না চাইলেও তুই আমার পর্ব ৯+১০

#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ৯

মিরা ওর নানার হাবভাব দেখে বুঝে গেছে তিনি নিতুর সাথে কথা বলতে চান কিন্তু মুখে প্রকাশ করছে না। হয়তো অভিমান এরজন্য! মিরা ডেনিকে ওর পাপা কে ভিডিও কল করতে বলে। ডেনি মিরার কথা মত কাজ করে। মিরা সিঙ্গেল সোফায় বসে সামনের টেবিলে ল্যাপটপ টা রাখে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ওর পাপা কে দেখে বলে,

—” পাপা তোমার বউ কই?”

—” কিচেনে। তোর উপর খুব রেগে আছে।”

—” জানি আমি। তুমি গিয়ে তোমার বউয়ের রাগ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে এসো, যাও।”

—” আমি পারবো না, এখন গেলে আমাকেও খুব বকবে।”

মিরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,

—” তুমি যাবে না আমি মাম্মাকে বলবো, তুমি অফিসে যাওয়ার সময় পাশের বাসার আন্টি সাথে কথা বলছো।”

মিরার পাপা অবাক হয়ে বলে,

—” আমি কখন কথা বললাম?”

—” সেটা আমি কী জানি?”

—” তুই এইভাবে আমাকে ফাঁসাবি?”

মিরা অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

—” কখন তোমাকে ফাঁসালাম?”

—” হইছে আর বলতে হবে না। তুই সব সময় আমার সাথে এমন করিস। যাই দেখি তোর মাম্মার রাগ কমে কী না?”

মিরা ওর পাপার কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

—” আচ্ছা যাও।”

মিরা ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে দেখে সবাই ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কী কারণে এমন করে তাকিয়ে আছে তা মিরার অজানা। মিরা সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

—” কী হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো তোমরা সবাই?”

মিরার বড় মামা আমতা আমতা করে বলে,

—” না মানে তুই তোর বাবার সাথে এইভাবে কথা বলিস?”

—” হ্যা কেনো?

মিরা মামা কিছু বলার আগে মিরার পাপা ওর মাম্মা কে নিয়ে এসে বলে,

—” কী হলো আবার কার সাথে কথা বলছিস?”

—” ও কিছু না।”

—” তোর কথা মত আমি তোর মাম্মাকে নিয়ে এসেছি। এখন কী বলবি বল।”

মিরা খেয়াল করে ওর মাম্মা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বড্ডো অভিমান করেছে মেয়ের সাথে সে। কথা বলবে না ঠিক করছে। ওখান থেকে এসেছে পর থেকে একবারো তাকে ফোন করেনি অথচ ওর পাপা কে ঠিকই ফোন করেছে।

—” মাম্মা।”

মাম্মা কিছু না বলে মুখ বাড় করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।

—” রাগ করছো মাম্মা? তুমি তো জানো আমি কেমন! তাহলে রাগ করছো কেনো?”

মিরার মাম্মা অভিমান করে বলে,

—” হ্যা, আমি তো জানি কে কেমন! আমাকে একবার ফোন করে বলতে পারলো না, যে সে ভালো ভাবে পৌঁছে? কিন্তু পাপার সাথে তো ঠিকই ফোন করে কথা বলা হয়েছে।”

—” আমি পাপা কে কেনো ফোন করছি সেটা বলেনি? শোনো আমি পাপার সাথে ঝগড়া করতে ফোন করেছিলাম। আর এখানে এসেছি পর থেকে কেউ এক মিনিটের জন্যও এক ছাড়েনি আমাকে তাই তোমাকে আর ফোন করা হয়ে উঠেনি। সরি মাম্মা আর কখনো এমন করবো না।”

মিরার মাম্মা চোখগুলো ছোট ছোট করে বলে,

—” আবার ঝগড়া করছিস কেনো তোর পাপার সাথে?”

—” এমনি। সেসব কথা ছাড়ো এখন। মাম্মা তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

—” সারপ্রাইজ?”

ওদের কথার মাঝে পাপা বলে,

—” সারপ্রাইজ যা দেওয়ার এখানে এসে দিস, তোকে ছাড়া বাড়ি আর অফিস কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

—” পাপা সবে আমি দুইদিন হলো এসেছি। এরমধ্যেই তুমি এমন করছো?”

