না_চাইলেও_তুই_আমার পর্ব ১৫+১৬

#না_চাইলেও_তুই_আমার
[ সিজান ৩ ]
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্ব- ১৫+১৬
মিরান গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একা একা ফোন ঘাটাঘাটি করছে আর বিড়বিড় করে নিজেকে দোষারোপ করছে। বিকেলের কোন যে ও ওর মাম্মার রুমে গিয়েছিল। বিকেলে মিরান ঘুরতে বের হবে এ কথাটা ওর মাম্মাকে বলতে গিয়ে ছিলো। কিন্তু ওর মাম্মার রুমে ঢুকে ওর মাম্মা ওকে দেখে বলে, তোহার নাকি কাল দুপুরে কনসার্ট আছে। তাই মিরান যেন তোহা কে নিজে সন্ধ্যার পর রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। মিরান প্রথমে মানা করে দিলে ওর মাম্মা ওকে বুঝিয়ে বলে এতো রাতে একা একটা মেয়ে মানুষ একা একা যাও নিরাপদ নয়। মিরান ও ভাবে এতো রাতে একটা মেয়েমানুষ একা যাবে এটা মোটেই ভালো দেখায় না। তারপরে মেয়েটা ওদের বাড়িতে ছিল। কোন বিপদ-আপদ হলে তার দায় কিছুটা ওদেরও থাকে। তাই মিরান ওর মাম্মার কথা সমর্থন জানিয়ে রাজি হয়ে যায় তোহা কে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মিরান কারো ধাক্কায় ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মাথা তুলে তাকায়। তোহা দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে তো পরীর মত তার উপরে আজ আবার সাজুগুজু করেছে। মিরান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,

—-” চলুন, না হলে দেরি হয়ে যাবে আমাদের।”

এতক্ষণ মিরান যে তোহার দিকে তাকিয়ে ছিলো তা দেখে তোহা মিরানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

—-” চলো।”

মিরান আর কিছু না বলে গাড়িতে উঠেন ড্রাইভ করতে শুরু করে। তোহা কিছুক্ষণ পর পর মিরানের দিকে তাকাচ্ছে। তা মিরান খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে কিন্তু সাহস করে কিছু বলতে পারছে না। যে গুন্ডি মেয়ে রে বাবা যদি মেরে হাত-পা ভেঙে দেয়? এই ভেবে মিরান আর কিছু বলে না তোহা কে। এদিকে তোহা তো বেশিক্ষন চুপচাপ থাকতে পারে। তাই তোহা নিজে থেকে মিরান কে বলল,

—-” তুমি সবসময় এমন চুপচাপ থাকো, তোমার গার্লফ্রেন্ড এই নিয়ে কিছু বলে না তোমাকে?

তোহা যদিও জানে মিরানের গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড কিছুই নেই। শুধু মিরান কে জ্বালানোর জন্য এমন প্রশ্ন করছে তোহা। মিরান ড্রাইভ করার মাঝে হতবাক চোখে তাকায় তোহার দিকে। এই মেয়ে বলে কী ওর গার্লফ্রেন্ড? জীবনে ঠিকমতো কোন মেয়ের সাথে কথাই বলবো না তার আবার হবে কিনা গার্লফ্রেন্ড? মিরান নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” ধুর আপনি যে কী বলেন না! আমার আবার গার্লফ্রেন্ড আসবে কোথা থেকে?”

তোহা মিরানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

—-” তাহলে তুমি বলতে চাইছো তোমার গার্লফ্রেন্ড নেই! থাক এই নিয়ে আর মন খারাপ করো না তুমি। দেখে নিও তোমার জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোমার থেকে তোমাকে বেশি ভালোবাসবে।”

মিরান তোহার কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল,

—-” মানে?”

তোহা মিরানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,

—-” না, কিছু না তুমি গাড়ি চালাও।”

মিরান আর কিছু না বলে ড্রাইভের মন দেয়। এই মেয়ে যে কখন কী বলে কিছুই বুঝতে পারেনা মিরান। সব সময় হেঁয়ালি করে কথা বলে। মিরান এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে সামনের দিক দিয়ে আসা একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে যায় ওদের গাড়ির। তোহা কিছু বলার আগেই মিরান তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে ধাক্কা লাগা গাড়িটার সামনে যায়। না বেশী একটা ক্ষতি হয়নি সামান্য ঘষা লেগেছে। এইভাবে মিরান ছোট নিঃশ্বাস ফেলে পিছন ফিরে তাকানোর আগে কেউ একজন মিরানের শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,

—-” এই ননসেন্স কিভাবে গাড়ি চালাস রাস্তা ঘাটে? গাড়ি যদি নাই চলাতে পারিস তাহলে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিস কেন? দেখেছিস গাড়িটা কি অবস্থা করেছিস?

