তোর নামেই এই শহর পর্ব -১৫

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব-১৫

৪৬)
শহরের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়লো ইয়াদ। নাবাদ, তিয়াশা এবং অরাও যাচ্ছে তার সাথে। এহসান কোম্পানি এন্ড সন্স একটা বড় পার্ট থ্রো করছে। আর সেখানেই যাচ্ছে তারা। সামির ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার কল করে বলেছে বলেছে কোন ভাবেই ইয়াদ যেন পার্টি টা মিস না করে। সন্ধ্যের কিছুটা সময় পূর্বে বাড়ি থেকে শহরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে তারা। তিয়াশা গাড়িতে উঠার পর থেকে আর একটি কথাও বলে নি। সামিরের মুখোমুখি হওয়াটা যে তার জন্য কতটা কঠিন সেটা মনে হতেই কেমন ভার হয়ে উঠলো মন। ইয়াদ সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। নাবাদ পাশে বসা ছিলো। খানিকটা সময় বাহিরে তাকিয়ে থেকে পরে বলল,

“আমরা পার্টিতে জয়েন করার জন্যই কি যাচ্ছি ভাইয়া। যদি তাই হয় তবে এটা একেবারেই উচিৎ হচ্ছে না।”

ইয়াদ নাবাদের কথা শুনেও প্রতিক্রিয়া করলো না। সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করে গেলো। নাবাদ কোন উত্তর না পেয়ে বলল,
“তুমি ফাইলটা কেন সঙ্গে নিয়েছো। এই ফাইলটা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা কি ভুলে গেছো?”

“আমি কিছুই ভুলি নি নাবাদ। আর এমনি এমনি সামিরের থ্রো করা পার্টিতে যাচ্ছি না। আমাদের সন্দেহ যদি ভুল না হয় তবে অরা এই ফাইলটার একটা কপি সেলিম এহসানের হাতে তুলে দিয়েছেন। কারণ এই ফাইলে প্রোজেক্টটা বাবা অরাকেই করতে দিয়েছিলেন। আমি যদি ভুল না হই তবে আজ ফাইলটা আমাদের খুব কাজে দিবে। অরা নিজেকে যতই চালাক মনে করুক আমি তাকে ঠিক ধরে নিয়েছি।”

“তার মানে অরাকে গ্রামে আনার এটাই কারণ।”
“একরকম তাই।”

“সেদিন বাবা অরাকে ডেকে পাঠিয়ে ফাইলটার বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা মি.সামির এই ব্যাপারে সহায়তা করছেন।”

“আমার মনে হয় না সামির এই ব্যাপারে কিছু জানে বলে। সেলিম এহসান এতটাও বোকা না যে নিজের সৎ আর নিষ্ঠাবান ছেলেকে এই অসৎ কাজের গোপন কথা বলবেন।”
“তুমি বলতে চাইছো সামির এই ব্যাপারে ইনোসেন্ট।”

“এখন পর্যন্ত তাই মনে হচ্ছে। তার সাথে আমার যতই শত্রুতা থাকুক না কেন সে সৎ এই টুকু স্বীকার করতে আমার বাধবে না।”

নাবাদ গাড় ফিরিয়ে একবার অরাকে দেখলো। সে ফোনে কি যেন করছে। হয় তো সেলিম এহসানের সঙ্গে গোপন কোন আলোচনা চলছে। ইয়াদ নাবাদকে দেখে বলল,
“ওকে দেখার কিছু নেই। সে আমাদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছে না।”

“শোনা উচিৎ ছিলো।”

“তাও সে উদাসীন। কারণ বুঝতে পারছিস তো।”
নাবাদ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ালো।

শহরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তারা। সামনে একটা ছোটখাটো টং দোকানের সামনে এসে ইয়াদ গাড়ি থামালো। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক ধরায় চমকায় তিয়াশা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আমরা পৌঁছে গেছি ইয়াদ?”

“না। গাড়ি এখানে দশ মিনিট দাঁড়াবে। চল টং দোকান থেকে এক কাপ চা খাওয়া যাক।”
অরা ফোটে ব্যাস্ত ছিলো। ইয়াদের কথা কর্ণকুহর হতেই বলল,

“আমাকে এখানে বসে চা খেতে বলবেন না ইয়াদ। আমি এগুলো পছন্দ করি না।”

“তোমার মর্জি।”
বলে ইয়াদ,তিয়াশা এবং নাবাদ গাড়ি থেকে নামলো। বেশ খোলামেলা জায়গা। সন্ধ্যার ম্লান আলো আর এলোমেলো হাওয়া বেশ লাগছে তাদের। তিয়াশা শাড়ি পড়ে চুল গুলো খোলা রেখেছে আজ। বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ে এসে বারবার মুখ ঢেকে দিচ্ছে। চুল গুলো সরাতে সরাতে তার মনে হলো, “আচ্ছা সামির কি তাকে ভালোবাসে? নাকি ভালোবাসাটা তার একতরফা। একান্ত নিজের। সামির তো জানেই না সে তাকে পছন্দ করে। তবে কি এত সাজগোছ সব বৃথা? একবারো তাকিয়ে দেখবে এলোকেশীর ব্যথিত নয়নে অঘোষিত প্রেমের বাক্য।”
বিশাল ভাবনার জগতে ডুবে আছে তিয়াশা। ইয়াদ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নাবাদকে বলল,

