তোর নামেই এই শহর পর্ব -১৬

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৬

(৪৮)

বেশ জমকালো আয়োজন করা হয়েছে পার্টিতে। ইয়াদের পেছনে তিয়াশাও প্রবেশ করলো সেখানে। সামির কিছু দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলো তাদের দেখে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল,
“ওয়েল কাম মি.ইয়াদ ইহতেসাম। হাই তিয়াশা। কেমন আছেন আপনি।”
তিয়াশা তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারলো না। মুচকি হাসলো শুধু। সামির নিজেও মুচকি হেসে তাকে ভেতরে আসার অনুরোধ করলো।

পার্টিতে এসে ইয়াদ চারদিকের অবস্থান বুঝে নিলো। মি.মেহেবুব এখনো এসে পৌঁছান নি। হয় তো এক্ষুনি এসে পড়বেন। ইয়াদ নাবাদ তিয়াশা এসে একপাশ দাঁড়াল। নাবাদের চোখ সর্বক্ষণ অরার উপর নজরদারি করছে। মেয়েটা এসেছে ধরে সেলিম এহসানের সাথেই কথা বলে যাচ্ছে। সামির বেশ কয়েকবার এসে তাদের সাথে কথা বলে গেছে। পার্টির মুল যিনি তিনি এখনো এখানে এসে পৌঁছান নি। ইয়াদ হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত কম হয় নি অথচ কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। ইয়াদ সামিরকে ইশারা করে ডাকতে সামির দ্রুত এগিয়ে এলো। সামির আসতেই ইয়াদ বলল,
“আপনাদের মতলবটা কি বুঝতে পারছি না। কি করতে চাইছেন বলুন তো।”

“এত অধৈর্য হতে নেই ইয়াদ। সবুর করুন জানেন তো সবুরের ফল মিঠা হয়।”

“সে না হয় করছি কিন্তু মি.মেহেবুব এখনো এলেন না কেনো? তিনি তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। বেশ কয়েকবার কল করার পরো ধরলেন না।”

“এত অস্থির কেন হচ্ছেন। চলে আসবেন।”

নাবাদ ইয়াদ আর সামিরের কথা শুনছিলো এসে বলল,
“উনি আসতে এত লেইট করছেন আর আপনারাও অপেক্ষা করছেন উনার জন্য। বিশেষ কিছু আছে বুঝি।”

“আপনারা জানার কথা এটা উনি উনার মেয়েকে আমার পার্টির মাধ্যমে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। তাছাড়া আমাদের হতে হতে না হওয়া প্রোজেক্ট তিনি পেয়েছেন একটু তো দর নিবেনই। অবশ্য আপনারাও আমাদের বিশেষ অতিথির চেয়ে কিছু কম নয়। কারণ আপনার ভাই মানে ইয়াদ সাহেবের জন্যই কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত প্রোজেক্টটা পেয়েছিলেন।”
নাবাদ আর কিছু বলল না। ফিরে তিয়াশার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তিয়াশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। নাবাদ তাকে কতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে দেখলো আজ মেয়েটা সত্যিই বড্ড শান্ত হয়ে আছে। মুখে হাসি নেই কোন চাঞ্চল্যতা নেই কেমন যেন পাথর হয়ে আছে।

অরা বেশ খানিকক্ষণ পর ইয়াদের কাছে এলো। তাকে দেখে বেশ খুশি খুশি লাগছে। অবশ্য খুশি হবেই না কেন সে যা করেছে তার জন্য তো খুশিই হওয়ার কথা কিন্তু এই খুশি কতক্ষণ স্থায়ী হবে সেটা ভেবে ইয়াদ মনে মনে এক দপা হেসে নিলো।

“মি.ইয়াদ চলুন ওই দিকে যাই মি.মেহেবুব মে বি চলে এসেছেন।”

“আপনার যাবার আপনি এগিয়ে যান আমি এখানেই ঠিক আছি।”

মিল.মেহেবুব ঢুকতেই সেলিম এহসান সহ সামির তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। ইয়াদ জায়গায় দাঁড়িয়ে সব দেখলো কিন্তু নিজে এগিয়ে গেলো না। মি.মেহেবুবের পেছন পেছন একজন বাইশ কি তেইশ বছরের রমনীও সেখানে এসে পৌঁছালো। ইয়াদ মেয়েটির দিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাঁকা হাসলো। মনে মনে বলল, “তবেই ইনিয়ে লিয়ানা।”
মেয়েটাকে দেখে কেমন পরিচিত লাগলো ইয়াদের। একে এর আগেও কোথাও দেখেছিলো সে। কোথায় দেখেছিলো মনে করতে গিয়ে সে অতিতে ফিরে যাবার চেষ্টা করলো।
“মি.ইয়াদ ইহতেসাম।”
মেহেবুব এর ডাকে সামনে তাকায় ইয়াদ। তিনি হাসি হাসি মুখে ইয়াদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনাদের অপেক্ষা করিয়ে রাখতে হলো। ক্ষমা করবেন সরি একটু দেরি হয়ে গেলো।”

