নিখোঁজ প্রেমের শহরে, পর্ব:২

🍁#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে (২)

ক্ষণিককাল বর্ষা ঘুমের দেশে বিচরণ করলো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে একটা স্বপ্নও দেখে ফেললো। পাত্রপক্ষ ফোন করেছে। কন্ঠে মিষ্টতা ধরে রেখে বলছে,
হেফাজত সাহেব। আপনার মেয়েকে আমাদের খুব পচ্ছন্দ হয়েছে। এমন মেয়ে হাজারে একটা পাওয়া যায়। কিন্তু ছেলে নিজেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত মনে করছে না। এখন কি করি বলেন তো?

বর্ষাদের ড্রইং রুমটা সুন্দর। কদিন আগেই নতুন একসেট সোফা বানানো হয়েছে। সেগুন কাঠের সোফা। এখনো রুম দিয়ে সেগুন সেগুন গন্ধ বেরুচ্ছে। দেয়ালে তিনটে পেইন্টিং টাঙ্গানো আছে। সামনে শোকেস এর ওপর একটা ৩৬ ইঞ্চির টিভি। এঘরে সারাদিন টিভি চলে। ড্রইং রুম দিয়ে বারান্দায় যাওয়ার দরজার পাশে একটি সুইং চেয়ার রাখা। রিটায়ারমেন্টের পর থেকে হেফাজত করিম দিনের বেশিরভাগ সময় এই সুইং চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় দুলে দুলে বই পড়ে কাটান। মুখ ভর্তি পান থাকে। তিনি যে আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখেন বিষয়টা তাও না। প্রোগ্রাম গুলো নিয়ে তার অভিযোগের শেষ নেই! উনার ভাষ্যমতে, প্রোগ্রাম হতো তাদের সময়। বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল ছিলো না। ঘরের মা বেটিরা সারাদিনের কাজকর্ম, পড়াশোনার পার্ট চুকিয়ে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখতে বসতো। আহা! কি দিন ছিলো! এখন টিভির প্রোগ্রাম মানেই যতসব অর্ধনগ্নতার কারবার। এত অভিযোগের পরেও এবাড়িতে সারাদিন টিভি চলে। হেফাজত করিম গল্পের বই পড়ার মাঝের বিরতিতে টিভির স্ক্রীণে চোখ মেলেন।

গায়ে পাতলা চাদর জড়িয়ে ঘুম ঘুম চোখে বর্ষা টিভির ঘরে এলো। তার মা রুমানাকে এখন এঘরেই পাওয়া যাবে। স্বামীর সাথে গুটুর গুটুর করে গল্প করা তার স্বভাব। রুমানাকে পাওয়া গেলো। হেফাজত করিমের সাথে নিচু গলায় কথা বলছিলো। বর্ষাকে দেখে দুজনেই চুপ হয়ে গেলো। হেফাজত হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
ঘুম হয়েছে মা?
হয়েছে।
ঈর্ষা বলল তোর মাথা ব্যাথা করছে। মাথা ব্যাথা কমেছে?
একটু কমেছে। পুরোপুরি কমে নি।
স্ত্রীর দিকে তাঁকিয়ে হেফাজত বললেন,
রুমানা যাও। চা বানাও। বর্ষা মা, চা খা। চা হলো মাথাব্যথার যম। আমার ঠ্যাং ব্যাথা হলেও আমি চা খেতাম। হা হা হা।

রুমানা স্বামীর কথায় মিটিমিটি হাসছেন। এই ভদ্রমহিলা স্বামীসঙ্গ অত্যন্ত পচ্ছন্দ করেন।

তুমি বসে রইলে কেনো? যাও। চা বানাতে যাও। ঈর্ষা চা খাবে নাকি ওর কাছে শুনে নিও। দুই মেয়েকেই সমান ভাবে ট্রিট করতে হবে। একজনকে বেশি, আরেকজনকে কম এমন ডিস্ক্রিমিনেশন আমার বাসায় চলবে না। বুঝেছো?
বুঝেছি।
তোমার সোনার গয়নার ক্ষেত্রেও সেইম হিসাব। এক আনি এদিক সেদিক হওয়া চলবে না।

রুমানা কোনো উত্তর দিলো না। উঠে চা বানাতে গেলো। বর্ষার কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। ছেলের বাড়ির থেকে হয়তো এখনো ফোন করে নি। তবে ঈর্ষা যে বলল বাবা রেগে আছেন?
বর্ষা সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল,
বাবা তুমি আমাকে ডেকেছিলে?
হ্যাঁ। ডেকেছিলাম। তোর সাথে দরকারি কিছু কথা ছিলো।
বলো।
দরকারি কথা বলার আগে তোকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। ছোট খাটো বক্তৃতাও বলতে পারিস।
হু।
হেফাজত সাহেব গলা কেশে পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর বললেন,
শোন মা, কোনো মা বাবাই সন্তানের খারাপ চায় না। সন্তানের ভালোর জন্য তারা নিজেদের জীবনটুকুও দিতে এক পায়ে খাড়া। বকের মতো। বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে জানিস তো?
হু।
আমি, তোর মা, কেউই তোর খারাপ চাইনা।
হু।
তুই কি বিয়ের ব্যাপারে বন্ধুদের সাথে কোনো কথা বলেছিস?
আমার একটাই বন্ধু বাবা। শাহানা।
ওইতো। শাহানাকে কিছু বলেছিস?
না।
বলিস না। বিয়ের ব্যাপারে আগেভাগে কারো সাথে কথা বলা উচিত না।
আচ্ছা।
মেয়েটাকে এমনিতেও আমার পচ্ছন্দ না। বিয়েতে বন্ধু বান্ধব না আসাই ভালো।
ছেলের বাড়ি থেকে ফোন করেছিলো?
এখনো করেনি। তবে করবে। মেয়ে আমার পচ্ছন্দ হওয়ার মতো। বানের জলে ভেসে এসেছে নাকি যে পচ্ছন্দ করবে না? তুই চিন্তা করিস না।
আমি চিন্তা করছি না।
ছেলেকে তোর পচ্ছন্দ হয়েছে তো?
বর্ষা কোনো উত্তর দিলো না। এ প্রশ্নের উত্তর সে জানে না।

