তোর শহরে রেখেছি পা পর্ব -০১

ভাইয়া দরজা খুলো ভাইয়া শুনতে পাচ্ছো তুমি! ওরা মা আর বাবাকে নিয়ে চলে যাবে। আমি কিভাবে থাকবো ওদের ছাড়া। ভাইয়া প্লিজ দরজা খুলো।

বোনের এরকম কথা শুনেও সদ্য এতিম হওয়া আরহাম চোখ মুখ শক্ত করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই তার মা বাবাকে চিরনিদ্রার স্থান মানে কবরস্থানে শায়িত করে এসেছে। আরহাম নিজেকে সামলাতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে না তার ছোট বোন আরুহি কে কিভাবে সামলাবে সে জন্য দরজায়~ই দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু বোনকে এ অবস্থায় সহ্য করতে পারছে না। না ওকে শক্ত হতে হবে নাহলে যে বোনকে সামলাতে পারবে না। আরহাম আর সহ্য না করতে পেরে আরহাম দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে আরুহি কে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। আর বলল,,

শান্ত হ বোনু!

ভাইয়া ছাড়ো আমাকে! আমাকে যেতে দাও আমি মা বাবার কাছে যাবো। আমার আর কিছু চাই না, আমার মা বাবাকে চাই। ভাইয়া প্লিজ।

আরু শান্ত হ। কি করছিস এগুলো, ঘরের কি হাল করেছিস। সকল জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছরিয়ে ছিটিয়ে আছে।

ভাইয়া তোমার কি কষ্ট হচ্ছে না। আজ বাবা মা এতিম করে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমাকে যেতে দাও । নাহলে ওরা বাবা মাকে নিয়ে চলে যাবে।

মা বাবাকে দাফন করা হয়ে গেছে আরু!

আরহামের কথায় আরুহি ওর দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। তখন আরহাম নিজেকে শক্ত করে আবারও বলল,,

আমি ঠিক বলছি আরু। মা বাবার দাফন হয়ে গেছে।আমি নিজ হাতে মা বাবাকে শায়িত করে এসেছি কবরে।

ভাইয়া তুমি নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছো তাইনা।আমায় ছাড়ো যেতে দাও।

আরুহি আরহাম কে ছাড়িয়ে যেতে নিল। তখন আরহাম আবারও আরুহি কে ধরে ফেললো। আর বলল,,

কেন পাগলামি করছিস আরু। তুই তো এমন না আরু। তুই তো বাস্তব কে সহজেই মেনে নিতে পারিস। তুই কেন বুঝতে চাইছিস না। মা বাবা আর নেই। বাবা মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। বাস্তবতা কে মেনে নে প্লিজ পাগলামি করিস না।

আরোহি এ কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পরলো। আরহাম বোনকে আগলে নিল। তখন আরুহি বলল,,

কেন এমন করলো তারা কি ক্ষতি করেছিল আমার বাবা মা । কেন তাদের মেরে ফেলা হলো। কি ক্ষতি করেছিল তারা। নিশ্চয়ই বাবা মার কাছে কিছু একটা ছিল। তারজন্যই ওরা বাবা মাকে এভাবে গুলি করে হত্যা করলো। আমি কাউকে ছাড়বো না ভাইয়া। প্রত্যেক কে শাস্তি দেব। আমার মা বাবাকে মারার শাস্তি।

তখন আরহাম বলল,,

হুম আমরা শাস্তি দেব সুযোগ আর সময় বুঝে কাউকে ছাড়বো না।তার আগে জানতে হবে বাবা মায়ের কাছে কি ছিল। যার জন্য তাদের এভাবে প্রান হারাতে হলো। তবে আমাদের যারা এতিম করলো তাদের কাউকে ছাড়বো না। আরহাম মাহমুদ খান আর আরুহি মাহমুদ খান ছাড়বে না তাদের ঠিকই শাস্তি দেবে।

