নিখোঁজ প্রেমের শহরে, পর্ব:১২

#পর্ব_১২
#আতিয়া_আদিবা

সকালের বাতাসে ভিটামিন আছে। কিন্তু এবাড়ির ছাদে সেই ভিটামিনের পরিমাণ দ্বিগুণ। সম্প্রতি এরকমটা মনে করছেন হেফাজত করিম। কেননা, বাড়ির ছাদে বেশ কিছু সবজির গাছ লাগানো হয়েছে। আর সবজি হলো নানাবিধ ভিটামিনের উৎস। এর প্রভাব এ বাড়ির ছাদের বাতাসে রয়েছে। বাতাসে ভিটামিন ভেসে বেড়ায়।

এজাতীয় আবিষ্কার সম্প্রতি হওয়ার কারণ হেফাজতের ছাদে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস ছিলো না। দিন কয়েক ধরে তিনি ছাদে হাঁটছেন। নিয়ম করে হাঁটলে শরীর-মন দুটোই ভালো থাকে। ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা তিনি চড়কির মত ঘুরেন। আর ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলেন। ঘেমে জবজবে অবস্থায় নিচে ফিরে আসেন। তারপর খালি পেটে এক গ্লাস চিরতার পানি পান করেন। এই পর্বে তাকে রুমানা এবং ঈর্ষা সংগ দেয়। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে। প্রথম দিন ঈর্ষা অর্ধেক গ্লাস চিরতার পানি পান করে মুখ চাপিয়ে মিনিট পাঁচেক বসে রইলো। তারপর বাথরুমের দিকে ছুটে গেলো। চোখ বড় বড় করে হড়হড় করে বমি করে ঘরে ফিরে এলো। হেফাজত নির্বিকার। বললেন,
প্রথম প্রথম এডজাস্ট করতে সমস্যা হবে। পরবর্তীতে আর হবে না। কথায় আছে না? ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয়’। আজ বমি হয়েছে। আগামীকাল হবে না।
ঈর্ষা গোমড়া মুখে বলল,
বাবা আমি শরীরে চিরতার পানি সহাতে চাইছি না।
হেফাজত শান্ত গলায় বললেন,
আমি দুঃখিত। এক্ষেত্রে তোমাকে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা দেওয়া হয় নি। আমি যেহেতু বলেছি প্রতিদিন খালি পেটে চিরতার পানি খেতে হবে। তার মানে খেতেই হবে।
রুমানা নিচু স্বরে বলল,
মেয়ে যখন চাইছে না কি দরকার জোর করে খাওয়ানোর?
দরকার আছে। অবশ্যই দরকার আছে। চিরতা হলো মহৌষধ। তুমি জানো চিরতার আদি নিবাস কোথায়?
রুমানা বলল, না।
চিরতার আদিনিবাস হলো ভারতে। এর উৎপত্তিস্থল হলো হিমালয়ের পদতলে। প্রাচীণকাল থেকেই ভারতে চিরতা ব্যবহার করা হয় গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে। কত বড় বড় রোগ চিরতার কাছে বাচ্চার সমতুল্য জানো?

না। আজ জানলাম।

ঈর্ষা বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল,
চিরতা অত্যাধিক তিতকুটে।

ভালো জিনিস তিতকুটেই হয়। যেমন ধর চিরতা তিতা। এটি তিতা বলেই এর আয়ুর্বেদিক নাম কিরাততিক্তা। করল্লাও তিতা। আবার সত্যি কথা বলা ভালো অথচ সত্য শুনতেও তিতা লাগে।

এটুকু বলে হেফাজত করিম হো হো করে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। যেনো সে মজার কোনো কথা বলে ফেলেছেন।

ঈর্ষা মনে মনে দোয়া করছে তার বর্ষা আপা যেনো দ্রুত ফিরে আসে। তার বিশ্বাস আপা ফিরে এলে বাবার এসব পাগলামি বন্ধ হবে। তবে আপা কবে ফিরবে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না। আপা কই গিয়েছে তাও পরিবারের কেউ জানে না। মাকে চিন্তিত দেখায়। রোজ জায়নামাজে বসে চোখের জল ফেলেন। হেফাজত বিরক্ত হোন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেন,
এত কান্নাকাটি করার কি আছে? কেউ কি মারা গিয়েছে?
রুমানা ভাঙ্গা গলায় বলেন,
মেয়েটা কই গেলো, কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানি না অথচ তুমি একটু খোঁজও নিলে না। কিভাবে এত নিশ্চিন্তে বসে আছো? কেমন বাবা তুমি?

