নিখোঁজ প্রেমের শহরে, পর্ব:৩

🍁 #নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে (৩য় পর্ব)

শিহাবের ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে ঘরে প্রবেশ করে কমলা। মেয়েটির এক হাতে থাকে কর্ণফ্রেক্স এর বাটি, আরেকহাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। প্রতিদিন সকালে শিহাবের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া তার অন্যতম দায়িত্ব।
শিহাবের বয়স সাতাশ। শান্ত স্বভাবের ছেলে। রাগ বলতে তার মাঝে কিছু নেই। সবসময় হাসিখুশি। তবুও এ বাড়িতে আসার প্রথম দিন থেকে শিহাবকে দেখে কমলা ভয় পায়। বুক দুরুদুরু করে তার।
আজকেও কর্নফ্রেক্স দিতে আসা মাত্রই কমলার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করলো। শিহাব বাসি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
গুড মর্নিং কমলা। হাও আর ইউ?
কমলা কোনো উত্তর দিলো না। সে আলগোছে বাটি আর মগ বিছানার পাশের টি টেবিলে রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
শিহাবের মন খারাপ হয়ে গেলো। মেয়েটা তাকে দেখে ভয় পায়। অথচ ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আজ পর্যন্ত কমলার সাথে উঁচু গলায় কোনো কথা সে বলে নি, ধমক দেওয়া অনেক দূরের বিষয়! শুধু কমলা কেনো কারো সাথেই উচ্চস্বরে কথা বলতে পারে না সে।

শিহাব কফির মগে চুমুক দিলো। কি চমৎকার স্বাদ! শিহাবের মতে, এরকম চমৎকার স্বাদের কফি একমাত্র তার মা রেহণুমা বানাতে পারেন। আর কেউ পারে না। কোথাও পাওয়াও যায় না। ঢাকার বিখ্যাত কফিশপ ক্রিমসন কাপ অথবা নর্দান ক্যাফে তেও না।
শিহাবের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের তালিকায় শুধুমাত্র একজনের নাম আছে। তার মা, রেহণুমা বেগম। সকালে জাগনা পাওয়ার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যাবতীয় যা কাজকর্ম সব মায়ের সাথে আলোচনা করে নেয়। কি রঙের শার্ট পরে অফিসে যাওয়া হবে, স্যালারির কোন অংশ কোন খাতে ব্যবহার করা হবে, দুপুরে কি দিয়ে খাবে ইত্যাদি। এমনকি শিহাবের ব্যাংক একাউন্টের নমিনিও তার মা।

নাস্তা শেষ করার সাথে সাথে কমলা আবার ঘরে ঢুকলো। শিহাব তার দিকে তাঁকিয়ে হাসলো। কমলা গোমড়া মুখে বলল,
খালাম্মা আফনারে ডাকে।
মাকে বলো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
খালাম্মা এক্ষণি যাবার কইছে।
শিহাব ভ্রুঁ কুচকে বলল,
ইম্পোর্ট্যান্ট কিছু?
কমলা উত্তর দিলো,
জানি না।
‘জানি না’ বলে সে এক মূহুর্তও দাঁড়ালো না। যেরকম ফুড়ুৎ করে এসেছিলো, ঠিক তেমনি ফুড়ুৎ করে চলে গেলো।

শিহাবদের বাড়িটা বিশাল বড়। ডুপ্লেক্স। ওপর তলায় তিনটা ঘর। একটি মাস্টার বেডরুম। সেখানে তার মা বাবা থাকে। বাকি দুটো ঘরের একটিতে সে থাকে, অপর ঘরটি তার বোন শিরিনের। অবশ্য শিরিনের ঘর এখন বেশিরভাগ দিন বন্ধ করে রাখা হয়। সপ্তাহে দুই দিন খোলা হয় পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। শিহাবের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে দুই বছর হলো। শুভ কাজ সম্পন্ন হওয়ার তিন মাসের মাথায় তার হাজবেন্ড নিয়াজ গ্রিন কার্ড পেয়ে গেলো। এখন তারা আমেরিকার নিউ জার্সিতে থাকে।
নিচতলার পুরো অংশটুকুই ড্রইংরুম বলা যেতে পারে। দুই সেট সোফা আছে। দুটোই কাঠের। দেয়ালে ৪২ ইঞ্চির টিভি। সদর দরজার দুপাশে দামী মূর্তি রাখা। পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা চারিদিক। শুধু দক্ষিণ দিকটায় রান্না বান্নার যত আয়োজন। রান্নাঘরের চুলায় সারাদিনই কিছু না কিছু চড়ানো থাকে। খাবারের গন্ধে ম ম করে পুরো বাসা। রান্নার জন্য আলাদা লোক আছে। তবুও খুন্তি নেড়েচেড়ে দেওয়া রেহণুমার স্বভাব। প্রতিটি আইটেম বার বার চেকে দেখেন লবণ ঠিক আছে কিনা? ঝালের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলো কিনা? তার ছেলে আবার ঝাল খেতে পারে না।

___________________
লেখিকার আইডি: https://www.facebook.com/hidden.me.99

গ্রুপ লিংক:
https://www.facebook.com/groups/2677596098993023/?ref=share
______________________