( আরুহি আর আরহাম হচ্ছে নাম করা পুলিশ অফিসার মাহমুদ খান এর সন্তান। আরুহির মা রেহানা খান পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। মাহমুদ খানের কিছু পারিবারিক কারনে তারা পরিবার থেকে আলাদা থাকতেন। তাই ওদের পাশে এখন আত্মীয় স্বজন বলতে কেউ নেই। তাদের কে আজ গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।আরহাম আর আরুহির ধারনা তার বাবা অথবা মায়ের কাছে কিছু একটা ছিল যার জন্য তাদের এভাবে প্রান দিতে হলো। আরুহি ওর মা বাবার মৃত দেহ দেখে পাগলামি করে আর কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আরহাম ওকে রুমে নিয়ে শুয়িয়ে দেয়। আর বাইরে থেকে দরজা আটকিয়ে দেয়। যাতে জ্ঞান ফিরলেও বাইরে বেরুতে না পারে। ওকে এই অবস্থায় দেখে আরহামের ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছিল। ও ওর মা বাবার দাফন করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কখন ওর বোন উঠবে। আর উঠেই আবারো পাগলামো শুরু করে দেয়। আরহামের বয়স এখন একুশ আর আরুহির বয়স চৌদ্দ। দুজনেরই উজ্জ্বল শ্যামবর্নের গায়ের রং দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ। ওদের চেহারা ফর্সা না হলেও দেখলে যে কেউ মায়ায় পড়ে যাবে। )

________________________

পাঁচ বছর পর,,

বোনু কোথায় তুই রেডি হয়েছিস। আজ না তোর প্রথম ক্লাস।

তখন বোরকা হিজাব পরিহিতা একজন মেয়ে উজ্জ্বল শ্যামবর্নের মেয়ে রুম থেকে বের হতে হতে বলল,,

হ্যা ভাইয়া আমি রেডি হয়ে গেছি। কি রান্না হয়েছে আজ?

বেশি কিছু না আমার বোনুর ফেবারিট আইটেম।

আরুহি গিয়ে টেবিলে বসলো পাশে আরহাম । হ্যা মেয়েটি আর কেউ না ও হলো আরুহি। আরহাম খাবার নিয়ে আরুহিকে খাওয়াতে লাগলো। এটা নতুন না সেই পাচ বছর ধরেই আরহাম নিজের হাতে বোনকে রোজ খায়িয়ে দেয়। আরুহি খেতে খেতে বলল,,

প্রতিদিনের মতো আজও তোমার রান্না বেস্ট হয়েছে।

আমার কলিজার পছন্দ হলেই আমি ধন্য। কিন্তু তুই বুঝলি কি করে যে রান্না টা আমিই করেছি।

আমার ভাইয়ের হাতের রান্না আর আমি বুঝতে পারবো না। গত পাঁচ বছরে তোমার হাতের কতো রান্না খেয়েছি। তুমি তো কাউকে কাজের জন্য আনবেই না।তারপর কতো বলে কয়ে একজন কে কাজের জন্য আনলাম। তুমি আবার রান্না করতে গেলে কেন? আমেনা চাচি কে বললেই তো হতো।

পাশেই ওদের বাড়ির কাজের লোক আমেনা বলল,,

আপা আমি কি করতাম ভাইজানই তো আজকে রান্না করতে দিল না।

আরে আমেনা চাচি তো রোজ করে। আজ আমার বোনের মেডিকেলে প্রথম ক্লাস। আমার বোন ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে। গর্বে আমার বুকটা ভরে যাবে। তাই আমি চেয়েছিলাম আমিই সব করবো আমার বোনের জন্য। মা থাকলে তো মা সব করতো।

আরহাম কথাটা বলেই চুপ করে গেল। আরুহি ওর ভাইয়ার হাতে হাত রেখে বলল,,

হুম বুঝতে পেরেছি। মায়ের কাজটা তুমি করছো। এখন আর পুরোনো কথা ভেবে মন খারাপ করো না প্লিজ। তুমি না আমাকে বলতে আরু তোকে স্ট্রং হতে হবে।অল্পতে ভেঙে পরলে চলবে না। এখন তুমি কি করছো।