রুমানা ট্রেতে চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। হেফাজত করিম স্ত্রীকে শুধালেন,
ছোট মেয়েকে দিয়ে এসেছো?
দিয়েছি।
ঠিকাছে দাও, বর্ষাকে চায়ের কাপটা দাও। আহারে! বেচারির মাথা ব্যাথা।
বর্ষা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হেফাজত করিম বিস্মিত স্বরে বললেন,
কই যাচ্ছিস?
তুমি আর মা চা খাও। একসাথে গল্প করো। আমি রুমে যাচ্ছি। টিভির সাউন্ড কানে লাগছে। একটু আরাম করে চা খাবো।

বর্ষা ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় চলে এলো। ছোট্ট বারান্দা। একটি চেয়ার পাতা। এক কোণায় বেশ কয়েকটি ফুলের টব রেখে দেওয়া। ফুলগুলো ঘ্রাণ ছেড়েছে। খুব মিষ্টি সুবাস বাতাসে। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। রাতটুকু পাতলা কুয়াশার পর্দায় ঘেরা থাকে। হিমালয়ের কনকনে বাতাস শহর কিছুটা ছুঁয়ে যায়। শরীরে হীম শীতল অনুভূতিরা খেলা করে। এরকম রাতে বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অতীতের কত কথা, কত স্মৃতি উঁকি ঝুঁকি দেয়। মস্তিষ্ক একাই সচল হয়ে ওঠে। কত পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলাতে থাকে।
বর্ষা কড় গুণে গুণে হিসেব করলো। সাত বছর আগের কথা!
নিউ টেনে উঠে নিজেকে বেশ বড় বলে মনে হচ্ছিলো বর্ষার। স্কুলের গন্ডি পেরোবার সময় চলে এসেছে। ক্লাসের শেষ তিনটি বেঞ্চ বর্ষা এবং তার বন্ধুদের দখলে। বারো জনের বৃহৎ একটি সার্কেল। ক্যাপ্টেন ক্লাসে পিন পতন নীরবতা বজায় রাখতে বোর্ডে নাম লিখে। ব্ল্যাক বোর্ডে চক দিয়ে ঘসঘস করে নাম লিখে। এক নম্বরেই বর্ষার নাম। পুরো ক্লাসে বর্ষা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বান্ধবীরা মুখ চাপিয়ে খিলখিল করে হাসে।
টিফিন পিরিয়ডে এদের গল্পের একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে থাকে প্রেম, ভালোবাসা। বারো জনের মাঝে ছয়জন প্রেম করে। তাদের গল্প শুনে বাকি ছয়জন। থেকে থেকে হাসির রোল পরে যায়। গল্পের বিষয়বস্তু মাঝে মাঝে সীমা অতিক্রম করে ফেলে। এ পর্যায়ে অনেকে কান বন্ধ করে বলে, আমি আর শুনবো না। আর শুনবো না। বাকিরা হাত শক্ত করে ধরে বলে, তোকে শুনতেই হবে। আরেক দফা হাসির রোল!
জীবন স্বাভাবিক ভাবেই তার সরল গতিতে চলছিলো। একদিন হঠাৎ সেই ছেলেটি বর্ষার জীবনে আসলো। জীবন তার গতিপথ হারালো। রং রুটে এগুতে লাগলো। এগুতেই লাগলো!
বর্ষা জানতো না এ রাস্তার শেষ সীমানা কোথায়? ফিরে আসার উপায়ই বা কি?
যদি সম্ভব হতো, কড় গুণে গুণে ঠিক সাত বছর আগে সে আবার ফিরে যেতো। জীবনকে তার গতিপথ হারাতে দিতো না। মোটেও না।

ঈর্ষা বারান্দার দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। নিচু স্বরে ডাকলো,
আপা।
বল।
তোমার কি মাথা ব্যাথা কমেছে?
কেনো?
ঈর্ষা বলল,
ওই ঘরে অনেক মশা। পা জ্বলে যাচ্ছে কামড়ে। আমি এই ঘরে পড়ি?
ছোটবোনের মুখের দিকে তাঁকিয়ে বর্ষার হঠাৎ মায়া লাগলো। সে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,
ঠিকাছে। পড়।

লেখনীতে, আতিয়া আদিবা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here