মিরান ভদ্রতার সাথে বলল,

—-” সরি আসলে আমি একটু বেখেয়াল হয়ে পড়েছিলাম তাই ভুল করে আপনার গাড়ি সঙ্গে লেগে গেছে। আপনি চাইলে আপনার যা ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ আমি দিতে পারি।”

ছেলেটা কিছু বলবে তার আগে গাড়ি থেকে অন্য একটা ছেলে বেরিয়ে এসে ওই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” কিরে কী হয়েছে এখানে?”

মিরান গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে গাড়ির দরজার লক হয়ে যায়। তোহা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখে একটা ছেলে মিরানের শার্টের কলার ধরে আছে। তোহা রেগে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল,

—-” এই ছেলে তোমার সাহস কী করে হয় মিরানের শার্টের কলার ধরার?”

তোহার কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকায়। সিঙ্গার নওশীন তোহা দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ছেলেটা তোহার থেকে চোখ সরিয়ে মিরানের দিকে তাকায়। মুহূর্তেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় ছেলেটার। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

—-” মি…মিরান ভাইয়া!”

মিরান ছেলেটার দিকে তাকায়। কেউ কিছু বলার আগে ছেলেটা গিয়ে ঐ ছেলেটা কাছ থেকে মিরানের শার্টের কলার ছাড়িয়ে নিয়ে আতঙ্কিত করে বলল,

—-” সরি ভাইয়া ও আপনাকে চেনে না। সজীব এতদিন দেশে ছিল না কিছু দিন হলো দেশে ফিরেছে। তাই আপনার ব্যাপারে কিছু জানেনা। প্লিজ ভাইয়া ওকে কিছু করবেন না।”

মিরান শান্ত গলায় বলল,

—-” না ঠিক আছে দোষটা এখানে আমার ছিল। আমি বেখেয়ালি হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। শুধু শুধু তুমি সরি বলছো কেন?”

মিরানের শার্টের কলার যে ছেলেটা চেপে ধরেছিল মিরান তার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” সরি সজীব আমি খেয়াল করিনি।”

তোহা এতক্ষণ কী হচ্ছিল কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু সজীব এর উপর ভীষণ রেগে আছে তোহা। সজীবের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

—-” তুমি ওকে সরি বলছো কেন? ওর সাহস কী করে হয় তোমার শার্টের কলার ধরার। ওকে তো আমি….

তোহার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে মিরান তোহা কে শান্ত করে বলল,

—-” আপনি গিয়ে গাড়িতে বসুন আমি এ দিকের ব্যাপারটা সামলে আসছি।”

মিরান তোহার থেকে চোখ সরিয়ে দ্বিতীয় ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” তোমাদের তো বেশ খানিক ক্ষতি হয়ে গেছে। তোমাদের ক্ষতিপূরণ কত টাকা দিতে হবে?”

ছেলেটা আতঙ্কিত চোখে তাড়াতাড়ি করে বলল,

—-” না না ভাইয়া আপনাকে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। আমি রিপেয়ার করে নেবো। আপনি ভাবিকে নিয়ে যান।”

মিরান চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকায়। এখানে ওরা ভাবি পেলো কোথায়? তোহা কে কোন ভাবে ওর বউ ভাবছে না তো? তোহার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে ছেলেটার কথা শুনে। তোহা এগিয়ে গিয়ে মিরানের হাত ধরে বলল,

—-” চলো, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মিরান আর কিছু না বলে তোহার সাথে গিয়ে গাড়িতে বসে। কিন্তু তোহার মনে বারবার একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, ছেলেটা মিরানকে দেখে ভয় পেয়েছিল কেন? বা মিরান কে দেখে ভয় পাবারই বা কী আছে?

মিরান গাড়ি নিয়ে চলে গেলে ছেলেটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সজীবের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” রাগকে কন্ট্রোল করতে শেখ। না হলে কিন্তু যখন-তখন তুই বিপদে পড়বি।”

সজীব ছেলেটার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,

—-” ভাইয়া তুমি ওই ছেলেটাকে দেখে এত ভয় পেয়ে গেছিলে কেন?”