আমার বোনটা অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন উল্টো আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে। এখন জলদি খাওয়া শেষ কর। আমি তোকে যাওয়ার সময় ড্রপ করে দিয়ে যাবো।

না বাবা তোমার সরকারি গাড়ি তোমার কাছেই রাখো। আর আমি চাইনা প্রথম দিনই সবাই জানুক দ্য গ্ৰেট সি আই ডি অফিসার আরহাম খান আমার ভাই। এ কথা শুনলে কেউ আমার সাথে বন্ধুত্ব করতেই আসবে না। আমি বাপু ওসবে নেই।তার থেকে বরং আমার ভাই গত বছর আমাকে একটা স্কুটি কিনে দিয়েছিল।আমি সেটা নিয়েই যাই।

আমার সাথে যাবিনা ঠিক আছে। তাই বলে এতো ঢং করতে হবে না।

ওকে বাবা সরি। এখন চলো।

আরুহি আর আরহাম যে যার বাহন নিয়ে বেরিয়ে পরলো নিজেদের গন্তব্যে।

( আরহাম এখন একজন সি আই ডি অফিসার হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকটি কঠিন কেস সল্ভ করেছে। তাই অনেকেই ওকে চেনে। আরুহির স্বপ্ন ডাক্তার হবে। এবার এম.বি.বি.এস ফাস্ট ইয়ার।)
______________________

অন্যদিকে,,

মেডিকেল কলেজ এ নিশান আবরার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। আবরারের বন্ধু দুজন ইমান ও নিরব। মেয়েদের কাছ থেকে সর্বদা দূরেই থাকে। তখন ওদের সামনে দিয়ে একটা কালো ছেলে গিয়ে একটা মেয়ের সামনে গিয়ে গোলাপ ফুল নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করলো। মেয়েটা ছিল ফর্সা আর একটু অহংকারী ও বটে। মেয়েটা ছেলেটার হাত থেকে ফুল নিয়ে ফেলে দিয়ে ফুলটা পায়ের নিচে পিষে বলল,,,

এই তোর সাহস কি হলো আমাকে প্রপোজ করার। তোর চেহারা দেখছিস আয়নায়। তোর মতো একটা কালো গাইয়া ছেলে কি না আমার মতো স্মার্ট আর সুন্দরী মেয়েকে প্রপোজ করছিস। তোর সাথে আমার যায় যত্তসব। কাক কাকের মতো থাকবি। তুই ও তোর মতো কোন কালো মেয়েকে খুজে নিয়ে সংসার কর না। আমার মতো ময়ূর এর পেছনে কি?

বলেই মেয়েটা হাসতে হাসতে লাগলো। ছেলেটা লজ্জায় আর অপমানে মাথা নিচু করে ফেলল। মেয়েটাকে সে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো কিন্তু মেয়েটা এরকম কিছু একটা করবে ছেলেটা ভাবতে পারে নি। মেয়েটা হাসতে হাসতে ওখান থেকে চলে গেল। ছেলেটাও অপমানে ওখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেল। কিন্তু এসব দেখে নিশান আবরারের খুব রাগ হলো। ও দাঁত কটমট করে বলল,,