“ইট’স ওকে মি. মেহেবুব।”

“ধন্যবাদ। হ্যালো নাবাদ এন্ড তিয়াশা তোমরাও নিশ্চই ভালো আছো। আচ্ছা তোমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেই ও আমার মেয়ে লিয়ানা মেহেবুব। আমেরিকায় থেকে পড়াশুনা করেছে তিন দিন আগেই বাংলাদেশে ফিরেছে।”

নাবাদ তিয়াশা দুজনি লিয়ানার সাথে পরিচিত হলো। বেশ খানিকটা সময় কাটালো তারা ইয়াদ অবশ্য সেদিকে তেমন আগ্রহ দেখালো গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। ইয়াদকে একা বসে থাকতে দেখে সামির এসে তার পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
“কি ভাবছেন মি.ইয়াদ কিছু আঁচ করতে পারছেন? আপনি কিন্তু ফেঁসে যাচ্ছেন।”

“সেটা নিয়ে আপনার ভাবনার আবশ্যকতা নেই।”

“মি.মেহেবুব কিন্তু এমনি এমনি আপনার সাহায্য নেন নি।”

“আপনার মনে হয় এই ব্যাপারে আমি কিছুই বুঝতে পারবো না।”

“না তা নয়। তবে,,,।”

“আপনারা তো কম জোচ্চুরি করেন নি সামির।”
ইয়াদের কথা ভ্রকুচকায় সামির। কিছু বুঝার চেষ্টা করে বলল,
“আপনি কিছু করেন নি বলছেন।”
ইয়াদ ভ্রুবিলাস করতে করতে বলল,
“আপনার বাবার গোপন অভিসন্ধি সম্পর্কে কোন ধারণা আছে।”

“আপনি আমার বাবাকে নিয়ে কিছু বলতে আসবেন না। আমি অন্তত মেনে নিবো না।”

“সেটা আপনি নাই মানতে পারেন সামির। তবে এটা জানেন ওই যে আমার পি এস অরা। যিনি আপনার বাবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন।”

সামির একবার অরার দিকে তাকালো তারপর ইয়াদের দিকে। বলল,
“কি বলতে চাইছেন?”

“আপনার বাবা গ্রামে আমাদের প্রোজেক্টের ডকুমেন্ট’স চুরি করতে অরাকে বেশ মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন। অরা উনার কথায় সব করেছিলোও বটে কিন্তু শেষ চালটা তার অজান্তেই ঘুরে গেছে।”

“যেমন?”

“বাবা কাজটা ওকে করতে দিয়েছিলো। সে করেছিলো কিন্তু একটা কপি আপনার বাবার হাতে তুলে দিয়েছ। আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম তাই বাবাকে সতর্ক করি। তারপর বাকিটা তিয়াশাই ঠিক করে। পুরো ফাইলটাই আমরা পাল্টে ফেলেছি। আচ্ছা আপনার বাবা তো এই পার্টি থ্রো করার কথা আপনাকে বলেছিলো কিন্তু কেন করছেন সেটা বলেছিলো কি?”
সামির এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। ইয়াদের কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বাবা প্রোজেক্টের ব্যাপারে যতটুকু বলেছিল তাতে কোথাও অরার বিষয় ছিল না। তিনি বলেছিলেন তিনি প্রোজেক্টের ডকুমেন্ট’স কোন এক কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি করিয়েছেন অথচ সে এত কিছুর গভীরে কি চলছে তা ধরতেই পারে নি। ইয়াদ সামিরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো। বলল,
“এত অবাক হচ্ছেন কেন। আপনার বাবা এবং অরা আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে নিয়ে এসেছে এখানে কিন্তু কিছুক্ষণ পর নিজেরাই সারপ্রাইজড হবেন। কারণ ইয়াদ এত কাচা খেলোয়াড় নয়।

সামির সেখানে আর বসে থাকতে পারলো উঠে বাবার দিকে এগিয়ে গেলো। তার পরিশ্রম সফলতা এসব এমনি এমনি আসে নি। সে চায় না অন্য কারো প্রোজেক্ট চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিতে। তাছাড়া সে নিজেও কম পরিশ্রমী নয় ইয়াদের সাথে তার শত্রুতার সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু তাদের কোম্পানির প্রোজেক্ট ডকুমেন্টস নিয়ে নিজের প্রজেক্টের কাজ করবে সেটা সে কিছুতে মেনে নিতে পারবে না।

(৪৯)

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো তাদের। ইয়াদ এসে নিজের ঘরে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। প্রোজেক্ট এর নতুন ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। তবে তার খটকা লাগছে মি মেহেবুবকে নিয়ে। লোকটা ঠিক কি করতে চাইছে মাথায় আসছে না। অরার বিষয়টা আজ ইচ্ছে করেই সামনে আনে নি। মি.মেহেবুবকে বুঝতে হলে তাকে অরার সাহায্য নিতে হবে। আপাতত অরা যেটা নিয়ে ব্যাস্ত আছে তাকে তা নিয়ে থাকতে দেয়া ভালো হবে।