বাবাদের আবার প্রকারভেদ আছে নাকি?

আছে। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে থানা পুলিশ করে ফেলতো।

আমার একটা মান সম্মান আছে। এই বয়সে এসে থানা পুলিশ করবো?

মেয়ের জীবনের থেকে মান সম্মান তোমার কাছে বড়?

এর উত্তর তুমি জানো রুমানা। খামোখা প্রশ্ন করো না। মন খারাপ হবে।

রুমানার ভেজা চোখ আরো ভিজে ওঠে। বিস্মিত চোখে স্বামীর দিকে তাঁকিয়ে থাকে সে। তার চোখে মুখে চিন্তার অত্যল্প পরিমাণও নেই! সে আছে তার সংসারে নতুন নতুন বিধান জারি করায়। সকালে নিয়ম করে হাঁটা, চিরতার পানি পান করা, বারোটার মাঝে দুপুরের খাবার শেষ করা, রাতের খাবারের ম্যানু পরিবর্তন করা ইত্যাদি!
সে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চান,
ইয়া আল্লাহ! আমার মেয়েটা যেখানেই থাকুক তাকে তুমি সুস্থ রেখো। ভালো রেখো।

রেহনুমা সাধারণত শিহাবের ঘরে আসেনা। তবে মাসের বিশেষ একটি দিনে তিনি এ বাড়ির প্রতিটি ঘরের আনাচে কানাচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে পরিদর্শন করেন। এই বিশেষ একটি দিন তার বাড়ি পরিষ্কার করা হয়। গ্রাম থেকে কমলার মাকে খবর দিয়ে আনা হয়। জানালার গ্রিল মোছা হয়। থাই গ্লাস পরিষ্কার করা হয়। ছাদের বাগানের আগাছা ফেলে দেওয়া হয়। পুরো বাড়ি একদম নতুনের মত লাগে। ঝকঝকে তকতকে।

আজকে সেই বিশেষ দিন। রেহনুমা প্রতিটি ঘর পরিদর্শনের পর শিহাবের ঘরে ঢুকলো। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। কোথাও ময়লা ছিটেফোঁটা আছে কিনা। কিন্তু না প্রতিবারের মতোই কমলার মা তাকে হতাশ করেনি।
ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সে হঠাৎ লক্ষ্য করল বিছানার পাশের টেবিলে একটি বই রাখা।
শিহাবের বই পড়ার অভ্যাস নেই। তার অবসর কাটে কার্টুন দেখে। তাহলে কিসের বই রাখা?
মনে কৌতুহল নিয়ে রেহনুমা টি টেবিলের কাছে গেল। অবাক হয়ে দেখল সেখানে বাংলা ব্যাকরণের বই রাখা আছে!
শিহাবের ঘরে বাংলা ব্যাকরণ বই কি করছে তা রেহনুমার বোধগম্য হলো না। তার ছেলের বাংলা শেখার প্রতি কোন আগ্রহ আছে বলে তো কখনো মনে হয়নি। এছাড়া ভাল চাকরি-বাকরি করতে আমাদের দেশে ইংরেজির ব্যাপক প্রসার। ভালো করে দু চারটি ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেই চাকরির বাজারে ব্যাপক ডিমান্ড!
এসব চিন্তা করেই না তিনি ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছেন। এর মাথায় নতুন করে বাংলা শেখার ভূত কবে থেকে চাপল?