সবাই সৌন্দর্যের পাগল অথচ,,
নিজের ছায়াটাই কালো-

ওর বন্ধুরা ওর কথা শুনে বুঝতে পারলো আবরার খুব রেগে গিয়েছে। ওরা বুঝতে পারেনা। কেউ যদি কারো গায়ের রং নিয়ে কিছু বলে তাহলেই আবরার রেগে যায়। কিন্তু আবরার নিজেই ফর্সা। বডি ও হাইট মিডিয়াম। বাম চোখের ব্রুতে একটা তিল আছে। মেডিকেল কলেজে এবার ইন্টার্নি করছে। দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ হাসলে মনে অনেক সুন্দর লাগে কিন্তু ছেলেটা হাসেই না। ওর হাসি দেখা মানে বিশাল কিছু। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে।ওর বন্ধুরা যখন বলে, কারো গায়ের রং নিয়ে কিছু বললে তোর এতো পুরে কেন? তুই তো নিজেই ফর্সা তাহলে তখন ও বলে “সব আল্লাহর সৃষ্টি আর আল্লাহর সৃষ্টি সর্বদাই সুন্দর। মানুষ কিভাবে রবের সৃষ্টি কে নিয়ে খারাপ কথা বলে।” এ কথার পিঠে ওর বন্ধুরা কিছু বলার সাহস পায় না।আবরার খুব রেগে আছে। ও যখন রেগে যায় তখন সবসময় একা থাকতে পছন্দ করে। ওর রাগ সহজে কমে না।ও রেগে গেলে মাথা ঠিক থাকে না। কাকে কি বলে বা করে ফেলবে তাই একা থাকতে পছন্দ করে।যাতে ওর দ্বারা রাগের সময় কারো ক্ষতি না হয়। আবরার রেগে মেগে ওখান থেকে চলে গেল।
___________________

আরুহি ভার্সিটি এসে স্কুটি পার্ক করে এসে কাউকে ওর পাশ দিয়ে যেতে দেখে বলল,,

এক্সকিউজ মি ভাইয়া! আসসালামু আলাইকুম!

আবরার কারো সালাম শুনে থমকে গেল। এমনিতেও ও রেগে ছিল। সালামটা শুনে ওর রাগটা কমে যেতে লাগলো। মনে শান্তি অনুভূত হলো। কন্ঠটাও চেনা লাগলো কোথাও যেন শুনেছে। সব সাইডে রেখে আবরার পেছনে ঘুরে সালামের জবাব দিল,,

ওয়ালাইকুমুস সালাম।

ঘুরেই ও থমকে গেল কালো বোরকা পরিহিত শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী তে। ও নিজেকে সামলিয়ে বলল,,

জি! কি বলবেন বলুন?

ফাস্ট ইয়ারের ক্লাসটা কোন দিকে যদি বলতেন তাহলে উপকার হতো।

দ্বিতীয় তলার সেকেন্ড ক্লাসটাই ফাস্ট ইয়ারের ক্লাস।

জি ধন্যবাদ আপনাকে!

ওয়েল কাম।

একমিনিট একমিনিট আপনি সেই না, যে কয়েক মাস আগে সিলেট গিয়েছিলেন ঘুরতে আর আপনার ওপর রং পরে গেছিল। একদম ভুতের মতো লাগছিল।

বলেই আরুহি একটু হাসলো। এ কথা শুনে আবরারের মুখটা চুপসে গেল। ও দেখেই চিনতে পেরেছিল আরুহিকে কিন্তু আরুহি যে ওকে এরকম ভাবে মনে রাখবে বুঝতে পারে নি। আবরার বলল,,

হুম আমিই সেই। কিন্তু আপনি সেই না যে আইসক্রিম খেতে গিয়ে নিজের মুখে আইসক্রিম মেখে ভুত সেজেছিলেন।

আবরারের কথা শুনে আরুহির মুখ থেকে হাসি গায়েব হয়ে যায়। আবরার যে ওকে এভাবে বলবে ও বুঝতে পারে নি। ও বুঝতে পারল ওকে ভুত বলেছে দেখে ও এভাবে বলল। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে দুজনেই একসাথে হেসে উঠল।