—” হা হা হা তুই জানিস তোর পাপা কম করে হলেও হাজারবার বলেছে আমাকে এই কথা।”

—” যাইহোক ছাড়ো এসব কথা, তোমরা এখন দুজনে চোখ বন্ধ করো?”

—” কেনো?”

—” তোমার সারপ্রাইজের জন্য।”

—” আচ্ছা করছি আমরা চোখ বন্ধ।”

—” আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।”

—” আচ্ছা।”

সবাই এতক্ষন ওদের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনেছে। ল্যাপটপের স্ক্রিন মিরার দিকে ছিলো বলে তারা কিছু দেখতে পায়নি। তবে একটু বুঝতে পেরেছে তাদের বাড়ির মেয়ে ভালো আছে, বেশ ভালো আছে। মিরা যে ওদের দুজনের চোখের মণি সেটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছে।

মিরা মাম্মা পাপা চোখ বন্ধ করলে, মিরা উঠে ল্যাপটপ টা নানা নানুর সামনে রেখে নিজে নানা নানুর মাঝে বসে পড়ে। নানা নানু একদৃষ্টিতে তাদের মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মিরার নানু এত বছর পর মেয়েকে দেখে তার চোখের পানি আজ বাঁধ মানছে না। কত বদলে গেছে তাদের মেয়ে। এখন শাড়ি পড়তে শিখেছে। গিন্নি গিন্নি ভাব আছে চেহারার মধ্যে। গিন্নি ভাব আসবে না কেনো? পুরো বাড়ি আর তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দুটোকে সামলে রাখে বলে কথা। এই কম কিসের?

মিরা আসতে করে বলে,

—” এবার চোখ খুললো তোমরা।”

মিরার কথা শুনে আসতে করে চোখ খুলে মিরার পাশে বসে থাকা দুই ব্যাক্তিকে দেখে চমকে উঠে দুজনে। মাথায় একগাদা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে! তারা মিরার কাছে কীভাবে এলো? না কী মিরা গেছে তাদের কাছে? মিরার পাপা আর মাম্মা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকায়। মিরার মাম্মা এত বছর পর বাবা মাকে একসাথে দেখে খুশিতে চোখের পানি পড়ছে। কী বলে কথা শুরু করবে তা বুঝতে পেরেছে না। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে করে, তাদের মান অভিমান ভেঙ্গে কথা বলে। অবশেষে শেষ হয় এত বছরের মান অভিমানের পালা।

__________________________________________

সন্ধ্যার পর মিহানের নামে পার্সেল এসেছে একটা। বাড়ির দারোয়ানের কাছে একটা লোক দিয়ে গেছে পার্সেল টা। দারোয়ান মিহানের মমের কাছে পার্সেল টা দিয়ে যায়। মিহান নিচে এলে পার্সেলের কথা বলে মম। মিহান ভালো করে পার্সেল টা খুঁতিয়ে দেখছে। পার্সেলে নাম বা কোনো এড্রেস লেখা নেই। কে হতে পারে? মিহানের কাছে রহস্য লাগছে বিষয় টা। অনু এসে দেখে মিহান হাতের থাকা পার্সেল টা নিয়ে গবেষণা করছে। এসব দেখে অনু বলে,

—” হাতে নিয়ে বসে থাকবি? না কি পার্সেল টাও খুলে দেখবি?”

—” কিন্তু নাম বা এড্রেস কিছুই তো লেখা নেই পার্সেল টায়। খোলা কী ঠিক হবে?”

অনু বিরক্ত ভাব এনে বলে,

—” না খুললে বুঝবি কী করে কে দিয়েছে এটা?”

—” তাও ঠিক। দাঁড় আমি খুলে দেখি।”

মিহান পার্সেল টা খুলে দেখে একটা সাদা শার্টের বুকের দুই পাশে রং মাখা হাতের ছাপ পড়া। মুহুর্তেই এটা দেখে মিহানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।

—” এটা কী ভাইয়া?”

মিহান শীতল কন্ঠে বলে,

—” ভালোবাসা।”

—” হোয়াট?”

মিহান অনুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পার্সেলের বক্সটা ভালো করে দেখে। খোঁজা খুঁজির পর এক কোনে ছোট্ট একটা চিরকুট পায়। ব্যস্ত হতে চিরকুট খুলে দেখে খুব ছোট করে লেখা “ভীতুরাম ফিরে এসেছি”!
এইটুকু পড়ে মিহান সোফায় বসে পড়ে। অনু এগিয়ে গিয়ে বসে উত্তেজিত হয়ে বলে,

—” ভাইয়া কী হয়েছে তোর এমন করছিস কেনো? তুই ঠিক আছিস তো? দাঁড় আমি মমকে ডাকছি!”