ছেলেটা সজীবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” তুই ওকে ওই ছেলে বলছিস? নাম করা কার্ডিওলজিস্ট মিরান চৌধুরী নাম শুনেছিস? এই হলো সেই মিরান চৌধুরী। কার্ডিওলজিস্ট মিহান চৌধুরী কে চিনিস? তিনি মিরান ভাইয়ার বাবা। বিজনেস ওয়ার্ল্ডের মিরা চৌধুরী নাম তুই তো নিউজপেপারে অনেকবার পড়েছিস। তিনি মিরান ভাইয়ার মা। আর তুই তার সাথে পাঙ্গা নিতে গিয়েছিলি!”

সব শুনে সজীব হতবাক হয়ে যায়। তা-ও কৌতুহলী হয়ে বলল,

—-” আমার মনে হয় না তুমি শুধু এই কারণে আমাকে এসব বলছো। সত্যি করে বলতো কাহিনী কী?”

এতক্ষণ যে কথাটা গোপন করতে চেয়েছিল তা গোপন করতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল,

—-” আসলে আমি আর আমার বন্ধুরা মিলে মিরান ভাইয়ার বোনের বান্ধবী কে কিছুদিন বিরক্ত করেছিলাম। তা মিরান ভাইয়া কোন ভাবে জানতে পেরে প্রথমে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু তখন আমাদের রক্ত গরম ছিল তাই উল্টো আরো বেশি বিরক্ত করতে শুরু করি মিরান ভাইয়ার বোনের বান্ধবী কে। একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়ার সময় কয়েকটা লোক এসে আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে দেখি আমাদের নির্জন একটা মাঠে নিয়ে এসেছে আর মাঠে মিরান ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সেদিন খুব মেরেছিল আমাদের। আর আমাদের শাসিয়ে দিয়েছিল আমরা যদি আর কখনো কোন মেয়েদের বিরক্ত করে তাহলে আমাদের অবস্থা আরো খারাপ করে দেবে।”

সব শুনে সজীব মুখ টিপে হেসে বলল,

—-” এর জন্যই তো বলি আমার ভাইয়া হঠাৎ করে বিড়াল হয়ে গেলো কেন?”

ছেলেটা সজীবের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,

—-” আর হাসাহাসি করতে হবেনা আপনাকে এখন চলুন। না হলে বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যাবে আমাদের।”

ছেলেটা কথামতো সজীব গাড়িতে উঠে বসে।

______________________________

গাড়ি ড্রাইভ করছে আর একা একা বিড়বিড় করছে শান্ত। পুলিশের চাকরি কারনে ঠিকমতো ছুটি নিয়েও ছুটি কাটাতে পারে না শান্ত। নতুন একটা কেসের ইনভেস্টিগেশন জন্য শহরের বাইরে যেতে হয়েছে শান্তকে দুপুরের পর। এ কথা শান্ত টিয়াকে জানায়নি। এ কথা টিয়া জানতে পারলে শান্ত কে আর আস্ত রাখবে না। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মিরা আন্টি কে জানিয়ে এসেছে শান্ত। একা একা হাবিজাবি বিড়বিড় করতে করতে অনেকটা পথ চলে এসেছে শান্ত। হাত ঘড়িতে সময় দেখে রাত সাড়ে দশটার বেশি বাজে‌। হঠাৎ করে চোখ যায় গাড়ির সামনে রাস্তার পাশ ধরে একটা মেয়ে হেঁটে চলেছে। শীতের রাতে, রাত দশটা মানে গভীর রাত। এতরাতে একটা মেয়েকে এমন নির্জন জায়গায় একা একা হাটতে দেখে শান্ত ভ্রু কুঁচকায়। গাড়িটা স্লো করে মেয়েটার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে শান্ত। বারবার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মেয়েটা। মেয়েটা হয়তো কোনো বিপদে পড়েছে ভেবে শান্ত গাড়ি নিয়ে মেয়েটার সামনে গিয়ে ব্রেক কষে। আচমকা এমন করে একটা গাড়ির সামনে এসে পড়ায় মেয়েটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। শান্ত গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কান্না করতে করতে হিচকি উঠে গেছে মেয়েটার। মেয়েটা ধীরে ধীরে পিটপিটিয়ে তাকায়। চোখের সামনে এক অজ্ঞাত যুবক দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা ভয়ে পিছিয়ে যেতে শুরু করে। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে দেখে শান্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” দেখুন আপনি আমাকে ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না। আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্য এই মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ছি।”