আচমকা রেহনুমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। সাথে মাথা চরকির মতো ঘুরতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে, শিহাব বদলে যাচ্ছে। তার মাঝে বেশ কদিন ধরেই পরিবর্তন লক্ষণীয়। কিন্তু কেন?

রেহনুমা ঠিক করলো শিহাব বাড়ি ফিরলে এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলবে।
সে তার ঘরে ফিরে জানালার ভারী পর্দা গুলো টেনে দিলো। দিনের আলো পর্দাগুলো ভেদ করে খুব একটা ঢুকতে পারে না। তাই পুরো ঘরে আবছা আলো আবছা অন্ধকার। রেহনুমা দরজা ভিরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার ক্লান্ত লাগছিল কিন্তু ঘুম এলো না। বারবার একটি কথাই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল,
তার ছেলেটা কি সত্যি পাল্টে যাচ্ছে? যদি পাল্টেও বা যায় তবে তা কার সংস্পর্শে এসে?

সখিপুরের তক্তারচালা এলাকাটি আজ বেশ উত্তাল। সকাল থেকে রাজনৈতিক দুটি দলের মাঝে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে। চলছে ইটপাথর ছোঁড়াছুঁড়ি। ঠিক সেসময়ই অফিসের গাড়ি নিয়ে শিহাব নিয়াজ করিমের ফার্ম হাউজে আসছিল। রাস্তায় কোথা থেকে একটি ইট উড়ে এসে অফিসের গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে সোজা শিহাবের মাথায় লাগলো। ঘটনার আকস্মিকতায় শিহাব বোকা বনে গেলো। খুব গভীর ক্ষত সৃষ্টি না হলেও বেশ রক্তপাত হয়।
ভাগ্যিস ড্রাইভার তুফান গাড়িটা তুফানের গতিতেই দিয়েছিল এক টান! নয়তো আরো চার পাঁচটি ইট পাথর গ্লাস ভেঙ্গে গাড়িতে এসে পড়তো।
বর্ষা বাড়ির সামনে পাটিতে বসে গল্পের বই পড়ছিল। এমন সময় ফারুক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। বর্ষা বিস্মিত স্বরে বলল,
আপনি এভাবে হাঁপাচ্ছেন কেন? আপনার হাঁপানি রোগ আছে নাকি?
ফারুক বলল,
না আপা। হাঁপানি রোগ নাই। শিহাব স্যার আসছেন। কপালে রক্ত। গল গল করে পড়তেছে।
কী বলছেন এসব?
সত্যি বলতেছি। আপনি আসেন আমার সাথে।

বর্ষা ফারুকের সাথে এগিয়ে গেল। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখল শিহাবের অফিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচ ভাঙ্গা। পাশেই হালকা আকাশি রংয়ের ফরমাল শার্টে শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। একটি রুমাল কপালে চেপে রেখেছে। রুমালটি লাল রঙের। ভেজা। সম্ভবত রক্তে ভিজে গেছে। বর্ষাকে দেখে শিহাব হাসার চেষ্টা করে বলল,
বাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স আছে? আসলে অনেক ব্লিডিং হচ্ছে তো।
বর্ষা বলল,
আছে। আসুন আমার সাথে।
শিহাব বর্ষার পিছে পিছে হাঁটতে লাগলো।
বর্ষা বলল,
আজকের দিনটায় এদিকে এসে ভালো করেন নি। সামনে ইলেকশন। এই এলাকা ভালো না। শুনেছি ইলেকশনের আগে দু চারটি লাশও ফেলে দেয়।
শিহাব আঁৎকে উঠলো,
বলেন কি? ডিরেক্ট মার্ডার?
হু। মার্ডার। এর মাঝে আসার কি প্রয়োজন ছিলো?
শিহাব অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
মিস্টার নিয়াজকে রাজী না করাতে পারলে আমার জব চলে যাবে। I don’t want to lose my job. That’s why, I started learning Bangla.

শিহাবের কথা শুনে বর্ষার মায়া লাগলো। মজার ছলে ছেলেটার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও সে খানিকটা চিন্তায় পরে গেলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here