মিহানে কানে হয়তো অনুর কোনো কথা পৌঁছায়নি, শুধু একটা কথাই কানে বাজছে ” ভীতুরাম ফিরে এসেছি”! অনু তট জলদি করে ওর মমকে ডেকে আনে, তিনি মিহানের পাশে বসে বলে,

—” মিহান কী হয়েছে তোর? অনু কী বলছে?”

মিহান কিছু না বলে হাতের চিরকুট টা ওর মমের দিকে এগিয়ে দেয়। তিনি কৌতুহলী হয়ে চিরকুট টার দিকে তাকায়। কিছু একটা ভেবে চিরকুট টা নিয়ে উল্লাসিত সরে পড়ে,

—” ভীতুরাম ফিরে এসেছি।”

খুশিতে চোখ ঝলঝল করে উঠে‌ মমের। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিহানের দিকে তাকায়, মিহান বুকের সাথে শার্ট টাকে জড়িয়ে ধরে আছে। অনু কিছুই বুঝতে পারছে না ওর মম আর ভাইয়া এমন করছে কেনো? মাথায় হাজারো প্রশ্ন, “ভীতুরাম ফিরে এসেছি” একথার মানে কী? কী হচ্ছে এসব? ভীতুরাম ই বা কে? অনু উত্তরের আশায় ওদের দিকে তাকায়। কিন্তু তারা তো এখন দুনিয়ার সবথেকে ব্যস্ত মানুষ। একজন চিরকুট টার দিকে তাকিয়ে আছে আর একজন রংয়ে মাখা শার্ট টা জড়িয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে নিজেই জিজ্ঞাসা করে,

—” মম তোমরা এমন করছো কেনো? আর এই ভীতুরাম টাই বা কে?”

—” ভীতুরাম তোর ভাইয়া।”

অনু অবাক হয়ে বলে,

—” হোয়াট? কী বলছো এসব?”

—” এই চিরকুট আর শার্ট টা মিরা পাঠিয়ে।

—” কী বলছো এসব? মিরা আপু?”

মিহান অনুর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,

—” ঠিক বলছে মম। ওর সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয় সেদিন আমার ভুল বসতো ওর দুই হাতের রং আমার শার্টের বুকের দুই পাশে লেগে যায়। আর এই শার্ট টা হলো সেই শার্ট।”

অনু বিরক্ত মুহুর্তে কেটে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,

—” মিরা আপু ইজ ব্যাক!”

মম মিহানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,

—” তাই তো মনে হচ্ছে।”

অনু কৌতুহলী হয়ে মিহানের কাছে এসে বলে,

—” কিন্তু মিরা আপু এখন কোথায়? তুই আপুর বাড়ির এড্রেস টেড্রেস কিছু জানিস?”

মিহান মুখ গোমড়া করে মাথা নাড়িয়ে না বলে। অনু মাথায় হাত দিয়ে বলে,

—” তাহলে আর কী? চিনবি কী করে মিরা আপুকে?”

অনুর কথা শুনে মম বলে,

—” তাই তো, অনু তো ঠিক কথা বলেছে।”

মিহান ওদের কিছু না বলে এক হাত চিরকুট অন্য হাতে শার্ট টা নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

—” কথা দিয়েছে আমায়! আসবে আমার কাছে। নিজে থেকে আসবে। একবার শুধু আমার সামনে এসে দাঁড়াক ভালোবাসা দিয়ে ওকে আটকে রাখবো। না চাইলেও ও আমার। শুধু আমার!