মেয়েটা আশার আলো দেখতে পায় শান্তর সাহায্য করার কথা শুনে। পরক্ষণেই আবার ভয় আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে ওকে। নিউজ বা খবরের কাগজ খুললেই মেয়েদের সম্মান হানির ঘটনাগুলো একের পর এক চোখে পড়ে। দেশের এমন অবস্থায় অপরিচিত এক যুবকের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া কী ঠিক হবে? মেয়েটা কিছু একটা ভাবতে দেখি শান্ত আবারও মৃদু স্বরে বলল,

—-” আপনি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাও বলবো আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আপনার বয়সী আমার একটা বোন আছে বাড়িতে। আমি এমন কোন কাজ করব না যাতে আপনার আত্মসম্মানের লাগে।”

মেয়েটা এবার একটু ভরসা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল,

—-” আসলে আমি হারিয়ে গিয়েছি।”

মেয়েটার কথা শুনে শান্ত মেয়ে টার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। এত বড় মেয়ে বলে কিনা সে হারিয়ে গেছে? নাকি ওর সাথে ফাজলামো করছে? শান্ত মেয়েটাকে ধমক দিয়ে বলল,

—-” আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্য মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামালাম। আর আপনি কিনা আমার সাথে ফাজলামো করছেন?”

শান্তর ধমক সঙ্গে মেয়েটা আবারো ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—-” সত্যি বলছি আমি হারিয়ে গেছি। ছোটবেলা থেকে কখনও আমি একা একা কোথাও যাইনি। এমন কী স্কুল-কলেজে ও বাবা অথবা মা বাবাকে নিয়ে যেত।”

মেয়েটার কথা শুনে শান্ত কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বলল,

—-” সেসব না হয় বুঝলাম কিন্তু আপনি এখানে কী করে এলেন আর কাঁদছেন বা কেন?”

মেয়েটা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল,

—-” আমি বাবা মায়ের সাথে বাবার বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাবো বলে বাসে উঠেছিলাম। বাসে উঠেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাস দাঁড়িয়ে আছে চায়ের দোকানের সামনে। বাস থেকে কিছু লোক নেমে চা নাস্তা খাচ্ছে। তখন বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি জানলা দিয়ে বাইরে থাকে সবকিছু দেখছিলাম। চায়ের দোকানের পাশে একটা গাছে অনেকগুলো জোনাকি পোকা দেখে আমি খুব খুশি হয়ে বাস থেকে নেমে জোনাকি পোকার দেখতে যাই। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এক মানে জোনাকি পোকা গুলো উড়ে বেড়ানো দেখছিলাম হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় বাসের কথা। চায়ের দোকানের সামনে এসে দেখি যারা চা খাচ্ছিল তারা নেই এমনকি বাস টা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে নেই। চায়ের দোকানদার কে বাসের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানায় বাস অনেকক্ষণ আগে চলে গেছে। বাবাকে যে একটা ফোন করবো ফোনটাও বাসে ফিরে এসেছি। আর তখন থেকে আমি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি।”

এই মেয়েটাকে যে এখন কী করতে ইচ্ছে করছে শান্ত বুঝতে পারছে না। এটা কোন ধরনের পাগলামী? সামান্য জোনাকি পোকার জন্য বাস মিস করলো? শান্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—-” আপনার মাথায় ঘিলু বলতে কিছু আছে?”

মেয়েটা সহজে মনে বলল,

—-” ওমা আপনি জানেন না পৃথিবীর সব মানুষের মাথায় ঘিলু থাকে? তাহলে আমার মাথায় থাকবে না কেন?”

শান্তর এতক্ষণে বুঝে গেছে মেয়েটার সোজা সরল প্রকৃতির। মেয়েটার ভিতরে কোন সাত-পাঁচ নেই। শান্ত আর কথা না বাড়িয়ে বলল,

—-” ওসব কথা ছাড়ুন। এখন আপনি আপনার বাবার বন্ধুর বাড়ির ঠিকানা দিন আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”

মেয়েটা মন খারাপ করে বলল,

—-” আমি জানিনা তো।”

শান্ত এবার মহা চিন্তায় পড়ে গেলো। মেয়েটা ঠিকানা জানেন না অথচ তাকে পৌঁছে দেবে কী করে? শান্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” আচ্ছা আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন সে জায়গার নাম জানেন?”

