাহিয়ান স্থির হয়ে আছে। সবাই কাতর কে কাকে শান্তনা দিবে। দু’টো মেয়ে এক সাথে! কিছু ক্ষণ পর আই সি ইউ থেকে ডাক্তার বের হয়ে এলেন। অত্যন্ত দুঃখের সহিত বললেন ,

” সি ইজ নো মোর। ”

সুফিয়া হানজালা মিরাজের বুকে আড়ছে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠে অস্ফুটে সুরে বললেন ,

” ফারাহ্। ”

” আমি সত্যি দুঃখীত অনেক চেষ্টা করে ও বাঁচাতে পারলাম না। ”

বলেই চলে গেলেন ডাক্তার এত দিনে ঘুরা ফিরার আনন্দ কয়েক ঘন্টায় ধুলিষাৎ হয়ে গেল। কান্না আহা’জারিতে ফেটে উঠে সারাফাত পরিবার। রিশাবের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো।

সময় চলমান কেটে গেল এক যুগ।

#চলবে

®️আহমেদ মুনিয়া
•••••×কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ×

(ভু’লত্রুটি গুলো মানিয়ে নিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here