চলবে…..
#না_চাইলেও_তুই_আমার_02
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্বঃ ১০

পড়ন্ত দুপুরবেলা! সবে মিরা আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম উঠেছে। কাল বেশ রাত করে খান বাড়ি ফিরেছে মিরা। নানা নানু সবাই হাজারবার বলেছে থেকে যাওয়ার জন্য কিন্তু মিরা সবাইকে বুঝিয়ে চলে এসেছে। বাড়ি ফিরে দাদাকে সবকিছু বলে, মিরার মাম্মা আর নানার মান অভিমানের পালা যে অবশেষে শেষ হয়েছে এইভাবে মিরার দাদা খুব খুশি। মিরা যে নানার বাড়ি গেছিলো এই বিষয়ে মিরার দাদা ছাড়া খান বাড়ির আর কেউ জানে না। মিরা শাওয়ার নিয়ে রেডি হচ্ছে, একবারে রেডি হয়ে নিচে যাবে বলে। তখন দরজা ঠেলে রুমে ঢোকে নীলা। শুকনো মুখে বেডের এক কোনে এসে বসে। মিরা অবশ্য এর কারণ জানে অভ্র নামক ইডিয়েটার জন্য মন খারাপ নীলার।

—” মন খারাপ করে আছো কেনো? আর নিঝুম কোথায়? ও না আজ আমার সাথে ঘুরতে যাবে!”

—” নিঝুম স্কুলে গেছে, হঠাৎ করে একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস পরে গেছে তাই না চাওয়া সত্ত্বেও স্কুলে যেতে হয়েছে।”

—” অহহহ।”

—” কাল তুই কোথায় গেছিলি? রাতে কখন ফিরছিস তুই?”

মিরা হাঁসি মুখে বলে,

—” গেছিলাম তোমার শ্বশুর বাড়ি, তাই ফিরতে রাত হয়ে গেছে।”

—” মজা করিস না। আমার শ্বশুর বাড়ি কোথায় পেলি তুই?”

—” তোমার ছোট মাথায় তা ঢুকবে না।”

—” বলছে তোরে? আর এতো সেজে গুজে কোথায় যাচ্ছিস এখন?”

—” যাচ্ছি একজনের সাথে দেখা করতে। কেনো?”

—” স্পেশাল কেউ?”

—” উমমম,,, খুব স্পেশাল।”

নীলা একটু নড়েচড়ে বসে বলে,

—” কে সে?”

—” আছে পরে বলবো তোমায়।”

এরমধ্যে মিরার ফোন বেজে ওঠে মিরা নিজের চুল ঠিক করতে করতে নীলাকে বলে,

—” আপু দেখো তো কে ফোন করছে?”

—” দাঁড় দেখি!”

নীলা মিরার ফোন হাতে নিয়ে দেখে বড় মামা, বেশ বড় বড় করে লেখাগুলো ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। কিন্তু নীলার মনে প্রশ্ন উঁকি মারছে। মিরার মামা আসলো কোথা থেকে? ওর তো ওর মামার বাড়ির সাথে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে? নীলার ভাবা ভাবির জন্য যে ফোন টা বাজেই যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। মিরার কথায় নীলা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।

—” কী হলো কে ফোন করছে?”

—” তোর বড় মামা।”

—” অহহহ। তুমি ফোন রিসিভ করে স্পিকারে দেও। আমি না হয় চুল ঠিক করতে করতে কথা বলি।”

—” হুম।”

মিরা চুল ঠিক করতে করতে বলে,

—” হ্যালো।”

—” হ্যা মিরা শোন কাল তোকে এত করে থাকতে বললাম আর তুই চলে গেলি। মা কড়া নির্দেশ দিয়েছে আমি যে করে পারি তোকে যেনো দুপুরের মধ্যে এ বাড়িতে হাজির করতে।”

—” কিন্তু মামা আমার তো আজ কাজ আছে।”

—” আমি ওতো কিছু জানি না। তুই আসবি এটাই শেষ কথা।”

মিরা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

—” ওকে মামা আমি দুই ঘন্টা তোমাদের ওখানে থাকতে পারবো। তারপর আর কেউ জোর করতে পারবে না।”

—” সে দেখা যাবে আগে তুই আয়।”

—” ঠিক আছে।”

নীলা এতক্ষন হা করে মিরার কথাবার্তা শুনছিলো। নিজেকে আর প্রশ্ন করতে না করে মিরাকেই জিজ্ঞাসা করে,

—” মিরা তোর এই মামা টা কে? আর সে তোকে তাদের বাড়ি যেতে বললো কেনো?”