ফ্রেশ হয়ে শিহাব নিচে নেমে এলো। সিড়ি দিয়ে নামতেই দেখলো বেতের চেয়ারে তার মা বসে আছেন। মায়ের মুখ গম্ভীর। মনে হচ্ছে প্রচন্ড সিরিয়াস মুডে আছেন। বাবাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। এসময়টায় তিনি পেপার পড়ায় ব্যস্ত থাকেন। বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে হেলান দিয়ে পেপার পড়েন। পাশে রেডিও চলতে থাকে। শিহাব রেহণুমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
‘মা, আমাকে ডেকেছো?’
‘হু। বোস।’
শিহাব বসলো।
ইম্পোর্ট্যান্ট কোনো কথা মা?
মোটামুটি ইম্পোর্ট্যান্ট।
শিহাব হাসলো।
রেহণুমা আগ্রহ ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
গতকাল মেয়েটাকে দেখে আসলি, ভালো কি মন্দ কিছুই তো বললি না।
মা, তুমি তো জানই আমি ভালো মন্দ বিচার করতে পারি না। তাই বলতে পারছি না।
মেয়েকে তোর পচ্ছন্দ হয়েছে?
হয়েছে।
মেয়ের তোকে পচ্ছন্দ হয়েছে?
জানি না।
মেয়ের তোকে পচ্ছন্দ হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করবি না?
সেরকম সুযোগ পাইনি। বর্ষা আমার সাথে খুবই ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো।
সেই ইন্টারেস্টিং বিষয়টা কি?
ও আমার সাথে চুক্তিতে যেতে চাচ্ছিলো।
কেমন চুক্তি?
চব্বিশ ঘন্টার জন্য বিয়ের চুক্তি।
রেহণুমা চোখে কপালে তুলে বলল,
চব্বিশ ঘণ্টার জন্য বিয়ে?
হু।
তুই কি বলেছিস?
আমি তাকে বলেছি ভেবে দেখবো।
তুই বর্ষাকে বলেছিস ভেবে দেখবি?
হু।
চব্বিশ ঘণ্টার জন্য বিয়ে করায় তোর মত আছে?
আছে।
প্রত্যুত্তরে রেহণুমা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। রাগ দমিয়ে শান্ত গলায় তিনি বললেন,
যাও। তোমার ঘরে যাও।
শিহাব বলল,
মা, তুমি কি আমার কথায় রাগ করেছো? প্লিজ, রাগ করো না। এরকম বিয়ে সত্যি সম্ভব। এধরণের বিয়েকে ‘মুতা ম্যারেজ’ বলে। যদিও শিয়া স্কুলের একটা গ্রুপ ছাড়া বাকি ইসলামিক স্কুলগুলো এই জাতীয় বিয়েকে নিষিদ্ধ করেছে। তবে ইরানে এখনো মুতা ম্যারেজ এর প্র‍্যাকটিস আছে। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং কিন্তু।
এসব কথা তোকে কে বলেছে?
বর্ষা বলেছে।
রেহণুমা উঠে দাঁড়ালেন। তার রাগ ক্রমশ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি চাচ্ছেন না তার রাগ এখন মাত্রা ছাড়িয়ে যাক। তার জন্য এই কথোপকথন বন্ধ করা প্রয়োজন।

শিহাব, এই বিয়ে নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমি এবং তোমার বাবা নিবো। তুমি বরং ঘরে যাও।
ঠিকাছে।
দুপুরে কি দিয়ে খাবে আজকে?
মুরগীর মাংস।
আচ্ছা।
শিহাব আর কোনো কথা বলল না। নিজের ঘরে ফিরে গেলো। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ‘ওগি এন্ড দ্যা ককরোচেস’ এর নতুন একটি সিডি কিনে এনেছে। সেটা চালিয়ে দিলো। অফিস যেদিন বন্ধ থাকে সেদিন সে কার্টুন দেখেই দিন কাটায়।

রেডিওতে পুরানো দিনের হিন্দি গান বাজছে। কিশোর কুমারের গাওয়া ‘মেরে মেহবুব কেয়ামাত’। বজলুল সাহেব গানের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে পা নাচাচ্ছেন। সাথে পেপার পড়ছেন।
রেহণুমা এসে কঠিন গলায় বলল,
গান বন্ধ করো।
বজলুল সাহেব গান বন্ধ করলেন। স্ত্রীকে তিনি বেশ ভয় পান। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন,
কি হয়েছে?
এই মেয়ের খোঁজ তোমার কোন বন্ধুর মাধ্যমে পেয়েছিলে?
কোন মেয়ে?
বর্ষা।
ও। শম্ভু বলেছিলো। ওর বন্ধুর মেয়ে। অনেক ভালো মেয়ে। আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আইনের ছাত্রীরা এমনিতেই অনেক বুদ্ধিমতী হয়।
তোমার বন্ধু শম্ভু যেনো এ বাড়িতে পা না ফেলে।
বজলুল সাহেব নিচু কণ্ঠে শুধালেন,
কি হয়েছে গিন্নি?
তোমার বন্ধুর এনে দেওয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে আমাদের ছেলেকে সুন্দর একটি চুক্তিপত্রে সাক্ষর করাতে চেয়েছে।
কিসের চুক্তিপত্র?
চব্বিশ ঘণ্টার জন্য বিয়ের চুক্তিপত্র।
বলো কি? শিহাবকে বলেছে?
হু।
শিহাব কি বলেছে?
ওর বলাবলির কি আছে এখানে? বলাবলির কথা আমাদের। মেয়ের বাড়ি কি তুমি ফোন করবে নাকি আমি করবো? থাক! তোমার মেয়ের বাড়ি ফোন করতে হবে না। তুমি গুছিয়ে কথা বলতে পারো না। আমি ফোন করছি।

বজলুল সাহেব কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই রেহণুমা নিচতলায় নেমে আসলেন। সোফায় বসে টেলিফোনের পাশে রাখা ছোট্ট নোটবুকটা হাতে নিলেন। গভীর মনোযোগের সাথে বর্ষাদের বাড়ির নাম্বার খুঁজতে লাগলেন।

চলবে…

লেখনীতে, আতিয়া আদিবা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here