ফ্লাসব্যাক,,,

আবরার কয়েক মাস আগে সিলেট গিয়েছিল। ওর যখন কোনকিছু ভালো লাগে না। তখন মন ভালো করার জন্য একা একাই ঘুরতে চলে যায়। সেবার ও তেমন ভাবেই সিলেট ঘুরতে গিয়েছিল। আরুহি আর আরহাম ও ঘুরতে গেছিল। ওখানেই ওদের পরিচয়। ওরা একি হোটেলে উঠেছিল। ওদের পরিচয় টাও কাকতালীয় ভাবে হয়েছিল। আরুহি আর আরহাম হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়ে ছিল। আবরার ও তাই। আবরার ছিল সামনে আর আরুহিরা পেছনে আবরার যেতে যেতে একটা লোকের সাথে ধাক্কা খায়। লোকটার মাথায় ছিল রঙ সেই সবটুকু রঙ পরে আবরার এর গায়ে। আবরার পুরো ভুতের মতো লাল দেখতে হয়ে যায়। আরুহিরা যেহেতু পেছনে আর ছিল । তাই কিছু রঙ ওদের গায়েও এসে লাগে। কিন্তু আরুহি আবরারের অবস্থা দেখে নিজেকে সামলাতে পারে না। ও ওকে দেখে হেসে ফেলে। আর তখনি আবরার এর সাথে দেখা হয়। আরহাম ও একটু হাসে। ও গিয়ে আবরার কে ওঠায় কারন ও হুট করে এসব হওয়ায় আবরার শক হয়ে গেছে। এখন মাটিতে বসে আছে। আরহাম আবরার কে উঠিয়ে বলল,,

আর ইউ ওকে মিস্টার?

তখন আবরার বলল,,,

ইয়া আই এম ওকে।

যার সাথে ধাক্কা লেগেছিল সেই লোকটা বলে ,,,

আমার ভুল হয়ে গেছে ভাইজান আমারে মাফ কইরা দেন। আমি ইচ্ছে করে করি নাই। আচংকা ধাক্কা লাগায় এমনটা হইছে।

তখন আবরার বলল,,

রিল্যাক্স এখানে আপনার কোন দোষ নেই। দোষটা আমারই আমিই অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটছিলাম তাই হয়তো আপনার সাথে ধাক্কা লেগে গেছে। ইশশ্ আপনার কতো লস হয়ে গেল। আপনার তো সব রঙ পরে গেল।কতো টাকার রঙ ছিল? বলেন আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

আরুহি আর আরহাম আবরার এর কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল। আর লোকটা অবাক হয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে আবরার এমনই। ও খুব শান্তি প্রিয় মানুষ ও সহজে ঝামেলায় যেতে চায় না। এমনিতেও দোষ টা বেশি ওরই ছিল।আর বাকিরা ভাবছে ওর গায়ে রঙ ফেলেছে ও তো কিছু বললই না উল্টো লোকটাকে জিজ্ঞেস করছে কতো টাকার রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য কেউ হলে এতক্ষনে লোকটাকে আস্ত রাখতো না। তখন লোকটা বলল,,

ভাইজান আমি আপনার ওপর রঙ ফেললাম।আপনি রাগ না কইরা আমারে কইতাছেন আপনার দোষ। আবার এটাও কইতাছেন টাকা দিবেন।

নিজের দোষ কবুল করাটা কোন অন্যায় না। আল্লাহ তায়ালা নিজের দোষ কবুল কারীকে ভালোবাসেন। আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার উম্মত কে বলেছেন “ভুল হলে সে যেনো তার দোষ কবুল করে। আর কারো কিছু নষ্ট করলে সে যেনো তার ক্ষতির বিনিময় পরিশোধ করে।” আমার জন্যই আপনার রঙ পরে গেছে আমি যদি অন্য মনস্ক হয়ে না হাটতাম তাহলে আপনার সাথে ধাক্কাও লাগতো না।আর আপনার রঙ ও পরতো না। এখন বলুন কতো টাকার রঙ ছিল। আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

না ভাইজান লাগবো না। এনে বেশি টাকার রঙ আছিল না। আপনি আর দারায় থাইকেন না। বাসায় গিয়া গোছল সাইরা নেন ।