মিরা সবকিছু ঠিক করে ফোন হাতে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

—” যে আমাকে ফোন করেছিলো সে আমার বড় মামা ফাহিম আহামেদ মানে তোমার হবু শ্বশুর। আমি এখন তাদের বাড়ি যাচ্ছি।”

মিরার কথা শুনে নীলা হতবাক হয়ে যায়। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যায়। কী বলে গেলো মিরা? ওর মামা, হবু শ্বশুর,,,,, কিছুক্ষণ পর নীলা লাফ দিয়ে উঠে মিরার দিকে দৌড়ে যায়। মিরা ততক্ষণে নিচে চলে যায়। নীলা আশেপাশে কেউ আছে কি না তা না দেখে মিরার সামনে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে,

—” একটু আগে তুই কী বললি? তুই তোর মামার বাড়ি যাচ্ছিস মানে?”

মিরা কিছু না বলে নিজে মনে ব্রেকফাস্ট করে যাচ্ছে। অবশ্য এই সময় এটাকে ব্রেকফাস্ট বলে না।এমন ভাব করছে নীলার কোনো কথা মিরা শুনতে পায়নি! এদিকে মিরার দাদি আর ফুপি নীলার কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। কী বলছে নীলা? মিরার মামার বাড়ি আসলো কোথা থেকে? ফুপি নীলার বলে,

—” কী বলছিস তুই মিরার মামার বাড়ি আসলো কোথা থেকে?”

—” আমি ঠিকই বলছি। মিরা নিজে বলেছে ওর মামার বাড়ি যাবে এখন।”

মিরার দাদি বলে,

—” নীলা কী বলছে মিরা?”

মিরা মুখ থেকে জুসের গ্লাস টা নামিয়ে বলে,

—” যা সত্যি তাই বলেছে।”

—” মানে?”

মিরা এরপর সবকিছু ওদের খুলে বলে। সব শুনে ওরা সবাই খুব খুশি। কিন্তু দাদি দাদার উপর রাগ করছে। তাকে তো একবার জানাতে পারতো সে! তিনি প্রথম থেকে সবকিছু যেনেও তাকে কিছু বলেনি। তিনি এসব জানলে কী এমন হতো? নীলা তো হা হয়ে গেছে সব শুনে। মিরা নীলাকে চোখে টিপ দিয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে বলে,

—” যাই দাদি মামার বাড়ি।”

নীলা মিরার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, এত বড় কান্ড ঘটিয়ে কেমন শান্ত মনে সব কাজ করছে। মিরা মানুষ না কী অন্য কিছু? মানুষ না হলে এমন একটা কাজ করে শান্তভাবে বসে থাকা যায়। মিরা আদৌ কী মানুষ?

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার
নেই মানা মনে মনে।
‌ মেলে দিলেম গানের সুরের
এই ডানা মনে মনে।
তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ কথার
পারুলবনের চম্পারে মোর
হয় জানা মনে মনে!
সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি মেঘে মেঘে
আকাশ-কুসুম তুলি।
সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে
আমি যাই ভেসে দূর দিশে-
পরীর দেশের বন্ধ দুয়ার
দিই হানা মনে মনে!!!

—– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনেকক্ষণ ধরে জ্যামে আটকে আছে মিরার গাড়ি। রাস্তার অন্য পাশে দিয়ে গানটার কিছু লাইন ভেসে আসছিলো তখন। বেশ ভালো লাগে গান টা এই মুহূর্তে মিরার। এখন মিরাও ইচ্ছে করছে কোথাও হারিয়ে যেতে। কেনো ইচ্ছে করছে সে কারনটা অজানা তার। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে কোথা থেকে গান টা ভেসে আসছে তার সুত্র জানার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে জানার চেষ্টা বিফলে যায়, কোন জায়গায় থেকে ভেসে আসছে গান টা তা বুঝে উঠতে পারে না। মন খারাপ করে পড়ন্ত বিকেলের আকাশের দিকে তাকায় মিরা। মুহুর্তেই মন খারাপের আভা কেটে যেতে শুরু করে। আকাশে মেঘের খেলা চলছে। বাতাসে ছুটে চলেছে মেঘগুলো। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস এসে তার চুলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। হাজার ভালো লাগা খুঁজে পায় মিরা এর মাঝে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার গাড়ি চলতে শুরু করে আর মিরার ভাবনার নতুন চিন্তা এসে উঁকি দেয়। চিন্তার নাম মিহান! আজ তার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো মিরা কিন্তু? যাইহোক সন্ধ্যার আগে একবার ও বাড়ি থেকে বের হবার চেষ্টা করতে হবে। না হলে আজও মিহানের সাথে দেখা হবে না মিরার। ভাবনার ইতি ঘটে গাড়ির ব্রেক করায়। বাইরে তাকিয়ে দেখে এসে গেছে তার গন্তব্যে!