“আজকাল তিয়াশাকে কেমন মন মরা বলে মনে হচ্ছে না? কেমন যেন চুপ হয়েছে। এমনটা তো ওর হওয়ার কথা না।”
নাবাদ তিয়াশার দিকে তাকিয়ে বুঝে নিলো এই মুহূর্তে তিয়াশার ভেতর কি চলছে। সামিরের মুখোমুখি হওয়ার সাহস হয় তো পাচ্ছে না সে। ভালোবাসার মানুষ নজরে এলে সেটা যে কত বড় অঘটন তা শুধু বিধাতাই জানেন।

চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে এসে তিয়াশার পাশে দাঁড়ায় ইয়াদ। তিয়াশা কিঞ্চিৎ অধর যুগল প্রসারিত করলো। বলল,
“পরিবেশটা সুন্দর তাই না ইয়াদ।”
ইয়াদ জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,
“বিষণ।”
গভীর দৃষ্টি দিয়ে ইয়াদকে দেখলো তিয়াশা। এই ছেলেটাকে সে ছোট্টকাল থেকে দেখছে, এক সাথে বড় হয়েছে অথচ ওর মনে কি চলছে, কি চায় সে, রহস্যময় ব্যাক্তিত্ব এই সব কিছুই বুঝতে পারে না সে। ইয়াদ নামক ব্যাক্তিটা নিজেকে সবার থেকে এতটা আড়াল করে কিভাবে রাখতে পারে? মাঝে মাঝে তিয়াশার মনে হয় ইয়াদের কি সত্যিই এমন কোন বন্ধু নেই যে কিনা তাকে দেখেই পড়তে পারে। যার কাছে সে নিজেকে আড়াল করে রাখে নি কখনো। আচ্ছা মানুষ কি শুধু নিজেকে নিয়ে একা বাঁচতে পারে, নিজের ভেতর বিশাল সমুদ্র তৈরি করে তাতে কষ্ট দুঃক্ষ সব ভাসিয়ে দিতে পারে? হয় তো পারে নয়ত ইয়াদ কি করে পারছে।

চা শেষ করে সবাই গাড়িতে এসে বসলো। ইয়াদ গাড়ি ছাড়তে অরা যেন হাঁফা ছেড়ে বাঁচলো। সে শুধু অপেক্ষা করছে কখন পার্টিতে গিয়ে পৌঁছাবে। আজ সেখানে ইয়াদের জন্য বেশ বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে যেটা ইয়াদ বুঝতেই পারছে না। মনে মনে বেশ খুশি অরা। ইয়াদের পিএস হয়ে তার খুব একটা লাভ হয় নি। তবে পিএস এর সুযোগে সেলিম এহসানের হয়ে কাজ করায় বেশ মোটা অংকের টাকা আসছে তার হাতে। নাবাদ অরার দিকে ঘুরে বলল,

“মিস অরা আপনাকে আজ বেশ খুশি বলে মনে হচ্ছে কি ব্যাপার।”

“ব্যাপার কিছুই নয়। অনেক দিন পর এমন বিশাল পার্টিতে যাচ্ছি তাই এক্সাইটেড। আচ্ছা মি.ইয়াদ আমি যতদূর জানি মি.মেহেবুব সেখানে আসছেন।”

ইয়াদ জবাবে কিছু বলল না সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করলো। অরা আবার বলল,

“শুনেছি সেখানে মি. মেহেবুব একা আসবেন না সাথে উনার মেয়েকেও আনবেন। নিজের মেয়েকে এবার তিনি আড়াল থেকে সকলের সামনে আনবেন। পরিচয় করিয়ে দেবেন বিজনেস সোসাইটির কাছে।”

মি.মেহেবুবের কথা মনে হতে ইয়াদ গম্ভীর হয়ে গেলো। সামিরের টেন্ডারটা মেহেবুব পাওয়ার পেছনে ইয়াদেরই হাত ছিলো। কিন্তু মি.মেহেবুব সহজ মানুষ নয়। যদিও ইয়াদ নিজের প্রয়োজনে কাজটা করেছে তবে মেহেবুব যে মনে মনে অন্য ফন্দি করছে না এই ব্যাপারে নিশ্চিত নয় সে। বাবার কথা চিন্তা করে মেহেবুবকে একটা সুযোগ দিয়েছে আর এতে তাদের কোম্পানির জন্যও লাভ হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বেশিদিন স্বাভাবিক থাকবে না মেহেবুব তাকে ফাঁসাবে নিশ্চিত জেনেও সে এত কিছু করেছে। অবশ্য নিজের ব্যবসা বাঁচাতে হলে কিছু ঝুঁকিতো তাকে নিতেই হতো। নায় এই ঝুঁকিটাই সে নিলো।