আরে গুরো রঙ তো কিছু হবে না।

আবরার জোর করে লোকটার হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দিল। লোকটা নেবেই না। আরুহি আর আরহাম ওদের কান্ড দেখতে লাগলো। লোকটা টাকা নিয়ে চলে গেল। তখন আররার এগিয়ে গিয়ে আরহাম কে বলল,,,

ধন্যবাদ মিস্টার আমাকে উঠতে সাহায্য করার জন্য।

মানুষ হয়ে যদি মানুষের সাহায্য করতে না পারলাম তাহলে কিসের মানুষ।

বাহ ভালো কথা বললেন তো। বাই দ্য ওয়ে আমি আবরার । নিশান আবরার ।

আবরার হাত বাড়িয়ে দিল। আবার বলল,,

হাতে রঙ লেগে আছে তবুও হাত বারালাম।

আরহাম হ্যান্ড শেক করে বলল,,,

আমার হাতেও রঙ আছে সমস্যা নেই। আমি আরহাম মাহমুদ খান। আর ও হচ্ছে আমার বোন আরুহি মাহমুদ খান। ( আরুহির দিকে ইশারা করে।)

তখন আরুহি বলল,,

আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুমুস সালাম। আপনাদের সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো।

সেম টু ইউ। এখন বাসায় গিয়ে গোসল নিন। আপনাকে তো ভুতের মতো লাগছে।

আরুহির কথা শুনে আবরার একটু লজ্জা পেল। আর বলল,,,

হুম যাবো। এখন একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।আর এরকম কান্ড হলো। এখন হোটেল এ গিয়ে শাওয়ার নিতে হবে।

তখন আবহাম বলল,,

কোন হোটেলে উঠেছেন?

এই তো ****** হোটেল।

আমরাও তো ওখানে উঠেছি। আমরাও যাবো চলুন এক সাথে যাওয়া যাক।

আবরার সম্মতি জানালো। আবরার আর আরহাম কথা বলতে বলতে এগুলো। আরুহি ওদের পিছু পিছু চলল। হোটেল এ গিয়ে দেখলো ওদের পাশের রুমেই আবরার এর রুম। আরহাম রাতে আবরার কে ডিনারের জন্য ইনভাইট করলো। আররার বলল সে আসবে। আবরার রুমে গিয়ে শাওয়ার নিল। সন্ধ্যার দিকে বের হলো। হোটেল এ সুন্দর একটা বাগান আছে সেখানে গেল। আবরার বাগানে গিয়ে থমকে গেল গ্ৰাউন আর হিজাব পড়া মেয়ের ওপর। ওর হার্টবিট বেড়ে গেল। ইশশ্ কি মায়াবী মুখ। লাইটের আলোতে আরো মোহনীয় লাগছে। আরুহি ও বাগানে কিছু বাচ্চাদের সাথে খেলছিল। হ্যা মেয়েটি আর কেউ না সেটা হলো আরুহি। আবরার মুগ্ধ চোখে ওদের দেখছিল। কিছু একটা ভেবে ও চোখ সরিয়ে নিল। আর আড়চোখে একটু পর পর ওর দিকে তাকাতে লাগলো। আরুহি আইসক্রিম খাচ্ছিল হুট করে কোথাও বেজে হোঁচট খেল। আর আইসক্রিম টা ওর পুরো মুখের ওপর পরে গেল আর সারা মুখে মেখে গেল। তা দেখে আবরার হেসে উঠল। আবরার আরুহির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,,

কে যেন আমাকে বলছিল রঙ মেখে ভুত হয়ে গেছি। আমি না হয় রঙ নিয়ে ভুত সেজেছিলাম। কিন্তু এখন কে যেন আইসক্রিম মুখে মেখে ভুত হয়ে গেছে।

আরুহি এ কথা শুনে রেগে হাত দিয়ে মুখ থেকে আইসক্রিম সরিয়ে ফেলল। আর সামনে আবরার কে দেখতে পেল। আর বুঝতে পারলো কথাটা আবরারই বলেছে। ও কিছু বলবে তার আগেই আরহাম আসলো আর আরুহিকে বলল,,,