মিরাকে ভিতরে ঢুকে দেখে ছোট মামী এগিয়ে এসে বলে,

—” এসে গেছো, মা সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ শুভ, নিশু, মিশু ওরা স্কুল কলেজও যায়নি।”

মিরা মামীর কথা শুনে উত্তরে শুধু হাসি উপহার দেয়। মিরার সাথে কাল সবার পরিচয় হয়েছে, মিরার বড় মামা আর মামীর এক ছেলে অভ্র। ছোট মামা আর মামীর তিন ছেলে মেয়ে বড় শুভ, তারপর নিশু আর‌ মিশু। এরা তিন জনেই বয়সে মিরার ছোট। কাল মিরা যতটুকু বুঝতে পেরেছে শুভ সবার পিছনে লাগতে ভালোবাসে। নিশু শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। মিশু সবথেকে বেশি দুষ্টুমি করে।

মিরা হল রুমে আসতে না আসতে মিরার নানু একটু রাগ করার অভিনয় করে বলে,

—” তোকে কখন আসতে বলছে তোর বড় মামা? আর তুই এখন এলি?”

—” মামা যখন ফোন করেছিলো তখন আমি সবে ঘুম থেকে উঠেছি। তাই আসতে তো একটু দেরি হবে তাই না? এখন বলো কী জন্য এত জরুরি তলব?”

—” আমি কী কোনো কারণ ছাড়া তোকে ঢাকতে পারিনা?”

—” কেনো পারবে না অবশ্যই পারবে।”

এদের মাঝে বড় মামী এসে বলে,

—” মা দাঁড়িয়ে কী কথা বলবেন না কী মেয়েটাকে বসতে বলবেন? মিরা তুই বসতো।”

সন্ধ্যার পর থেকে শুভ, নিশু, মিশু এদের যেত সব আজগুবি আজগুবি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে মিরা। অনেক চেষ্টা করছে সন্ধ্যার আগে বের হবার কিন্তু ওর নানুর জন্য তা আর সম্ভব হলো না। কত কী প্লান করে রেখেছিলো মিরা আজকের জন্য। কিন্তু? যাইহোক কাল না হয় নতুন করে প্লান করবে মিরা মিহানের জন্য। এইসব আনমনে ভাবছে তখন মিশুর কথা শুনে বাস্তবে ফিরে আসে মিরা।

—” আপু আমার না একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে তোমার কাছে?”

—” কী?”

—” কাল যে ভিডিও টা দেখিয়েছে ফুপি আর ফুপার। তুমি ভিডিও টা কোথায় পেলে?”

মিরা ছোট মামী বলে উঠে,

—” হ্যা! হ্যা! আমিও ওকে এই কথাটা জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কথায় কথায় ভুলে গেছিলাম। এখন বলোতো কী করে কী হলো?”

মিরা হালকা হেসে বলে,

—” আমি আর আমার দুই বেস্টফ্রেন্ড প্রিয়া আর প্রেম মিলে এসব করি। মাম্মা পাপার বার্থডে, ওয়েডিং আন্নিভর্সারি বা অন্য কোনো অক্কেশন থাকে তার আগের দিন রাত থেকে রেডি থাকি ক্যামেরা নিয়ে আমরা তিনজন। এইসব ভিডিও হলো আমাদের Create।”

মিরার মামী হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন মিরার দিকে। মিরা ওর মামীর অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,

—” জানো মামী আমাদের জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত একবারই আসে যেমন ধরো না কালকে রাতের কথা। এরকম Situation আর কখনো আসবে না আমাদের জীবনে। তাই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখতে চাই। কখনো মন‌ খারাপ থাকলে ঐসব মুহূর্তে গুলো দেখলে নিমেষ মন ভালো হয়ে যায়। অসংখ্য মন খারাপের মাঝে এগুলো খুব সহজে মনে আনন্দ দিয়ে যায়। এবার বুঝলে কেনো করি আমি এসব!”

মামী হেসে বলে,

—” জ্বী বুঝেছি মেম।”

চলবে…..

কেমন লাগলো জানাবেন। হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ। 💙
কেমন লাগলো জানাবেন। হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ। 💙

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here