(৪৭)

টেবিলে বসে বইয়ের পাতা নাড়াচাড়া করছে হুরায়রা। দুমাস পর তার এস এস সি পরিক্ষা অথচ পড়ায় কিছুতে মন বসাতে পারছে না। মাথা থেকে ইয়াদ নামক যন্ত্রণাটা কিছুতেই সরছে না। আর কত দিন এমন হবে কত তাকে অপেক্ষা করাবে ইয়াদ।
বাহিরে হাওয়া বইছে। হুরায়রা টেবিল ছেড়ে উঠে জানালার বাহিরে অন্ধকারে দৃষ্টি ফেললো। ছাতিম ফুলের গন্ধে সারা ঘর মো মো করছে। বাতাসের সাথে আরেক দলা সুবাস এসে তার নাকে লাগলো। ছাতিম ফুলের গন্ধটা তার বরাবর অপছন্দ কিন্তু ইদানীংকালে সেটা সয়ে নিয়েছে কারণ ইয়াদ ছাতিমফুলের সুবাস পছন্দ করে।
বাড়িটা আজ বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। ইয়াদ, নাবাদ, তিয়াশা কেউ নেই। হুমাশাও বাবা আর চাচা জানের সাথে তুরিনের শ্বশুড় বাড়ি গেছে। ফিরবে কাল। তুরিনের ননদের বিয়ের কথা পাকা হয়েছে। আজ ছেলে পক্ষ তাকে দেখতে এসেছে তাই বাবা আর চাচা জান গেছেন সেখানে।

রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়তেই হুরায়রা এসে বই নিয়ে বসলো। হুমায়রা মেয়েকে ডাকতে ডাকতে ঘরে এলেন। মাকে দেখে হুরায়রা এমন ভাব করলো যেন সে সন্ধ্যা থেকে এক নাগাড়ে পড়ে যাচ্ছে। মেয়েকে পড়ার টেবিলে দেখে হুমায়রা কাছে এসে দাঁড়ালে। হুরায়রার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বললেন,
“অনেক রাত হয়েছে হুর খেয়ে আরেকটু পড়ে নিবি। এমনি কয়েকদিন পড়া হবে না তুরিনের ননদ মাইশার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কাল বাদে পরশু সবাইকে যেতে হবে সেখানে।”

“মাইশা আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মা। কিন্তু বাবা তো বলল দেখতে আসবে।”

“দেখতে এসে ছেলে পক্ষ পছন্দ করে গেছে। তারা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায়। সামনের শুক্রবার বিয়ের দিন ঠিক করেছে।”
হুরায়রা আর কিছু বলতে যাবে তখনি হুমায়রা তাড়া দিয়ে বললেন,
“আর দেরি করিস না হুর। চল তাড়াতাড়ি খেয়ে নিবি।”

হুরায়রা মায়ের পিছন পিছন খাবার টেবিলে এসে বসলো। বেশ খিদে পেয়েছিলো আলসেমি করে তখন খেতে আসে নি সে। ইতিমধ্যে বাড়ির সকলে খেয়ে উঠে পড়েছে। মালিহা হুমায়রা খেতে বসার আগে হুরায়রাকে খেতে দিলেন। হুরায়রা গপগপ করে খাওয়া শুরু করতেই মালিহা বলল,
“এত খিদে পেয়েছে অথচ সবাই যখন খেতে বসেছে তখন এলি না। কতবার ডেকে এলাম।”

“তখন আমার খিদে পায় নি ছোট মা।”

“ঠিক আছে খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। বুবু আমরাও বসে যাই রাত বাড়ছে। ইয়াদ,নাবাদ এরা আসতে আসতে বেশ রাত হবে। ওদের জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই।”

“তাই কর ছোট। আর আমার মনে হয় না আজকে তারা আসবে। ইয়াদ তো বলে গেছে বেশি রাত হলে বাড়িচলে যাবে। কাল দুপুরে ফিরবে।”
হুমায়রা কথা শেষ না করতে হুরায়রা ভ্রুকুচকে বলল,
“কাল দুপুরে ফিরবে মানে? উনারা কি এমন কাজে গেছেন যে কাল দুপুরে ফিরতে হবে।”

“সে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তোমার পড়ায় মনোযোগ দাও। ইয়াদ বলে গেছে পড়া শেষ করে রাখতে এলেই ধরবে।”

“তুমি কিছু বলো নি কেন মা। আর উনি যখন তখন পড়া ধরলেই বা আমি দিতে যাবো কেন? উনি আমার টিচার নাকি।”

“চুপ কর হুর খেয়ে পড়তে বস।”
হুরায়রা আর কথা বলল না। গপগপ করে খেয়ে উঠে গেলো। তার রাগ হচ্ছে ইয়াদের প্রতি। নিজে পার্টিতে তো গেছেই সাথে করে ওই ন্যাকা ষষ্ঠি টাকেও নিয়ে গেছে আবার বলে যাওয়া হয়েছে পড়া পড়তে এসে ধরবে।
চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here