বোনু তোর এ অবস্থা কি করে হলো।

তখন আবরার মজা করে বলল,,,

আমার দেখা দেখে একটু ভুত সাজতে গিয়েছিল। রঙ তো পায় নি তাই আইসক্রিম দিয়েই হলো।

আবরারের কথা শুনে আরহাম একটু হাসলো। তা দেখে আরুহি রেগে বলল,,,

ভাইয়া উনাকে চুপ করতে বলো। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।

আরে মিস সরি আমি একটু মজা করছিলাম। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।

আরুহি ওখান থেকে চলে গেল। আরহাম আর আবরার কথা বলতে লাগলো।আর ওখান থেকে দু’জনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলো। আবরার আরহাম এর সম্পর্কে জানতে পারলো।ও একজন সি আই ডি। ওদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে লাগলো। রাতে তিনজন মিলে একসাথে ডিনার করলো। পরের দিনই আরুহি রা চলে এসেছে। তাই আর ওদের সাথে দেখা বা কথা হয় নি।

__________________

বর্তমান,,,

আরুহি আর আবরার হাসতে লাগলো। যারা আবরার কে চেনে তারা সবাই অবাক হয়ে ওদের দেখছে। সব থেকে অবাক ইমান আর নিরব কারন ওরা জানে আবরারের রাগ সহজে কমে না। কিন্তু আজ সব রাগ ভুলে হাসছে। অনেক কম মানুষই আছে যারা আবরার কে হাসতে দেখেছে। আর কলেজের কম বেশি সকলেই আবরার কে চেনে। কারন আবরারের বাবাও একজন নাম করা ডাক্তার আর এই কলেজেই আছে। তিনিও কলেজের গেট দিয়ে ঢুকেই ছেলের হাসি মুখ দেখতে পেল। অনেক বছর হলো ছেলেটার হাসি মুখ দেখে না। তখন হাসি থামিয়ে আরুহি আবরারের গায়ে এপ্রোন দেখে বলল,,,

আপনি যে ডাক্তারি পরছেন বললেন না তো!

আবরার মুচকি হেসে বলল,,

আমরা যখন কথা বলছিলাম তখন তো আপনি ছিলেন না। আপনার ভাই জানে। তবে আপনি যে মেডিকেল এ পরবেন সেটা বলে নি।

হয়তো সময় হয়ে উঠেনি।

আমাদের কলেজে আপনাকে স্বাগতম।

ধন্যবাদ। এখন আমি যাই হয়তো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।

হুম। আপনাকে আবারও দেখতে পেয়ে খুশি হলাম।

মি টু। তবে একটা কথা আমার ভাইয়া যে সি আই ডি অফিসার সেটা কিন্তু কাউকে বলবেন না।

কেন?

এমনি!

ওহ বুঝতে পেরেছি । যাতে আপনাকে দেখে কেউ ভয় না পায়।

এটা পুরোপুরি কারন না হলেও কিছু টা। এখন যাই আল্লাহ হাফেজ এবং ধন্যবাদ।

ওকে আল্লাহ হাফেজ।

আরুহি ওখান থেকে চলে গেল। কিন্তু এতক্ষন অবাক চোখে সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু একজোড়া চোখ দাঁড়িয়ে রাগে ফুসছিল। আরুহি যেতেই ইমান আর নিরব আবরারের দিকে এগিয়ে এলো। ইমান বলল,,,

কিরে আবরার যার মুখে হাসি দেখা মানে দিনের আলোতে চাঁদ দেখার মতো। সে আজ একটা মেয়ের সাথে দাড়িয়ে হাসছিল। যে কিনা কোন মেয়ের সাথে কথাই বলে না। কেস টা কি?

কেস তেমন কিছু না। সিলেটে গিয়ে ওনাদের সাথে আমার এক্সিডেন্টলি দেখা হয়েছিল। তাই সেদিনের কথা ভেবে একটু হাসলাম।

ওনাদের মানে?