মেয়েটা মাথা চুলকিয়ে চুলকিয়ে বলল,

—-” সিলেট না জানি শেরপুর। আমার নাম টা মাথায় আসছে না।”

শান্ত বিড় বিড় করে বলল,

—-” মাথা থাকলে তো কিছু আসবে।”

শান্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—-” আপনার বাড়ি কোথায় সেটা আপনার মনে আছে?”

মেয়েটা তাড়াতাড়ি করে বলল,

—-” হ্যাঁ তা আমার মনে আছে আমরা তো ঢাকায় থাকি।”

শান্ত আশার আলো দেখতে পেয়ে মৃদু হেসে বলল,

—-” যাক কিছু অন্তত আপনার মনে আছে। এত রাতে তো আর ঢাকায় রওনা দেওয়ার সম্ভাবনা তার থেকে আপনি আমার সাথে আমাদের বাড়িতে চলুন। কাল সকালে আমি নিজ দায়িত্বে আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো।”

মেয়েটা ভয়ে ভয়ে বলল,

—-” আপনার বাড়িতে আমি কেন যাব এত রাতে?”

শান্ত হালকা হেসে বলল,

—-” চিন্তা করবেন না আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না। আসলে বাড়িটা আমাদের নয় বাড়িটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের। আমরা সবাই সেখানে ঘুরতে এসেছি। আঙ্কেল আন্টি আমার বোন বোনের বেস্ট ফ্রেন্ড আরো অনেকে আছে সেখানে।”

মেয়েটা কিছুটা ভরসা পেয়ে বলল,

—-” ঠিক আছে চলুন।”

শান্ত গাড়ির দিকে হাঁটা দিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল,

—-” বাই দ্যা ওয়ে আপনার নামটা তো জানা হলো না।”

মেয়েটা ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,

—-” জান্নাতুল ফেরদৌস। আপনি আমাকে জান্নাত বলে ডাকতে পারেন।”

শান্ত মৃদু হেসে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” চলুন জান্নাত আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

জান্নাত হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে শান্তর পিছনে হাটতে শুরু করে।

______________________________

রাত এগারোটার বেশি বাজে। গাড়ি এসে থামে তোহার বাড়ির সামনে। এতক্ষণ তো বেশ সময় কাটাচ্ছিল মিরানের সাথে কিন্তু এখন যে ও চলে যাবে। তোহা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে মিরানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” বাড়ির ভিতরে চলো। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে তারপর নাহয় আবার চলে যেও। একটানা এতক্ষণ গাড়ি ড্রাইভ করলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে।”

মিরান সিট বেল খুলে তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না আমার অভ্যাস আছে একটানা অনেকক্ষণ ড্রাইভ করার।”

তোহা মিরানের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—-” এক কাপ কফি অন্তত খেয়ে যাও।”

মিরান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

—-” ঠিক আছে চলুন।”

কলিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে মিনা এসে দরজা খুলে দেয়। তোহার সঙ্গে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দেখে অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। মিনা কিছু বলার আগে ভিতর থেকে স্নেহা মৃদু স্বরে বলল,

—-” কে এসেছে মিনা?”

মিনা আরো কিছুক্ষণ তোহাদের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু চিৎকার করে বলল,

—-” আম্মা!”

মিনা এইটুকু বলে দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। তোহা আর মিরান ভিতরে গিয়ে দেখি সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তুলি কিছু একটা আন্দাজ করে ঠোঁটে হাসি এনে বলল,

—-” ভাইয়া আপনি কী ডাক্তার?”

মিরান অবাক গলায় বলল,

—-” হ্যাঁ কিন্তু….

মিরানের কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তুলি ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,

—-” আম্মু তোমার বড় জামাই এসে গেছে বরণের ব্যবস্থা করো।”

মিরান চোখ বড় বড় করে তাকায় তুলির দিকে। এই পিচ্চিটা কী পাগল হয়ে গেছে? বড় জামাই মানে?

চলবে….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। গঠনমূলক মন্তব্য করলে লেখা উৎসাহ আসে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here