গভীর রাত হুরায়রা চোখে ঘুম নেই। অন্ধকারে নিজের ছায়া হাতরে শেষে আলো জ্বালিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ইয়াদরা এসেছে বুঝতে পেরেছে তবুও উঠে যায় নি সে। গিয়েই বা কি হবে সেখানে তো তার কোন কাজ নেই। ঘরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ মনে হলো একবার ইয়াদের ঘরে গেলে কেমন হয়। যেইভাবা সেই কাজ আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না হুরায়রা। দরজা খুলে পা টিপে টিপে ইয়াদের ঘরের দিকে এগোয়।

দরজা খোলাই ছিলো হুরায়রা একটু জোর দিতেই সেটা মেলে গেলো। ইয়াদ দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকাতেই দেখলো হুরায়রা দাঁড়িয়ে আছে। কালো শাড়িতে ড্রিমলাইটের আলোয় তাকে স্বর্গীয় অপ্সরা থেকে কম কিছু মনে হল না ইয়াদের। রাতবিরেতে মাথা নষ্ট করার জন্য হুরায়রার এই বেশে আবির্ভাবই যথেষ্ট।

হুরায়রা গুটিগুটি পায়ে ইয়াদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ইয়াদ নজর সরিয়ে ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল,
“এত রাতে উঠে এলি কেনো ঘুমাস নি।”

“উঁহু ঘুম আসছে না।”

“তবে এই ঘরে কেন এলি? এখানে কি আমি ঘুমের ওষুধ নিয়ে বসে আছি।”

“আপনি নিজেই তো একজন ঘুমের ওষুধ।”
হুরায়রার কথা ল্যাপটপ থেকে নজর সরিয়ে ভ্রুকুচকে তাকালো ইয়াদ। মৃদু আলোয় হুরায়রার মুখটা বুঝার চেষ্টা করে বলল,
“এত রাতে পাঁকা পাঁকা কথা বলে আমার মাথা নষ্ট করতে এসেছিস?”

“আপনি তো আমার ঘুম নষ্ট করলেন। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি কখন আপনারা ফিরবেন।”

“অনেক রাত হয়েছে হুর নিজের ঘরে যা। এত রাতে আমার ঘরে এসেছিস কেউ দেখলে অন্য কিছু ভাববে।”

“ভাবলে ভাববে তাতে কি আমি তো আপনাকে ভালোবাসি। আজ আপনি জানেন কাল সবাই জানবে। ”

“খুব সাহস বেড়েছে দেখছি। রাতবিরেতে কি সব পাগলামি করছিস হুর। যা ঘরে যা।”

“আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

“তোকে ঘরে যেতে বলেছি।”

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা সেটা না বললে আমি ঘরে যাবো না।”

“মুখে মুখে কথা বলছিস কেন।”
বলেই ল্যাপটপ রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে হুরায়রার সামনে এসে দাঁড়ায় ইয়াদ। নজের মধ্যে গাম্ভীর্যতা ধারণ করে হুরায়রা চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,
“তুই অনেক ছোট হুর। বাস্তবতা কি এখনো বুঝিস না। তোর সাথে আমার কিছু হওয়ার নয়। যদি হওয়ারই হতো তবে এই ইয়াদের কাছ থেকে কেউ একচুল তোকে সরিয়ে রাখতে পারতো না। আমার সঙ্গে স্বপ্নে ঘর বেধে শুধু শুধু নিজের কৈশোর কালটা নষ্ট করিস না। আমি চাই তুই ভালো থাক। নিজের মতো করে বাঁচ।”

“নিজের মতো করে আর বাঁচতে দিলেন কোথায়?”

“বড্ড জ্বালাই তোকে।”
হুরায়রা জবাব দিতে পারলো না। কাঁদতে চাইলো তাও চোখে এক ফোঁটা জল এলো না। ইয়াদের কথাগুলো তার অন্তঃকরণে গিয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে অথচ ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না। ক্ষতস্থানে আঘাত করতে করতে এক সময় সে স্থান অনুভূতি শূন্য হয়ে যায় তখন আর সেখানে যতই আঘাত করো ব্যাথা আর অনুভব হয় না। তবে ক্ষত হতে হতে একটা সময় জায়গাটায় পচন ধরে। হুরায়রার মাঝেও ঠিক একি জিনিস কাজ করছে। অবহেলা নামক ক্ষতটা বড্ড ভয়ঙ্কর। একবার হৃদয় পচে গেলে তা আর কখনো ঠিক হয় না। কে জানে আর কতদিন ইয়াদ হুরায়রার মনো সম্রাজ্যে আধিপত্য চালাতে পারবে।

চলবে,,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here