উনি আর উনার ভাই। খুবই ভালো মানুষ। আবরার ওদের সব খুলে বলল।’ তবে আরুহির কথা অনুযায়ী আরহামের সি আই ডির কথা বললো না।

সব শুনে ইমান আর নিরব ও হাসলো। ওরা হলো আবরারের কলিজার দোস্ত। ওর জীবন বিত্তান্ত সব ওদের জানা। ইমান হুট করে বলল,,

তোর হাসিটা কতো সুন্দর তুই নিজেও জানিস না। এইভাবেই সবসময় হাসি খুশি ভাবে থাক না। আমাদের খুব ভালো লাগবে।

আবরার চুপ হয়ে গেল। আর বলল,,,

যার জীবন থেকে সুন্দর শৈশব কেরে নেওয়া হয়। সে কখনো সবসময় হাসি খুশি থাকতে পারে না।

তখন নিরব বলল,,,

দেখবি একদিন তোর জীবনে এমন কেউ আসবে। তোর সব কষ্ট মুছে দেবে। তোর জীবনকে রঙিন করে তুলবে। আর হাসিখুশি দিয়ে ভরিয়ে দেবে।

সে যখন আসবে তখন দেখা যাবে এখন চল। স্যার হয়তো চলে এসেছে।

ইমান আর নিরব কিছু বললো না। আবরার এর সাথে ভেতরে চলে গেল। আবরার কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো আর মনে মনে বলল,,

তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা!
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা!

শীতের রিক্ততা আর আমার জীবনের তিক্ততা! কাটিয়ে
তুমি বসন্তের হাওয়ার মতো এসো এই জীবনে!
_________________

আরুহি আবরারের কথা মতো ক্লাসরুমে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে পরলো। ওর দিকে সবাই এমনভাবে তাকালো মনে হয় কোন ভিন্ন গ্ৰহের প্রানী ওদের ক্লাসরুমে ঢুকে পরেছে। ও বসতেই তিনটা মেয়ে ওর সামনে এসে দাড়ালো ওদের মধ্যে থেকে একটা মেয়ে নাম হলো নিতু ও বলল,,,

এই মেয়ে এভাবে প্যাকেট হয়ে কলেজে এসেছো কেন? এখানে সবাই মডার্ন হয়ে আসে তোমার মতো গাইয়া ভুতেরা এখানে আসে না।

এক জোড়া চোখ রাখে ফুসছিল সেটাই হচ্ছে এই নিতু। আর এখন আরুহিকে নিচু দেখানোর জন্যই ও এগুলো বলছে। আরুহি নিতুর দিকে তাকালো দেখলো খারাপ ড্রেস নয় বেশ শালীন ভাবেই থ্রিপিস পরেছে কিন্তু দামী। গায়ে সাদা এপ্রোন, হাতে থিতোস্কোপ। কিন্তু ওকে এভাবে কথা শোনানোর কারন খুজে পেল না। আরুহি চোখ বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করলো আর শান্ত স্বরে বলল,,,

কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় তো ভর্তি ফরমে কোথাও লেখা ছিল না যে মর্ডান হয়ে কলেজে আসতে হবে। বোরকা পড়ে আসা যাবে না।

নিতু এ কথা শুনে রেগে বলল,,

এই মেয়ে সিনিয়র দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তুমি জানো না। সিনিয়র দের সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়। ম্যানার্সলেস যত্তসব।

সম্মান নিতে চাইলে অবশ্যই সম্মান পাওয়ার কাজ করতে হয়। আর অপরজন কেও সম্মান করতে হয়। তাছাড়া আমি যদি ডাক্তার হই তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে দেখেই লোকে আমার কাছে ট্রিটমেন্ট নিতে আসবে। আমার পোশাক দেখে নয়।

অতঃপর,,

~চলবে,,

#তোর_শহরে_রেখেছি_পা
#পর্ব_১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। পর্ব টা কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here